মাওলানা আব্দুল্লাহ রাশেদহক্কানি

উলামায়ে হক্কানি ও উলামায়ে সূ : পরিচিতি ও  প্রকৃতি – পর্ব ১

উলামায়ে হক্কানি ও উলামায়ে সূ : পরিচিতি ও  প্রকৃতি

পর্ব ১

মাওলানা আবদুল্লাহ রাশেদ (হাফিযাহুল্লাহ)

 

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمدلله وحده، والصلاة والسلام على من لا نبي بعده، وعلى من تبعه، أما بعد:

উলামায়ে কেরাম দ্বীনের মুহাফিজ। উম্মাহর রাহবার। শরীয়তের ধারক বাহক। আম্বিয়ায়ে কেরামের ওয়ারিস। আল্লাহ তাআলা তাঁদের মাধ্যেমেই তাঁর দ্বীনের হিফাজত করছেন। মানব জাতিকে হিদায়াতের পথ দেখাচ্ছেন। যতদিন উলামায়ে কেরাম থাকবেন ততদিন দ্বীন থাকবে। যখন উলামায়ে কেরামকে তুলে নেয়া হবে তখন দ্বীনও উঠে যাবে। জাহালাত ও অজ্ঞতার অন্ধকারে পৃথিবী ছেয়ে যাবে। ফিতনা ফাসাদে ভরে যাবে। কেয়ামত ঘনিয়ে আসবে। এজন্যই ইলম উঠে যাওয়া, অজ্ঞতা ব্যাপক হওয়া এবং উলামায়ে কেরামের সংখ্যাস্বল্পতা দেখা দেওয়া কেয়ামতের আলামত বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

إن من أشراط الساعة أن يرفع العلم ويثبت الجهل ويشرب الخمر ويظهر الزنا -صحيح البخاري، رقم: 80؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“কেয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে রয়েছে ইলম উঠে যাওয়া, জাহালাত ও অজ্ঞতা ছেয়ে যাওয়া, মদ্যপান (ব্যাপক) হওয়া এবং যিনার প্রসার হওয়া।” –সহীহ বুখারি : ৮০

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

أن يقل العلم ويظهر الجهل -صحيح البخاري، رقم: 81؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“ইলম কমে যাওয়া এবং ব্যাপকভাবে জাহালাত-অজ্ঞতা ছেয়ে যাওয়া।” –সহীহ বুখারি : ৮১

অন্য হাদিসে এসেছে,

إن الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد ولكن يقبض العلم بقبض العلماء حتى إذا لم يبق عالما اتخذ الناس رؤوسا جهالا فسئلوا فأفتوا بغير علم فضلوا وأضلوا -صحيح البخاري، رقم: 100؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“আল্লাহ তাআলা ইলম এভাবে উঠিয়ে নেবেন না যে বান্দাদের অন্তর থেকে তা মুছে দেবেন। বরং ইলম উঠিয়ে নেবেন উলামাদের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। অবশেষে যখন একজন আলেমও বাকি রাখবেন না, লোকজন কতক জাহেলকে নিজেদের নেতা বানিয়ে নেবে। তারা ইলম ছাড়াই ফতোয়া দেবে। এভাবে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করবে।” – সহীহ বুখারি: ১০০

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

ينتزعه منهم مع قبض العلماء بعلمهم فيبقى ناس جهال يستفتون فيفتون برأيهم فيضلون ويضلون –صحيح البخاري، رقم: 6877؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“উলামাদেরকে তাদের ইলমসহ উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নেবেন। অবশেষে থেকে যাবে কতক জাহেল লোক। তাদের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হবে। তারা নিজেদের মনমতো ফতোয়া দেবে। এভাবে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে।” –সহীহ বুখারি: ৬৮৭৭

যেহেতু ইলম ও ইলমের ধারক বাহক উলামারাই দ্বীন ও দুনিয়া টিকে থাকার মাধ্যম, তাই ইলম ও উলামার অশেষ ফজিলত কুরআন হাদিসে এসেছে। ইলম তলবের প্রতি সীমাহীন উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

“আপনি বলুন, যে ব্যক্তি জানে আর যে জানে না উভয়ে কি সমান?” –সূরা যুমার (৩৯) : ৯

আরো ইরশাদ করেন,

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ –ا

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম দেয়া হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে বহুগুণ মর্যাদায় উন্নীত করবেন।” –সূরা মুজাদালা (৫৮): ১১

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من سلك طريقا يلتمس فيه علما سهل الله له به طريقا إلى الجنة -صحيح مسلم، رقم: 7028؛ ط. دار الجيل بيروت + دار الأفاق الجديدة ـ بيروت

“যে ব্যক্তি ইলমের তলবে কোনো রাস্তা অবলম্বন করবে, আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেবেন।” –সহীহ মুসলিম: ৭০২৮

অন্য হাদিসে ইরশাদ করেন,

خيركم من تعلم القرآن وعلمه –صحيح البخاري، رقم: 4739؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে কুরআন মাজিদ (নিজে) শিক্ষা করে এবং (অন্যদেরকে) শিক্ষা দেয়।”–সহীহ বুখারি: ৪৭৩৯

আরও ইরশাদ করেন,

طلب العلم فريضة على كل مسلم -سنن ابن ماجه، رقم: 224؛ ط. دار الرسالة العالمية، قال الأرنؤوط رحمه الله تعالى فى التحقيق: حديث حسن بطرقه وشواهده. اهـ

“ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয।” –সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪

এছাড়াও অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে ইলম ও আহলে ইলমের ফজিলতের কথা এসেছে, যার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে ইলমের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে।

সত্যিকারের আলেমদের জন্য আসমানের ফেরেশতা, যমিনের জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ এমনকি সমূদ্রের মাছ পর্যন্ত দোয়া করে। পক্ষান্তরে যারা ইলমে দ্বীনকে দুনিয়া উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, পার্থিব স্বার্থে ইলমে দ্বীন গোপন করে, তাদের উপর লা’নত করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন তাদের মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেয়া হবে। তারা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

 

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

“আমি যেসকল সুস্পষ্ট বিধান ও (সঠিক) পথের দিশা দানকারী প্রমাণাদি অবতীর্ণ করেছি, আমি মানুষের জন্য কিতাবে স্পষ্টভাবে তা বর্ণনা করে দেয়ার পরও যারা তা গোপন করে, এরাই হচ্ছে সেসব লোক যাদের ওপর আল্লাহ তাআলা অভিসম্পাত করেন, অভিশাপ বর্ষণ করে অন্যান্য অভিশাপকারীরাও” –সূরা বাকারা (২) : ১৫৯

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من سئل عن علم، فكتمه ألجمه الله بلجام من نار يوم القيامة -سنن ابي داود، رقم: 3658؛ ط. دار الرسالة العالمية، ت: شعَيب الأرنؤوط – محَمَّد كامِل قره بللي، الناشر: دار الرسالة العالمية، قال الشيخ شعيب الأرنؤوط رحمه الله تعالى فى التحقيق: إسناده صحيح. اهـ

“ইলমের কিছু জিজ্ঞাসা করার পর যে তা গোপন করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেবেন।” –সুনানে আবু দাউদ : ৩৬৫৮

আরও ইরশাদ করেন,

“من تعلم علما مما يبتغى به وجه الله عز وجل لا يتعلمه إلا ليصيب به عرضا من الدنيا لم يجد عرف الجنة يوم القيامة” يعني ريحها -سنن ابي داود، رقم: 3664؛ ط. دار الرسالة العالمية، ت: شعَيب الأرنؤوط – محَمَّد كامِل قره بللي، الناشر: دار الرسالة العالمية، قال الشيخ الأرنؤوط رحمه الله تعالى فى تحقيقه: حديث صحيح لغيره. اهـ

“যে ইলম আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য শেখা হয়, তাকে যে ব্যক্তি স্রেফ দুনিয়ার সামান্য স্বার্থ হাসিলের জন্য শিখবে, কিয়ামতের দিন সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।” –সুনানে আবু দাউদ : ৩৬৬৪

 

  • আলেম দুই শ্রেণীতে বিভক্ত : উলামায়ে হক্বানিরব্বানি উলামায়ে সূ

আল্লাহ তাআলা মাখলুকের হিদায়াতের জন্য দ্বীন দিয়েছেন; যেন তারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির পথে চলতে পারে। শয়তানের রাস্তা পরিহার করে চিরস্থায়ী সুখের ঠিকানা জান্নাতের পথে চলতে পারে। সে দ্বীনের বিধিবিধান জানিয়ে দেয়ার জন্য নবী-রসূল প্রেরণ করেছেন। কিতাব নাযিল করেছেন। নবী-রসূলগণ সুস্পষ্টরূপে আল্লাহ তাআলার দ্বীনের বিধানাবলী ব্যাখ্যা করে গেছেন। রিসালাতের দায়িত্ব শতভাগ আদায় করেছেন। তাঁদের পর এ মহান দায়িত্ব উলামায়ে কেরামের উপর অর্পণ করেছেন। তিনি তাঁদের কাছে থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, তাঁরা নবী-রসূলগণের স্থলাভিষিক্ত হয়ে আল্লাহর দ্বীনের সকল বিধান সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করবেন। দ্বীনকে দুনিয়া উপার্জনের হাতিয়ার বানাবেন না। দুনিয়ার তুচ্ছ মোহে আল্লাহর কোন বিধান গোপন করবেন না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

 

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ

“স্মরণ করুন, যাদেরকে কিতাব (-এর ইলম) দেয়া হয়েছে, আল্লাহ যখন তাদের থেকে এ অঙ্গীকার নিলেন যে, তোমরা অবশ্যই তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না।” –সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮৭

অন্যত্র ইরশাদ করেন,

وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا –

“আর তোমরা আমার আয়াতগুলোর বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করো না।” –সূরা মায়িদা (৫) : ৪৪

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, উলামায়ে হক্কানি-রাব্বানি এ দায়িত্ব শতভাগ আদায় করলেও আলেম নামধারী অনেকেই আল্লাহ তাআলার এ অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। দুনিয়াবি স্বার্থে তারা আল্লাহর বিধান গোপন করেছে। দ্বীনকে দুনিয়া উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। আল্লাহর বিধানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন-বিয়োজন করে এবং আল্লাহর কিতাবের অপব্যাখ্যা করে তারা দুনিয়ার তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ

“এরপর তারা সে অঙ্গীকার পিঠের পশ্চাতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো এবং এর বিনিময়ে খরিদ করল সামান্য ‍মূল্য। কত নিকৃষ্ট মূল্যই না তারা খরিদ করছে।” –সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮৭

 

অন্যত্র ইরশাদ করেন,

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَذَا الْأَدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِنْ يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِثْلُهُ يَأْخُذُوهُ أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِيثَاقُ الْكِتَابِ أَنْ لَا يَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ وَدَرَسُوا مَا فِيهِ وَالدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (169) وَالَّذِينَ يُمَسِّكُونَ بِالْكِتَابِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ الْمُصْلِحِينَ

“অনন্তর তাদের পর এমন কতক অযোগ্য উত্তরসূরি তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো, যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে। তারা এই তুচ্ছ দুনিয়ার সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে, “আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেয়া হবে”। যদি অনুরূপ সামগ্রী তাদের সামনে পুনরায় আসে তাহলে তাও গ্রহণ করে। ওদের থেকে কি কিতাবে এ অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে, আল্লাহর উপর সত্য বৈ (মিথ্যা) কিছু আরোপ করবে না? আর তাতে (অর্থাৎ কিতাবে) যা কিছু লেখা ছিল তারা যথারীতি তা পড়েছেও। বস্তুত, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখেরাতের নিবাসই অধিক উত্তম। তারপরও কি তোমরা বুঝবে না?

পক্ষান্তরে, যারা দৃঢ়ভাবে কিতাবকে আঁকড়ে ধরে এবং নামায কায়েম করে, আমি এরূপ সংশোধনকারীদের সওয়াব বিনষ্ট করি না।” –সূরা আ’রাফ (৭) : ১৬৯-১৭০

পূর্ব যুগে ইহুদি আলেমরা এ বিচ্যুতির শিকার হয়েছিল। এ উম্মতেও এমন লোক জন্মাবে, যারা ইহুদি-খ্রিস্টানদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لتتبعن سنن من كان قبلكم شبرا بشبر وذراعا بذراع حتى لو دخلوا جحر ضب تبعتموهم. قلنا: يا رسول الله اليهود والنصارى ؟ قال: فمن ! -صحيح البخاري، رقم: 6889؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“নিঃসন্দেহে তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের লোকদের রীতি-নীতির অনুকরণ করবে। বিঘতে বিঘতে, হাতে হাতে। এমনকি তারা যদি ‘দবে’র (সাপের মতো এক ধরণের প্রাণী) গর্তে প্রবেশ করে থাকে তাহলে তোমরাও তাদের অনুসরণ করবে”। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইহুদি-খ্রিস্টানদের কথা বলছেন”? তিনি উত্তর দেন, “তাহলে আর কারা?” –সহীহ বুখারি : ৬৮৮৯

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮হি.) বলেন,

وكان السلف يرون أن من انحرف من العلماء عن الصراط المستقيم: ففيه شبه من اليهود ومن انحرف من العباد: ففيه شبه من النصارى –مجموع الفتاوى، ج: 1، ص: 65، ط. مجمع الملك فهد

“সালাফগণ মনে করতেন, যেসব আলেম-উলামা সিরাতে মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত হবে তাদের মধ্যে ইহুদিদের সাদৃশ্য রয়েছে আর যেসব আবেদ-জাহেল ইবাদতগুযার সিরাতে মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত হবে তাদের মধ্যে খ্রিস্টানদের সাদৃশ্য রয়েছে।” –মাজমুউল ফাতাওয়া : ১/৬৫

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. (১১৭৬হি.) বলেন,

فإنك إذا أردت أن ترى نماذج اليهود في هذه الأمة فانظر إلى علماء السوء، طلاب الدنيا –الفوز الكبير في أصول التفسير(معرَّبُ: سلمان الحسيني النَّدوي)، ص: 53، ط. دار الصحوة – القاهرة

“এ উম্মতের মাঝে ইহুদিদের নজির দেখতে চাইলে দুনিয়ালোভী উলামায়ে সূ-দের দিকে তাকাও।” –আলফাওযুল কাবির : ৫৩

শুরুতে উল্লেখিত হাদিসে বিবৃত হয়েছে,

اتخذ الناس رؤوسا جهالا فسئلوا فأفتوا بغير علم فضلوا وأضلوا -صحيح البخاري، رقم: 100؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“লোকজন কতক জাহেলকে নিজেদের নেতা বানিয়ে নেবে। তারা ইলম ছাড়াই ফতোয়া দেবে। এভাবে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে।” –সহীহ বুখারি : ১০০

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

فيبقى ناس جهال يستفتون فيفتون برأيهم فيضلون ويضلون –صحيح البخاري، رقم: 6877؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“অবশেষে থেকে যাবে কতক জাহেল লোক। তাদের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হবে। তারা নিজেদের মনমতো ফতোয়া দিয়ে দেবে। এভাবে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে।” –সহীহ বুখারি : ৬৮৭৭

কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে তিন শ্রেণীর ব্যক্তিকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তাদের একজনের ব্যাপারে এসেছে,

ورجل تعلم العلم وعلمه وقرأ القرآن فأتى به فعرفه نعمه فعرفها قال فما عملت فيها قال تعلمت العلم وعلمته وقرأت فيك القرآن. قال كذبت ولكنك تعلمت العلم ليقال عالم. وقرأت القرآن ليقال هو قارئ. فقد قيل ثم أمر به فسحب على وجهه حتى ألقى فى النار. -صحيح مسلم، رقم: 5032؛ ط. دار الجيل بيروت + دار الأفاق الجديدة ـ بيروت

“আরেক ব্যক্তি যে ইলম শিখেছে, শিখিয়েছে এবং কুরআন পড়েছে (ক্বারী হয়েছে), তাকে আনা হবে। আল্লাহ তাআলা তাকে যে নিয়ামতরাজি দিয়েছিলেন সেগুলো তাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন। সে সব স্বীকার করবে। এরপর জিজ্ঞেস করবেন, ‘এগুলো পেয়ে তুমি কী আমল করেছো?’ সে বলবে, ‘ইলম শিখেছি, শিখিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পড়েছি’। আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। বরং তুমি ইলম শিখেছো যেন তোমাকে আলেম বলা হয়। কুরআন পড়েছো যেন তোমাকে ক্বারী বলা হয়। তা তো বলা হয়েই গেছে’। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হবে। অধোমুখে হেঁচড়িয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” –সহীহ মুসলিম : ৫০৩২

বোঝা গেল, এমন কিছু আলেম ও ক্বারী জন্মাবে যারা দুনিয়ার জন্য ইলম শিখবে ও শেখাবে এবং দুনিয়ার জন্য কুরআন পড়বে।

আরেক হাদিসে এসেছে,

القضاة ثلاثة: واحد في الجنة، واثنان في النار، فأما الذي في الجنة فرجل عرف الحق فقضى به، ورجل عرف الحق فجار في الحكم، فهو في النار، ورجل قضى للناس على جهل، فهو في النار -سنن ابي داود، رقم: 3573؛ ط. دار الرسالة العالمية، ت: شعَيب الأرنؤوط – محَمَّد كامِل قره بللي، الناشر: دار الرسالة العالمية

“বিচারক তিন শ্রেণীর; এক শ্রেণী জান্নাতী আর দুই শ্রেণী জাহান্নামী। জান্নাতী হলো সে, যে হক (অর্থাৎ সত্য ও ন্যয়) জেনেছে এবং সে অনুযায়ী ফায়সালা দিয়েছে। আর যে ব্যক্তি হক জেনেছে কিন্তু না-হক-অন্যায় ফায়সালা দিয়েছে সে জাহান্নামী। আরেক ব্যক্তি যে অজ্ঞতা নিয়েই ফায়সালা দিয়ে দিয়েছে সেও জাহান্নামী।” –সুনানে আবু দাউদ : ৩৫৭৩

ইবনুল কায়্যিম রহ. (৭৫১হি.) বলেন,

قال غير أبي عمر: كما أن القضاة ثلاثة: قاضيان في النار وواحد في الجنة فالمفتون ثلاثة، ولا فرق بينهما إلا في كون القاضي يلزم بما أفتى به، والمفتي لا يلزم به. –إعلام الموقعين، ج: 2، ص: 134، ط. دار الكتب العلمية – ييروت

“বিচারক যেমন তিন শ্রেণীর: দুই শ্রেণী জাহান্নামী এক শ্রেণী জান্নাতী, মুফতিও তিন শ্রেণীর। উভয়ের মাঝে ব্যবধান শুধু এটুকু যে, বিচারক তার ফতোয়া মানতে বাধ্য করতে পারে আর মুফতি পারে না।” –ই’লামুল মুআক্কিয়িন : ২/১৩৪

অতএব, এ উম্মতের মাঝে এমন কতক বিচারক ও মুফতি জন্ম নেবে যারা হক জেনেও দুনিয়ার লোভে হকের উল্টো বিচারাচার করবে এবং ফতোয়া দিয়ে জুলুম করবে। আর এমন অনেক কাযি মুফতিও জন্ম নেবে যারা অযোগ্য হওয়া সত্বেও ক্ষমতার জোরে কিংবা ঘুষ দিয়ে পদ দখল করে নেবে।

আরেক হাদিসে এসেছে,

يحمل هذا العلم من كل خلف عدوله ينفون عنه تحريف الغالين وانتحال المبطلين وتأويل الجاهلين –شرح مشكل الآثار للطحاوى، رقم: 3884، تحقيق: شعيب الأرنؤوط، الناشر: مؤسسة الرسالة

“প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্মের আদেল ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিবর্গই এই ইলমের ধারক-বাহক হবেন; যারা সীমা লঙ্গনকারীদের বিকৃতি, বাতিল লোকদের মিথ্যারোপ এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে এই ইলমকে রক্ষা করবেন।” -শরহু মুশকিলিল আসার লিত-ত্বহাবি : ৩২৬৯

অতএব, এ উম্মতে এমন কতক সীমা লঙ্গনকারী, বাতিলপন্থী ও মূর্খ আলেম জন্মাবে যারা দ্বীনের অপব্যাখ্যা করবে, দ্বীনের নামে মিথ্যাচার করবে এবং অসংগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে নিজেরাও বিভ্রান্তির শিকার হবে অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করবে।

হাদিসে কেয়ামতের একটি আলামত বলা হয়েছে,

وتعلم لغير الدين -سنن الترمذي، رقم: 2211؛ ط. شركة مكتبة ومطبعة مصطفى البابي الحلبي – مصر

“(দ্বীনের) ইলম দ্বীনের জন্য শেখা হবে না।” –সুনানে তিরমিযি : ২২১১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

والتمست الدنيا بعمل الآخرة، وتفقه لغير الدين -جامع بيان العلم وفضله لابن عبد البر، ج: 1، ص: 654، رقم: 1135، ط. دار ابن الجوزي، المملكة العربية السعودية

“আখেরাতের আমল দ্বারা দুনিয়া তালাশ করা হবে। (দ্বীনের) ইলম দ্বীনের জন্য শেখা হবে না।”

–জামিউ বয়ানিল ইলম : ১/৬৫৪, হাদিস নং ১১৩৫

ইবনে আব্দুল বার রহ. (৪৬৩হি.) উল্লেখ করেছেন, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

يا حملة العلم، اعملوا به؛ فإنما العالم من علم ثم عمل ووافق عمله علمه، وسيكون أقوام يحملون العلم لا يجاوز تراقيهم تخالف سريرتهم علانيتهم ويخالف عملهم علمهم، يقعدون حلقا فيباهي بعضهم بعضا حتى إن الرجل ليغضب على جليسه أن يجلس إلى غيره ويدعه، أولئك لا تصعد أعمالهم في مجالسهم تلك إلى الله عز وجل -جامع بيان العلم وفضله لابن عبد البر، ج: 1، ص: 696، رقم: 1237، ط. دار ابن الجوزي، المملكة العربية السعودية

“হে ইলমের ধারক-বাহকেরা, তোমরা ইলম অনুযায়ী আমল করো। কেননা, আলেম তো সে-ই যে ইলম শিখেছে এরপর আমল করেছে এবং তার ইলমের সাথে আমলের মিল আছে। অচিরেই এমন সব লোক আসবে যারা ইলম ধারণ করবে কিন্তু তা তাদের গলদেশ অতিক্রম করবে না। তাদের জাহের বাতেন মিল থাকবে না। আমল ইলমের বিপরীত হবে। অনেক মজলিস নিয়ে তারা বসবে। একে অপরের সাথে গর্ব করবে। অবস্থা এমন হবে যে, তাকে ছেড়ে অন্যের মজলিসে বসার কারণে রাগান্বিত হবে। ওসব লোকের ওই সব মজলিসের আমল আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার কাছে উঠবে না।” –জামিউ বয়ানিল ইলম : ১/৬৯৪, হাদিস নং ১২৩৭

এছাড়াও কুরআন সুন্নাহয় আরও অসংখ্য দলীল প্রমাণ দিয়ে প্রমাণিত যে, দুনিয়ালোভী স্বার্থান্বেষী একদল উলামা ছিল এবং থাকবে, যাদের ইলম তাদের কোনও উপকারে আসেনি, আসবে না। ইবনে রজব হাম্বলি রহ. (৭৯৫হি.) বলেন,

قد ذكر الله -تعالى- في كتابه العِلْم تارة في مقام المدح، وهو العِلْم النافع، وذكر العِلْم تارة في مقام الذم، وهو العِلْم الَّذِي لا ينفع.

فأما الأول فمثل قوله تعالى: {قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ} [الزمر: 9]، وقوله: {شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ} [آل عمران: 18]، وقوله: {وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا} [طه: 114] وقوله: {إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ} [فاطر: 28]، وما قص الله سبحانه من قصة آدم وتعليمه الأسماء وعرضهم عَلَى الملائكة وقولهم: {سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ} [البقرة: 32]، وما قص الله سبحانه من قصة موسى -عليه السلام- وقوله للخضر: {هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا} [الكهف: 66] فهذا هو العِلْم النافع.

وقد أخبر عن قوم أنهم أوتوا علماً ولم ينفعهم علمهم، فهذا علم نافع في نفسه لكن صاحبه لم ينتفع به، قال تعالى:

{مَثَلُ الَّذِينَ حُمِّلُوا التَّوْرَاةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا} [الجمعة: 5]، وقال تعالى: {وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ * وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ} [الأعراف: 175 – 176]، وقال تعالى: {فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَذَا الْأَدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِنْ يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِثْلُهُ يَأْخُذُوهُ … } الآية [الأعراف: 169] وقال: {وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ} [الجاثية: 23]. –مجموع رسائل ابن رجب الحنبلي، ج: 3، ص: 7-8، ط. الفاروق الحديثة للطباعة والنشر

“আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ইলমকে কখনও প্রশংসার স্থলে উল্লেখ করেছেন। এটিই হলো ইলমে নাফে তথা উপকারী ইলম। আবার কখনও নিন্দার স্থলে উল্লেখ করেছেন। এটিই হলো ওই ইলম যা কোনও উপকারে আসে না। (যেমন তর্কশাস্ত্র।)

প্রথমটির দৃষ্টান্ত:

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

‘আপনি বলুন, যে ব্যক্তি জানে আর যে জানে না উভয়ে কি সমান?’ –সূরা যুমার (৩৯) : ৯

شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ

‘আল্লাহ স্বয়ং এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেন এবং ফেরেশতাগণ এবং ইলমের অধিকারীরাও যে, তিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নাই, যিনি ইনসাফের সাথে (বিশ্ব জগতের) নিয়ম-শৃঙ্খলা বিধান করছেন।’ –সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮

وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا

‘এবং আপনি বলুন, হে আমার রব, আপনি আমার ইলম বাড়িয়ে দিন।’ –সূরা ত্ব হা (২০) : ১১৪

إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

‘আল্লাহকে তো তার বান্দাদের মধ্যে (প্রকৃত অর্থে) তারাই ভয় করে যারা ইলমের অধিকারী।’ –সূরা ফাতির (৩৫) : ২৮

হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়া, সেগুলোকে ফেরেশতাদের সামনে পেশ করা এবং এ সংক্রান্ত যে ঘটনা আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন সেটিও এর দৃষ্টান্ত। ফেরেশতারা বলেছিল,

سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ

‘আপনি মহা পবিত্র। আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনোই ইলম নেই। নিঃসন্দেহে আপনিই প্রকৃত জ্ঞানী এবং মহা প্রজ্ঞাময়।’ –সূরা বাকারা (২) : ৩২

হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও খাযিরের যে ঘটনা আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন সেটিও এর দৃষ্টান্ত। মূসা আলাইহিস সালাম খাযিরকে বলেছিলেন,

هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا

‘আমি কি এ উদ্দেশ্যে আপনার সাথে থাকতে পারি যে, সত্য পথের যে ইলম আপনাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে তার কিছু আমাকে শিক্ষা দেবেন?’ –সূরা কাহফ (১৮) : ৬৬

এটিই হচ্ছে ইলমে নাফে-উপকারী ইলম।

পাশাপাশি আল্লাহ তাআলা এমন কওমের কথাও জানিয়েছেন, যাদেরকে (উপকারী) ইলম দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তাদের ইলম তাদের কোনও উপকারে আসেনি। এ ইলম উপকারী কিন্তু ইলমধারী তা থেকে উপকৃত হয়নি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

مَثَلُ الَّذِينَ حُمِّلُوا التَّوْرَاةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا

‘যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি (তার অনুসরণ করেনি), তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধার ন্যায়, যে অনেক পুস্তক বহন করে চলেছে।’ –সূরা জুমুআ (৬২) : ৫

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ * وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ

‘আপনি তাদের কাছে সেই ব্যক্তিটির বৃত্তান্ত পড়ে শোনান, যাকে আমি আমার নিদর্শনসমূহ দান করেছিলাম। কিন্তু সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে শয়তান তার পেছনে লাগল। এরপর সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। আমি চাইলে ওই আয়াতগুলোর বদৌলতে তাকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করতে পারতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ল এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করল।’ –সূরা আ’রাফ (৭) : ১৭৫-১৭৬

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَذَا الْأَدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِنْ يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِثْلُهُ يَأْخُذُوهُ

‘অনন্তর তাদের পর এমন কতক অযোগ্য উত্তরসূরি তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো, যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে। তারা এই তুচ্ছ দুনিয়ার সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে, ‘আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেয়া হবে’। যদি অনুরূপ সামগ্রী তাদের সামনে পুনরায় আসে তাহলে তাও গ্রহণ করে।’ –সূরা আ’রাফ (৭) : ১৬৯

وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ

‘ইলমের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে গোমরাহ করেছেন।’ –সূরা জাসিয়া (৪৫) : ২৩” –মাজমুউ রাসায়িলি ইবনি রজব আলহাম্বলি : ৩/৭-৮

  • উলামায়ে সূ : পরিচিতি ও প্রকৃতি

উলামায়ে সূ-য়ের প্রকৃষ্ট নজির উলামায়ে ইয়াহুদ—যেমনটা ওপরে উল্লেখিত হয়েছে। আমরা যদি এতদ্‌সংক্রান্ত আয়াতগুলো দেখি তাহলেই আমাদের সামনে উলামায়ে সূ-য়ের পরিচিতি ‍ও প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কুরআনে কারীমের অংসখ্য আয়াতে এদের গোমর ফাঁস করা হয়েছে। সেখান থেকে মৌলিক কিছু পয়েন্ট আলোচনা করছি। সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু আয়াত ও হাদিসও উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ।

  • বেআমল আলেম

নাম মাত্রই তারা আলেম ছিল। ইলম অনুযায়ী আমলের কোন ধার ধারতো না। আল্লাহ তাআলা এদেরকে গাধার সাথে তুলনা করে বলেন,

مَثَلُ الَّذِينَ حُمِّلُوا التَّوْرَاةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا –

“যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি (তার অনুসরণ করেনি), তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধার ন্যায়, যে অনেক পুস্তক বহন করে চলেছে।” –সূরা জুমুআ (৬২) : ৫

অন্য আয়াতে আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন,

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ –

“অনন্তর তাদের পর এমন কতক অযোগ্য উত্তরসূরি তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো যারা নামায নষ্ট করল এবং নফসের কামনা-বাসনার পেছনে পড়ে গেল।” –সূরা মারইয়াম (১৯) : ৫৯

অন্য আয়াতে বলেন,

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَذَا الْأَدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِنْ يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِثْلُهُ يَأْخُذُوهُ أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِيثَاقُ الْكِتَابِ أَنْ لَا يَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ وَدَرَسُوا مَا فِيهِ

“অনন্তর তাদের পর এমন কতক অযোগ্য উত্তরসূরি তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে। তারা এই তুচ্ছ দুনিয়ার সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে, ‘আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেয়া হবে’। যদি অনুরূপ সামগ্রী তাদের সামনে পুনরায় আসে তাহলে তাও গ্রহণ করে। ওদের থেকে কি কিতাবে এ অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে, আল্লাহর উপর সত্য বৈ (মিথ্যা) কিছু আরোপ করবে না? আর তাতে (অর্থাৎ কিতাবে) যা কিছু লেখা ছিল তারা যথারীতি তা পড়েছেও।” –সূরা আ’রাফ (৭) : ১৬৯

অর্থাৎ তারা গোনাহ করতো আর বলতো, অচিরেই তাওবা করে নেবো। কিন্তু আবার যখন গুনাহর সুযোগ আসতো, আগের কথা ভুলে গিয়ে আবারও হারামে লিপ্ত হতো। এভাবে যতবারই সুযোগ আসতো, হারাম করতে থাকতো।

  • বেআমল মুফতি, বেআমল ওয়ায়েজ

বনি ইসরাঈল অন্যকে গুনাহ পরিহার করে সৎ পথে চলার এবং আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার আদেশ দিতো।

কেউ আলেমদের কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করলে, যেখানে সত্য বললে দুনিয়ার কোনো স্বার্থ ছুটে যেতো না, সেখানে তারা হক ও সত্য কথাটি বলে দিতো এবং সে অনুযায়ী আমল করার উপদেশ দিতো, কিন্তু নিজেরা আমল করতো না। এ ধরনের বে-আমল মুফতি ও ওয়ায়েজদের তিরস্কার করে আল্লাহ তাআলা বলেন,

أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

“তোমরা কি লোকদের ভালো কাজের আদেশ দাও আর নিজেরা ভুলে থাকো? অথচ তোমরা তো কিতাব পাঠ করো। তাহলে (কি অন্যায় যে তোমরা করছো তা) কি তোমরা বুঝো না?” –সূরা বাকারা (২) : ৪৪

ইবনে কাসির রহ. (৭৭৪হি.) বলেন,

يقول تعالى: كيف يليق بكم -يا معشر أهل الكتاب، وأنتم تأمرون الناس بالبر، وهو جماع الخير-أن تنسوا أنفسكم، فلا تأتمروا بما تأمرون الناس به، وأنتم مع ذلك تتلون الكتاب، وتعلمون ما فيه على من قصر في أوامر الله؟ أفلا تعقلون ما أنتم صانعون بأنفسكم؛ فتنتبهوا من رقدتكم، وتتبصروا من عمايتكم. وهذا كما قال عبد الرزاق عن معمر، عن قتادة في قوله تعالى: {أتأمرون الناس بالبر وتنسون أنفسكم} قال: كان بنو إسرائيل يأمرون الناس بطاعة الله وبتقواه، وبالبر، ويخالفون، فعيرهم الله، عز وجل. وكذلك قال السدي. –تفسير ابن كثير، ج: 1، ص: 246، ط. دار طيبة للنشر والتوزيع

“আল্লাহ তাআলা বলছেন, হে কিতাবধারীরা, তোমাদের জন্য কীভাবে শোভা পায় যে, তোমরা লোকজনকে ভালো কাজের আদেশ দাও আর নিজেদের ভুলে থাকো? লোকজনকে যার আদেশ দাও নিজেদের সে আদেশ দাও না, অথচ তোমরা কিতাব পড়, আল্লাহর আদেশ মানায় অবহেলাকারীদের কী পরিণাম তাতে লেখা আছে তোমরা তা জানও। তোমরা নিজেদের সাথে যে প্রবঞ্চনা করছো তা কি তোমরা বুঝতে পারছো না যে, এই অমোঘ নিদ্রা ছেড়ে জেগে উঠবে? এ অন্ধত্ব ছেড়ে আলোতে ফিরে আসবে?

আব্দুর রাযযাক রহ. মা’মারের সূত্রে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কাতাদা রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন, বনি ইসরাঈল অন্যদেরকে আল্লাহ তাআলার ফরমাবরদারি ও তাকওয়া অবলম্বনের এবং সৎ কাজের আদেশ দিতো, কিন্তু নিজেরা উল্টো করত। আল্লাহ তাআলা তাদের এহেন ঘৃণ্য কর্মের কারণে তিরস্কার করেছেন। সুদ্দি রহ.ও এমনই বলেছেন।” –তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/২৪৬

আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন আয়াতে এ ধরনের লোকের তিরস্কার করেছেন। যেমন এক আয়াতে বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3) –الصف

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কর না? এটা আল্লাহর কাছে বড় অপছন্দনীয় যে, তোমরা এমন কথা বল যা তোমরা কর না।” –সূরা সফ (৬১) : ২-৩

উল্লেখ্য, ভাল কাজের আদেশ দেয়ার কারণে তিরস্কার করা হয়নি, করা হয়েছে নিজে আমল না করার কারণে। কারণ, নিজে আমল না করলেও ভাল কাজের আদেশ দেয়া জরুরি। কারণ উভয়টি স্বতন্ত্র ফরয।

এ ধরনের লোকেদের শাস্তির ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

رأيت ليلة أسري بي رجالا تقرض شفاههم بمقاريض من نار، فقلت: يا جبريل من هؤلاء؟ قال: هؤلاء خطباء من أمتك، يأمرون الناس بالبر، وينسون أنفسهم، وهم يتلون الكتاب أفلا يعقلون؟ -مسند الإمام أحمد، رقم: 13515؛ ط. الرسالة، ت: شعيب الأرنؤوط، عادل مرشد، وآخرون، قال الشيخ شعيب الأرنؤوط رحمه الله تعالى: حديث صحيح، وهذا إسناد ضعيف لضعف علي بن زيد بن جدعان. اهـ

“মেরাজের রাত্রে কিছু লোককে দেখতে পেলাম আগুনের কেঁচি দিয়ে তাদের ঠোঁট কাটা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, জিব্রাঈল! এরা কারা? তিনি উত্তর দেন, এরা আপনার উম্মতের বক্তারা, যারা লোকদের ভালোর আদেশ দিতো আর নিজেরা ভুলে থাকতো, অথচ তারা কিতাবও পড়তো। তারা কি বুঝতো না?” –মুসনাদে আহমাদ : ১৩৫১৫

এ হল উলামায়ে সূ-র হালত। পক্ষান্তরে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও উলামায়ে হক্কানির তরিকা হল সেটাই যা হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালাম বলেছেন,

وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ إِنْ أُرِيدُ إِلَّا الْإِصْلَاحَ مَا اسْتَطَعْتُ –هود 88

“আর আমি এটা চাই না যে, আমি তোমাদের যে কাজ করতে নিষেধ করি তোমাদের পশ্চাতে আমি নিজে সে কাজে লিপ্ত হই। আমি তো আমার সাধ্যমতো কেবল ইসলাহ করতে চাই।” –সূরা হুদ (১১) : ৮৮

বুঝা গেল, ওয়াজ-নসীহত ও ফতোয়ার সাথে যদি আমল না থাকে, তাহলে ইসলাহ হবে না। ইবনুল কায়্যিম রহ. (৭৫১হি.) বড়ই সুন্দর কথা বলেছেন,

عُلَمَاء السوء جَلَسُوا على بَاب الْجنَّة يدعونَ إِلَيْهَا النَّاس بأقوالهم ويدعونهم إِلَى النَّار بأفعالهم فَكلما قَالَت أَقْوَالهم للنَّاس هلمّوا قَالَت أفعالهم لَا تسمعوا مِنْهُم فَلَو كَانَ مَا دعوا إِلَيْهِ حَقًا كَانُوا أول المستجيبين لَهُ فهم فِي الصُّورَة أدلاء وَفِي الْحَقِيقَة قطّاع الطّرق –الفوائد، ص: 61، دار الكتب العلمية – بيروت

“উলামায়ে সূ-রা জান্নাতের দরজায় বসে মুখে মুখে লোকদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকছে কিন্তু কর্মের দ্বারা ডাকছে জাহান্নামের দিকে। তাদের মুখ যখন বলছে, ‘এসো জান্নাতের দিকে’ তখন তাদের কর্ম বলছে, ‘তাদের কথা শুনবে না। তারা যে দিকে ডাকছে তা যদি সত্যই হতো তাহলে তারাই তো সর্ব প্রথম সাড়া দিত’। বেশ-ভূষায় এরা পথ প্রদর্শক আর বাস্তবে রাজ পথের ডাকাত।” –আল ফাওয়ায়িদ : ৬১

Related Articles

Back to top button