গণতান্ত্রিক শাসন ইসলামি শাসন নয় কেন?
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
প্রশ্ন:
ইমামত ও খিলাফত কাকে বলে? গণতান্ত্রিক শাসন ইসলামি শাসন নয় কেন?
উত্তর:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ইমামত (الإمامة)
আভিধানিক অর্থে ইমামত বলা হয় কাফেলার সামনে চলা, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া, দিক নির্দেশনা দেয়া ইত্যাদি। যারা একাজগুলো করেন তাদেরকে বলা হয় ইমাম। এহিসেবেই সমাজের সর্দার, নেতা ও অনুসরণীয় ব্যক্তিদের ইমাম বলা হয়। যেহেতু তারা সমাজে অগ্রগণ্য বিবেচিত, তারা জাতিকে পরিচালনা করেন এবং সাধারণ লোকজন তাদের অনুসরণ করে। একারণেই খলিফাতুল মুসলিমিনকে ইমাম বা ইমামুল মুসলিমিন বলা হয়।-লিসানুল আরব: ১২/২৪-২৬, তাজুলআরুস: ৩১/২৪৩-২৪৫, আলমু’জামুল ওয়াসিত: ১/৩৭, মু’জামু লুগাতিল আরাবিয়্যাতিল মুআসিরাহ: ১/১২০
এঅর্থেই কুরআনে কারিমে ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে ইমাম বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا}
আমি আপনাকে সকল মানুষের ইমাম বানাবো। -সূরা বাকারা (০২): ১২৪
অর্থাৎ পরবর্তীদের জন্য আমি আপনাকে অনুসরণীয় আদর্শ বানাবো।-তাফসীরে কাশশাফ: ১/১৮৪, তাফসিরে নাসাফি: ১/১২৭
এমনকি আভিধানিক অর্থে যে কোনো অনুসরণীয় ও মান্য জিনিসকেই ইমাম বলা হয়; ব্যক্তি হওয়া আবশ্যক নয়। এজন্যই কুরআনে কারিমে তাওরাতকে ইমাম বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَمِنْ قَبْلِهِ كِتَابُ مُوسَى إِمَامًا وَرَحْمَةً}
“এর আগে মূসার কিতাব এসেছে ইমাম ও রহমত হয়ে।” -সূরা আহকাফ (৪৬): ১২
অর্থাৎ অনুসরণীয় ও পথ প্রদর্শক হিসেবে। -তাফসিরে নাসাফি : ৩/৩১৭
ইমাম শব্দটি ভালোর জন্য যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি মন্দের জন্যও ব্যবহৃত হয়। এজন্য কাফের নেতাদেরকেও কুরআনে কারিমে ‘আইম্মাতুল কুফর’ (ইমাম শব্দের বহুবচন: আইম্মাহ) বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{فَقَاتِلُوا أَئِمَّةَ الْكُفْرِ} [التوبة: 12]
“তোমরা কুফরের ইমামদের বিরুদ্ধে কিতাল কর।” -সূরা তাওবা (১০): ১২
অবশ্য মুসলিম সমাজে ইমাম শব্দটি সাধারণত ভালো অর্থেই ব্যবহৃত হয়। বিশেষত শরয়ী যে কোন বিষয়ে অনুসৃত, মান্য বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে ইমাম বলা হয়, যেমন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম বুখারী, ইমাম গাযালী, ইমামুল মুসলিমিন (মুসলিম শাসক), নামাযের ইমাম ইত্যাদি। -আলইমামাতুল উজমা: ১৭
খিলাফত (الخلافة)
আভিধানিকভাবে খিলাফাহ অর্থ অন্যের স্থলাভিষিক্ত ও প্রতিনিধি হয়ে তার কার্যক্রম চালানো।-মাকায়িসুল লুগাহ, ইবনে ফারেস (৩৯৫ হি.): ২/২১০; আলমুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, রাগেব ইস্পাহানি (৫০২ হি.): ২৯৪
যে এপ্রতিনিধিত্ব করে, তাকে বলা হয় তার খলিফা। এহিসেবেই ইমামুল মুসলিমিনকে খলিফা বলা হয়। কারণ, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিরূপে তাঁর আনীত দ্বীন যমিনে বাস্তবায়ন করেন। -মুকাদ্দিমাতু ইবনি খালদুন : ১/২৫৫
পরিভাষায় ইমামত ও খেলাফত পরস্পর সমার্থক। ইমামত বলতে খেলাফতই বুঝায়।
মাওয়ারদি রহ. (৪৫০ হি.) বলেন,
الإمامة موضوعة لخلافة النبوة في حراسة الدين وسياسة الدنيا. -الأحكام السلطانية للماوردي (ص: 15)
“ইমামত হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিরূপে দ্বীনের হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং (দ্বীন অনুযায়ী) দুনিয়া পরিচালনা করা।” -আলআহকামুস সুলতানিয়া: ১৫
অবশ্য ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত কর্তৃত্ব ও পরিচালনাকে ইমামত বা খেলাফত বলে না। খেলাফত বলে মুসলিম বিশ্বের সার্বজনীন কর্তৃত্বকে। খলিফা হন একজন, বাকি সকলে সকল বিষয়ে তার কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের অধীন থাকে। ইমাম কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর ও আমীরকে ইমাম বা খলিফা বলা হয় না। এজন্য অনেকে ইমামতের সংজ্ঞায় ‘সার্বজনীন কর্তৃত্ব’ বলেছেন।
যেমন ইবনে আবিদিন শামি রহ. (১২৫২ হি.) বলেন,
عرفها في المقاصد بأنها رياسة عامة في الدين والدنيا خلافة عن النبي – صلى الله عليه وسلم. -الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (1/ 548)
“মাকাসিদ কিতাবে ইমামতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ইমামত হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিরূপে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রের সার্বজনীন নেতৃত্ব।” -রদ্দুলমুহতার: ১/৫৪৮
ইবনে খালদুন রহ. (৮০৮ হি.) বলেন,
الخلافة هي حمل الكافة على مقتضى النظر الشرعي في مصالحهم الأخروية و الدنيوية الراجعة إليها إذ أحوال الدنيا ترجع كلها عند الشارع إلى اعتبارها بمصالح الآخرة فهي في الحقيقة خلافة عن صاحب الشرع في حراسة الدين و سياسة الدنيا به. -مقدمة ابن خلدون (1/ 255)
খেলাফত হচ্ছে সকলকে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পরিচালনা করে পরলৌকিক কল্যাণ এবং তৎসংশ্লিষ্ট ইহজাগতিক কল্যাণসমূহ বাস্তবায়ন করা।… কাজেই প্রকৃতপক্ষে খেলাফত হচ্ছে শরীয়ত প্রবর্তকের প্রতিনিধিরূপে দ্বীনের হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং দ্বীন অনুযায়ী দুনিয়া পরিচালনা। -মুকাদ্দামাতু ইবনি খালদুন: ১/২৫৫
অতএব, খিলাফাহর শাসন বা ইসলামি শাসন বলতে আমরা বলতে পারি, যে শাসনব্যবস্থা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শরীয়ত বাস্তবায়ন করে। আল্লাহর যমিনে আল্লাহর বিধান কায়েম করে। এশাসন ব্যবস্থায় শাসকগণ বিধানদাতা বা আইনপ্রণেতা নন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিমাত্র। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আইন ও বিধান দিয়ে গেছেন, তারা তা-ই বাস্তবায়ন করে। নিজ থেকে কোনো বিধান ও আইন প্রণয়ণের অধিকার রাখে না। পক্ষান্তরে গণতন্ত্র এর সম্পূর্ণ উল্টো।
গণতন্ত্র (Democracy)
গণতন্ত্রকে ইংরেজিতে Democracy বলে। Democracy শব্দটি গ্রিক dēmokratiā থেকে এসেছে। dēmokratiā শব্দটি Demos এবং kratos শব্দ দুটির সমন্বয়ে গঠিত। Demos অর্থ people তথা ‘জনগণ’ আর kratos অর্থ power, rule তথা ‘ক্ষমতা’, ‘শাসন’। অতএব, Democracy অর্থ rule by the people তথা ‘জনগণের শাসন’। অর্থাৎ যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ নিজেরাই তাদের আইন প্রণেতাদের নির্বাচন করে। তারপর তারা যে আইন তৈরি করে সে অনুযায়ী রাষ্ট্র চলে। -ব্রিটানিকা, উইকিপিডিয়া (Democracy)
বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে, ‘গণতন্ত্র: জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা।’ –আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি
অর্থাৎ গণতন্ত্র হচ্ছে যে শাসন ব্যবস্থায় নিরঙ্কুশ শাসন ও কর্তৃত্বের মালিক জনগণ বা নির্বাচিত প্রতিনিধি। তাদের ইচ্ছা ও খাহেশ এবং তাদের অভিব্যক্তিই চূড়ান্ত আইন। আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত আসমানী শরীয়তের এখানে কোনো মূল্য নেই। এ শাসনব্যবস্থার অনুসারীরা আম্বিয়ায়ে কেরামের উপর নাযিলকৃত আসমানি শরীয়তের অনুসারী নয়; নিছক মস্তিষ্ক ও প্রবৃত্তিপ্রসূত তাগুতি আইনসম্বলিত সংবিধানের অনুসারী। মানব জাতির হিদায়াত ও জীবনব্যবস্থারূপে নবী রাসূল ও আসমানি কিতাবের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যে দ্বীন নাযিল করেছেন, তারা তার বিপরীতে নিজস্ব খেয়ালখুশী ও খাহেশকে জীবনবিধানরূপে গ্রহণ করেছে।
গণতন্ত্রে ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং একটি আত্মিক প্রশান্তির মাধ্যমমাত্র। এখানে সত্যাসত্যের কিছু নেই। যে যেটি করে আত্মিক প্রশান্তি পায় সেটিই তার ধর্ম। যদি কেউ নামায পড়ে প্রশান্তি পায় তাহলে সেটিই তার ধর্ম। যে মূর্তি পূজা করে প্রশান্তি পায় সেটিই তার ধর্ম। কেউ ধ্যান করে প্রশান্তি পেলে সেটিই তার ধর্ম। যেহেতু এ ধারণামতে ধর্মের বেলায় হক বাতিলের কোনো প্রশ্ন নেই, তাই কেউ আপন ধর্মকে হক এবং অন্যের ধর্মকে বাতিল গণ্য করতে পারে না। প্রত্যেককেই অপরের ধর্মকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে হবে। ধর্মের এই সম্মানও ধর্ম হিসেবে নয়। কারণ ধর্মে যেহেতু সত্য মিথ্যার প্রশ্ন নেই, এজন্য তার নিজস্ব কোনো সম্মান ও মর্যাদা নেই। বরং ধর্মের প্রতি এই সম্মান শুধুই এজন্য যে, তা একটি মানুষের অবলম্বন। সুতরাং রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধানে এবং জাতীয় সভ্যতা সংস্কিতিতে ধর্মের কোনো ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। দেখুন: ইসলাম আওর সিয়াসি নযরিয়াত, শায়খুল ইসলাম তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ, পৃষ্ঠা: ৮৪-৮৫
অথচ এটা সুস্পষ্ট কুফুরি আকিদা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেন,
اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰه الۡاِسۡلَامُ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র সত্য ধর্ম ইসলাম।” –সূরা আলে ইমরান (০৩): ১৯
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْآخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِينَ
“যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার কাছ থেকে তা কিছুতেই গৃহীত হবে না। এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” –সূরা আলে ইমরান (০৩): ৮৫
ইসলাম ও গণতন্ত্র
গণতন্ত্রের হাকিকত বুঝার পর স্পষ্ট যে, গণতন্ত্র ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরোধী। ইসলামি শাসনের ভিত্তি আল্লাহর হাকিমিয়ার উপর। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক আল্লাহ তাআলা। তিনিই একমাত্র বিধানদাতা। তিনি যে শরীয়ত নাযিল করেছেন, খলিফা ও সুলতানগণ শুধু তা বাস্তবায়ন করেন। ইসলামে রব একমাত্র আল্লাহ। মানুষের জন্য একমাত্র সত্য দ্বীন ও জীবনবিধান ইসলাম। ইসলামই একমাত্র হক বাতিলের মানদণ্ড। ইসলাম যা হক বলবে তাই হক; যা বাতিল বলবে তাই বাতিল। ইসলাম যা ভাল বলবে তাই ভাল; যা মন্দ বলবে তাই মন্দ। শরীয়ত হক বাতিল ও ভাল মন্দের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে। শাসক শাসিত সকলেই এক আল্লাহর গোলাম। সুতরাং তাদেরকে তাই মানতে হবে।
পক্ষান্তরে গণতন্ত্রে কিছু মানুষ রবের আসনে বসেছে। তারা তাদের খেয়ালখুশী মতো আইন তৈরি করে। আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করে। হারামকে হালাল করে, হালালকে হারাম করে। এরা শরীয়াহর অনুসারী নয়, শরীয়াদ্রোহী। কাজেই ইসলাম ও গণতন্ত্র সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দু’টি জীবনব্যবস্থা। ইসলামের অনুসারী কখনও গণতন্ত্রী হতে পারে না। গণতন্ত্রী কখনও মুসলিম হতে পারে না। গণতান্ত্রিক শাসন কখনও ইসলামি শাসন হতে পারে না।
উল্লেখ্য, অনেকে বলতে চান, গণতন্ত্র শুধু একটি নির্বাচন পদ্ধতি। তারা বুঝাতে চান, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে শাসক নির্ধারণ করা হয় মাত্র। তাতে কুফর-শিরকের কি আছে?
বস্তুত এটি সুস্পষ্ট জালিয়াতি। নয়তো গণতন্ত্রের স্বরূপ সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা। গণতন্ত্রের হাকিকত নির্বাচন নয়। নির্বাচন তো গণতন্ত্রে প্রতিনিধি নিয়োগের একটি প্রক্রিয়ামাত্র। গণতন্ত্রের হাকিকত সেটাই, যা উপরে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘শরীয়াহ আইনের মোকাবেলায় মানবরচিত আইন ও সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা’। এবিষয়ে গণতন্ত্রের জনক, পরিপালক, ধারক বাহক, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ উলামায়ে কেরাম নির্বিশেষে কারোই দ্বিমত নেই। কপট ও অজ্ঞ ব্যতীত কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না। আরব আজমের উলামায়ে কেরাম বিষয়টির উপর প্রচুর লিখেছেন। আগ্রহীরা সংশ্লিষ্ট বই পত্রগুলো দেখতে পারেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন। আমীন।
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
২৯-০৫-১৪৪২ হি
১৪-০১-২০২১ ইং