হাকেমিয়্যাহ (শরীয়াহ আইন ও মানবরচিত আইন):ফাতওয়া  নং  ২১৪

তাগুত প্রশাসনের কাউকে কি মাননীয় বলা যাবে?

তাগুত প্রশাসনের কাউকে কি মাননীয় বলা যাবে?

তাগুত প্রশাসনের কাউকে কি মাননীয় বলা যাবে?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্নঃ

তাগুত প্রশাসনের কাউকে কি মাননীয় বলা যাবে? যেমন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্পীকার, মাননীয় বিচারপতি ইত্যাদি।

প্রশ্নকারী- মুহাম্মদ বিজয়

 

উত্তরঃ

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله وحده والصلاة والسلام على من لا نبي بعده أما بعد:

মাননীয় শব্দের অর্থ, যাকে মান্য করা হয়, মান্য করা জরুরি, মান্য করা উচিত কিংবা যিনি মান্যতা পাওয়ার যোগ্য। তাগুতকে যখন উক্ত শব্দে ব্যক্ত করা হবে, তার অর্থ দাঁড়াবে তাকে মান্য করা জরুরি বা মান্য করা চাই। অথচ শরীয়তের বিধান হল, তাগুতকে মান্য করার কোনো সুযোগ নেই; বরং তাকে অমান্য করা, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং অস্ত্র ধরা জরুরি।

قال القاضي فلو طرأ عليه كفرٌ وتغييرٌ للشرع أو بدعةٌ خرج عن حكم الوِلايةِ وسقطت طاعتُه ووجب على المسلمين القيامُ عليه وخَلعُه ونصبُ إمامٍ عادلٍ إن أمكنَهم ذلك، فإن لم يَقَعْ ذلك إلا لطائفةٍ وجبَ عليهم القيامُ بخَلع الكافرِ”.)فَصْلٌ فِي شُرُوطِ الْإِمَامِ الْأَعْظَمِ، تُحفةُ المحتاج 9-75(

“কাযী ইয়ায রহ. (মৃত্যু ৫৪৪ হি.) বলেন, শাসকের উপর যদি কুফর আপতিত হয় এবং সে যদি শরীয়াহ বিনষ্ট করে অথবা বিদ‘আত করে, তবে সে পদচ্যুত হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্যের অপরিহার্যতা শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানদের উপর ফরজ হবে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে অপসারণ করা এবং একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফা নিযুক্ত করা; যদি এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। আর যদি একটা জামাতের পক্ষেই কেবল এটি করা সম্ভব হয়, তবে তাদের উপরই ফরজ হবে কাফেরকে অপসারণের জন্য উঠে দাঁড়ানো।” -তুহফাতুল মুহতাজ: ৯/৭৫; শরহে মুসলিম, ইমাম নববী: ১২/২২৯; হাশিয়াতুশ শিরওয়ানী আলা তুহফাতিল মুহতাজ: ১১/৩৪৭; ইকমালুল মু’লিম: ৬/২৪৬-২৪৭

হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,

ومُلَخَّصُه أنه يَنعَزِلُ بالكفر إجماعا فيجبُ على كل مسلمٍ القيامُ في ذلك، فمن قَوِيَ على ذلك فله الثوابُ، ومن داهن فعليه الإثمُ، ومن عَجَزَ وجبتْ عليه الهجرةُ من تلكَ الأرضِ.

“সারকথা, কুফরীর কারণে শাসক সর্বসম্মতিক্রমে অপসারিত হয়ে যাবে। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যে তাতে সক্ষম হবে, তার জন্য রয়েছে প্রতিদান। যে শিথিলতা করবে, সে গুনাহগার হবে। আর যে অক্ষম হবে, তার উপর ওয়াজিব ঐ এলাকা থেকে হিজরত করা।” – ফাতহুল বারী, কিতাবুল আহকাম: ১৩/১৫৩, দারুস সালাম, রিয়াদ, ১৩/১২৩, দারুল মা’রিফাহ ও মাকতাবায়ে সালাফিয়্যাহ

পক্ষান্তরে তাগুতকে যারা ‘উলুল আমর’ তথা কর্তৃত্বের অধিকারী ও মাননীয় মনে করে, তাদের সম্পর্কে মুফতি কেফায়াতুল্লাহ রহ. (১৩৭২ হি.)র একটি ফতোয়া হচ্ছে, তাদেরকে নামাযের ইমাম বানানো জায়েয নয়।

خلاف شرع حکم کرنے والے حکمران طاغوت ہیں ان کو “اولی الامر” میں داخل کرنےوالے کی امامت نا‍‍‌جائز ہے۔ (سوال) جو شخص آیت شریفہ “واولی الامر منکم” کو حکام آئین موجودہ  پر محمول کرتا ہو اور حکام آئین موجودہ کے حکم کو اس آیت شریفہ سے استدلال کر کے واجب العمل کہتا ہو تو ایسے شخص کا شریعت میں کیا حکم ہے اور اس  شخص کے ‍‍‌پیچھے نماز پڑھنا جائز ہے یا نہیں؟                  المستفتی نمبر 1462 مولوی محمد شفیغ صاحب مدرس اول مدرسہ اسلامیہ شہرملتان 23 ربیع الاول 1356ھ م 3 جون 1937۔ (جواب 144 ) “و اولی الامر منکم” سے علماء یا حکام مسلمین مراد ہیں۔ یعنی ایسے حکام جو مسلمان ہوں اور خدا و رسول صلی اللّہ علیہ و سلم کے حکم کے موافق احکام جاری کریں۔ ایسے مسلمان حاکم جو خدا اور رسول کے احکام کے خلاف حکم جاری کریں “من لم یحکم بما انزل اللّہ فاولئک ھم الکافرون” میں داخل ہیں اور خدا اور رسول کے خلاف حکم جاری کرنےوالوں کو قرآن پاک میں طاغوت فرمایا گیا ہے۔ اور طاغوت کی اطاعت حرام ہے۔ پس جو شخص ایسے حکام کو جو الہی شریعت اور آسمانی قانون کے خلاف حکم کرتے ہیں  “اولی الامرمنکم” میں داخل قرار دے، وہ قرآن پاک کی نصوص صریحہ کی مخالفت کرتا ہے۔ انگریزی قانون کے ماتحت خلاف شرع حکم کرنے والے خواہ غیر مسلم ہوں،خواہ نام کے مسلمان طاغوت ہیں۔ اولی الامر میں کسی طرح داخل نہیں ہو سکتے۔ ان کو اولی الامر میں داخل کرنےوالا یا مجنون ہے یا جاہل یا فاسق۔ اور ایسی حالت میں اس کو مقتدا بنانا اور امام مقرر کرنا ناجائز ہے۔ فقط محمد کفایت اللّہ کان اللّہ لہ۔ كفاية المفتي: 1/139

 

“শরীয়াহ পরিপন্থী বিধান আরোপকারী শাসক তাগুত। যে ব্যক্তি তাকে ‘উলুল আমর’ গণ্য করে, তার ইমামতি জায়েয নয়।

প্রশ্ন: যে ব্যক্তি আয়াতে বর্ণিত ‘উলিল আমরি মিনকুম’কে বর্তমান আইনের শাসকদের উপর প্রয়োগ করে এবং এধরনের শাসকদের আইন ও বিধান মানা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে আয়াত দিয়ে দলিল দেয়, শরীয়তে এমন ব্যক্তির হুকুম কি এবং তার পেছনে নামায পড়া জায়েয কি না?

উত্তর: ‘উলুল আমর’ দ্বারা উলামা বা মুসলিম শাসক উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন মুসলিম শাসক, যে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান অনুযায়ী আইন জারি করে। যে মুসলিম শাসক আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের বিপরীত আইন জারি করে, সে ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারা কাফের’ [মায়েদা: ৪৪], এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এমন ব্যক্তিকে কুরআনে তাগুত বলা হয়েছে। আর তাগুতের আনুগত্য হারাম। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন শাসকদের উলুল আমর মনে করে, সে কুরআনের সুস্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচারী। ইংরেজদের আইন অনুযায়ী শরীয়তের খেলাফ বিধান আরোপকারী; অমুসলিম হোক বা নামধারী মুসলিম হোক, সে তাগুত। কিছুতেই সে উলুল আমরের অন্তুর্ভুক্ত হতে পারে না। যে ব্যক্তি তাকে উলুল আমর গণ্য করবে, সে হয় পাগল, না হয় মুর্খ, না হয় ফাসেক। এমন ব্যক্তিকে অনুসৃত ও ইমাম বানানো জায়েয নেই।” -কেফায়াতুল মুফতি: ১/১৩৯

সুতরাং তাগুতের জন্য মাননীয় বা এজাতীয় কোনো সম্মানসূচক শব্দ ব্যাবহার করা শরীয়াহ সম্মত নয়।

তাছাড়া তাগুত হচ্ছে আল্লাহর সবচেয়ে বড় অবাধ্য এবং সবচেয়ে বড় হঠকারী, যে নিজেকে রবের আসনে সমাসীন করে। শরীয়ত তো ইহুদি নাসারা এবং মুনাফিককেও এরকম সম্মান প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছে। এক হাদিসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّ نَبِيَّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ” لَا تَقُولُوا لِلْمُنَافِقِ سَيِّدَنَا؛ فَإِنَّهُ إِنْ يَكُ سَيِّدَكُمْ فَقَدْ أَسْخَطْتُمْ رَبَّكُمْ “- مسند أحمد ط الرسالة: 22939، سنن أبي داود: 4977؛ قال المحققون في تحقيق المسند:  رجاله ثقات رجال الشيخين … صحح إسناده المنذري في “الترغيب والترهيب” 3/579، وكذا العراقي في تخريج أحاديث “الإحياء” 3/162، والنووي في “الأذكار” ص 449.

“বুরাইদাহ রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা মুনাফিককে ‘সাইয়্যেদানা’ (হে আমাদের সর্দার) বলে সম্বোধন করো না। মুনাফিক যদি তোমাদের সর্দার হয়, তবে তো তোমরা তোমাদের রবকে অসন্তুষ্ট করলে’।”  -সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭৭

মোল্লা আলী কারি রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,

 )أسخطتم ربكم) أي: أغضبتموه؛ لأنه يكون تعظيما له، وهو ممن لا يستحق التعظيم. – مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح (7/ 3009)

“‘তোমাদের রবকে অসন্তুষ্ট করলে’ অর্থাৎ তাকে রাগান্বিত করলে। কেননা, এ সম্বোধন মানে মুনাফিককে সম্মান করা; অথচ সে সম্মানের যোগ্য নয়।” -মিরকাত ৭/৩০০৯

অন্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

لا تبدءوا اليهود ولا النصارى بالسلام، فإذا لقيتم أحدهم في طريق، فاضطروه إلى أضيقه. -صحيح مسلم : 5789، ط. دار الجيل بيروت + دار الأفاق الجديدة ـ بيروت

“তোমরা ইহুদী ও নাসারাদেরকে আগে সালাম দিও না। (চলার) পথে তাদের কেউ সামনে পড়লে (তোমরা মাঝপথে চল) তাকে তোমার পথ ছেড়ে সঙ্কীর্ণ অংশে চলতে বাধ্য করো।” -সহিহ মুসলিম: ৫৭৮৯

হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী রহ. (৬৫৬ হি.) বলেন,

قوله – صلى الله عليه وسلم -: (لا تبدؤوا اليهود والنصارى بالسَّلام) إنما نهى عن ذلك لأن الابتداء بالسلام إكرام، والكافر ليس أهلًا لذلك، فالذي يناسبهم الإعراض عنهم، وترك الالتفات إليهم، تصغيرًا لهم، وتحقيرًا لشأنهم، حتى كأنهم غير موجودين. -المفهم لما أشكل من تلخيص كتاب مسلم (5/ 490)

‘তোমরা ইহুদী ও নাসারাদেরকে আগে সালাম দিও না।’ এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হচ্ছে, আগে সালাম দেয়ার অর্থ তাদের সম্মান করা। আর কাফের সম্মানের উপযুক্ত নয়। সঙ্গত হচ্ছে, তাদের হীনতা ও তুচ্ছতা প্রকাশার্থে তাদের উপেক্ষা করা এবং তাদের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করা। এমন ভাব দেখিয়ে চলা যেন কিছুই সামনে পড়েনি।” –আলমুফহিম ৫/৪৯০

মোল্লা আলী কারি রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,

)لا تبدءوا اليهود ولا النصارى) أي: ولو كانوا ذميين، فضلا عن غيرهما من الكفار (بالسلام) : لأن الابتداء به إعزاز للمسلم عليه، ولا يجوز إعزازهم. -مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح (7/ 2939(

“অর্থাৎ যিম্মি হলেও ইয়াহুদি নাসারাকে সালাম দিও না। আর অন্য কাফের হলে তো কথাই নেই। কারণ, আগে সালাম দেয়া মানে তাকে সম্মান করা। অথচ তাকে সম্মান করা জায়েয নয়।” -মিরকাত ৭/২৯৩৯

অতএব, তাগুতের জন্য ‘মাননীয়’ বা এ ধরনের কোনো সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না।

অবশ্য কোথাও যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে, এ ধরনের সম্মানসূচক কোনো শব্দ ব্যবহার না করলে তাগুতের রোষানলে পড়ার এবং জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রু হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে ঐ পরিস্থিতিতে ক্ষতির থেকে বাঁচার জন্য বলা যেতে পারে। তখন তা নাজায়েয হবে না।

আল্লামা ইবনে আল্লান রহ. (১০৫৭ হি.) বলেন,

(لا تقولوا للمنافق سيد) ومثله سائر ألفاظ التعظيم. ومحل النهي ما لم يحس من تركه، ضرراً، على نفسه أو أهله أو ماله. – دليل الفالحين لطرق رياض الصالحين (8/ 542)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী- ‘তোমরা মুনাফিককে ‘সর্দার’ বলে সম্বোধন করো না’। অন্য সকল সম্মানসূচক শব্দেরও একই বিধান। তবে এ নিষেধ হচ্ছে যখন তা না বলার দ্বারা জান-মাল ও পরিবার পরিজনের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা না হবে।” -দালিলুল ফালিহিন ৮/৫৪২

আল্লামা শামী রহ. (১২৫২ হি.) বলেন,

لو قام له خوفا من شره فلا بأس أيضا بل إذا تحقق الضرر، فقد يجب وقد يستحب على حسب حال ما يتوقعه. -الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (4/ 208(

“অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য যদি মুসলিম যিম্মিকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। বরং অনিষ্টের সম্মুখীন হতে হবে বলে যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে আশঙ্কার মাত্রার ভিত্তিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা ওয়াজিব এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হয়ে পড়বে।” -রদ্দুল মুহতার ৪/২০৮

والله تعالى أعلم بالصواب

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

০৩-০৪-৪৩ হি.

০৯-১১-২০২১ ঈ.

আরও পড়ুনঃ তাগুতের আদালতে বিচারপ্রার্থী হওয়ার বিধান

Back to top button