খারেজিরা কি কাফের?না,বিভ্রান্ত মুসলিম?
পিডিএফ ডাউলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
প্রশ্ন:
খারেজিদের নিয়ে যত হাদিস এসেছে, তার প্রায় সবগুলোতেই বলা হয়েছে, ‘তীর যেমন ধনুক থেকে বের হয়ে যায়, তারাও তেমন ঈমান থেকে বের হয়ে যাবে। ‘এ কথার অর্থ কি? খারেজিরা কি কাফের? না, বিভ্রান্ত মুসলিম?
বিনীত
ইমরান খন্দকার
উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم
সরাসরি ঈমান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা না থাকলেও অনেক হাদিসেই এসেছে, খারেজিরা দ্বীন ও ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। যেমন,
يأتي في آخر الزمان قوم حدثاءالأسنان سفهاءالأحلام يقولون من خير قول البرية يمرقون من الإسلام كما يمرق السهم من الرمية لا يجاوز إيمانهم حناجرهم فأينما لقيتموهم فاقتلوهم فإن قتلهم أجر لمن قتلهم يوم القيامة. -صحيح البخاري، رقم: 4770؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا
“শেষ যামানায় এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের বয়স হবে কম, বুদ্ধিতে হবে নির্বোধ। (বাহ্যত) সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ বাণী তারা বলবে, (বস্তুত) শিকারের দেহ ভেদ করে নিক্ষিপ্ত তীর যেমন বেরিয়ে যায়, তেমনি তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। তাদের ঈমান তাদের গলদেশ পেরিয়ে নিচে নামবে না। যেখানেই পাবে, তাদেরকে হত্যা করবে। তাদের হত্যা করাটা কিয়ামত দিবসে হত্যাকারীর জন্য প্রতিদানের কারণ হবে।” –সহীহ বুখারি: ৪৭৭০
অন্য হাদিসে এসেছে,
يمرقون من الدين كما يمرق السهم من الرمية. -صحيح البخاري، رقم: 4094؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا
“শিকারের দেহ ভেদ করে নিক্ষিপ্ত তীর যেমন বেরিয়ে যায়, তেমনি তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে।” –সহীহ বুখারি: ৪০৯৪
এ ধরনের হাদিসের আলোকে কেউ কেউ খারেজিদের কাফের আখ্যায়িত করেছেন। তবে আহলুস সুন্নাহর জুমহুর ওলামায়ে কেরামের মতে ভিন্ন কোনো কুফর পাওয়া না গেলে তারা কাফের নয়, গোমরাহ ও ফাসেক। বরং কেউ কেউ একথার ওপর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র ইজমাও দাবি করেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
وذهب أكثر أهل الأصول من أهل السنة إلى أن الخوارج فساق وأن حكم الإسلام يجري عليهم لتلفظهم بالشهادتين ومواظبتهم على أركان الإسلام وإنما فسقوا بتكفيرهم المسلمين مستندين إلى تأويل فاسد وجرهم ذلك إلى استباحة دماء مخالفيهم وأموالهم والشهادة عليهم بالكفر والشرك. وقال الخطابي: أجمع علماء المسلمين على أن الخوارج مع ضلالتهم فرقة من فرق المسلمين وأجازوا مناكحتهم وأكل ذبائحهم وأنهم لا يكفرون ما داموا متمسكين بأصل الإسلام. فتح الباري لابن حجر (12/ 300)
আহলুস-সু্ন্নাহ ওয়াল-জামাআ’হর অধিকাংশ উসূলবিদের মতে খারেজিরা ফাসেক, তাদের ওপর মুসলিমের বিধান কার্যকর হবে। কারণ, তারা কালিমায়ে শাহাদাতের স্বীকৃতি দেয় এবং রীতিমতো আরকানে ইসলাম (ইসলামের মৌলিক বিধান সালাত সাওম ইত্যাদি) আদায় করে। তবে তারা ভুল ব্যখ্যার ভিত্তিতে মুসলিমদের তাকফীর করে, এই তাকফীরের ভিত্তিতে তাদের বিরোধীদের জান-মাল বৈধ মনে করে এবং তাদেরকে কাফের ও মুশরিক বলে সাক্ষ্য প্রদান করে। খাত্তাবী রহ. বলেন, ওলামায়ে উম্মত একমত যে, খারেজিরা তাদের মধ্যে বিদ্যমান যাবতীয় ভ্রান্তি সত্ত্বেও মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত একটি দল। ওলামায়ে কেরামের মতে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন বৈধ, তাদের যবাইকৃত পশু খাওয়া হালাল। যতদিন তারা ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলী ধরে রাখবে, ততদিন তাদেরকে তাকফীর করা যাবে না। -ফাতহুল বারি: ১২/৩০০
খারেজিদের কাফের না হওয়ার পক্ষে তারা বিভিন্ন দলীল পেশ করেছেন-
এক. খারেজিদের ব্যাপারে বর্ণিত কোনো কোনো হাদিসে مِنْ أُمَّتِى –‘আমার উম্মতের মধ্য থেকে’ বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে। যা থেকে বুঝা যায়, তারা বিভ্রান্তির চরম সীমায় পৌঁছলেও উম্মতে মুসলিমা থেকে বের হয়ে যায়নি। যেমন, সহীহ মুসলিমে আলী রাদি. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
يَخْرُجُ قَوْمٌ مِنْ أُمَّتِى يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَيْسَ قِرَاءَتُكُمْ إِلَى قِرَاءَتِهِمْ بِشَىْءٍ وَلاَ صَلاَتُكُمْ إِلَى صَلاَتِهِمْ بِشَىْءٍ وَلاَ صِيَامُكُمْ إِلَى صِيَامِهِمْ بِشَىْءٍ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ يَحْسِبُونَ أَنَّهُ لَهُمْ وَهُوَ عَلَيْهِمْ لاَ تُجَاوِزُ صَلاَتُهُمْ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنَ الإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ -صحيح مسلم: 2516
“আমার উম্মতের মধ্য থেকে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। তাদের তেলাওয়াতের সামনে তোমাদের তেলাওয়াত কিছুই না। তাদের নামাযের সামনে তোমাদের নামায কিছুই না। তাদের রোযার সামনে তোমাদের রোযা কিছুই না। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে আর ভাববে তা তাদের পক্ষে, অথচ বাস্তবে তা তাদের বিপক্ষে। তাদের নামায তাদের গলদেশ পেরিয়ে নিচে নামবে না। শিকারের দেহ ভেদ করে নিক্ষিপ্ত তীর যেমন বেরিয়ে যায়, তেমনি তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে।” -সহীহ মুসলিম: ২৫১৬
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ –صلى الله عليه وسلم- « إِنَّ بَعْدِى مِنْ أُمَّتِى – أَوْ سَيَكُونُ بَعْدِى مِنْ أُمَّتِى – قَوْمٌ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَلاَقِيمَهُمْ يَخْرُجُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَخْرُجُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ ثُمَّ لاَ يَعُودُونَ فِيهِ هُمْ شَرُّ الْخَلْقِ وَالْخَلِيقَةِ ». صحيح مسلم: 2518
আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার পরে আমার উম্মতের মধ্যে থেকে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে, যারা কুরআন পড়বে কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। নিক্ষিপ্ত তীর যেভাবে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করে বেরিয়ে যায়, তারাও দ্বীন থেকে সেভাবে বেরিয়ে যাবে, এরপর আর দ্বীনে ফিরে আসবে না। সৃষ্টিজীবের মধ্যে তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট। -সহীহ মুসলিম: ২৫১৮
ইমাম নববী রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,
لفظة “مِن” تقتضي كونهم من الأمة، لا كفارا … فقد جاء … من رواية علي رضي الله عنه يخرج من أمتي قوم وفي رواية أبي ذر ان بعدي من أمتي أو سيكون بعدي من أمتي. وقد سبق الخلاف في تكفيرهم وأن الصحيح عدم تكفيرهم. شرح النووي على مسلم (7/ 164-165)
‘মিন’ (তথা আমার উম্মতের মধ্য থেকে) শব্দটির দাবী হলো, খারেজিরা এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত, কাফের নয়। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় এসেছে, ‘আমার উম্মতের মধ্য থেকে এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে’। আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় এসেছে ‘আমার পরে আমার উম্মতের মধ্য থেকে’ কিংবা বলেছেন, ‘অচিরেই আমার পর আমার উম্মতের মধ্য থেকে’ (এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে)। তাদেরকে তাকফীর করা হবে কি না এ বিষয়ক ইখতেলাফ পেছনে অতিবাহিত হয়েছে এবং একথাও অতিবাহিত হয়েছে যে, সহীহ মত হলো তাদেরকে তাকফীর করা হবে না। -শরহু মুসলিম, নববী রহ.: ৭/১৬৪-১৬৫
দুই. এক হাদিসে এসেছে,
يمرقون من الدين مروق السهم من الرمية فينظر الرامي إلى سهمه إلى نصله إلى رصافه فيتمارى في الفوقة هل علق بها من الدم شيء. صحيح البخاري: 6532، صحيح مسلم: 2503
“নিক্ষিপ্ত তীর যেভাবে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করে বেরিয়ে যায়, তারাও দ্বীন থেকে সেভাবে বেরিয়ে যাবে। (দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা এমন যে,) এরপর নিক্ষেপকারী তীরটি ভালোভাবে দেখে; তীরের ফলা দেখে, ফলা আটকানোর জন্য তীরের মাথায় পেঁচানো কাপড়টি দেখে (কিন্তু তীর এতোই সজোরে বেরিয়ে গেছে যে, রক্ত মাংসা কিছুই তাতে লাগেনি)। এরপর সে তীরের একেবারে গোড়ার খাঁজ, যেটি রশিতে লাগিয়ে তীর তাক করা হয়, সেটি দেখে সন্দেহে পড়ে যায় যে, এতে একটু রক্ত লাগলো না’কি?” –সহীহ মুসলিম: ২৫০৩
হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
ومما احتج به من لم يكفرهم قوله في ثالث أحاديث الباب بعد وصفهم بالمروق من الدين كمروق السهم فينظر الرامي إلى سهمه إلى أن قال فيتمارى في الفوقة هل علق بها شيء قال ابن بطال ذهب جمهور العلماء إلى أن الخوارج غير خارجين عن جملة المسلمين لقوله يتمارى في الفوق لأن التماري من الشك وإذ وقع الشك في ذلك لم يقطع عليهم بالخروج من الإسلام لأن من ثبت له عقد الإسلام بيقين لم يخرج منه إلا بيقين قال وقد سئل علي عن أهل النهروان هل كفروا؟ فقال من الكفر فروا. فتح الباري لابن حجر (12/ 300-301)
“যারা খারেজিদের তাকফীর করেন না, তাদের আরেকটি দলিল হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী, ‘এরপর নিক্ষেপকারী তীরের গোড়ার খাঁজ, যেটি রশিতে লাগিয়ে তীর তাক করা হয়, সেটি দেখে সন্দেহে পড়ে যায় যে, এতে একটু কিছু লাগলো না’কি?’
ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন, অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মত হলো, খারেজিরা মুসলিম সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কৃত নয়। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে, নিক্ষেপকারী তীরের গোড়ার খাঁজ দেখে সংশয়ে পতিত হবে। যেহেতু সংশয় হয়ে গেছে, তাই তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ, যার ব্যাপারে নিশ্চিত জানা আছে, সে মুসলমান; (এর বিপরীতে কুফরির) নিশ্চয়তা ছাড়া সে ইসলাম থেকে বের হবে না। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নাহরাওয়ানবাসী (অর্থাৎ তিনি যেসব খারজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হত্যা করেছিলেন, তাদের) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, এরা কি কাফের হয়ে গেছে? তিনি উত্তর দেন, (না!) কুফর থেকে তারা পলায়ন করেছে।” -ফাতহুল বারি: ১২/৩০০-৩০১
তিন. তাছাড়া খারেজিদের প্রথম ফিরকার উদ্ভব হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের যামানায়। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম তাদের তাকফির করেননি। এমনকি খোদ আলী রাদি.ও তাদের তাকফীর করেননি; অথচ খারেজিরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, তাঁকেসহ অনেক সাহাবিকে কাফের আখ্যায়িত করে তাঁদের সঙ্গে কিতাল করেছে এবং শেষে আলী রাদি.কে তারা শহীদও করেছে-
ইবনে আবি শায়বা রহ. (২৩৫ হি.) বর্ণনা করেন,
عن طارق بن شهاب، قال : كنت عند علي، فسئل عن أهل النهر أمشركون هم؟ قال : من الشرك فروا، قيل : فمنافقون هم؟ قال : إن المنافقين لا يذكرون الله إلا قليلا، قيل له : فما هم، قال : قوم بغوا علينا. -مصنف ابن أبي شيبة: 39097، قال الشيخ الأرنؤوط في تخريج العواصم والقواصم (3\288): وهذا سند صحيح على شرط مسلم. اهـ
“তারিক বিন শিহাব রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আলী রাদি.-র কাছে উপস্থিত ছিলাম। তখন নাহরাওয়ানবাসী (অর্থাৎ খারেজিদের) সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কি মুশরিক? তিনি উত্তর দেন, ‘শিরক থেকে তো তারা পলায়ন করেছে’। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে কি তারা মুনাফিক? তিনি উত্তর দেন, ‘মুনাফিকরা তো আল্লাহকে কমই স্মরণ করে’। (আর এরা তো আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে) জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে তারা কেমন লোক? তিনি উত্তর দেন, ‘এমন লোক, যারা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে’।” -মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৩৯০৯৭
ইবনে আবি শায়বার অন্য বর্ণনায় এসেছে,
إخواننا بغوا علينا.
“আমাদের ভাইরা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।” -মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৩৮৯১৮
এখানে তিনি খারেজিদের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন এবং তারা যে মুশরিক কিংবা মুনাফিক নয়, তা সুস্পষ্ট করে বলেছেন।
মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকে হাসান বসরি রহ. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে,
لما قَتَلَ علي رضي الله عنه الحروريةَ، قالوا: مَن هؤلاء يا أمير المؤمنين؟ أكفارٌ هُم؟ قال:مِن الكفر فرٌّوا، قيل: فمنافقين؟ قال: إن المنافقين لا يذكرون الله إلا قليلا، وهؤلاء يذكرون الله كثيرا، قيل: فما هم؟ قال: قوم أصابتهم فتنة فعموا فيها وصموا. –مصنف عبد الرزاق: 18656
“আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন হারুরিয়্যাহ্ (অর্থাৎ খাওয়ারেজদের) হত্যা করলেন, তখন তাঁর সমর্থকরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, আমিরুল মু’মিনীন! তারা কেমন লোক? তারা কি কাফের? তিনি উত্তর দিলেন, ‘কুফর থেকে তো তারা পলায়ন করেছে’। জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে কি তারা মুনাফিক? তিনি উত্তর দিলেন, ‘মুনাফিকরা তো আল্লাহকে কমই স্মরণ করে। আর এরা তো আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে’। জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে তারা কেমন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা ফেতনায় নিপতিত হয়ে অন্ধ ও বধির হয়ে গেছে’।” -মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক: ১৮৬৫৬
ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮হি.) বলেন,
فأما من كان في قلبه الإيمان بالرسول وما جاء به وقد غلط في بعض ما تأوله من البدع فهذا ليس بكافر أصلا والخوارج كانوا من أظهر الناس بدعة وقتالا للأمة وتكفيرا لها ولم يكن في الصحابة من يكفرهم لا علي بن أبي طالب ولا غيره بل حكموا فيهم بحكمهم في المسلمين الظالمين المعتدين. –مجموع الفتاوى (7/ 217-218)
“যার অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর আনীত শরীয়তের প্রতি ঈমান আছে, ভুল তা’বিল করে কোনো বিদআতে লিপ্ত হয়ে গেলে সে মোটেও কাফের নয়। খারেজিরা সবচেয়ে বড় ধরনের বিদআতে লিপ্ত ছিল। উম্মাহর বিরুদ্ধে কিতাল করতো। উম্মাহকে তাকফির করতো। এতদসত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরামের কেউ তাদের তাকফির করতেন না। আলী রাদি.ও না, অন্য কেউও না। বরং অন্য দশজন সীমালংঘনকারী জালেম মুসলিমের যে বিধান সে বিধানই তাদের ওপর আরোপ করতেন।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ৭/২১৭-২১৮
তিনি আরও বলেন,
وأصحاب الرسول – صلى الله عليه وسلم – علي بن أبي طالب وغيره لم يكفروا الخوارج الذين قاتلوهم، بل أول ما خرجوا عليه وتحيزوا بحروراء، وخرجوا عن الطاعة والجماعة، قال لهم علي بن أبي طالب رضي الله عنه: إن لكم علينا أن لا نمنعكم مساجدنا ولا حقكم من الفيء. ثم أرسل إليهم ابن عباس فناظرهم فرجع نحو نصفهم، ثم قاتل الباقي وغلبهم، ومع هذا لم يسب لهم ذرية، ولا غنم لهم مالا، ولا سار فيهم سيرة الصحابة في المرتدين، كمسيلمة الكذاب وأمثاله، بل كانت سيرة علي والصحابة في الخوارج مخالفة لسيرة الصحابة في أهل الردة، ولم ينكر أحد على علي ذلك، فعلم اتفاق الصحابة على أنهم لم يكونوا مرتدين عن دين الإسلام.
قال الإمام محمد بن نصر المروزي : ” وقد ولي علي رضي الله عنه قتال أهل البغي، وروى عن النبي – صلى الله عليه وسلم – فيهم ما روى، وسماهم مؤمنين، وحكم فيهم بأحكام المؤمنين. وكذلك عمار بن ياسر “. منهاج السنة النبوية (5/ 241)
“আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইকারী খারেজিদের তাকফীর করতেন না। বরং সর্বপ্রথম যখন তারা আলী রাদি.র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, হারুরায় ঘাঁটি গাড়ে এবং (ইমামের) আনুগত্য ও মুসলিম জামাত পরিত্যাগ করে; আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন তাদের বলেছেন,‘আমাদের যিম্মায় তোমাদের প্রাপ্য অধিকার হলো, আমরা তোমাদেরকে আমাদের মসজিদে আসতে বাধা দেব না এবং গনিমতের সম্পদে তোমাদের যে অধিকার আছে তা থেকে তোমাদের বঞ্চিত করব না’। এরপর তিনি তাদের কাছে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের সাথে আলোচনা পর্যালোচনা করেন, ফলে তাদের অর্ধেকের মতো লোক ফিরে আসে। অন্যদের বিরুদ্ধে তিনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন এবং বিজয় লাভ করেন। বিজয়ী হলেও তিনি তাদের নারী-শিশুদের বন্দী করেননি, তাদের সম্পদকে গনিমত হিসেবে গ্রহণ করেননি। সাহাবায়ে কেরাম মুসায়লামা কাযযাব ও অন্যান্য মুরতাদের সাথে যেমন আচরণ করেছেন, তিনি তাদের সাথে তেমন আচরণও করেননি। বরং খারেজিদের ব্যাপারে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবাদের আচরণ মুরতাদদের সাথে কৃত সাহাবাদের আচরণের বিপরীত। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই কাজে কেউ আপত্তি করেনি। অতএব, সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্য পাওয়া গেল যে, খারেজিরা মুরতাদ তথা দ্বীন ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত নয়।
ইমাম মুহাম্মদ ইবনু নাসর আলমারওয়াযী রহ. বলেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং তাদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা কিছু হাদিস বর্ণনা করার করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে মুসলমান গণ্য করেন এবং তাদের সাথে মুসলমান হিসেবেই আচরণ করেন। আম্মার বিন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহুও একই আচরণ করেন।” -মিনহাজুস সুন্নাহ: ৫/২৪১
তিনি আরও বলেন,
ومما يدل على أن الصحابة لم يكفروا الخوارج أنهم كانوا يصلون خلفهم، وكان عبد الله بن عمر رضي الله عنه وغيره من الصحابة (2) يصلون (3) خلف نجدة الحروري، وكانوا أيضا يحدثونهم ويفتونهم ويخاطبونهم، كما يخاطب المسلم المسلم، كما كان عبد الله بن عباس يجيب نجدة الحروري لما أرسل إليه يسأله عن مسائل، وحديثه في البخاري (4) . وكما أجاب نافع بن الأزرق عن مسائل مشهورة (5) ، وكان نافع يناظره في أشياء بالقرآن، كما يتناظر المسلمان.
وما زالت سيرة المسلمين على هذا، ما جعلوهم مرتدين كالذين قاتلهم الصديق رضي الله عنه. هذا مع أمر رسول الله – صلى الله عليه وسلم – بقتالهم (1) في الأحاديث الصحيحة، …. ومع هذا فالصحابة رضي الله عنهم والتابعون لهم بإحسان لم يكفروهم، ولا جعلوهم مرتدين، ولا اعتدوا عليهم بقول ولا فعل، بل اتقوا الله فيهم، وساروا فيهم السيرة العادلة. منهاج السنة النبوية (5/ 247)
“সাহাবায়ে কেরাম যে খারেজিদের কাফের মনে করতেন না, এর আরও একটি দলিল হলো, তারা খারেজিদের পেছনে নামায পড়তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নাজদাহ আলহারুরী (খারেজি)-র পেছনে নামায আদায় করতেন। এমনিভাবে তারা খারেজিদের হাদীস শুনাতেন, ফতোয়া প্রদান করতেন এবং তাদেরকে একজন মুসলামান যেমন আরেক মুসলমানকে সম্বোধন করে সেভাবে সম্বোধন করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু নাজদা আলহারুরীর পাঠানো প্রশ্নাবলীল জবাব দিতেন। এ হাদীস বুখারিতে আছে। (খারেজি) নাফে’ ইবুনল আযরাকেরও প্রসিদ্ধ কিছু প্রশ্নের তিনি জবাব দিয়েছেন। দু’জন মুসলিম যেমন পরস্পর মুনাযারা করে, (খারেজি) নাফে’য়ের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে ইবনে আব্বাস রাদি. কুরআন দিয়ে মুনাযারা করতেন। খারেজিদের সাথে মুসলমানদের আচরণ সর্বদা এমনই ছিল। আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাদের মতো খারেজিদের তারা মুরতাদ মনে করতেন না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহীহ হাদীসসমূহে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ তাদেরকে তাকফীর করেননি। মুরতাদ আখ্যা দেননি। কথায় কাজে তাদের ওপর কোনো সীমালংঘন করেননি। বরং তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলেছেন এবং তাদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করেছেন।” -মিনহাজুস সুন্নাহ: ৫/২৪৭
বুঝা গেল, খারেজিরা ভ্রান্ত একটি ফিরকা। মুসলিমদের জান মাল ও ইজ্জত আব্রু রক্ষায় তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা হবে। কিন্তু অন্য কোনো সুস্পষ্ট কুফর না পাওয়া গেলে তাদের তাকফির করা হবে না।
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
১৬-০৮-১৪৪২ হি.
৩১-০৩-২০২১ ইং