বিবিধফাতওয়া  নং  ১৫৭

কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে?

কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে?

কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

 

প্রশ্ন:

কোনো মুসলমান কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার পর তাওবা না করেই মারা গেলে সে কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে? ইউটিউবে একটি ভিডিওতে দেখলাম, একজন বক্তা সূরা আলে ইমরানের ২৪ নাম্বার আয়াত এবং এমন আরো বেশ কয়েকটি দলিল উল্লেখ করে বলছেন, কোনো মুসলমান যদি কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার পর তাওবা না করেই মারা যায়, তাহলে সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। যেহেতু এটি আকিদা সংক্রান্ত বিষয়। তাই দলিলভিত্তিক একটি সমাধান দিলে খুবই উপকৃত হতাম।

প্রশ্নকারী-ফয়জুল্লাহ

 

উত্তর:

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله والصلاة و السلام على رسول الله، أما بعد:

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সকলে একমত যে, কবীরা গুনাহকারী ব্যক্তি কাফের নয়, মুমিন; যতক্ষণ না সে গুনাহটিকে হালাল মনে করে বা অন্য কোনো কুফরী করে। মুমিন ব্যক্তি শিরক ব্যতীত যত গুনাহই করুক, তাওবা ছাড়া মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। আল্লাহ চাইলে ক্ষমা করে জান্নাত দিয়ে দিতে পারেন। অন্যথায় তার গুনাহের শাস্তি দেয়ার পর এক সময় অবশ্যই তাকে জান্নাতে দিবেন। এটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র সর্বসম্মত মূলনীতি।

পক্ষান্তরে কবীরা গুনাহগারকে কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী মনে করা খারেজিদের আকিদা।

কবীরা গুনাহগার যে কাফের বা চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়, তা কুরআন সুন্নাহর অসংখ্য আয়াত ও হাদীস এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। নমুনাস্বরূপ কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি-

 

এক. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ. -سورة النساء: 48

“নিশ্চয় আল্লাহ তার সঙ্গে শরীক করা ক্ষমা করবেন না, এছাড়া অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন।” -সূরা নিসা (০৪): ৪৮

আয়াতের উদ্দেশ্য, যারা তাওবা ছাড়া মারা যাবে। মুশরিক যদি শিরক থেকে তাওবা না করে মারা যায় তাহলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। আল্লাহ শিরক ক্ষমা করবেন না। আর মুমিন যদি গুনাহ থেকে তাওবা না করে মারা যায়, তাহলে আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন, যাকে ইচ্ছা তিনি ইহসান করবেন। ক্ষমা করে শাস্তি ছাড়াই জান্নাত দিয়ে দেবেন। আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন। সর্বশেষ সেও জান্নাতে যাবে।

এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে জারির তাবারী রহ. (৩১০ হি.) বলেন,

وقد أبانت هذه الآية أن كل صاحب كبيرة ففي مشيئة الله، إن شاء عفا عنه، وإن شاء عاقبه عليه، ما لم تكن كبيرة شركا بالله. اهـ (جامع البيان في تأويل القرآن: 8/450 ط. مؤسسة الرسالة)

“এ আয়াত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, প্রত্যেক কবীরা গুনাহকারী ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। যদি চান ক্ষমা করে দিবেন, অন্যথায় শাস্তি দিবেন; যতক্ষণ না গুনাহটা শিরক পর্যন্ত গড়ায়।” -তাফসীরে তাবারী: ৮/৪৫০

পক্ষান্তরে যারা তাওবা করে মারা যাবে, আল্লাহ তাআলা নিশ্চিত তাদের মাফ করে দেবেন। তাওবা করলে তো গুনাহ কেন, কুফর-শিরকও মাফ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

{قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ} [الأنفال: 38]

হে নবী! যারা কুফরি করেছে আপনি তাদের বলুন, যদি তারা (কুফর থেকে) বিরত হয়ে যায়, তাহলে তাদের অতীতের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে। -সূরা আনফাল (০৮): ৩৮

 

দুই. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

{وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ (9) إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (10)} [الحجرات: 9، 10]

“মুমিনদের দুটি দল পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত হলে, তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তাদের একটি দল যদি অন্য দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দল বাড়াবাড়ি করছে তার বিরুদ্ধে কিতাল কর, যাবত না তারা আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দেবে এবং (সব বিষয়ে) ইনসাফ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন। প্রকৃতপক্ষে সকল মুসলিম ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের দু’ ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও। আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমের আচরণ করা হয়।” -সূরা হুজুরাত (৪৯): ৯-১০

মুসলিমদের পরস্পরে মারামারিতে লিপ্ত হওয়ার পরও আল্লাহ তাআলা উভয় দলকে মুমিন ও পরস্পর ভাই ভাই বলেছেন। অথচ অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা হারাম ও কবীরা গুনাহ। ইমাম কুরতুবি রহ. (৬৭১ হি.) বলেন,

في هذه الآية والتي قبلها دليل على أن البغي لا يزيل اسم الإيمان، لأن الله تعالى سماهم إخوة مؤمنين مع كونهم باغين. تفسير القرطبي (16/ 323)

“এ আয়াত ও পূর্বোক্ত আয়াত প্রমাণ করে, অন্যের ওপর অন্যায় সীমালংঘন করার দ্বারা ঈমান চলে যায় না। কারণ, সীমালংঘন সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা পরস্পরকে মুমিন ভাই বলেছেন।” -তাফসিরে কুরতুবি: ১৬/৩২৩

এ অজুহাতে খারেজিরা আলী রাদি.সহ জুমহুর সাহাবায়ে কেরামকে কাফের আখ্যায়িত করে। কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরও আলী রাদি.সহ অন্য কোনো সাহাবিই খারেজিদেরকে কাফের আখ্যায়িত করেননি।

ইবনে আবি শাইবা রহ. (২৩৫ হি.) বর্ণনা করেন,

عن طارق بن شهاب ، قال : كنت عند علي ، فسئل عن أهل النهر أمشركون هم؟ قال: من الشرك فروا، قيل: فمنافقون هم؟ قال: إن المنافقين لا يذكرون الله إلا قليلا، قيل له: فما هم، قال: قوم بغوا علينا. -مصنف ابن أبي شيبة: 39097، قال الشيخ الأرنؤوط في تخريج العواصم والقواصم (3\288): وهذا سند صحيح على شرط مسلم. اهـ

“তারিক বিন শিহাব রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আলী রাদি. এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। তখন নাহরাওয়ানবাসী (তথা খারেজিদের) ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তারা কি মুশরিক? তিনি উত্তর দেন, ‘শিরক থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করেছে’। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে কি তারা মুনাফিক? তিনি উত্তর দেন, ‘মুনাফিকরা তো আল্লাহকে কমই স্মরণ করে’। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে তারা কেমন? তিনি উত্তর দেন, ‘এমন লোক যারা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে’।” -মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৩৯০৯৭

ইবনে আবি শাইবার অন্য বর্ণনায় এসেছে,

إخواننا بغوا علينا.

“আমাদের ভাইরা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।” -মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৩৮৯১৮

 

তিন. অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

{يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنْثَى بِالْأُنْثَى فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ذَلِكَ تَخْفِيفٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ فَمَنِ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ (178)} [البقرة: 178]

“হে মুমিনগণ! যাদেরকে (ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে) হত্যা করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কিসাসের বিধান ফরয করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি। গোলামের বদলে গোলাম। নারীর বদলে নারী। অতঃপর হত্যাকরীকে যদি তার ভাই (নিহতের অভিভাবক)-এর পক্ষ হতে কিছুটা ক্ষমা করা হয়, তবে (তার অভিভাবকের জন্য) ন্যায়ানুগভাবে (রক্তপণ) দাবি করার অধিকার আছে। আর উত্তমভাবে তা আদায় করা (হত্যাকারীর উপর) ফরয। এটা তোমাদের রবের পক্ষ হতে হালকাকরণ ও রহমত। এরপরও কেউ সীমালঙ্গন করলে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” -সূরা বাকারা (০২): ১৭৮

এ আয়াত থেকে বুঝা গেল, হত্যাকারী কাফের হয়নি। কারণ, নিহতের অভিভাবক ইচ্ছা করলে কিসাসরূপে হত্যাকারীকে হত্যা করতে পারে। ইচ্ছা করলে কিসাস মাফ করে দিয়াত-রক্তপণ আদায় করতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে কিসাস-দিয়াত কোনোটি না নিয়ে সম্পূর্ণ মাফ করে দিতে পারে। এটাই হত্যাকারীর বিধান। যদি হত্যাকারী মুরতাদ হয়ে যেতো, তাহলে মাফ করার সুযোগ থাকতো না। কারণ, মুরতাদের শাস্তি হত্যা, যা কেউ মাফ করার অধিকার রাখে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من بدل دينه فاقتلوه. صحيح البخاري: 6524

“যে ব্যক্তি তার আপন দ্বীন (ইসলাম) ত্যাগ করবে, তাকে হত্যা করে দাও।” –সহীহ বুখারী: ৬৫২৪

যেহেতু হত্যাকারী দ্বীন থেকে বেরিয়ে যায়নি, এ কারণেই আয়াতে তাকে নিহতের অভিভাবকের ‘ভাই’ বলা হয়েছে। কারণ একজন মুমিনই অপর মুমিনের ভাই।

ইবনুল জাওযি রহ. (৫৯৭ হি.) বলেন,

ودل قوله: مِنْ أَخِيهِ على أن القاتل لم يخرج عن الإسلام. زاد المسير في علم التفسير 1/ 137

“তার ভাই বলা থেকে বুঝা গেল, হত্যাকারী ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়নি।” -যাদুল মাসির: ১/১৩৭

 

চার. এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা চুরি, যিনা ইত্যাদি গুনাহে কবীরার বিপরীতে হাত কাটা ও দোররা মারার মতো হদের বিধান দিয়েছেন। যদি গুনাহকারী কাফের হয়ে যেতো তাহলে এসব শাস্তির কোনো অর্থ থাকতো না। কারণ, মুরতাদের শাস্তি হত্যা, যেমনটা হাদিসে বলা হয়েছে।

 

পাঁচ. আবু যর রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে,

قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( آتاني آت من ربي فأخبرني أو قال بشرني أنه من مات من أمتي لا يشرك بالله شيئا دخل الجنة ) . قلت وإن زنى وإن سرق ؟ قال ( وإن زنى وإن سرق ). -صحيح البخاري (1080) صحيح مسلم (282)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একজন আগন্তুক [জিব্‌রীল আলাইহিস সালাম] আমার রবের কাছ থেকে এসে আমাকে সুসংবাদ দিলেন, আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে দাখিল হবে। আমি বললাম, যদিও সে যিনা করে, যদিও সে চুরি করে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যদিও সে যিনা করে, যদিও সে চুরি করে।” -সহীহ বুখারী: ১০৮০, সহীহ মুসলিম: ২৮২

উক্ত হাদীসে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, যিনা ও চুরির মতো কবিরা গুনাহ করলেও সে জান্নাতে যাবে। যদি কবিরা গুনাহের কারণে কাফের হয়ে যেতো, তাহলে জান্নাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ কাফের চিরস্থায়ী জাহান্নামী।

অপর একটি হাদিসে এসেছে,

عن عبادة بن الصامت رضي الله عنه قال: بايعت رسول الله صلى الله عليه و سلم في رهط فقال ( أبايعكم على أن لا تشركوا بالله شيئا ولا تسرقوا ولا تزنوا ولا تقتلوا أولادكم ولا تأتوا ببهتان تفترونه بين أيديكم وأرجلكم ولا تعصوني في معروف فمن وفى منكم فأجره على الله ومن أصاب من ذلك شيئا فأخذ به في الدنيا فهو كفارة له وطهور ومن ستره الله فذلك إلى الله إن شاء عذبه وإن شاء غفر له). –صحيح البخاري: 6416، صحيح مسلم: 4588

“উবাদা ইবনুস সামিত রাদি. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদল সাহাবিসহ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাইয়াত হলাম। বাইয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি এই মর্মে তোমাদের বাইয়াত নিচ্ছি যে, তোমরা আল্লাহ্‌র সঙ্গে কোনো কিছু শরীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেবে না এবং (আমার) শরীয়াহ সম্মত আদেশ অমান্য করবে না। তোমাদের মধ্যে যে তা পূরণ করবে, তার বিনিময় আল্লাহ্‌র কাছে। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে গেলে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তাই হবে তার জন্য কাফ্‌ফারা ও পবিত্রতা। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে গেলে আল্লাহ্ যদি তা মানুষ থেকে গোপন রাখেন, তাহলে তার শাস্তি আল্লাহ্‌র ইচ্ছাধীন। তিনি যদি চান, তাকে মাফ করে দেবেন আর যদি চান, তাকে শাস্তি দেবেন।” -সহীহ বুখারী: ৬৪১৬ সহীহ মুসলিম: ৪৫৮৮

উক্ত হাদীসে কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন, আবার চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন। এটাই শরীয়তে মুমিন গুনাহগারের বিধান; কফেরের বিধান এটা নয়। কাফের চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তাকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না বলে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেন।

ইবনু আবিল ইজ রহ. (৭৯২ হি.) বলেন,

ونصوص الكتاب والسنة والإجماع تدل على أن الزاني والسارق والقاذف لا يقتل، بل يقام عليه الحد، فدل على أنه ليس بمرتد. شرح الطحاوية في العقيدة السلفية (2/ 256)

“কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা (শরীয়তের সকল দলীল) প্রমাণ করে, যিনাকার, চোর ও যিনার মিথ্যা অপবাদ আরোপকারীকে হত্যা করা হবে না, বরং তাদের উপর ‘হদ’ (শরীয়াহ নির্ধারিত শাস্তি) কায়েম করা হবে। বুঝা গেল, এ (গুনাহে লিপ্ত) ব্যক্তি মুরতাদ নয়।” -শরহুততহাবিয়া: ২/২৫৬

ইমাম নববী রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,

وأما قوله صلى الله عليه وسلم وإن زنى وإن سرق فهو حجة لمذهب أهل السنة أن أصحاب الكبائر لا يقطع لهم بالنار وأنهم إن دخلوها أخرجوا منها وختم لهم بالخلود في الجنة. شرح النووي على مسلم (2/ 97)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, ‘যদিও সে যিনা করে, যদিও সে চুরি করে’ আহলুস সুন্নাহর এ মূলনীতির পক্ষে দলীল যে, কবীরা গুনাহকারী ব্যক্তি নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে, বলা যায় না। এ কথারও দলীল যে, যদি জাহান্নামে যায়ও, তথাপি এক সময় জাহান্নাম থেকে বের হবে এবং শেষে জান্নাতই তাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে।” -শরহে মুসলিম, নববী: ২/৯৭

 

ছয়. কবীরা গুনাহকারী ব্যক্তি কাফের নয়, এর আরও একটি বড় দলীল হল শাফাআতের হাদিসসমূহ। যেগুলোতে বলা হয়েছে, ঈমানের ওপর মৃত্যুবরণ করেছে এমন সকল ব্যক্তিই শাফাআত লাভ করবে এবং জাহান্নাম থেকে বের হয়ে জান্নাতে যাবে, যদিও সে গুনাহগার হয়।

ইবনে আবিল ইজ হানাফি রহ. (৭৯২ হি.) বলেন,

النَّوْعُ الثَّامِنُ : شَفَاعَتُهُ فِي أَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِهِ ، مِمَّنْ دَخَلَ النَّارَ ، فَيَخْرُجُونَ مِنْهَا ، وَقَدْ تَوَاتَرَتْ بِهَذَا النَّوْعِ الْأَحَادِيثُ . وَقَدْ خَفِيَ عِلْمُ ذَلِكَ عَلَى الْخَوَارِجِ وَالْمُعْتَزِلَةِ ، فَخَالَفُوا فِي ذَلِكَ ، جَهْلًا مِنْهُمْ بِصِحَّةِ الْأَحَادِيثِ ، وَعِنَادًا مِمَّنْ عَلِمَ ذَلِكَ وَاسْتَمَرَّ عَلَى بِدْعَتِهِ . وَهَذِهِ الشَّفَاعَةُ تُشَارِكُهُ فِيهَا الْمَلَائِكَةُ وَالنَّبِيُّونَ وَالْمُؤْمِنُونَ أَيْضًا. شرح العقيدة الطحاوية (2/ 70)

“অষ্টম প্রকার: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবিরা গোনাহকারী উম্মতের জন্য তাঁর শাফাআত। যারা জাহান্নামে যাবে, তারপর তাঁর শাফাআতে সেখান থেকে বের হবে। এসম্পর্কে অসংখ্য মুতাওয়াতির হাদীস রয়েছে। খাওয়ারিজ ও মু’তাজিলাদের কাছে এই ইলম নেই। ফলে তাদের কেউ এবিষয়ক সহীহ হাদীসগুলো না জেনে, আর কেউ জেনেও হঠকারিতাবশত এর বিরুদ্ধাচরণ করে তার বিদআতের উপর গোঁ ধরে বসে আছে। এই শাফাআত ফিরেশতারা করবেন, নবীরা করবেন এবং মুমিনরা করবেন।” –শরহুল আকিদাতিত তাহাবিয়্যাহ: ২/৭০

যেমন এক হাদিসে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « لِكُلِّ نَبِىٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِىٍّ دَعْوَتَهُ وَإِنِّى اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِى شَفَاعَةً لأُمَّتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَهِىَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللَّهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِى لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا ». صحيح مسلم: 512

“আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রত্যেক নবীরই একটি মাকবুল দোয়ার সুযোগ ছিল। সকল নবী দুনিয়াতেই তাদের আপন আপন দোয়াটি করে নিয়েছেন। আর আমি কেয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের জন্য আমার দোয়াটি সঞ্চিত রেখেছি। আমার উম্মতের যারা এমতাবস্থায় মারা যাবে যে, আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক করেনি, তারা সকলেই ইনশাআল্লাহ সে শাফাআত পাবে।” -সহীহ মুসলিম: ৫১২

ইমাম নববী রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,

وأما قوله صلى الله عليه وسلم فهي نائلة إن شاء الله تعالى من مات من أمتي لا يشرك بالله شيئا ففيه دلالة لمذهب أهل الحق أن كل من مات غير مشرك بالله تعالى لم يخلد في النار وإن كان مصرا على الكبائر. شرح النووي على مسلم (3/ 75)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণী ‘আমার উম্মতের যারা এমতাবস্থায় মারা যাবে যে, আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক করেনি, তারা সকলেই ইনশাআল্লাহ সে শাফাআত পাবে।’ -আহলে হকের এ মূলনীতির দলীল যে, কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ শিরক না করবে, বার বার কবীরা গুনাহ করে মারা গেলেও চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না।” -শরহে মুসলিম, নববী: ৩/৭৫

অন্য হাদিসে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: “شَفَاعَتِي لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِي”. مسند أحمد ط الرسالة: 13222، قال المحققون: إسناده صحيح. … وأخرجه أبو داود (4739) … والترمذي (2435) ، … والحاكم 1/69 … من طرق عن أنس. وقال الترمذي: حديث حسن صحيح. وصححه الحاكم على شرط الشيخين. اهـ

“আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার শাফাআত হবে আমার উম্মতের ওইসব লোকদের জন্য, যারা কবীরা গুনাহ নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছে।” -মুসনাদে আহমাদ: ১৩২২২

আবুল হাসান সিন্ধি রহ. (১১৩৮ হি.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,

“لأهل الكبائر” ففيه دلالة على الشفاعة في الكبائر، فهو رد على من ينكر ذلك ويرى أن الشفاعة لرفع الدرجات وغيره، ولا شفاعة لأهل الكبائر؛ بل هم يخلدون في النار. فتح الودود في شرح سنن أبي داود (4/ 499)

“…এ হাদিস প্রমাণ করে, কবীরা গুনাহের জন্য শাফাআত হবে। অতএব, এ হাদিস ওইসব লোকদের খণ্ডন করছে যারা বলে, ‘শাফাআত হবে শুধু (জান্নাতীদের) মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। কবীরা গুনাহকারীদের জন্য কোনো শাফাআত হবে না, বরং তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী’।” -ফাতহুল ওয়াদুদ: ৪/৪৯৯

আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে এসেছে,

قال النبي صلى الله عليه و سلم ( يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وكان في قلبه من الخير ما يزن شعيرة ثم يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وكان في قلبه من الخير ما يزن برة ثم يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وكان في قلبه ما يزن من الخير ذرة ). صحيح البخاري: 6975، صحيح مسلم: 499

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার অন্তরে যবের দানার ওজন পরিমাণ ঈমান আছে, তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করা হবে । তারপর তাকেও বের করা হবে, যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার অন্তরে গমের দানার ওজন পরিমাণ ঈমান আছে। তারপর তাকেও বের করা হবে, যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার অন্তরে অণু পরিমাণ হলেও ঈমান আছে।” -সহীহ বুখারি: ৬৯৭৫, সহীহ মুসলিম: ৪৯৯

এছাড়াও আরো অসংখ্য হাদিসে এসেছে যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম, শুহুাদা ও সালিহিনদের শাফাআতের মাধ্যমে এবং সর্বশেষ আল্লাহ তাআলার অপার রহমতে সকল গুনাহগার মুমিন জাহান্নাম থেকে মুক্ত হয়ে জান্নাতে যাবে। কোনো মুমিন চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না, সে যত গুনাহই করে থাকুক। এটিই আহলুস সুন্নাহর আকিদা। ইমাম তহাবি রহ. (৩২১ হি.) বলেন,

وأهل الكبائر من أمة محمد صلى الله عليه و سلم في النار لا يخلدون إذا ماتوا وهم موحدون وإن لم يكونوا تائبين بعد أن لقوا الله عارفين مؤمنين.  وهم في مشيئته وحكمه: إن شاء غفر لهم وعفا عنهم بفضله كما ذكر عز و جل في كتابه : ( ويغفر ما دون ذلك لمن يشاء ).  وإن شاء عذبهم في النار بعدله ثم يخرجهم منها برحمته وشفاعة الشافعين من أهل طاعته ثم يبعثهم إلى جنته. العقيدة الطحاوية (ص: 45)

“উম্মাতে মুহাম্মাদির কবীরাগুনাহগাররা যদি আল্লাহর পরিচয় ও ঈমান নিয়ে মৃত্যু বরণ করে, তাওবা না করে মারা গেলেও চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না। তাদের বিষয়টা আল্লাহর ইচ্ছা ও ফায়সালার ওপর ন্যস্ত। তিনি চাইলে ইহসান করে ক্ষমাও করতে পারেন; যেমনটা আল্লাহ তায়ালা নিজেই জানিয়েছেন, ‘শিরক ছাড়া অন্যান্য গুনাহ যাকে চান ক্ষমা করে দেবেন।’ চাইলে ইনসাফের সাথে শাস্তিও দিতে পারেন। তারপর তিনি নিজ রহমতে এবং নেককারদের শাফাআতে জাহান্নাম থেকে বের করে তাদের জান্নাতে দেবেন।” -আলআকিদাতুত তহাবিয়া: ৪৫

ইমাম ইবনে আবিল ইয রহ. বলেন,

فقوله وأهل الكبائر من أمة محمد صلى الله عليه وسلم في النار لا يخلدون ، إذا ماتوا وهم موحدون – رد لقول الخوارج والمعتزلة ، القائلين بتخليد أهل الكبائر في النار. اهـ (شرح عقيدة الطحاوي لابن ابي العز: 373 ط. الدار العالمية)

“কবীরা গুনাহকারীরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না এ বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম তহাবী খারেজি ও মুতাজিলাদের মত খণ্ডন করেছেন, যারা বলে, কবীরা গুনাহকারীরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।” -শরহুল আকীদাতিত তহাবী, পৃ: ৩৭৩

 

খারেজিদের বিভ্রান্তির কারণ

খারেজিদের বিভ্রান্তির কারণ হল, তাদের একমুখী অধ্যয়ন ও খণ্ডিত জ্ঞান কিংবা হঠকারিতা। তারা সঠিক মর্মার্থ না বুঝে কিংবা হঠকারিতাবশত শুধু একদিকের কিছু আয়াত ও হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে, বিপরীত দিকের অসংখ্য আয়াত ও হাদীস উপেক্ষা করেছে। তারা এমন কিছু নস দেখে বিভ্রান্ত হয়েছে, যেগুলোতে:

– গুনাহগারের ঈমান থাকে না বলা হয়েছে;

– কিংবা কোনো গুনাহের ওপর কুফর শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে;

– অথবা বলা হয়েছে, অমুক গুনাহ করলে জাহান্নামে যাবে বা জান্নাত হারাম ইত্যাদি।

যে হাদীসগুলোর বাহ্যিক অর্থ দেখে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে, আমরা উদাহরণ হিসেবে এমন কিছু হাদীস এবং পরে মুহাদ্দিসীনে কেরামের উদ্ধৃতিতে সেগুলোর ব্যাখ্যা তুলে ধরছি। যেমন আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,

إن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( لا يزني الزاني حين يزني وهو مؤمن ولا يشرب الخمر حين يشربها وهو مؤمن ولا يسرق السارق حين يسرق وهو مؤمن ). صحيح البخاري: 5256، صحيح مسلم: 211

“নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যিনাকার যখন যিনা করে তখন মুমিন থাকে না। মদখোর যখন মদ খায় তখন মুমিন থাকে না। চোর যখন চুরি করে তখন মুমিন থাকে না।” -সহীহ বুখারি: ৫২৫৬, সহীহ মুসলিম: ২১১

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে,

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ». صحيح البخاري: 48، صحيح مسلم: 230، واللفط لمسلم.

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুসলিমকে গালি দেয়া ফিসক আর তার সাথে কিতাল করা কুফর।” -সহীহ বুখারী: ২৮, সহীহ মুসলিম: ২৩০

সাআ’দ রা. বলেন,

سمعت النبي صلى الله عليه و سلم يقول ( من ادعى إلى غير أبيه وهو يعلم أنه غير أبيه فالجنة عليه حرام ) . صحيح البخاري: 6385، صحيح مسلم: 229

“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি (নিজ পিতাকে অস্বীকার করে অন্য) কাউকে পিতা দাবি করবে, অথচ সে জানে যে, এ লোক তার পিতা নয়, তাহলে তার জন্য জান্নাত হারাম।” -সহীহ বুখারী: ৬৩৮৫, সহীহ মুসলিম: ২২৯

দেখুন, এই হাদীসগুলোর বাহ্যিক বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, কেউ যিনা, চুরি বা মদপান করলে তখন সে মুমিন থাকে না। মুসলিমের সঙ্গে কিতাল কুফর। সুতরাং কেউ করলে কাফের হয়ে যাবে। পিতাকে অস্বীকার করলে তার জন্য জান্নাত হারাম।

খারেজিরা মূলত এজাতীয় কিছু আয়াত ও হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দেখেই বিভ্রান্ত হয়েছে। অথচ একই বিষয়ে আরো অসংখ্য আয়াত ও হাদীস আছে, যেগুলো থেকে এর বিপরীত বুঝা যায়। যেমন শুরুতে আমরা এমন অনেকগুলো আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছি, যেগুলোতে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, একজন মুমিন যিনা বা চুরি করলেও জান্নাতে যাবে এবং অপর মুমিনের সঙ্গে কিতাল করলেও কোরআনের ভাষায় সে তার মুমিন ভাই-ই গণ্য হবে।

কোরআন ও হাদীসে এমন অসংখ্য বক্তব্য আছে, যেখানে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে, দুটি আয়াত কিংবা দুটি হাদীস পরস্পর বিরোধী সাব্যস্ত হয়। একটির বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে অপরটি প্রত্যাখ্যান করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই দুটি বক্তব্যেরই বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। অন্যথায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক কথা আরেক কথার বিরোধী বলতে হবে। যা আদৌ সম্ভব নয়। আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এজাতীয় বক্তবগুলোর ব্যাখ্যা কিভাবে করতে হয়, তা স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্র এবং দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। এবিষয়ে অনেক কিতাব রচিত হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সে আলোচনার সুযোগ নেই। আমরা এখানে শুধু দেখাব, যে বক্তব্যগুলোর বাহ্যিক অর্থ দেখে খারেজিরা বিভ্রান্ত হয়েছে, সেগুলোর সঠিক অর্থ কী? মুহাদ্দিসীনে কেরাম সে হাদীসগুলোর কী ব্যাখ্যা করেছেন।

 

প্রথম হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইমাম নববী রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,

إن الزاني والسارق والقاتل وغيرهم من أصحاب الكبائر غير الشرك لا يكفرون بذلك بل هم مؤمنون ناقصو الإيمان إن تابوا سقطت عقوبتهم وإن ماتوا مصرين على الكبائر كانوا في المشيئة فان شاء الله تعالى عفا عنهم وأدخلهم الجنة أولا وإن شاء عذبهم ثم أدخلهم الجنة. اهـ (شرح النووي على مسلم: 2/41-42 ط. دار إحياء التراث العربي)

“ব্যভিচারী, চোর ও হত্যাকারী সহ শিরক ব্যতীত অন্যান্য কবীরা গুনাহকারীরা এ সব গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে কাফের হবে না। বরং তারা দুর্বল ঈমানদার। যদি তারা তওবা করে, তাদের শাস্তি মওকুফ হয়ে যাবে। আর যদি তওবা না করে কবিরা গুনাহের ওপর মারা যায়, তাহলে তারা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ চাইলে প্রথমেই ক্ষমা করে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন। আর চাইলে শাস্তি দিয়ে (শাস্তির পর) জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন।’ -শরহে মুসলিম: ২/৪১-৪২

হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,

ومن أقوى ما يحمل على صرفه عن ظاهره إيجاب الحد في الزنا على أنحاء مختلفة في حق الحر المحصن والحر البكر وفي حق العبد فلو كان المراد بنفي الإيمان ثبوت الكفر لاستووا في العقوبة لأن المكلفين فيما يتعلق بالإيمان والكفر سواء فلما كان الواجب فيه من العقوبة مختلفا دل على أن مرتكب ذلك ليس بكافر حقيقة اهـ. -فتح الباري لابن حجر: 12/ 60، طـ. دار المعرفة – بيروت.

“উল্লেখিত হাদিসের বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য না হওয়ার সবচেয়ে মজবুত দলিল হচ্ছে, যিনা-ব্যভিচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হদ (শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) ওয়াজিব হওয়া। যেমন বিবাহিত স্বাধীন মানুষের বিধান একরকম, অবিবাহিত স্বাধীনের বিধান একরকম এবং গোলামদের বিধান আরেক রকম। এখানে যদি মুমিন না হওয়ার দ্বারা কুফর উদ্দেশ্যে হত, তাহলে সকলের শাস্তি এক ও অভিন্ন হত। কেননা ঈমান ও কুফরের ক্ষেত্রে স্বাধীন, পরাধীন সকলেই সমান। যখন এখানে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি ওয়াজিব হয়েছে, তো বিষয়াটি সুস্পষ্ট যে, এ সমস্ত পাপাচারে লিপ্তরা বাস্তবে কাফের নয়।” –ফাতহুল বারী: ১২/৬০

দ্বিতীয় হাদীসের ব্যাখ্যা:

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. (৮৫৫ হি.) বলেন,

والإجماع من أهل السنة منعقد على أن المؤمن لا يكفر بالقتال اهـ. -عمدة القاري: 1/ 279، طـ.  دار إحياء التراث العربي – بيروت

“কিতালের কারণে কোনো মুমিনকে তাকফির না করার ওপর আহলুস সুন্নাহ’র ইজমা রয়েছে।” –উমদাতুল কারী: ১/২৭৯

ইমাম ইবনুল বাত্তাল রহ. (৪৪৯ হি.) বলেন,

والدليل على صحة قولنا: إجماع أهل السُّنَّة أن قتل المسلم للمسلم لا يخرجه من الإيمان إلى الكفر، وإنما فيه القود اهـ. -شرح صحيح البخارى لابن بطال: 1/ 111، طـ. مكتبة الرشد – السعودية.

“আমাদের বক্তব্য বিশুদ্ধ হওয়ার প্রমাণ হলো, একথার ওপর আহলুস সুন্নাহ’র ঐকমত্য যে, কোনো মুসলমান কর্তৃক কোনো মুসলমানকে হত্যা করা তাকে ঈমান থেকে বের করে দেয় না; বরং হত্যার শাস্তি হল কিসাস।” –শরহু ইবনু বাত্তাল: ১/১১১

 

তৃতীয় হাদীসের ব্যাখ্যা:

আল্লামা আইনী রহ. বলেন,

(فالجنة عليه حرام) إما على سبيل التغليظ، وإما أنه إذا استحل ذلك اهـ. -عمدة القاري: 17/ 305، طـ. دار إحياء التراث العربي – بيروت.

“(হাদিসের বক্তব্য) ‘তার জন্য জান্নাত হারাম’ হয়ত ধমকিস্বরূপ বলা হয়েছে। অথবা হাদিসের উদ্দেশ্য, যে ব্যক্তি এ কাজটিকে হালাল মনে করবে তার জন্য জান্নাত হারাম।” –উমদাতুল কারী: ১৭/৩০৫

মোল্লা আলী ক্বারী রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,

(فالجنة عليه حرام): أي: إن اعتقد حله، أو قبل أن يعذب بقدر ذنبه، أو محمول على الزجر عنه; لأنه يؤدي إلى فساد عريض اهـ. -مرقاة المفاتيح: 5/ 2170، طـ. دار الفكر، بيروت.

“(হাদিসের বক্তব্য) ‘তার জন্য জান্নাত হারাম’ অর্থ কেউ যদি এ কাজকে হালাল মনে করে, তার জন্য জান্নাত হারাম। অথবা তার গুনাহ পরিমাণ শাস্তি ভোগ করার পূর্বে জান্নাত হারাম। অথবা এমন কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য ধমকিস্বরূপ বলা হয়েছে। কেননা এমন কাজ অনেক বড় ফেতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” –মিরকাতুল মাফাতীহ: ৫/২১৭০

আর উক্ত বক্তা সুরা আলে ইমরানের যে আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে এরকম কোন কথা নেই। আয়াতটি হলো-

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُدْعَوْنَ إِلَى كِتَابِ اللَّهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِنْهُمْ وَهُمْ مُعْرِضُونَ (23) ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ وَغَرَّهُمْ فِي دِينِهِمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ. (سورة آل عمران: 24)

আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যাদেরকে কিতাবের কিছু অংশ দেয়া হয়েছিল? ওদের আল্লাহর কিতাবের দিকে আহবান করা হয়, যাতে তা ওদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়; তা সত্ত্বেও ওদের একদল উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটা এজন্য যে তারা বলে, মাত্র কয়েকদিন ছাড়া আগুন আমাদেরকে কখনই স্পর্শ করবে না। আর ওদের মনগড়া কথা বার্তাই ওদের ধর্ম-বিষয়ে প্রতারিত করেছে। -সুরা আলে ইমরান (০৩): ২৩,২৪

 

আয়াতের তাফসীরে মুফাসসিরগণ যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো, ইহুদি-নাসারারা দাবী করত, তারা তাওরাত-ইঞ্জিলের অনুসরণ করে। অথচ তাওরাত-ইঞ্জিলে শেষ নবী হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন আলামত ও তার প্রতি ঈমান আনার আদেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং যদি বাস্তবেই তারা তাওরাত-ইঞ্জিলের অনুসারী হত, তবে তাদের কর্তব্য ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনা। কিন্তু যখন তাদেরকে তাওরাত-ইঞ্জিলের বিধান অনুযায়ী নবীজির প্রতি ঈমান আনতে বলা হয়, তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ হলো, তাদের ওই ভ্রান্ত বিশ্বাস যে, তারা অল্প কয়েকদিনই দোযখে থাকবে, এরপর তারা জান্নাতে চলে যাবে। আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে তাদের এ ভ্রান্ত ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন। -দেখুন, তাফসীরে ইবনে কাসীর: ২/২৮

কেউ কবিরা গুনাহ করলে কাফের হয়ে যাবে এমন কোনে কথার নাম গন্ধও উক্ত আয়াতে নেই।

উল্লেখ্য, আজকের এই ফেতনার সময়ে যারা যোগ্য আলেম নন এবং কোরআন হাদীসের শুদ্ধ অশুদ্ধ যাচাই করার মতো ইলম যাদের নেই, তাদের জন্য যার তার বয়ান শোনা নিরাপদ নয়। এতে তাদের দ্বীন ও ঈমান ঝুঁকিতে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাদের জন্য জরুরি হল, শুধু এমন আলেমদের বয়ান শোনা, যাদের ইলমি যোগ্যতা, দ্বীনদারি, তাকওয়া তাহারাত ও সততা উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে নির্ভরযোগ্য।

والله تعالى أعلم وعلمه أتم وأحكم، وصلى الله تعالى عليه وعلى آله وسلم.

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

১৬-০৭-১৪৪২ হি.

০১-০৩-২০২১ ইং

আরও পড়ুন
একাধিকবার সমকামিতার কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির করণীয় কী?

Related Articles

Back to top button