তাকফীরমাওলানা আব্দুল্লাহ রাশেদ

আকীদা ঠিক থাকলে কোনো কাজের কারণে কি কেউ কাফের হবে না?

আকীদা ঠিক থাকলে কোনো কাজের কারণে কি কেউ কাফের হবে না?

শায়খ আবদুল্লাহ রাশেদ হাফিযাহুল্লাহ

 

সংশয়ঃ কারো কাজ কখনো কুফর হবে না। অন্তরের আকীদা বিশ্বাস ঠিক থাকলে কোনো কাজের কারণে কেউ কখনো কাফের হবে না। কাফের হওয়ার জন্য ‘ইস্তিহলাল–الاستحلال’ তথা হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল মনে করা কিংবা ‘জুহুদ–الجحود’ তথা শরীয়তের অকাট্য কোনো বিষয়কে অস্বীকার করা শর্ত।

 

সংশয় নিরসন

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

এ ভুল ধারণাটি অনেক উলামা-তলাবার মাঝে বিদ্যমান। তারা কুফর বলতে অন্তরের বিশ্বাস বুঝেন। মনে করেন, অন্তরের বিশ্বাস যদি ঠিক থাকে তাহলে আমলের দ্বারা কেউ কাফের হয় না।

ইমাম তাহাবী রহ. (৩২১হি.) -এর দুটি বক্তব্য থেকে অনেকে এ সংশয়টিতে পড়েন। বক্তব্য দুটি হলো:

এক.

وَلَا نُكَفِّرُ أَحَدًا مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ، مَا لَمْ يَسْتَحِلَّهُ. -العقيدة الطحاوية (ص: 15)

আহলে কিবলা (তথা কোনো মুসলিমকে) আমরা কোনো গুনাহের কারণে কাফের বলি না, যতক্ষণ না সে তা হালাল মনে করে। আকীদাতুত তাহাবী: ১৫

বাহ্যত এ থেকে বুঝা যায়, হালাল মনে না করলে যত রকমের নাফরমানিই করুক কাফের হবে না।

দুই.

وَلَا يَخْرُجُ الْعَبْدُ مِنَ الْإِيمَانِ إِلَّا بِجُحُودِ مَا أَدْخَلَهُ فِيهِ. -العقيدة الطحاوية (ص: 17)

যেসব বিষয় মেনে নেয়ার দ্বারা বান্দা ঈমানদার হয়েছে, সেগুলোর কোনো কিছু অস্বীকার করা ছাড়া সে কাফের হবে না। আকীদাতুত তাহাবী: ১৭

বাহ্যত এ থেকে বুঝা যায়, কোনো ব্যক্তি ঈমানদার হওয়ার পর শরীয়তের অকাট্য কোনো বিষয় অস্বীকার না করলে কাফের হবে না; যত রকমের নাফরমানিই করুক না কেন।

আসলে তাহাবী রহ. এখানে খাওয়ারেজ ও মুতাজিলাদের খণ্ডন করেছেন। তাদের আকীদা হলো, কোনো মুসলিম কবীরা গুনাহে লিপ্ত হলে কাফের হয়ে যায়। যেমন যিনা, চুরি, মদপান, অন্যায়ভাবে মুসলিম হত্যা ইত্যাদি। তাদের মতে কোনো মুসলিম এগুলোতে লিপ্ত হলেই কাফের হয়ে যাবে। ইমাম তাহাবী রহ. তাদের এ ভ্রান্ত আকীদা খণ্ডন করেছেন যে, এ ধারণা সঠিক নয়। এ ধরনের গুনাহের কাজে শুধু লিপ্ত হলেই কাফের হয়ে যাবে না। যদি হালাল মনে না করে এবং ইসলামের বিধানটি অস্বীকারও না করে, তাহলে শুধু লিপ্ত হলেই কাফের হবে না।

আকীদায়ে তাহাবীয়ার বিখ্যাত ভাষ্যকার ইবনে আবিল ইয হানাফী রহ. (৭৯২হি.) বলেন,

يشير الشيخ إلى الرد على الخوارج والمعتزلة في قولهم بخروجه من الإيمان بارتكاب الكبيرة. -شرح الطحاوية في العقيدة السلفية لابن أبي العز الحنفي (2/ 275)

শায়খ (তাহাবী রহ.) খাওয়ারেজ ও মুতাজিলাদের খণ্ডনের প্রতি ইঙ্গিত করছেন, যারা বলে যে, কবীরা গুনাহে লিপ্ত হলেই বান্দা ঈমান থেকে বের হয়ে যাবে। শরহে ইবনে আবিল ইয: /২৭৫

পক্ষান্তরে শরীয়তের দলীলের আলোকে কোনো কথা বা কাজ যদি স্বয়ং নিজেই কুফর প্রমাণিত হয় তাহলে উক্ত কথা বলার দ্বারাই বা উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার দ্বারাই ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে। হালাল মনে করার বা অস্বীকার করার দরকার পড়বে না। যেমন আল্লাহ বা তাঁর কোনো নবী রাসূলকে নিয়ে কটূক্তি করা। স্বয়ং এ কাজটিই কুফর। কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে নিয়ে বা তাঁর কোনো নবী বা রাসূলকে নিয়ে কটূক্তি করলেই কাফের হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে এটি দেখার দরকার নেই যে, সে উক্ত কটূক্তি হালাল মনে করেছে কি না।

তাবুক অভিযানের সময় পথিমধ্যে কিছু লোক রাসূল ﷺ কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপে লিপ্ত হয় এবং বিভিন্ন সমালোচনামূলক কথা বলে। জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, রাস্তা চলতে চলতে কৌতুকবশত এবং সময় কাটানোর জন্য আমরা এগুলো বলেছিলাম। এগুলো আমাদের মনের কথা না। এতদসত্ত্বেও এসব কথার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের কাফের আখ্যায়িত করে আয়াত নাযিল করেন। ইরশাদ করেন,

{يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوا إِنَّ اللَّهَ مُخْرِجٌ مَا تَحْذَرُونَ (64) وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (65) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ (66)} [التوبة: 64 – 66]

৬৪) ‘‘মুনাফেকরা এ ব্যাপারে ভয় করে যে, মুসলমানদের উপর না এমন কোনো সূরা নাযিল হয়, যাতে তাদের অন্তরের গোপন বিষয় অবহিত করা হবে। আপনি বলে দিন, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে থাক; আল্লাহ্ তা অবশ্যই প্রকাশ করবেন যার ব্যাপারে তোমরা ভয় করছ।

৬৫) আপনি যদি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেন, তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলে?

৬৬) ছলনা কর না, তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ ঈমান আনার পর। তোমাদের মধ্যে (তাওবা করার কারণে) কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেইও, তবে কিছু লোককে অবশ্য (যারা তাওবা করেনি) আযাবও দেব। কারণ, তারা অপরাধী।” সূরা তাওবা (০৯) : ৬৪৬৬

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮হি.) বলেন,

دل على أنهم لم يكونوا عند أنفسهم قد أتوا كفرا بل ظنوا أن ذلك ليس بكفر فبين أن الاستهزاء بالله وآياته ورسوله كفر يكفر به صاحبه بعد إيمانه فدل على أنه كان عندهم إيمان ضعيف ففعلوا هذا المحرم الذي عرفوا أنه محرم ولكن لم يظنوه كفرا وكان كفرا كفروا به فإنهم لم يعتقدوا جوازه. مجموع الفتاوى (7/ 273)

আল্লাহ তাআলার উক্ত বাণী প্রমাণ করছে, তাদের ধারণা ছিল, কুফরী কোনো কাজ তারা করেনি। বরং তারা মনে করেছিল, এসব কথাবার্তা কুফর নয়। তখন আল্লাহ তাআলা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন: আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করা কুফর। ঈমান আনার পর কোনো ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হলে কাফের হয়ে যাবে। এ থেকে বুঝা যায়, তারা দুর্বল ঈমানের লোক ছিল। এরপর তারা এ হারামটিতে লিপ্ত হয় যেটিকে তারা হারাম বলে তো জানতো কিন্তু এমনটা মনে করিনি যে, তা কুফর। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল কুফর এবং এর দ্বারা তারা কাফের হয়ে যায়। কেননা, তাদের বিশ্বাস এমনটা ছিল না যে, তাদের এ কর্ম জায়েয। মাজমুউল ফাতাওয়া: /২৭৩

দেখার বিষয় যে, তারা এ ঠাট্টা-বিদ্রূপ শুধু কৌতুকবশত করেছিল। একে তারা হালাল মনে করেও করেনি। তারা একে একটি মন্দ কাজই মনে করত। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাদের কাফের আখ্যায়িত করেছেন। বুঝা গেল, আল্লাহ, আল্লাহর আয়াত ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও সমালোচনা বা কটূক্তি করা সরাসরি কুফর। এটি হালাল মনে করে করার দরকার নেই; যেকোনোভাবে করলেই কাফের হয়ে যাবে। এমনকি গালি দেয়া বা অবমাননা করা উদ্দেশ্য না থাকলেও কাফের হয়ে যাবে।

ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮হি.) বলেন,

وهذا نص في أن الاستهزاء بالله وبآياته وبرسوله كفر فالسب المقصود بطريق الأولى وقد دلت هذه الآية على أن كل من تنقص رسول الله صلى الله عليه وسلم جادا أو هازلا فقد كفر. الصارم المسلول على شاتم الرسول (ص: 31)

আয়াতে কারীমায় সুস্পষ্ট ভাষ্য যে, আল্লাহ, তাঁর আয়াত বা তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফর। কাজেই গালি –যেটি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি- সেটি তো এর আগেই কুফর হবে। আয়াতে কারীমায় এও বুঝাচ্ছে যে, যে ব্যক্তিই রাসূল ﷺ -এর অবমাননা করবে, অবমাননার উদ্দেশ্যে করুক বা কথায় কথায় এসে গিয়ে থাকুক- সর্বাবস্থায় কাফের হয়ে যাবে। আসসারিমুল মাসলুল: ৩১

একই ধরনের আলোচনা এসেছে অন্য আয়াতেও। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সালুল এক যুদ্ধে রাসূল ﷺ -এর শানে কটূক্তি করে। পরে জিজ্ঞেস করা হলে অস্বীকার করে। তখন এ আয়াত নাযিল হয়,

{يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ مَا قَالُوا وَلَقَدْ قَالُوا كَلِمَةَ الْكُفْرِ وَكَفَرُوا بَعْدَ إِسْلَامِهِمْ } [التوبة: 74]

“তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলে যে, তারা (অমুক কথাটি) বলেনি; অথচ নিঃসন্দেহে তারা কুফরী বাক্য বলেছে এবং মুসলমান হবার পর কাফের হয়ে গেছে।” সূরা তাওবা (০৯) : ৭৪

একই বিষয়ের বিবরণ এসেছে নিম্নোক্ত আয়াতেও,

مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (106) النحل

“যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত যে কেউ ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরী করে এবং কুফরীর জন্য মন উন্মুক্ত করে দেয়, তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তাদের জন্যে রয়েছে মহাশাস্তি।“ সূরা নাহল (১৬) : ১০৬

অর্থাৎ যে ব্যক্তি মুখে কোনো কুফরী কথা বলবে সে কাফের হয়ে যাবে। তবে কাউকে যদি জানের ভয় দেখিয়ে কুফরী কথা বলতে বাধ্য করা হয়, আর সে অন্তরে ঈমান বহাল রেখে জান বাঁচানোর জন্য শুধু মুখে মুখে কুফরী কথা উচ্চারণ করে, তাহলে সে কাফের হবে না। কিন্তু এ হালতেও যদি কেউ মন থেকে কুফরী কথা বলে তাহলে সেও কাফের হয়ে যাবে। (আসসারিমুল মাসলুল: ৫২৪)

উপর্যুক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা গেল, কিছু আমল এমন আছে যেগুলো নিজেই কুফর। এগুলো যিনা, মদপান, চুরি ইত্যাদির মত গুনাহ নয় যেগুলো করলে কাফের হওয়ার জন্য ইস্তিহলাল বা জুহুদ শর্ত। বরং এগুলো নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ কুফর, যা করলেই কাফের হয়ে যায়।

এ কারণে আপনি যদি ফিকহের কিতাব থেকে (বিশেষত ফিকহে হানাফী) বাবুল মুরতাদ অধ্যয়ন করেন, দেখতে পাবেন, ফুকাহায়ে কেরাম অনেক কথা ও কাজের ব্যাপারে বলেছেন, এগুলো বললেই বা করলেই কাফের হয়ে যাবে। ইস্তিহলাল বা জুহুদের কোন শর্ত করা হয়নি। এমন ধরনের কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরছি,

এক.

وقد حقق في المسايرة أنه لا بد في حقيقة الإيمان من عدم ما يدل على الاستخفاف من قول أو فعل.اهـ

(মুহাক্কিক ইবনুল হুমাম রহ. তাঁর) ‘আল-মুসায়ারাহ্’ কিতাবে বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছেন যে, ঈমান সহীহ হওয়ার জন্য অবমাননা বুঝায় মত কোনো কথা বা কাজ না পাওয়া যাওয়া অত্যাবশ্যক। ফাতাওয়া শামী: /৩৫৫

অর্থাৎ আল্লাহ, আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা দ্বীনের অবমাননা বুঝায় মত কোনো কথা বললে বা কাজ করলে আর ঈমান থাকবে না। সামনের বক্তব্যে এটি আরও স্পষ্ট করা হয়েছে,

দুই.

 (قوله من هزل بلفظ كفر )أي تكلم به باختياره غير قاصد معناه ، وهذا لا ينافي ما مر من أن الإيمان هو التصديق فقط أو مع الإقرار لأن التصديق ، وإن كان موجودا حقيقة لكنه زائل حكما لأن الشارع جعل بعض المعاصي أمارة على عدم وجوده كالهزل المذكور ، وكما لو سجد لصنم أو وضع مصحفا في قاذورة فإنه يكفر ، وإن كان مصدقا لأن ذلك في حكم التكذيب.اهـ

যে ব্যক্তি হাসি-তামাশায় কোন কুফরী কথা বলবে সেও কাফের হয়ে যাবে। হাসি-তামাশায় বলার অর্থ, কথাটা বলেছে ইচ্ছাকৃতভাবেই তবে এর অর্থ সে উদ্দেশ্য নেয়নি। … কারণ শরীয়তদাতা কোনো কোনো নাফরমানিকে অন্তরে বিশ্বাস না থাকার আলামত নির্ধারণ করেছেন। যেমন, হাসি-তামাশায় কুফরী কথা বলা যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তদ্রূপ যদি মূর্তিকে সেজদা করে কিংবা কুরআনে কারীমকে ময়লায় নিক্ষেপ করে তাহলেও কাফের হয়ে যাবে। যদি সে আন্তরিকভাবে বিশ্বাসীও হয়, তবুও কাফের হয়ে যাবে। ফাতাওয়া শামী: /৩৫৬

তিন.

قال في المسايرة : وبالجملة فقد ضم إلى التصديق بالقلب ، أو بالقلب واللسان في تحقيق الإيمان أمور الإخلال بها إخلال بالإيمان اتفاقا ، كترك السجود لصنم ، وقتل نبي والاستخفاف به ، وبالمصحف والكعبة … ثم قال ولاعتبار التعظيم المنافي للاستخفاف كفر الحنفية بألفاظ كثيرة ، وأفعال تصدر من المنتهكين لدلالتها على الاستخفاف بالدين … قلت : ويظهر من هذا أن ما كان دليل الاستخفاف يكفر به ، وإن لم يقصد الاستخفاف.اهـ

‘আল-মুসায়ারাহ্’ কিতাবে (ইবনুল হুমাম রহ.) বলেন, ‘ঈমান শুদ্ধ হওয়ার জন্য অন্তরের বিশ্বাসের সাথে কিংবা অন্তরের বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকারোক্তির সাথে আরও কতিপয় বিষয়কে সংযুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোর কোনো একটাতে ত্রুটি করলে সর্বসম্মতিক্রমে তা ঈমান বিনষ্ট বলে ধর্তব্য হবে। যেমন মূর্তিকে সেজদা না করা, কোনো নবীকে হত্যা বা তাঁর শানের অবমাননা না করা, কুরআনে কারীম বা কাবা শরীফের শানের অবমাননা না করা। …

(ইবনুল হুমাম রহ.) এরপর বলেন, তাজীম; যেটি অবমাননার বিপরীত, ঈমান সহীহ হওয়ার জন্য এটি শর্ত করার কারণে হানাফীরা তাজীম বিনষ্টকারীদের থেকে প্রকাশিত অনেক কথা ও কাজের দ্বারা তাকফীর করে থাকেন। কেননা, সেগুলো দ্বীনের অবমাননা বুঝায়। …

আমি বলি (অর্থাৎ আল্লামা শামী রহ. বলেন), উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, যা কিছুই (দ্বীনের) অবমাননা বুঝায় তার দ্বারাই তাকফীর করা হবে, যদিও অবমাননা করা ব্যক্তির উদ্দেশ্য না হয়। ফাতাওয়া শামী: /৩৫৬

চার.

رجل كفر بلسانه طائعا، وقلبه مطمئن بالإيمان يكون كافرا ولا يكون عند الله مؤمنا كذا في فتاوى قاضي خان. اهـ

ইচ্ছাকৃতভাবে যে ব্যক্তি মুখে কুফরী করবে, কিন্তু তার অন্তর ঈমানে পরিপূর্ণ, সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলার কাছেও সে ঈমানদার বলে ধর্তব্য হবে না। ফাতাওয়া কাজী খানে এমনই বলা হয়েছে। ফাতাওয়া আলমগীরি: /২৮৩

পাঁচ.

الهازل، أو المستهزئ إذا تكلم بكفر استخفافا واستهزاء ومزاحا يكون كفرا عند الكل، وإن كان اعتقاده خلاف ذلك. اهـ

যে ব্যক্তি অবজ্ঞাপূর্বক, উপহাসস্বরূপ কিংবা রসিকতা করে কুফরী কথা বলবে, সে সকলের ঐক্যমতে কাফের হয়ে যাবে, যদিও তার অন্তরের বিশ্বাস এর বিপরীত হয়। ফাতাওয়া আলমগীরি: /২৭৬

ছয়.

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. (১৩৫২হি.) বলেন,

وكذلك … نكفر بكل فعل فعله شخص مسلم، أجمع المسلمون على أنه – أي ذلك الفعل – لا يصدر إلا من كافر حقيقة …  وإن كان صاحبه – أي من صدر منه – مسلما مصرحا بالإسلام مع فعله ذلك الفعل. “شرح شفاء” للخفاجي ملتقطا ملخصا. ومثله في “شرح الملا على القارئ” سواء. اهـ

প্রত্যেক এমন কর্ম, যার ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত যে, তা প্রকৃত কাফের ব্যতীত অন্য কারও থেকে প্রকাশ পেতে পারে না, কোনো মুসলমান তাতে লিপ্ত হলে এর দ্বারা আমরা তাকে তাকফীর করবো, যদিও উক্ত কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হওয়ার পরও সুস্পষ্টরূপে নিজেকে মুসলমান ঘোষণা দেয়। খাফফাজী রহ. এর শরহে শিফা থেকে গৃহীত। মোল্লা আলী কারী রহ.-এর শরাহতেও হুবহু এমনই বলা হয়েছে। ইকফারুল মুলহিদীন: ৫৮

সাত.

কাজী আবু ইউসুফ রহ. (১৮২হি.) বলেন,

وأيما رجل مسلم سب رسول الله صلى الله عليه وسلم أو كذبه أو عابه أو تنقصه؛ فقد كفر بالله وبانت منه زوجته؛ فإن تاب وإلا قتل. -الخراج لأبي يوسف (ص: 199)

যেকোন মুসলিম ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেবে, মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, তাঁর কোনো দোষ ধরবে বা অবমাননা করবে সে কাফের হয়ে যাবে এবং তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। তাওবা করলে তো ভালই, অন্যথায় হত্যা করে দেয়া হবে। কিতাবুল খারাজ: ১৯৯

আট.

امرأة شدت على وسطها حبلا وقالت: هذا زنار تكفر كذا في الخلاصة. اهـ

যদি কোনো মহিলা কোমরে রশি বেঁধে বলে, ‘এটি পৈতা’ তাহলে কাফের হয়ে যাবে। ‘আলখুলাসা’ কিতাবে এমনই বলা হয়েছে। ফাতাওয়া আলমগীরি: /২৭৭

নয়.

يكفر بوضع قلنسوة المجوس على رأسه على الصحيح إلا لضرورة دفع الحر والبرد وبشد الزنار في وسطه إلا إذا فعل ذلك خديعة في الحرب وطليعة للمسلمين -الفتاوى الهندية (17/ 254)

মাজুস তথা অগ্নিপূজারিদের টুপি মাথায় দিলে সহীহ মত হল, কাফের হয়ে যাবে। তবে গরম বা ঠাণ্ডা থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মাথায় দিলে ভিন্ন কথা। তদ্রূপ কোমরে পৈতা বাঁধলেও কাফের হয়ে যাবে। তবে যুদ্ধে শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বা মুসলিমদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরির জন্য বাঁধলে ভিন্ন কথা। ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১৭/২৫৪

দশ.

رجل يجلس على مكان مرتفع ، ويسألون منه مسائل بطريق الاستهزاء ، ثم يضربونه بالوسائد ، وهم يضحكون يكفرون جميعا ، وكذا لو لم يجلس على المكان المرتفع . -الفتاوى الهندية (17/ 199)

এক লোক (আলেম সেজে) একটি উঁচু স্থানে বসেছে। অন্যরা হাসি-মস্করা করে তার কাছে বিভিন্ন মাসআলা জিজ্ঞেস করছে। এরপর সকলে হাসতে হাসতে তাকে বালিশ দিয়ে পেটাচ্ছে। এরা সকলেই কাফের হয়ে যাবে। উঁচু স্থানে না বসলেও কথা একই (সকলেই কাফের হয়ে যাবে)। ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১৭/১৯৯

এ বিষয়ে অসংখ্য বক্তব্য রয়েছে। এখানে এ কয়টিই উদ্ধৃত করা হল। এসব উদ্ধৃতি থেকে এখানে আমরা নিম্নোক্ত কুফরী আমলগুলো পেলাম:

১. মূর্তিকে সেজদা করা।

২. কুরআনে কারীমকে ময়লায় নিক্ষেপ করা।

৩. কাবা শরীফের অবমাননা করা।

৪. কোনো নবীকে হত্যা করা।

৫. কোন নবীকে নিয়ে ঠাট্টা করা বা শানের অবমাননা করা।

৬. পৈতা বাঁধা।

৭. অগ্নিপূজারিদের টুপি মাথায় দেয়া।

৮. আলেম ও মুস্তাফতির অভিনয় করে হাসি-মস্কারি করা।

এ ধরনের কাজগুলোতে কাফের হওয়ার জন্য ইস্তিহলাল তথা হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল মনে করা কিংবা জুহুদ তথা শরীয়তের অকাট্য কোন বিষয়কে অস্বীকার করা শর্ত নয়। এ ধরনের আরও বিভিন্ন কাজ রয়েছে, যেগুলোতে লিপ্ত হলে কাফের হয়ে যাবে- যদিও অন্তরের আকীদা-বিশ্বাস বহাল থাকে।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আশা করি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কাফের হওয়ার জন্য সর্বক্ষেত্রে ইস্তিহলাল কিংবা জুহুদ শর্ত নয়। এগুলো সাধারণ গুনাহের ক্ষেত্রে শর্ত। যেসব কাজ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সরাসরি কুফর বলে প্রমাণিত, সেগুলোতে এ শর্ত নেই। সেগুলোতে লিপ্ত হলেই কাফের হয়ে যাবে; হালাল মনে করুক বা না করুক, অস্বীকার করুক বা না করুক। ওয়াল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা আলাম।

আরও পড়ুনঃ জিহাদের মুখাতাব কি শুধুই শাসকশ্রেণি?

Related Articles

Back to top button