প্রবন্ধ-নিবন্ধ
Trending

রাসূল ﷺ এর আবির্ভাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

 রাসূল ﷺ এর আবির্ভাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

রাসূল এর আবির্ভাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

রচনা

মাওলানা উযায়ের আহমদ হাফিযাহুল্লাহ

সূচিপত্র

এক. দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে তাওহীদের প্রসার এবং কুফর-শিরক নির্মূল. 2

দুই. ইসলামকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করা.. 11

তিন. ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং মানবজাতিকে সকল বাতিল ধর্ম ও মানবরচিত তন্ত্রমন্ত্রের জুলুম-অত্যাচার থেকে উদ্ধার করে শরীয়তের ছায়াতলে নিয়ে আসা.. 14

চার. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা.. 19

পাঁচ. মূর্তি ভাঙ্গা এবং মাজারসহ কুফর-শিরকের সকল নিদর্শন বিনাশ করা.. 19

ছয়. কুরআন শোনানো… 25

সাত. কুরআন শিক্ষা দেয়া.. 25

আট. হিকমত বা হাদীস শিক্ষা দেয়া.. 25

নয়. আত্মশুদ্ধি ও উত্তম চরিত্র গঠন. 25

 

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ

দীর্ঘদিন যাবৎ দ্বীনের আংশিক বুঝ এবং খণ্ডিত দ্বীন চর্চার ফলে আমরা বরাবরই শুনে থাকি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবীরূপে প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো চারটি, তিলাওয়াতে কুরআন, কুরআন-সুন্নাহ শিক্ষাদান এবং তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি।

অথচ বাস্তবে রাসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য শুধু এই চারটি বিষয় নয়। নবীজীকে প্রেরণের আরও কিছু উদ্দেশ্যর কথা কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে, যা গুরুত্বের বিবেচনায় কোনো অংশেই উল্লেখিত চারটি থেকে কম নয়। এবিষয়গুলো বিস্মৃতপ্রায় হওয়ার কারণে আমরা পদে পদে ভুলভ্রান্তি ও গোমরাহীর শিকার হচ্ছি। এমনকি কোনো কোনো আলেমের জবানেও এমন বক্তব্য শোনা যাচ্ছে যা নবীজীর রিসালাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপন্থী। অথচ নবীর ওয়ারিশ হিসেবে নবীজীর মিশনের পূর্ণতা সাধনে আলেমদেরই নেতৃত্ব দেয়ার কথা।

তাই আমরা এ প্রবন্ধে নবীজীকে প্রেরণের সবগুলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। আশা করি এর মাধ্যমে আমরা নবীজীর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করবো।

এক. দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে তাওহীদের প্রসার এবং কুফর-শিরক নির্মূল

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ. –النحل: 36

“নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মতের ভেতর কোনও না কোনও রাসূল পাঠিয়েছি এই পথনির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে পরিহার কর।” –সূরা আন-নাহল ১৬:৩৬

আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ (৭৭৪ জি.) বলেন,

بعث في كل أمة رسولا أي: في كل قرن من الناس وطائفة رسولا وكلهم يدعو إلى عبادة الله، وينهى عن عبادة ما سواه. -تفسير ابن كثير (4/ 570)

“অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতি ও জনগোষ্ঠীর মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা সবাই আল্লাহ তাআলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন এবং গায়রুল্লাহর ইবাদত থেকে বারণ করেছেন। -তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৪/৫৭০

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِله فَإِنِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ. –البقرة: 193

“তোমরা তাদের সঙ্গে কিতাল করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন আল্লাহর হয়ে যায়। অতঃপর তারা যদি ক্ষান্ত হয়, তবে (জেনে রাখো) জালিম ছাড়া অন্য কারও প্রতি কঠোরতা করার অবকাশ নেই।” –সূরা বাকারা ০২: ১৯৩

আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ বলেন,

[حتى لا تكون فتنة] أي: شرك. قاله ابن عباس، وأبو العالية، ومجاهد، والحسن، وقتادة، والربيع، ومقاتل بن حيان، والسدي، وزيد بن أسلم.

[ويكون الدين لله] أي: يكون دين الله هو الظاهر العالي على سائر الأديان. -تفسير ابن كثير (1/ 525)

“যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় অর্থাৎ শিরক নির্মূল হয়। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু, আবুল আলিয়া, মুজাহিদ, হাসান বসরী, কাতাদাহ, রবী বিন আনাস, মুকাতিল বিন হাইয়ান, সুদ্দী ও যায়েদ বিন আসলাম রহিমাহুমুল্লাহ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন।

‘দ্বীন আল্লাহর হয়ে যায়।’ অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন সকল ধর্মের উপর বিজয়ী হয়।” -তাফসীরে ইবনে কাসীর: ১/৫২৫

হাদীসে এসেছে,

عن ابن عمر، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «أمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله، وأن محمدا رسول الله، ويقيموا الصلاة، ويؤتوا الزكاة، فإذا فعلوا ذلك عصموا مني دماءهم وأموالهم إلا بحق الإسلام، وحسابهم على الله. -صحيح البخاري (25) صحيح مسلم(22)

“ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়। তারা যদি এ কাজগুলো করে, তবে আমার পক্ষ থেকে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি (শাস্তির) কোনো কারণ থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহ্‌র ওপর ন্যস্ত।” -সহীহ বুখারী: ২৫; সহীহ মুসলিম: ২২

ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহিমাহুল্লাহু (৭৯৫ হি.) বলেন,

وكان صلى الله عليه وسلم إنما يقاتل على دخول الناس في التوحيد كما قال: أمرت أن أقاتل الناس حتى يقولوا لا إله إلا الله. الحكم الجديرة بالإذاعة من قول النبي صلى الله عليه وسلم بعثت بالسيف بين يدي الساعة (ص: 22)

“নবীজী মানুষকে তাওহীদে দাখিল করার জন্যই যুদ্ধ করতেন। যেমনটা তিনি বলেছেন, ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আদিষ্ট হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।’ -আল-হিকামুল জাদীরাহ বিল-ইযাআহ, পৃ: ২২

অপর হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,

حدثنا محمد بن يزيد يعني الواسطي، أخبرنا ابن ثوبان، عن حسان بن عطية، عن أبي منيب الجرشي، عن ابن عمر قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «بعثت بالسيف حتى يعبد الله لا شريك له، وجعل رزقي تحت ظل رمحي، وجعل الذلة، والصغار على من خالف أمري، ومن تشبه بقوم فهو منهم». -مسند أحمد (5114) وقال الشيخ أحمد شاكر في تعليقه على «مسند أحمد» (4/ 515) : «إسناده صحيح». وقال الشيخ عوامة في تعليقه على «المصنف» (10/286، 287) : «وابن ثوبان» هو عبد الرحمن بن ثابت بن ثوبان. وهو صدوق يخطئ وتغير، وقال في «الفتح» (6/98 الباب 88 من كتاب الجهاد) : «مختلف في توثيقه» وهذا شأن من يحسن حديثه، … وروى أبو داود (4027) من طريق هاشم بن القاسم، الجملة الأخيرة منه. … ورواه الطحاوي في «شرح المشكل» (231) من طريق الأوزاعي، عن حسان بن عطية، وهذه متابعة قوية .. وقد ذكر ابن تيمية في «اقتضاء الصراط المستقيم» (1/269) رواية أبي داود بإسناده، وعنده -كما تقدم – الجملة الأخيرة منه، وقال: هذا إسناد جيد، وتكلم على رجاله فردا فردا، وهو رجال المصنف أيضا. وذكر هذه الجملة أيضا وعزاها إلى أبي داود: العراقي في تخريج الإحياء (1/269) وصحح سنده، وقال الحافظ في «الفتح» (10/274) : «ثبت أنه قال: من تشبه بقوم فهم منهم». وذكره الذهبي في «السير» (10/509) وقال: إسناده صالح.

“আমাকে তরবারিসহ প্রেরণ করা হয়েছে, যতক্ষণ না মানুষ শুধু আল্লাহ তাআলার ইবাদত করে। আমার রিযিক নির্ধারণ করা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে এবং আমার বিরোধীদের ‍উপর লাঞ্ছনা ও যিল্লতি আরোপ করা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি (ভিন্ন) কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে।” -মুসনাদে আহমদ: ৫১১৪

হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহু বলেন,

يعني أن الله بعثه داعيا إلى توحيده بالسيف بعد دعائه بالحجة، فمن لم يستجب إلى التوحيد بالقرآن والحجة والبيان دعي بالسيف. -الحكم الجديرة بالإذاعة (ص: 5)

“অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দলীল দ্বারা তাওহীদের দাওয়াতের পর তরবারি দ্বারা দাওয়াতের দায়িত্ব দিয়েছেন। সুতরাং যে কুরআন ও দলীল-প্রমাণের দ্বারা তাওহীদের আহ্বানে সাড়া দিবে না তাকে তরবারির জোরে দাওয়াত দেয়া হবে।” -আল-হিকামুল জাদীরাহ বিল-ইযাআহ, পৃ: ৫

এক হাদীসে নবীজী নিজের নামগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,

أنا محمد، وأنا أحمد، وأنا الماحي الذي يمحو الله بي الكفر، وأنا الحاشر الذي يحشر الناس على قدمي، وأنا العاقب.  –رواه البخاري (3532) ومسلم (2354) من حديث جبير بن مطعم، ووقع في حديث حذيفة: أنا محمد، وأحمد، ونبي الرحمة، ونبي التوبة، والحاشر، والمقفي، ونبي الملاحم. -رواه أحمد (23445) والترمذي في الشمائل المحمدية (368) وقال العرافي في تخريج أحاديث الإحياء (ص: 870) : سنده صحيح.

“আমি মুহাম্মদ, আমি আহমদ, আমি আল–মাহি (নিশ্চিহ্নকারী) আমার দ্বারা আল্লাহ কুফর ও শিরককে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আমি আল–হাশির (সমবেতকারী কিয়ামত দিবসে) আমার পেছনে লোকদের সমবেত করা হবে। আমি আল–আকিব (সর্বশেষ আগমনকারী আমার পর অন্য কোনো নবীর আগমন হবে না)। -সহীহ বুখারী: ৩৫৩২; সহীহ মুসলিম: ২৩৫৪

অপর হাদীসে নবীজী নিজেকে ‘রহমতের নবী, তাওবার নবী এবং যোদ্ধা নবী’ বলে পরিচয় দিয়েছেন।” -মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৪৫; শামায়েলে তিরমিযী: ৩৬৮

ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ (৪৫৮ হি.) বলেন,

قال الحليمي رحمه الله: وأما نبي الملحمة فلأن الله تبارك وتعالى فرض عليه جهاد الكفار وجعله شريعة باقية إلى قيام الساعة، وما فتحت هذه البلدان إلا بحد السيف أو خوف السيف، ما عدا المدينة فإنها فتحت بالقرآن. -شعب الإيمان (2/ 531)

“হালীমী রহিমাহুল্লাহ বলেন, নবীজীকে যোদ্ধা নবী নামকরণের কারণ হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর জিহাদ ফরয করেছেন এবং একে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী বিধান সাব্যস্ত করেছেন। (বর্তমানে মুসলিমদের অধীন) এই দেশগুলো তো তরবারির জোরেই বিজয়ী হয়েছে। শুধু মদীনা বাদে, তা কুরআনের দাওয়াতে বিজয়ী হয়েছে।” -শুআবুল ঈমান: ২/৫৩১

ইসলামের স্বর্ণযুগে সাহাবা-তাবেয়ীদের বিজয়াভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এটাই ছিল। নাহাওয়ান্দ যুদ্ধের দিন পারস্য সেনাপতির পক্ষ থেকে একজন দোভাষী মুসলিমদের জিজ্ঞাসা করলো তোমরা কারা? উত্তরে মুগীরা বিন শোবা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন,

نحن أناس من العرب، كنا في شقاء شديد وبلاء شديد، نمص الجلد والنوى من الجوع، ونلبس الوبر والشعر، ونعبد الشجر والحجر، فبينا نحن كذلك إذ بعث رب السموات ورب الأرضين – تعالى ذكره وجلت عظمته – إلينا نبيا من أنفسنا نعرف أباه وأمه، أمرنا نبينا رسول ربنا صلى الله عليه وسلم أن نقاتلكم حتى تعبدوا الله وحده، أو تؤدوا الجزية. وأخبرنا نبينا صلى الله عليه وسلم عن رسالة ربنا، أنه من قتل منا صار إلى الجنة في نعيم لم ير مثلها قط، ومن بقي منا ملك رقابكم. -صحيح البخاري (4/ 97  رقم: 3159   ط. دار طوق النجاة)

“আমরা আরবের লোক। দীর্ঘ দিন আমরা অতিশয় দুর্ভাগ্য (কুফরীতে) এবং কঠিন বিপদে (দারিদ্র্যে) ছিলাম। ক্ষুধার তাড়নায় আমরা চামড়া ও খেজুরের বিচি চুষতাম। চুল ও পশম পরিধান করতাম। বৃক্ষ ও পাথর পূজা করতাম। আমরা যখন এ অবস্থায় ছিলাম তখন আসমান ও জমিনের প্রতিপালক আমাদের মধ্য থেকে একজন নবী প্রেরণ করেন। তাঁর পিতা–মাতাকে আমরা চিনি। আমাদের নবী, আমাদের রবের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন, তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করবে কিংবা জিযিয়া প্রদান করবে এবং আমাদের নবী তাঁর রবের পক্ষ হতে আমাদের জানিয়েছেন, আমাদের যারা (তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে) শহীদ হবে, তারা জান্নাতে এমন নেয়ামত ভোগ করবে, যা কেউ কখনো দেখেনি। আর যারা জীবিত থাকবে, তারা তোমাদের গর্দানের মালিক হয়ে যাবে।” –সহীহ বুখারী: ৪/৯৭ হাদীস: ৩১৫৯ (দারু তাওকিন নাজাহ)

কাদেসিয়ার যুদ্ধের পূর্বে পারস্যের সেনাপতি রুস্তম মুসলিম বাহিনীর দূত রিবয়ী বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করে তোমরা কেন এসেছো? তখন রিবয়ী বিন আমের বলেন,

الله ابتعثنا، والله جاء بنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام، تاريخ الطبري (3/ 520 ط. دار التراث)

“আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উত্থিত করেছেন, যেন আল্লাহ তাআলা যাদেরকে চান তাদেরকে সৃষ্টির গোলামি থেকে মুক্ত করে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের দিকে, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে এবং সকল ধর্মের অবিচার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের ইনসাফের দিকে নিয়ে যান।” –তারীখে তাবারী: ৩/৫২০

উকবা বিন নাফে রহিমাহুল্লাহ (৬৩ হি.) যখন পুরো উত্তর আফ্রিকা বিজয় করে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে পৌঁছেন তখন তিনি ঘোড়াকে সমুদ্রে নামিয়ে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে দেন এবং বলেন,

اللهم اشهد أني قد بلغت المجهود، ولولا هذا البحر لمضيت في البلاد أقاتل من كفر بك، حتى لا يعبد أحدٌ من دونك .-رياض النفوس في طبقات علماء القيروان وإفريقية (1/39 ط. دار الغرب الإسلامي) ومثله في فتوح مصر والمغرب (ص:    226 ط. مكتبة الثقافة الدينية) والكامل (3/206 ط. دار الكتاب العربي) والروض المعطار في خبر الأقطار (ص: 142 ط. مؤسسة ناصر )

“হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি সাধ্যের সবটুকু করেছি। যদি এ সাগর প্রতিবন্ধক না হতো তাহলে আমি কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে যেতাম যতক্ষণ না আপনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত বন্ধ না হয়।” –রিয়াযুন নুফুস, আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আল-মালেকী: ১/৩৯ (দারুল গরবিল ইসলামী) ফুতুহু মিসর ওয়াল মাগরিব, ইবনে আব্দুল হাকাম, পৃ: ২২৬ (মাকতাবাতুস সাকাফাহ); আল-কামিল, ইবনে আসীর: ৩/২০৬ (দারুল কিতাবিল আরাবী); আর-রাওযুল মিতার, মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল-হিময়ারী, পৃ: ১৪২ (মুআসসাসাতু নাসের)

সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহর বিশিষ্ট সভাসদ ও তাঁর জীবনীকার কাজী বাহাউদ্দিন ইবনে শাদ্দাদ রহিমাহুল্লাহু একদিন সালাহুদ্দিন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহর সাথে সমুদ্র পাড়ে ছিলেন। তখন সুলতান তাঁকে বলেন,

أما أحكي لك شيئاً في نفسي أنه متى يسر الله تعالى فتح بقية الساحل قسمت البلاد وأوصيت وودعت وركبت هذا البحر إلى جزائره واتبعتهم فيها حتى لا أبقي على وجه الأرض من يكفر بالله أو أموت. –النوادر السلطانية والمحاسن اليوسفية (ص: 55)

“আমি কি তোমাকে আমার মনের একটি কথা বলবো না? (আমার মন চায়) আল্লাহ তাআলা সমুদ্র উপকূলবর্তী শহরগুলো জয় করার তাওফীক দিলে আমি (আমার অধীন) দেশগুলো (যোগ্য আমীরদের মাঝে) বণ্টন করে দিবো এবং তাদেরকে (তাকওয়া, ইনসাফ ইত্যাদির) অসিয়ত করে বিদায় জানাবো। এরপর আমি এ সাগরে আরোহণ করে এর দ্বীপসমূহে যাবো এবং তাতে বসবাসবকারী কাফেরদের পিছু ধাওয়া করবো যতক্ষণ না ভুপৃষ্ঠে কোনো কাফের বাকি না থাকে কিংবা আমি মৃত্যুবরণ করি।” -আন-নাওয়াদিরুস সুলতানিয়্যাহ, পৃ: ৫৫

দুই. ইসলামকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করা

আল্লাহ তাআলা বলেন,

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ. –التوبة: 33، الفتح: 28، الصف: 9

“তিনিই তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, অন্য সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করার জন্য।” –সূরা তাওবা ০৯: ৩৩; সূরা ফাতহ ৪৮: ২৮; সূরা সফ ৬১: ০৯

বলা বাহুল্য সকল ধর্মের উপর ইসলামের বিজয় শুধু জিহাদের মাধ্যমেই সম্ভব। এজন্যই আমরা দেখি উপর্যুক্ত আয়াতটি কুরআনের তিন জায়গায় এসেছে এবং সবখানেই আগে পরে জিহাদের কথা রয়েছে। সূরা তাওবা তো পুরোটাই জিহাদ বিষয়ে। সূরা ফাতহের অধিকাংশ আলোচনাও জিহাদ-কিতাল নিয়ে। আর সূরা সফফে উপর্যুক্ত আয়াতের পরে  ইরশাদ হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. –الصف: 10-11

“হে মুমিনগণ, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে? তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম; যদি তোমরা জান।” –সূরা সফ (৬১) : ১০-১১

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

من قاتل لتكون كلمة الله هي العليا، فهو في سبيل الله عز وجل. –صحيح البخاري (123) صحيح مسلم (1904)

“আল্লাহর দ্বীনকে বুলন্দ করার জন্য যে যুদ্ধ করে সেই আল্লাহর রাস্তায় (যুদ্ধ করলো)।” -সহীহ বুখারী: ১২৩; সহীহ মুসলিম: ১৯০৪

হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহিমাহুল্লাহ (১০০৪ হি.) বলেন,

أي: لم يقاتل لغرض من الأغراض إلا لإظهار الدين. مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح (6/ 2471)

“অর্থাৎ সে দুনিয়াবি কোনো উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করেনি। বরং দ্বীনের বিজয়ের জন্যই যুদ্ধ করেছে। -মিরকাতুল মাফাতীহ: ৬/২৪৭১ (দারুল ফিকর)

উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীসে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, জিহাদ ও কিতালের মাধ্যমেই ইলায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা দ্বীনের বিজয় হয়। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬ হি.) বলেন,

اعلم أن النبي صلى الله عليه وسلم بعث بالخلافة العامة، وغلبة دينه على سائر الأديان لا يتحقق إلا بالجهاد وإعداد آلاته، فإذا تركوا الجهاد، واتبعوا أذناب البقر أحاط بهم الذل؛ وغلب عليهم أهل سائر الأديان. -حجة الله البالغة (2/ 268)

“জেনে রাখো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বজগতের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আর সকল ধর্মের উপর নবীজীর ধর্মের বিজয় জিহাদ ও জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব। যখন মুসলিম উম্মাহ জিহাদ ছেড়ে গরুর লেজের পেছনে পড়ে থাকবে (অর্থাৎ চাষাবাদ ও দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে) তখন লাঞ্ছনা ও যিল্লতি তাদের বেষ্টন করে নিবে এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরা তাদের উপর বিজয়ী হয়ে যাবে (ফলে তারা নবীজীর প্রেরণের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারবে না এবং বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে মানবজাতিকে মুক্তির দিশা ও সঠিক পথ দেখানোর যোগ্যতা হারাবে)।” -হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা: ২/২৬৮

তিন. ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং মানবজাতিকে সকল বাতিল ধর্ম ও মানবরচিত তন্ত্রমন্ত্রের জুলুমঅত্যাচার থেকে উদ্ধার করে শরীয়তের ছায়াতলে নিয়ে আসা

আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ. –الحديد: 25

“আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সঙ্গে কিতাবও নাযিল করেছি এবং মীযানও, যাতে মানুষ ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং আমি অবতীর্ণ করেছি লোহা, যার ভেতর রয়েছে রণশক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। এটা এই জন্য যে, আল্লাহ জানতে চান, কে তাকে না দেখে তাঁর (দ্বীনের) সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিমান ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক।” -সূরা হাদীদ ৫৭: ২৫

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমামাহুল্লাহ (৭২৮ হি.) বলেন,

قال الله تعالى: {لقد أرسلنا رسلنا بالبينات وأنزلنا معهم الكتاب والميزان ليقوم الناس بالقسط} فالمقصود من إرسال الرسل وإنزال الكتب أن يقوم الناس بالقسط في حقوق الله وحقوق خلقه. ثم قال تعالى: {وأنزلنا الحديد فيه بأس شديد ومنافع للناس وليعلم الله من ينصره ورسله بالغيب} . فمن عدل عن الكتاب قوم بالحديد؛ ولهذا كان قوام الدين بالمصحف والسيف. وقد روي {عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما قال: أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نضرب بهذا – يعني السيف – من عدل عن هذا – يعني المصحف}. –مجموع الفتاوى (28/264)

“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলিসহ পাঠিয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে কিতাবও নাযিল করেছি এবং মীযানও, যাতে মানুষ ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।’ সুতরাং রাসূলদের প্রেরণ ও আসমানি কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করার উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন আল্লাহর হক ও বান্দার হকের ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েম করে। এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি অবতীর্ণ করেছি লোহা, যার ভেতর রয়েছে রণশক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ।’ অতএব যে কুরআন থেকে বিচ্যুত হবে তাকে তরবারি দিয়ে সংশোধন করা হবে। একারণেই দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হলো কুরআন ও তরবারি। জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে কুরআন থেকে বিচ্যুত হবে তাকে তরবারি দ্বারা আঘাত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।”  -মাজমুউল ফাতাওয়া:  ২৮/২৬৪

ইতোপূর্বে আমরা রুস্তমের সাথে রিবয়ী বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহুর কথোপকথন দেখেছি, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের আগমণের উদ্দেশ্য মানুষকে সকল ধর্মের অবিচার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের ইনসাফের ছায়াতলে নিসে আসা।’

রিবয়ী রাযিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্যের এ অংশ উদ্ধৃত করে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহিমাহুল্লাহু বলেন,

ولا تزال في هذا العصر المتنور الواعي المثقف أديان تعبث بعقول الناس وتسخرهم كالحمير والبقر، وتزين لأتباعها قتل مئات من البشر لأجل بقرة ذبحت في عيد الأضحى، أو شجرة مقدسة عُضدت في قرية من القرى. وهنالك أديان بغير اسم الأديان لا تقل في نفوذها وسلطانها ولا تقل في جورها وعدوانها وعبثها بعقول أتباعها وفي عجائبها عن الأديان القديمة، وهي النظم السياسية والنظريات الاقتصادية التي يؤمن بها الناس كدين ورسالة، كالجنسية والوطنية، الديموقراطية والاشتراكية والدكتاتورية والشيوعية. –ماذا خسر العالم بانحطاط المسلمين (ص: 233)

“শিক্ষা-সংস্কৃতির অগ্রগতি এবং আধুনিকতা ও প্রগতির এ যুগেও এমন অনেক ধর্মের দেখা মেলে যেসব ধর্ম মানুষের আকল-বুদ্ধি নিয়ে তামাশা করে এবং তাদেরকে গাধা-গরুর মতো বশ করে। যেসব ধর্ম শুধু কুরবানী ঈদে একটি গরু জবাইয়ের কারণে কিংবা কোনো গ্রামে একটি পবিত্র বৃক্ষ কর্তনের দায়ে তার অনুসারীদেরকে শত শত মানুষকে হত্যার বৈধতা দিয়ে দেয়। এছাড়াও বর্তমানে এমন কিছু ধর্ম আছে যা ধর্ম নামে প্রসিদ্ধ না হলেও কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার দিক দিয়ে ধর্মের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এবং জুলুম-অত্যাচার, অনুসারীদের আকল-বুদ্ধি নিয়ে খেলা করা ও আশ্চর্যজনক বিষয়াদির বিবেচনায়ও প্রাচীন ধর্মগুলো থেকে ব্যতিক্রম নয়। সেগুলো এমন কিছু রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক দর্শন মানুষ ধর্মের মতোই যেগুলো বিশ্বাস করে, যেমন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি।” -মা যা খাসিরুল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমিন, পৃ: ২৩৩

আল্লামা তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,

إن الإسلام ليس مجموعة من العقائد والعبادات فقط، شأنَ غيره من الأديان، وإنما هو حكم الله في جميع شؤون الحياة، ودعوته دعوة انقلابية، لا إلى العقائد فقط، بل وإلى إقامة العدل الذي شرعه الله لعباده في الأرض، ومن أهدافه: إخلاء العالم من الظلم والجور والفساد، وإقامة العدل في الأرض بتحكيم شريعة الله فيها. وإن الإسلام غاية ما يتحمل عن الكفار أن يبقوا على عقيدتهم إن أصروا على ذلك، ولكنه لا يرضى أبدا أن يستعبدوا عباد الله بتحكيم قوانينهم المنبثقة عن آراءهم وأهواءهم الفاسدة، التي تستبيح الظلم والجور، أو تشيع الخلاعة والفحشاء، أو تفسد طباع الناس، وتسد مسامعهم عن قبول الحق والرشاد. فلذلك جعل الإسلام هدف جهاد الابتداء أحد الأمرين: إما أن تعتنق البلاد الكافرة الإسلام، وإما أن يؤدوا الجزية، وحينئذ يتركون على عقيدتهم، ولكنهم لا يتركون لينفذوا في الأرض قوانينهم على عباد الله. وإنما تكون الأرض تابعة لحكم الله وأحكام الإسلام، ثم يترك الكفار وما يدينون في حياتهم الانفرادية….

وإن هذا الهدف هو الذي بينه سبحانه وتعالى في قوله جل وعلا: [وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ]. ويقول الإمام ابن جرير الطبري في تفسير هذه الآية (13/537) : “فقاتلوهم حتى لا يكون شرك، ولا يعبد إلا الله وحده لا شريك له، فيرتفع البلاء عن عباد الله من الأرض، وهو الفتنة.” وهذا الهدف هو الذي باح به ربعي بن عامر رضي الله أمام رستم ….». –تكملة فتح الملهم (3/11-12 ط. دار إحياء التراث)

“অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলাম শুধু আকীদা ও ইবাদতের সমষ্টি নয়। বরং ইসলাম হলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন। ইসলামের দাওয়াত বৈপ্লবিক দাওয়াত। তা শুধু আকীদা সংশোধনেরই দাওয়াত দেয় না। বরং আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে তাঁর বান্দাদের যে ইনসাফ ও ন্যায়ের বিধান দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করারও দাওয়াত দেয়। ইসলামের লক্ষ্য বিশ্বকে জুলুম, অত্যাচার ও অশান্তি থেকে মুক্ত করা এবং পৃথিবীতে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। ইসলাম কাফেরদের বেশি থেকে বেশি এতটুকু ছাড় দিবে তারা চাইলে নিজ আকীদা-বিশ্বাসে বাকি থাকবে। কিন্তু ইসলাম এটা মানবে না যে, তারা নিজেদের মনগড়া আইনে আল্লাহর বান্দাদের গোলাম বানিয়ে রাখবে, যে আইন জুলুম-অত্যাচারের বৈধতা দেয় কিংবা অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার প্রসার করে অথবা মানুষের ফিতরত ও স্বভাব নষ্ট করে এবং হক ও সঠিক ধর্ম গ্রহণে অন্তরায় হয়। একারণে ইসলাম আক্রমণাত্মক জিহাদের দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, হয় কাফের রাষ্ট্রগুলো ইসলাম গ্রহণ করে নিবে কিংবা জিযিয়া প্রদান করবে। তখন তাদেরকে তাদের আকীদা-বিশ্বাসের ‍উপর ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু (জিযিয়া প্রদানের ক্ষেত্রেও) আল্লাহর বান্দাদের উপর তাদের আইন প্রয়োগের সুযোগ দেয়া হবে না। বরং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন এবং ইসলামী শরীয়তই চলবে। কাফেরদের শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুযোগ দেয়া হবে।

এ উদ্দেশ্যেরই বিবরণ এসেছে আল্লাহ তাআলার এই বাণীতে “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাকো, যতক্ষণ না যাবতীয় ফিতনার অবসান হয় এবং দ্বীন পূর্ণাঙ্গরূপে আল্লাহর হয়ে যায়। অতঃপর তারা যদি নিবৃত্ত হয়, তবে আল্লাহ তো তাদের কার্যাবলি সম্যক দেখছেন।” [সূরা আনফাল ০৮:৩৯]

আয়াতের তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী রহিমাহুল্লাহু বলেন, “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না শিরক নির্মূল হয় এবং শুধু আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা হয় তার সাথে কাউকে শরীক করা ব্যতীত, তখন পৃথিবীতে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট ও বিপদ দূর হবে। আয়াতে ফিতনা দ্বারা এই কষ্ট ক্লেশই উদ্দেশ্য। [তাফসীরে তাবারী: ১৩/৫৩৭] এবং এ উদ্দেশ্যের কথাই রিবয়ী বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু রুস্তমের সামনে ঘোষণা করেছিলেন।” … -তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম: ৩/১১-১২ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস)

চার. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা

পাঁচ. মূর্তি ভাঙ্গা এবং মাজারসহ কুফর-শিরকের সকল নিদর্শন বিনাশ করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أرسلني بصلة الأرحام، وكسر الأوثان. –صحيح مسلم: 832

“আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও মূর্তি ভাঙ্গার আদেশ দিয়ে।” -সহীহ মুসলিম: ৮৩২।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান এবং নবীজীর দাওয়াতের অন্যতম বিষয়বস্তু। বাদশা নাজ্জাশির দরবারে জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের প্রশ্নের জবাবে আবু সুফিয়ান নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশাবলির যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে উভয়ের আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। -সহীহ বুখারী: ৭; সহীহ মুসলিম: ১৭৭৩; সীরাতে ইবনে হিশাম: ১/৩৩৬

তেমনি মূর্তি ভাঙ্গা ও কুফর শিরকের সকল নিদর্শন বিলুপ্ত করাও নবীজীর রিসালাতের একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল নিজে কাবা শরীফে রাখা ৩৬০ মূর্তি ভাঙ্গেন। -সহীহ বুখারী: ২৪৭৮ সহীহ মুসলিম: ১৭৮০

মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তোলার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মূর্তি ভাঙ্গার জন্য দিকে দিকে বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। ইয়ামানের সবচেয়ে বড় মন্দির ‘যিল খালাসা’কে ভাঙ্গার জন্য নবীজী জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালী রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে দেড়শো ঘোড়সওয়ারের বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। -সহীহ বুখারী: ৪৩৫৬ সহীহ মুসলিম: ২৪৭৬

আবুল হাইয়াজ রহিমাহুল্লাহ বলেন,

قال لي علي بن أبي طالب: ألا أبعثك على ما بعثني عليه رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ أن لا تدع تمثالا إلا طمسته ولا قبرا مشرفا إلا سويته. -صحيح مسلم (2/ 666 رقم:  969)

“আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু (তাঁর খেলাফতকালে) আমাকে বলেন, আমি কি তোমাকে সেই কাজে পাঠাবো না যে কাজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম আমাকে পাঠিয়েছিলেন। কাজটা ছিল সব মূর্তি ধ্বংস করে ফেলা এবং সব উঁচু কবর সমান করে দেয়া।” -সহীহ মুসলিম: ৯৬৯

হাদীসের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বলেছেন, এখানে উঁচু কবর দ্বারা উদ্দেশ্য অধিক উঁচু কবর, জাহেলি যুগের লোকেরা কবরের উপরের স্থাপনা নির্মাণ করে কবরকে অনেক উঁচু করতো। নবীজী তা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। -আল-মুফহিম: ২/৬২৬ (দারু ইবনি কাসীর); ফাতহুল কাদীর: ২/১৪১ (দারুল ফিকর); মিরকাতুল মাফাতীহ: ৩/১২১৬ (দারুল ফিকর)

মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘উযযা’কে ভাঙ্গার জন্য খালিদ বিন ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে ত্রিশজন অশ্বারোহী প্রেরণ করেন। ‘লাত’কে ভাঙ্গার জন্য মুগিরাহ বিন শোবা ও আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে প্রেরণ করেন। ‘মানাত’কে ভাঙ্গার জন্য বিশজন অশ্বারোহীসহ সাদ বিন যায়েদ আশহালী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠান। ‘হুযাইল’ গোত্রের মূর্তি ভাঙ্গার জন্য প্রেরণ করেন আমর বিন আস রাযিয়াল্লাহু আনহুকে। ‘তাই’ গোত্রের মূর্তি ভাঙ্গার জন্য প্রেরণ করেন আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে। তোফায়েল বিন আমর দাউসী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে প্রেরণ করেন আমর বিন হুমামার মূর্তি ভাঙ্গার জন্য। তিনি সে মূর্তিটা ভেঙ্গে আগুনে পুড়িয়ে দেন। -আস-সুনানুল কুবরা, নাসায়ী: ১১৪৮৩ মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ১০২৫৫ তবাকাতু ইবনি সা’দ: ১/২৪৩; ২/১১০-১১২; ৪/১৮১ ৭/৩৪২ যাদুল মাআদ: ৩/৫২৩

আর রাসূল কেনই বা মূর্তি ভাঙ্গবেন না? রাসূল তো বংশ ও ধর্ম উভয় দিক দিয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের উত্তরসূরি। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কীভাবে মূর্তি ভেঙ্গেছিলেন, এ জন্য কী কী কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, এর বিস্তারিত বিবরণ কুরআনে রয়েছে। বলা বাহুল্য, এ সব কিছু কুরআন আমাদের জন্য আদর্শ হিসেবেই পেশ করেছে। -দেখুন, সুরা আম্বিয়া ২১: ৫৭-৭০ সুরা সাফফাত ৩৭: ৮৮-৯৮

নবীদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিজয়ী সাহাবী ও আমীরগণ মূর্তি ভেঙ্গেছেন। আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু সিজিস্তান বিজয় করার পর মূর্তি ভাঙ্গেন। -মুজামুল বুলদান: ২/৪৩৪

মাহমুদ গযনবী রহিমাহুল্লাহ সোমনাথের সবচেয়ে বড় মূর্তি ভাঙ্গেন। -আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া: ৬/২২৩

কিয়ামতের পূর্বে ঈসা আলাইহিস সালাম নবীজীর শরীয়তের অনুসারী ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে অবতরণ করেও ক্রশ ভাঙ্গবেন।

আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

والذي نفسي بيده، ليوشكن أن ينزل فيكم ابن مريم حكما مقسطا، فيكسر الصليب، ويقتل الخنزير، ويضع الجزية، ويفيض المال حتى لا يقبله أحد». –صحيح البخاري (2222) صحيح مسلم (155) ووقع في رواية الطبراني في المعجم الأوسط (1342) : “ويقتل الخنزير والقرد.” وقال الحافظ ابن حجر في فتح الباري (6/491) : “وإسناده لا بأس به.” وقال قبل أسطر: “قوله: “حكما” أي حاكما، والمعنى أنه ينزل حاكما بهذه الشريعة، فإن هذه الشريعة باقية لا تنسخ، بل يكون عيسى حاكما من حكام هذه الأمة. … وللطبراني من حديث عبد الله بن مغفل: “ينزل عيسى ابن مريم مصدقا بمحمد على ملته.”

“শপথ সেই সত্তার, যাঁর হাতে আমার প্রাণ। অচিরেই তোমাদের মাঝে ন্যায় বিচারক রূপে মারয়াম তনয় (ঈসা আলাইহিস সালাম) অবতরণ করবেন। তিনি ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকর হত্যা করবেন, জিযিয়ার (বিধান) রহিত করবেন এবং ধন–সম্পদের এরূপ প্রাচুর্য হবে যে, কেউ তা গ্রহণ করবে না।” -সহীহ বুখারী: ২২২২; সহীহ মুসলিম: ১৫৫

তাবারানীর বর্ণনায় এসেছে, তিনি শূকর ও বানর হত্যা করবেন। -মুজামে আওসাত: ১৩৪২; ফাতহুল বারী: ৬/৪৯১

আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহিমাহুল্লাহ (১৩৬৯ হি.) বলেন,

ولعل في قتل القرد إشارة إلى إبطال أوهام الهنود المشركين، فانهم يعظمونها، كما أن في كسر الصليب وقتل الخنزير إشعارا بهدم شعار النصارى الدينية. –فتح الملهم (1/205 ط. دار إحياء التراث)

“সম্ভবত বানর হত্যা দ্বারা মুশরিক হিন্দুদের (অবাস্তব) ধ্যান-ধারণার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা (তাদের পৌরাণিক কাহিনির ভিত্তিতে) তারা বানরকে সম্মান করে। যেমনিভাবে ক্রশ ভাঙ্গা ও শূকর হত্যার মধ্যে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় নিদর্শন বিনাশ করার ইশারা রয়েছে।” -ফাতহুল মুলহিম: ১/২০৫ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস)

ছয়. কুরআন শোনানো

সাত. কুরআন শিক্ষা দেয়া

আট. হিকমত বা হাদীস শিক্ষা দেয়া

নয়. আত্মশুদ্ধি ও উত্তম চরিত্র গঠন

আল্লাহ তাআলা বলেন,

كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ. –البقرة: 151

“(এ অনুগ্রহ ঠিক সেই রকমই) যেমন আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য হতে, যে তোমাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম দেয় এবং তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না।” -সূরা বাকারা (০২) : ১৫১

উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إن الله لم يبعثني معنتا، ولا متعنتا، ولكن بعثني معلما ميسرا. -صحيح مسلم (2/ 1104 رقم: 1478)

“আল্লাহ আমাকে কঠোরতা আরোপকারী ও হঠকারীরূপে নয় বরং সহজ পন্থায় শিক্ষাদানকারী হিসাবে প্রেরণ করেছেন।” –সহীহ মুসলিম: ১৪৭৮

অপর হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,

إنما بعثت لأتمم صالح الأخلاق. –مسند أحمد (8952) وقال الهيثمي في «مجمع الزوائد» (8/ 188) : رجاله رجال الصحيح.

“আমাকে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।” –মুসনাদে আহমদ: ৮৯৫২

উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,

حضرت ابراہیم (علیہ السلام) نے کعبے کی تعمیر کے وقت دو دعائیں کی تھیں، ایک یہ کہ ہماری نسل سے ایسی امت پیدا فرمائیے جو آپ کی مکمل فرمانبردار ہو، اور دوسری یہ کہ ان میں ایک رسول بھیجئے (دیکھئے پیچھے آیات ١٢٨۔ ١٢٩) اللہ تعالیٰ نے پہلی دعا اس طرح قبول فرمائی کہ امت محمدیہ (علی صاحبہا السلام) کو معتدل امت قرار دے کر پیدا فرمایا (دیکھئے آیت ١٤٣) اب اللہ تعالیٰ فرماتے ہیں کہ جس طرح ہم نے حضرت ابراہیم (علیہ السلام) کی دعا قبول کرتے ہوئے تم پر یہ انعام فرمایا کہ تمہیں معتدل امت بناکر آئندہ ہمیشہ کے لئے انسانیت کی رہنمائی تمہیں عطا کردی، جس کی ایک اہم علامت یہ بھی ہے کہ ہمیشہ کے لئے کعبے کو قبلہ بنادیا گیا ہے، اسی طرح ہم نے حضرت ابراہیم ( علیہ السلام) کی دوسری دعا قبول کرتے ہوئے رسول اکرم (صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم) کو تمہارے درمیان بھیج دیا ہے، جو انہی خصوصیات اور فرائض منصبی کے حامل ہیں جو حضرت ابراہیم (علیہ السلام) نے ان کے لئے مانگے تھے، ان میں سے پہلا فریضہ تلاوت آیات ہے، اس سے معلوم ہوا کہ قرآن کریم کی آیات کو تلاوت کرنا بذات خود ایک مقصد اور ایک نیکی ہے، خواہ تلاوت آیات بغیر سمجھے کی جائے، کیونکہ قرآن کے معنی کی تعلیم آگے ایک مستقل فریضے کے طور پر بیان کی گئی ہے، دوسرا مقصد قرآن کریم کی تعلیم ہے، اس سے یہ بات واضح ہوتی ہے کہ آنحضرت (صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم) کی تعلیم کے بغیر قرآن کریم کو ٹھیک ٹھیک سمجھنا ممکن نہیں ہے، اور یہ کہ صرف ترجمہ پڑھ لینے سے قرآن کریم کی صحیح سمجھ حاصل نہیں ہوسکتی کیونکہ اہل عرب عربی زبان سے خوب واقف تھے، انہیں ترجمہ سکھانے کے لئے کسی استاذ کی ضرورت نہیں تھی، تیسرے آپ کا فریضہ یہ بتایا گیا ہے کہ آپ حکمت کی تعلیم دیں، اس سے معلوم ہوا کہ حکمت و دانائی اور عقلمندی وہی ہے جو آنحضرت (صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم) نے تلقین فرمائی، اس سے نہ صرف آپ کی احادیث کا حجت ہونا معلوم ہوتا ہے بلکہ یہ بھی واضح ہوتا ہے کہ اگر آپ کا کوئی حکم کسی کو اپنی عقل کے لحاظ سے حکمت کے خلاف محسوس ہو تو اعتبار اس کی عقل کا نہیں بلکہ آنحضرت (صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم) کی سکھائی ہوئی حکمت کا ہے، چوتھا فریضہ یہ بتایا گیا ہے کہ آپ لوگوں کو پاکیزہ بنائیں اس سے مراد آپ کی عملی تربیت ہے، جس کے ذریعے آپ نے صحابہ کرام کے اخلاق اور باطنی صفات کو گندے جذبات سے پاک کرکے انہیں اعلی درجے کی خصوصیات سے آراستہ فرمایا، اس سے معلوم ہوا کہ قرآن وسنت کا صرف کتابی علم بھی انسان کی اصلاح کے لئے کافی نہیں ہے، جب تک اس نے اس علم کو اپنی زندگی میں نافذ کرنے کی عملی تربیت نہ لی ہو، آنحضرت (صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم) نے صحابہ کو اپنی صحبت سے سرفراز فرما کر ان کی تربیت فرمائی، پھر صحابہ نے تابعین کی اور تابعین نے تبع تابعین کی اسی طرح تربیت کی، اور یہ سلسلہ صدیوں سے اسی طرح چلا آتا ہے، باطنی اخلاق کی اسی تربیت کا علم علم احسان یا تزکیہ کہلاتا ہے اور تصوف بھی در حقیقت اسی علم کا نام تھا اگرچہ بعض نااہلوں نے اس میں غلط خیالات کی ملاوٹ کرکے بعض مرتبہ اسے خراب بھی کردیا ؛ لیکن اس کی اصل یہی تزکیہ ہے جس کا ذکر قرآن کریم نے یہاں فرمایا ہے، اور ہر دور میں تصوف کی اصل حقیقت کو سمجھ کر اس پر عمل کرنے والے ہمیشہ موجود رہے ہیں۔ توضيح القرآن: 1/108

“কাবা নির্মাণকালে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দুটি দোয়া করেছিলেন। এক. আমার বংশধরদের মধ্যে এমন একটি উম্মত সৃষ্টি করুন, যারা আপনার পরিপূর্ণ আনুগত্য করবে। দুই. তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করুন (দেখুন সূরা বাকারা, ০২: ১২৮-১২৯)। আল্লাহ তাআলা প্রথম দোয়াটি এভাবে কবুল করেন যে, উম্মতে মুহাম্মাদীকে একটি মধ্যপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ উম্মতরূপে সৃষ্টি করেছেন (দেখুন সূরা বাকারা ০২: ১৪৩)। এবার আল্লাহ তাআলা বলছেন, আমি যেমন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দোয়া কবুল করে তোমাদের প্রতি এই অনুগ্রহ করেছি যে, তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি এবং স্থায়ীভাবে তোমাদেরকে মানবতার পথ-প্রদর্শনের দায়িত্ব দিয়েছি, যার একটি উল্লেখযোগ্য আলামত হলো কাবাকে স্থায়ীভাবে তোমাদের কিবলা বানিয়ে দেওয়া। অনুরূপভাবে আমি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় দোয়াও কবুল করেছি, সেমতে নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি, যিনি সেই সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জন্য চেয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো আয়াত তিলাওয়াতের দায়িত্ব পালন। এর দ্বারা জানা গেল, কুরআন মাজীদের আয়াত তিলাওয়াত করাও একটি স্বতন্ত্র পুণ্যের কাজ ও কাম্য বস্তু, তা অর্থ না বুঝেই তিলাওয়াত করা হোক না কেন! কেননা কুরআন মাজীদের অর্থ শিক্ষা দানের বিষয়টি সামনে একটি পৃথক দায়িত্বরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো কুরআন মাজীদের শিক্ষা দান করার দায়িত্ব পালন। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক শিক্ষাদান ব্যতিরেকে কুরআন মাজীদ যথাযথভাবে বোঝা সম্ভব নয়। কেবল তরজমা পড়ার দ্বারা কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবন করা যেতে পারে না। আরববাসী তো আরবী ভাষা ভালোভাবেই জানত। তাদেরকে তরজমা শেখানোর জন্য কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল না। তথাপি যখন তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে কুরআনের তালীম নিতে হয়েছে, তখন অন্যদের জন্য তো কুরআন বোঝার জন্য নববী ধারার তালীম গ্রহণ আরও বেশি প্রয়োজন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তৃতীয় দায়িত্ব বলা হয়েছে ‘হিকমত’-এর শিক্ষা দান। এর দ্বারা জানা গেল যে, প্রকৃত হিকমত ও জ্ঞান সেটাই, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। এর দ্বারা কেবল তাঁর হাদীসসমূহের ‘হুজ্জত’ (প্রামাণিক মর্যাদা সম্পন্ন) হওয়াই বুঝে আসছে না; বরং আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাঁর কোনো নির্দেশ যদি কারও নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী যুক্তিসম্মত মনে না হয়, তবে সেক্ষেত্রে তার বুদ্ধি-বিবেচনাকে মাপকাঠি মনে করা হবে না; বরং মাপকাঠি ধরা হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশকেই। তাঁর চতুর্থ দায়িত্ব বলা হয়েছে এই যে, তিনি মানুষকে পরিশুদ্ধ করবেন। এর দ্বারা তাঁর বাস্তব প্রশিক্ষণ দানকে বোঝানো হয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি সাহাবায়ে কিরামের আখলাক-চরিত্র ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলিকে পঙ্কিল ভাবাবেগ ও অনুচিত চাহিদা থেকে মুক্ত করে তাদেরকে উন্নত বৈশিষ্ট্যে বিমণ্ডিত করে তোলেন। এর দ্বারা জানা গেল, মানুষের আত্মিক সংশোধনের জন্য কুরআন-সুন্নাহর কেবল পুঁথিগত বিদ্যাই যথেষ্ট নয়; বরং সে বিদ্যাকে নিজ জীবনে প্রতিফলিত করার বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ জরুরি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে নিজ সাহচর্যে রেখে তাঁদেরকে বাস্তব প্রশিক্ষণ দান করেছেন, তারপর সাহাবীগণ তাবিঈদেরকে এবং তাবিঈগণ তাবে তাবিঈনকে এভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এভাবে প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার এ ধারা শত-শত বছর ধরে চলে আসছে। অভ্যন্তরীণ আখলাক চরিত্রের এ প্রশিক্ষণ যে জ্ঞানের আলোকে দেওয়া হয় তাকে ‘ইলমুল ইহসান ও তাযকিয়া বলা হয। ‘তাসাওউফ’-ও মূলত এ জ্ঞানেরই নাম ছিল, যদিও এক শ্রেণির অযোগ্যের হাতে পড়ে এ মহান বিদ্যায় অনেক সময় ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার সংমিশ্রণ ঘটেছে, কিন্তু তাঁর মূল এই তাযকিয়া (পরিশুদ্ধকরণ)-ই, যার কথা কুরআন মাজীদের এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। বস্তুত তাসাওউফের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করার মতো লোক সব যুগেই বর্তমান ছিল, যারা সে অনুযায়ী আমল করে নিজেদের জীবনকে উৎকর্ষমণ্ডিত করেছেন এবং যথারীতি তা করে যাচ্ছেন। -তাওযীহুল কুরআন, উর্দু: ১/১০৮ ।

***

 

আরো পড়ুন লিংক-

গাযওয়ায়ে হিন্দ বিষয়ক হাদীসসমূহ: সনদ বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা

Related Articles

Back to top button