বিবিধফাতওয়া  নং  ৪৯৮

রেশমি পোশাক পরিধানের বিধান

রেশমি পোশাক পরিধানের বিধান

 

প্রশ্ন: পুরুষের জন্য রেশমি পোশাক পরার হুকুম কী? রেশমি পোশাক সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে উপকৃত হতাম।

উত্তর:

بسم الله، والحمد لله، والصلاة والسلام على رسول الله، أما بعد!

০১. পুরুষের জন্য রেশমি পোশাক পরা নাজায়েয। এ বিষয়ে হাদীসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে সুনানে আবু দাউদে এসেছে,

إن نبي الله -صلَّى الله عليه وسلم- أخذَ حريراً فجعلَه في يمينه، وأخذ ذهباً فجعله في شِمَالِه، ثم قال: “إنَّ هذينِ حَرَامٌ على ذُكُورِ أُمَّتي”. -سنن أبي داود ت الأرنؤوط (6/ 165)، كتاب اللباس، باب في الحرير للنساء، الرقم: 4057، ط. دار الرسالة العالمية، قال الارنؤوط: إسناده صحيح.

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান হাতে রেশম ধরলেন এবং বাম হাতে স্বর্ণ ধরলেন। তারপর বললেন, আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য এ দুটি বস্তু হারাম।” –সুনানে আবু দাউদ: ৪০৫৭

ইবনে মাজাহর বর্ণনায় এসেছে,

“إِنَّ هَذَيْنِ حَرَامٌ عَلَى ذُكُورِ أُمَّتِي، حِلٌّ لِإِنَاثِهِمْ”. سنن ابن ماجة: 3595، قال الشيخ الأرنؤؤط: صحيح لغيره. سنن الترمذي: 1720، قال الترمذي:  حديث حسن صحيح.

“আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য এ দুটি বস্তু হারাম, নারীদের জন্য হালাল।” -সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৫৯৫

পাঞ্জাবি, জুব্বা, লুঙ্গি, পায়জামা, গেঞ্জি, টুপি, পাগড়ি, শার্ট, প্যান্ট, জ্যাকেট সব ধরনের পরিধানের বস্ত্র এ নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।

এমনিভাবে চাদর, কাঁথা, কম্বল, লেপ তথা যেগুলো সরাসরি পরিধান করা হয় না, তবে গায়ে জড়ানো হয় বিধায় পরিধানের সদৃশ, সেগুলোও নাজায়েয। -রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৫৪

বড়দের জন্য যেমন নিষেধ, হানাফি মাযহাব মতে ছেলে শিশুদেরকে পরানোও নিষেধ এবং যারা পরাবে তারা গুনাহগার হবে। -আলজামিউস সাগির (নাফে কাবিরের সাথে মুদ্রিত): ৫৩৪, হিদায়া: ৪/৩৬৭, রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৬২

তবে রেশম যদি জ্যাকেট কিংবা কাঁথার ভিতরে তুলার মতো ভরে দেয়া হয়, তাহলে তা পরিধানের অন্তর্ভুক্ত হবে না বিধায় জায়েয। -রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৫২

উল্লেখ্য, হাদীসে রেশমি কাপড় দ্বারা উদ্দেশ্য: ‘রেশম পোকা’ থেকে তৈরি সুতায় বুনা কাপড়। সম্পূর্ণ কাপড় বা কাপড়ের পোড়েন সুতা যদি রেশমের হয়, তাহলে তা নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে পোড়েন অন্য সুতার হলে টানা সুতা রেশমের হলেও তা হাদীসের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। -আদদুররুল মুখতার: ৬৫৪, রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৫১

এমনিভাবে আধুনিক প্রক্রিয়ায় তৈরি কাপড় যদি ‘রেশম পোকা’ থেকে তৈরি সুতার না হয়ে ভিন্ন উপাদান বা ক্যামিকেলের তৈরি হয়, তাহলে সেগুলো রেশমি কাপড় নয়, রেশম নাম দেয়া হলেও সেগুলো নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে না। -ফাতাওয়া উসমানি: ৪/৩৪০-৩৪১

০২. অসুস্থতা জনিত কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে রেশমের কাপড় পরতে হলে, তা নাজায়েয নয়। সহীহ বুখারীতে এসেছে,

عن أنس قال : رخص النبي صلى الله عليه و سلم للزبير وعبد الرحمن في لبس الحرير لحكة بهما. -صحيح البخاري – البغا (5/ 2196)، الرقم:  5501

“আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু ও আব্দুর রহমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর শরীরে চুলকানি জনিত সমস্যা থাকায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে রেশম পরার অবকাশ দেন।” –সহীহ বুখারী: ৫৫০১

সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,

أَنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ، وَالزُّبَيْرَ بْنَ الْعَوَّامِ شَكَوَا إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقَمْلَ، «فَرَخَّصَ لَهُمَا فِي قُمُصِ الْحَرِيرِ فِي غَزَاةٍ لَهُمَا». – صحيح مسلم (3/ 1647)، الرقم: 2076

“আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও যুবায়ের বিন আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উকুনের যন্ত্রণার অভিযোগ করেন। তখন তিনি তাদেরকে রেশমের জামা পরার অবকাশ দেন। এটি এক যুদ্ধের সফরে থাকাকালের ঘটনা।” –সহীহ মুসলিম: ২০৭৬

অর্থাৎ উকুনের আধিক্য থেকে তাদের শরীরে চুলকানি সমস্যা দেখা দেয়। সফরে থাকায় চিকিৎসারও সুযোগ ছিল না। তখন রেশমের জামা পরার অবকাশ দেন। রেশমের জামা মসৃণ হওয়ায় উকুন তাতে থাকতে পারে না, ঝরে পড়ে যায়। তাছাড়া চুলকানি সমস্যায় ডাক্তারি শাস্ত্রমতে রেশমের পোশাক উপকারীও বটে।

হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ বলেন,

قال الطبري فيه دلالة على أن النهي عن لبس الحرير لا يدخل فيه من كانت به علة يخففها لبس الحرير انتهى ويلتحق بذلك ما يقي من الحر أو البرد حيث لا يوجد غيره.-فتح الباري لابن حجر (10/ 295)

“তাবারি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘হাদীসটি প্রমাণ করে, যার শরীরে এমন কোনো সমস্যা বিদ্যমান, যা রেশমের পোশাক পরার দ্বারা উপশম হতে পারে, রেশম পরিধানের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সে ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হবে না।’

তীব্র গরম কিংবা শীতে আত্মরক্ষার কিছু না থাকলে আত্মরক্ষার জন্য রেশম পরিধানও এই শ্রেণিভুক্ত।” –ফাতহুল বারী: ১০/২৯৫

জিহাদের মাসলাহাতে রেশমের পোশাক পরিধানের প্রয়োজন পড়লে (যেমন শত্রুদের মাঝে গোয়েন্দাগিরি করা, শত্রুদের ধোঁকা দেয়া বা প্রতিরক্ষা জ্যাকেট হিসেবে পরিধান করা), যদি সহজ কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকে তাহলে পরিধান জায়েয। উকুন ও চুলকানি সমস্যা উপশমে ভিন্ন ব্যবস্থা না থাকার সময় যখন হাদীসে রেশম পরার অবকাশ এসেছে, তখন জিহাদের প্রয়োজনে যে জায়েয হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। -শারহু সহীহিল বুখারী, ইবনুল বাত্তাল: ৯/১১৪; রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৫১, ৩৫৭; মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া: ২৮/২৭

বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে জায়েয হবে কিনা তা মতভেদপূর্ণ, তাই বেঁচে থাকাই উত্তম।

০৪. মূল পোশাকের অনুগামী হিসেবে কিছু রেশম যুক্ত করা হলে বা কাপড়ে রেশমের নকশা করা হলে, যদি তা প্রস্থে চার আঙ্গুলের বেশি না হয়, তাহলে উক্ত পোশাক পরা জায়েয। প্রস্থে চার আঙ্গুলের বেশি না হলে দৈর্ঘ্যে লম্বা হলেও সমস্যা নেই।

عن قتادة عن عامر الشعبى عن سويد بن غفلة أن عمر بن الخطاب خطب بالجابية فقال نهى نبى الله -صلى الله عليه وسلم- عن لبس الحرير إلا موضع إصبعين أو ثلاث أو أربع. صحيح مسلم: 5538

“উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ﷺ রেশম পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। তবে এক, দুই, তিন বা চার আঙ্গুল পরিমাণ (বৈধ)।” -সহীহ মুসলিম: ৫৫৩৮

প্রস্থে চার আঙ্গুলের বেশি নয় এমন একাধিক সংযুক্তি বা নকশা থাকলেও তাতে সমস্যা নেই; যদি দেখতে পুরো কাপড় রেশমের বলে মনে না হয়। পক্ষান্তরে নকশা যদি এতো ঘন ঘন হয় যে, দেখতে পুরো কাপড়টি রেশমের বলে মনে হয়, তাহলে তা পরিধান করা জায়েয নয়।

উপর্যুক্ত শর্ত সাপেক্ষে রেশম লাগানো বা রেশমের নকশা করা পাঞ্জাবি, জুব্বা, লুঙ্গি, পাজামা, টুপি, পাগড়ি ও অন্য সকল পোশাক পরিধান করা যাবে। -হিদায়া: ৪/৩৬৬; আদদুররুল মুখতার: ৬৫২-৬৫৪; রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৫১-৩৫৪; ইমদাদুল ফাতাওয়া: ৯/৬০

فقط والله تعالى أعلم بالصواب

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

২৭-০২-১৪৪৬ হি.

০২-০৯-২০২৪ ঈ.

Related Articles

Back to top button