উস্তায হামজা আব্দুর রহমানলিবারেলিজম

নব্য জাহেলিয়াতের মূর্তি: লিবারেলিজম

নব্য জাহেলিয়াতের মূর্তি: লিবারেলিজম

উস্তাদ হামজা আব্দুর রাহমান হাফিজাহুল্লাহ

 

জাহেলি যুগে আরবের মুশরিকরা অসংখ্য মূর্তির উপাসনা করতো। তিনশ ষাটটির মতো মূর্তি তারা বাইতুল্লাহর অভ্যন্তরে এবং এর আশাপাশে স্থাপন করে রেখেছিল। তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় মূর্তিটি ছিল হুবাল। হুবালের পর তাদের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল তিনটি নারী মূর্তি – লাত, মানাত ও উযযা।  

বর্তমানেও আমরা দেখতে পাই, আরব্য জাহেলিয়াতের মতো নব্য জাহেলিয়াতেরও তিন মূর্তি রয়েছে। গণতন্ত্র, সেকুলারিজম ও লিবারেলিজম। জাহেলি যুগে যেমন তখনকার মুশরিকদের আকিদা-বিশ্বাসে লাত, মানাত ও উযযা একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল ঠিক তেমন নব্য জাহেলিয়াতের তিন মূর্তিও একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের আজকের আলোচনা এই ত্রিমূর্তির সর্বশেষটিকে নিয়ে।

 

পরিচয়

লিবারেলিজমের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এসব সংজ্ঞায় নানা পরিবর্তনও এসেছে। বিভিন্ন ধ্যানধারণা, ব্যাখ্যা, প্রয়োগের নীতি যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে লিবারেলিজম শব্দটি দ্বারা নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক দর্শন ইত্যাদি বুঝানো হয়ে থাকে। যেমন অর্থনীতিশাস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে অর্থনৈতিক উদারনৈতিকতাবাদ (Economic Liberalism) কিংবা উদারনৈতিক পুঁজিবাদ (Liberal Capitalism) বলা হয়। এই নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আগত পলিসিকে লিবারেল বলা হয়। একইভাবে বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারাকে উদারনৈতিক বা লিবারেল রাজনীতি বলা হয়। যেমন আমেরিকার দুই প্রধান দলের মধ্যে অনেকে রিপাবলিকান দলকে রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল এবং ডেমোক্রেটিক দলকে লিবারেল আখ্যায়িত করে। একইভাবে কেউ হয়তো ব্রিটেনের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে টোরি পার্টিকে রক্ষণশীল এবং লেবার পার্টিকে লিবারেল বলতে পারেন। তেমনিভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকে আওয়ামী লীগকে তুলনামূলকভাবে লিবারেল এবং বিএনপিকে রক্ষনশীল ও জাতীয়তাবাদী ধারার বলে থাকেন।

এই প্রবন্ধে আমরা যখন ‘লিবারেলিজম বা লিবারেল’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি, তখন উপরোক্ত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা রাজনৈতিক ধারাকে বুঝাচ্ছি না। লিবারেলিজম বলতে আমরা বুঝাচ্ছি একটি বৃহত্তর নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনকে, যে দর্শনের জন্ম হয়েছে ইউরোপের রেনেসা, প্রটেস্টান্ট রিফরমেশন ও এনলাইটেনমেন্টের গর্ভ থেকে। আমরা যে বৃহত্তর অর্থে লিবারেলিজম নিয়ে আলোচনা করছি সে দিক থেকে রিপাবলিকান-ডেমোক্রেট, টোরি-লেবার, আওয়ামী-বিএনপি- সকলেই লিবারেল ধারার অনুসারী। আধুনিক পশ্চিমা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে কাঠামো আজ আমরা দেখি মোটাদাগে তার পুরোটাই লিবারেল।  

লিবারেল দর্শনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (individualism), ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সমানাধিকারের নীতি। এই মূলনীতিগুলো থেকে পরবর্তী সময় বাকস্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা বা মুক্তচিন্তা, যৌনতার স্বাধীনতা, লৈঙ্গিক সমতার মতো বিভিন্ন ধারণা উদ্ভূত হয়। বর্তমানে লিবারেলিজমের ধারণার সাথে ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ এবং সেক্যুলার শাসন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে লিবারেলিজমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ছিল ব্রিটিশ থমাস হবস (মৃত্যু. ১৬৭৯ ইং) ও জন লক (মৃত্যু. ১৭০৪ ইং)। তারা সর্বপ্রথম ব্যক্তির কর্মের চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এবং সামাজিক চুক্তি তথা সোশাল কন্ট্রাক্টের ধারণাকে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করে। এর মধ্যে জন লককে অনেকেই সর্বপ্রথম লিবারেল দার্শনিক হিসাবে গণ্য করে থাকে। পরে ফরাসী বিল্পবের মাধ্যমে লিবারেলিজম প্রথম বারের মতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্যায়ের লিবারেলিজমের সাথে লিবারেলিজমের আজকের চেহারার বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। তবে উভয়ের মৌলিক কাঠামো এক। ভলতেয়ার (মৃত্যু. ১৭৭৮ ইং) ও রুশোর (মৃত্যু. ১৭৭৮ ইং) মতো ফরাসী দার্শনিকরা এই পর্যায়ে লিবারেল দর্শনে নতুন কিছু মাত্রা যোগ করে। বিশেষ করে জনমত, সরকার এবং ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু ধারণা যুক্ত হয় যা পরবর্তীতে লিবারেল দর্শনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠে। পরবর্তী সময় ইমানুয়েল কান্ট (মৃত্যু. ১৮০৪ ইং), বেন্থাম (মৃত্যু. ১৮৩২ ইং), জন স্টুয়ার্ট মিলসহ (মৃত্যু. ১৮৭৩ ইং) বিভিন্ন ইউরোপীয় এবং আমেরিকান দার্শনিক লিবারেল দর্শনের ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে।

 

লিবারেল দর্শনের বৈশিষ্ট্য

লিবারেল দর্শনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে, যা তালিকা আকারে নির্দিষ্ট করা কঠিন। তবুও আলোচনার স্বার্থে আমরা এখানে লিবারেল দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছি –

১। ব্যক্তি মানুষ স্বাধীন ও সার্বভৌম। ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর কোন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ সমর্থনযোগ্য নয়। সেটা হোক ধর্ম বা সমাজ কিংবা রাষ্ট্র।

২। ব্যক্তি ও তার ইচ্ছা সার্বভৌম। কোন মালিকের অধীনস্ত নয়।

৩। মানবীয় বিচারবুদ্ধি, যুক্তি ও বিজ্ঞান সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। সকল সত্য মানবীয় বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে অর্জনীয়। এর বাইরে আর কিছু নেই।

৪। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে – ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে – ব্যক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

৫। ধর্মীয় স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার ধারণা। অর্থাৎ একজন মানুষের জন্য সব ধরনের বিশ্বাস, সব ধরনের যৌনতা, সব ধরনের কথা, সব ধরনের চিন্তা বৈধ।

৬। সমানাধিকার। আইনের চোখে সকলে সমান। একজন মুসলিম ও একজন কাফির এক সমান, নারীপুরুষের বিবাহ এবং সমকামিদের বিবাহ সমান।

৭। ক্ষতি তত্ত্ব – হার্ম প্রিন্সিপল। ব্যক্তির কোন কাজের দ্বারা যদি সে আনন্দ লাভ করে এবং এতে অপর কোন ব্যক্তির ক্ষতি না হয়, তাহলে তা বৈধ।

৮। প্রতিটি মানুষের সুনির্দিষ্ট ও অবিচ্ছেদ্য কিছু অধিকার আছে।

৯। মানুষের এ অধিকারগুলো সংরক্ষণের জন্যই পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হয়।

১০। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কটি হল একটি চুক্তি।

১১। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উপায় হল আইন, হুকুম নয়। 

১২। নারী অধিকার ও লৈঙ্গিক সমতা (নারীবাদী ব্যাখ্যা অনুযায়ী)

 

এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অনেকগুলো অন্যান্য দর্শন থেকে গ্রহণ করা, যেমন ক্ষতি তত্ত্ব/হার্ম প্রিন্সিপাল উপযোগবাদী দর্শনের অংশ। তবে অন্যান্য দর্শনের মাধ্যমে আবির্ভাব ঘটলেও কালক্রমে এই বিষয়গুলো লিবারেল দর্শনের অংশে পরিণত হয়েছে। লিবারেল দর্শনের আরও অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না।

 

লিবারেল দর্শনের প্রকৃত অর্থ

ওহির আলোকে গভীর অধ্যায়ন এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, বিভিন্ন সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা এবং ভাষার চাতুর্যপূর্ণ ব্যবহারের আড়াল থেকে লিবারেলিজমের প্রকৃত রূপ চিহ্নিত করা যায়।

বস্তুত লিবারেলিজম এমন এক দর্শন যা মানুষের ওপর দেবত্ব আরোপ করে। লিবারেল দর্শন ‘স্বাধীনতা’ বলতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইবাদত ও আনুগত্য থেকে বের হয়ে নিজের নফস ও খেয়ালখুশির দাসত্ব করাকে বুঝায়। এই দর্শন মনে করে মানুষ স্বাধীন, সার্বভৌম এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার কোনো রব বা প্রতিপালকের প্রয়োজন নেই। রবের নির্দেশনা মানারও প্রয়োজন নেই। সে নিজেই নিজের রব। সে নিজের জন্য যা ভালো মনে করবে তাই হবে ভালো আর যা সে খারাপ মনে করবে তাই হবে মন্দ। 

তাদের দৃষ্টিতে ওই ব্যক্তিই হল স্বাধীন যে সকল বিশ্বাস ও বিধিবিধানের উর্ধে উঠে লিবারেল মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরতে পেরেছে এবং এ মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক সব কিছুকে ছুড়ে ফেলে দিতে পেরেছে।

এই দর্শনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আনুগত্য করা এবং তাঁর আইন মেনে চলার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং এমন করা হল এক প্রকারের দাসত্ব। স্বাধীন লিবারেল যে কোন ব্যক্তি এসব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করে। সে নিজেই নিজের জন্য আইন বানায়। লিবারেল দার্শনিকদের মতে লিবারেল মানুষের রচিত আইনের ওপরে অন্য কোন আইন হতে পারে না। হবস থেকে রুশো পর্যন্ত সকল দার্শনিকদের মধ্যে এ বিশ্বাস বিরাজমান ছিল।

যা কিছু ব্যক্তির পছন্দ, যা কিছু তার মনকে সুখী করবে, তার খেয়ালখুশিকে পরিতৃপ্ত করবে, লিবারেল দর্শনের মতে তা সবই বৈধ। নিজের সুখ, সন্তুষ্টি, পরিতৃপ্তি হল সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। লিবারেলিজম এমন একটি দর্শন যা সকল মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। লিবারেলিজমের প্রথম ধাপই হল আসমানী ও প্রাকৃতিক বিধানকে অস্বীকার করা। 

 

লিবারেল দর্শন মানবীয় বুদ্ধি ও বিবেচনাকে সার্বভৌম মনে করে। এই দর্শন মনে করে মানবীয় বিবেচনা, চিন্তা এবং যুক্তির উর্ধে আর কোন সত্য নেই। প্রত্যেক মানুষের জন্য ভালোমন্দ ও নৈতিকতার মাপকাঠি হল তার নিজের মন, তার যুক্তি, তার স্বার্থ। আর সামাজিকভাবে নৈতিকতা ও কল্যাণের মাপকাঠি হল সমাজের সকলের সামষ্টিক সিদ্ধান্ত। তাদের স্বার্থ। আধুনিক ব্যক্তি যেসব মূল্যবোধকে পবিত্র মনে করে সেগুলোই চূড়ান্ত। নৈতিকতার মানদন্ড তৈরি হবে সমাজের স্বাধীন ব্যক্তিদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। অন্য সকল নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে আধুনিক লোকদের ঠিক করা এই মূল্যবোধের আলোকে যাচাই করতে হবে। ধর্মকেও যাচাই করতে হবে আধুনিক লোকদের বাছাই করা এই মূল্যবোধের আলোকে। কাজেই অধিকাংশ লোক কোন কিছুকে বৈধ বললে তা হবে বৈধ এবং অবৈধ বলে তা হবে অবৈধ। অধিকাংশরা কোন কিছুকে ভালো বললে ওটা হবে ভালো। মন্দ বললে হবে মন্দ। 

বলাবাহুল্য লিবারেল সমাজে অধিকাংশের চিন্তাভাবনা চালিত হয় লিবারেল মূল্যাবোধের কাঠামোর ভিতরে। লিবারেল দর্শন কার্যত শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্র, ও সমাজ থেকে নৈতিকতাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের সকল বোধ জনপরিসর থেকে অপসারিত হয়। সেই জায়গা দখল করে লিবারেল মূল্যবোধ। লিবারেলিজম তার নিজস্ব নৈতিকতা, মূল্যবোধ, শিল্প, ফ্যাশন, সাহিত্য, আইন এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করে।

অধিকাংশ জনগণের চাহিদা অনুযায়ী লিবারেল সমাজে কখনো সমকামিতা অবৈধ হতে পারে আবার কখনো বৈধ। কখনো মদ অবৈধ হতে পারে, কখনো বৈধ। আবার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যিনা বৈধ হলেও লিবারেল মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হবার কারণে ১৮ কিংবা ১৬ বছরের নিচে বিয়ে অবৈধ। বহুগামীতা, লিভ টুগেদার এবং একাধিক বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড কালচার ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তর্ভূক্ত হলেও আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বহুবিবাহ অপরাধ। গণতন্ত্র কিংবা নারী অধিকার চাপিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধ করা মহৎ কাজ হলেও আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করা সন্ত্রাস।

 

মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিস্টানরা খ্রিষ্ট ধর্ম রক্ষা ও প্রচারের নামে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করেছিল। ইতিহাসের পাতায় ইউরোপের এ আগ্রাসন ক্রুসেড নামে পরিচিত। মধ্যুযগের ক্রুসেডের অনুকরণে আধুনিক যুগের নব্য ক্রুসেডাররা তাদের লিবারেল ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করছে। গণতন্ত্র, নারী অধিকার, স্বাধীনতা আর সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মুসলিমকে হত্যা করছে।

বাস্তবতা হল লিবারেলিজম এমন এক দর্শন যা মানুষকে ইলাহ বানায়। এই দর্শন প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের ইলাহ বানায়। নিজের খেয়াল, নিজের বুঝ, নিজের বিবেকই সব। বাকি আর কিছুই ধর্তব্য নয়। এভাবে লিবারেলিজম মূলত মানুষের প্রবৃত্তি ও নফসের ওপর উলুহিয়াত আরোপ করে।

 

তাই ওহির আলোকে দেখলে আমরা লিবারেলিজমের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোকে এভাবে লিখতে পারি –

১। মহান আল্লাহর আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে নিজের খেয়ালখুশিকে ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করা।

২। সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর আনুগত্য ও বিধান প্রত্যাখ্যান করা। লিবারেল মূলনীতি অনুযায়ী অধিকাংশের খেয়ালখুশিকে বিধানদাতা হিসাবে গ্রহণ করা।

৩। স্বাধীন হওয়ার নামে আকিদা, আমল এবং মূল্যবোধের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত পথকে প্রত্যাখ্যান করা।

৪। ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো-মন্দের কোন ধ্রুব মাপকাঠি নেই। যে যুগের মানুষের কাছে যা ভালো লাগবে তাই তারা গ্রহণ করবে।

 

 

আল্লাহদ্রোহীতা

বিশ্বাস ও কর্ম, উভয় দিক থেকে লিবারেলিজম হল মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। বিশ্বাসগতভাবে এটি হল কুফর ও শিরকে আকবর। লিবারেল মতাদর্শী প্রথমে আল্লাহর কর্তৃত্ব, আনুগত্য এবং বিধানাবলীকে প্রত্যাখ্যান করে। এরপর সেখানে সে বসায় নিজের নফস ও খেয়ালখুশিকে। জীবন চলার ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখাকে অস্বীকার করে সে নিজেই নিজের জন্য সীমারেখা ঠিক করে। আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে নিজের খেয়ালখুশি ও নফসের আনুগত্য করে। বিশ্বাসগত দিক থেকে লিবারেলিজম ঈমান ও তাওহিদের মূলকেই অস্বীকার করে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-‘আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই’ এর পরিবর্তে লিবারেলজিম গ্রহণ করে ‘লা ইলাহা ইল্লান্নাস’-‘জনগণ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই’ এই কালেমা। লিবারেল মতাদর্শীদের বাস্তবতা ফুটে উঠেছে আল্লাহ তাআলার এই কথায়- 

أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَـٰهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّـهُ عَلَىٰ عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِن بَعْدِ اللَّـهِ ۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

তুমি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছ, যে তার খেয়াল-খুশিকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন আর তার কানে ও দিলে মোহর মেরে দিয়েছেন আর তার চোখের উপর টেনে দিয়েছেন পর্দা। অতঃপর আল্লাহর পর আর কে (আছে যে) তাকে সঠিক পথ দেখাবে? এরপরও কি তোমরা শিক্ষাগ্রহণ করবে না? -সুরা জাসিয়াহ (৪৫) : ২৩

কর্মের দিক থেকেও লিবারেলিজম আল্লাহর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। কারণ তা শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হারাম হালালের সীমানাকে লঙ্ঘনই করে না, বরং হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম করে। লিবারেল দর্শন  আল্লাহর বিধানকে কেবল অস্বীকারই করে না, বরং মানবীয় বিচারবুদ্ধিকে আল্লাহর বিধানের উর্ধে স্থান দেয়। এটি আল্লাহর নাযিলকৃত শরীয়ার সর্বনিকৃষ্ট পর্যায়ের প্রত্যাখ্যান। 

চিন্তাগত দিক থেকে লিবারেলিজম চরমপর্যায়ের ভ্রষ্টতা। আজ আমরা এমন এক দুনিয়াতে বাস করছি যেখানে সমকামিতাকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে, সমকামি বিবাহকেও আইনী স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নারী ও পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাকে সম্পূর্ণ উলটে দেয়া হচ্ছে। সব ধরনের যৌনতা, সব ধরনের বিকৃত রুচির কাজকে ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে আল্লাহ ও নবী রসূলগণের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসারটনা ও মিথ্যাচারকে বাকস্বাধীনতার নামে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। মুখে মানবাধিকারের কথা বলে প্রতি বছর কোটি কোটি গর্ভস্থিত শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। শান্তির কথা বলে বিশ্বজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। সমতার কথা বলে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বানানো হয়েছে যা ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক সম্পদের বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে। পরিবার, সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। লিবারেলিজম এমন এক কুৎসিত মতাদর্শ যা জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রকে কলুষিত করে ছেড়েছে।

 

শয়তানী আদর্শ

মানুষ যখন আল্লাহর নির্ধারিত সীমাকে অস্বীকার করে, ভালোমন্দের চিরন্তন মাপকাঠিকে প্রত্যাখ্যান করে কেবল ভোগ বিলাস এবং নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলাকে জীবনের লক্ষ বানিয়ে নেয়, তখন সে আর আশরাফুল মাখলুকাত থাকে না, সে তখন চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট এক প্রাণীতে পরিণত হয়। সে যখন নিজ কামনাবাসনার কাছে আত্মসমর্পণ করে, কামনাবাসনা চরিতার্থ করাকেই জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয় তখন সে তার চাহিদা আর খেয়ালখুশির দাসে পরিণত হয়। আর তখন সে ক্রমাগত সীমালঙ্ঘন আর পাপাচারের সমুদ্রে তলিয়ে যেতে থাকে। 

লিবারেলিজমের দর্শন এমন সমাজ ও সভ্যতা তৈরি করেছে, যার দিকে তাকালে একজন বিবেকবান মানুষ নিঃসন্দেহে একে একটি শয়তানী আদর্শ বলে চিহ্নিত করতে বাধ্য হবে। এই দর্শন ভালোমন্দের সংজ্ঞা উলটে দিয়েছে, আল্লাহর দাসত্বকে নফসের দাসত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখাগুলো লঙ্ঘন করাকে স্বাধীনতা বলে নাম দিয়েছে। এ এমন এক দর্শন যা মানুষকে সত্য থেকে বিচ্যুত করে। সত্যকে মানুষের সামনে কদর্য ও কলুষিত করে তুলে ধরে। লিবারেলিজম বনি আদমকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেছে যা আসমানী হিদায়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের জন্য যে পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন লিবারেলিজম তাদেরকে সে পথ থেকে বিচ্যুত করেছে এবং তাকে নিয়ে গেছে সম্পূর্ণ বিপরীত এক পথে।

মূলত লিবারেলিজম হল শয়তানী আদর্শ। লিবারেলিজমের আজকের বাস্তবতার মাঝে বনি আদমের চিরশত্রু ইবলিসের বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় –

قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ

সে বলল, ‘হে আমার রব, যেহেতু আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তাই যমীনে আমি তাদের জন্য (পাপকে) শোভিত করব এবং তাদের সকলকে পথভ্রষ্ট করব’।-সূরা হিজর (১৫) : ৩৯

লিবারেলিজমের মূল মন্ত্র আর শয়তানী আদর্শ হুবহু এক। দেখুন, লিবারেলিজমের মূল মন্ত্র হল, ‘মানুষের বিবেক সবচেয়ে বড় আদালত’। ‘তোমার যা ভালো লাগে তাই করো’। ‘তুমি নিজেই ভাগ্যবিধাতা, তুমি নিজেই ভালোমন্দ ঠিক করো’। এই ধরনের চিন্তা আধুনিককালে যারা সরাসরি শয়তান উপাসনা করে তাদের দর্শনেরও মৌলিক ভিত্তি।

বর্তমানে লিবারেলিজম যে কুৎসিত এক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে তাতো আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। যিনা-ব্যাভিচার, সমকামিতা, সমকামি বিবাহ, গর্ভপাত, পর্নোগ্রাফিসহ সব ধরনের অশ্লীলতা, নোংরামি এবং কুফর ও শিরক, নাস্তিক্যবাদ, নারী পুরুষের সীমানা মুছে দেয়া, পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া, সামাজিক মূল্যাবোধের অবক্ষয়সহ আর কোন অপকর্মটি বাকি আছে যা এই সভ্যতায় নেই?

 

উপসংহার

লিবারেল মতাদর্শীরা নিজেদেরকে স্বাধীন মনে করে, অথচ আদতে তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের গোলাম। নিজের খেয়ালখুশির গোলামে পরিণত হওয়া এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ। নিয়ন্ত্রনকারী সরকার বা সাম্রাজ্যবাদ কিংবা শয়তান, যেই হোক। লিবারেলিজমের কথিত স্বাধীনতা ব্যক্তিকে খেয়ালখুশির গোলামে পরিণত করে আর সমাজ ও সভ্যতাকে জঘন্য জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। এই দর্শন আজ সারা বিশ্বকে কলুষিত করে ফেলেছে। লিবারেলিজমের এ বিষ জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে বর্তমানে অনেক মুসলমানের চিন্তা চেতনায়ও ঢুকে পড়েছে। ইসলামের জন্য আন্দোলন করার দাবিদাররাও এ থেকে মুক্ত নন। অনেকে আবার ইসলামকে লিবারেলিজমের আদলে বুঝা ও বুঝানোর চেষ্টা করছে।

বর্তমানে লিবারেলিজম ইরতিদাদ ও আল্লাহদ্রোহীতার উৎসমূলে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আমাদের সামনে যেসকল আদর্শিক যুদ্ধ রয়েছে, লিবারেলিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তার মধ্যে অন্যতম একটি। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল অধিকাংশ মুসলমানই এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে একদমই বেখবর। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সব ধরনের ফিতনা সম্পর্ক সঠিক জ্ঞান লাভ করার তাওফিক দান করুন এবং সকল ফিতনা থেকে হেফাজত করুন, আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।

Back to top button