তুফানুল আকসা || উলামায়ে কেরামের ফতোয়া ও মূল্যায়নঃ একটি বিশ্লেষণ
তুফানুল আকসা || উলামায়ে কেরামের ফতোয়া ও মূল্যায়নঃ একটি বিশ্লেষণ
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
তুফানুল আকসা
উলামায়ে কেরামের ফতোয়া ও মূল্যায়নঃ একটি বিশ্লেষণ
রচনা
মুফতি আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আলমাহদি (হাফিযাহুল্লাহ)
সূচিপত্র
সামরিক বিশ্লেষণ নয়; উদ্দেশ্য ফতোয়ার বিশ্লেষণ 13
এই সাহসী ফতোয়া উম্মাহর জন্য আশাব্যঞ্জক 14
যে বিভ্রান্তিগুলো সামনে আসছে 16
বর্তমান পরিস্থিতিতে গেরিলা যুদ্ধই উপযুক্ত অবলম্বন 18
গেরিলা যুদ্ধের উপযুক্ততার বিচারে ভূমির বিভাজন 18
ভূমির উপযোগিতা ও ব্যক্তির সক্ষমতা এক কথা নয় 19
সক্ষমতার ক্ষেত্রে দুনিয়ার স্বভাবজাত সুন্নাহ 20
কিতালের সক্ষমতা ও জিহাদের সক্ষমতা আলাদা বিষয় 20
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে তা আরো ব্যাপক 22
এটি ফিকহের কাওয়ায়েদে কুল্লিয়্যারও অন্তর্ভুক্ত 27
ময়দানের বাইরে থেকে জিহাদে অংশ গ্রহণের কিছু আদর্শ দৃষ্টান্ত 31
শহীদ মুহাম্মাদ জুওয়ারি রহিমাহুল্লাহর বিস্ময়কর অবদান 31
শায়খ ইযযুদ্দীন আল-কাসসাম রহিমাহুল্লাহ 33
আরেক ফিলিস্তিনি যুবকের কীর্তিগাঁথা 33
ডা. সাজুল ইসলাম সিলেটি হাফিযাহুল্লাহ…………………………………………34
আফগান ও চেচনিয়া জিহাদ…………………………………………………………34
শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ………………………………………………34
হাফিজুস সহীহাইন ইউসুফ আল উইয়াইরী রহিমাহুল্লাহ……………………………35
সাইফুল ইসলাম খাত্তাব রহিমাহুল্লাহ…………………………………………………35
বাইরের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা 35
ফিলিস্তিন জিহাদের অর্থের উৎস, প্রভাব ও আমাদের দায় 36
ইরানের সহযোগিতা উম্মাহর জন্য লজ্জাজনক! 37
রক্তাশ্রুও অক্ষম যে উপাখ্যানের চিত্রায়নে! 39
বাইরের নুসরত ব্যতীত আদৌ কি জিহাদ সম্ভব? 41
আপনি যদি সত্য প্রকাশে মাজুর হন! 42
এই ফতোয়া অনুযায়ী জিহাদ হয়নি এবং জিহাদ অসম্ভব! 42
নুসরতের ভূমিতে সক্ষমতা নিরূপণ ও করণীয় নির্ধারণ 43
০১. ময়দানে গিয়ে কিতালে শরীক হওয়া 43
০২. জিহাদ বিল মাল তথা অর্থ দিয়ে জিহাদে শরীক হওয়া 44
ফিলিস্তিনের জন্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইদলিবের সহায়তা 45
০৩. লজিস্টিক (রসদ ও প্রযুক্তি) সহায়তা দিয়ে শরীক হওয়া 45
প্রযুক্তি সহায়তায় আলেমদেরও ভূমিকা রাখা কাম্য 45
০৪. সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ময়দানের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় 46
হক জিহাদের সঙ্গে একীভূত হোন! 46
পিপাসার উপলব্ধি ও উত্তরণের তড়প সৃষ্টি করুন 47
যদি হক জামাআত খুঁজে না পান! 48
ময়দানের বাইরে থেকে জিহাদে অংশগ্রহণের সম্ভাব্য কিছু ক্ষেত্র 48
প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতা এবং সক্ষমতার কাজটি খুঁজে বের করা! 51
যে অংশে সক্ষমতা নেই, তা অর্জনের চেষ্টা করা 52
তৃতীয় সংশয়: হুকুমতের দায়িত্ব 52
ইমাম ব্যতীত জিহাদ নেই, রাফেজি শিয়াদের আকীদা 53
ইমাম না থাকলেও জিহাদ বিলম্বিত করা যাবে না 55
ইমাম নিষেধ করলেও জিহাদ করতে হবে 55
সালাফের সঙ্গে আজকের ফতোয়ার পার্থক্য 56
বস্তুত কারো কারো ফতোয়া জিহাদ নিষিদ্ধ বলারই নামান্তর 58
মানবরচিত আইনের শাসকরা মুসলিম, না মুরতাদ? 58
ফিলিস্তিন ইসরাঈল যুদ্ধ আবারো বিষয়গুলো চোখ ফুঁড়ে দেখিয়ে দিল! 61
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
الحمد لله الذي بنعمته تتم الصالحات، القائل لعباده: {وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا (75) الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا (76) أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ قِيلَ لَهُمْ كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْيَةِ اللَّهِ أَوْ أَشَدَّ خَشْيَةً وَقَالُوا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَيْنَا الْقِتَالَ لَوْلَا أَخَّرْتَنَا إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لِمَنِ اتَّقَى وَلَا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا (77) أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ} [النساء: 75 – 78]
قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللَّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنْصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ (14) وَيُذْهِبْ غَيْظَ قُلُوبِهِمْ وَيَتُوبُ اللَّهُ عَلَى مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ (15) أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَا رَسُولِهِ وَلَا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (16) مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَنْ يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ أُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ (17) إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ (18) أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَوُونَ عِنْدَ اللَّهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (19) الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ (20) [التوبة: 14]
والصلاة والسلام على رسوله نبي الرحمة والملحمه، القائل لأمته يُوشِكُ الأُمَمُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الأَكَلَةُ إِلَى قَصْعَتِهَا فَقَالَ قَائِلٌ وَمِنْ قِلَّةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ قَالَ بَلْ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيرٌ وَلَكِنَّكُمْ غُثَاءٌ كَغُثَاءِ السَّيْلِ وَلَيَنْزِعَنَّ اللهُ مِنْ صُدُورِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَابَةَ مِنْكُمْ وَلَيَقْذِفَنَّ اللهُ فِى قُلُوبِكُمُ الْوَهَنَ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا الْوَهَنُ قَالَ حُبُّ الدُّنْيَا وَكَرَاهِيَةُ الْمَوْتِ.
وعلى آله وصحبه اجمعين، ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، وبعد.
সমরবিদদের মূল্যায়ন
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসংখ্য অগণিত শোকর! দীর্ঘ সত্তর বছর যাবৎ ইসরাঈল নামক জারয রাষ্ট্রটি যেভাবে প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনিদের উপর একতরফা নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদের ভিটেমাটি দখল করে নিচ্ছিল, হামাসের জানবায মুজাহিদরা তার কিঞ্চিৎ প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছে। মুমিনদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণে সামান্য হলেও প্রশান্তির প্রলেপ পড়েছে। বর্বর ইহুদী জাতি কিঞ্চিৎ টের পেয়েছে, স্বজনহারার বেদনা কত গভীর!
{قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللَّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنْصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ} [التوبة: 14]
“তোমরা ওদের বিরুদ্ধে কিতাল করো! আল্লাহ তোমাদের হাতে ওদেরকে শাস্তি দেবেন, অপদস্থ করবেন এবং তোমাদেরকে ওদের উপর বিজয়ী করবেন। (তোমাদের বিজয় ও কাফেরদের পরাজয়ের দ্বারা) মুমিনদের অন্তর প্রশান্ত করবেন।” -সূরা তাওবা ০৯:১৪
বরকতময় নাইন-ইলেভেন এবং ১৫ই আগস্ট ইমারার বিজয়ের পর তৃতীয়বারের মতো এমন হৃদয় শীতল করা দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্ববিবেক।
বিগত ০৭ই অক্টোবর হামাস কর্তৃক ইসরাঈলের সীমানা ভেঙ্গে একযোগে আকাশ, জল ও স্থলপথে পরিচালিত ‘তুফানুল আকসা’র সামরিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন শত্রু-মিত্রের সমরবিদরা এমনটাই করছেন। এই বরকতময় আক্রমণের পর আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে বার্তা প্রকাশ করেছে, তা থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট।[1] শত্রুশিবিরের স্বীকারোক্তি, পশ্চিমা সমরবিদদের বিশ্লেষণও এখানে প্রায় অভিন্ন। বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবেই প্রচারিত হচ্ছে।
বিজ্ঞ মুজাহিদদের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের সামান্য অংশ আমরা তুলে ধরছি। যারা বিস্তারিত পড়তে চান, তাদের জন্য টীকায় সূত্র দেয়া আছে।
‘তুফানুল আকসা’ উপলক্ষে আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় বিবৃতিতে বলা হয়েছে:
“এখন লেখক সাহিত্যিকদের একথা স্বীকার করে নেয়ার সময় এসেছে যে, ঈমানী এই গৌরব তুলে ধরতে তাদের কলম অক্ষম। ফিলিস্তিনের বরকতময় যুদ্ধের নৈপুণ্য বর্ণনা করতে তাদের লেখনী ব্যর্থ। ফিলিস্তিনের মুজাহিদীন কাফেলা এই রণাঙ্গন রচনা করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে ‘তুফানুল আকসা’ অন্যতম রণাঙ্গন। যুগান্তকারী এই যুদ্ধের পরিকল্পনা, নৈপুণ্য, কর্মক্ষেত্রে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা, নিষ্ঠা, বীর বাহাদুরদের কর্মদক্ষতা, রণকৌশল এবং অভিযান পরিচালনাকারীদের চতুর্মুখী বুদ্ধিমত্তা ও চতুরতা- এই যুদ্ধকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করেছে, যা কল্পনাকেও হার মানায়।”
………………
“নিরাপত্তা, সামরিক অবস্থা, গোয়েন্দা নীতি, স্ট্র্যাটেজি— সব ক্ষেত্রেই এই অভিযান ছিল কল্পনাতীত সাফল্যের অধিকারী। যখন থেকে বানর শূকরের বংশধর ইহুদীরা আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফরের মানযিল দখলে নিয়েছে, তখন থেকেই আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম, ইসলামের বীর বাহাদুরদের পক্ষ থেকে পরিচালিত আগামী দিনের তুফান জায়নবাদী ও ক্রুসেডারদেরকে সেপ্টেম্বরের ভয়াবহতার কথা ভুলিয়ে দেবে। আগামী দিনের অভিযানগুলো এমন সাফল্য অর্জন করবে, যার সামনে বিগত দিনের অভিযানগুলো নিছক আনুষ্ঠানিকতা বলে মনে হবে।”
…………..
“তুফানুল আকসা যুদ্ধ থেমে যাবার পর গোটা বিশ্ব অচিরেই এই বরকতময় যুদ্ধের এমন ফলাফল দেখতে পাবে, যা জায়নবাদীদের সামাজিক ও সামষ্টিক কাঠামোতে বড় মাপের ক্ষতি সাধন করবে। এই অভিযান সকল অঙ্গনে ইসরাঈল এবং তার মিত্রবাহিনীর জন্য বিপর্যয় বলে প্রমাণিত হবে। বৈশ্বিক জিহাদী অঙ্গনে এই বিরাট পরিবর্তন, লড়াইয়ের ঘাঁটিগুলোতে এই তৃণমূল বিবর্তন এবং শতাব্দীকালের এই সুযোগ— যা গোটা জীবনে কখনও এক দুইবারের বেশি আসে না—এই সবকিছুকে সামনে রেখে আমরা গোটা বিশ্বের মুসলিম জনসাধারণকে আহ্বান করতে চাই, তারা যেন এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, যা ফিলিস্তিন ভূখণ্ড স্বাধীন করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী পদক্ষেপ বলে গণ্য। আমরা তাদেরকে সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে জিহাদে অংশগ্রহণের দাওয়াত দিচ্ছি। এই ইসলামিক তুফানের প্রশ্নে ইতিবাচকতা অবলম্বনের এবং যেকোনো পশ্চিমা ও ইহুদী বিষয়ের প্রশ্নে নেতিবাচক পন্থা অবলম্বনের জন্য উৎসাহিত করছি।”
………
“ফযীলাতুশ শায়খ মৌরিতানিয়ার আলেমে দীন মুহাম্মাদ আল-হাসান বিন আল-দেদেউ (দেদু) হাফিযাহুল্লাহ যেই ফাতওয়া দিয়েছেন, আল-আকসা চ্যানেল কর্তৃক প্রচারিত সেই ফাতওয়া আঁকড়ে ধরতে আমরা ভুলবো না। তাঁকে যখন ‘তুফানুল আকসা’ যুদ্ধের পরিস্থিতিতে উম্মাহর নানাবিধ যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী উম্মাহর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন আল্লাহর তাওফীকে তিনি বলেছেন: “আল-আকসা মসজিদ স্বাধীন করার জন্য গোটা উম্মাহর ওপর সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে দেয়া ওয়াজিব। সীমান্তপ্রহরী ভাই-বোনদের সাহায্যের জন্য সবকিছু নিয়ে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। গাজা উপত্যকায় আমাদের ভাই-বোনদের ওপর আরোপিত অন্যায় অবরোধ ভেঙে দেয়ার জন্য তাদের এগিয়ে আসা উচিত। সর্বস্থানের মজলুম ও নিপীড়িতদের সাহায্যের জন্য গোটা উম্মাহর ওপর ফরয ও ওয়াজিব হলো কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা।” –উদ্ধৃতি সমাপ্ত
তুফানুল আকসার সফলতা!
জালেমদের বর্ণনাতীত জুলুমের মোকাবেলায় এই প্রতিশোধ যদিও কিঞ্চিৎ মাত্র, কিন্তু এই বরকতময় ‘তুফানে’র সফলতা যেমন স্পষ্ট, তেমনি পরাজিত উম্মাহ ও দাম্ভিক শত্রুর উপর এর প্রভাবও অনেক সুগভীর ও সুদূরপ্রসারী বি-ইযনিল্লাহ। একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী ৯/১১ ও ১৫ ই আগস্টের মতো ০৭ই অক্টোবর আবারো পৃথিবীকে হুঙ্কার দিয়ে জানিয়ে গেল, ভবিষ্যত পৃথিবী মুসলিম উম্মাহর, ভবিষ্যত পৃথিবী কল্যাণের, ভবিষ্যত পৃথিবী ন্যায় ও ইনসাফের!
একতরফা মুসলিম নির্যাতনের পৃথিবী, বরকতময় নাইন/ইলেভেনে; ইতিহাস পরিবর্তনের যে ইউটার্ন নিয়েছিল, ০৭ই অক্টোবরের তুফান তাতে যে গতি প্রয়োজন ছিল, তা সঞ্চার করে গেল। এই বরকতময় আক্রমণ একদিকে যেমন মনোবল শূন্য অস্ত্রবলে দাম্ভিক শত্রুর কলিজায় কাঁপন ধরিয়েছে, অন্যদিকে অসংখ্য মুসলিম যুবকের চোখের ছানি অপারেশন করে কাগুজে বাঘের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে। নাইন/ইলেভেনের আঘাত ছিল যে সাপের মাথায়, তুফানুল আকসার আঘাত ছিল সে সাপের কোমরে। সুতরাং আমাদের বুঝতে হবে, এখন শত্রুর মাথা কোমর দুটোই আহত!
أَلا إِنَّ نَصْرَ اللّهِ قَرِيبٌ
“শুনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে” –সূরা বাকারা: ০২:২১৪
ফিলিস্তিন ইস্যু ২২ লাখ গাজাবাসীর ইস্যু নয়; সমগ্র মুসলিম উম্মাহর প্রাণের ইস্যু। ইসলাম ও মুসলিমদের প্রথম কেবলা বাইতুল মাকদিসের ইস্যু। পৃথিবীর বুকে তৃতীয় শ্রেষ্ঠ মসজিদ রক্ষার ইস্যু। যে ভূমি আল্লাহ মুসলিমদের মালিকানায় লিখে দিয়েছেন বলে কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন, সমগ্র মুসলিম জাতির কলিজায় ছুরি চালিয়ে আন্তর্জাতিক ভূমিদস্যু ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসদের ছিনিয়ে নেয়া সেই ভূমি উদ্ধারের ইস্যু!
আল্লাহ তুফানুল আকসার মুজাহিদদের পূর্ণ প্রতিদান দিন। নাদান উম্মত যখন আল্লাহ প্রদত্ত এই মহা নেয়ামতের কথা ভুলতে বসেছে, নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পেছনে ফেলে তুচ্ছাতিতুচ্ছ গান্দা দুনিয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, গাদ্দার শাসক শ্রেণি যখন মুসলিমদের এই কলিজার টুকরাটি দস্যুদের চিরতরে লিখে দেয়ার উৎসব আয়োজনে মেতেছে, তখন ফিলিস্তিনের জানবাজ মুজাহিদরা, জানের নাযরানা দিয়ে গাদ্দার ও দস্যুদের সেই যৌথ আয়োজন থামিয়ে দিয়েছে।
ইসরাঈলি বর্বরতায় গত তিন মাসে ৩০ হাজারেরও বেশি মুসলিমের প্রাণ ঝরেছে। আল্লাহ তাঁদের শাহাদাত কবুল করুন। বাহ্যত এটা আমাদের অনেক বড় ক্ষতি কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে আমাদের লাভের পাল্লা যে এর চেয়েও হাজার গুণ বেশি, তাতেও চক্ষুষ্মানদের ন্যূনতম সংশয় নেই বি-ইযনিল্লাহ। এক মুহূর্তের বীরত্বের যিন্দেগি যে হাজার বছরে গোলামির যিন্দেগি থেকে শ্রেয়, এই সবক তো বিশ্ব আমাদের কাছেই পেয়েছে! আমাদের প্রিয় ভাই বোনদের এই রক্তবন্যা শুধু কুদস-ফিলিস্তিন নয়; সমগ্র মুসলিম জাতির মুক্তির দ্বার উন্মোচন করেছে আলহামদুলিল্লাহ।
তুফানুল আকসার শুহাদারা ০৭ই অক্টোবর নতুন করে নিষ্প্রাণ উম্মাহর হৃদয়ে যে প্রাণের সঞ্চার করেছে, যুবকদের হৃদয়ে জিহাদ ও শাহাদাতের রক্তসিঞ্চিত যে বীজ বোপন করেছে, নতুন প্রজন্মের বক্ষে প্রতিশোধের যে বাঁধভাঙ্গা তুফান সৃষ্টি করেছে, মুসলিম শিশু কিশোরদের কচি মনে যে আলোকিত ভবিষ্যতের মশাল জ্বেলেছে, বিশ্ববাসী খুব শীঘ্রই; বিশ্বের ক্ষমতার হাত বদলের মাধ্যমে তার ফলাফল দেখতে পাবে ইনশাআল্লাহ।
০৭ই অক্টোবরের তুফান যদি ০৮ই অক্টোবর থেমে যেত, তবুও এর সফলতা এবং উপর্যুক্ত ফলাফলে ন্যূনতম ব্যত্যয় ঘটত না। কিন্তু মহান আল্লাহর মেহেরবানি, বিগত তিন মাসেরও অধিক সময় ফিলিস্তিনের প্রিয় মুজাহিদ ভাইরা যেভাবে বীর বিক্রমে জিহাদ করে যাচ্ছেন এবং যেভাবে তথ্য প্রযুক্তি ও সমরকৌশল সর্বদিক থেকে অভিশপ্ত ইহুদীদের সাত ঘাটের ঘোলা পানি খাওয়াচ্ছেন, তা একদিকে যেমন উক্ত ফলাফলগুলোকে আরও নিশ্চিত করেছে, অপর দিকে বিশ্ববাসীর সামনে সৌদি-আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ; ইসরাঈলের প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বন্ধুদের উলঙ্গ করেছে। ঈমান-কুফর ও শত্রু-মিত্র শিবিরের পার্থক্যরেখা আরও স্পষ্ট করেছে। জিহাদ ছাড়া যা সর্বদাই ঘোলা থেকে যায়!
مَّا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَىٰ مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىٰ يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ
“তোমরা যেভাবে আছ, সেভাবে আল্লাহ মুমিনদের ছেড়ে রাখার নন, যতক্ষণ না তিনি মন্দকে ভালো থেকে আলাদা করেন।” –সূরা আলে ইমরান: ০৩:১৭৯
জিহাদই যে উম্মাহর মুক্তির একমাত্র পথ, চক্ষুষ্মানদের কাছে তা আবারো স্ফটিকের ন্যায় পরিষ্কার করে দিয়েছে।
সামরিক বিশ্লেষণ নয়; উদ্দেশ্য ফতোয়ার বিশ্লেষণ
ঘটনার সামরিক মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ আমাদের এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। গুরুত্বের বিবেচনায় বিষয়টির প্রতি সামান্য ইঙ্গিত করা হল। আমাদের উদ্দেশ্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত উলামায়ে কেরামের ফতোয়া ও মূল্যায়নের বিশ্লেষণ। ঘটনার পর থেকেই শত্রু-মিত্র সকল শিবিরে ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’ পরিণত হয়েছে হামাস-ইসরাঈল যুদ্ধ। জাগরণ তৈরি না হলেও উম্মাহর নিরলস ঘুমের ঘোরে কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে। সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কথা বলার চেষ্টা করছেন। সভা সমাবেশ করছেন, নিজ নিজ দেশ থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফতোয়া দেয়ার চেষ্টা করছেন, মজলুম ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন আলহামদুলিল্লাহ।
“মুসলিমদের কোনো ভূখণ্ড কাফেরদের দ্বারা আক্রান্ত হলে, প্রথমত আক্রান্ত ভূমির মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায় এবং তারা ফরয আদায়ে ত্রুটি করলে কিংবা যথেষ্ট না হলে ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক মুসলিমের উপর তা ফরযে আইন হয়ে যায়” -এ মাসআলাটি উম্মাহর মাঝে সর্বসম্মত ও সর্বজনবিদিত। বরকতময় ‘তুফানুল আকসা’ অপারেশন পরিচালনার পর ক্রুসেডার-জায়নিস্ট জোট গাজায় পাশবিক আক্রমণ শুরু করার প্রেক্ষিতে এ মাসআলা আবারো নতুন করে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে আলহামদুলিল্লাহ। উম্মাহর সম্মানিত আলেমগণ স্পষ্টভাবে ফতোয়া দিচ্ছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জিহাদ ফরযে আইন।
এই সাহসী ফতোয়া উম্মাহর জন্য আশাব্যঞ্জক
এটা উম্মাহর জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক বিষয় যে, উম্মাহর সম্মানিত হক্কানি উলামায়ে কেরাম বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্ভয়ে সকলের উপর জিহাদ ফরযে আইন হওয়ার ফতোয়া দিচ্ছেন। এ ফতোয়া সরাসরি সুপারপাওয়ার আমেরিকার বিরুদ্ধে যাচ্ছে, ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। আল্লাহ না করুন, এমন আশংকাও অমূলক নয় যে, এ ফতোয়া প্রদানের মূল্য কাউকে হয়তো প্রাণ দিয়েও চুকাতে হতে পারে। তবুও নির্ভীক আহলে হক উলামায়ে কেরাম পিছপা হননি, ইলমের আমানত আদায়ের চেষ্টা করছেন, এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের সারেতাজ সম্মানিত উলামায়ে কেরামকে জাযায়ে খায়র দান করুন, কাফেরদের এবং তাদের নিযুক্ত শাসকদের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করুন, আফিয়াতের সাথে হকের আওয়াজ পরিপূর্ণভাবে উচ্চকিত করার তাওফীক দান করুন।
তবে…!
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে উম্মাহর উপর জিহাদ ফরযে আইন, এতটুকু ইজমালী কথার উপর মোটামুটি সকল হকপন্থি আলেম একমত হবার পর ফতোয়ার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অনেক আলেমের ফতোয়া সঠিক ধারায় এলেও কোনো কোনো আলেমের কাছ থেকে সুস্পষ্ট কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিভ্রান্তি সামনে এসেছে। উম্মাহর এসব কাঙ্ক্ষিত জিহাদি পদক্ষেপ, উম্মাহর ফরয আদায়, করণীয়-বর্জনীয় ও জয় পরাজয়ের উপর কার্যত যে বিভ্রান্তিগুলোর প্রভাব অনেক ব্যাপক। তাই বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্ক করা, ভুল-শুদ্ধ নির্ণয় করা সময়ের শরঈ ফরিযাহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা সে বিভ্রান্তিগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব বি-ইযনিল্লাহ। ওয়াল্লাহু ওয়ালিইউত তাওফীক।
এই আলোচনার উদ্দেশ্য
এই আলোচনার একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহ, আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর রাসূল, মুসলিমদের নেতৃবর্গ ও সাধারণ মুসলিমদের কল্যাণ কামনা। যেমনটি হাদীসে এসেছে,
عَنْ تَمِيمٍ الدَّارِيِّ رضي الله عنه : ” أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ 🙁 الدِّينُ النَّصِيحَةُ ) قُلْنَا لِمَنْ ؟ ، قال : ( لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ )” -رواه الإمام مسلم رحمه الله في “صحيحه” (55)
“হযরত তামীম দারী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কল্যাণকামনাই দীন (অর্থাৎ দীনের অন্যতম স্তম্ভ) । আমরা প্রশ্ন করলাম, কার জন্য কল্যাণ কামনা? তিনি বললেন, আল্লাহর, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের এবং ইমামুল মুসলিমীনের ও সাধারণ মুসলিমদের।” -সহীহ মুসলিম: ৫৫
আমাদের অনেকের বদ্ধমূল ধারণা, নসীহা শুধু ছোটদেরকে বড়রা করতে পারেন; ছোটদের অধিকার নেই নসীহা করার, কিংবা ছোটদের জন্য তা বেয়াদবি। এই ধারণা সম্পর্ণ ভুল এবং উক্ত হাদীসের পরিপন্থী। নসীহা হচ্ছে প্রত্যেক মুসলিমের ফরিযাহ এবং তার উপর অপর মুসলিমের হক, চাই সে বড় হোক কিংবা ছোট।
أسأل الله الصواب والسداد، وأعوذ به من كل زيغ وضلال، وما توفيقي إلا بالله، استغفر الله وأتوب إليه، عليه توكلت وإليه أنيب
বর্তমান সময়ে ফরযে আইন জিহাদ আদায়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে উল্লেখযোগ্য যে বিভ্রান্তিগুলো সামনে এসেছে তা নিম্নরূপ:
০১. অনেকেই বর্তমান পরিস্থিতিতে জিহাদ ফরযে আইন ফতোয়া দেয়ার পর বলছেন, মাজলুমদের জন্য আমাদের দোয়া এবং বিক্ষোভ করা ছাড়া কিছু করার নেই। সাধ্যমত আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেকের উপর ফরয। তবে আমাদের যেহেতু শুধু দোয়া করা ব্যতীত আর কিছু করার সামর্থ্য নেই, তাই আমাদের দায়িত্ব কেবল দোয়া করা।
অর্থাৎ সাধ্য অনুযায়ী জিহাদে শরীক হওয়া ফরযে আইন স্বীকার করলেও অনেকেই সাধ্য ও সক্ষমতা নিরূপণে ভুল করছেন, দোয়া ছাড়া অন্য সক্ষমতাগুলোর প্রতি খেয়াল করছেন না। ফলে জিহাদ ফরযে আইন বলা সত্ত্বেও আমলী ময়দানে এ ফতোয়ার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ও কার্যকরিতা থাকছে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দারুল আসবাবের এই দুনিয়ায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিয়ম হল, আদিষ্ট আমল না করে দোয়া করলে, তা কবুল করার ওয়াদা যেমন নেই, তেমনি আদেশের দায় থেকেও মুক্তি মেলে না। -ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন: ৪/২৬৫; মাজমুউল ফাতাওয়া: ৮/৫২৮
০২. দ্বিতীয় বিভ্রান্তি হচ্ছে, অনেকের কথা থেকে বুঝা যায়, ‘যেসব বিষয়ে এই মুহূর্তে আমাদের সক্ষমতা নেই, সেসব বিষয়ে আমাদের করণীয়ও কিছু নেই; বরং আমরা দায়মুক্ত।’ অর্থাৎ এই মুহূর্তে যেহেতু আক্রান্ত ভাইদের সহযোগিতা করার সামর্থ্য নেই, সুতরাং বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ফিকির করা, সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা তাদবীর চালানোরও যেন কোনো দায়িত্ব নেই। অতএব এবিষয়ে আপাতত আমরা কোনো প্রকার করণীয় থেকে দায়মুক্ত।
এই বিভ্রান্তিগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বড় বড় ব্যক্তিত্বের বক্তব্য থেকেও প্রকাশিত হচ্ছে।
০৩. তৃতীয় বিভ্রান্তিটি হচ্ছে, অনেকেই এই ফরযকে শাসকদের উপর সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন। শাসকরা এগিয়ে না গেলে তারা গুনাহগার হবে, সাধারণ মানুষের কোনো সমস্যা নেই। তারা সর্বোচ্চ শাসকদের কাছে বিভিন্নভাবে দাবি দাওয়া জানাতে পারে। কেউ সাধারণ মুসলিমদের উপর ফরয বললেও তা আদায়ের জন্য; মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উপর চেপে বসা গণতান্ত্রিক শাসকদের অনুমতি ও তত্ত্বাবধানের শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। অথবা এমনভাবে মাসআলা বলছেন, যা থেকে পাঠক বুঝবে, কিছু আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া বাকি কাজ সরকারের দায়িত্ব, সাধারণ মুসলিমদের দায়িত্ব নয়। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, পাকিস্তানের বড় একটি জাতীয় সেমিনারে একজন আলেম স্পষ্ট করে বলছেন, সরকার যদি আমাদের অনুমতি দেয়, আমরা ফিলিস্তিনিদের জন্য এটা করব, ওটা করব ইত্যাদি। সকল মাসলাকের উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে এমন বার্তা থেকে সাধারণ মানুষ এটাই বুঝবে যে, ফিলিস্তিনিদের মতো নির্যাতিত মুসলিমদের সাহায্য করতে হলে শাসকদের অনুমতি নিতে হবে।
তিনটি বিষয়ই ভুল
অথচ উপর্যুক্ত তিনটি বিষয়ই ভুল। চলমান জিহাদে আমাদের অংশ গ্রহণ করার সক্ষমতা যেমন দোয়া-বিক্ষোভ ছাড়া আরও অনেক বেশি কিছু করার আছে, তেমনি যে অংশ আমাদের সক্ষমতার বাইরে, তার অনেক কিছুই অর্জন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। শরীয়তের সাধারণ নীতি হলো, একটি ফরযের যতটুকু পালনের সক্ষমতা আছে, ততটুকু আদায় করলেই ফরয আদায় হয়। আর যতটুকুর সক্ষমতা ফিলহাল নেই, কিন্তু ধীরে ধীরে সে সক্ষমতা অর্জন করা ও বৃদ্ধি করা সম্ভব, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সক্ষমতা তৈরি ও বৃদ্ধির কাজ চলমান রাখা আবশ্যক।
একইভাবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসকদেরকে উলুল আমর মনে করা, জিহাদ শুধু তাদের দায়িত্ব মনে করা বা তাদের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানকে জিহাদের জন্য শর্ত সাব্যস্ত করা, অনেক ‘মুজমা আলাইহি’ ও সর্বসম্মত মাসআলারই পরিপন্থী।
শুরুতে আমরা প্রথমোক্ত দুটি বিভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করব, তারপর আলোচনা করব তৃতীয়টি সম্পর্কে ইনশাআল্লাহ।
ভুল ধারণার অন্যতম উৎস
আমাদের সক্ষমতা সম্পর্কে এ ধরনের ভুল ধারণাগুলোর পেছনে অনেকাংশেই দায়ী, বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতা, আধুনিক পৃথিবীর সমরজ্ঞান ও জিহাদি কার্যক্রমের ব্যাপকতা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ধারণা, নুসরতের ভূমিতেও যে বহুভাবে জিহাদের হুকুম আদায়ের সক্ষমতা বিদ্যমান এবং বিদ্যমান সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যে সক্ষমতার অনেক স্তর বৃদ্ধি করা যায়, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ও ধারণা না থাকা। এ লেখায় মূলত আমরা এই দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। এই দিকগুলো পরিষ্কার হলে আশা করি সকলের সামনেই আলোচ্য বিভ্রান্তিগুলো দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে গেরিলা যুদ্ধই উপযুক্ত অবলম্বন
বর্তমান বিশ্বে কুফরি শক্তির হাতে বলা যায় সম্ভাব্য সকল প্রকার যুদ্ধ-সামগ্রী বিদ্যমান এবং বিশ্বের প্রায় সকল কুফরি শক্তি; এমনকি মুসলিম ভূখণ্ডসমূহের শাসক শ্রেণিসহ সকলেই কার্যত মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। সকলের আকীদা ও আমলে, আইন ও কানুনে জিহাদ ও মুজাহিদ নিষিদ্ধ। অপরদিকে যেসব মুজাহিদ তাদের মোকাবেলায় প্রত্যয়ী, তাদের হাতে সে তুলনায় তেমন কিছুই নেই। এমন অসম লড়াইয়ের জন্য আমাদের জানা মতে এখন পর্যন্ত ইসলামী অ-ইসলামী সকল সমর বিশেষজ্ঞের মতে যুদ্ধের পরীক্ষিত ও একমাত্র পদ্ধতি গেরিলা যুদ্ধ। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমেই আমাদেরকে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে; যতদিন না শক্তির কিছুটা হলেও ভারসাম্য তৈরি হবে এবং মুজাহিদদেরও স্বাভাবিক যুদ্ধের সম্মুখ সমরে যাওয়ার মতো শক্তি সামর্থ্য অর্জিত হবে।
গেরিলা যুদ্ধের উপযুক্ততার বিচারে ভূমির বিভাজন
বৈশ্বিক জিহাদের বিশেষজ্ঞগণ গেরিলা যুদ্ধের সামর্থ্য ও সম্ভাবনার দিক থেকে বর্তমান মুসলিম বিশ্বকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন।
০১. যুদ্ধের ভূমি: যেসব অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের উপাদানগুলো বিদ্যমান এবং গেরিলা যুদ্ধ সম্ভব, এমন রাষ্ট্রের সংখ্যা ফিলহাল খুবই সীমিত, এই প্রকারকে যুদ্ধের ভূমি বা অগ্রবর্তী ভূমি বলা হয়, যেখানে মুজাহিদরা যুদ্ধের ফ্রন্ট খুলবে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করবে।
০২. সহযোগী ভূমি: যেসব অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো বিদ্যমান নেই, অদূর ভবিষ্যতে তার সম্ভাবনাও ক্ষীণ, আমূল কোনো পরিবর্তন হলেই হয়তো সেগুলোতে গেরিলা যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। অন্যথায় এসব ভূমিতে গেরিলা যুদ্ধ করা যাবে না; বরং যে অঞ্চলগুলোতে গেরিলা যুদ্ধ সম্ভব, সেগুলো বিজয় করার পরই সম্মুখ সমরের সামর্থ্য অর্জন করে স্বাভাবিক ও গতানুগতিক যুদ্ধের মাধ্যমে দ্বিতীয় ভাগের অঞ্চলগুলো বিজয় করতে হবে। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই এই দ্বিতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত এবং বাংলাদেশ তার অন্যতম। বাংলাদেশে নিকট ভবিষ্যতেও যুদ্ধক্ষেত্র কায়েম করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ; যদি না এ অঞ্চলের আমূল কোনো পরিবর্তন হয়, কিংবা আল্লাহ না করুন শত্রুরাই ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে এবং যুদ্ধ কায়েম করে। তখন হয়তো আমাদের আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু সামর্থ্য আছে, ততটুকু দিয়েই প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে। এই প্রকারের ভূমিগুলো সমরবিদদের ভাষায় নুসরতের ভূমি, সাপোর্টার ল্যান্ড বা সহযোগী ভূমি হিসেবে আখ্যায়িত। বর্তমানে এই ভূমির মুসলিমদের কাজ হবে, অগ্রবর্তী ভূমিতে পরিচালিত জিহাদের সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রস্তুত করা এবং সেখানে তা সরবরাহ করা। একই সঙ্গে সহযোগী ভূমিকে ধীরে ধীরে সম্ভাব্য ভবিষ্যত জিহাদের জন্য প্রস্তুত করা।
ভূমির উপযোগিতা ও ব্যক্তির সক্ষমতা এক কথা নয়
সুতরাং এবিষয়টি খুবই পরিষ্কার যে, কোনো ভূমি ফিলহাল কিতালের উপযোগী না হওয়া আর সেই ভূমির অধিবাসীদের জিহাদে সক্ষম না হওয়া এক কথা নয়। হতে পারে কোনো ভূমি কিতালের উপযুক্ত নয়, কিন্তু সেই ভূমির অনেকেই অন্য ভূমিতে গিয়ে কিতাল করতে সক্ষম। একইভাবে যারা কিতালে সক্ষম নন, তারাও কিতালের সহযোগিতামূলক বিভিন্ন জিহাদি কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম। জিহাদ শুধু কিতালেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং জিহাদের কাজ কিতাল থেকে অনেক অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। তবুও নুসরতের ভূমিগুলো ফিলহাল গেরিলা যুদ্ধের অনুপযোগী হওয়ায় এবং সেখানে যুদ্ধ শুরু করার মতো সামর্থ্য না থাকায় জনগণের মাঝে এবং সামরিক জীবন থেকে দূরে থাকা উলামাদের মাঝে সহজেই কিছু ভুল ধারণা কাজ করে।
যেমন ‘এ ভূমির অধিবাসীদের উপর জিহাদ ফরয নয়’, ‘জিহাদ জায়েয নয়’ কিংবা দোয়া ছাড়া আর কিছু করার সক্ষমতা নেই ইত্যাদি ।
একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো, যুদ্ধের জন্য ভূমির উপযোগিতা এক বিষয়, আর জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর কাজে শরীক হওয়ার অসংখ্য সুরতের মধ্য থেকে যেকোনো এক বা একাধিক সুরতের উপর ব্যক্তি সক্ষম হওয়া ভিন্ন বিষয়। কিতালের জন্য ভূমি অনুপযোগী হলেই সকল মুসলিম অক্ষম হয়ে যায় না। আখের শরীয়তের হুকুমের মুকাল্লাফ তো ব্যক্তি মুসলিম; ভূমি নয়।
কিতালের ভূমিতে থাকা একজন ব্যক্তিও জিহাদ থেকে অক্ষম হতে পারে, যদি সে মাজুর তথা পাগল কিংবা শিশু হয়। আবার নুসরতের ভূমিতে থাকা একজন মুসলিমও অসংখ্য সুরতেই জিহাদে শরীক হওয়ার উপর সক্ষম হতে পারে। নুসরতের ভূমিতে জন্মগ্রহণকারী সকল মুসলিম অন্ধ কিংবা পঙ্গু নন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো, দিনের পর দিন অক্ষমতার অজুহাত দিয়ে বসে না থেকে সক্ষমতার জায়গাগুলো খুঁজে খুঁজে কাজে লাগানো এবং ধারাবাহিক মেহনত ও প্রস্তুতির মাধ্যমে ক্রমাগত সক্ষমতা বাড়ানো।
সক্ষমতার ক্ষেত্রে দুনিয়ার স্বভাবজাত সুন্নাহ
সক্ষমতার ক্ষেত্রে দুনিয়ার স্বভাবজাত সুন্নাহ ও নেজামই হচ্ছে, অক্ষমতার দোহাই দিয়ে বসে থাকলে, অক্ষমতা বাড়তেই থাকে। আর আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন ততটুকু ফরয আদায় করলে এবং সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করলে দিন দিন দুর্বলতা কমতে থাকে এবং সক্ষমতা বাড়তে থাকে। এবিষয়ে ইতিহাস এবং বাস্তবতা থেকে হাজারো নজির পেশ করা যাবে, তবে কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছি না।
কিতালের সক্ষমতা ও জিহাদের সক্ষমতা আলাদা বিষয়
শত্রুর সঙ্গে সরাসরি সশস্ত্র লড়াই হচ্ছে কিতাল। পক্ষান্তরে জিহাদের অর্থ আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। কিতাল এবং কিতালের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জরুরি কাজগুলো হচ্ছে জিহাদ। শরীয়াহ সম্মত কিতাল তথা সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য দাওয়াত থেকে শুরু করে অর্থায়ন, সমরাস্ত্র আবিষ্কার, তৈরি, সরবরাহ, শত্রুর তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দাগিরি, জিহাদের জন্য সৈনিক সংগ্রহসহ যা কিছু জরুরি, কিতালের নিয়ত ও পরিকল্পনার অধীনে সম্পাদিত এরকম সবগুলো কাজই জিহাদের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। উলামায়ে কেরাম এ বিষয়গুলোকে জিহাদের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
জিহাদ ও কিতালের সংজ্ঞা
যেমনটি আল্লামা শুমুন্নি রহিমাহুল্লাহ (৮৭২ হি.) ও ইমাম ইবনে কামাল পাশা রহিমাহুল্লাহ (৯৪০ হি.) জিহাদের সংজ্ঞায় বলেছেন।
আল্লামা হাসকাফি রহিমাহুল্লাহ (১০৮৮ হি.) বলেন,
كِتَابُ الْجِهَادِ…..
وَهُوَ لُغَةً: مَصْدَرُ جَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ. وَشَرْعًا: الدُّعَاءُ إلَى الدِّينِ الْحَقِّ وَقِتَالُ مَنْ لَمْ يَقْبَلْهُ شُمُنِّيٌّ. وَعَرَّفَهُ ابْنُ الْكَمَالِ بِأَنَّهُ بَذْلُ الْوُسْعِ فِي الْقِتَالِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ مُبَاشَرَةً أَوْ مُعَاوَنَةً بِمَالٍ، أَوْ رَأْيٍ أَوْ تَكْثِيرِ سَوَادٍ أَوْ غَيْرِ ذَلِكَ. اهـ. – الدر المختار مع حاشية ابن عابدين (رد المحتار): 4/ 119-121
“জিহাদ অধ্যায়: আভিধানিক অর্থে الْجِهَادِ (আল-জিহাদ) শব্দটি جَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (জা-হাদা ফী সাবীলিল্লাহ) এর ক্রিয়ামূল। শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ হল, ‘সত্য দীনের প্রতি আহ্বান করা এবং যে তা গ্রহণ করবে না, তার সঙ্গে কিতাল (সশস্ত্র যুদ্ধ) করা’। (এই সংজ্ঞা দিয়েছেন) শুমুন্নি রহিমাহুল্লাহ। ইবনে কামাল পাশা রহিমাহুল্লাহ সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘সরাসরি কিতাল ফী সাবীলিল্লায় শক্তি সামর্থ্য ব্যয় করা অথবা সম্পদ, পরামর্শ, সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমে তাতে সহযোগিতা করা’।” –আদদুররুল মুখতার: ৪/১১৯-১২১
উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় আল্লামা শামি রহিমাহুল্লাহ (১২৫২ হি.) বলেন,
فَتَعْرِيفُ ابْنِ كَمَالٍ تَفْصِيلٌ لِإِجْمَالِ هَذَا ح (قَوْلُهُ فِي الْقِتَالِ) أَيْ فِي أَسْبَابِهِ وَأَنْوَاعِهِ مِنْ ضَرْبٍ وَهَدْمٍ وَحَرْقٍ وَقَطْعِ أَشْجَارٍ وَنَحْوِ ذَلِكَ (قَوْلُهُ أَوْ مُعَاوَنَةً إلَخْ) أَيْ وَإِنْ لَمْ يَخْرُجْ مَعَهُمْ بِدَلِيلِ الْعَطْفِ ط (قَوْلُهُ أَوْ تَكْثِيرِ سَوَادٍ) السَّوَادُ الْعَدَدُ الْكَثِيرُ وَسَوَادُ الْمُسْلِمِينَ جَمَاعَتُهُمْ مِصْبَاحٌ (قَوْلُهُ أَوْ غَيْرِ ذَلِكَ) كَمُدَاوَاةِ الْجَرْحَى وَتَهْيِئَةِ الْمَطَاعِمِ وَالْمَشَارِبِ ط. – الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) ) 4/ 121(
“ইবনে কামাল রহিমাহুল্লাহ প্রদত্ত সংজ্ঞাটি শুমুন্নি রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত সংজ্ঞারই বিশ্লেষণ।
‘কিতাল’ বলতে (সরাসরি কাফেরদের উপর) আক্রমণ, (তাদের স্থাপনা) ধ্বংস করা ও পুড়িয়ে ফেলা, (ফল-ফসলের) গাছ কেটে ফেলা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের (সামরিক) কার্যক্রম উদ্দেশ্য।
‘সহযোগিতা’র মধ্যে মুজাহিদদের সাথে (বের হয়ে সহযোগিতা করা যেমন শামিল,) বের না হয়ে কৃত সহযোগিতাও শামিল। কারণ, প্রথমে বলা হয়েছে ‘হতে পারে তা সরাসরি কিতাল ও যুদ্ধে অংশ নিয়ে’ তারপর বলা হয়েছে, ‘কিংবা সহযোগিতা করে’- যা থেকে এ বিষয়টি বুঝা যায় (যে, সরাসরি বের না হয়ে কৃত সহযোগিতাও জিহাদ বলে গণ্য)।
‘অথবা দল ভারি করা’; অর্থাৎ মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বাহিনী বড় করা। ‘আরও বিভিন্ন কাজ’; যেমন আহতদের চিকিৎসা করা এবং খাবার-দাবার প্রস্তুত করা।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২১
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে তা আরো ব্যাপক
বাস্তবতা হল বর্তমান স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটসহ নানা রকম আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে জিহাদি কার্যক্রমের পরিধি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক ও বিস্তৃত। কোনো কোনো কাজ তো সরাসরি ময়দানের লড়াইয়ের চেয়েও অধিক প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
মনে করুন, একজন মুসলিম বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। আমীর তাকে ময়দানে না পাঠিয়ে ল্যাবে বসে বিস্ফোরক তৈরির দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। মুসলিম জামাআতের জন্য তার তৈরি বিস্ফোরক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মুসলিমদের অস্ত্রের বড় একটা যোগান এখান থেকেই যায়। শত শত ময়দানের সৈনিকের চেয়ে তার কাজটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় কি? অথবা একজন বিজ্ঞ হ্যাকার। যিনি ময়দান থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও শত্রুর যুদ্ধপ্রযুক্তি বিকলে কাজ করতে পারেন। যেমনটি তুফানুল আকসায় ফিলিস্তিনি যুবক উমরের ভূমিকা বিশ্ববাসী দেখেছে (সামনে এই মুজাহিদের কীর্তিগাঁথার সংক্ষিপ্ত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ)। এই উমরের ভূমিকা কি অসংখ্য ময়দানি স্নাইপার যোদ্ধার চেয়েও কার্যকর নয়?
ধরা যাক তারা কোনো কারণবশত সরাসরি ময়দানের যুদ্ধে অংশ নিতে পারছেন না, ময়দান পর্যন্ত পৌঁছতে একাধিক চেকপোস্ট আছে এবং তারা ওয়ান্টেড। তাদের চেহারা শত্রুর পরিচিত। ফলে আমীরও তাদেরকে ময়দানে পাঠাতে আগ্রহী নন; বরং নিরাপদ কোনো অবস্থানে আত্মগোপন করে তারা বিস্ফোরক তৈরি ও হ্যাকিংয়ের কাজ করে যাবেন, এটাই আমীরের নির্দেশ। এখন ময়দানে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতার কারণে কি তাদের উপর জিহাদ ফরয থাকবে না? তারা যে বিষয়ে সক্ষমতা রাখেন, সেটা কাজে লাগানো ফরয নয়? জিহাদ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে বসে থাকা তাদের জন্য বৈধ হবে?
উত্তর স্পষ্ট। তাদের উপর নিজের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করা ফরয; সরাসরি ময়দানে না থাকা বা ময়দানে গিয়ে কিতালে অংশ গ্রহণের সক্ষমতা নেই বলে বসে থাকা জায়েয নয়।
এ তো একটি উদাহরণ মাত্র। জিহাদ ফী সাবীলিল্লায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার এমন অসংখ্য পথ ও পদ্ধতি রয়েছে; যা সশরীরে ময়দানে উপস্থিত হওয়া ছাড়াও আঞ্জাম দেয়া সম্ভব। বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে সক্ষমতার এমন নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। বরং যাদের বর্তমান জিহাদ ও আধুনিক সমরবিদ্যা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে, তারা সকলেই জানেন, বর্তমান যুদ্ধে যারা বড় ভূমিকা রাখেন, তাদের অনেকেই তা ময়দানের বাইরে নিরাপদ কোনো জায়গা থেকে করেন এবং করতে হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একেবারেই স্পষ্ট যে, কিতালে অক্ষম হওয়া আর জিহাদে অক্ষম হওয়া এক কথা নয়। বরং একজন কিতালে অক্ষম হয়েও জিহাদের অনেক কাজেই সক্ষম হতে পারে। সুতরাং জিহাদ ফরযে আইন হওয়ার পর কেউ যদি কিতালে অক্ষম হয়, তবুও তাকে জিহাদের সেই কাজগুলো করতে হবে, যেগুলো তার সাধ্যের মধ্যে আছে। অন্যথায় তিনি ফরয ত্যাগের দায়ে গুনাহগার হবেন। কারণ:
দীনের সর্বসম্মত উসুল
দীনের একটি সর্বসম্মত উসুল হলো, যদি কোনো হুকুমের সবটুকু পালনের সামর্থ্য না থাকে, আংশিক পালনের সামর্থ্য থাকে, তাহলে পুরো হুকুম মাফ হয় না; বরং যতটুকুর সামর্থ্য আছে ততটুকুই পালন করা ফরয থাকে।
আল্লাহ তাবারকা ওয়া তাআলা বলেন,
{فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَأَنْفِقُوا خَيْرًا لِأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [التغابن: 16]
“সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো এবং শোন ও মান্য করো। আর (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) অর্থ ব্যয় করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যাদেরকে নিজেদের নফসের লোভ-লালসা থেকে মুক্ত করা হয়েছে, তারাই সফলকাম।” -সূরা তাগাবুন: ৬৪:১৬
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ، فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ، وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ ؛ فَدَعُوهُ “. -صحيح مسلم: ١٣٣٧
“আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কাজের আদেশ করবো, সাধ্যমতো তোমরা তা পালন করবে। আর যখন কোনো কাজ থেকে বারণ করবো, তা থেকে পরিপূর্ণ বিরত থাকবে।” -সহীহ মুসলিম: ১৩৩৭
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু: ৬৭৬ হি.) বলেন,
قوله صلى الله عليه وسلم : ( فإذا أمرتكم بشيء فأتوا منه ما استطعتم) هذا من قواعد الإسلام المهمة، ومن جوامع الكلم التي أعطيها صلى الله عليه وسلم، ويدخل فيه ما لا يحصى من الأحكام كالصلاة بأنواعها، فإذا عجز عن بعض أركانها أو بعض شروطها أتى بالباقي، وإذا عجز عن بعض أعضاء الوضوء أو الغسل غسل الممكن، وإذا وجد بعض ما يكفيه من الماء لطهارته أو لغسل النجاسة فعل الممكن، وإذا وجبت إزالة منكرات أو فطرة جماعة ممن تلزمه نفقتهم أو نحو ذلك، وأمكنه البعض فعل الممكن، وإذا وجد ما يستر بعض عورته أو حفظ بعض الفاتحة أتى بالممكن؛ وأشباه هذا غير منحصرة، وهي مشهورة في كتب الفقه، والمقصود التنبيه على أصل ذلك، وهذا الحديث موافق لقول الله تعالى: {فاتقوا الله ما استطعتم} اهــــ. -المنهاج شرح صحيح مسلم بن الحجاج: 9/102 ط. دار إحياء التراث العربي – بيروت.
“নবীজীর বাণী: ‘আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কাজের আদেশ করবো, সাধ্যমতো তোমরা তা পালন করো।’ এটি ইসলামের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিগুলোর একটি এবং তা সর্বমর্মী কথাসমূহের একটি; যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে (মুজিযা স্বরূপ) দেয়া হয়েছে। শরীয়তের অসংখ্য বিধিবিধান এই মূলনীতির অধীনে এসে যায়। যেমন সর্বপ্রকার সালাত (এ মূলনীতির অধীন)।
অতএব কেউ যদি সালাতের কোনো রুকন অথবা কোনো শর্ত আদায়ে অক্ষম হয়, তাহলে সে কেবল যেগুলো আদায় করতে সক্ষম সেগুলো আদায় করবে। কেউ অযু কিংবা গোসলের ক্ষেত্রে কোনো অঙ্গ ধৌত করতে অপারগ হলে শুধু সম্ভবগুলো ধৌত করবে। পবিত্রতা অর্জন কিংবা নাপাকি দূর করার জন্য কারো কাছে যথেষ্ট পরিমাণ পানি না থাকলে, তা দিয়ে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই ধৌত করবে। কখনো যদি কোনো অন্যায় রোধ করা জরুরি হয়ে পড়ে অথবা যাদের খরচাদি তার দায়িত্বে তাদের সাদাকাতুল ফিতির তার উপর ওয়াজিব হয় কিংবা এধরনের কোনো কর্তব্য সামনে আসে, আর তার সাধ্যে থাকে এর কিছু অংশ, তাহলে সাধ্যে যা আছে তাই করবে। এমনিভাবে কারো যদি সতরের আংশিক ঢাকার সামর্থ্য থাকে অথবা কারো সূরা ফাতেহার আংশিক মুখস্থ থাকে, তাহলে সামর্থ্যে যতটুকু আছে ততটুকু করবে। এধরনের উদাহরণ অনেক। ফিকহের কিতাবাদি এগুলো দিয়ে ভরপুর। এখানে উদ্দেশ্য শুধু এই মূলনীতিটির দিকে ইঙ্গিত করা।
এই হাদীসটি আল্লাহর বাণী: فاتقوا الله ما استطعتم (তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো) এর সমমর্মী।” -আল-মিনহাজ –লিন-নাবাবী: ৯/১০২
ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৮৫৫ হিজরী) বলেন,
قَوْله: فَأتوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُم أَي: افعلوا قدر استطاعتكم، وَقَالَ النَّوَوِيّ: ‘هَذَا من جَوَامِع الْكَلم وقواعد الْإِسْلَام’ وَيدخل فِيهِ كثير من الْأَحْكَام كَالصَّلَاةِ لمن عجز عَن ركن أَو شَرط فَيَأْتِي بالمقدور، وَكَذَا الْوضُوء وَستر الْعَوْرَة وَحفظ بعض الْفَاتِحَة والإمساك فِي رَمَضَان لمن أفطر بالعذر ثمَّ قدر فِي أثْنَاء النَّهَار إِلَى غير ذَلِك من الْمسَائِل الَّتِي يطول شرحها.اهــ -عمدة القاري في شرح صحيح البخاري: 25/32 ط. دار إحياء التراث العربي – بيروت.
“হাদীসের বাণী: فَأتوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُم (তোমরা যথাসাধ্য তা বাস্তবায়ন করো)। অর্থাৎ তোমাদের সাধ্যে যতটুকু আছে ততটুকু করো। নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, এটা সর্বমর্মী বাণী এবং ইসলামের স্বীকৃত মূলনীতিগুলোর একটি- এর অধীনে অনেক বিধিবিধান এসে যায়, যেমন সালাত; যে ব্যক্তি এর কোনো রুকন বা শর্ত আদায়ে অক্ষম হয়ে যাবে, সে সম্ভবগুলো আদায় করবে। এমনিভাবে অযু, সতর ঢাকা, সূরা ফাতেহার আংশিক মুখস্থ থাকা এবং যে ওজরের কারণে রোযা রাখতে পারেনি, এরপর দিনের কোনো অংশে ওজর দূর হয়ে গেছে, তার জন্য দিনের বাকি অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকার বিধানসহ অনুরূপ আরো অনেক বিধি-বিধান; সব বলতে গেলে কথা দীর্ঘ হয়ে যাবে।” -উমদাতুল কারী: ২৫/৩২
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৮৫২ হিজরী) নববী রহিমাহুল্লাহ এর কথা উদ্ধৃতি করে বলেন,
وقال غيره فيه: أن من عجز عن بعض الأمور لا يسقط عنه المقدور، وعبر عنه بعض الفقهاء بأن الميسور لا يسقط بالمعسور، كما لا يسقط ما قدر عليه من أركان الصلاة بالعجز عن غيره. اهـــ -فتح الباري: 13/262 ط. دار الفكر
“অন্যরা মূলনীতিটিকে এভাবে বলেছেন, কেউ কিছু বিষয়ে অক্ষম হয়ে গেলে সক্ষমটা রহিত হয় না। কোনো কোনো ফকীহ এটাকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন, অসম্ভব কাজের কারণে সম্ভব কাজ মাফ হয়ে যায় না। যেমন সালাতের যে কাজগুলো করতে পারছে না সেগুলোর কারণে যা করার সক্ষমতা আছে সেটা বাদ হয়ে যায় না।” -ফাতহুল বারী: ১৩/২৬২
উল্লেখ্য, الميسور لا يسقط بالمعسور শব্দে বা এর কাছাকাছি শব্দেই সাধারণত শাফেয়ী, মালেকী এবং হাম্বলী মাযহাবে উপর্যুক্ত মূলনীতিটি উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আর হানাফী মাযহাবেও এই মূলনীতিটি স্বীকৃত। এ জন্যই হানাফী ফকীহ ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহিমাহুল্লাহ উমদাতুল কারী কিতাবে ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহর আলোচনাটি উদ্ধৃতি করেছেন। তবে হানাফী মাযহাবের উসুলুল ফিকহের কিতাবগুলোতে আদা-কাযার আলোচনায় এ মূলনীতির উল্লেখ পাওয়া যায় ভিন্ন শব্দে। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মুসলিম তার উপর আবশ্যক বিধানটিকে ‘আদায়ে কাসের’ তথা অসম্পূর্ণভাবে হলেও আদায় করতে সক্ষম, ততক্ষণ পর্যন্ত আদায় করাই জরুরি, কাজা করাও বৈধ নয়। একান্ত যদি বিধানটি সে আদায় না-ই করে, তবুও সেটি মাফ হয়ে যায় না, কাযা করা আবশ্যক থেকে যায়।
উপরে বদরুদ্দীন আইনী, ইবনে হাজার আসকালানি এবং নববী রহিমাহুল্লাহর আলোচনা একটু লক্ষ করুন। এটা শুধু তাদের দুই-তিনজনের কথা নয়, কোনো এক-দুটি মাযহাবের অনুসৃত মূলনীতিও নয়; বরং এই মূলনীতির উপর পুরো উম্মাহর ইজমা রয়েছে। এ জন্যই ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,
هذا من قواعد الإسلام المهمة. اهـــــ. – المنهاج شرح صحيح مسلم بن الحجاج: 9/102 ط. دار إحياء التراث العربي – بيروت.
“এটি দীন ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত।” -আল-মিনহাজ –লিন-নাবাবী: ৯/১০২
এটি ফিকহের কাওয়ায়েদে কুল্লিয়্যারও অন্তর্ভুক্ত
ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী জুয়াইনী রহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৪৭৮ হিজরী) বলেন,
من الأصول الشائعة التي لا تكاد تنسى ما أقيمت أصول الشريعة أن المقدور عليه لا يسقط بسقوط المعجوز عنه.اهـــ. –غياث الأمم: 469 ط. مكتبة إمام الحرمين.
“যতদিন শরীয়তের মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন যে সর্বজন স্বীকৃত মূলনীতিটি বিস্মৃত হবে না, তা হল, যে অংশ করতে অক্ষম তার কারণে যে অংশ করতে সক্ষম তা মাফ হয় না।” –গিয়াসুল উমাম: ৪৬৯
আরও দেখুন: আলআশবাহ ওয়ান্নাযায়ের-সুবকী: ১/১৫৫-১৫৬, (দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা), আল-ওয়াজীয ফি ইযাহি কাওয়ায়িদিল ফিকহিল কুল্লিয়্যাহ: ১/৩৯৬, (মুয়াসসাসাতুর রেসালা)
এ ছাড়াও অসংখ্য ইমাম কাছাকাছি শব্দে এই মূলনীতিটি বর্ণনা করেছেন। আমরা সামান্য কিছু হাওয়ালা এখানে উল্লেখ করছি-
ইমাম আবু মুহাম্মাদ ইযযুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম রহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৬৬০ হিজরী) বলেন,
[قاعدة]: وهي أن من كلف بشيء من الطاعات فقدر على بعضه وعجز عن بعضه فإنه يأتي بما قدر عليه ويسقط عنه ما عجز عنه لقوله – سبحانه وتعالى: {لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلَّا وُسْعَهَا} وقوله عليه السلام: “إذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم”. اهــــ. – قواعد الأحكام في مصالح الأنام: 2/5-6 ط. دار المعارف بيروت – لبنان
“মূলনীতি হলো, যার উপর ইবাদত সংক্রান্ত কোনো বিধান আরোপিত হয়েছে; যার কিছু অংশ সে করতে সক্ষম, আর কিছু অংশে সে অক্ষম, তাহলে যতটুকু সে করতে সক্ষম ততটুকু পালন করবে। আর যতটুকু অক্ষম সেটা পালন করতে হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন: لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلَّا وُسْعَهَا (“আল্লাহ সাধ্যাতীত কোনো কিছু বান্দার উপর চাপিয়ে দেন না”)। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কাজের আদেশ করবো, সাধ্যমতো তোমরা তা পালন করো’।” –কাওয়ায়িদুল আহকাম: ২/৫-৬
‘আর যেখানে সে অক্ষম তা রহিত হয়ে যাবে’ মূলনীতির এই অংশটি প্রয়োগ করার শর্ত হচ্ছে, ব্যক্তি বাস্তবেই বিধানটি পালনে অক্ষম হতে হবে। শুধুই ধারণা এবং দাবি হলে হবে না, যেমন বার্ধক্য ও অসুস্থতা ইত্যাদির মতো এমন বাস্তব ওজর, যার ফলে শরীয়তের দৃষ্টিতে সে অতি কষ্টসাধ্য অংশটি ছাড়তে অনুমোদন প্রাপ্ত। দেখুন আল-মুওয়াফাকাত: ১/৪৯৩
লক্ষ করুন, বনী ইসরাঈলও পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করা এবং অতি শক্তিধর এক সম্প্রাদয়ের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার ব্যাপারে অক্ষমতার দাবি করেছিল, কিন্তু এই দাবির কারণে তাদের উপর আরোপিত দায় থেকে তারা মুক্তি পায়নি। বরং তাদেরকে আল্লাহ তাআলা নবী মূসা আলাইহিস সালামের যবানে অবাধ্য সম্প্রদায় বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৭২৮ হিজরী) এই মূলনীতিটি একাধিক শব্দে ব্যক্ত করেছেন,
এক.
العبادات المشروعة إيجابا أو استحبابا إذا عجز عن بعض ما يجب فيها لم يسقط عنه المقدور؛ لأجل المعجوز.اهــــ -مجموع الفتاوى: 26/230 ط. مجمع الملك فهد.
“শরীয়তের ওয়াজিব কিংবা মুস্তাহাব ইবাদতগুলোর ক্ষেত্রে কেউ যদি কোনো আবশ্যকীয় অংশে অক্ষম হয়, তাহলে এ অক্ষমতার কারণে সক্ষম অংশ তার থেকে মাফ হবে না।” –মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৬/২৩০
দুই.
… ومعلوم أن الصلاة وغيرها من العبادات التي هي أعظم من الطواف لا تسقط بالعجز عن بعض شروطها وأركانها اهــــ -مجموع الفتاوى: 26/230 ط. مجمع الملك فهد.
“… আর জানা কথা যে, সালাত সহ অন্য ইবাদতসমূহ; যা তাওয়াফ থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কোনো শর্ত বা রুকুন আদায়ে অক্ষম হয়ে গেলে পুরো বিধান পালন থেকেই সে মুক্তি পায় না।” –মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৬/২৩০
তিন.
إذا أمكن العبد أن يفعل بعض الواجبات دون بعضٍ، فإنه يُؤمَر بما يقدر عليه، وما عجز عنه يبقى ساقطًا”.اهـــ. -مجموع الفتاوى: 26/ 187- 188 ط. مجمع الملك فهد.
“যদি এমন হয় যে, বান্দা তার কর্তব্যগুলোর কোনোটা করতে পারে, আর কোনোটা পারে না, তাহলে সে যা করতে সক্ষম, সেগুলো করতে সে আদিষ্ট। আর যেখানে সে অক্ষম, সেটা বাদ যাবে।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৬/১৮৭-১৮৮
ইমাম শিহাবুদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ আল-কারাফী আল-মালেকী রহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৬৮৪ হিজরী) ব্যক্ত করেছেন এই শব্দে,
“إن المتعذِّر يسقط اعتباره، والممكن يستصحب فيه التكليف”اهـــ. –الفروق للقرافي: 3/ 198 ط. عالم الكتب
“যা অসম্ভব তা তো বিবেচনার বাইরে। যেটা সম্ভব সেখানেই আদেশ কার্যকর হবে।” –আল-ফুরূক লিলকারাফী: ৩/১৯৮
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৮৫২ হিজরী) এভাবে ব্যক্ত করেছেন,
” أن من عجز عن بعض الأمور لا يسقط عنه المقدور وعبر عنه بعض الفقهاء بأن الميسور لا يسقط بالمعسور.اهــــــ -فتح الباري: 13/262 ط. دار الفكر
“কেউ কিছু বিষয়ে অক্ষম হলে সক্ষমটা রহিত হয় না। কোনো কোনো ফকীহ এটাকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন, অসম্ভব কাজের কারণে সম্ভব কাজ বাতিল হয়ে যায় না। যেমন সালাতের যে কাজগুলো করতে পারছে না সেগুলোর কারণে যা করার সক্ষমতা আছে সেটা বাদ যায় না। -ফাতহুল বারী: ১৩/২৬২
চার মাযহাবের সর্বসম্মত মত
সুতরাং চার মাযহাবের সর্বসম্মত মত এটাই যে, কেউ যদি সালাতের কোনো শর্ত বা রুকন আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়ে, তাহলে তার উপর থেকে পুরো সালাতের ফরযিয়াত মাফ হয়ে যায় না।
চিন্তা করুন! সালাতের রুকনের চেয়েও মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ আর কী আছে? কিন্তু একজন প্যারালাইজড পঙ্গু মানুষ কিয়াম-রুকু-সিজদা করতে অক্ষম হলেও তার উপর সালাত ফরয থেকেই যাচ্ছে। যেভাবে সে সালাত আদায় করতে সক্ষম সেভাবেই আদায় করা ফরয।
ঠিক জিহাদেরও অতি মৌলিক অংশটি হলো, সশরীরে কিতালে অংশ নেয়া। তাই কেউ যদি কিতালে অক্ষম হয়, কিন্তু জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর অন্যান্য কাজে সক্ষম হয়, তাহলে তার উপর সেগুলো ফরয থেকে যায় এবং সেগুলো আদায় না করে ফরযের দায় থেকে মুক্ত হতে পারে না। যদিও বাস্তবতা হলো আমাদের ভূমিগুলোর সকলেই কিতালে অক্ষম নয়। সবাই না পারলেও অন্তত কিছু মানুষ অবশ্যই অন্য ভূমিতে হিজরত করে সরাসরি কিতাল করতেও সক্ষম।
বাস্তব প্রামণ
বিগত শেষ কয়েক দশকে আফগান সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন রণাঙ্গনে বাংলাদেশসহ বহিঃবিশ্বের নানা প্রান্তের হাজারো যুবকের অংশগ্রহণ এর বাস্তব প্রমাণ। যারা স্থানীয় তাগুতের রক্তচক্ষু ও জাতীয়তাবাদের কাঁটাতার উপেক্ষা করে আমলের মাধ্যমে তাদের জীবনের লালিত স্বপ্ন জিহাদি তামান্নার সত্যতা প্রমাণ করেছেন।
{مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا (23) لِيَجْزِيَ اللَّهُ الصَّادِقِينَ بِصِدْقِهِمْ وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِينَ إِنْ شَاءَ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا } [الأحزاب: 23، 24]
“মুমিনদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে; কেউ তো নিজেদের নজরানা পেশ করেছে আর কেউ অপেক্ষায় আছে। তারা তাতে কোনোরূপ পরিবর্তন করেনি। কেননা আল্লাহ সত্যনিষ্ঠদেরকে তাদের সততার পুরস্কার দিবেন। আর মুনাফিকদেরকে ইচ্ছা করলে শাস্তি দিবেন, অথবা তাদের তাওবা কবুল করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” -সূরা আহযাব: ৩৩:২৩-২৪
ময়দানের বাইরে থেকে জিহাদে অংশ গ্রহণের কিছু আদর্শ দৃষ্টান্ত
ফিলিস্তিন জিহাদ
আমরা দেখেছি, ১৯৬৭ সালে যেখানে সবগুলো আরব রাষ্ট্র মিলে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে মাত্র ৬ দিনের মাথায় কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করেছিল, সেই সঙ্গে ইসরাঈলের হাতে মুসলমানদের অনেকগুলো ভূমি তুলে দিয়ে যিল্লতি ও লাঞ্ছনা বরণ করে নিয়েছিল, সেখানে আজ তুফানুল আকসার মুবারক এই যুদ্ধে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ গাজা দীর্ঘ তিন মাসেরও অধিক সময় প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে এবং সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ইসরাঈলকে ক্রমাগত নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে। ইসরাঈলের সঙ্গে আরব গাদ্দার শাসকদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সকল উদ্যোগ-আয়োজন ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। ওয়া লিল্লাহিল হামদু ওয়াল মিন্নাহ।
কল্পনাকেও হার মানানো এই বিস্ময়কর অপারেশনের পেছনে আছে এমন অসংখ্য মুজাহিদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাঁথা, যারা ফিলিস্তিনের বাইরে আপনার আমার মতো সহযোগী ভূমি থেকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। আজকের তুফানুল আকসায় আলাদা করে যে বিষয়গুলো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো, তথ্যপ্রযুক্তির জগতে মুজাহিদদের বিস্ময়কর উত্থান ও অগ্রগতি। আর এ অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যিনি রেখেছেন, তিনি হচ্ছেন শহীদ মুহাম্মাদ জুওয়ারি রহিমাহুল্লাহ।
শহীদ মুহাম্মাদ জুওয়ারি রহিমাহুল্লাহর বিস্ময়কর অবদান
শহীদ মুহাম্মাদ জুওয়ারি রহিমাহুল্লাহ ফিলিস্তিনের নাগরিক নন। জন্মেছেন তিউনিসিয়ায়। তিউনিসিয়ার ভূমি অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। বাংলাদেশের ভূমির মতোই বর্তমান অবস্থা পরিবর্তিত না হলে, সামরিক দৃষ্টিতে তিউনিসিয়াকে গেরিলা যুদ্ধের ময়দান বানানো কিংবা সেখানে যুদ্ধ শুরু করার সুযোগ নেই। আলহামদুলিল্লাহ, শহীদ জুওয়ারি রহিমাহুল্লাহ সেখানকার নাগরিক হয়েও আর দশজনের মতো গতানুগতিক চিন্তা করেননি। ‘দোয়া করা ছাড়া অন্য কিছুতে আমাদের সক্ষমতা নেই, যিম্মাদারিও নেই’ এমন প্রচলিত ভুল চিন্তায় তিনি পা দেননি। তিনি সেভাবেই ভেবেছেন, যেমনটা আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা কুরআনে বলেছেন এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীসে বলেছেন, অতঃপর যেমনটা ফুকাহায়ে কেরাম তাঁদের কিতাবে লিখেছেন।
তিনি অনুধাবন করেছেন, চলমান জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর কাজে আমাদের যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, অন্তত ততটুকু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা ফরয। সেটা করতে হলে ময়দানের মুজাহিদদের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে এবং তাদের নির্দেশনা মোতাবেক নিজের সক্ষমতাটাকে কাজে লাগাতে। যেমন চিন্তা করেছেন, তেমন সেটাকে তিনি বাস্তবায়ন করেও দেখিয়েছেন।
মুহাম্মাদ জুওয়ারি ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান এক ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই মেধা ও কর্মদক্ষতাকে জিহাদের পথে কাজে লাগানো ফরয। নুসরতের ভূমির অধিবাসী হওয়ায় কেবল দোয়া ছাড়া সব দায়িত্ব মাফ হয়ে যায়নি। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যখন তিনি জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর যিম্মাদারি আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বারা এত বড় কাজ নিয়েছেন, যা আমাদেরকে সিদ্দিকে আকবার রাযিয়াল্লাহু আনহুর সেই বাক্যটিই স্মরণ করিয়ে দেয়, যা তিনি কাকা ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বলেছিলেন-
لصوت القعقاع في الجيش خيرٌ من ألف رجل. أسد الغابة ط الفكر: 4/ 109
“সৈন্যবাহিনীর মাঝে কাকার কণ্ঠস্বর এক হাজার যোদ্ধা থেকেও অধিক উত্তম। -উসদুল গাবাহ: ৪/১০৯
নিঃসন্দেহে জুওয়ারি রহিমাহুল্লাহ লড়াইয়ের ময়দান থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও, দূর থেকে নুসরতের মাধ্যমে জিহাদের যিম্মাদারি আদায় করা সত্ত্বেও একাই তিনি হাজারো যোদ্ধার চেয়ে অধিক কার্য়কর ভূমিকা রেখেছেন। হামাসের ব্যবহৃত ড্রোনগুলো তাঁরই আবিষ্কার এবং তাঁর নামেই নামকরণ করা। আত্মঘাতী ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, টর্পেডো, ক্রমোন্নতির পথে থাকা রকেট ও মিসাইল এবং এ্যান্টিট্যাংক ইয়াসীন-১০৫ সহ আজ ফিলিস্তিন মুজাহিদদের হাতে যে চমৎকার সব গেম চেঞ্জার প্রযুক্তি দেখছি আমরা, এসবের পেছনেও তাঁর অবদান অনেক। তাঁর শাহাদাতের পর হামাসের সামরিক মুখপাত্র আবু উবায়দাহ বলেছেন, জুওয়ারির আগমন আমাদের প্রযুক্তি বিষয়ক কার্যক্রমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। চালকবিহীন আত্মঘাতী সাবমেরিন আবিষ্কারে কর্মরত অবস্থায় অভিশপ্ত মোসাদের হাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
আমরা গতানুগতিক স্লোগানকে মহাসত্য ধরে নিয়ে আমাদের সক্ষমতার জায়গাগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি। তাই আজ আমরা দোয়া ছাড়া আর কোনো যিম্মাদারী স্বীকার করতে পারিনি। এটাই আমাদের মাঝে আর জুওয়ারীর মাঝে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
শায়খ ইযযুদ্দীন আল-কাসসাম রহিমাহুল্লাহ
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে লিবিয়ায় ইতালির বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনে ব্রিটেন ও ইহুদীদের বিরুদ্ধে জিহাদ সংঘটিত হয়। খেলাফতের পতন এবং পতন পরবর্তী সময়ে এ দুটি জিহাদ যেন উম্মাহর অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল।
উম্মাহর দুই ভূখণ্ডে সংঘটিত দুই যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছিলেন শায়খ ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রহিমাহুল্লাহ, যাঁর নামে নামকরণ করা হামাসের সামরিক শাখা ‘ইযযুদ্দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড’ আজ তুফানুল আকসায় বিশ্ব মোড়লদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনে তিনি সরাসরি উপস্থিত থেকে জিহাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর লিবিয়া যুদ্ধে মূল ময়দান থেকে দূরে থাকলেও অবদানে তিনি হয়ে উঠেছিলেন লিবিয়া যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব।
অর্থ সংগ্রহ করে ময়দানে পাঠানোর পাশাপাশি পুরো শাম অঞ্চল থেকে যুবকদেরকে জিহাদের জন্য সংগঠিত করে লিবিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যদিও সকল উদ্যোগ সফল হয়নি, কিন্তু ইযযুদ্দীন রহিমাহুল্লাহ সক্ষমতা অনুযায়ী জিহাদ করে যেতে কোনো কসুর করেননি।
আরেক ফিলিস্তিনি যুবকের কীর্তিগাঁথা
ফিলিস্তিনি যুবক ইঞ্জিনিয়ার উমর। প্রোগ্রামিং এবং হ্যাকিংয়ে পারদর্শী। বসবাস করেন তুরস্কে। কিন্তু তুরস্ক যুদ্ধের ভূমি নয় বলে তিনি নিজেকে যিম্মাদারী থেকে মুক্ত মনে করে বসে থাকেননি। তাঁর দক্ষতা ও সামর্থ্য দিয়ে তিনি জিহাদ করেছেন এবং কতইনা উত্তম কাজ করেছেন। তুফানুল আকসায় তাঁর ভূমিকা ময়দানের শত যোদ্ধার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ইসরাঈলের আরয়ন ডোমের পরাক্রমের কথা শুনে শুনে পৃথিবী অস্থির। যে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় জায়নবাদীদের অহমিকার অন্ত ছিল না। সে আয়রন ডোমের প্রোগ্রামিং সিস্টেম হ্যাক করে বিকল করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন উমর। ফলে এখন অনেক সময়ই হামাসের রকেটগুলো ইসরাঈল ঠেকাতে পারছে না। এমনকি সিস্টেম গোলযোগজনিত কারণে অনেক সময় আয়রন ডোমের প্রতিরক্ষা রকেটই ঘাতক হয়ে পতিত হচ্ছে তেল আবিবে ইহুদীদের মাথায়। আয়রন ডোমকে দুর্বল না করা গেলে, হাজারো রকেট ছুঁড়েও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা নিঃসন্দেহে কঠিন হতো হামাসের পক্ষে।
সিরিয়া জিহাদ
ডা. সাজুল ইসলাম সিলেটি হাফিযাহুল্লাহ
ডা. সাজুল ইসলাম বাংলাদেশের সিলেটি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। উম্মাহদরদী মেধাবী এই ডাক্তারের দুনিয়াবি সুযোগ-সুবিধার কোনো কমতি ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু পার্থিব জীবনের সব সুযোগ-সুবিধা, আলো ঝলমল ভবিষ্যতের হাতছানি, মখমল জীবনের পিছুটান উপেক্ষা করে আল্লাহর এই বান্দা হিজরত করেছেন ইদলিবে। রাশিয়া, ইরান, হিজবুল্লাহ এবং বাশার আল আসাদের বোম্বিংয়ে আহত মুজাহিদ ও মুসলিম রোগীদের চিকিৎসা করে দিন কাটছে তাঁর।
আফগান ও চেচনিয়া জিহাদ
এ শতাব্দীতে উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম জিহাদগুলোর অন্যতম আফগান জিহাদ এবং চেচনিয়ার জিহাদ। এ জিহাদ দুটো নিয়ে বলা যায় উম্মাহর প্রায় সকল মানহাজ ও মাসলাকের উলামায়ে কেরাম গর্ব করেন। আফগান জিহাদে যে কত শত, হাজার বিদেশি মুজাহিদ অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিশাল বড় ভূমিকা রেখেছেন, তা তো সবারই জানা। এখানে উদাহরণ হিসেবে নুসরতের ভূমি থেকে ওঠে আসা কয়েকজন কিংবদন্তি মুজাহিদের নাম উল্লেখ করছি।
শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ
আফগান জিহাদের দুই কিংবদন্তি শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ ও শায়খ আইমান যাওয়াহিরীর সুখ্যাতি ও পরিচিতি তো আলোচনার উর্ধ্বে।
আফগান জিহাদের আরেক কিংবদন্তি ‘ফাদার অব জিহাদ’ খ্যাত শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ। শায়খ উসামা বিন লাদেন, শায়খ সাইফুল ইসলাম খাত্তাব, শায়খ ইউসুফ আল উইয়াইরী রহিমাহুমুল্লাহর মতো মহান মুজাহিদরা যাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জিহাদে এসেছিলেন, তিনিই আধুনিক জিহাদের রূপকার শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ। আফগান জিহাদে হিজরত করে বহুমুখী জিহাদি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিলেন অসামান্য প্রতিভাবান এই আলেম। বিশ্বের নানা প্রান্তে সফর করে, উলামাদের সাথে মতবিনিময় করে, দাওয়াত ও লেখালেখির মাধ্যমে প্রচুর কাজ করেছেন তিনি আফগান জিহাদের নুসরতে। আফগান জিহাদের অনেক বড় বড় মুজাহিদই তাঁর সে নুসরতের ফসল।
হাফিজুস সহীহাইন ইউসুফ আল উইয়াইরী রহিমাহুল্লাহ
আরেকজন হলেন হাফিজুস সহীহাইন শায়খ ইউসুফ আল উইয়াইরী রহিমাহুল্লাহ। তিনি কেবল সাধারণ একজন সৈনিকই ছিলেন না; বরং অসামান্য একজন প্রশিক্ষকও ছিলেন। তাঁর পরিচালিত প্রশিক্ষণ শিবির থেকে হাজারো আফগান এবং নন আফগান মুজাহিদ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে জিহাদে অংশগ্রহণ করছেন।
আর দশজন প্রশিক্ষকের মতোও ছিলেন না শায়খ ইউসুফ। তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সমরবিদদের একজন। তাঁর লেখা বইগুলো নিয়ে বিশ্বের বহু নামকরা সামরিক একাডেমিতে গবেষণা হয়। আফগান জিহাদে তিনি সরাসরি শরীক ছিলেন আর চেচনিয়ার জিহাদে শরীক ছিলেন অর্থ সংগ্রহের যিম্মাদারী আদায়ের মাধ্যমে। নিজ ভূমি সৌদিতে অবস্থান করে সময়ে সময়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পৌঁছে দিতেন চেচনিয়ার ময়দানে।
সাইফুল ইসলাম খাত্তাব রহিমাহুল্লাহ
তাঁদের আরেকজন সাইফুল ইসলাম খাত্তাব রহিমাহুল্লাহ। তিনিও সৌদি আরবের সন্তান। আফগান ও চেচেন উভয় জিহাদেই শরীক হয়েছেন। বিশেষ করে চেচনিয়ার প্রথম জিহাদে রাশিয়াকে পরাজিত করার পেছনে তাঁর যে বিপুল অবদান ছিল সেটা শত্রু-মিত্র সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেন।
বাইরের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান জিহাদগুলোতে বাইরের সহযোগিতা যে কি পরিমাণ প্রয়োজন, তা হয়তো আমাদের অনেকেরই ধারণার বাইরে। একটি উদাহরণ টেনে পূর্ণ অবগত করা সম্ভব না হলেও কিছুটা ধারণা আশা করি দেয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
যেমন হামাসের ১০ থেকে ২৫০ কিমি রেঞ্জের এক একটি রকেট তৈরিতে খরচ হয় কমপক্ষে তিনশত থেকে আটশত ডলার। প্রকাশিত তথ্য মতে প্রথম তিন মাসে হামাস রকেট ব্যবহার করেছে অন্তত ১২০০০ (বারো হাজার)। গড়ে প্রতিটি রকেটের দাম ৬০০ (ছয়শত) ডলার হলে বাংলাদেশি টাকায় বারো হাজার রকেটের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় একশত কোটি টাকা। শুধু রকেটের খরচই যদি এই পরিমাণ হয়, তাহলে তাদের ব্যবহৃত একে ৪৭, .50 ক্যালিবার DShk মেশিনগান, আর পিজি, স্নাইপার রাইফেল, আইইডি, প্যারা গ্লাইডার, ড্রোনসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং ১৫/২০ হাজার মুজাহিদ, তাদের পরিবার-পরিজন ও সাংগঠনিক ব্যয় নির্বাহের খরচ কত বিপুল, একটু চিন্তা করলেই অনুমান করা যায়।
অপর দিকে এটা স্পষ্ট যে, গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে এই অর্থের যোগান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ২৩ লক্ষ জনগণের মধ্যে ১২ লক্ষই ছিলেন ভিটেমাটি হারা শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা। যাদের জীবন যাপনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণের অর্থও তাদের নেই। যেখানে অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের জীবন বাঁচানোই দায়, সেখানে যুদ্ধের খরচের তো প্রশ্নই আসে না। নতুন করে ইসরাঈলি বর্বরতা শুরুর পর শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ লাখে। যাদের অনেকেই এক বেলা খাবার, পানযোগ্য পানি ও চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অধিকাংশ হাসপাতালই হয় বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত না হয় জ্বালানির অভাবে বন্ধ। অ্যানেস্থেসিয়ার অভাবে আহত রোগীর অপারেশন করা হচ্ছে অবশ ও অচেতন করা ছাড়াই। প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোসহ কীভাবে সমগ্র বিশ্ব তাদের অবরুদ্ধ করে অর্ধাহারে অনাহারে মারছে, তার প্রতি যে পশ্চিমা শত্রুদেরও করুণা হচ্ছে, তা আমরা নিয়মিতই প্রথম সারির আন্তার্জাতিক মিডিয়াগুলোতে দেখছি। এই অবস্থায় তাদের বাইরের সাহায্য কী পরিমাণ প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফিলিস্তিন জিহাদের অর্থের উৎস, প্রভাব ও আমাদের দায়
স্বভাবতই এই বিপুল অর্থের যোগান যখন স্থানীয়দের পক্ষে সম্ভব নয়, তখন এই ফরয বর্তায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের উপর। সামর্থ্য অনুযায়ী সকলেরই তাতে অংশ গ্রহণ করা ফরয। এটি সর্বসম্মত মাসআলা। কিন্তু আমাদের এই দায়িত্ব আদায় না করার মাশুলও উম্মাহকে গুণতে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও গুণতে হবে।
অধিকাংশ মানুষ গাফেল থাকলেও উম্মাহর একটি অংশ আলহামদুল্লিাহ সাধ্য অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রয়োজনীয় অর্থের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের যোগান দেন প্রবাসে বসবাসরত ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য ভূখণ্ডের জিহাদ সমর্থক মুসলিমগণ। যারা এ সাদাকাগুলোর মাধ্যমে জিহাদ বিল মালের ফরয আদায় করার চেষ্টা করছেন এবং আল-আকসা রক্ষার জিহাদকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের অর্থ অবশ্যই যথেষ্ট ও পর্যাপ্ত নয়। একারণে বাধ্য হয়েই হামাসকে অনাকাঙ্ক্ষিত উৎস থেকেও অর্থ গ্রহণ করতে হয়।
ইরানের সহযোগিতা উম্মাহর জন্য লজ্জাজনক!
এর চেয়ে বড় লজ্জা ও দুঃখের আর কী হতে পারে যে, মুসলিম উম্মাহর হাতে অঢেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আজ একদিকে নারী শিশু নির্বিশেষে ফিলিস্তিনের লাখ লাখ মুসলিম অর্ধাহারে অনাহারে ধুঁকছে, বোমার আঘাতে জর্জরিত বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের বেঁচে থাকার জন্য ইরানের মতো কট্টর আহলুস সুন্নাহ বিদ্বেষী শিয়াদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হচ্ছে। যদিও তাদের এই অর্থ নিতান্তই অপর্যাপ্ত, কিন্তু এর বিনিময়ে মুসলিম উম্মাহর প্রাণকেন্দ্র মধ্যপ্রাচের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের মতো চড়া মূল্য তারা সুদে আসলে উসুল করে নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যে নিতে থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি সত্যিই প্রাচুর্য নিমজ্জিত উম্মাহর জন্য লজ্জার বিষয়। যেন এই আয়াতেরই মর্মান্তিক দৃশ্য:
{وَمَا نَقَمُوا إِلَّا أَنْ أَغْنَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ مِنْ فَضْلِهِ} [التوبة: 74]
“তারা শুধু এজন্যই প্রতিশোধ নেয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাঁর অনুগ্রহে তাদের প্রাচুর্যময় করেছেন।” –সূরা তাওবা: ০৯:৭৪
ফিলিস্তিনি মুজাহিদদের অগ্রগতি একদিকে আমাদের আনন্দিত করছে, অন্যদিকে শিয়া রাফেজীরা ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়ায় গণহত্যা চালাচ্ছে এবং ইতিমধ্যে এ ভূমিগুলোর অনেকাংশ দখল করে নিয়েছে। এটা উম্মাহর অনেক বড় বিপর্যয়, যা শক্তি সামর্থ্যের অভাব নয়; বরং একমাত্র মুসলিম উম্মাহ তাদের দায়িত্ব পালন না করা এবং মুজাহিদদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে রাখার অনিবার্য ফল। সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর সময়কার সেই সমীকরণ যেন ফিরে এসেছে, একদিকে ক্রুসেডার শত্রু, অন্যদিকে ‘ফাতেমী খেলাফতের’ নামধারী যিন্দিক বনু উবায়েদ। চারদিক থেকে উম্মাহকে শত্রু ঘিরে ধরেছে।
তাই ইরান-হুথি-হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনি মুজাহিদদের সহায়তা দিচ্ছে, এটা আমাদের জিহাদ ত্যাগের এবং মুজাহিদদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে রাখার অজুহাত হতে পারে না। বরং তা আমাদের যিম্মাদারিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘তুফানুল আকসা’ উপলক্ষে আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং ইসলামিক মাগরিবের মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ তাঁদের বিবৃতিতে এ কথাগুলোই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে।[2]
তবুও ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য!
তবুও বলব ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য, যে কারণেই হোক, প্রয়োজনীয় সাহায্য করুক আর না করুক; মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্ববাসী অন্তত তাদের দুর্দশার কথা জানতে পারছে। মুসলিম উম্মাহর অন্তত মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সমর্থন ও সহানুভূতি তারা পাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর অসংখ্য জনপদে মুসলিম উম্মাহর হয়ে এমন অনেক মুজাহিদ তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন, যাদের সম্পর্কে উম্মাহ না ন্যূনতম খোঁজ খবর রাখছে, না মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। বরং উল্টো নিজের গাফলত ও শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ ইত্যাদির মতো অপবাদ দিয়ে তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়াচ্ছে এবং এর অন্তরালে কাফেরদের সাহায্য করে যাচ্ছে।
রক্তাশ্রুও অক্ষম যে উপাখ্যানের চিত্রায়নে!
উইঘুর মুসলিমদের উপাখ্যান আর কী বলব! সেই চিত্র্র তো রক্তাশ্রুর পক্ষেও অঙ্কন করা অসম্ভব। অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ ছাড়া হাত পা বেঁধে কিংবা বুকে গুলি করে অর্ধমৃত মানুষটির কিডনি চক্ষুসহ প্রতিস্থাপন যোগ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুলে যে ব্যবসার হাঁট বসিয়েছে কমিউনিস্ট চাইনিজরা, তার বড় খদ্দেরের ভূমিকা পালন করছেন আমাদেরই রাজরাজড়া ও খাদেমুল হারামাইনরা। কিডনি চক্ষু বের করা অর্ধমৃত যিন্দা লাশটির চিহ্ন মুছে দেয়ার জন্য যে মুসলিম ভাইটিকে জ্বলন্ত আগুনের চুল্লিতে নিক্ষেপ করা হয়, তার সেই কিডনি চক্ষু দিয়ে মদ-নারীতে বুঁদ হওয়া নিঃশেষ জীবন নতুন করে উপভোগ করার চেষ্টা করেন আমাদেরই নামধারী মুসলিম ধনকুবেররা।
মনে রাখা দরকার, এ-সবই সম্ভব হচ্ছে আমাদের ফরয বিধান ত্যাগ করার দরুন। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা আমাদের প্রত্যেকের উপর ফরযে আইন। পূর্ণটা আদায় করার সামর্থ্য না থাকলে, যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকুই আমার উপর ফরয, ততটুকুই আদায় করা জরুরি। অন্যথায় একদিন পরাক্রমশালী মহান রবের কাঠগড়ায় অবশ্যই এর যাররা যাররা হিসেব আমাকে দিতে হবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। ক্ষমার পথ অবলম্বন করার তাওফীক দান করুন।
একটু ভাবুন!
প্রিয় ভাই! একটু ভাবুন, কিসের জন্য আমার এই জীবন! এই জীবনের সুখ! দুনিয়ার সামান্য খেল তামাশা ও প্রতারণার ফাঁদে আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম সবই ভুলে গেলাম তাহলে! আল্লাহর কাছে বিক্রি করা জান মালের সওদা নিয়ে আল্লাহর সঙ্গেই প্রতারণা! অথচ আজ পৃথিবীর সকল মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকলের সামর্থ্যের এক-দশমাংশ ব্যয় করলেও মুসলিম উম্মাহর এমন আত্মঘাতী পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ সম্ভব বি-ইযনিল্লাহ। যে তুচ্ছ দুনিয়ার লোভে ঈমান আমল ও আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে লাঞ্ছনা ও গোলামির শেকল জড়িয়েছি সর্বাঙ্গে, সেই দুনিয়াও সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে আমাদের পদতলে আসতে বাধ্য ইনশাআল্লাহ।
{الر كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ (1) أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ إِنَّنِي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ (2) وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُمْ مَتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ} [هود: 1 – 3]
“আলিফ-লাম-মীম-রা। এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াতসমূহকে (দলীল-প্রমাণ দ্বারা) সুদৃঢ় করা হয়েছে। অতঃপর এমন এক সত্তার পক্ষ হতে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি হিকমতের মালিক এবং সবকিছু সম্পর্কে অবহিত। (এ কিতাব নবীকে নির্দেশ দেয়, যেন তিনি মানুষকে বলেন) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না। আমি তাঁর পক্ষ হতে তোমাদের জন্য সতর্ককারী এবং সুসংবাদদাতা। এবং এই (পথনির্দেশ দেয়) যে, তোমাদের প্রতিপালকের কাছে গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁর অভিমুখী হও। তিনি তোমাদেরকে এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত উত্তম জীবন উপভোগ করতে দিবেন এবং যে কেউ বেশি আমল করবে তাকে নিজের পক্ষ থেকে বেশি প্রতিদান দিবেন। আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমি তোমাদের জন্য এক মহা দিবসের শাস্তির আশংকা করি।” -সূরা হুদ ১১:০১-০৩
{وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ } [النور: 55]
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে জমিনের খলীফা বানাবেন, যেমন খলীফা বানিয়েছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তাদের জন্য তিনি সেই দীনকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা দান করবেন, যে দীনকে তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তারা যে ভয়-ভীতির মধ্যে আছে, তার পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে। আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপরও যারা কুফরি করবে, তারাই অবাধ্য বিবেচিত হবে।” -সূরা নূর ২৪: ৫৫
বাইরের নুসরত ব্যতীত আদৌ কি জিহাদ সম্ভব?
উম্মাহর জন্য এটা অবশ্যই ইতিবাচক ও সুসংবাদ যে, কোনো কোনো ফ্রন্টের জিহাদকে উম্মাহ নিজেদের জিহাদ মনে করছেন, মুজাহিদদেরকে নিজেদের ভাই মনে করছেন, তাদের বিজয়ে আনন্দিত হচ্ছেন, তাদের সহযোগিতার আলোচনা করছেন এবং আংশিক হলেও সহযোগিতার ফিকির করছেন। কিন্তু আমাদের ভাবা দরকার, আমরা যেভাবে জিহাদের কথা বলছি, জিহাদ ও সহযোগিতার সঙ্গে যেসব শর্ত জুড়ে দিচ্ছি, আসলেই কি বর্তমান বিশ্বে সেই জিহাদ সম্ভব? যে আফগান জিহাদ ও ফিলিস্তিন জিহাদের জন্য আজ আমরা মুজাহিদদের সাধুবাদ জানাচ্ছি, তাদের পক্ষেও কি সম্ভব হয়েছে আমাদের ফতোয়া অনুযায়ী এই জিহাদি সফরের যাত্রা?
বিনীত অনুরোধ!
উলামায়ে কেরাম সমীপে; বিশেষত যারা বলছেন, দোয়া করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই, তাদের কাছে আমরা হাতজোড় করে বিনীত অনুরোধ করছি, মেহেরবানি করে একটু ভাবুন, আমার ফতোয়া কতটুকু শরীয়াহ সম্মত ও বাস্তব সম্মত হচ্ছে? কতটুকু জিহাদ ও মুজাহিদের পক্ষে যাচ্ছে আর কতটুকু শত্রুর পক্ষে যাচ্ছে? এমন ফতোয়া কি আদৌ শরীয়তে গ্রহণযোগ্য, যার সুফল উম্মাহর শত্রু ভোগ করে! যে ফতোয়া ইসলাম ও মুসলিম এবং জিহাদ ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফেরদের উপকার করে! যে ফতোয়ায় মুসিলমদের চেয়ে কাফের মুশরিকরা বেশি খুশি হয়!
আপনার নিজেকে নিজের পরিবারকে একটু তাদের জায়গায় চিন্তা করুন। কল্পনা করুন, আপনি আপনার প্রিয় পরিবার গাজা কিংবা উইঘুর মুসলিমদের মতো করুণ পরিস্থিতির শিকার। তখন আপনার মতো স্বচ্ছল সজ্জন মুসলিম ভাইয়ের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি হবে? তাদের কাছে আপনি কি চাইবেন? সামার্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা এগিয়ে আসবে না, তাদের আপনি কোন শ্রেণির মানুষ মনে করবেন?
মনে করুন, আপনার এ দূরাবস্থায় কিছু যুবক তাদের নামধারী মুসলিম শাসকদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আপনার সহযোগিতার পরিকল্পনা করছে, তখন তাদেরকে কিছু আলেম ফতোয়া দিলেন, এটা ঠিক নয়। এসব কাজ হুকুমতের দায়িত্ব। এগুলো আমাদের সামর্থ্যের বাইরের কাজ। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এগুলো ফিতনার কারণ। ইত্যাদি যেমনটি আজ আপনি বলছেন। তখন এই আলেমদের সম্পর্কে আপনার ধারণা ও মূল্যায়ন কী হবে, আল্লাহর ওয়াস্তে একটু ভাবুন। পাঁচটা মিনিট সময় ব্যয় করে একটু নির্জনে চিন্তা করুন, এই ফতোয়া আপনার মীযানে আমলের কোন পাল্লায় ওঠবে!
আপনি যদি সত্য প্রকাশে মাজুর হন!
হ্যাঁ, আপনার যদি সুলতানে জায়ের-জালিম শাসকের সামনে হকের কালিমা উচ্চারণের সাহস ও হিম্মত না থাকে, আপনি যদি আপনার অবস্থান থেকে তা হিকমাহ ও প্রজ্ঞা পরিপন্থী মনে করেন বা আপনার যদি বাস্তবে কোনো ওজর কিংবা বাধ্যবাধকতা থাকে, সেটারও উসওয়া আছে সালাফের কাছে। আপনি আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো বলে দিন, আমি যদি সঠিক ফতোয়া দেই, আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। এতটুকু বলে ক্ষান্ত হয়ে যান। কিংবা সম্পূর্ণ চুপ থাকুন। এতটুকু রুখসত মাজুর কিংবা দুর্বলের জন্য অবশ্যই আছে। কিন্তু তা না করে, এমন অস্পষ্ট কিংবা অপূর্ণ ফতোয়া প্রদান করা, যার ফলে উম্মাহ বিভ্রান্ত হয়, জিহাদ ও মুজাহিদদের ক্ষতি হয়, যুদ্ধরত শত্রু উপকৃত হয়, তার অনুমোদন তো আপনার জন্য নেই।
যে ফতোয়ায় মানুষ সহীহ জিহাদের প্রতি উৎসাহিত না হয়ে আরও স্তিমিত হয়ে পড়ে, সে ফতোয়া দেয়ার আগে হাজার বার ভাবা জরুরি, আমি কী ফতোয়া দিচ্ছি! বর্তমান জিহাদগুলো তো সব মৌলিকভাবে মুত্তাফাক আলাইহি এবং দিফায়ী জিহাদ। যদি ধরেও নেই, আপনার ইখতেলাফের কারণে বিষয়টি মুখতালাফ ফিহি হল, তাহলেও কি আপনার জন্য এমন ফতোয়া ও প্রচারণা জায়েয, যা মুজাহিদদের বিপক্ষে কাফেরদের উপকৃত করে? বরং যে ফতোয়ার উপর আমল করলে জিহাদই ‘মুয়াত্তাল’ ও অকার্যকর হয়ে যাবে?
এই ফতোয়া অনুযায়ী জিহাদ হয়নি এবং জিহাদ অসম্ভব!
বাস্তবতা হল, বর্তমান গ্লোবাল পৃথিবীতে গেরিলা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যেখানে বিশ্বশক্তি ঐক্যবদ্ধ, সেখানে গাজা-আফগানের মতো বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ এবং শত্রুর সঙ্গে যোগ দেয়া নামধারী মুসলিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র দ্বারা বেষ্টিত কোনো অঞ্চলেই বাইরের সাধারণ মুসলিমদের সহযোগিতা ছাড়া, না জিহাদ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, না কোথাও জিহাদে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। যে আফগান জিহাদ ও ফিলিস্তিন জিহাদ নিয়ে আজ আমরা আনন্দিত হচ্ছি, গর্ব করছি, যে বিজয়ে উজ্জীবিত হয়ে জিহাদের পক্ষে কথা বলার সাহস পাচ্ছি, তাও বহির্বিশ্বের সাধারণ মুসলিমদের সহযোগিতা ছাড়া বাস্তবতার আলো দেখেনি, দেখা সম্ভবও ছিল না। যে আফগানদের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী জিহাদ করতে হয়েছে, আমাদের ফতোয়া অনুযায়ী বহির্বিশ্ব থেকে তাগুত শাসকদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মুসলিম যুবকরা যদি সেখানে সমবেত না হত, তাহলে হয়তো পরাশক্তির মোকাবেলায় ০৬ মাসও তাদের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বিজয় তো অনেক দূরের প্রশ্ন।
সুতরাং যে ফতোয়া অনুযায়ী বর্তমান জিহাদগুলোর বাস্তব রূপদান সম্ভব নয়, বরং কারো কারো ফতোয়া অনুযায়ী তা নাজায়েয, তাদেরই বিজয় ও সফলতার পর্বে সেই জিহাদের পক্ষে কথা বলা এবং তাতে আনন্দ প্রকাশ করা দ্বিচারিতা ও বাস্তবতা পরিপন্থী নয় কি?
নুসরতের ভূমিতে সক্ষমতা নিরূপণ ও করণীয় নির্ধারণ
যদি আমরা বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশের মতো নুসরতের ভূমিগুলোর প্রেক্ষাপটে আমাদের সক্ষমতা নিরূপণ করার চেষ্টা করি, তাহলে স্পষ্টই দেখবো, আমাদের সক্ষমতা মোটেও শুধু দোয়া করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর বাইরেও বহুভাবে জিহাদে শরীক হওয়ার সক্ষমতা আমাদের আছে। এখানে আমরা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিন্দু উল্লেখ করছি।
০১. ময়দানে গিয়ে কিতালে শরীক হওয়া
নুসরতের ভূমির অধিবাসীদের একটা অংশ আক্রান্ত ভূমিতে হিজরত করে সরাসরি ময়দানের কিতালে শরীক হতে পারে।
এটা একটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, নুসরতের ভূমির অধিবাসীদের একটা অংশ কিতালেও অক্ষম নয়; বরং প্রচুর সংখ্যক মানুষ যদি শরীয়াহর নীতি অনুসারে ফরযে আইন কিংবা অন্তত ফরযে কেফায়া হিসেবেও বিষয়টিকে আমলে নেয়, তাহলে তারা অবশ্যই কিতালের ভূমিতে হিজরত করে সরাসরি কিতালে অংশ নিতে সক্ষম। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম সকলেই একযোগে হিজরত করে আক্রান্ত ভূমিতে গিয়ে কিতালে শরীক হওয়া সম্ভব নয় এটা সত্য, এবং এটা উচিতও নয়। মুজাহিদরা এমন কথা বলেনও না। কারণ প্রথমত এ ভূমি মুসলমানদের ভূমি, মুসলমানদের যিম্মাদারী এখানকার সকল দীনি মেহনতগুলো আবাদ ও কায়েম রাখা, মেহনতগুলোকে নষ্ট করে ফেলা নয়। দ্বিতীয়ত খোদ বাংলাদেশও সেক্যুলার শাসন ব্যবস্থায় আক্রান্ত। সুতরাং এ ভূমির মুসলমানদের যিম্মাদরি এটা নয় যে, সবাই এ ভূমি ছেড়ে অন্য ভূমিতে হিজরত করবেন, আর এ ভূমিটি কাফের-মুরতাদ ও সেক্যুলারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাবেন। বরং যিম্মাদারি হলো, অধিকাংশ মুসলিম এ ভূমিতে থেকেই পর্যায়ক্রমে সক্ষমতা অর্জন ও দীন কায়েমের মেহনত করে যাওয়া এবং প্রয়োজন ও সক্ষমতা অনুপাতে কিছু মুসলিমকে আক্রান্ত ভূমিগুলোতে হিজরত করানো। অতঃপর মুহাজিরদের পরিবার ও যাবতীয় বিষয়গুলোর দেখভাল করা।
কিন্তু তাই বলে ১৮ কোটি জনগণের একটা ভূখণ্ড থেকে মাত্র ১৮০০ মুসলিম যুবকও ১৮ টা আক্রান্ত ভূমিতে হিজরত করতে সক্ষম নয়, এমন দাবি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবান্তর।
ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যদি যুবকরা বাংলাদেশ থেকে আফগান জিহাদে গিয়ে শরীক হতে পারে, অল্প কিছু মানুষ নিয়ে গঠিত ছোট্ট একটি জামাআত যদি সেখানে নুসরতের জন্য মুজাহিদ পাঠাতে পারে এবং সে মুজাহিদদের পরিবার-পরিজনের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে পারে, নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করে ময়দানে পৌঁছে দিতে পারে, পাঠানো সেই অর্থ ব্যালেস্টিক মিসাইল হয়ে আমেরিকার ঘাঁটিতে আঘাত হানতে পারে, এই সকল কার্যক্রমই সেক্যুলার-লিবারেলদের চোখ এড়িয়ে নিরাপত্তার সাথে সম্পন্ন হতে পারে, তাহলে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সম্পদশালী, সুস্থ, সবল ও মেধাবী মুসলিমরা কী করে নিজেদেরকে অক্ষম দাবি করতে পারে?
০২. জিহাদ বিল মাল তথা অর্থ দিয়ে জিহাদে শরীক হওয়া
কুরআনুল কারীমে যত জায়গায় আল্লাহ তাআলা জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অধিকাংশেই জান দিয়ে জিহাদ করার পাশাপাশি সম্পদ দিয়ে জিহাদ করার নির্দেশও দিয়েছেন। জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর কার্যক্রমকে মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত করলে, একটি হবে জান দ্বারা জিহাদ করা, দ্বিতীয়টি হবে মাল দ্বারা জিহাদ করা। সামান্য চিন্তা করলেই বুঝা যায়, আমরা কেউই মাল দ্বারা জিহাদ করতে অক্ষম নই। এমনকি ভিক্ষুক এবং যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিরাও নয়।
প্রতিটি ময়দান বর্তমানে অর্থ সংকটে ভুগছে, অথচ পৃথিবীতে মুসলিমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। সারা পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা দুইশত কোটি, যাদের মাঝে মিলিয়নিয়ার ও বিলিয়নিয়ারের সংখ্যাই লক্ষাধিক। এরা সবাই যদি দাবি করতে থাকে, দোয়া করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার সক্ষমতা নেই, তাহলে এ দাবি কি গ্রহণযোগ্য হবে?
বিভিন্ন ছোট ছোট জিহাদি জামাআত প্রতি বছর শুধু সদস্যদের কাছ থেকেই কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে ময়দানে প্রেরণ করছে। আফগান যুদ্ধে মার্কিন ঘাঁটিতে বাংলাদেশি মুজাহিদদের মিসাইল হামলার কথা আমরা আলোচনা করেছি, যে সম্পর্কে মুজাহিদ ভাইগণ ভিডিও প্রকাশ করে এও জানিয়েছেন যে, ওই সকল মিসাইল বাংলাদেশি মুসলিম ভাইদের অর্থায়নে সংগ্রহ করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনের জন্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইদলিবের সহায়তা
কয়দিন আগে সিরিয়ার ইদলিবের মুসলমানদের দান-সাদাকার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মূলধারার মিডিয়ার আলোচনায় এসেছে। অথচ ইদলিবও গাজার মতোই যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি ভূমি, বোমার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া একটি জনপদ। কিন্তু সেখানকার যুদ্ধাহত মুসলিমরাই সবার আগে গাজার জন্য কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে সাদাকা করেছেন, মা বোনেরা গায়ের গহনা খুলে সাদাকা করেছেন। তাঁরা যদি অক্ষম না হয়ে থাকেন, তাহলে আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের জবাব কী হবে?
নুসরতের ভূমি থেকে ওঠে এসে ময়দানের জিহাদে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন শায়খ ইউসুফ আল উইয়াইরী রহিমাহুল্লাহ। তাঁর এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, চেচনিয়ার মুজাহিদরা তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, এক মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে দেয়ার। সুবহানাল্লাহ! একজন মানুষ যদি এত বড় কাজ করতে পারেন, তাহলে আমরা কোটি কোটি মুসলিম সবাই একযোগে কী করে অক্ষমতার দাবি করতে পারি?
০৩. লজিস্টিক (রসদ ও প্রযুক্তি) সহায়তা দিয়ে শরীক হওয়া
জিহাদের ময়দানগুলোতে সার্বক্ষণিক বিভিন্ন ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার। তাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রসায়নবিদ, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ, সমর বিশেষজ্ঞ, সামরিক প্রশিক্ষকসহ জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলোর উপর দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে তাদেরকে হিজরতে পাঠিয়ে কিংবা দূর থেকে নুসরতের মাধ্যমে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর ময়দানগুলোকে সহায়তা করতে পারি আমরা। ময়দানে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন শাস্ত্রে শহীদ মুহাম্মাদ জুওয়ারি, ইঞ্জিনিয়ার উমর, শায়খ ইউসুফ আল উইয়াইরীর মতো অসংখ্য বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের মতো দুর্বল জায়গাতেও আছে।
প্রযুক্তি সহায়তায় আলেমদেরও ভূমিকা রাখা কাম্য
এখানে আমরা আরেকটি বিষয় স্মরণ করাতে চাই! সামরিক প্রযুক্তিতে উম্মাহকে অগ্রসর করার দায়িত্ব শুধু ইঞ্জিনিয়ারদের উপরই বর্তায় না; বরং এ ক্ষেত্রে উলামা-মাশায়েখ ও দাঈদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার অবকাশ আছে। হ্যাঁ, উলামায়ে কেরাম প্রযুক্তি তৈরির কাজে নেমে যাবেন না, কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদেরকে দাওয়াত দিয়ে দীনের পথে আনা, জিহাদের যিম্মাদারি বোঝানো ও শরয়ী দিকনির্দেশনা দেয়া তো আলেমদেরই দায়িত্ব। জিহাদি সংগঠন তৈরি করে সঠিকভাবে শরয়ী দিকনির্দেশনা দেয়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষকে জিহাদে সংগঠিত করা ও পথনির্দেশ করা তো উলামা-মাশায়েখেরই যিম্মাদারি৷ তাঁরা যদি এ যিম্মাদারি সঠিকভাবে আদায় করতে না পারেন, তাহলে উম্মাহর সন্তানদের প্রতিভা ও আবিষ্কার শত্রুর হাতেই যাবে, উম্মাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হয়ে সেটা উম্মাহর বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে।
০৪. সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ময়দানের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়
বর্তমান ফিতনাপূর্ণ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন, তথ্যসন্ত্রাস ও শত্রু নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বৈশ্বিক পৃথিবীতে জিহাদের ভূমির বাইরে থেকে জিহাদে অংশ গ্রহণ করার জন্য এবং জিহাদের ফরয আদায়ের জন্য বিশেষ করে কর্ণধার উলামায়ে কেরাম ও নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের জন্য যে কাজটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে জিহাদের ভূমিগুলোর সঙ্গে নির্ভরযোগ্য যোগসূত্র তৈরি করা এবং সমন্বয় করা। কারণ এমন নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতীত জিহাদের ভূমিতে কোনো সহযোগিতা করা সম্ভব নয় এবং নিরাপদও নয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা হল, এই দায়িত্ব সর্বাগ্রে আলেমদের উপর বর্তালেও আলেমরা এখানে অনেক পিছিয়ে। কারো কারো অবস্থা দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে কোথায় কি ঘটছে, কে কাকে মারছে, এসব খোঁজ খবর নেয়াও সময়ে অপচয় ও অনর্থ কাজ। কেউ কেউ তো এসব বিষয়ে সচেতন যুবকদের ‘আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নেয়া’ ইত্যাকার কথা বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেন না। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, সুমতি দিন।
হক জিহাদের সঙ্গে একীভূত হোন!
আল্লাহর মেহেরানি, বৈশ্বিক জিহাদের সুবাদে এখন বিশ্বের উল্লেখযোগ্য মুসলিম দেশেই জিহাদি জামাআতের কার্যক্রম বিদ্যমান এবং জিহাদের ভূমির সঙ্গে তাদের মজবুত সম্পর্ক ও সমন্বয়ও আছে। আমরা উলামায়ে কেরামকে বিনীত অনুরোধ করব, আপনারা মেহেরবানি করে একটু খোঁজ নিন। আলেমদের জন্য তাদের খুঁজে বের করা কঠিন নয়। তারা আপনার আশপাশেই ঘুরছে এবং আপনার কাছে পৌঁছার চেষ্টা করছে। তাদের কথা বলার সুযোগ দিন। তাদের কথাগুলো শুনুন। আপনার ভয় কিসের? আল্লাহ তো আপনাকে হক-নাহক যাচাই করার ইলম ও যোগ্যতা দিয়েছেন। শুনলেই তা গ্রহণ করতে হবে না, আপনি তাদের কথা শুনুন। আপত্তি না করে বাস্তবতা বুঝার জন্য ইস্তেফসার করুন। বাস্তবেই তাদের কাছে সত্য থাকলে আল্লাহ তা উন্মোচিত করে দিবেন এবং আপনার কল্যাণের দ্বার খুলে দেবেন। মিথ্যা প্রমাণিত হলে বাসীরতের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করার পথ খুলে দিবেন। উম্মাহকে মিথ্যা থেকে বাঁচানোও তো আপনার দায়িত্ব। শুধু শোনা কথার উপর আমল করা তো আপনার শান নয়। অমুক বলেছেন তারা হক নয়, সুতরাং তারা না হক, এভাবে উম্মাহ আপনার কথা শুনবে না, আলেম হিসেবে আপনার দায়িত্বও আদায় হবে না।
পিপাসার উপলব্ধি ও উত্তরণের তড়প সৃষ্টি করুন
উম্মাহর অবস্থা তো এখন মরুপ্রান্তরে পাথেয় হারা পিপাসার্ত পথিকের ন্যায়। যে মরীচিকা দেখলেও দৌড়ায়। বরং উম্মাহর পরিস্থিতি তার চেয়েও হাজার গুণ করুণ। সদ্য সন্তান প্রসবিনী মা হাজেরা তো একবার দেখলেন কোথাও পানি নেই। তবুও তিনি সাফা মারওয়ায় সাত সাত বার কেন দৌড়ালেন অসুস্থ অচল শরীরের ভার বয়ে? কারণ তাঁর পিপাসার উপলব্ধি ছিল। সন্তানকে বাঁচানোর তড়প ও বেচাইনি ছিল। চিন্তা করা দরকার আল্লাহই বা কেন সেটাকে উসওয়াহ বানিয়ে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা আমাদেরও দৌড়াচ্ছেন সেই সাফা মাওয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে? তবে কি উম্মাহর এই দুর্দশার উপলব্ধি নেই আমার? কিংবা উত্তরণের তড়প ও বে-চাইনি নেই? না হয় আমি জিহাদের কথা শুনলেই ভয় পেয়ে যাই কেন? আমারও তো উচিত সামান্য সম্ভাবনা দেখলেই খোঁজ নেয়া, সহীহ কাজ ও কর্মপদ্ধতি এবং উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না!
মায়াযাল্লাহ কারো কারো অবস্থা দেখলে মনে হয় তারা খুব মহাশান্তিতে ‘দীন’ পালন করে যাচ্ছেন। জিহাদের আলোচনা আসলেই তথা কথিত সেই ‘পুর-সুকূন দীনি পরিবেশ’ নষ্ট হয়ে যাবে নাউযুবিল্লাহ। আমরা আশা করব, সত্যান্বেষী আলেমগণ তাদের মতো হবেন না। আপনারা বৈশ্বিক জিহাদের খোঁজ খবর নিন। সত্য মিথ্যা যাচাই করে সত্যের নুসরতে এগিয়ে আসুন। তাদের কোনো ভুল ত্রুটি থাকলে যথানিয়মে সেগুলোর ইসলাহ ও সংশোধনের দায়িত্ব পালন করুন। দীর্ঘ এক শতাব্দী পর আল্লাহ আমাদেরকে যে ইমারতে ইসলামিয়ার নেয়ামত দান করেছেন, তার সাহায্যে হাত বাড়ান। তাদের সঙ্গে নিজেকে একীভূত করুন।
আর যারা মনে করেন আমরা সুকূনের সঙ্গে দীন পালন করছি, তাদের বলব আপনার এই তথাকথিত ‘দীন’ ও ‘পুর-সুকূন দীনি পরিবেশ’কে মেহেরবানি করে একটু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের দীনের সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করুন। তবেই আল্লাহ আপনার কল্যাণের পথ খুলতে পারেন ইনশাআল্লাহ।
যদি হক জামাআত খুঁজে না পান!
যদি হক জামাআত আপনি খুঁজে না পান, তবুও একজন আলেম হিসেবে আপনার ছুটি নেই। মুসলিমদের সংগঠিত করুন, হক জামাআত তৈরি করুন। মুসলিম উম্মাহকে এভাবে কাফেরদের শিকারে পরিণত হতে দেয়া, উম্মাহকে শরীয়াহর সঙ্গে বিদ্রোহ করা, পশ্চিমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গোলামদের অধীন তাদের ধর্মহীনতার খেলনা হিসেবে ছেড়ে দেয়ার অবকাশ কিছুতেই নেই। খেলাফত ব্যবস্থা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত অন্তত যতটুকু সম্ভব শরীয়াহর অধীন জামাআতবদ্ধ থাকা এবং খেলফত ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা, শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করাও আপনার ফরয দায়িত্ব। এই দায়িত্বে আলেমরা এগিয়ে না আসলে আর কে আসবে? সকলেই যদি মনে করেন, আমি ছোট, এটা বড়রা করবেন, তাহলে তো রাজার পুকুর দুধের বদলে পানি দিয়েই ভরবে!
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে সহীহভাবে বোঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।
ময়দানের বাইরে থেকে জিহাদে অংশগ্রহণের সম্ভাব্য কিছু ক্ষেত্র
উপর্যুক্ত চারটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র ছাড়াও জিহাদের সাওয়াব অর্জন ও জিহাদে অংশগ্রহণের এমন অসংখ্য ক্ষেত্র আছে, যেগুলোর উপর জিহাদের ভূমির বাইরের লোকেরাও আমল করতে পারেন। প্রত্যেক মুমিনেরই একই সঙ্গে একাধিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সক্ষমতা আছে এবং ময়দানের জিহাদও তাদের এই সহযোগিতগুলোর মুখাপেক্ষী। অন্যথায় শুধু জিহাদের ভূমির স্থানীয় উপায় উপকরণ দিয়ে জিহাদ চালিয়ে যাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি বিজয় অর্জন করাও অসম্ভব। এই বিচারে আফগান থেকে ফিলিস্তিন; পৃথিবীর প্রতিটি রণাঙ্গনের অবস্থাই এক ও অভিন্ন। প্রতিটি রণাঙ্গন মুসলিম উম্মাহর প্রতি সে আহ্বান জিহাদ শুরুরও আগে থেকে জানিয়ে আসছে; যদিও সেই আওয়াজে আমরা কান দিচ্ছি না কিংবা শুনেও শুনছি না। আমরা সংক্ষেপে উপরে আলোচিত চারটি ক্ষেত্রসহ আরও বেশ কিছু ক্ষেত্র উল্লেখ করছি, যার মাধ্যমে রাণাঙ্গনের বাইরের মুসলিমরাও জিহাদের সাওয়াব এবং জিহাদে শরীক হয়ে জিহাদ ও মুজাহিদদের সহযোগিতা করার সৌভাগ্য অর্জনের পাশাপাশি নিজের উপর অর্পিত ফরয দায়িত্বটি আঞ্জাম দিতে পারেন।
০১. জিহাদের দৃঢ় সংকল্প করা।
০২. শাহাদাতের তামান্না করা।
০৩. জিহাদে শরীক হতে পারার ও শাহাদাত লাভের দোয়া করা।
০৪. সশরীরে জিহাদের ভূমিতে গিয়ে কিতালে অংশগ্রহণ করা।
০৫. ময়দানে সম্পদ প্রেরণ করা।
০৬. জিহাদের জন্য সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয় করা।
০৭. মুজাহিদের সাজ সরঞ্জাম প্রস্তুত করে দেয়া।
০৮. মুজাহিদের অনুপস্থিতিতে উত্তমভাবে তার পরিবার-পরিজনের দেখা-শোনা করা।
০৯. শহীদ পরিবারের ভরণ পোষণ করা।
১০. যুদ্ধাহত ও বন্দী পরিবারের ভরণ পোষণ করা।
১১. মুজাহিদদের যাকাত প্রদান করা।
১২. যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবা দেয়া।
১৩. জিহাদের দিকে আহ্বান করা এবং মুজাহিদ সংগ্রহ করা।
১৪. মুজাহিদদের তালীম ও তাযকিয়ার কাজ করা।
১৫. মুজাহিদদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
১৬. জিহাদ ও মুজাহিদদের পক্ষ হতে প্রতিউত্তর করা।
১৭. শত্রুদের মুখোশ উন্মোচন করা।
১৮. শত্রু থেকে জিহাদ ও মুজাহিদদের তথ্য গোপন করা।
১৯. মুজাহিদদের জন্য দোয়া করা।
২০. কুনুতে নাযেলা পড়া।
২১. শত্রু ও মুজাহিদদের খোঁজ খবর রাখা।
২২. জিহাদ ও মুজাহিদদের অনুকূল সংবাদ প্রচার করা।
২৩. ফতোয়া প্রদান করা।
২৪. আলেম, দাঈ ও খতীবদের কাছে জিহাদ ও মুজাহিদদের সঠিক সংবাদ পৌঁছে দেয়া।
২৫. জিহাদ ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে উলামায়ে সূ’দের তাহরীফ ও জাহেলদের বাতিল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের খণ্ডন করা।
২৬. ইদাদের নিয়তে শরীর চর্চা করা।
২৭. ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেয়া।
২৮. অস্ত্র চালনা শেখা।
২৯. সাঁতার শেখা।
৩০. অশ্বারোহণ শেখা।
৩১. প্যারাগ্লাইডিং শেখা।
৩২. প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেয়া।
৩৩. জিহাদের মাসায়েল চর্চা করা।
৩৪. মুজাহিদদের আশ্রয় প্রদান করা।
৩৫. বন্দী মুজাহিদদের মুক্তির চেষ্টা করা।
৩৬. জিহাদ ও মুজাহিদদের জন্য তথ্য প্রযুক্তির আবিষ্কার, উন্নয়ন ও ব্যবহার করা।
৩৭. শত্রুর তথ্য প্রযুক্তি হ্যাক করা।
৩৮. মুজাহিদদের জন্য সেইফ হাউজের ব্যবস্থা করা।
৩৯. সন্তান সন্ততি ও অধীনস্থদের জিহাদি তারবিয়াহ ও চিন্তা চেতনায় গড়ে তোলা।
৪০. শত্রুদের পণ্য বর্জন ও শত্রুর সঙ্গে বয়কট করা ইত্যাদির মতো অসংখ্য বিষয় এমন আছে, যার অনেকগুলোই যুদ্ধের ভূমি থেকে দূরে অবস্থান করা সকল মুসলিমের সাধ্যের অন্তর্ভুক্ত।
শায়খ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আসসালিম কী কী উপায়ে জিহাদের সেবা করা যায় এবং জিহাদে শরীক হওয়া যায়, তার লম্বা তালিকা দিয়ে 39 وسيلة لخدمة الجهاد والمشاركة فيه নামে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেছেন, যেখানে প্রত্যেকটি কাজ আবার কত অসংখ্য সুরতে করা যায়, বাস্তবতার আলোকে তাও ব্যাখ্যা করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতা এবং সক্ষমতার কাজটি খুঁজে বের করা!
সুতরাং এতসব কাজের উপর আমাদের সক্ষমতা থাকার পরও আমরা জিহাদে সক্ষম নই, দোয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই, এমন ফতোয়া ও মূল্যায়ন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আসলে আমাদের অভাব সক্ষমতার নয়; অভাব আন্তরিকতার। প্রয়োজন শুধু উম্মাহর দুর্দশা উপলব্ধি করার এবং তার সমাধানে ও নিজের ফরিযাহ আদায়ে আন্তরিক হওয়ার, তারপর আমার সক্ষমতার জায়গাটি খুঁজে বের করার। উম্মাহ যদি এই উপলব্ধি ও দায়িত্ববোধের জায়গায় উঠে আসতে পারে, ইসরাঈল-আমেরিকা বলুন আর চিন-রাশিয়া বলুন সকল পরাশক্তির মাকড়সার প্রাসাদই মুসলিম উম্মাহর এক ফুঁৎকারে কর্পূরের মতো উবে যাবে বি-ইযনিল্লাহ। আফসোস এই একটি আয়াতও যদি আমরা যথাযথ উপলব্ধি করতাম এবং দৃঢ়ভাবে তা বক্ষে ধারণ করতে পারতাম, হয়তো আজ আমাদেরকে উম্মাহর এই করুণ পরিস্থিতির সাক্ষী হতে হত না!
{مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ} [العنكبوت: 41]
“যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের বন্ধু বনিয়েছে, তাদের উদাহরণ সেই মাকড়সার মতো যে ঘর বানিয়েছে। নিশ্চয়ই সর্বাধিক দুর্বল ঘর হচ্ছে মাকড়সার ঘর; যদি তারা বিষয়টি উপলব্ধি করত!” –সূরা আনকাবুত: ২৯:৪১
আল্লাহ আমাদের সুমতি দান করুন।
যে অংশে সক্ষমতা নেই, তা অর্জনের চেষ্টা করা
এর পরের দায়িত্ব হচ্ছে, যে অংশের সক্ষমতা নেই, তা অর্জন করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। উম্মাহ শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় আমাদের উপর জিহাদ ফরয হয়ে গেছে। যতটুকুতে সক্ষম ততটুকু আদায় করা ফরয। যতটুকুর সক্ষমতা নেই, তা অর্জন করা ফরয। শরীয়তের ভাষায় যাকে ইদাদ বলা হয়। সক্ষমতা না থাকার ফলে আদায় বিলম্বিত হতে পারে, কিন্তু ফরযের দায় থেকে মুক্তি নেই। এই মাসআলাগুলোও উম্মাহর ‘মুজমা আলাইহি’ ও সর্বজনবিদিত মাসআলা। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে জিহাদ ও ইদাদ উভয় পর্ব থেকেই নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ শরীয়তে নেই।
তৃতীয় সংশয়: হুকুমতের দায়িত্ব
আমরা শুরুতে আলোচনা করেছিলাম, বর্তমান পরিস্থিতিতে জিহাদ ফরযে আইন এ কথা যারা স্বীকার করছেন, তাদের কারো কারো ফতোয়া ও মূল্যায়ন থেকে যে বিভ্রান্তিগুলো সামনে আসছে, তার একটি ছিল দোয়া বিক্ষোভ ছাড়া আর কিছু করার সক্ষমতা আমাদের নেই।
দ্বিতীয় বিভ্রান্তিটি ছিল, যখন সক্ষমতা নেই, তো আমাদের কিছু করারও দায়িত্ব নেই।
এই দুটি বিভ্রান্তি সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। উপরের আলোচনায় আশা করি আমরা দুটি বিষয়ই বিজ্ঞ পাঠকের সামনে পরিষ্কার করতে পেরেছি। উপরের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি, দোয়া বিক্ষোভ ছাড়াও অনেক কিছু আমাদের সক্ষমতার ভেতর আছে এবং যা করার সক্ষমতা আমাদের নেই, তার সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করাও আমাদের উপর ফরয।
কোনো কোনো আলেমের ফতোয়া ও বিশ্লেষণ থেকে তৃতীয় যে বিভ্রান্তিটি সামনে আসছে, তা হল, এই দায়িত্ব বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসকদের, আমাদের নয়। অথবা আমাদের দায়িত্ব শাসকদের অনুমতি ও তত্ত্বাবধান সাপেক্ষে করা। যতটুকুর তারা অনুমতি দিবে, আমরা ততটুকু করব, বাকিটার জন্য আমরা দায়বদ্ধ না।
এই বিভ্রান্তিটি নিরসন করার জন্য অনেক দীর্ঘ আলোচনা এবং স্বতন্ত্র রচনা প্রয়োজন। এই লেখায় তার হক আদায় করা সম্ভব নয়। আপাতত এখানে আমরা সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে এই লেখার ইতি টানব ইনশাআল্লাহ।
প্রথম কথা হচ্ছে, এটা যদি কেবল শাসকদেরই দায়িত্ব হয় তাহলে ফরযে আইন হয় কীভাবে? একদিকে বলছেন সবার উপর ফরযে আইন, অপরদিকে বলছেন শাসকদের দায়িত্ব, এতো বিপরীতমুখী কথা হয়ে গেল। ফরযে আইন মানেই তো প্রত্যেক মুকাল্লাফের উপর তা আদায় করা ফরয। আর বাস্তবেও জিহাদ সক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরয। অন্যরা না করলেও তার দায়িত্ব ও সক্ষমতা অনুযায়ী তাকে এই দায়িত্ব আদায় করতেই হবে। অন্যদের ছাড়া করা সম্ভব না হলে অন্যদের সংগঠিত করে জিহাদের প্রস্তুতি নিবে। ছুটি কোনো অবস্থায়ই নেই।
হ্যাঁ, কাউকে যদি এই ফরয দায়িত্ব আদায়ে শাসকরা বাধা দেয়, আর তাদের বাধা উপেক্ষা করার সামর্থ্য তার না থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। বাধার কারণে সক্ষমতা হারানো এক বিষয়, আর শাসকদের অনুমতি হলে করা দায়িত্ব, অনুমতি না থাকলে দায়িত্ব নেই, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এই মাসআলা সালাফে সালেহীনও আলোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন,
ইমাম ব্যতীত জিহাদ নেই, রাফেজি শিয়াদের আকীদা
ইমাম ছাড়া জিহাদ নেই, এমন কথা ঠিক নয়। এটা রাফেজি শিয়াদের আকীদা। তারা বলে, যেদিন আলে মুহাম্মাদের রিজা (ইমাম মাহদি) প্রকাশিত হবেন এবং আকাশ থেকে আহ্বানকারী ডেকে বলবেন, তাঁর অনুসরণ কর, তার আগে আল্লাহর পথে জিহাদ নেই; বরং জিহাদ মৃত প্রাণী ও প্রবাহিত রক্ত কিংবা শূকরের গোশতের ন্যায় হারাম।
ইমাম আবুল হাসান আশআরি রহিমাহুল্লাহ (৩২৪ হি.) বলেন,
وقالت الروافض بإبطال السيف ولو قتلت حتى يظهر الإمام فيأمر بذلك. – مقالات الإسلاميين واختلاف المصلين، أبو الحسن علي بن إسماعيل بن إسحاق الأشعري، المكتبة العصرية، ج:2، ص:236، الطبعة الأولى، 1426هـ. 2005 م.
“রাফেজিদের কথা হচ্ছে, তরবারির ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, যদিও তোমাকে হত্যা করা হয়; যতক্ষণ না ইমাম মাহদি আসবেন এবং এবিষয়ে তোমাকে নির্দেশ দিবেন।” –মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন ওয়াখতিলাফুল মুসাল্লিন: ২/২৩৬
ইবনু আবিল ইয আল-হানাফি রহিমাহুল্লাহ (৭৪৬ হি.) বলেন-
قوله: (وَالْحَجُّ وَالْجِهَادُ مَاضِيَانِ مَعَ أُولِي الْأَمْرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، بَرِّهِمْ وَفَاجِرِهِمْ، إلى قِيَامِ السَّاعَة، لَا يُبْطِلُهُمَا شَيْءٌ وَلَا يَنْقُضُهُمَا). ش: يُشِيرُ الشَّيْخُ رحمه الله إلى الرَّدِّ على الرَّافِضَة، حَيْثُ قَالُوا: لَا جِهَادَ في سَبِيلِ الله حتى يَخْرُجَ الرِّضَا مِنْ آلِ مُحَمَّدٍ، وَيُنَادِي مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: اتَّبِعُوهُ !! وَبُطْلَانُ هَذَا الْقَوْلِ أَظْهَرُ مِنْ أَنْ يُسْتَدَلَّ عليه بِدَلِيلٍ. انتهى.- شرح العقيدة الطحاوية، الطبعة الأولى، وزارة الشئون الإسلامية والأوقاف والدعوة والإرشاد، المملكة العربية السعودية،1418 ه. ج:2، ص: 443
“ইমাম তাহাবির বক্তব্য: (মুসলিম উলুল আমরের সঙ্গে হজ ও জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে, চাই তারা নেককার হোক কিংবা ফাসেক। কোনো কিছুই এদুটি বিষয়কে বাতিল করবে না।)
ব্যাখ্যা: শায়খ (ইমাম তাহাবি) উক্ত কথা বলে মূলত রাফেজিদের খণ্ডনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তারা বলে, ‘যতক্ষণ না আলে মুহাম্মাদের রেজা (ইমাম মাহদি) আগমন করবেন এবং আকাশ থেকে আহ্বানকারী আহ্বান করবে, তোমরা তাঁর অনুসরণ কর, তার আগে কোনো জিহাদ নেই।’ এই কথার বাতুলতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট, যা দলীলের অপেক্ষা রাখে না।” –শরহুল আকিদাতিত তাহাবিয়া: ২/৪৪৩
আরও দেখুন আব্দুল কাদের জিলানির আল-গুনইয়াহ…: ১/১৮৪; শিয়া ইমামিয়া আলেম মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব কুলিনি (৩২৯ হি,) রচিত আল-কাফি: ৫/ ৫৪-৫৮
কুলিনি তার কিতাবে ইমাম ব্যতীত জিহাদকে মৃত প্রাণী, রক্ত ও শূকরের গোশত খাওয়ার মতো হারাম বলেছেন। মাও. ফরিদ মাসউদও (হাদাহুল্লাহ) জিহাদ যে হাসান লি-গাইরিহি, তা বুঝানোর আর কোনো উপমা খুঁজে পাননি। তাই জিহাদকে তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য মৃত প্রাণী খাওয়ার মতো বলেছেন।
সালাফ আরও বলেছেন,
ইমাম না থাকলেও জিহাদ বিলম্বিত করা যাবে না
ইবনে কুদামা হাম্বলী রহিমাহুল্লাহ (৬২০ হি.) বলেন,
فان عدم الامام لم يؤخر الجهاد لان مصلحته تفوت بتأخيره، وان حصلت غنيمة قسموها على موجب الشرع، قال القاضي وتؤخر قسمة الاماء حتى يقوم إمام احتياطا للفروج. اهـ المغني: 10/374
“যদি ইমাম না থাকে তাহলে এ কারণে জিহাদ পিছিয়ে দেয়া যাবে না। কেননা, পিছিয়ে দেয়ার দ্বারা জিহাদে নিহিত মাসলাহাত ও কল্যাণসমূহ হাতছাড়া হয়ে যাবে। গনীমত লাভ হলে হকদারদের মাঝে শরীয়তে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী বণ্টন করে নেবে। তবে কাজী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইমাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত লজ্জাস্থান হালাল হওয়ার বিষয়ে সতর্কতাবশত দাসীদের বণ্টন স্থগিত রাখবে।”-আল-মুগনী ১০/৩৭৪
সালাফরা বলেছেন,
ইমাম নিষেধ করলেও জিহাদ করতে হবে
শরহুস সিয়ারুল কাবীরে এসেছে,
وإن نهى الإمام الناس عن الغزو والخروج للقتال فليس ينبغي لهم أن يعصوه إلا أن يكون النفير عاما لأن طاعة الأمير فيما ليس فيه ارتكاب المعصية واجب كطاعة السيد على عبده فكما أن هناك بعد نهي المولى لا يخرج إلا إذا كان النفير عاما فكذلك هاهنا. اهـ. شرح السير الكبير: 2/378
“ইমাম যদি লোকজনকে যুদ্ধ করতে এবং কিতালে বের হতে নিষেধ করেন, তাহলে তাদের জন্য তার আদেশ অমান্য করা জায়েয হবে না। তবে যদি নাফীরে আম হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা। কেননা যেখানে আমীরের আনুগত্য করতে গেলে নাফরমানিতে লিপ্ত হতে হয় না, সেখানে আমীরের আনুগত্য ফরয, যেমন গোলামের জন্য তার মনিবের আনুগত্য ফরয। সেখানে যেমন মনিব নিষেধ করলে গোলাম জিহাদে যাবে না, তবে নাফীরে আম হলে (নিষেধ করলেও) যাবে, এখানে (ইমামের ক্ষেত্রে)ও বিষয়টি তেমনই।”-শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ২/৩৭৮
বস্তুত ফরযে আইন জিহাদের মুখাতাব সবাই এবং শাসক বাধা দিলেও সাধ্য অনুযায়ী সকলকে ফরযে আইন জিহাদ আদায় করতেই হবে। যেমনিভাবে শাসক ফরয নামায রোযা ইত্যাদির মতো ফরয আমলে বাধা দিলেও বাধা উপেক্ষা করে তা আদায় করতে হয়। অন্যথায় ফরয ত্যাগের দায়ে আল্লাহর সামনে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আরও বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: ‘জিহাদের মুখাতাব কি শুধুই শাসক শ্রেণি?’ লিংক:
সালাফের সঙ্গে আজকের ফতোয়ার পার্থক্য
সালাফের ফতোয়ায় যেখানে তাঁরা সুস্পষ্ট করে বলে গেছেন, খলীফাতুল মুসলিমীন, যিনি কুরআন সুন্নাহ দ্বারা শাসন করেন, মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা করেন, তিনি ফরযে আইন জিহাদে বাধা দিলেও তা মান্য করা যাবে না; বরং তাকে উপেক্ষা করে জিহাদ করতে হবে, শুধু তাই নয়; বরং তিনি জিহাদ ছেড়ে দিলেও তাকে উপেক্ষা করে ফরযে আইন তো অবশ্যই, ফরযে কেফায়া জিহাদও চালু রাখতে হবে, সেখানে আজকের গণতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানকে ফরযে আইন জিহাদের জন্য শর্ত করা হচ্ছে। অথচ এই শাসকরা (ধর্মের জন্য লড়াই করা যাবে না মর্মে) রাষ্ট্রীয়ভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে আইন করে জিহাদ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। যেখানেই জিহাদের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, কাফের শক্তির সঙ্গে একজোট হয়ে তা নির্মূলের জন্য তাদের সর্বশক্তি ব্যয় করছে। বরং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে দীন দুনিয়া সকল ক্ষেত্রে কাফেরদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাফেরদের অগ্রজের ভূমিকা পালন করছে। যেখানেই কুফর ও কাফেরদের সঙ্গে ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থের সংঘাত হচ্ছে, সেখানেই নির্দ্বিধায় কাফের ও কুফরের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তাদের পক্ষ নিয়ে মুসলিমদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
সালাফে সালেহীন ইমামুল মুসলিমীনের তত্ত্বাবধান ও নির্দেশ মেনে জিহাদের কথা বলেছন, যখন ইমাম ন্যায়সঙ্গতভাবে জিহাদের কাজ আঞ্জাম দিবেন এবং মুসলিমদের জান মাল ইজ্জত দীন ও ভূমি রক্ষায় যথাযথ দায়িত্ব আঞ্জাম দিবেন। পক্ষান্তরে এর ব্যতিক্রম হলে কখন তাদের উপর জিহাদ মওকুফ রাখা যাবে না, কখন তাদের সঙ্গে জিহাদ করা যাবে না এবং তাদেরকেও জিহাদে শরীক করা যাবে না, সেগুলোও খুলে খুলে বলেছেন। অথচ আজ সে ফতোয়া প্রয়োগ করা হচ্ছে এমন নিকৃষ্ট শাসকের উপর, ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি যাদের শত্রুতা ষোলো কলায় পূর্ণ। যারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে শত্রুর চেয়েও অগ্রগামী। আল্লাহর জমিন থেকে ইসলামের চিহ্ন মুছে দিতে বদ্ধপরিকর।
পাকিস্তানের যে বাহিনী পৃথিবীর একমাত্র ইসলামী ইমারতকে বোমার আঘাতে ধূলিসাৎ করে দিল, হাজারো মুজাহিদকে হত্যা করল, সামান্য ডলারের বিনিময়ে ইসলামী ইমারতের রাষ্ট্রদূতসহ হাজারো মুজাহিদকে শত্রুর হাতে পণ্যের মতো বিক্রি করল, আজ ফতোয়া দেয়া হচ্ছে তারাই নাকি মুসলিমদের অভিভাবক, তারাই উলুল আমর। তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম ও বাগাওয়াত। যারা তালেবানকে হক মনে করেন, তালেবানের জিহাদকে সহীহ জিহাদ মনে করেন, তারাই দিচ্ছেন এমন বিপরীতমুখী ফতোয়া। ওয়া ইলাল্লাহিল মুশতাকা!
বস্তুত কারো কারো ফতোয়া জিহাদ নিষিদ্ধ বলারই নামান্তর
বস্তুত এই গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের আমি মুরতাদ কিংবা মুসলিম যাই গণ্য করি না কেন, তাদের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানকে জিহাদের জন্য শর্ত করা কার্যত কাফেরদের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানকে জিহাদের শর্ত করা কিংবা জিহাদ ‘মুয়াত্তাল’ তথা নিষিদ্ধ বলারই নামান্তর। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের ধারক ও রক্ষক হওয়ার দিক থেকে; ধর্মনিরপেক্ষ পৃথিবীতে ইসলামী জিহাদ নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে; ধর্মনিরপেক্ষ কাফের ও ধর্মনিরপেক্ষ নামধারী মুসলিম উভয়েরই আকীদা ও আমল এক ও অভিন্ন। সুতরাং যারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জিহাদ নিষিদ্ধ করে রেখেছে, কার্যত যেখানেই জিহাদ হচ্ছে, সেখানেই সর্বশক্তি নিয়ে জিহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে, জিহাদের জন্য তাদের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানের শর্ত করা, জিহাদ নিষিদ্ধ করা নয় তো কী? অধিকন্তু এরা নামধারী মুসলিম হওয়ায় এটা আরও জঘন্য ও প্রতারণাপূর্ণ। আর এই নামধারী মুসলিম শাসকদের ইরতেদাদের মাসআলা, সে তো আরেক ভয়ঙ্কর অধ্যায়!
মানবরচিত আইনের শাসকরা মুসলিম, না মুরতাদ?
আমাদের জানা মতে যখন থেকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে মানবরচিত আইন প্রণয়ন ও সেই আইনে শাসনের প্রশ্ন এসেছে, তখন থেকেই উম্মাহর উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে ফতোয়া দিয়ে আসছেন, তা কুফর এবং যারা তা করবে তারা মুরতাদ। এবিষয়ে সালাফের কারো গ্রহণযোগ্য দ্বিমতের কথা আমাদের জানা নেই। আসলে মাসআলাটির দলীল প্রমাণও এত স্পষ্ট, যাতে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু তথাপিও উম্মাহর চূড়ান্ত পতন, পরাজিত মানসিকতা ও গোলামির যিন্দেগির পূর্ণতার এই যুগে এসে অনেককে এবিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায়। অথচ এখন তা শুধু মানবরচিত আইনের শাসনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বর্তমান মানবরচিত শাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ‘ফাসলুদ দীন আনিদ দাওলাহ’ তথা রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে শরীয়তের উর্ধ্বে স্থান দেয়া, শরীয়তের পূর্ণ সিয়াসাহ ও ইমারাহ অধ্যায়কে অস্বীকার করা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতাবাদ, নারীবাদ, বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদির মতো ইতিহাসের জঘন্যতম অসংখ্য কুফর শিরক ও ধর্মহীনতার সমষ্টি, যা পৃথিবীর অতীত ইতিহাস কখনোই দেখেনি। ভবিষ্যত পৃথিবীতেও হয়তো এর চেয়ে জঘন্য, প্রতারণাপূর্ণ ও সর্বব্যাপী কুফর সমষ্টি আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না। এত অসংখ্য কুফর, শিরক, ইলহাদ ও যান্দাকার প্রবক্তা এবং প্রাণোৎসর্গী ও আত্মস্বীকৃত ধারক বাহকরাও যদি মুরতাদ না হয়, তাহলে পৃথিবীতে ইরতেদাদের অস্তিত্ব কোথায় পাওয়া যাবে আল্লাহু আলাম।
আমরা আগেই ইঙ্গিত করেছি, এবিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। এই লেখায় যা সম্ভব নয়, এখানে আমরা অতি সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের প্রতি উলামায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
ক. পশ্চিমাদের আবিষ্কৃত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র (আমাদের ধারণা নির্ভর ব্যাখ্যাকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা গণতন্ত্র নয়) কুফর। একথায় মুসলিম উম্মাহর নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমের দ্বিমত নেই। এমনকি সমকালীন কোনো আলেমেরও না।
খ. বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গণতান্ত্রিক শাসকরা শুধু মৌখিকই নয়; বরং কাফেরদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করে, রাষ্ট্রীয় আইন করে, নির্বাচনি ইশতেহার দিয়ে হুবহু পশ্চিমাদের সেই মুত্তাফাক আলাইহি কুফরটি (আমাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী নয়) গ্রহণ করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে এবং বারবার দিয়ে যাচ্ছে। তারা যে পশ্চিমা সে কুফরি অর্থের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রই গ্রহণ করেছে, এটার ব্যাখ্যাও তারা তাদের বিভিন্ন অফিসিয়াল ডকুমেন্টে দিয়ে রেখেছে। প্রতিদিন তাদের গৃহীত সেই কুফরি অর্থের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশংসা করছে, তা বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা করছে, সবার উপর বল প্রয়োগ করে তা বাস্তবায়ন করছে, যেখানেই ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধ সামনে আসে, সেখানেই দীন ধর্মের মোকাবেলায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
এটিও এমন একটি বাস্তবতা, যা আশা করি কোনো বিবেকবান মানুষ অস্বীকার করবেন না।
সুতরাং ফলাফল দাঁড়াল, একটি বিষয় কুফরি হওয়াও নিশ্চিত এবং কিছু লোকের সেই কুফরি গ্রহণ করাও নিশ্চিত। ফিকহ ফতোয়ার উসুল অনুযায়ী এমন লোকদের কাফের ও মুরতাদ হওয়াও নিশ্চিত।
হ্যাঁ, তাকফীরে মুআইয়ানের জন্য শুধু এতটুকু নিশ্চিত হওয়ার জরুরি যে, তার মধ্যে তাকফীরের শর্ত বিদ্যমান কি না কিংবা তাকফীরের কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না। যাদের মধ্যে তাকফীরের শর্ত নেই কিংবা প্রতিবন্ধতা আছে, শুধু তাদের তাকফীরে মুআইয়ান থেকে বিরত থাকতে হবে। পক্ষান্তরে যাদের মধ্যে তাকফীরের শর্তও বিদ্যমান এবং প্রতিবন্ধকতাও নেই, তাদেরকে অবশ্যই তাকফীর করতে হবে। বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্বের এসব শাসকের হাতেগোনা দুই চারজন ব্যতীত সকলের ক্ষেত্রেই যে তাকফীরে শর্ত বিদ্যমান এবং প্রতিবন্ধক নেই, তাও স্পষ্ট বিষয়।
তাবিল তো তার কথা ও কাজের করা যায়, যার কথা ও কাজ একাধিক অর্থের অবকাশ রাখে এবং বক্তা থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে যারা নিজেদের কথা ও কাজের ব্যাখ্যা দিনরাত দিয়ে যাচ্ছেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে প্রমাণ করে যাচ্ছেন, আমাদের কথা ও কাজগুলো দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য এটা, তাদের কথা ও কাজে তাবিল করা এবং তাদের বিবৃতি ব্যাখ্যা থেকে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করা, নিজের সঙ্গে যেমন প্রতারণা তেমনি তা শরীয়তের সঙ্গেও উপহাসের শামিল।
বস্তুত আল্লাহর বিধানের মোকাবেলায় যারা নিজেদেরকে বিধান দেয়ার হকদার মনে করে, তারা তাগুত। তাগুত কখনো মুসলিম হয় না। জিহাদের জন্য তাগুতের অনুমতি কিংবা তত্ত্বাবধানের শর্ত বিস্ময়কর! বরং এদের বিরুদ্ধেই জিহাদ করা, এদেরকে উৎখাত করে মুসলিমদের ভূমি পুনর্দখল করা এবং সেখানে খলীফা নিয়োগ দেয়া ফরয। এগুলো শরীয়তের ‘মুসাল্লামাত’ তথা সর্বস্বীকৃত মাসায়েলের অন্তর্ভুক্ত।
গ. তর্কের খাতিরে যদি তাদের ইরতেদাদের বিষয়টা আমরা আলোচনার বাইরেও রাখি, তবুও খোদ এই শাসকদের বিরুদ্ধেই যে জিহাদ ফরয, তাতে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কারণ এরা মুসলিমদের উপর চেপে বসা সংঘবদ্ধ শক্তি, শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার পথে প্রথম বাধা এবং ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সম্প্রদায়। এরাই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে আছে এবং শরীয়াহ আইনের পরিবর্তে মুসলিমদের উপর কুফরি আইন চাপিয়ে দিয়েছে। এমন সম্প্রদায়কে ফিকহের ভাষায় ‘তায়েফাহ মুমতানিয়াহ মুহারিবাহ’ তথা প্রতিরক্ষা শক্তিধর বিদ্রোহী সম্প্রদায় বলা হয়। এমন সম্প্রদায়ের লোকেরা যদি মুসলিমও হয় এবং তারা সবাই মিলে আযানের মতো শরীয়তের কোনো সুন্নত স্তরের প্রতীকি বিধানও ছেড়ে দেয়, তবুও তাদের বিরদ্ধে জিহাদ ওয়াজিব, যতক্ষণ না তারা তাদের অবস্থান থেকে ফিরে আসে। আর যদি বর্তমান শাসকদের মতো অসংখ্য ইরতেদাদে নিমজ্জিত হয়, যারা শুধু নিজেরাই নয়; বরং শরীয়তের অসংখ্য বিধানের উপর মুসলিম উম্মাহর একজন ব্যক্তিকেও পৃথিবীর কোথাও আমল করতে দিচ্ছে না, তাহলে তো তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ আরো আগেই ফরয। এই অবস্থায় জিহাদের জন্য তাদের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানের শর্ত সত্যিই বিস্ময়কর!
ঘ. আরেকটু গভীরে প্রবেশ করলে বলতে হবে, এসব শাসক মূলত কাফের মুশরিকদেরই এজেন্ট ও প্রতিনিধি। কাফেরদের অন্য সব স্বার্থের মতো ইসরাঈলকে রক্ষা করাও তাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার মুচলেকা দিয়েই তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং ক্ষমতায় থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ে জাতিসংঘে ভেটো পাওয়ারের অধিকারী পাঁচ কাফের পরাশক্তির আনুগত্যের মুচলেকা দিয়েই তারা জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বলা বাহুল্য, জাতিসংঘে চলে কাফেরদের এই পাঁচ পরাশক্তির একক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বে এবং কাফের ও কুফরের স্বার্থের বিপরীতে যাওয়া না এসব কাফেরের চিন্তা চেতনায় আছে, না জাতিসংঘের দীর্ঘ আশি বছরের ইতিহাসে আছে। প্রতারণার শতাব্দী পার হওয়ার পরও যারা এই বাস্তবতাগুলো অনুধাবন করতে ব্যর্থ, তাদের বোধ বুদ্ধির উপর আল্লাহ রহম করুন।
একটা সময় ছিল যখন কাফেররা সরাসরি মুসলিম রাষ্ট্রগুলো শাসন করত। ধীরে ধীরে মানুষ যখন তাদের জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তাদের বিতাড়িত করে, তখন তারা প্রতারণার সুবিধার্থে বাহ্যত আমাদেরই গোত্রভুক্ত নামধারী মুসলিমদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যায়। আমরা ভাবতে থাকি আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। বস্তুত আমরা তাদের শাসন ও শোষণ থেকে এক চুলও বের হতে পারিনি। শুধু রূপ পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। গণতন্ত্র ও নির্বাচন শুধুই একটি প্রতারণা মাত্র। প্রতারিত করে শাসন ক্ষমতা ধরে রাখার অপকৌশল। এজন্যই যতক্ষণ গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ফল ছলচাতুরি করে অনুকূল রাখা যায়, ততদিন তা দিয়েই মুসলিম জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়া হয়। যখন গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ফল কোনো ফাঁক গলে তাদের প্রতিকূল হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র নির্বাচন সবই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। মিশর, আলজেরিয়া ও পাকিস্তানের ঘটনাগুলো এই বাস্তবতা বারবার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যায়, তবুও আমরা না দেখার ভান করে ভালো থাকতে চাই।
ফিলিস্তিন ইসরাঈল যুদ্ধ আবারো বিষয়গুলো চোখ ফুঁড়ে দেখিয়ে দিল!
ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র ইসরাঈল ছাড়া সবগুলো মুসলিম রাষ্ট্র। খোদ শত্রু রাষ্ট্র ইসরাঈলও চতুর্দিক থেকে মুসলিম রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। এবারের যুদ্ধে সবাই ফিলিস্তিনের সমর্থকও। তবুও ইসরাঈল এসব কথিত মুসলিম শাসকের সরবরাহ করা জ্বালানি দিয়েই ফিলিস্তিনিদের উপর ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ তিন মাস পার হল। অথচ ওদের আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো বন্ধুরা প্রেসিডেন্ট থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবাই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে রণতরী-বোমা-বারুদ নিয়ে সশরীরে রণাঙ্গনে উপস্থিত! একবার নয় বার বার!
৫৭ টি মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠন ওআইসি। শত্রু শিবিরসহ পুরো পৃথিবীর সাধারণ মানুষ যখন গাজাবাসির দুর্দশায় বিক্ষুব্ধ, তখনো ওআইসি অধিবেশন ডেকে না মৃত্যুপথযাত্রী ফিলিস্তিনিদের জন্য এক বোতল পানি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে, না ইসরাঈলের জন্য আরব্য গোলামদের বরাদ্দ করা এক লিটার তেলের চালান বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। শুধু শুধু সাধারণ গরীব জনগণের রক্ত-ঘামে কেনা অর্থে রসনা বিলাস করে অধিবেশন শেষ করেছে।
একটু অক্সিজেন, এক ঢোক পানি কিংবা এক টুকরো রুটির জন্য যখন ফিলিস্তিনি শিশুরা আর্তনাদের শক্তি হারিয়ে নিথর হয় এবং মিশরের মতো প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রের সীমান্ত রাফাহ ক্রস সম্পর্কে সংবাদ শিরোনাম হয়, ‘ইসরাঈল রাফাহ ক্রস খোলার অনুমতি দেয়নি’ তখন একজন মুসলিম হিসেবে সত্যিই লজ্জা নিবারণের উপায় থাকে না।
মুসলিমদের প্রতারণার জন্য মুখে ফিলিস্তিনিদের মায়াকান্না জড়ানো আরব শাসকরা; ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য এক টুকরো রুটি পাঠাতে না পারলেও ওদের প্রকৃত বন্ধু ইসরাঈলের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতায় সামান্য ছেদ পড়ার শঙ্কাও বরদাশত করে না। হুথিদের আক্রমণে যখন ইসরাঈলি জাহাজের চলাচলে সামান্য ব্যাঘাত ঘটে, তখন রাতারাতি আরব আমিরাত ও সৌদির যৌথ উদ্যোগে ইসরাঈলের পণ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে স্থলপথে বিকল্প রুট তৈরি হয়ে যায়।
ইসরাঈলের জন্য লোহিত সাগরকে নিরাপদ রাখতে বাহরাইনের মতো মুসলিম রাষ্ট্র ইহুদী খ্রিস্টানদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। পাকিস্তানও সেখানে নৌ জাহাজ মোতায়েন করে।
ইসরাঈলের এই বর্বর যুদ্ধের মাঝেও পাকিস্তানের মতো ‘ইসলামী’ সংবিধানের গর্বে টইটুম্বুর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ফিলিস্তিনিদের বুক ঝাঁজরা করার জন্য ইসরাঈলকে শেল ‘উপঢৌকন’ করে।
وهذا غيض من الفيض، وما تخفي صدورهم أكبر، وهي أدهى وأمر
এ হচ্ছে তাদের লুকায়িত বন্ধুত্বের সিন্ধু থেকে বিন্দু। আর যা তারা লুকায়িত রাখে, তা তো আরও জঘন্য আরও ভয়ঙ্কর!
আরও দুঃখ হয়, যখন উলামায়ে কেরাম এই খায়েন বে-ঈমান ও প্রতারক শাসকদেরকে খলীফাতুল মুসলিমীন ও উলুল আমরের মর্যাদা দিয়ে ফতোয়া দেন, জিহাদের জন্য তাদের অনুমোদন ও তত্ত্বাবধান শর্ত করেন। অথচ সালাফের ফুকাহায়ে কেরাম সুস্পষ্ট বলে দিয়েছেন, খলীফাতুল মুসলিমীনও যদি যুদ্ধে মুসলিমদের সঙ্গে খেয়ানত করে, শত্রুর সঙ্গে আঁতাত করে, তাদের সঙ্গে মুসলিমরা জিহাদ করবে না। তারা মুসলিমদের সঙ্গে জিহাদে শরীক হলেও অন্যান্য মুজাহিদের মতো তাদের গনীমত প্রদান করা যাবে না।
যেসব আলেম এই তাগুত শাসকদেরকে মুসলিমদের উলুল আমর মনে করেন, মুফতি কেফায়াতুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ তো তাদেরকে ইমামতের অযোগ্য ফাসেক, জাহেল ও পাগল আখ্যায়িত করেছেন। একটি ফতোয়ায় তিনি লিখেন:
شرع حکم کرنے والے حکمران طاغوت ہیں ان کو “اولی الامر” میں داخل کرنےوالے کی امامت ناجائز ہے۔
(سوال) جو شخص آیت شریفہ “واولی الامر منکم” کو حکام آئین موجودہ پر محمول کرتا ہو اور حکام آئین موجودہ کے حکم کو اس آیت شریفہ سے استدلال کر کے واجب العمل کہتا ہو تو ایسے شخص کا شریعت میں کیا حکم ہے اور اس شخص کے پیچھے نماز پڑھنا جائز ہے یا نہیں؟
المستفتی نمبر 1462 مولوی محمد شفیغ صاحب مدرس اول مدرسہ اسلامیہ شہرملتان 23 ربیع الاول 1356ھ م 3 جون 1937۔
(جواب 144 ) “و اولی الامر منکم” سے علماء یا حکام مسلمین مراد ہیں۔ یعنی ایسے حکام جو مسلمان ہوں اور خدا و رسول صلی اللّہ علیہ و سلم کے حکم کے موافق احکام جاری کریں۔ ایسے مسلمان حاکم جو خدا اور رسول کے احکام کے خلاف حکم جاری کریں “من لم یحکم بما انزل اللّہ فاولئک ھم الکافرون” میں داخل ہیں اور خدا اور رسول کے خلاف حکم جاری کرنےوالوں کو قرآن پاک میں طاغوت فرمایا گیا ہے۔ اور طاغوت کی اطاعت حرام ہے۔ پس جو شخص ایسے حکام کو جو الہی شریعت اور آسمانی قانون کے خلاف حکم کرتے ہیں “اولی الامرمنکم” میں داخل قرار دے، وہ قرآن پاک کی نصوص صریحہ کی مخالفت کرتا ہے۔ انگریزی قانون کے ماتحت خلاف شرع حکم کرنے والے خواہ غیر مسلم ہوں،خواہ نام کے مسلمان طاغوت ہیں۔ اولی الامر میں کسی طرح داخل نہیں ہو سکتے۔ ان کو اولی الامر میں داخل کرنےوالا یا مجنون ہے یا جاہل یا فاسق۔ اور ایسی حالت میں اس کو مقتدا بنانا اور امام مقرر کرنا ناجائز ہے۔ فقط محمد کفایت اللّہ کان اللّہ لہ۔ كفاية المفتي: 1/139
“শরীয়াহ পরিপন্থী বিধান আরোপকারী শাসক তাগুত। যে ব্যক্তি তাকে ‘উলুল আমর’ গণ্য করে, তার ইমামতি নাজায়েয।
প্রশ্ন: যে ব্যক্তি আয়াতে বর্ণিত ‘উলিল আমরি মিনকুম’কে বর্তমান আইনের শাসকদের উপর প্রয়োগ করে এবং এধরনের শাসকদের আইন ও বিধান মানা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে আয়াত দিয়ে দলীল দেয়, শরীয়তে এমন ব্যক্তির হুকুম কী এবং তার পেছনে নামায পড়া জায়েয কি না?
উত্তর: ‘উলুল আমর’ দ্বারা উলামা বা মুসলিম শাসক উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন মুসলিম শাসক, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান অনুযায়ী আইন জারি করে। যে মুসলিম শাসক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানের বিপরীত আইন জারি করে, সে “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারা কাফের।” [সূরা মায়েদা: ০৫:৪৪], এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এমন ব্যক্তিকে কুরআনে তাগুত বলা হয়েছে। আর তাগুতের আনুগত্য হারাম। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন শাসকদের উলুল আমর মনে করে, সে কুরআনের সুস্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচারী। ইংরেজদের আইন অনুযায়ী শরীয়তের খেলাফ বিধান আরোপকারী; অমুসলিম হোক বা নামধারী মুসলিম হোক, সে তাগুত। কিছুতেই সে উলুল আমরের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। যে ব্যক্তি তাকে উলুল আমর গণ্য করবে, সে হয় পাগল, না হয় মূর্খ, না হয় ফাসেক। এমন ব্যক্তিকে অনুসৃত ও ইমাম বানানো জায়েয নেই।” -কেফায়াতুল মুফতী: ১/১৩৯
এই শাসকদের স্বরূপ তো সেই মুনাফিকদের চেয়েও জঘন্য, যারা ঈমানের চেয়ে কুফরের অধিক ঘনিষ্ঠতর!
{وَمَا أَصَابَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ (166) وَلِيَعْلَمَ وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ نَافَقُوا وَقِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوِ ادْفَعُوا قَالُوا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَاتَّبَعْنَاكُمْ هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلْإِيمَانِ يَقُولُونَ بِأَفْوَاهِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُونَ (167) الَّذِينَ قَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُوا لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا قُلْ فَادْرَءُوا عَنْ أَنْفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ } [آل عمران: 166- 168]
“উভয় বাহিনীর পারস্পরিক সংঘর্ষের দিন তোমাদের যে বিপদ ঘটেছিল, তা আল্লাহর হুকুমেই ঘটেছিল, যাতে তিনি মুমিনদেরকেও পরখ করে দেখতে পারেন এবং দেখতে পারেন মুনাফিকদেরকেও। আর তাদেরকে (মুনাফিকদেরকে) বলা হয়েছিল, এসো, আল্লাহর পথে কিতাল কর কিংবা প্রতিরোধ কর। তখন তারা বলেছিল, আমরা যদি মনে করতাম এটা কিতাল, তবে অবশ্যই তোমাদের অনুসরণ করতাম। সেদিন (যখন তারা একথা বলেছিল) তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরেরই বেশি নিকটবর্তী ছিল। তারা তাদের মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের অন্তরে থাকে না। তারা যা-কিছু লুকায় আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। তারা সেই সব লোক, যারা নিজেদের (শহীদ) ভাইদের সম্পর্কে বসে বসে মন্তব্য করে যে, তারা যদি আমাদের কথা শুনত, তবে নিহত হত না। বলে দাও, তোমরা সত্যবাদী হলে খোদ নিজেদের থেকেই মৃত্যুকে হটিয়ে দাও দেখি!” – সূরা আলে ইমরান: ০৩:১৬৬–১৬৮
তারা তো সেই সম্প্রদায়, যাদের কাছে ‘সাবীলুল্লাহর কিতাল’ থেকে ‘সাবীলুত তাগুতে’র কিতাল অধিক প্রিয়!
{الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا } [النساء: 76]
“যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর পথে কিতাল করে আর যারা কুফর অবলম্বন করেছে তারা কিতাল করে তাগুতের পথে। সুতরাং (হে মুসলিমগণ!) তোমরা শয়তানের বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। (স্মরণ রেখ) শয়তানের কৌশল অতি দুর্বল।” -সূরা নিসা: ০৪:৭৬
বর্তমান সময়ে উম্মাহর সবচেয়ে বড় যিম্মাদারিগুলোর একটি হলো, সেক্যুলার লিবারেল শাসকদেরকে বর্জন করা, এদেরকে শাসক মনে না করা, এদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত সহীহ জিহাদি আন্দোলন দাঁড় করানো। আলেমদের সবচেয়ে বড় যিম্মাদারির একটি হলো উম্মাহকে কাফেরদের এসব তল্পিবাহক শাসক থেকে সতর্ক করা। এদেরকে ততদিন পর্যন্ত বর্জন ও পরিত্যাগ করা, যতদিন না এরা কুফরী শাসন ও কাফেরদের মিত্রতা এবং শরীয়তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অস্ত্র ধারণ ত্যাগ করে তওবা করে।
এরা যে শরয়ী উলুল আমর নয়, এরা আমাদের শাসক নয়, এমনকি মুতাগাল্লিব ফাসেক শাসকের হুকুমও এদের জন্য প্রযোজ্য নয় এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করা।
যেসব শাসক বাইতুল মাকদিস পুনরুদ্ধারের জিহাদে অথবা অন্য কোনো ফরযে আইন জিহাদে কিংবা শরীয়ত প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদেরকে উৎখাত করে যিম্মাদারি আদায়ের পথে এগিয়ে যাওয়া।
উম্মাহর আলেম সম্প্রদায় যেদিন এই বাস্তবতাগুলো উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, সেদিনই হয়তো চলমান দুর্দশা থেকে উম্মাহর উত্তরণ সম্ভব হবে, বি-ইযনিল্লাহ!
وما ذلك على الله بعزيز، وإلى الله أتوب وإليه أنيب، وصلى الله تعالى عليه وعلى آله وصحبه أجمعين،
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين
***
[1] আরবী (সরাসরি অনলাইনে পড়ুন)
https://justpaste.it/bxrv4
ডাউনলোড করুন
https://justpaste.it/bxrv4/pdf
অনুবাদ (সরাসরি অনলাইনে পড়ুন)
https://noteshare.id/ET557Ji
ডাউনলোড করুন:
https://jumpshare.com/v/17iddNWTvjmgDklQJxdO
[2] আলকায়েদার বিবৃতি:
আরবী (সরাসরি অনলাইনে পড়ুন)
https://justpaste.it/bxrv4
ডাউনলোড করুন
https://justpaste.it/bxrv4/pdf
অনুবাদ (সরাসরি অনলাইনে পড়ুন)
https://noteshare.id/ET557Ji
ডাউনলোড করুন:
https://jumpshare.com/v/17iddNWTvjmgDklQJxdO
ইসলামিক মাগরিবের বিবৃতি: