মুফতি আবু আসেম নাবিলযিলহজ

যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর পালনীয় একটি সুন্নাহ : কিছু জিজ্ঞাসার জবাব

যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর পালনীয় একটি সুন্নাহ : কিছু জিজ্ঞাসার জবাব

মুফতি আবু আসেম নাবিল (হাফিযাহুল্লাহ)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على خاتم النبيين، وعلى آله وصحبه أجمعين، و من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين

যিলহজ্ব মাসে ফরয হজ্ব ছাড়াও কুরবানী, আরাফা দিবসের সিয়াম, তাকবীরে তাশরীক ইত্যাদী ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল পর্যায়ের কয়েকটি মৌলিক ইবাদত পালন করতে হয়। এ সকল আমলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত আমল হল, যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা।

যিলহজ্ব মাসের সূচনালগ্নে উক্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের দ্বীনদার মহলে কিছু জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়।  যেমন-

 

১. যারা কুরবানী দিতে ইচ্ছুক, তাদেরকে যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে। (যেমনটা সহীহ মুসলিমের ১৯৭৭ নং হাদীসে এসেছে)

 

২. কিন্তু যারা সামর্থ্য না থাকার কারণে কুরবানী দিতে ইচ্ছুক নয়, তাদের করণীয় কী?

 

৩. আর কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি যদি চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকতে চায়, তাহলে সে কবে থেকে বিরত থাকবে?

 

৪. কুরবানীদাতা তার চুল-নখ ইত্যাদি পরবর্তীতে কখন কাটতে পারবে?

 

৫. নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকার বিধানটা কি ওয়াজিব, নাকি মুস্তাহাব পর্যায়ের?

 

৬. যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকে সাধারণ মুমিনদের জন্য চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা, এটা হাজ্বীদের কর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কি না?

 

যিলহজ্ব মাসের নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার আগে-পরে উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে দ্বীনদার মহলে ব্যাপক জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়। তাই উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা তুলে ধরা হলো-

 

১.    যারা কুরবানী করবে তাদের জন্য যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা সুন্নত।

 

এ বিষয় উম্মে সালামা রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ رَأَى هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ فَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ فَلَا يَأْخُذْ مِنْ شَعْرِهِ وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ حَتَّى يُضَحِّيَ. (هذا لفظ النسائي، و لفظ مسلم “مَنْ كَانَ لَهُ ذِبْحٌ يَذْبَحُهُ فَإِذَا أُهِلَّ هِلَالُ ذِي الْحِجَّةِ، فَلَا يَأْخُذَنَّ مِنْ شَعْرِهِ، وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ شَيْئًا حَتَّى يُضَحِّيَ”). 

যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখবে এবং কুরবানী করার ইচ্ছা করবে, সে যেন কুরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখের কোনো কিছু না কাটে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; সুনানে নাসাঈ ৭/২১১-২১২, তাহকীক- আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.; সুনানে তিরমিযি, হাদীস ১৫২৩; ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।

“فَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ” (যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা করবে) হাদীসে উল্লিখিত এ বাক্য দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, উপরোক্ত বিধান শুধুমাত্র কুরবানী দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য।

 

২.    আর যারা কুরবানী করবে না অর্থাৎ কুরবানী দিতে অক্ষম, তাদের কী করণীয়?

এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাযি. এর সূত্রে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীনি বিষয়ে জানতে এসেছিলেন। জওয়াব নিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আবার ডেকে বললেন,

أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ فَقَالَ الرَّجُلُ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةَ أُنْثَى (و في رواية أحمد: مَنِيحَةَ اِبْنِي) أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ لَا وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.

“আমি কুরবানীর দিনে ঈদ উদযাপন করতে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি। মহান আল্লাহ এই দিনকে এ উম্মাহের জন্য ঈদ হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন। লোকটি  জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি মাদি মানীহা ছাড়া অন্য পশু না পাই (যা আমার নিজ মালিকানাধীন নয়) তাহলে তা দ্বারাই কুরবানী করব কি? তিনি বললেন: না, কিন্তু তুমি ঐ দিন তোমার চুল ও নখ কাটবে, মোচ খাটো করবে এবং নাভীর নীচের পশম মুণ্ডন করবে। এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পরিপূর্ণ কুরবানী।” -শায়খ আহমাদ শাকের রহ. বলেন, বর্ণনাটির সনদ সহীহ। সুনানে নাসাঈ ২/১৭৯, হাদীস ৪৩৭৭, অধ্যায়- বাবু মান লাম্ ইয়াজিদিল্ উদহিয়্যাতা; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯১; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস ৭৫২৯; ইমাম হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭৫, তাহকীক-শায়খ আহমাদ শাকের।

উল্লেখ্য, আরবের লোকেরা দুগ্ধবতী গাভী বা ভেড়া এ শর্তে কাউকে দান করত যে, প্রয়োজনীয় সময় দুধ পানের পর ফেরত দেবে। এই জাতীয় পশুকে ‘মানীহা’ বলা হত। -শরহুন নববী আলা সহীহ মুসলিম, ৭/১০৬

এ হাদীস দ্বারা এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কাটলে সে পূর্ণ কুরবানীর সওয়াব পাবে।

আল্লামা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রহ. এ হাদীসের বাক্য

“فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ”

এর ব্যাখ্যায় বলেন,

“أَيْ أَضْحِيَّتُكَ تَامَّةٌ بِنِيَّتِكَ الْخَالِصَةِ وَ لَكَ بِذَلِكَ مِثْلُ ثَوَابِ الْأُضْحِيَّةِ”

অর্থাৎ একনিষ্ঠ নিয়তের কারণে, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিধান অনুযায়ী কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তির কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কাটা) এটা পূর্ণাঙ্গ কুরবানীর অনুরূপ বলে বিবেচিত হবে এবং এর দ্বারা সে কুরবানীর মতো সওয়াব পাবে। -বযলুল মাজহুদ: ৯/৫৩৩, হাদীস ২৭৮৯

আবুল হাসান সিন্দী রহ. “وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ …”  অংশের ব্যাখ্যায় বলেন,

“كَأَنَّهُ أَرْشَدَهُ إِلَى أَنْ يُّشَارِكَ الْمُسْلِمِيْنَ فِيْ الْعِيْدِ وَالسُّرُوْرِ وَ إِزَالَةِ الْوَسْخِ فَذَاكَ يَكْفِيْهِ إِذَا لَمْ يَجِدِ الْأُضْحِيَّةَ.”

অর্থাৎ উক্ত ব্যক্তির প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা এমন ছিল যে, সে মুসলিমদের সাথে ঈদের আনন্দে অংশ নেবে এবং পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করবে; আর কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য না থাকা অবস্থায় এটাই তার জন্য যথেষ্ট হবে। – সুনানে নাসাঈ ২/১৭৯, হাদীস ৪৩৭৭ এর টীকা।

 

৩.    তবে কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি কবে থেকে চুল, নখ প্রভৃতি কাটা থেকে বিরত থাকবে?

এ ব্যাপারে হাদীসে কিছুই বলা হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কুরবানীর সওয়াব পাওয়ার জন্য কুরবানী দিতে সক্ষম ব্যক্তির মতো যিলহজ্ব মাসের শুরু থেকে এগুলো কর্তন থেকে বিরত থাকতে হবে কি না, এ সংক্রান্ত কোনো শর্তও হাদীসে উল্লেখ নেই। বরং হাদীসে শর্তহীন ও সাধারণভাবে কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কর্তন করতে বলা হয়েছে।

 

উপরিউক্ত পর্যালোচনা থেকে এটা প্রতিভাত হয় যে, কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তির জন্য যিলহজ্ব মাসের শুরু থেকে চুল, নখ প্রভৃতি কাটা থেকে বিরত থাকা শর্ত নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ কুরবানীর সওয়াব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শুধু কুরবানীর দিনে এগুলো কাটলে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে। উপরে উল্লিখিত সিন্দী রহ.-এর কথা থেকেও এমনটি ফুটে ওঠে। মহান আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।

কোনো কোনো বইতে শর্তযুক্ত করে এভাবে বলা হয়েছে, ‘কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি যদি কুরবানীর ঈদের চাঁদ ওঠার আগ থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত এগুলো কাটা থেকে বিরত থাকে, তবে সেও পূর্ণ একটি কুরবানীর সওয়াব পাবে।’ -যেমন: ফয়যুল কালাম, ২৪৭ পৃষ্ঠা, অনু: মাওলানা মুহাম্মাদ খালিদ সাইফুল্লাহ, মাকতাবায়ে এমদাদিয়া- ঢাকা। ‘ফয়যুল কালাম’ এর ঊর্দূ শরাহ ‘ফাতহুল মারাম’ এর ৩০৩ পৃষ্ঠা, মুফতী ইজহারুল ইসলাম, কুতুবখানা ফাইযিয়া, হাটহাজারী- চট্টগ্রাম।

উক্ত বইটিতে এ কথার স্বপক্ষে কোনো দলিল পেশ করা হয়নি; আর আমরাও তালাশ করে এ সংক্রান্ত কোনো বর্ণনা খুঁজে পাইনি।

 

৪.    কুরবানীদাতা তার চুল-নখ ইত্যাদি পরবর্তীতে কখন কাটতে পারবে?

উল্লিখিত প্রথম হাদীস থেকে এটা বুঝে আসে যে, কুরবানীদাতা চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত চুল, নখ প্রভৃতি কাটবে না। বরং কুরবানী করার পর কাটবে। হাদীসটির মূল বক্তব্য নিম্নরূপ-

“مَنْ رَأَى هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ فَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ فَلَا يَأْخُذْ مِنْ شَعْرِهِ وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ حَتَّى يُضَحِّيَ”

যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখবে এবং কুরবানী করার মনস্থ করবে, সে যেন তার চুল ও নখের কোনো কিছু না কাটে।

কুরবানী করার পরপর কাটার বিষয়টি উপরে উল্লিখিত দ্বিতীয় হাদীস থেকে আরো স্পষ্ট হয়। সেখানে বলা হয়েছে, কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কাটলে সে পূর্ণ কুরবানীর সওয়াব পাবে। হাদীসটি হল-

أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةَ أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ لَا وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.

“(হে আল্লাহর রাসূল!) আমি যদি মাদি মানীহা ছাড়া অন্য পশু না পাই (যা আমার নিজ মালিকানাধীন নয়) তাহলে তা দ্বারাই কুরবানী করব কি? তিনি বললেন: না, কিন্তু তুমি ঐ দিন তোমার চুল ও নখ কাটবে, মোচ খাটো করবে এবং নাভীর নীচের পশম মুণ্ডন করবে। এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পরিপূর্ণ কুরবানী।”

ইবনে উমর রাযি. এর আমল দ্বারাও বুঝা যায় যে, কুরবানী করার পরপরই কাটা উত্তম।

عَنْ نَافِع، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ، أَنَّهُ ضَحَّى مَرَّةً بِالْمَدِينَةِ فَأَمَرَنِي أَنْ أَشْتَرِيَ لَهُ كَبْشًا فَحِيلا أَقْرَنَ، ثُمَّ أَذْبَحَهُ لَهُ يَوْمَ الأَضْحَى فِي مُصَلَّى النَّاسِ فَفَعَلْتُ، ثُمَّ حُمِلَ إِلَيْهِ، فَحَلَقَ رَأْسَهُ حِينَ ذُبِحَ كَبْشُهُ، وَكَانَ مَرِيضًا لَمْ يَشْهَدِ الْعِيدَ مَعَ النَّاسِ، قَالَ نَافِعٌ: وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ يَقُولُ: لَيْسَ حِلاقُ الرَّأْسِ بِوَاجِبٍ عَلَى مَنْ ضَحَّى إِذَا لَمْ يَحُجَّ ، وَقَدْ فَعَلَهُ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ .

“নাফে রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ইবনে উমর রাযি. মদীনায় অবস্থানকালে একবার কুরবানী করেছিলেন। তিনি আমাকে আদেশ করেছিলেন যে, আমি যেন তাঁর জন্য একটি শিংবিশিষ্ট মর্দা মেষ ক্রয় করি এবং ঈদুল আযহার দিনে তা কুরবানী করি। আমি (তার নির্দেশ মোতাবেক) তা-ই করলাম। তারপর তা তাঁর নিকট নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর (মেষ কুরবানী করা হলে) তিনি তাঁর মাথা মুণ্ডন করলেন। আর তিনি অসুস্থ ছিলেন, বিধায় মানুষদের সাথে ঈদে (ঈদগাহে) উপস্থিত হতে পারেননি। নাফে রহ. বলেন, ইবনে উমর রাযি. বলতেন, কুরবানীদাতার উপর মাথা মুণ্ডন করা ওয়াজিব নয়, যদি সে হজ্জ না করে। অথচ ইবনে উমর রাযি. সেটাই করেছেন। -মুয়াত্তা মালিক, হাদীস ১৭৬৩; মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, হাদীস ৬৩১, পৃ. ২৮০ (كِتَابُ الضَّحَايَا وَمَا يُجْزِئُ مِنْهَا.)

যদিও এখানে ইবনে উমর রাযি. এর মাথা মুণ্ডন করার বিষয় এসেছে। তবে উক্ত দুটি হাদীস এবং এ ঘটনা থেকে কুরবানী করার পরপরই চুল, নখ প্রভৃতি কাটা উত্তম, এমন নির্দেশানা পাওয়া যায়।

 

৫.    নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকার বিধানটা কি ওয়াজিব, না কি মুস্তাহাব পর্যায়ের?

চুল, নখ প্রভৃতি কাটা থেকে বিরত থাকার বিধানটি মুস্তাহাব পর্যায়ের, ওয়াজিব বা আবশ্যক নয়। এ ব্যাপারে কতিপয় ফকীহের মতামত নিম্নরূপ:

ক) আবু বকর বিন আব্দুর রহমান বিন হারিস বিন হিশাম (মৃত্যু ৯৪ হি.)।  খ) আতা বিন ইয়াসার (মৃত্যু ১০৩ হি.)। গ) আবু বকর বিন সুলাইমান (মৃত্যু ৯১-১০০ হি.) রহ. প্রমুখ তাবেঈগণ থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন,

لاَ بَأْسَ أَنْ يَأْخُذَ الرَّجُلُ مِنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ فِي الْعَشْر. 

“কোনো ব্যক্তি যদি যিলহজ্বের প্রথম দশকে চুল ও নখ কর্তন করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৫০০৫

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন,

…وَأَمَّا الْحِلاقُ فَنَقُولُ فِيهِ بِقَوْلِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ: إِنَّهُ لَيْسَ بِوَاجِبٍ عَلَى مَنْ لَمْ يَحُجَّ فِي يَوْمِ النَّحْرِ، وَهُوَ قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ، وَالْعَامَّةِ مِنْ فُقَهَائِنَا. 

“মাথা মুণ্ডনের ক্ষেত্রে আমরা ইবনে উমর রাযি. এর মতো মত পোষণ করি, অর্থাৎ হাজ্ব পালনরত নয়- এমন ব্যক্তির উপর কুরবানীর দিনে মাথা মুণ্ডন করা ওয়াজিব হবে না। এটা ইমাম আবু হানীফা রহ. এবং অধিকাংশ ফকীহের মাযহাব। -মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, পৃষ্ঠা ২৮০ (৬৩১) (كِتَابُ الضَّحَايَا وَمَا يُجْزِئُ مِنْهَا.)

 

৬.    যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকে সাধারণ মুমিনদের জন্য চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা, এটা হাজ্বীদের কর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কি না?

বাহ্যত, এটা হাজ্বীদের নির্দিষ্ট একটি কর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কোনো কোনো আলেম এ সাদৃশ্যের তাৎপর্য এভাবে তুলে ধরেছেন-

“আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলোতে হজ্বের মতো গুরুত¦পূর্ণ একটি ইবাদত মুসলমানদের ওপর ফরজ করেছেন। সামর্থ্যবান ব্যক্তিগণ এই দিনে ইহরামের পোশাক পরিধান করে যখন বাইতুল্লাহ অভিমুখী হন, তখন তাদের উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। তন্মধ্যে চুল ও নখ কাটতে না পারাও একটি। কিন্তু বাইতুল্লাহ যেয়ারতের সৌভাগ্য যারা অর্জন করতে পারেনি, পৃথিবীর দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব মুমিনদের প্রতিও আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানীকে আকৃষ্ট করতে আদেশ করা হয়েছে যে, তোমরা হাজ্বীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো। তোমরাও চুল-নখ কেটো না। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহর রহমতের বারিধারা তোমাদেরও সিক্ত করবে।” (সংক্ষেপিত) -ইসলাহী খুতুবাত, কুতুবখানা নাইমিয়্যা, দেওবন্দ, ২/১১১-১১২

অবশ্য সাদৃশ্যের বিষয় সংক্রান্ত কোনো হাদীস (বা সাহাবা-তাবেঈন থেকে কোনো বর্ণনা) আমরা পাইনি। মহান আল্লাহই অধিক অবগত।

উল্লেখ্য, হজ্বের সাথে সাদৃশ্য সংক্রান্ত কোনো বর্ণনা পাওয়া যাক অথবা না যাক, যেহেতু সহীহ হাদীসে এসেছে ‘উক্ত সময় কুরবানীদাতা নখ-চুল প্রভৃতি কাটা থেকে বিরত থাকবে’, তাই তার জন্য এ সময় এগুলো না কাটা মুস্তাহাব।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা উক্ত সুন্নাহসহ অন্যান্য সুন্নাহ আমাদেরকে নিজেদের জীবনে ধারণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমিন

وصلى الله على سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وصحبه وسلم

১৮ যিলক্বদ, ১৪৪১ হিজরী

১০ জুলাই, ২০২০ ঈসায়ী।

 

 

গ্রন্থপঞ্জি

১.    মুয়াত্তা মালিক, ইমাম মালিক (১৭৯ হি.) আশরাফী বুক ডিপো, দেওবন্দ, সাহারানপুর, ভারত।

২.    মুয়াত্তা, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানী (১৮৯হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।

৩.    মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, আব্দুল্লাহ ইবনে আবি শাইবা (২৩৫হি.), (তাহকীক: শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ), দারুল মিনহাজ, জিদ্দাহ, ১ম সংস্করণ, ২০০৬ খ্রি.।

৪.    মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (২৪১হি.) তাহকীক: আহমাদ শাকের, দারুল মা’আরিফ, মিশর।

৫.    মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (২৪১হি.) তাহকীক, শায়খ শুআইব আল-আরনাউত।

৬.    সহীহ মুসলিম, ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬১হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।

৭.    সুনানে আবু দাউদ, ইমাম আবু দাউদ আস-সিজিসতানী (২৭৫হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।

৮.    সুনানে তিরমিযি, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিযি (২৭৯ হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।

৯.    সুনানে নাসায়ী, ইমাম নাসায়ী (৩০৩হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।

১০.   আল-মুসতাদরাক, আবু আব্দুল্লাহ হাকেম (৪০৫ হি.), দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, ১৯৯০ খ্রি.।

১১.   শরহে সহীহ মুসলিম,  ইমাম নববী (৬৭৬ হি.), দারুল ফিকর।

১২.   বাযলুল মাজহূদ, খলীল আহমাদ সাহারানপুরী, মারকাযুশ শাইখ আবুল হাসান নদভী, ভারত।

১৩.   ফয়যুল কালাম, পৃষ্ঠা ২৪৩-২৪৬, লেখক: মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ., অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মাদ খালিদ সাইফুল্লাহ, মাকতাবায়ে এমদাদিয়া, ঢাকা।

১৪.   ‘ফয়যুল কালাম’ এর উর্দূ শরাহ ‘ফাতহুল মারাম’ এর ৩০৩ পৃষ্ঠা, মুফতী ইজহারুল ইসলাম, কুতুবখানা ফাইযিয়া, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

১৫.   ইসলাহী খুতুবাত, ত্বাকী উসমানী, কুতুবখানা নাইমিয়্যা, দেওবন্দ, ভারত।

Back to top button