তাকফীরমাওলানা আব্দুল্লাহ রাশেদ

সংশয় নিরসনঃ তাকফীরে ভুল হলে তাকফীরকারী নিজেই কি কাফের হয়ে যায়?

 

সংশয় নিরসনঃ তাকফীরে ভুল হলে তাকফীরকারী নিজেই কি কাফের হয়ে যায়?

 

 

মাওলানা আবদুল্লাহ রাশেদ হাফিযাহুল্লাহ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন 

 

সূচিপত্র

সংশয়: তাকফীরে ভুল হলে নিজেই কাফের হয়ে যায়. 7

তাকফীর কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ এবং সাহাবায়ে কেরামের তরীকা   8

তাকফীর একটি ইজতিহাদি বিষয়, তাতে দ্বিমত হতে পারে, ভুলও হতে পারে  16

তাকফীরে ভুল হলে কি বিধান? 18

প্রথম দলীল: হাতিব বিন আবু বালতাআ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর হাদীস  19

দ্বিতীয় দলীল: খারেজী সম্প্রদায়. 26

তাকফীরে ভুল এবং হাফেজ ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২হি.) -এর ফায়সালা সমৃদ্ধ বক্তব্য  29

‘মুসলিমকে তাকফীর করলে নিজের ওপর কুফর বর্তাবে’ কথাটির ব্যাখ্যা   31

বি.দ্র. গালি-গালাজ করে কাফের বললে কাফের হবে না.. 34

সারকথা.. 35

 

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وأصحابه ومن والاه، أما بعد

তাকফীর নিয়ে আমরা প্রান্তিকতার শিকার। কেউ কেউ ঠুনকো অজুহাতে সামান্য সামান্য বিষয়ে তাকফীর করে বসেন। আবার কেউ কেউ স্পষ্ট কুফর দেখতে পেয়েও বিভিন্ন সংশয়-সন্দেহে তাকফীর করা থেকে দূরে থাকেন। আসলে এ উভয়টিই প্রান্তিকতা। মুমিনকে কাফের বলা যেমন ভয়াবহ, কাফেরকে মুমিন বলাও তেমনি ভয়াবহ।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

{يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَتَبَيَّنُوا وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا} [النساء: 94]   

“হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর করবে তখন যাচাই-বাছাই করে দেখবে। কেউ তোমাদেরকে সালাম দিলে পার্থিব জীবনের উপকরণ লাভের আকাঙ্ক্ষায় তাকে বলবে না যে, তুমি মুমিন নও।” -সূরা নিসা (০৪) : ৯৪

এ আয়াতে যাচাই-বাছাই ছাড়া কাফের বলে দিতে নিষেধ করা হয়েছে।

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন,

{أَتُرِيدُونَ أَنْ تَهْدُوا مَنْ أَضَلَّ اللَّهُ} [النساء: 88]

“আল্লাহ যাকে গুমরাহ করে দিয়েছেন তোমরা কি তাকে হেদায়াত দিয়ে দিতে চাচ্ছ?” -সূরা নিসা (০৪) : ৮৮

তাফসীরে জালালাইনে এ আয়াতে তাফসীরে এসেছে,

{أتريدون أن تهدوا من أضل} هـ {الله} أي تعدوهم من جملة المهتدين. تفسير الجلالين (ص: 116)

“অর্থাৎ যারা কাফের হয়ে গেছে তোমরা তাদেরকে হেদায়াতের ওপর আছে তথা মুমিন বলে গণ্য করতে চাচ্ছ?” (তাফসীরে জালালাইন)

এ আয়াতে কাফেরকে মুমিন গণ্য করতে নিষেধ করা হয়েছে।

অতএব, এ উভয়টিই প্রান্তিকতা। উভয়টিই ভয়াবহ এবং উভয়টারই নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

মোল্লা আলী কারী রহিমাহুল্লাহ (১০১৪ হি.) বলেন,

إدخال كافر في الملّة الإسلامية وإخراج مسلم عنها عظيم في الدّين. -شرح الشفا (2/ 499)

“কোনো কাফেরকে মুসলিম মিল্লাতে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা কিংবা কোনো মুসলিমকে মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করা দেয়া, দ্বীনে ইসলামে উভয়টিই ভয়াবহ কাজ।” -শরহুশশিফা: ২/৪৯৯

মুফতী শফী রহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘জাওয়াহিরুল ফিকহ’-গ্রন্থে বলেন,

جس طرح فروعی اختلا فات کی وجہ سے ياکسى محتمل اور  مبهم کلام کی وجہ سے ياكسى اىسے عقیدہ وكلمہ کی وجہ سے جس کےکفرہونے میں علماء  کا اختلاف ہو،کسی مسلما ن کوکافر كہنا سخت بے احتياطى  اور اپنے ايمان  كوخطره  ميں  ڈ النا  ہے۔  کیو نكہ اس سے كفر كو  ايمان قرار دينا  لازم آتاہے۔ اور يہ ظاہر ہے كہ ايمان كو كفر يا كفر كو ايمان قرار دينا اگر  اپنے اختيار واراده سے ہو،  تو بلاشبہ كفر ہے۔ ورنہ كفر كے خطره سےتو خالى نہيں۔ علاوه از يں کسى كافرکومسلما ن كہہ د ینامحض ايك لفظى سخاوت نہيں،   بلکہ پوري ملت اور اسلامی معاشرہ پرظلم  عظمیم ہے ۔کیونکہ اس سے پوری ملت کا معاشره و متاثر ہبوتا ہے۔ نكاح ، نسب ، میراث،  ذ بيحہ،  امانت، نماز اور اجتماعى   اورسیاسی حقوق سبھی پر اثر  پڑتا ہے۔

 

“ফুরুয়ী তথা শাখাগত মতভেদ, ভিন্ন ব্যাখ্যা সম্ভব এমন কিংবা অস্পষ্ট কথা-বার্তা, কিংবা এমন আকীদা ও শব্দ যা কুফর হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মাঝে দ্বিমত আছে: এ ধরনের বিষয়াদির ভিত্তিতে কোনো মুসলিমকে তাকফীর করা নেহায়েত অসতর্কতা এবং নিজ ঈমানকে হুমকির সম্মুখীন করার নামান্তর। কেননা, এ সূরতে পরিণতিতে ঈমানকে কুফর বলা হচ্ছে। ঠিক একইভাবে কোনো সুস্পষ্ট কাফেরকে মুসলমান আখ্যা দেয়াও নেহায়েত ভয়ানক অপরাধ এবং আপন ঈমানকে হুমকির সম্মুখীন করার নামান্তর। কেননা, এতে পরিণতিতে কুফরকে ঈমান বলা হচ্ছে। আর এতো সুস্পষ্ট যে, ঈমানকে কুফর বা কুফরকে ঈমান আখ্যা দেয়া নিঃসন্দেহে কুফর; কিংবা কুফরের শঙ্কামুক্ত নয়। তাছাড়া কোনো কাফেরকে মুসলমান বলে দেয়া শুধু একটি শাব্দিক ব্যাপার নয়, বরং গোটা মিল্লাত ও ইসলামী সমাজের ওপর মহাজুলুম। কারণ, এর দ্বারা গোটা সমাজ প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে। নিকাহ, নসব (বংশ), মীরাস, জবাইকৃত জন্তু, ইমামত, নামায এবং এছাড়াও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার ও কর্তব্য সব কিছুর ওপরই এর প্রভাব পড়ে।” জাওয়াহিরুল ফিকহ: ১/১০৪-১০৫

***

অন্য এক প্রবন্ধে তাকফীরে বাড়াবাড়ির ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ প্রবন্ধে তাকফীরে শিথিলতা সংক্রান্ত একটি সংশয় নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।

সংশয়: তাকফীরে ভুল হলে নিজেই কাফের হয়ে যায়

তাকফীরের ব্যাপারে সতর্ক করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

إذا كفر الرجل أخاه فقد باء بها أحدهما -صحيح مسلم، رقم: 224؛ ط. دار الجيل بيروت + دار الأفاق الجديدة ـ بيروت

“কোনো ব্যক্তি তার কোনো (মুসলিম) ভাইকে তাকফীর করলে দুজনের একজন তা অবশ্যই বহন করবে।” –সহীহ মুসলিম ২২৪

অন্য হাদীসে ইরশাদ করেন,

أيما امرئ قال لأخيه يا كافر فقد باء بها أحدهما إن كان كما قال وإلا رجعت عليه -صحيح مسلم، رقم: 225؛ ط. دار الجيل بيروت + دار الأفاق الجديدة ـ بيروت

“যেকোনো ব্যক্তি তার (মুসলিম) ভাইকে বলবে, ‘হে কাফের’ তাহলে তাদের দুজনের একজন তা অবশ্যই বহন করবে। যেমন বলেছে বাস্তবে তেমন হয়ে থাকলে তো হলই, অন্যথায় তার নিজের ওপর এসে পড়বে।” –সহীহ মুসলিম ২২৫

এ জাতীয় হাদীসগুলো দেখে অনেকে সংশয়ে পড়েন যে, কোনো মুসলিমকে তাকফীর করতে গিয়ে যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে আমি নিজেই কাফের হয়ে যাব। তাই স্পষ্ট কুফর দেখেও তাকফীর করেন না। এ ধারণা আসলে ভুল।

তাকফীর কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ এবং সাহাবায়ে কেরামের তরীকা

ঠুনকো অজুহাতে কোনো মুসলিমকে তাকফীর করা অত্যন্ত ভয়াবহ কাজ। কিন্তু শরয়ী দলীলের আলোকে কারও মাঝে সুস্পষ্ট কুফর পাওয়া গেলে তাকে তাকফীর করা, ‘সে কাফের’ এ কথা বলে দেয়া, এটি কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ। বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে এর নির্দেশনা এসেছে। যেমন,

এক.  

তাবুক অভিযানের সময় পথিমধ্যে কিছু লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপে লিপ্ত হয় এবং সমালোচনামূলক বিভিন্ন কথা বলে। জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর দেয়, এগুলো আমরা রাস্তা চলতে চলতে সময় কাটানোর জন্য কৌতুকবশত বলেছি। এসব আমাদের মনের কথা না। আল্লাহ তাআলা তাদের কাফের আখ্যায়িত করে আয়াত নাযিল করেন। ইরশাদ করেন,

{يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوا إِنَّ اللَّهَ مُخْرِجٌ مَا تَحْذَرُونَ (64) وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (65) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ (66)}

৬৪) “মুনাফেকরা এ ব্যাপারে ভয় করে যে, মুসলমানদের ওপর না এমন কোনো সূরা নাযিল হয়, যাতে তাদের অন্তরের গোপন বিষয় অবহিত করা হবে। আপনি বলে দিন, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে থাক; আল্লাহ্ তা অবশ্যই প্রকাশ করবেন যার ব্যাপারে তোমরা ভয় করছ।

৬৫) আপনি যদি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেন, তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলে?

৬৬) ছলনা কর না, তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ ঈমান আনার পর। তোমাদের মধ্যে (তাওবা করার কারণে) কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেইও, তবে কিছু লোককে (যারা তাওবা করেনি) অবশ্য আযাবও দেব। কারণ, তারা অপরাধী।” -সূরা তাওবা (০৯) : ৬৪-৬৬

দুই.

কেউ মুরতাদ হয়ে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন,

من بدل دينه فاقتلوه

“যে ব্যক্তি তার আপন দ্বীন (ইসলাম) ছেড়ে দেয় তাকে হত্যা করে দাও।” –সহীহ বুখারী: ৬৫২৪

তিন.

শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে তাকে অপসারণ করে দিতে আদেশ দেয়া হয়েছে। হযরত উবাদা ইবনে সামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

دعانا النبي صلى الله عليه وسلم فَبَايَعْنَاهُ. فكان فيما أخذ علينا أَنْ بَايَعَنَا على السمع والطاعة في مَنشَطِنا ومَكْرَهِنا، وعُسرنا ويُسرنا، وَأَثَرَة علينا، وَأَنْ لا نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَه. قَالَ: إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ. (متفق عليه وهذا لفظ مسلم. رقم الحديث: 1709،  تحقيق فؤاد عبد الباقي)

“রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ডাকলেন, আমরা তাঁর হাতে বাইআত হলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের থেকে যে বিষয়ে বাইআত নিলেন তা হল, আমরা আমাদের পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় বিষয়ে, সুখে-দুঃখে এবং আমাদের ওপর যদি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া হয় তথাপিও (আমীরের কথা) শুনব ও আনুগত্য করব এবং আমরা দায়িত্বশীলের সাথে দায়িত্ব নিয়ে বিবাদে জড়াবো না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তবে হ্যাঁ, যদি তোমরা কুফরে বাওয়াহ তথা সুস্পষ্ট কোনো কুফর দেখতে পাও, যার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে- তাহলে ভিন্ন কথা।” –সহীহ মুসলিম: ১৭০৯

উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীসসহ আরও বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কেউ সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত হলে তাকে তাকফীর করা হবে এবং কুফরের হুকুম আহকামও তার ওপর প্রয়োগ করা হবে। যেমন শাসক হলে অপসারণ করে দেয়া, নতুন করে মুসলমান না হলে হত্যা করে দেয়া ইত্যাদি। সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমের আমল এমনই ছিল। যেমনটি বিভিন্ন হাদীসে এসেছে। এখানে কয়েকটি নজির উল্লেখ করছি-

.

عن أبي بردة قال : بعث رسول الله صلى الله عليه و سلم أبا موسى ومعاذ بن جبل إلى اليمن قال وبعث كل واحد منهما على مخلاف قال واليمن مخلافان ثم قال ( يسرا ولا تعسرا وبشرا ولا تنفرا ) . فانطلق كل واحد منهما إلى عمله وكان كل واحد منهما إذا سار في أرضه وكان قريبا من صاحبه أحدث به عهدا فسلم عليه فسار معاذ في أرضه قريبا من صاحبه أبي موسى فجاء يسير على بغلته حتى انتهى إليه وإذا هو جالس وقد اجتمع إليه الناس وإذا رجل عنده قد جمعت يداه إلى عنقه فقال له معاذ يا عبد الله بن قيس أيم هذا ؟ قال هذا الرجل كفر بعد إسلامه قال لا أنزل حتى يقتل قال إنما جيء به لذلك فانزل قال ما أنزل حتى يقتل فأمر به فقتل ثم نزل. –صحيح البخاري: 4086

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু মুসা (আশআরী) রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু ও মুআজ বিন জাবাল রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুকে ইয়েমেনের গভর্ণর করে পাঠালেন। প্রত্যেককে আলাদা আলাদা প্রদেশে পাঠালেন। ইয়েমেনে তখন দুটি প্রদেশ ছিল। নসীহত করে দিলেন, ‘তোমরা (সব বিষয়ে) সহজ করবে, কঠিন করবে না। সুসংবাদ দেবে, অনীহা সৃষ্টি করবে না’। তারপর উভয়ে নিজ নিজ কর্ম এলাকায় চলে গেলেন। প্রত্যেকের অভ্যাস ছিল, যদি নিজ এলাকায় চলতে চলতে কখনও অপরজনের কাছাকাছি চলে যেতেন, তাহলে তার সাথে সাক্ষাত করে সালাম দিতেন। একদিন মুআজ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু নিজ এলাকায় এমন স্থানে সফর করছিলেন যেটি তার সাথী আবু মুসা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর কাছাকাছি ছিল। তাই তিনি তার খচ্চরের পিঠে চড়ে আবু মুসা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে পৌঁছে গেলেন। তখন আবু মুসা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বসা ছিলেন। তার কাছে অনেক লোক জমায়েত হয়েছে। মুআজ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু দেখেন যে, আবু মুসা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর নিকটে একটা লোক উপস্থিত যার উভয় হাত ঘাড়ের সাথে মুড়ি দিয়ে বাঁধা। মুআজ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু জিজ্ঞেস করলেন, আব্দুল্লাহ বিন কায়স! লোকটির কি হল? তিনি উত্তর দেন, এ লোক মুসলামন হওয়ার পর মুরতাদ হয়ে গেছে। মুআজ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, একে হত্যা না করা পর্যন্ত আমি নামবো না। আবু মুসা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, এজন্যই একে আনা হয়েছে। আপনি নামুন। তিনি উত্তর দেন, না, আমি নামবো না, যতক্ষণ না একে হত্যা করা হয়েছে। তখন আবু মুসা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু একে হত্যা করার আদেশ দেন। একে হত্যা করা হল। তখন মুআজ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বাহন থেকে নামলেন।”-সহীহ বুখারী: ৪০৮৬

.

عن ابن شهاب أخبرني عبيد الله بن عبد الله بن عتبة أن أبا هريرة قال : لما توفي النبي صلى الله عليه و سلم واستخلف أبو بكر وكفر من كفر من العرب قال عمر يا أبا بكر كيف تقاتل الناس وقد قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( أمرت أن أقاتل الناس حتى يقولوا لا إله إلا الله فمن قال لا إله إلا الله عصم مني ماله ونفسه إلا بحقه وحسابه على الله ) . قال أبو بكر والله لأقاتلن من فرق بين الصلاة والزكاة فإن الزكاة حق المال والله لو منعوني عناقا كانوا يؤدونها إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم لقاتلتهم على منعها . قال عمر فوالله ما هو إلا أن رأيت أن قد شرح الله صدر أبي بكر للقتال فعرفت أنه الحق. –صحيح البخاري: 6526

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আবু বকর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু খলীফা হলেন। আরবের অনেক লোক তখন মুরতাদ হয়ে গেল (যাদের বিরুদ্ধে আবু বকর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু কিতালের সংকল্প করেছেন)। তখন ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু আবু বকর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুকে বললেন, আবু বকর! আপনি (ওই) লোকদের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ করবেন (যারা সম্পূর্ণ দ্বীন বর্জন করেনি, শুধু যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে) অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে যতক্ষণ না তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে। যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে সে আমার থেকে তার জান-মাল সুরক্ষিত করে নিল। তবে ইসলামের কোনো হকের কারণে পাকড়াও করতে হলে সেটা ভিন্ন কথা। আর তাদের অন্তরে কি লুকায়িত আছে তার হিসাব আল্লাহ তাআলার হাতে।’

তখন আবু বকর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু উত্তর দিলেন, আল্লাহর কসম, সালাত ও যাকাতের মাঝে যারা পার্থক্য করেছে অবশ্যই আমি তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করব। (সালাত যেমন জানের হক, তেমনি) যাকাত মালের হক (সে হক আদায়ে কিতাল করা হবে)। আল্লাহর কসম, রাসূলের কাছে যাকাত হিসেবে দিত এমন একটি মেষ শাবক দিতে অস্বীকার করলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করব।

ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, আল্লাহর কসম, শেষে আমার বুঝে আসলো যে, আল্লাহ তাআলা আবু বকরের অন্তরকে কিতালের জন্য উন্মোচন করে দিয়েছেন। তখন আমিও বুঝতে পারলাম যে, তার সিদ্ধান্তই যথার্থ।” -সহীহ বুখারী: ৬৫২৬

.

عن عكرمة قال : أتي علي رضي الله عنه بزنادقة فأحرقهم فبلغ ذلك ابن عباس فقال لو كنت أنا لم أحرقهم لنهي رسول الله صلى الله عليه و سلم ( لا تعذبوا بعذاب الله ) . ولقتلتهم لقول رسول الله صلى الله عليه و سلم ( من بدل دينه فاقتلوه ). –صحيح البخاري: 6524

“আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে কয়েকটি যিন্দিককে ধরে আনা হল। তিনি তাদের জ্বালিয়ে দিলেন। ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি বললেন, আমি হলে জ্বালাতাম না। কারণ, রাসূল নিষেধ করেছেন। বলেছেন, আল্লাহর আযাব দিয়ে তোমরা আযাব দিয়ো না। তবে হত্যা অবশ্যই করতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার আপন দ্বীন (ইসলাম) ছেড়ে দেয় তাকে হত্যা করে দাও।”-সহীহ বুখারী: ৬৫২৪

.

مَالِكٌ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمنِ بْنِ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبْدٍ الْقَارِيِّ، عَنْ أَبِيهِ؛ أَنَّهُ قَالَ: قَدِمَ عَلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَجُلٌ مِنْ قِبَلِ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ. فَسَأَلَهُ عَنِ النَّاسِ. فَأَخْبَرَهُ. ثُمَّ قَالَ لَهُ عُمَرُ: هَلْ كَانَ فِيكُمْ مِنْ مُغَرِّبَةِ خَبَرٍ؟ فَقَالَ: نَعَمْ. رَجُلٌ كَفَرَ بَعْدَ إِسْلاَمِهِ. قَالَ: فَمَا فَعَلْتُمْ بِهِ؟ قَالَ: قَرَّبْنَاهُ ، فَضَرَبْنَا عُنُقَهُ. فَقَالَ عُمَرُ: أَفَلاَ حَبَسْتُمُوهُ ثَلاَثاً. وَأَطْعَمْتُمُوهُ كُلَّ يَوْمٍ رَغِيفاً. وَاسْتَتَبْتُمُوهُ لَعَلَّهُ يَتُوبُ وَيُرَاجِعُ أَمْرَ اللهِ. ثُمَّ قَالَ عُمَرُ: اللَّهُمَّ، إِنِّي لَمْ أَحْضُرْ. وَلَمْ آمُرْ. وَلَمْ أَرْضَ، إِذْ بَلَغَنِي. –موطأ مالك ت الأعظمي: 2728

“আবু মুসা আশআরী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর এলাকা থেকে এক লোক (আমীরুল মুমিনন) ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর কাছে আসলো। ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু তাকে মানুষজনের অবস্থাদি জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি বিবরণ শুনালো। তারপর ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো ব্যতিক্রমধর্মী সংবাদ আছে কি? লোকটি বলল, জি, আছে। এক লোক মুসলমান হওয়ার পর মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু জিজ্ঞেস করলেন, তার সাথে তোমরা কি আচরণ করেছ? লোকটি বলল, তরবারির সামনে দাঁড় করিয়ে গর্দান উড়িয়ে দিয়েছি (যেমনটা হাদিসে হত্যা করে দিতে বলা হয়েছে)। ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, (তখনই হত্যা না করে) কেন তাকে তিন দিন বন্দী করে রাখলে না? প্রতিদিন একটা একটা রুটি খেতে দিতে এবং তাকে তাওবা করে মুসলমান হওয়ার আহ্বান জানাতে। হতে পারে সে তাওবা করতো। আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে আবারও ফিকির করতো। এরপর ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, হে আল্লাহ! আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। আমি (সরাসরি হত্যা করে দিতে) আদেশও দিইনি। আমার কাছে সংবাদ পৌঁছার পর আমি তাতে সন্তুষ্টও হইনি।” -মুআত্তা মালেক: ২৭২৮

বুঝা গেল মুরতাদকে তাকফীর করা এবং কুফরের হুকুম-আহকাম আরোপ করা কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ এবং এটিই সাহাবায়ে কেরামের আমল। অতি সতর্কতার নামে কাফেরকে তাকফীর করা থেকে বিরত থাকা কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের তরীকা পরিপন্থী এবং ঠিক তেমনই ভয়াবহ যেমন কোনো মুসলিমকে কুফর ছাড়াই তাকফীর করা ভয়াবহ। যেমনটা মুফতী শফী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন। জাওয়াহিরুল ফিকহ: ১/১০৪-১০৫

***

তাকফীর একটি ইজতিহাদি বিষয়, তাতে দ্বিমত হতে পারে, ভুলও হতে পারে

তাকফীরের ভিত্তি দুটি বিষয়ের ওপর;

ক. যে কথা বা কাজের কারণে তাকফীর করা হবে সেটি কুফর হওয়া।

খ. কুফরী কথা বা কাজে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তির মাঝে কাফের হওয়ার সবগুলো শর্ত পূর্ণরূপে পাওয়া যাওয়া এবং কাফের হওয়ার পথে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধক বিদ্যমান না থাকা।

যখন কোনো ব্যক্তি কোনো কুফরী কথা বলবে বা কাজ করবে পাশপাশি তার মাঝে কাফের হওয়ার সবগুলো শর্ত পাওয়া যাবে এবং কোনো প্রতিবন্ধক না থাকবে তখন তাকে তাকফীর করা হবে। এর কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলে তাকফীর করা যাবে না। আর এ দুটি বিষয়ে মতভেদ হওয়া একদমই স্বাভাবিক।

  • কোনো কথা বা কাজ শরীয়তের দলীলের আলোকে একজন ইমামের নিকট কুফর মনে হলে, অন্যজনের কাছে কুফর মনে নাও হতে পারে। এভাবে অনেক বিষয়ে মতভেদ সম্ভব। কারও মতে কুফর, কারও মতে কুফর নয়।
  • কথা বা কাজটি কুফর হলেও শর্ত পাওয়া, না পাওয়া বা প্রতিবন্ধক বিদ্যমান থাকা, না থাকা নিয়েও মতভেদ হতে পারে। কারও মতে সবগুলো শর্ত পাওয়া গেছে এবং কোনো প্রতিবন্ধক নেই। তিনি তাকফীর করবেন। পক্ষান্তরে কারও মতে কোনো শর্তে কমতি আছে বা কোনো প্রতিবন্ধক বিদ্যমান আছে। তিনি তাকফীর করবেন না। এভাবে একই ব্যক্তির মাঝে দুজন আলেমের দ্বিমত হতে পারে। একজনের মতে কাফের, অন্যজনের মতে কাফের নয়।

এভাবে শরয়ী দলীলের আলোকে যখন দ্বিমত দেখা দেবে যে, কেউ তাকফীর করছেন আর কেউ করছেন না, তখন এক দল আরেক দলকে গালমন্দ বা অহেতুক সমালোচনা করতে পারবে না। যাদের কাছে যেমন মনে হয়েছে সে অনুযায়ী আমল করবে। হযরত থানভী রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেন,

کسی امر موجبِ کفر کی دلالت علی الکفر یا اس امر موجب کفر کا ثبوت قرائن مقامیہ یا مقالیہ کے اختلاف سے مختلف فیہ ہو سکتا ہے۔ اور خود قطعیت بھی کبھی مختلف فیہ ہو سکتی ہے کحرمۃ متروک التسمیۃ عامداً اسی طرح کبھی اجماع مختلف فیہ ہو سکتا ہے ۔۔۔اس صورت میں ہر عامل اپنے عمل میں معذور ہوگا۔ امداد الفتاوی جدید ۔ جدید مطول حاشیہ شبیر احمد القاسمی جلد 11 صفحہ نمبر: 167

“কোনো কুফরী বিষয় পরিষ্কার কুফর বুঝাচ্ছে কি না এবং কুফরী বিষয়টি (ব্যক্তি থেকে) সুস্পষ্ট প্রমাণিত কি না; কথাবার্তার ধরন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিন্নতার ভিত্তিতে তাতে মতভেদ হতে পারে। তদ্রূপ বিষয়টি অকাট্য কুফর কি না তাতেও মতভেদ হতে পারে। যেমন ইচ্ছাকৃত বিসমিল্লাহ ছেড়ে দিয়ে যবেহকৃত জন্তু হারাম কি না তা মতভেদপূর্ণ। তদ্রূপ বিষয়টি সর্বসম্মত ও মুজমা আলাইহি কুফর কি না তাতেও দ্বিমত হতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি যে মত অনুযায়ী আমল করবে, সেক্ষেত্রে তাকে মাযুর ধরা হবে (সমালোচনা করা যাবে না)।” -ইমদাদুল ফাতাওয়া (জাদীদ): ১১/১৬৭

তাকফীরে ভুল হলে কি বিধান?

আমরা দেখেছি তাকফীর একটি ইজতিহাদি বিষয়। তাতে দ্বিমত হতে পারে। কারও তাকফীর সঠিক হতে পারে, কারওটা ভুল। যদি কুফর মুত্তাফাক আলাইহি তথা সর্বসম্মত হয় এবং সব রকমের শর্ত পাওয়া যায় এবং কোনো প্রতিবন্ধক না থাকে তাহলে তো পরিষ্কারই যে, তাকফীরকারী সঠিক। তিনি সাওয়াবের অধিকারী হবেন। কিন্তু যদি কেউ তাকফীর করতে গিয়ে ভুল করেন তাহলে কি বিধান?

তাকফীরে ভুল হওয়ার কারণ নিচের কোনো একটা হয়ে থাকবে:

  • তিনি যেটিকে কুফর মনে করেছিলেন বাস্তবে সেটি কুফর নয়।
  • তিনি মনে করেছিলেন সবগুলো শর্ত পাওয়া গেছে কিন্তু বাস্তবে সবগুলো শর্ত পাওয়া যায়নি।
  • তিনি মনে করেছিলেন কোনো প্রতিবন্ধক নেই, কিন্তু বাস্তবে প্রতিবন্ধক ছিল।

এ ধরনের ভুলকে আমরা ইজতিহাদি ভুল বলতে পারি। এ ধরনের ভুলের কি বিধান?

উত্তর: এ ধরনের ভুলের কারণে তাকফীরকারী কাফের হবে না। তবে তাকফীরকারী যদি ইজতিহাদের যোগ্য হয়ে থাকেন, শরীয়তের নুসুস ও কাওয়াইদের আলোকে সর্বসামর্থ্য ব্যয় করে ইজতিহাদ করে থাকেন এতদসত্ত্বেও ভুল হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তিনি মাযুর গণ্য হবেন এবং একটি সাওয়াবের অধিকারী হবেন। যেমনটা হাদীসে এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

إذا حكم الحاكم فاجتهد ثم أصاب فله أجران وإذا حكم فاجتهد ثم أخطأ فله أجر. -صحيح البخاري: 6919

“বিচারক যদি ফায়সালা দিতে গিয়ে ইজতিহাদ করে আর সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে তাহলে দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। আর যদি ফায়সালা দিতে গিয়ে ইজতিহাদে ভুল হয় তাহলেও একগুণ সাওয়াব পাবে।” -সহীহ বুখারী: ৬৯১৯

পক্ষান্তরে যদি তাকফীরকারী ইজতিহাদের যোগ্য না হয় কিংবা শরীয়তের নুসুস ও কাওয়াইদ যথাযথ ব্যবহার না করে; তাকফীরের পেছনে অজ্ঞতা, দলান্ধতা ইত্যাদি কাজ করে তাহলে সে কাফের না হলেও গুনাহগার হবে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

رَجُلٌ قضى للنَّاس على جهلٍ، فهو في النار. -سنن أبي داود ت الأرنؤوط: 3573، قال المحققون: حديث صحيح بطرقه وشواهده. اهـ

“যে ব্যক্তি অজ্ঞতা সত্ত্বেও লোকজনের মাঝে ফায়সালা দেয় সে জাহান্নামী।” -সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৭৩

মোটকথা ইজতিহাদি ভুলের কারণে- ইজতিহাদ সঠিক হোক বা ভুল- তাকফীরকারী কাফের হবে না, নিম্নে এর স্বপক্ষে দুটি দলীল উল্লেখ করছি।

প্রথম দলীল: হাতিব বিন আবু বালতাআ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর হাদীস

হাদীসটি সহীহ বুখারীসহ বিভিন্ন কিতাবে এসেছে। সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় এসেছে, আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন,

بعثني رسول الله صلى الله عليه و سلم والزبير وأبا مرثد وكلنا فارس قال (انطلقوا حتى تأتوا روضة حاج – قال أبو سلمة هكذا قال أبو عوانة حاج – فإن فيها امرأة معها صحيفة من حاطب بن أبي بلتعة إلى المشركين فأتوني بها) . فانطلقنا على أفراسنا حتى أدركناها حيث قال لنا رسول الله صلى الله عليه و سلم تسير على بعير لها وكان كتب إلى أهل مكة بمسير رسول الله صلى الله عليه و سلم إليهم فقلنا أين الكتاب الذي معك ؟ قالت ما معي كتاب فأنخنا بها بعيرها فابتغينا في رحلها فما وجدنا شيئا فقال صاحبي ما نرى معها كتابا قال فقلت لقد علمنا ما كذب رسول الله صلى الله عليه و سلم ثم حلف علي والذي يحلف به لتخرجن الكتاب أو لأجردنك فأهوت إلى حجزتها وهي محتجزة بكساء فأخرجت الصحيفة فأتوا بها رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال عمر يا رسول الله قد خان الله ورسوله والمؤمنين دعني فأضرب عنقه فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم (يا حاطب ما حملك على ما صنعت) . قال يا رسول الله ما لي أن لا أكون مؤمنا بالله ورسوله ؟ ولكني أردت أن يكون لي عند القوم يد يدفع بها عن أهلي ومالي وليس من أصحابك أحد إلا له هنالك من قومه من يدفع الله به عن أهله وماله قال ( صدق ولا تقولوا له إلا خيرا) . قال فعاد عمر فقال يا رسول الله قد خان الله ورسوله والمؤمنين دعني فلأضرب عنقه قال (أو ليس من أهل بدر وما يدريك لعل الله اطلع عليهم فقال اعملوا ما شئتم فقد أوجبت لكم الجنة) . فاغرورقت عيناه فقال الله ورسوله أعلم. – صحيح البخاري: 6540

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবায়ের, আবু মারসাদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং আমাকে (বিশেষ একটি কাজে) পাঠান। আমরা সবাই ছিলাম ঘোড়সওয়ার। বললেন, ‘রাওজাতু খাক পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকবে। সেখানে গিয়ে এক মহিলাকে পাবে। তার সাথে হাতিব বিন আবু বালতাআ কর্তৃক মুশরিকদের কাছে লিখিত একটা চিঠি আছে। চিঠিটা নিয়ে এসো’। আমরা ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা দিলাম। শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানকার কথা বলেছিলেন সেখানে গিয়ে মহিলাটিকে পেয়ে গেলাম। সে তার উটে চড়ে যাচ্ছিল। হাতিব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু মক্কাবাসীর কাছে তাদের বিরুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানের সংবাদ লিখে পাঠিয়েছিলেন। আমরা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার সাথে থাকা চিঠিটি কোথায়? সে বলল, আমার সাথে কোনো চিঠি নেই। তখন আমরা তার উটটি বসিয়ে দিলাম। এরপর তার হাওদায় তালাশ করলাম। কিন্তু কোনো চিঠি পেলাম না। আমার সাথী তখন বললো, এর সাথে তো কোনো চিঠি আছে বলে মনে হচ্ছে না। আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, তখন আমি বললাম, (আল্লাহর কসম) আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যা বলেননি। এরপর আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু কসম করে বললেন, ওই সত্তার শপথ, যার নামে কসম খাওয়া হয়! চিঠিটি হয় বের করবি, না হয় বিবস্ত্র করে তালাশ করব। তখন সে তার কোমরে হাত দিল। কোমরে একটি চাদর বাঁধা ছিল। হাত দিয়ে চিঠিটি বের করল। তারা চিঠিটি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হলেন। তখন ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু আরজ করলেন, সে আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনদের সাথে খিয়ানত করেছে। (ইয়া রাসূলাল্লাহ) অনুমতি দিন, ওর গর্দানটা উড়িয়ে দিই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতিব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, হে হাতিব! তুমি এ কাজ কেন করলে? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (আমি সত্যিকারেই মুমিন, কাফের নই) কোন কারণে আমি আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী হবো না? তবে (এ কাজটি করেছি এ কারণে যে,) আমি চেয়েছিলাম মক্কাবাসীর প্রতি আমার একটা ইহসান থাকুক, যার বদৌলতে তারা আমার পরিবার ও সম্পদ হেফাযত করবে। আপনার সাহাবীদের সকলেরই মক্কায় নিজ কওমের কেউ না কেউ আছে যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার পরিবার ও সম্পদ হেফাযত করছেন (কিন্তু আমার এমন কেউ নেই। তাই এমনটি করেছি)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে সত্যই বলেছে। তাকে ভাল বৈ (মন্দ) কিছু বলো না’। তখন ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু আবারও আবেদন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনদের সাথে খিয়ানত করেছে। অনুমতি দিন, তার গর্দানটা উড়িয়ে দিই। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে কি বদরী নয়? আর তুমি কি জানো, হয়তো আল্লাহ তাআলা বদরীদের লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘তোমরা যা ইচ্ছা কর। তোমাদের জন্য জান্নাত অবধারিত করে রেখেছি’। এ কথা শুনার পর ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লো এবং বললেন, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন।” -সহীহ বুখারী: ৬৫৪০

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

فقال عمر يا رسول الله دعني أضرب عنق هذا المنافق. –صحيح البخاري: 4025

“তখন ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অনুমতি দিন, এ মুনাফিকের গর্দানটা উড়িয়ে দিই।” -সহীহ বুখারী: ৪০২৫

মুসনাদে বাযযারে এসেছে,

فقال عمر: فاخترطت سيفي فقلت: يا رسول الله أمكني من حاطب فإنه قد كفر فأضرب عنقه. –مسند البزار = البحر الزخار (1/ 309)، الرقم: 197، قال البوصري في إتحاف الخيرة المهرة (7\267، الرقم: 6823): رواه أبو يعلى والبزار بسند صحيح. اهـ وقال الهيثمي (مجمع الزوائد: 15662) : رواه أبو يعلى في الكبير والبزار والطبراني في الأوسط باختصار ورجالهم رجال الصحيح. اهـ

“ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, আমি তরবারি কোষমুক্ত করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অনুমতি দিন, হাতিবের গর্দানটা উড়িয়ে দিই। সে কাফের হয়ে গেছে।” -মুসনাদে বাযযার: ১/৩০৯, হাদীস নং ১৯৭

ইমাম তাবারী রহিমাহুল্লাহ-এর বর্ণনায় এসেছে,

فقام عمر فقال: خان الله ورسوله، ائذن لي أضرب عنقه، فقال النبيّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم: “أَلَيْسَ قَدْ شَهِدَ بَدْرًا؟ ” قال: بلى، ولكنه قد نكث وظاهر أعداءك عليك. -تفسير الطبري = جامع البيان ت شاكر (23/ 312)

“তখন ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, এ লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খিয়ানত করেছে। অনুমতি দিন, এর গর্দানটা উড়িয়ে দিই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে কি বদর যুদ্ধে শরীক ছিল না? ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু এখন সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আপনার শত্রুদেরকে আপনার বিরুদ্ধে সাহায্য করেছে।” -তাফসীরে তাবারী: ২৩/৩১২

আল্লাহ ও রাসূল, ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে কাফেরকে সহায়তা করা কুফর। হাতিব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বাহ্যত এ ধরনের কাজ সংঘটিত হয়েছিল। এর ভিত্তিতে ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু তাকে কাফের সাব্যস্ত করেছেন এবং হত্যার অনুমতি চেয়েছেন। এ হিসেবে ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর অবস্থান সঠিক ছিল। তবে হাতিব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর যে ওজর বা তাবীল ছিল তা তিনি জানতেন না। এ প্রতিবন্ধকটি বিদ্যমান থাকার কারণে হাতিব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু কাফের হননি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তার ঈমানের সাক্ষী। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর তাকফীর ভুল ছিল। এতদসত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কিছু বলেননি। কারণ, তিনি সহীহ ইজতিহাদের ভিত্তিতে তাকফীর করেছিলেন।

খাত্তাবী রহিমাহুল্লাহ (৩৮৮হি.) বলেন,

وفيه دليل على أن من كفر مسلما أو نفقه على سبيل التأويل وكان من أهل الاجتهاد لم تلزمه عقوبة. ألا ترى أن عمر رضي الله عنه قال دعني أضرب عنق هذا المنافق وهو مؤمن قد صدقه رسول الله صلى الله عليه وسلم فيما ادعاه من ذلك ثم لم يعنف عمر فيما قاله. وذلك أن عمر لم يكن منه عدوان في هذا القول على ظاهر حكم الدين إذ كان المنافق هو الذي يظهر نصرة الدين في الظاهر ويبطن نصرة الكفار وكان هذا الصنيع من حاطب شبيها بأفعال المنافقين إلاّ أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قد أخبر أن الله تعالى قد غفر له ما كان منه من ذلك الصنيع وعفا عنه فزال عنه اسم النفاق والله أعلم. -معالم السنن (2/ 275)

“এই হাদীস প্রমাণ করে, ইজতিহাদের যোগ্য কোনো ব্যক্তি তাবীলের ভিত্তিতে কোনো মুসলিমকে কাফের বা মুনাফিক আখ্যা দিলে ওই তাকফীরকারীর ওপর কোনো শাস্তি বর্তাবে না। তুমি কি দেখো না যে, ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেছেন, ‘অনুমতি দিন এ মুনাফিকের গর্দানটা উড়িয়ে দিই’ অথচ তিনি (হাতিব বিন আবু বালতাআ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) মুমিন ছিলেন। (মুনাফিক ছিলেন না।) তিনি যে (ওজরের) দাবি করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেক্ষেত্রে তাকে সত্যবাদী বলেছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর প্রতি কোনো কঠোরতা করেননি। কারণ, ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু যা বলেছেন বাহ্যত শরীয়তের বিধান অনুযায়ী, তাতে কোনো সীমালঙ্গন ছিল না। কারণ, স্বাভাবিক মুনাফিকই এমন হয়ে থাকে যে, বাহ্যত তো দ্বীনের নুসরত করছে দেখায় কিন্তু ভিতরে ভিতরে কাফেরদের নুসরত করে। হাতিব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর এ কাজটি মুনাফিকদের কাজের সদৃশ ছিল। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন, তার থেকে যে কাজটি প্রকাশ পেয়েছে আল্লাহ তাআলা তা মাফ করে দিয়েছেন। কাজেই তাকে মুনাফিক বলা যায় না।” -মাআলিমুস সুনান: ২/২৭৫

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ (৭৫১হি.) বলেন,

وفيها: أن الرجل إذا نسب المسلم إلى النفاق والكفر متأولا وغضبا لله ورسوله ودينه لا لهواه وحظه، فإنه لا يكفر بذلك، بل لا يأثم به، بل يثاب على نيته وقصده، وهذا بخلاف أهل الأهواء والبدع، فإنهم يكفرون ويبدعون لمخالفة أهوائهم ونحلهم، وهم أولى بذلك ممن كفروه وبدعوه. -زاد المعاد في هدي خير العباد (3/ 372)

“এই ঘটনা থেকে বুঝা গেল, কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ, রাসূল ও দ্বীনের প্রতি গায়রতবশত কোনো মুসলিমকে মুনাফিক বা কাফের বলে; প্রবৃত্তি বা স্বার্থের কারণে নয়- তাহলে এ কারণে তিনি কাফের হবেন না। এমনকি গুনাহগারও হবেন না। বরং নেক নিয়ত ও সদিচ্ছার কারণে সাওয়াব পাবেন। কিন্তু বিদআতী ও প্রবৃত্তিপূজারিদের অবস্থাটা ব্যতিক্রম। কারণ, তারা কেবল নিজেদের প্রবৃত্তি ও মতাদর্শের বিরোধিতা করলেই কাউকে কাফের ও বিদআতী বলে দেয়। অথচ যাদের তারা কাফের বা বিদআতী বলছে, তাদের তুলনায় তারা নিজেরাই এর অধিক উপযুক্ত।” -যাদুল মাআদ: ৩/৩৭২

দ্বিতীয় দলীল: খারেজী সম্প্রদায়

খারেজীরা সাহাবায়ে কেরামসহ প্রায় গোটা মুসলিম উম্মাহকেই তাকফীর করেছে। এতদসত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী গ্রহণযোগ্য আইম্মায়ে কেরাম তাদের তাকফীর করেননি। কারণ, তারা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে ভুল করেছে। কাফেরদের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াতগুলো মুসলিমদের ওপর প্রয়োগ করেছে। জাহান্নামের শাস্তি সংক্রান্ত কিছু অস্পষ্ট আয়াত ও হাদীস দিয়ে উম্মাহকে তাকফীর করেছে। যেহেতু তারা কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে ভুল করে সংশয়ে পড়ে তাকফীর করেছে, তাই তাদেরকে তাকফীর করা হয়নি।

হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

لما قَتَلَ علي رضي الله عنه الحروريةَ ، قالوا : مَن هؤلاء يا أمير المؤمنين؟ أكفارٌ هُم؟ قال :مِن الكفر فرٌّوا ، قيل : فمنافقين؟ قال : إن المنافقين لا يذكرون الله إلا قليلا ، وهؤلاء يذكرون الله كثيرا ، قيل : فما هم؟ قال : قوم أصابتهم فتنة فعموا فيها وصموا .

“আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন হারুরিয়্যাহ্ (অর্থাৎ খারেজীদের) হত্যা করলেন, তখন তার সমর্থকরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, আমীরুল মুমিনীন? তারা কেমন লোক? তারা কি কাফের? তিনি উত্তর দিলেন, ‘কুফর থেকে তো তারা পলায়ন করেছে’। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে কি তারা মুনাফিক? তিনি উত্তর দিলেন, মুনাফিকরা তো আল্লাহকে কমই স্মরণ করে থাকে। আর এরা তো অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করে। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে তাদের অবস্থা কি? তিনি উত্তর দিলেন, তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা ফিতনায় নিপতিত হয়ে অন্ধ ও বধির হয়ে গেছে।” -মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক: ১৮৬৫৬

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ (৭২৮হি.) বলেন,

فأما من كان في قلبه الإيمان بالرسول وما جاء به وقد غلط في بعض ما تأوله من البدع فهذا ليس بكافر أصلا والخوارج كانوا من أظهر الناس بدعة وقتالا للأمة وتكفيرا لها ولم يكن في الصحابة من يكفرهم لا علي بن أبي طالب ولا غيره بل حكموا فيهم بحكمهم في المسلمين الظالمين المعتدين. –مجموع الفتاوى (7/ 217-218)

“যার অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর আনীত শরীয়তের প্রতি ঈমান আছে, ভুল তাবীল করে কোনো বিদআতে লিপ্ত হয়ে গেলে সে মোটেও কাফের নয়। খারেজীরা সবচেয়ে বড় ধরনের বিদআতে লিপ্ত ছিল। উম্মাহর বিরুদ্ধে কিতাল করতো। উম্মাহকে তাকফীর করতো। এতদসত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরামের কেউ তাদের তাকফীর করতেন না। আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুও না, অন্য কেউও না। বরং অন্য দশজন সীমালঙ্ঘনকারী জালেম মুসলিমের যে বিধান সে বিধানই তাদের ওপর আরোপ করতেন।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ৭/২১৭-২১৮

তাদের কাফের না হওয়ার কারণ হাসকাফী রহিমাহুল্লাহ (১০৮৮হি.) বলেন,

وإنما لم نكفرهم لكونه عن تأويل وإن كان باطلا، بخلاف المستحل بلا تأويل. اهـ

“(মুসলিমদের তাকফীর করা সত্ত্বেও) আমরা তাদের কাফের বলি না, যেহেতু বাতিল হলেও তা তাবীলের ভিত্তিতে হয়েছে। কিন্তু কোনো তাবীল ছাড়াই যারা মুসলিমদের জান-মাল হালাল মনে করে তাদের কথা ভিন্ন (তারা কাফের হয়ে যাবে)।” -আদদুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারের সাথে মুদ্রিত): ৪/২৬৩

ইবনে আবিদীন রহিমাহুল্লাহ (১২৫২হি.) -এর ব্যাখ্যায় বলেন,

لأنه إذا بناه على تأويل دليل من كتاب أو سنة كان في زعمه إتباع الشرع لا معارضته ومنابذته، بخلاف غيره. اهـ

“খারেজী যেহেতু তার এ তাকফীরকে তাবীল করে কুরআন-সুন্নাহর দলীলের ওপর দাঁড় করিয়েছে, তখন তার বিশ্বাস যে, সে শরীয়তের অনুসরণ করছে; শরীয়তের বিরোধিতা বা শরীয়ত প্রত্যাখান করছে না। পক্ষান্তরে যার কোনো তাবীল নেই তার বিষয়টা উল্টো।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/২৬২

***

তাকফীরে ভুল এবং হাফেজ ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২হি.) -এর ফায়সালা সমৃদ্ধ বক্তব্য

তাকফীরে ভুলের সুরত এবং সেগুলোর হুকুম উল্লেখ করে ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ বলেন,

والحاصل أن من أكفر المسلم نظر فإن كان بغير تأويل استحق الذم وربما كان هو الكافر وإن كان بتأويل نظر إن كان غير سائغ استحق الذم أيضا ولا يصل إلى الكفر بل يبين له وجه خطئه ويزجر بما يليق به ولا يلتحق بالأول عند الجمهور وإن كان بتأويل سائغ لم يستحق الذم بل تقام عليه الحجة حتى يرجع إلى الصواب قال العلماء كل متأول معذور بتأويله ليس بآثم إذا كان تأويله سائغا في لسان العرب وكان له وجه في العلم. -فتح الباري لابن حجر (12/ 304)

“মোটকথা, কোনো ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে তাকফীর করলে দেখতে হবে:

ক. যদি কোনো তাবীল ছাড়াই করে থাকে তাহলে সে নিন্দার উপযুক্ত। এমনকি এও হতে পারে যে, সে নিজেই কাফের হয়ে যাবে।

যদি তাবীলের ভিত্তিতে করে থাকে, তাহলে দেখতে হবে:

খ. তাবীলটি যদি এমন হয় যে, এ ধরনের তাবীলের কোনো সুযোগ নেই, তাহলেও নিন্দার উপযুক্ত। তবে কাফের হবে না। ভুলটি ধরিয়ে দেয়া হবে। উপযুক্ত শাস্তিও দেয়া হবে। তবে জুমহুর আইম্মার মতে সে প্রথমোক্ত ব্যক্তির সমান অপরাধী নয়।

গ. আর যদি তাবীলটি এমন হয় যে, এর সুযোগ রয়েছে, তাহলে তিনি নিন্দার উপযুক্ত নন। তবে দলীল প্রমাণ দিয়ে ভুলটি ধরিয়ে দেয়া হবে যাতে ফিরে আসতে পারেন।

উলামায়ে কেরাম বলেন, তাবীল যদি এমন হয় যে, আরবী ভাষানুযায়ী এর সুযোগ আছে এবং ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে এর একটি যথার্থ অবস্থান রয়েছে, তাহলে উক্ত তাবীলকারী গুনাহগার হবে না; তাকে মাযুর ধরা হবে।” -ফাতহুল বারী: ১২/৩০৪

***

‘মুসলিমকে তাকফীর করলে নিজের ওপর কুফর বর্তাবে’ কথাটির ব্যাখ্যা

আমরা দেখলাম সহীহ তাকফীর কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত বিধান এবং এটিই সাহাবায়ে কেরামের তরীকা। এটিও দেখলাম যে, তাকফীরে দ্বিমত হতে পারে, ভুলও হতে পারে। শরয়ী দলীলের আলোকে ইজতিহাদ করে তাকফীর করলে ভুল হলেও তাকফীরকারী কাফের হবে না। তবে ইজতিহাদের শর্ত রক্ষা করে যোগ্য ব্যক্তি তাকফীর করলে ভুল হলেও সাওয়াব পাবেন। পক্ষান্তরে অযোগ্য লোক কিংবা যথাযথ শর্ত রক্ষা না করে তাকফীর করলে কাফের না হলেও গুনাহগার হবে। যেমনটা খারেজীদের বেলায় ঘটেছে। তাহলে যেসব হাদীসে অন্য মুসলিমকে কাফের বললে নিজের ওপর কুফর বর্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেসব হাদীসের কি ব্যাখ্যা?

এর ব্যাখ্যা হল,

.

হাদীসটি ওইসব তাকফীরকারীর বেলায় প্রযোজ্য হবে, যারা কোনো লোককে সুস্পষ্ট মুসলিম জানা সত্ত্বেও এবং কাফের নয় পরিষ্কার জানার পরও কাফের আখ্যায়িত করে। কোনো প্রকার দলীল বা তাবীল না থাকার পরও তাকে মুরতাদ আখ্যায়িত করে। এ ধরনের তাকফীরকারী নিজেই কাফের হয়ে যাবে।

হাফেজ ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২হি.) বলেন,

وأرجح من الجميع أن من قال ذلك لمن يعرف منه الإسلام ولم يقم له شبهة في زعمه أنه كافر فإنه يكفر بذلك. -فتح الباري لابن حجر (10/ 466)

“সবচেয়ে অগ্রগণ্য ব্যাখ্যা হল, যে ব্যক্তি কারও ব্যাপারে পরিষ্কার জানে যে সে মুসলিম, এতদসত্ত্বেও তাকে কাফের আখ্যায়িত করে অথচ সে কাফের বলে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার মতও কোনো কিছু তার মাঝে দেখতে পায়নি- এমন ব্যক্তি নিজেই কাফের হয়ে যাবে।” -ফাতহুল বারী: ১০/৪৬৬

.

পক্ষান্তরে যারা ঝগড়া-বিবাদ করতে গিয়ে কোনো মুসলিমকে ‘তুই একটা কাফের’, ‘এই কাফেরের বাচ্চা’ ইত্যাদি বলে গালি দেয়; আসলে তাকফীর করা উদ্দেশ্য থাকে না; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ঝগড়া-বিবাদেও যেন কোনো মুসলিমকে কাফের না বলে। কারণ, এভাবে কাফের বলার দ্বারা যদি নিজে কাফের নাও হয়, মুসলিমকে কাফের বলে গালি দেয়ার গুনাহ তো অবশ্যই বর্তাবে। আর এও অসম্ভব নয় যে, এভাবে অন্যকে অহেতুক কাফের বলার কারণে আল্লাহ তাআলা এক সময় স্বয়ং তাকেই কাফের বানিয়ে দেবেন।

হাফেজ ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২হি.) বলেন,

والتحقيق أن الحديث سيق لزجر المسلم عن أن يقول ذلك لأخيه المسلم.  -فتح الباري لابن حجر (10/ 466)

“তাহকীকী কথা হচ্ছে, কোনো মুসলিম তার কোনো মুসলিম ভাইকে এ ধরনের কথা বলা থেকে বারণ রাখার জন্য হাদীসটি বলা হয়েছে।” -ফাতহুল বারী: ১০/৪৬৬

ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ (৬৭৬হি.) বলেন-

معناه أن ذلك يؤول به إلى الكفر وذلك أن المعاصي كما قالوا بريد الكفر ويخاف على المكثر منها أن يكون عاقبة شؤمها المصير إلى الكفر”. –شرح مسلم للنووي 2\50، ط: دار إحياء التراث العربي – بيروت

“হাদীসটির অর্থ হল, কোনো মুসলমানকে কাফের বলা বক্তাকে কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। উলামায়ে কেরাম বলেন, গুনাহ কুফরীর বার্তাবাহী। বেশি বেশি গুনাহকারীর ব্যাপারে আশঙ্কা আছে যে, গুনাহের মন্দ পরিণাম তাকে কুফর পর্যন্ত পৌঁছে দিবে।” -শরহে মুসলিম: ২/৫০

উপর্যুক্ত আলোচনা ও হাদীসের ব্যাখ্যা থেকে বুঝা গেল,

যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে এমন কোনো কথা বা কাজ করতে দেখেছে যা তার কাছে শরয়ী দলীলের আলোকে কুফর মনে হয়েছে, আর সে ভিত্তিতে তাকে তাকফীর করেছে, তাহলে তাকফীরকারী কাফের হবে না। তবে উক্ত কথা কাজকে কুফর মনে করা এবং এর ভিত্তিতে তাকফীর করার ক্ষেত্রে তিনি সঠিকও হতে পারেন, ভুলও হতে পারেন। ভুল হলে সাওয়াবও পেতে পারেন, গুনাহগারও হতে পারেন। তবে কাফের হবেন না। কাফের হবে কেবল তখনই যখন কোনো ইজতিহাদ, কোনো তাবীল ছাড়া সম্পূর্ণই বিনা দলীলে তাকফীর করে। কেননা, এ ধরনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে তাকফীর করা হলেও তা গিয়ে পড়ছে ইসলাম ধর্মের আকীদা ও বিধি-বিধানের ওপর। তাকে তাকফীর করার অর্থ, যে ইসলামী আকীদা সে পোষণ করে তাকে কুফর সাব্যস্ত করা। কোনো প্রকার দলীল, তাবীল ও ইজতিহাদ ছাড়া যে ব্যক্তি এ ধরনের কথা বলবে সে কাফের না হয়ে উপায় কি? ওয়াল্লাহু আলাম।

বি.দ্র. গালি-গালাজ করে কাফের বললে কাফের হবে না

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এও বুঝা গেল, গালি-গালাজ করে কোনো মুসলিমকে কাফের বলা মূলত তাকে তাকফীর করা নয়। ঠিক যেমন কেউকে কুকুর বলে গালি দিলে আসলেই সে কুকুর, মানুষ নয়- এটি উদ্দেশ্য হয় না। তাকফীর অর্থ হচ্ছে তার ব্যাপারে এ ফায়সালা দেয়া যে, সে মুরতাদ হয়ে দ্বীনে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। এখন তার ওপর মুরতাদের হুকুম আহকাম বর্তাবে। যেমন, হত্যা করতে হবে, স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে, আখিরাতে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে ইত্যাদি।

ইমাম গাযালী রহিমাহুল্লাহ (৫০৫হি.) বলেন,

التكفير حكم شرعي، يرجع إلى إباحة المال، وسفك الدم، والحكم بالخلود في النار. -فيصل التفرقة بين الإسلام والزندقة، ص: 66، ت: محمود بيجو

“তাকফীর একটি শরয়ী হুকুম, যার ফলাফল দাঁড়াবে: জান-মাল হালাল গণ্য করা এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী ফায়সালা দেয়া।” –ফায়সালুত তাফরীকা বাইনাল ইসলাম ওয়াযযানদাকা: ৬৬

গালি-গালাজে এমনটা উদ্দেশ্য থাকে না। তাই তা তাকফীর নয়। এতে গালিদাতা কাফের হবে না।

ইবনে আবিদীন রহিমাহুল্লাহ (১২৫২হি.) বলেন,

قال في النهر: وفي الذخيرة المختار للفتوى أنه إن أراد الشتم ولا يعتقده كفرا لا يكفر وإن اعتقده كفرا فخاطبه بهذا بناء على اعتقاده أنه كافر يكفر؛ لأنه لما اعتقد المسلم كافرا فقد اعتقد دين الإسلام كفرا. اهـ. –الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (4/ 69)

“আননাহরুল ফায়িক গ্রন্থকার বলেন, যাখিরা কিতাবে বলা হয়েছে, এ কথার ওপর ফাতওয়া যে, যদি কাফের বলার দ্বারা গালি উদ্দেশ্য নেয়, বাস্তবেই কুফর- এমন উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে গালিদাতা কাফের হবে না। পক্ষান্তরে যদি তার বিশ্বাসই হয় যে তা কুফর এবং এর ওপর ভিত্তি করেই তাকে কাফের বলে সম্বোধন করে, তাহলে কাফের হয়ে যাবে। কারণ, সে যখন মুসলিমকে কাফের জ্ঞান করছে, এর অর্থ দ্বীনে ইসলামকে কুফর জ্ঞান করছে।” – রদ্দুল মুহতার: ৪/৬৯

অর্থাৎ যখন কোনো প্রকার তাবীল ও ইজতিহাদ ছাড়া কাফের বলবে। তখন এ হুকুম। যেমন ওপরে আলোচনা করা হয়েছে।

সারকথা

  • কাফেরকে কাফের সাব্যস্ত করা এবং তার ওপর কুফরের হুকুম-আহকাম জারি করা কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ এবং সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইনের সীরাত ও তরীকা। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা উভয়টাই পরিত্যাজ্য।
  • তাকফীর শরীয়তের অন্য দশটা বিষয়ের মতোই একটি বিষয়। তাতে দ্বিমত হতে পারে, ভুলও হতে পারে। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমরা এলোপাতাড়ি তাকফীর শুরু করে দেব। যার ব্যাপারে নিশ্চিত জানা ছিল যে সে মুসলমান, অকাট্য দলীল ছাড়া তাকে ইসলাম থেকে বের করা যাবে না। অন্যথায় নিজেই কাফের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
  • ইজতিহাদ ও তাবীলের ভিত্তিতে তাকফীর করলে তাকফীরকারী কাফের হবে না। তবে যোগ্য লোক হলে এবং সহীহ তরীকায় কুরআন-সুন্নাহ মতে ইজতিহাদ হলে তাকফীরকারী একগুণ সাওয়াব পাবেন। অন্যথায় গুনাহগার হবে। তবে কাফের হবে না। তবে লাগামহীন তাকফীর এক সময় তাকফীরকারীকে কুফর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। তাই হাদীসে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যেন কোনো মুসলিমকে কাফের বলতে খুব হিসেব-নিকেশ করে বলা হয়। যেমন অন্যায়ভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা ভয়ানক অপরাধ। এমনকি তা এক সময় ব্যক্তিকে কাফেরে পরিণত করতে পারে। তাই হাদীসে এ ব্যাপারে কঠিন ধমকি ও হুঁশিয়ারি এসেছে।
  • কাউকে সুস্পষ্ট মুসলিম জানার পরও এবং কাফের হয়নি পরিষ্কার বুঝার পরও তথা কোনো প্রকার দলীল, তাবীল ও ইজতিহাদ ছাড়াই তাকফীর করলে তাকফীরকারী কাফের হয়ে যাবে। কারণ, তখন সে ঈমানকে কুফর সাব্যস্ত করছে এবং কুরআন-সুন্নাহর অসংখ্য নুসুস প্রত্যাখ্যান করছে, যা সুস্পষ্ট কুফর। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সুস্পষ্ট কাফেরকেও আমরা কাফের বলব না। বরং এ ধরনের লোককে তাকফীর করা আবশ্যক। নয়তো সমাজে ঈমান কুফরের সীমা ঠিক থাকবে না। মানুষ কুফরকে কুফর জ্ঞান না করে তাতে লিপ্ত হয়ে ঈমান হারাবে। এ বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত শিথিলতার ফলে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সমাজে ব্যাপকভাবে ভ্রান্ত ইরজায়ী আকীদা ছড়িয়ে পড়েছে। আজীবন হাজারো রকমের নাফরমানী ও কুফর-শিরক করার পরও নিজেকে মুমিন ভাবছে। কারণ, কেউ তাকে তাকফীর করছে না। এভাবে মানুষ ঈমানহারা হচ্ছে। তাই তাকফীরে শিথিলতাও কাম্য নয়, যেমন বাড়াবাড়ি কাম্য নয়।

***

[1] ইরজায়ি আকিদা : আমল না করেও এবং গুনাহে লিপ্ত থেকেও ঈমান ঠিক আছে মনে করার নাম হল, ইরজা। আপনি অনেককে বলতে শুনবেন, নামায না পড়লেও ঈমান ঠিক আছে!! এটি ইরজায়ি আকিদার কুফল। আমল না করলে ঈমান ঠিক থাকতে পারে না। কিন্তু ইরজাগ্রস্ত লোকেরা আমল না করেও ঈমান ঠিক আছে মনে করে।

ইরজার একটি ভয়াবহ স্তর হচ্ছে, কুফর শিরকে লিপ্ত থাকার পরও শুধু মনের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নিজেকে ঈমানদার মনে করা। এ কারণে অনেক রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবি বরং অনেক কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী; যারা অহরহ কুফরি কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছে, কুফরি কাজ-কর্ম করে যাচ্ছে: তারাও নিজেদের মুসলমান মনে করে। এটি ইরজায়ি আকিদার ভয়াবহ কুফল। প্রচ্ছন্নভাবে অনেক ওলামা তুলাবার মাঝেও এ আকিদা বিস্তার লাভ করেছে। ফলে শুধু মুখে মুখে নিজেদের মুসলিম দাবি করে বলে অনেক সুস্পষ্ট মুরতাদকেও তারা মুরতাদ বলতে সাহস করে না।–দেখুন, মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া : ৭/১৮৮-১৯০

Related Articles

Back to top button