পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
প্রশ্ন:
বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারে হালাল পণ্যের ব্যবসা করার হুকুম কী?
-রাশিদুল হক
উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله، والصلاة والسلام على محمد ومن والاه، أما بعد:
সম্ভবত আপনি বর্ডারে কাস্টমস ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করার কথা বলতে চাচ্ছেন। যদি তাই হয়, তাহলে জানা দরকার, প্রচলিত ট্যাক্স অন্যায় ও জুলুম। এতে তাগুত ও জালিম শাসকগোষ্ঠী শক্তিশালী হয়।
হাদীসে এসেছে,
عن عقبة بن عامر، قال: سمعت رسول الله – صلى الله عليه وسلم – قال: “لا يدخُل الجنةَ صاحبُ مَكْسٍ”. –مسند أحمد ط الرسالة: 17294، سنن أبي داود: 2937، صحيح ابن خزيمة: 2333، منتفى ابن الجارود: 339، شرح معاني الآثار للطحاوي: 3062. قال السخاوي: صححه ابن خزيمة والحاكم.اهــــ -المقاصد الحسنة (ص: 729) وكذا صححه العيني في نخب الأفكار (8/112)
উকবা বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “ট্যাক্স গ্রহণকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” –মুসনাদে আহমাদ: ১৭৩৯৪, সুনানে আবু দাউদ: ২৯৩৭
একারণে নববী যুগে ট্যাক্স আরোপকারীকে চূড়ান্ত পর্যায়ের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হত। জনৈক নারী যিনায় লিপ্ত হওয়ার পর অনুতপ্ত হয়ে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিজের শাস্তির আবেদন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে রজমের আদেশ দেন এবং বলেন,
لقد تابت توبة لو تابها صاحب مكس لغفر له. –صحيح مسلم: 4528
“সে এমন তাওবা করেছে, যা ট্যাক্স উত্তোলনকারী করলে তাকেও ক্ষমা করে দেয়া হতো।” –সহীহ মুসলিম: ৪৫২৮
হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ (৬৭৬ হি.) বলেন,
فيه أن المكس من أقبح المعاصي والذنوب والموبقات. –شرح النووي على مسلم (11/203)
“এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, ট্যাক্স গ্রহণ নিকৃষ্টতম একটি অপরাধ ও গুনাহ এবং ধ্বংসাত্মক কাজ।” –শরহে মুসলিম: ১১/২০৩
ইমাম ইবনে হাযম রহিমাহুল্লাহ বলেন,
واتفقوا أن المراصد الموضوعة للمغارم على الطرق وعند أبواب المدن وما يؤخذ في الأسواق من المكوس على السلع المجلوبة من المارة والتجار ظلم عظيم وحرام وفسق. –مراتب الاجماع: 121
“পথ-ঘাট ও নগর দ্বারে আগমন-প্রত্যাগমনকারীদের থেকে যে চাঁদা উত্তোলন করা হয় এবং হাটে-বাজারে জনসাধারণ ও ব্যবসায়ীদের থেকে আমদানিকৃত পণ্য বাবদ যে ট্যাক্স নেয়া হয়, তা অনেক বড় জুলুম, হারাম ও ফিসক হওয়ার ব্যাপারে সকল উলামায়ে কেরাম একমত।” -মারাতিবুল ইজমা, পৃষ্ঠা: ১২১
হান্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মাতালিবু উলিন নুহা’ গ্রন্থকার বলেন,
)فرع: يحرم تعشير أموال المسلمين والكلف التي ضربها الملوك على الناس) بغير طريق شرعي (إجماعا) ، قال القاضي: لا يسوغ فيها اجتهاد. اهــــ -مطالب أولي النهى في شرح غاية المنتهى (2/ 619)
“অবৈধ পন্থায় মুসলিমদের সম্পদে ট্যাক্স আরোপ করা এবং শাসক কর্তৃক মানুষের উপর কর ধার্য করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। কাজী রহিমাহুল্লাহ বলেন, উক্ত মাসআলায় ইজতেহাদ করে ভিন্ন মত পোষণের সুযোগ নেই।” -মাতালিবু উলিন নুহা: ২/৬১৯
আর কোনো হারাম কাজে সহযোগিতা করাও হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ –سورة المائدة: 2
“তোমরা নেক কাজ ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহায়তা কর। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠিন।” –সূরা মায়েদা ০৫:০২
একারণে আল্লাহ তাআলা মদ ও মদ পানকারী এবং সাহায্যকারী সকলকে লানত দিয়েছেন। ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: “لَعَنَ اللهُ الْخَمْرَ، وَلَعَنَ شَارِبَهَا، وَسَاقِيَهَا، وَعَاصِرَهَا، وَمُعْتَصِرَهَا، وَبَائِعَهَا، وَمُبْتَاعَهَا، وَحَامِلَهَا، وَالْمَحْمُولَةَ إِلَيْهِ” -سنن أبي داود ت الأرنؤوط: 3674، مسند أحمد ط الرسالة: 5716. قال ابن حجر العسقلاني: صححه ابن السكن.اهــــ -التلخيص الحبير ط العلمية (4/ 200)
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মদ, মদ পানকারী, অন্যকে পান করানেওয়ালা, আঙ্গুর থেকে মদের রস নিংড়ানেওয়ালা, আঙ্গুরের রস বের করার জন্য অন্যকে তলবকারী, আঙ্গুরের রস বিক্রেতা, ক্রেতা, বহনকারী এবং যার কাছে বহন করা হচ্ছে, সবাইকে লানত করেছেন। -সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৭৪, মুসনাদে আহমদ: ৫৭১৬
ইবনে আবিদিন শামি রহিমাহুল্লাহ (১২৫২ হি.) বলেন,
فإن ما حرم أخذه حرم إعطاؤه كما في الأشباه … فإنه بإعطائه ما يحرم أخذه يكون معينا على الظلم باختياره. –رد المحتار (2/ 336)
(না দিয়ে বাঁচার সুযোগ থাকলেও ট্যাক্স দেয়া যাবে, কথাটি আপত্তিকর। কারণ) যা নেয়া হারাম তা দেয়াও হারাম; যেমনটা ‘আল-আশবাহ’তে বলা হয়েছে… (কাজেই যে ব্যক্তি না দিয়ে পারবে, তার জন্য ট্যাক্স দেয়া জায়েয হবে না)। কেননা, যা নেয়া হারাম তা দেয়ার অর্থ স্বেচ্ছায় জুলুমে সহযোগিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।” –রদ্দুল মুহতার: ২/২৩৬
তাই কাস্টমস ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া শুধু বৈধই নয়, বরং সামর্থ্য থাকলে তা জরুরি। অবশ্য কারো জন্য ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না হলে অথবা জুলুম-অত্যাচার ও সম্মানহানির ভয় থাকলে, তার জন্য জুলুম থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ট্যাক্স প্রদান করা গুনাহ হবে না ইনশাআল্লাহ। এটা অনেকটা জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষার জন্য ঘুষ দেয়ার মতো। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায় বর্তাবে যারা অন্যায়ভাবে তা গ্রহণ করবে এবং যারা তাদেরকে সহযোগিতা করবে তাদের ওপর।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَنْبَغِي لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يُذِلَّ نَفْسَهُ» قَالُوا: وَكَيْفَ يُذِلُّ نَفْسَهُ؟ قَالَ: «يَتَعَرَّضُ مِنَ البَلَاءِ لِمَا لَا يُطِيقُ» -سنن الترمذي ت شاكر: 2254، سنن ابن ماجه ت الأرنؤوط: 4016، مسند أحمد ط الرسالة: 23444. قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.اهـــ
হুযায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মুমিনের জন্য নিজেকে অপমানিত করা উচিত নয়।” সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, “কীভাবে নিজেকে অপমানিত করবে?” তিনি বললেন, “(ইচ্ছাকৃতভাবে) সাধ্যাতীত মুসীবতের সম্মুখীন হওয়ার মাধ্যমে।” -সুনানে তিরমিযী: ২২৫৪, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪০১৬, মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৪৪
ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহিমাহুল্লাহ (২৩৫ হি.) বর্ণনা করেন,
عن القاسم بن عبد الرحمن عن ابن مسعود رضي الله عنه: «أنه لما أتى أرض الحبشة أُخِذ في شيء، فأَعطى دينارين، حتى خُلِّي سبيله» … عن مجاهد ، قال : اجعل مالك جنة دون دينك ، ولا تجعل دينك جنة دون مالك … عن عطاء . و… عن جابر بن زيد والشعبي ، أنهم قالوا : لا بأس أن يصانع الرجل على نفسه وماله إذا خاف الظلم. … عن الحسن ، مثله. … عن الحسن : أنه كان لا يرى بأسا أن يعطي الرجل من ماله ما يصون به عرضه. -المصنف لابن أبي شيبة: 22423-22428، )قال الشيخ عوامة فى تحقيقه: قوله: «يصانع عن نفسه» : أي يرشو عن نفسه).
ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাবশায় হিজরত করলে কাফেররা তাঁকে কোনো কারণে পাকড়াও করে। তখন তিনি দুই দিনারের বিনিময়ে তাদের থেকে মুক্তি লাভ করেন।
মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, “দ্বীন হেফাযতের জন্য তোমার সম্পদকে ঢালরূপে ব্যবহার কর। দ্বীনকে সম্পদ রক্ষার ঢাল বানিয়ো না।”
আতা (বিন আবী রাবাহ), জাবের বিন যায়েদ ও শাবি রহিমাহুমুল্লাহ সকলেই বলেছেন, “জুলুম-অত্যাচারের ভয় হলে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে জান-মাল রক্ষা করলে সমস্যার কিছু নেই।” হাসান বসরি রহিমাহুল্লাহ থেকেও এমন কথা বর্ণিত আছে।
হাসান বসরি রহিমাহুল্লাহ থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, সম্ভ্রম রক্ষার্থে ঘুষ দেয়াকে তিনি অসুবিধার কিছু মনে করতেন না।” -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ২২৪২৪-২২৪২৮
উপর্যুক্ত আসারসহ আরও বিভিন্ন আসার ও হাদীসের আলোকে ইমাম আবু বকর জাসসাস রহিমাহুল্লাহ (৩৭০ হি.) বলেন,
ووجه آخر من الرشوة، وهو الذي يرشو السلطان لدفع ظلمه عنه، فهذه الرشوة محرمة على آخذها غير محظورة على معطيها … فهذا الذي رخص فيه السلف إنما هو في دفع الظلم عن نفسه بما يدفعه إلى من يريد ظلمه أو انتهاك عرضه. –أحكام القرآن 2\541-542، دار الكتب العلمية
“ঘুষ প্রদানের আরেকটা বৈধ ক্ষেত্র হলো, জুলুম থেকে বাঁচার জন্য শাসককে ঘুষ দেয়া। এ ধরনের ঘুষ; গ্রহণকারীর জন্য নেয়া হারাম, প্রদানকারীর জন্য নিষিদ্ধ নয়। … সালাফে সালিহিন জুলুম থেকে বাঁচার জন্য ঘুষ দেয়ার যে ক্ষেত্রটি জায়েয বলেছেন, তা এটিই যে, যখন কেউ তার ওপর জুলুম করতে চায় বা সম্ভ্রমহানি করতে চায়, তখন তাকে ঘুষ দিয়ে জুলুম থেকে নিস্তার লাভ করা।” –আহকামুল কুরআন: ২/৫৪১-৫৪২
ইবনে আবেদীন শামী রহিমাহুল্লাহ (১২৫২ হি.) বলেন,
فإذا كان الظالم لا بد من أخذه المال على كل حال لا يكون العاجز عن الدفع عن نفسه آثما بالإعطاء -رد المحتار (2/ 336)
“(অন্যায়ভাবে ট্যাক্স আরোপকারী) জালিম যদি এমন হয় যে, সে যে করেই হোক ট্যাক্স নিয়েই ছাড়বে, তখন নিরুপায় ব্যক্তি তাকে অর্থ প্রদানের কারণে গুনাহগার হবে না।” –রদ্দুল মুহতার: ২/২৩৬
কাজেই কাস্টমস ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানি করা এবং তা দ্বারা ব্যবসা করা জায়েয; যদি পণ্যটি শরীয়তের দৃষ্টিতে হালাল এবং শরীয়ত সম্মত পদ্ধতিতে লেনদেন করা হয়।
والله تعالى أعلم
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
২২-১০-১৪৪৬ হি.
২১-০৪-২০২৫ ইং