সুদ-ঘুষফাতওয়া  নং  ২১৬

ব্যাংক থেকে সুদি ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার হুকুম?

ব্যাংক থেকে সুদি ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার হুকুম কী?

ব্যাংক থেকে সুদি ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার হুকুম কী?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্নঃ

আমি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি। আর আপনি অবশ্যই অবগত আছেন যে, বর্তমানে প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক কর্তৃক সুদ নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে-

১. উক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এবং সেখান থেকে বেতন গ্রহণ করার হুকুম কী?

২. এ সকল প্রতিষ্ঠানে ওপরের দিকে থাকা কর্মকর্তাগণ অধিকাংশই নৈতিকতামুক্ত। তাদের কোন শরীয়ত বিরোধী হুকুম কি মানা যাবে? যখন আমার ও পরিবারের চলার মত এই চাকরিই একমাত্র অবলম্বন।

প্রশ্নকারী- আব্দুর রহমান

উত্তরঃ

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله وحده والصلاة والسلام على من لا نبي بعده أما بعد

১. আপনি যদিও বলেছেন, ‘বর্তমানে প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক কর্তৃক সুদ নির্ভরশীল’, যার অর্থ দাঁড়ায়, তারা ব্যাংক থেকে সুদ নিয়ে চলে, কিন্তু বাস্তব বিষয়টি এমন নয়। বাস্তবতা হচ্ছে তারা ব্যাংক থেকে সুদ গ্রহণ করে না; বরং ব্যাংক থেকে সুদি ঋণ গ্রহণ করে উক্ত ঋণের অর্থ দিয়ে ব্যবসা করে এবং ঋণের বিনিময় ব্যাংককে সুদ প্রদান করে। আপনি সম্ভবত এটিই বলতে চেয়েছেন।

সুদ গ্রহণ করা যেমন নাজায়িয, তেমনি সুদ প্রদান করাও নাজায়িয। সুতরাং কোন প্রতিষ্ঠান যদি ব্যাংক থেকে সুদের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে এটা নাজায়িয হবে এবং একারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা গুনাহগার হবে। তবে তারা যেহেতু সুদ নিচ্ছে না; বরং ঋণ নিচ্ছে, তাই উক্ত ঋণের অর্থ তাদের জন্য হালাল হবে। অতএব আপনি যদি এমন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, যারা নিজেরা কারও থেকে সুদ নেয় না, বরং সুদি ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে, তাহলে আপনার জন্য উক্ত চাকরি দু’টি শর্তে জায়িয হবে;

এক. তারা ব্যাংকের সঙ্গে যে সুদি ঋণের লেনদেন করে, সেই লেনদেনের সঙ্গে আপনার কোন সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবেন না।

দুই. প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রম শরীয়াহ সম্মত হতে হবে।

পক্ষান্তরে যদি আপনাকে ব্যাংকের সঙ্গে কৃত সুদি লেনদেনে জড়িত হতে হয় কিংবা শরীয়াহ বিরোধী অন্য কোন কাজ করতে হয়, তাহলে আপনার জন্য উক্ত চাকরি করা জায়িয হবে না।

একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি যদি সুদি অর্থ উপার্জনে জড়িত থাকে এবং আপনার বেতন সরাসরি সুদের অর্থ বা অন্য কোন হারাম সম্পদ থেকে দেয়, তাহলে উক্ত বেতনও আপনার জন্য হালাল হবে না।

জাবির (রা) থেকে বর্ণিত-

لعن رسول الله صلى الله عليه وسلم آكل الربا وموكله وكاتبه وشاهديه وقال هم سواء. -صحيح مسلم، رقم: 4177

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদগ্রহীতা, সুদ দাতা, সুদি লেন-দেনের লেখক ও তার স্বাক্ষীদ্বয়; সকলের ওপর লা’নত করেন এবং বলেন, এরা সকলেই সমান।” (সহীহ মুসলিম: ৪১৭৭

এ ক্ষেত্রে আপনার কর্তব্য হবে, অন্যকোন বৈধ উপার্জনের পথ খোঁজা এবং উক্ত চাকরি ছেড়ে দেয়া।

কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-

}وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا (3)} [الطلاق: 2، 3[

“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পথ খুলে দেন এবং তাকে এমনভাবে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করে না। যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হন। আল্লাহ তাঁর বিষয় পূর্ণ করেই ছাড়েন। সবকিছুর জন্যই তিনি একটি সীমা নির্ধারিত করেছেন।” (সূরা তালাক: ২-৩)

ইমাম বাইহাকী (র) বর্ণনা করেন-

832-  أَخْبَرَنَا أَبُو طَاهِرٍ الْفَقِيهُ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حَمْشَاذٍ، حَدَّثَنَا الْحَارِثُ بْنُ أَبِي أُسَامَةَ، حَدَّثَنَا أَبُو النَّضْرِ، حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ الْمُغِيرَةِ، عَنْ حُمَيْدٍ، حَدَّثَنَا أَبُو قَتَادَةَ، وَأَبُو الدَّهْمَاءِ، قَالا : أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ ، فَقَالَ الْبَدَوِيُّ : أَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِيَدِي، فَجَعَلَ يُعَلِّمُنِي مِمَّا عَلَّمَهُ اللَّهُ، وَكَانَ يَقُولُ : إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءً لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ أَعْطَاكَ اللَّهُ خَيْرًا مِنْهُ. الآداب للبيهقي: 2/ 8، بترقيم الشاملة آليا

“… আবু কাতাদা ও আবুদ দাহমা (রা) বলেন, আমরা এক বেদুঈন (সাহাবী)-এর নিকট গেলাম। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরেন এবং আল্লাহ তাঁকে যা শিখান, তা থেকে আমাকে শেখাতে লাগলেন। তিনি বলেন, তুমি আল্লাহর ভয়ে যে কোন বিষয় পরিহার করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন।” (আলআদাব, বাইহাকী: ২/৮)

আরও দেখুন: (রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৮৫-৩৮৬, ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ৫/৩৪২, ফাতাওয়া রহিমিয়া: ৯/২৮৯, ফাতাওয়া উসমানী: ৩/৩৬২-৩৬৩)

উল্লেখ্য, আপনার কোম্পানি ব্যাংকের সঙ্গে সুদি কারবারে জড়িত, আপনি প্রশ্নে শুধু এতটুকুই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোম্পানিটি ঠিক কীভাবে আয় করে, কী ব্যবসা করে, তার কোন বিবরণ আপনি দেননি। আপনার কাছে যদিও মনে হচ্ছে, তারা সুদি ঋণ নেয়া ব্যতীত অন্য কোন শরীয়াহ বিরোধী কাজে জড়িত নয়, কিন্তু বাস্তবতা এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। এখন ব্যাপকভাবেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন হারামে জড়িত থাকে। তাই কোম্পানির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বিজ্ঞ কোন মুফতি সাহেব থেকে বিষয়টি জেনে নিলে ভাল হবে।

২. গুনাহ এবং আল্লাহ তা‌‌’আলার অবাধ্যতাকে অবধারিত করে, এমন যেকোন হুকুম, তা যার পক্ষ থেকেই হোক, মান্য করা সম্পূর্ণ হারাম। বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা শিরক পর্যন্তও গড়াতে পারে। হাদীসে এসেছে-

عن علي، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «لا طاعة لبشر في معصية الله». –صحيح البخاري (7257) صحيح مسلم (1840) مصنف ابن أبي شيبة (34998( واللفظ له.

“আলী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‌’আলার অবাধ্য হয়ে কোন মানুষের আনুগত্য করা যাবে না।” (সহীহ বুখারী: ৭২৫৭; সহীহ মুসলিম: ১৮৪০; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা: ৩৪৯৯৮)

উমারাহ (র) বলেন-

نزل معضد إلى جنب شجرة، فقال: ما أبالي أطعت رجلا في معصية الله، أو سجدت لهذه الشجرة من دون الله. -مصنف ابن أبي شيبة:34403

(বিশিষ্ট তাবিঈ) মি’দাদ (র) একটি গাছের পাশে অবতরণ করেন। অত:পর তিনি বলেন, আল্লাহর অবাধ্য হয়ে কোন মানুষের আনুগত্য করা, আর আল্লাহর পরিবর্তে এই গাছকে সিজদা করা আমার নিকট বরাবর।(মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা: ৩৪৪০৩)

যদি এমন শরীয়ত বিরোধী আদেশ মানা ব্যতীত উক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সম্ভবপর না হয়, তবে আপনার জন্য এই চাকরি করা জায়িয হবে না। আপনার কর্তব্য হবে, অন্য কোন বৈধ উপার্জনের পথ খুঁজে নেয়া এবং উক্ত চাকরি ছেড়ে দেয়া। আপাতত এই চাকরি আপনার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হলেও; আল্লাহর ভয়ে তা ছেড়ে দিলে তিনি আপনার জন্য এরচেয়ে উত্তম জীবিকার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে ওয়াদা আছে, যেমনটি প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতিতে আমরা আলোচনা করেছি।

উল্লেখ্য, কর্তৃপক্ষ কাজের সুবিধার্থে কাজের সময় সুন্নত মুস্তাহাব পর্যায়ের ‘আমাল করতে বারণ করলে, সেটাকেও কেউ কেউ শরীয়ত বিরোধী নির্দেশ মনে করেন। এটা ঠিক নয়। দায়িত্ব পালনের সময় কর্মীকে এমন নির্দেশ দেয়ার এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের আছে এবং এই নির্দেশ মান্য করাও কর্মীর জন্য জরুরি। এটা শরীয়ত পরিপন্থি নির্দেশ নয়। বরং কারও সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় দেয়ার ওপর পারিশ্রমিকের চুক্তি হলে, কাজের ক্ষতি করে সেই সময় নফল ইবাদতে ব্যয় করা জায়িয নয়।

فقط، والله تعالى أعلم بالصواب.

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

২৩-০৪-১৪৪৩ হি.

২৯-১১-২০২১ ঈ.

আরও পড়ুনঃ দুই দেশের মুদ্রা বিনিময় করা কি বৈধ?

Related Articles

Back to top button