আগ্রাসনকিতাব-রিসালাহপ্রবন্ধ-নিবন্ধমাওলানা আব্দুল্লাহ রাশেদসমসাময়িক

উম্মাহর দুর্দিনে নেতৃত্বে এগিয়ে আসা দুনিয়াদারি নয়

উম্মাহর দুর্দিনে নেতৃত্বে এগিয়ে আসা দুনিয়াদারি নয়

মাওলানা আবদুল্লাহ রাশেদ হাফিযাহুল্লাহ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

يجب أن يعرف أن ولاية أمرالناس من أعظم واجبات الدين، بل لا قيام للدين ولا للدنيا إلا بها، … ولأن الله تعالى أوجب الأمر بالمعروف والنهى عن المنكر، ولا يتم ذلك إلا بقوة وإمارة، وكذلك سائر ما أوجبه من الجهاد والعدل وإقامة الحج والجمع والأعياد ونصر المظلوم وإقامة الحدود لا تتم إلا بالقوة والامارة. مجموع الفتاوى: 28\390

“জেনে রাখা আবশ্যক যে, জনগণের নেতৃত্ব দেওয়া দীনের সুমহান আবশ্যিক দায়িত্ব। শুধু তাই নয়, এটি ব্যতীত দীন-দুনিয়া কোনোটাই চলতে পারে না। … তাছাড়া আল্লাহ তাআলা ‘আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার’ ফরয করেছেন। আর তা প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব ব্যতীত পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তদ্রূপ জিহাদ, ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা; হজ, জুমআ ও ঈদ কায়েম করা; মাজলুমকে সাহায্য করা, হদসমূহ কায়েম করা ইত্যাদিসহ আল্লাহ তাআলার ফরযকৃত যাবতীয় বিধান প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব ব্যতীত পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০
فجائز للفاضل أن يعمل وأن يطلب العمل إذا رأى ألا عوض منه. وجائز أيضا للمرء أن يثني على نفسه بالحق إذا جهل أمره. –تفسير ابن عطية = المحرر الوجيز في تفسير الكتاب العزيز (3/ 256)
“দীনদার মহৎ ব্যক্তির জন্যও পদ নেওয়া এবং পদ তলব করা জায়েয- যখন দেখেন যে, তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারার মতো যোগ্য কেউ নেই। যদি তার যোগ্যতার বিষয়টি লোকজনের জানা না থাকে, তাহলে নিজের মাঝে বিদ্যমান বাস্তবিক গুণ-জ্ঞান তুলে ধরতেও সমস্যা নেই।” –তাফসীরে ইবনে আতিয়া: ৩/২৫৬
فإذا كان في البلد قوم يصلحون للقضاء فامتنع كل واحد منهم عن الدخول فيه أثموا إن كان السلطان بحيث لا يفصل بينهم وإلا فلا، ولو امتنع الكل حتى قلد جاهل اشتركوا في الإثم لأدائه إلى تضييع أحكام الله تعالى. -العناية شرح الهداية (7/ 262) “কাজী হওয়ার মতো একদল লোক এলাকায় আছে। কিন্তু কাজীর পদটি গ্রহণ করতে সকলেই অস্বীকৃতি জানালো। তাহলে সকলে গুনাহগার হবে। … যোগ্যদের সকলে বিরত থাকার ফলে শেষে যদি কোনো অজ্ঞকে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে সকল যোগ্য গুনাহগার হবে। কারণ, এটি আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান বিনষ্ট হওয়ার দিকে ঠেলে দিবে।” –ইনায়া: ৭/২৬৩
أن الذي تفرد بالاستحقاق يجب عليه أن يتعرض للدعاء إلى نفسه، والتسبب إلى تحصيل الطاعة، والانتهاض لمنصب الإمامة. فإن لم يعدم من يطيعه، وآثر التقاعد، والاستخلاء لعبادة الله [عز وجل] مع علمه بأنه لا يسد أحد مسده – كان ذلك عندي من أكبر الكبائر، وأعظم الجرائر، وإن ظن ظان أن انصرافه وانحرافه سلامة، كان ما حسبه باطلا قطعا. -غياث الأمم في التياث الظلم (ص: 323)
“যোগ্যতা বলে খলীফা হওয়ার উপযুক্ত যদি কেবল একজন লোকই থাকে, তাহলে তাঁর জন্য আবশ্যক: লোকজনকে নিজের দিকে আহ্বান করা, তাঁর প্রতি লোকদের আনুগত্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালানো এবং ইমামের পদটি লাভের জন্য উঠে দাঁড়ানো। তার আনুগত্যে সাড়া দেয়ার মতো মানুষের অভাব না হলে, এতদসত্ত্বেও যদি তিনি বসে থাকাকে অগ্রাধিকার দেন, ইবাদতে মনোনিবেশ করাকে প্রাধান্য দেন, অথচ তিনি জানেন যে, তাঁর এ শূন্যতাটি অন্য কেউ পূরণ করতে পারবে না: তাহলে আমার মতে এটি (শুধু কবীরা গুনাহই না, বরং) আকবারুল কাবায়ির এবং অতি ভয়ানক অপরাধ। কেউ যদি এমনটা মনে করে যে, দূরে থাকাই তো নিরাপদ তাহলে সে যে ধারণা করেছে কোনো সন্দেহ নেই যে এটি সম্পূর্ণ একটি বাতিল ধারণা।” –গিয়াসুল উমাম: ৩২৩

বর্তমান তাগুতি শাসনের নেতাদের হাল সকলের জানা। জানের ভয়ে কিংবা বিশেষ জরুরতে তাদের দ্বারস্থ হতে হয় শুধু; নতুবা মনে মনে মানুষ তাদের ঘৃণা করে। নিকৃষ্ট জন্তু জানোয়ারের মতোই মনে করে।
স্পষ্ট যে, এ ধরনের নেতাদের দুনিয়াদার বলা ছাড়া কোনো উপায় নাই। আর বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুনিয়াদাররাই এসব পদের জন্য কামড়া কামড়ি করে। এ কারণে নেতৃত্বের প্রতি উলামা সমাজের বিতৃষ্ণা। এটাকে দুনিয়াদারি মনে করে, তাই তাঁরা এ থেকে দূরে থাকাকে দীন ঈমানের জন্য নিরাপদ মনে করে। এভাবে আমাদের বর্তমান সময়কার দীনদারদের মধ্যে নেতৃত্ব বিমুখতা একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।
অপরদিকে নেতৃত্ব তলব করার ব্যাপারে হাদীসেও কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। যেমন,
হাদীস -১
عن عبد الرحمن بن سمرة قال : قال لي النبي صلى الله عليه و سلم ( يا عبد الرحمن لا تسأل الإمارة فإنك إن أعطيتها عن مسألة وكلت إليها وإن أعطيتها عن غير مسألة أعنت عليها). -صحيح البخاري (6/ 2612)، كتاب الأحكام، 5 – باب من لم يسأل الإمارة أعانه الله عليها: 6727
“আব্দুর রহমান বিন সামুরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন, হে আব্দুর রহমান! তুমি কখনও নেতৃত্ব তলব করো না। কারণ, তুমি যদি তা চেয়ে নাও, তাহলে তোমাকে তোমার নফসের কাছেই সমর্পণ করে দেওয়া হবে (আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য করা হবে না) আর যদি চাওয়া ছাড়াই তোমার কাছে এসে পড়ে, তাহলে তোমাকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সাহায্য করা হবে।” –সহীহ বুখারী: ৬৭২৭
‘আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য করা’র ব্যাখ্যা অন্য এক হাদীসে এসেছে,
أنزل الله مَلَكاً يُسَدِّدُهُ
“আল্লাহ তাআলা একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ করবেন, যে তাঁকে সঠিক পথ দেখিয়ে চলবে।” –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৫৭৮
স্পষ্ট যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যাকে নুসরত করা হবে না সে সঠিক পথে চলতে পারবে না। এজন্য যারা নেতৃত্ব চায় তাদের হাতে নেতৃত্ব সমর্পণ করা নিষেধ। (রদ্দুল মুহতার: ৫/৩৬৬, কিতাবুল কাজা)
যেমন হাদীসে এসেছে:
হাদীস -২
عن أبي موسى رضي الله عنه قال : دخلت على النبي صلى الله عليه و سلم أنا ورجلان من قومي فقال أحد الرجلين أمرنا يا رسول الله وقال الآخر مثله فقال ( إنا لا نولي هذا من سأله ولا من حرص عليه). -صحيح البخاري (6/ 2613)، كتاب الأحكام، 7 – باب ما يكره من الحرص على الإمارة: … 6730
“আবু মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি এবং আমার কওমের দুজন লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম। (আশ্চর্যের বিষয়) তখন দুজনের একজন আবেদন করে বসলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে (কোনো এলাকার) আমীর নিয়োগ করুন। অন্যজনও এমন আবেদন করলো। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে এই পদের আবেদন করে বা এর প্রতি লোভ করে, আমরা তাকে এতে নিয়োগ দেই না।” –সহীহ বুখারী: ৬৭৩০
হাদীস -৩
عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلاَ تَسْتَعْمِلُنِى قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِى ثُمَّ قَالَ « يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْىٌ وَنَدَامَةٌ إِلاَّ مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِى عَلَيْهِ فِيهَا ». -صحيح مسلم للنيسابوري (6/ 6-7)، كتاب الإمارة، 4 – باب كَرَاهَةِ الإِمَارَةِ بِغَيْرِ ضَرُورَةٍ. (57): 4823
“আবু যর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলের কাছে আবেদন করলাম: “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে কি কোনো পদে নিয়োগ দেবেন না?” তখন তিনি আমার কাঁধে তাঁর হাত দিয়ে আঘাত করে বললেন, “হে আবু যর, তুমি দুর্বল মানুষ। এই পদগুলো হচ্ছে আমানত (যার হক আদায় করার সামর্থ্য তোমার নেই) । এগুলো কিয়ামতের দিন অপমান আর পরিতাপের কারণ হবে। হ্যাঁ, যে ব্যক্তি যথাযথভাবে তা গ্রহণ করে এবং যথাযথ হক আদায় করে, তার বিষয়টা ভিন্ন।” –সহীহ মুসলিম: ৪৮২৩
এমন আরও অনেক হাদীসে পদ চাইতে নিষেধ এসেছে। যারা পদ চাইবে তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে না। আর কিয়ামতের দিন এসব পদের হক আদায় করতে না পারার কারণে মাখলুকাতের সামনে লজ্জিত ও অপমানিত হতে হবে।
এ ধরনের বিভিন্ন শরয়ী নুসুসের কারণে উলামায়ে কেরাম সব সময়ই নেতৃত্ব বিমুখ। আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ সহ উলামায়ে সালাফের অসংখ্য ব্যক্তিকে কাজী বানানোর জন্য জবরদস্তি করা সত্ত্বেও তাঁরা তা গ্রহণ করতে সম্মত হননি।
নেতৃত্বের বিষয়টা আসলেই ভয়ানক। প্রথমে মনে হয় পদটা আমি পেলে অনেক ভালোভাবে চালাতে পারতাম। কিন্তু হাতে আসার পর নফসের খিয়ানত ধরা পড়ে।
এভাবে শরয়ী হুঁশিয়ারি আর বাস্তবিক তিক্ত অভিজ্ঞতা মিলিয়ে উলামা ও দীনদার সমাজ নেতৃত্ব থেকে দূরে থাকাই নিজেদের জন্য নিরাপদ মনে করেন।
***
এই নেতৃত্ব বিমুখতা আমাদের মাঝে এমনই প্রভাব ফেলেছে যে, এর বিপরীতও যে একটা দিক আছে, আমরা তা বিলকুল ভুলে গেছি।
আল্লাহ তাআলা নেককার বান্দাদের দোয়া বিবৃত করেছেন,
{وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا } [الفرقان: 74]
“এবং যারা (এই) বলে (দোয়া করে), হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে এবং আমাদের আপনি মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন।” –সূরা ফুরকান ২৫:৭৪
সুলাইমান আলাইহিস সালামের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِي إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ (35) فَسَخَّرْنَا لَهُ الرِّيحَ تَجْرِي بِأَمْرِهِ رُخَاءً حَيْثُ أَصَابَ (36) وَالشَّيَاطِينَ كُلَّ بَنَّاءٍ وَغَوَّاصٍ (37) وَآخَرِينَ مُقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ (38)} [ص: 35 – 38]
“সুলাইমান বললো, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে মাফ করুন এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য দান করুন যা আমার পরে আর কেউ পেতে পারবে না। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা। তখন আমি বাতাসকে তাঁর অনুগত করে দিলাম, যা তাঁর হুকুমে অবাধে প্রবাহিত হত যেখানে সে পৌঁছাতে চাইতো। আর প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী সকল শয়তান (জিন)কে তাঁর অধীন করে দিলাম। এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকতো শৃঙ্খলে।” –সূরা সোয়াদ ৩৮:৩৫-৩৮
ইউসুফ আলাইহিস সালাম মিশরের মন্ত্রিত্বের পদ চেয়ে নিয়েছিলেন,
{وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِي فَلَمَّا كَلَّمَهُ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ (54) قَالَ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ (55) وَكَذَلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَاءُ نُصِيبُ بِرَحْمَتِنَا مَنْ نَشَاءُ وَلَا نُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ (56)} [يوسف: 54 – 56] “বাদশাহ বললো, তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাঁকে নিজের বিশ্বস্ত সহচর করে রাখবো। অতঃপর যখন তাঁর সাথে মতবিনিময় করলো, তখন বললো, “নিশ্চয়ই আপনি আমার কাছে আজ থেকে বিশ্বস্ত হিসাবে মর্যাদার স্থান লাভ করেছেন।” ইউসুফ বললো, “আমাকে দেশের ধন-ভাণ্ডারে নিযুক্ত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান।” এমনিভাবে আমি ইউসুফকে সে দেশের বুকে প্রতিষ্ঠা দান করেছি। সে তথায় যেখানে ইচ্ছা স্থান করে নিতে পারতো। আমি স্বীয় রহমত যাকে ইচ্ছা পৌঁছে দেই এবং আমি পুণ্যবানদের প্রতিদান বিনষ্ট করি না।” –সূরা ইউসুফ ১২:৫৪-৫৬
***
নেতৃত্ব চাওয়া নিষেধ এটাই স্বাভাবিক নীতি। কিন্তু সর্বাবস্থায় নিষেধ- তা নয়।
সুলাইমান আলাইহিস সালাম কেন রাজত্ব চাইলেন?
সুলাইমান আলাইহিস সালাম এত বড় রাজত্ব কেন চাইলেন? কারণ, তখনকার যমানায় দীনের দাওয়াতের জন্য তা দরকার ছিলো।
যামাখশারি রহিমাহুল্লাহ (৫৩৮ হি.) বলেন,
كان سليمان عليه السلام ناشئا في بيت الملك والنبوّة ووارثا لهما، فأراد أن يطلب من ربه معجزة، فطلب على حسب ألفه ملكا زائدا على الممالك زيادة خارقة للعادة بالغة حد الإعجاز، ليكون ذلك دليلا على نبوّته قاهرا للمبعوث إليهم. -تفسير الزمخشري = الكشاف عن حقائق غوامض التنزيل (4/ 95)
“সুলাইমান আলাইহিস সালাম এমন উঁচু পরিবারের সন্তান ছিলেন, যে পরিবার ছিলো একই সাথে রাজপরিবার এবং নবী পরিবার (কারণ, তিনি দাউদ আলাইহিস সালামের সন্তান, আর দাউদ আলাইহিস সালাম একাধারে বাদশা ও নবী ছিলেন)। এবং এ উভয়টিই তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেনও (অর্থাৎ বাদশাহি এবং নবুওয়াত)। (নবী হওয়ার পর) তিনি তাঁর রবের কাছে একটি মুজেযা দান করার আবেদন করবেন স্থির করলেন (যা দেখে লোকজন তাঁকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করবে এবং তাঁর উপর ঈমান আনবে)। তাই তিনি যে রাজকীয় পরিবেশে বড় হয়েছেন, সে হিসেবেই তিনি প্রচলিত বাদশাহদের বাদশাহির উর্ধ্বে এমন একটি রাজত্ব চাইলেন, যা হবে একেবারে মুজেযার স্তরের। যাতে এ রাজত্ব একটি দলীল হিসেবে গণ্য হয় যে, তিনি নবী এবং যাদের প্রতি তিনি নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছেন, তারা তাঁর বশীভূত হয়।” –তাফসীরে কাশশাফ: ৪/৯৫
এরপর আল্লাহ তাআলা যখন তাঁকে জিনদের ওপর ক্ষমতা দিলেন, বাতাসকে তাঁর আদেশের আজ্ঞাবহ করে দিলেন এবং পশুপাখির ভাষা বুঝার ক্ষমতা দান করলেন তখন এগুলো দেখে লোকজন বুঝতে পারলো যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী। নবী না হলে দুনিয়ার কোনো বাদশাহর পক্ষে এমন বাদশাহি সম্ভব না।
অধিকন্তু রাজা-বাদশাহদের মানুষ সহজে আজ্ঞাবহ হয়। নবী হওয়ার পাশাপাশি যদি তিনি একটি অসম্ভব রকমের রাজত্বেরও অধিকারী হন যা অন্য কারও নেই, তাহলে দুনিয়ার বড় বড় রাজা-বাদশাহরাও তাঁর দাওয়াত কবুল করে ঈমানের ছায়াতলে আসতে কুণ্ঠা বোধ করবে না।
ইমাম মাতুরিদি রহিমাহুল্লাহ (৩৩৪ হি.) বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন,
يحتمل سؤاله الملك – واللَّه أعلم – أنه أراد أن يستسلم له الخلق في الإجابة إلى ما يدعو إليه من وحدانية اللَّه تعالى وجعل العبادة له؛ لما رأى أن إجابة الناس وإقبالهم إلى ما عنده من السعة والغناء أسرع ولقوله أقبل ورغبتهم فيه أكثر. وإذا كان ما ذكرنا وهو متعارف فيما بينهم أن إجابتهم –أعني: إجابة الناس- للملوك ولمن عنده السعة والغنى أسرع لهم وأطوع: فكان في سؤاله الملك له نجاة الخلق كلهم بما يستسلمون له ويجيبون إلى ما يدعوهم إليه، فينجون نجاة لا هلاك بعدها. –تفسير الماتريدي = تأويلات أهل السنة (8/ 628)
“একটি কারণ এও হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ এবং শুধু তাঁরই ইবাদত করার যে দাওয়াত তিনি দিচ্ছিলেন, তিনি চাচ্ছিলেন লোকজন যেন সে দাওয়াতের সামনে আত্মসমর্পণ করে তা কবুল করে নেয়। তিনি দেখেছিলেন, যার কাছে প্রাচুর্য ও ধনাঢ্যতা রয়েছে, লোকজন সহজে তাঁর ডাকে সাড়া দেয়, তাঁর প্রতি সহজে ঝুঁকে, সহজে তাঁর কথা সহজে কবুল করে এবং সে তাদের আগ্রহের পাত্র হয় তুলনামূলক বেশি। বিষয়টি যখন এমনই – এবং সে সময়কার সমাজের অবস্থা সাধারণত এমনটিই ছিলো যে, রাজা-বাদশাহ এবং

ঐশ্বর্যের অধিকারীদের প্রতি সমাজের ঝোঁক ছিলো বেশি এবং তাঁদের আনুগত্য মেনে নিতো সহজে: এমনটি হয়ে থাকলে রাজত্বের আবেদন করার মাঝেই লোক সকলের নাজাত (পরকালীন চিরস্থায়ী মুক্তি) নিহিত ছিলো। যেহেতু তখন তারা তাঁর সামনে আত্মসমর্পণ করবে। তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে তা কবুল করবে। যার ফলে তারা এমনিভাবে নাজাত লাভ করবে, যার পরে ধ্বংসে পতিত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নাই।” –তাফসীরে মাতুরিদি: ৮/৬২৮
ইউসুফ আলাইহিস সালাম মন্ত্রিত্ব কেন চাইলেন?
ইউসুফ আলাইহিস সালাম মন্ত্রিত্ব চেয়ে নিলেন কেন? কারণ, লাগাতার সাত বছর দুর্ভিক্ষ চলাকালে তাঁর মতো যোগ্য এবং আমানতদার লোকেরই দরকার ছিলো। নইলে অযোগ্য আর দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের হাতে জন-মানুষ সীমাহীন কষ্টে নিপতিত হতো।
ইবনে আতিয়া আন্দালুসি রহিমাহুল্লাহ (৫৪২ হি.) বলেন,
قال القاضي أبو محمد: وطلبة يوسف للعمل إنما هي حسبة منه عليه السلام لرغبته في أن يقع العدل، ونحو هذا هو دخول أبي بكر الصديق في الخلافة مع نهيه المستشير من الأنصار عن أن يتأمر على اثنين … الحديث بكماله فجائز للفاضل أن يعمل وأن يطلب العمل إذا رأى ألا عوض منه، وجائز أيضا للمرء أن يثني على نفسه بالحق إذا جهل أمره. –تفسير ابن عطية = المحرر الوجيز في تفسير الكتاب العزيز (3/ 256)
“ইউসুফ আলাইহিস সালাম পদটি চেয়েছেন দীনের খাতিরে। তিনি চাচ্ছিলেন যেন আদল-ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন আবু বকর সিদ্দিক রাযিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের (মতো বড়) পদ গ্রহণ করেছেন, অথচ আনসারী যে ব্যক্তিটি তাঁর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলো, তিনি তাঁকে দুজনের আমীর হতেও বারণ করে দিয়েছেন। অতএব, দীনদার মহৎ ব্যক্তির জন্যও পদ নেওয়া এবং পদ তলব করা জায়েয- যখন দেখেন যে, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে পারার মতো যোগ্য কেউ নেই। যদি তাঁর যোগ্যতার বিষয়টি লোকজনের জানা না থাকে, তাহলে নিজের মাঝে বিদ্যমান বাস্তবিক গুণ-জ্ঞান তুলে ধরতেও সমস্যা নেই।” –তাফসীরে ইবনে আতিয়া: ৩/২৫৬
বুঝা গেল, যখন দীনের উপকারের স্বার্থে এবং মুসলিম ও জনমানুষের কল্যাণে নেতৃত্ব গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে, তখন এগিয়ে আসতেও সমস্যা নেই, চেয়ে নিতেও সমস্যা নেই।
সুনানে আবু দাউদে উসমান বিন আবুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা এসেছে। তিনি দশম হিজরীতে সাকিফ গোত্রের প্রতিনিধিদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আগমন করেন। হাদীসে বলা হয়েছে,
عن عثمان بن أبي العاص، قال: قلت: يا رسولَ الله، اجعلني إمامَ قومي ، قال: “أنتَ إمامُهم، واقتَدِ بأضعَفِهم، واتخِذْ مُؤَذِّناً لا يأخذُ على أذانِه أجراً”. (إسناده صحيح). -سنن أبي داود ت الأرنؤوط (1/ 398)، كتاب الصلاة، 40 – باب أخذ الأجر على التأذين: 531
“উসমান বিন আবুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে আমার কওমের (নামাযের) ইমাম বানিয়ে দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ঠিক আছে) তুমি তাদের ইমাম …।” –সুনানে আবু দাউদ: ৫৩১
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কওমের মধ্যে তাঁর চেয়ে ভালো যোগ্য কেউ ছিলো না। কিংবা আগে যিনি ইমাম ছিলেন, তিনি যোগ্য ছিলেন না, তাই তিনি পদটি চেয়ে নিয়েছেন, যাতে মুসলিমদের নামাযের ইবাদতটি সঠিক ভাবে আদায় হয়।
ইবনে রাসলান রহিমাহুল্লাহ (৮৪৪ হি.) উপর্যুক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,
(عن عثمان بن أبي العاص … قال: قلت … يا رسول الله اجعلني إمام قومي) فيه جواز طلب الإمامة من الإمام الأعظم إذا عرف من نفسه القيام بحقوقها، ولعله كان أَوْلَاهم بالإمامة فتعيَّن عليه طلبها ليحفظ على المسلمين صلواتهم، أو كان فيها من لا يصلح. (قال: أنت إمامهم) فيه إعطاء الإمامة لمن طلبها إذا عرف منه أنه أهل لها أو هو أحقهم بالإمامة، ولا يقدح الطلب في أهليته. -شرح سنن أبي داود لابن رسلان (3/ 499)
“উসমান বিন আবুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে আমার কওমের (নামাযের) ইমাম বানিয়ে দিন।’ … হাদীসের এ অংশটি এ কথার দলীল যে, ইমামে আজম (তথা খলীফা)-এর কাছে ইমামতির পদ তলব করা জায়েয- যদি মনে করেন যে, এ দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে আদায় করতে পারবেন। হতে পারে তাদের মাঝে তিনিই ইমামতির সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন, যার ফলে ইমামতির পদটি চেয়ে নেওয়া তাঁর জন্য আবশ্যক ছিলো, যেন মুসলিমদের নামায ঠিক ঠিক মতো আদায় হয়। কিংবা হতে পারে আগে এ দায়িত্বে এমন কেউ ছিলো যে যোগ্য ছিলো না। ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ঠিক আছে) তুমি তাদের ইমাম।’’ হাদীসের এ অংশটি এ কথার দলীল যে, ইমামতির পদ যে চায় তাঁকে পদটি দেওয়া জায়েয- যখন মনে হবে যে, লোকটি এর যোগ্য কিংবা ইমামতির সে-ই সবচেয়ে উপযুক্ত। তলব করার কারণে সে পদটির অনুপযুক্ত গণ্য হবে না।” –শারহু ইবনি রাসলান: ৩/৪৯৯
আরেক হাদীসে এসেছে,
من طَلَبَ قضاءَ المسلمين حتَّى ينالَه، ثم غَلَبَ عدلُه جَورَهُ فله الجنةُ، ومن غلب جَورهُ عَدلَهُ فله النارُ”. -سنن أبي داود ت الأرنؤوط (5/ 429)، كتاب الأقضية، 2 – باب القاضي يُخطئ: 3575
“যে ব্যক্তি মুসলিমদের বিচারক হওয়ার পদটি লাভ করতে চায় এবং অবশেষে (বিভিন্নজনের সুপারিশ ইত্যাদির মাধ্যমে) তা লাভ করে; তারপর যদি তাঁর সুবিচার অবিচারের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে (অর্থাৎ সুবিচার করে এবং অবিচার থেকে বিরত থাকে) তাহলে তাঁর জন্য রয়েছে জান্নাত। আর যার অবিচার সুবিচারের উপর প্রাধান্য পাবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।” –সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৭৫
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এ লোকটি মুসলিমদের দুর্দিনে এগিয়ে এসেছে। বিভিন্নজনকে সুপারিশ ধরেছে যাতে কাজীর পদটি অন্য কোনো অযোগ্য লোক দখল করতে না পারে। এভাবে অনেক চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর পদটি সে লাভ করে এবং ইনসাফের সাথে শরীয়ত অনুযায়ী বিচার করে তাহলে লোকটি জান্নাতী।
পদটি লাভ করার জন্য উঠেপড়ে লাগা জায়েয হলো কেন? কারণ, সে না নিলে অযোগ্য লোক তা দখল করে জনগণের জান-মালের উপর চেপে বসতো।
নেতৃত্ব তলব করা কখন নাজায়েয?
রাষ্ট্রের নেজাম যখন ইসলামী নিয়মানুযায়ী স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে, তখন নিজে থেকে পদ দাবি করা নাজায়েয। এমন ব্যক্তিকে পদে বসানোও নাজায়েয। অর্থাৎ সুলতান অথবা ইমামুল মুসলিমীন যোগ্য লোক তালাশ করে বেড়াচ্ছেন। তিনি যোগ্য লোক ছাড়া কাউকে পদে নিয়োগ দিবেন না। তখন মুসলিমদের যোগ্য লোকেরা নিজে থেকে পদ তলব করবে না। ইমামের পক্ষ থেকে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই তা কবুল করবে। এমন ধরনের পরিস্থিতিতে নিজে থেকে পদ দাবি করার অর্থ, সে পদের লোভী। উম্মাহর স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে সে তৎপর হবে। তার হাতে ইসলাম ও মুসলিমরা নিরাপদ নয়। তাই তাকে পদে বসানো নাজায়েয।
আল্লামা মুনাবী রহিমাহুল্লাহ (১০৩১ হি.) বলেন,
لأن إرادته إياه والحرص عليه مع العلم بكثرة آفاته وصعوبة التخلص منها آية أنه يطلبه لنفسه ولأغراضه. ومن كان هكذا أوشك أن تغلب عليه نفسه فيهلك، إذ الولاية تفيد قوة بعد ضعف وقدرة بعد عجز. –فيض القدير (2/ 550)
“নেতৃত্ব গ্রহণে যে কত বিপদ, (সঠিক দায়িত্ব পালন করে জাহান্নামের আগুন থেকে) নিজেকে মুক্ত করা যে এক্ষেত্রে কত কঠিন, তা জানার পরও যে ব্যক্তি তা চায় এবং এর প্রতি লোভ করে: এটিই এ বিষয়ের আলামত যে, সে নিজের গরজে, নিজের স্বার্থে তা তলব করছে। আর এই যার অবস্থা, এমনটিই হবে যে, নফসের প্রবৃত্তি তার উপর চেপে বসবে আর সে ধ্বংসে নিপতিত হবে। কারণ, নেতৃত্ব লাভ হলে দুর্বলতার পর শক্তি এবং অক্ষমতার পর সক্ষমতা অর্জন হয় (আর আশ্চর্য নয় যে, এ শক্তি-সক্ষমতার সে অপব্যবহার করবে)।” –ফায়জুল কাদীর: ২/৫৫০
পক্ষান্তরে যখন পদগুলো অযোগ্য ও স্বার্থবাজদের দখলে যেতে উপক্রম, তখন যোগ্যদের জন্য এগিয়ে আসা আবশ্যক- যেমনটা এগিয়ে এসেছেন হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম। এগিয়ে এসেছেন সাহাবী উসমান বিন আবুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং পূর্বোক্ত হাদীসে বর্ণিত বিচারক পদের প্রার্থী লোকটি।
হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২ হি.) বলেন,
ويستثنى من ذلك من تعين عليه كأن يموت الوالي ولا يوجد بعده من يقوم بالأمر غيره وإذا لم يدخل في ذلك يحصل الفساد بضياع الأحوال قلت وهذا لا يخالف ما فرض في الحديث الذي قبله من الحصول بالطلب أو بغير طلب بل في التعبير بالحرص إشارة إلى أن من قام بالأمر عند خشية الضياع يكون كمن أعطي بغير سؤال لفقد الحرص غالبا عمن هذا شأنه وقد يغتفر الحرص في حق من تعين عليه لكونه يصير واجبا عليه. -فتح الباري لابن حجر، كتاب الأحكام: (13/ 126)
“সুনির্দিষ্টভাবে যার জন্য নেতৃত্ব গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে, সে ব্যক্তি উক্ত নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন কোনো এলাকার প্রশাসক মারা গেল। তাঁর মৃত্যুর পর দায়িত্ব দেখাশুনার মতো এই লোক ছাড়া আর কেউ নেই। সে যদি তা গ্রহণ না করে তাহলে সমাজের অবস্থার অবনতি হবে এবং ফাসাদ দেখা দিবে। … (নিষেধাজ্ঞার হাদীসে) লোভের কথাটি আনা থেকে এ দিকে ইশারা করা হয়েছে যে, অবস্থার অবনতি হবার ভয়ে যে ব্যক্তি নেতৃত্ব হাতে নেয়, সে ওই ব্যক্তির মতোই, যাকে চাওয়া ব্যতিরেকেই নেতৃত্ব সমর্পণ করা হলো। কারণ, এ পরিস্থিতিতে এ ধরনের ব্যক্তির মধ্যে সাধারণত লোভের দিকটা থাকবে না। অধিকন্তু নেতৃত্বের ভার নেওয়া যার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়েছে, তাঁর ক্ষেত্রে (কিছু) লোভ থাকলেও তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা হতে পারে; যেহেতু নেতৃত্ব নেওয়াটা তাঁর জন্য আবশ্যক।” –ফাতহুল বারী: ১৩/১২৬, কিতাবুল আহকাম

বক্তব্যটি লক্ষণীয়
• যখন নেতৃত্ব হাতে না নিলে ফাসাদ দেখা দিবে, তখন নেতৃত্ব হাতে নেওয়া আবশ্যক। (ফাসাদ হয়তো এভাবে দেখা দিতে পারে যে, পদটি নেতৃত্ব শূন্য থেকে যাবে, কিংবা অযোগ্য লোক তা দখল করবে। তখন যোগ্য লোকদের এগিয়ে আসা কর্তব্য।)
• এ ধরনের সুরতে নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় হাতে নিলেও তা হাদীসের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে না। কারণ, এখন সে নিজের স্বার্থে নেতৃত্ব চায়নি, উম্মাহর স্বার্থে চাইছে।
• এ ধরনের ক্ষেত্রে মনে মনে নেতৃত্বের প্রতি কিছুটা লোভ থাকলেও তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা হবে। তাঁর লোভ তাঁর ক্ষতি করতে পারে, কিংবা জনগণেরও হয়তো কিছু ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু অযোগ্যের হাতে ছেড়ে দিলে ইসলাম ও মুসলিমদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে শায়খ মূসা শাহীন রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وهذا إذا كانت أمور الولايات تجري في مجراها الصحيح، وولي الأمر الأعلى يضع الرجل المناسب في المكان المناسب، أما إذا اختلت الموازين، وأبعد الأكفاء عن مواقعهم، وقدمت الأحساب والوسائط فللأكفاء أن يطلبوا، وأن يلحوا في الطلب، وأن يكافحوا من أجل وصولهم، فوصولهم حينئذ مصلحة عامة، قبل أن تكون خاصة. ويمكن حمل حديث أبي داود عن أبي هريرة رفعه “من طلب قضاء المسلمين حتى يناله، ثم غلب عدله جوره فله الجنة، ومن غلب جوره عدله فله النار” يمكن حمل هذا الحديث على مثل هذه الحالة. -ـ فتح المنعم شرح صحيح مسلم (7/ 427-428) للأستاذ الدكتور موسى شاهين
“নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রটি হচ্ছে: যখন পদগুলো সহীহ গতিতে চলতে থাকবে এবং রাষ্ট্র প্রধান উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে যেতে থাকবে। পক্ষান্তরে যখন নিয়োগের মানদণ্ড ভিন্ন হয়ে যাবে, যোগ্য লোকদেরকে সরিয়ে রাঘব বোয়ালকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে: তখন যোগ্য লোকদের পদ চাইতে অসুবিধার কিছু নাই। বরং তাঁরা নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকবে, পদ পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এ সময়ে তাঁরা নেতৃত্ব পাওয়ার মাঝে তাঁদের ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে জন-মুসলিমের কল্যাণই বেশি। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু বর্ণিত আবু দাউদের মারফু হাদীস: من طلب قضاء المسلمين – এ হাদীসকে এ ধরনের পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ধরা যেতে পারে।” –ফাতহুল মুনয়িম শারহু সহীহ মুসলিম: ৭/৪২৭-৪২৮
মুসলিমদের যখন কোনো ইমাম কিংবা সুলতান না থাকে, তখনকার সময়ে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইমামুল হারামাইন আব্দুল মালিক আলজুআইনি রহিমাহুল্লাহ (৪৭৮ হি.) তাঁর ‘গিয়াসুল উমাম’ কিতাবে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের মূল একটা অংশ এখানে তুলে ধরা সমীচীন মনে হচ্ছে। তিনি বলেন,
فإذا شغر الزمان عن كاف مستقل بقوة ومنة، فكيف تجري قضايا الولايات، وقد بلغ تعذرها منتهى الغايات. فنقول:
أما ما يسوغ استقلال الناس [فيه] بأنفسهم ولكن الأدب يقتضي فيه مطالعة ذوي الأمر، ومراجعة مرموق العصر، كعقد الجمع، وجر العساكر إلى الجهاد، واستيفاء القصاص في النفس والطرف، فيتولاه الناس عند خلو الدهر.
ولو سعى عند شغور الزمان طوائف من ذوي النجدة والبأس في نفض الطرق عن السعاة في الأرض بالفساد، [فهو] من أهم أبواب الأمر بالمعروف، والنهي عن المنكر.
وإنما ينهى آحاد الناس عن شهر الأسلحة استبدادا إذا كان في الزمان [وزر] قوام على أهل الإسلام، فإذا خلا الزمان عن السلطان، وجب البدار على حسب الإمكان إلى درء البوائق عن أهل الإيمان.
ونهينا الرعايا عن الاستقلال بالأنفس من قبيل [الاستحثاث] على ما هو الأقرب إلى الصلاح، والأدنى إلى النجاح، فإن ما يتولاه السلطان من أمور السياسة أوقع وأنجع، وأدفع للتنافس، وأجمع لشتات الرأي في تمليك الرعايا أمور الدماء، وشهر الأسلحة، وجوه من الخبل لا [ينكرها] ذوو العقل.
وإذا لم يصادف الناس قواما بأمورهم يلوذون به فيستحيل أن يؤمروا بالقعود عما يقتدرون عليه من دفع الفساد، فإنهم لو تقاعدوا عن الممكن، عم الفساد البلاد والعباد. وإذا أمروا بالتقاعد في قيام السلطان، كفاهم ذو الأمر المهمات، وأتاها على أقرب الجهات.
وقد قال بعض العلماء: لو خلا الزمان عن السلطان فحق على قطان كل بلدة، وسكان كل قرية، أن يقدموا من ذوي الأحلام والنهى، وذوي العقول والحجا من يلتزمون امتثال إشاراته وأوامره، وينتهون عن مناهيه ومزاجره ; فإنهم لو لم يفعلوا ذلك، ترددوا عند إلمام المهمات، وتبلدوا عند إظلال الواقعات. –غياث الأمم: 386-388
“যদি এমন যমানা আসে, যখন শক্তি ও সক্ষমতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগ্য কোনও ইমাম নেই, তাহলে নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কীভাবে পরিচালিত হবে; যখন তা অক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে? (এর সমাধানে) বলবো,
– যেসব বিষয় জনগণ নিজেরাই আদায় করে নেওয়ার বৈধতা আছে, তবে আদব হলো দায়িত্বশীল ও বিশিষ্টজনদের অবহিতি ও নির্দেশনা সাপেক্ষে করা; যেমন: জুমআ কায়েম, জিহাদের জন্য বাহিনী প্রেরণ, হত্যা অথবা যখমের কিসাস নেওয়া- ইমাম না থাকার সময়ে জনগণ নিজেরাই সেগুলো আঞ্জাম দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
– ইমাম না থাকার সময়ে যদি শক্তিধর কতক দল যমিনে সন্ত্রাস ও ফাসাদ বিস্তারকারীদের থেকে জনচলাচলের পথঘাটসমূহের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে তা (শুধু বৈধই নয়, বরং) অতি গুরুত্বপূর্ণ আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকারের কাজ হবে।
– নিজেরা অস্ত্র প্রয়োগ করা থেকে জনগণকে বারণ করা হবে তো তখন, যখন মুসলিমদের দেখাশুনা করার মতো দায়িত্বশীল থাকবে। পক্ষান্তরে যখন কোনো সুলতান থাকবে না, ঈমানদারকে উপর থেকে ধ্বংসাত্মক বিপদাপদ প্রতিহত করার ময়দানে সামর্থ্যানুসারে এগিয়ে আসা তখন আবশ্যক।
(ইমামের অনুমতি ব্যতীত) জনগণ নিজেরাই (এসব বিষয়ে) পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা নিষেধ করেছিলাম অধিকতর শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও ভালো কামিয়াবি অর্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য। কেননা, সুলতান নিজে যে বিষয়ের পদক্ষেপ নেন ও পরিচালনা করেন, সেটি তুলনামূলক অধিক কার্যকর ও সফল হয়। বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা কম হয়। জনগণকে বিচারাচার ও অস্ত্র প্রয়োগের স্বাধীনতা দিয়ে দিলে অনেক রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, যা কোনও বিবেকবান ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারবে না।

কিন্তু জনগণের সার্বিক দেখাশুনার মতো যোগ্য ইমাম যদি না থাকে, যার কাছে তারা আশ্রয় নেবে- তাহলে যতটুকু ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করার সামর্থ্য তাদের আছে, ততটুকুও আঞ্জাম না দিয়ে বসে থাকতে আদেশ দেওয়া একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, যতটুকু সামর্থ্যে আছে, ততটুকু যদি আঞ্জাম না দেয়, তাহলে দেশ-জনগণ সবকিছুই ফাসাদে ভরে যাবে। পক্ষান্তরে যখন সুলতান (থাকবে এবং সুলতান) নিজে এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তখন জনগণকে এসব বিষয় থেকে দূরে থাকার আদেশ দিলে (সমস্যার কিছু নেই, কারণ) তখন যোগ্য ব্যক্তি দরকার মেটাচ্ছেন এবং সর্বোত্তম পন্থায় তা বাস্তবায়ন করছেন।
কোনো কোনো আলেম তো বলেছেন, সুলতান না থাকার সময়ে প্রত্যেক এলাকা ও জনপদের অধিবাসীদের কর্তব্য হল, বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন একজন জ্ঞানীকে নিজেদের দায়িত্বশীল বানিয়ে নেওয়া। যাঁর আদেশ নিষেধ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। কেননা, এমনটা না করলে সংকটজনক পরিস্থিতি দেখা দিলে তাদেরকে দিশেহারা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতে হবে।”- গিয়াসুল উমাম: ৩৮৬-৩৮৮
তিনি আরও বলেন,
فإذا شغر الزمان عن الإمام وخلا عن سلطان ذي نجدة وكفاية ودراية، فالأمور موكولة إلى العلماء، وحق على الخلائق على اختلاف طبقاتهم أن يرجعوا إلى علمائهم، ويصدروا في جميع قضايا الولايات عن رأيهم، فإن فعلوا ذلك، فقد هدوا إلى سواء السبيل، وصار علماء البلاد ولاة العباد. فإن عسر جمعهم على واحد استبد أهل كل صقع وناحية باتباع عالمهم. وإن كثر العلماء في الناحية، فالمتبع أعلمهم، وإن فرض استواؤهم … فالوجه أن يتفقوا على تقديم واحد منهم. –غياث الأمم: 391
“প্রজ্ঞাসম্পন্ন শক্তিধর কোনো ইমাম অথবা সুলতান না থাকার সময়ে নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের দায়-দায়িত্ব আলেমদের উপর বর্তাবে। উম্মাহর সকল শ্রেণির লোকের জন্য আবশ্যক, আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া এবং নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের সকল বিষয়ে তাদের কথা মতো চলা। এমনটা করলে তারা সঠিক পথের দিশা পাবে। আলেমগণ তখন শাসকদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাবেন।
যদি সকলে মিলে একজন আলেমকে মেনে চলবে- এই ব্যবস্থাপনা কষ্টসাধ্য হয়, তাহলে প্রত্যেক এলাকার অধিবাসীরা তাদের নিজেদের আলেমকে মেনে চলবে। এক এলাকায় অনেক আলেম থাকলে যিনি বড় আলেম, তিনি হবেন অনুসরণীয়। সকল আলেম সমান স্তরের হলে … সকলে মিলে তাদের মধ্য থেকে একজনকে দায়িত্বশীল বানিয়ে নেবে।”– গিয়াসুল উমাম: ৩৯১
জুওয়াইনি রহিমাহুল্লাহ এর বক্তব্য থেকে বুঝা গেল:
* শক্তি প্রয়োগ ও অস্ত্র ব্যবহারের দরকার পড়ে যেসব বিষয়ে, সেগুলোতে জনসাধারণ দখল দিবে না ওই সময়, যখন সুলতান থাকবেন এবং তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পক্ষান্তরে যখন সুলতান থাকবে না, তখন জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।
* এমনিভাবে সুলতান না থাকার সময়ে উলামায়ে কেরাম সুলতান ও দায়িত্বশীলদের স্থলাভিষিক্ত হবেন। তখন তাঁদের আর পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। জিহাদ, আমর বিল মারূফ, নাহী আনিল মুনকার, ঈদ, জুমা, হুদুদ, কিসাস ইত্যাদি সব কিছু তখন তাঁদের দায়িত্বে বর্তাবে। জনগণকে সাথে নিয়ে শরীয়তের সব বিধান বাস্তবায়ন করা তখন উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব।
***
দৃষ্টি আকর্ষণ: নেতৃত্ব তলব করা তখন নিন্দনীয় যখন তা আমি না নিলেও সহীহভাবে চলমান থাকবে। তখন নেতৃত্ব তলব করা লোভের আলামত। পক্ষান্তরে যখন তা অযোগ্যদের দখলে চলে যায় কিংবা নেতৃত্ব-শূন্য জাতি হতাশার তীহ ময়দানে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকে: তখন নেতৃত্ব হাতে নেওয়া শুধু জায়েযই নয়, বরং আবশ্যক। এ সময় যোগ্য লোকেরা এগিয়ে না আসলে গুনাহগার হবে এবং আল্লাহর দরবারে পাকড়াও হতে হবে।
এ কারণে আমরা দেখতে পাই, আমাদের আকাবিরগণ খানকা ছেড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হন। ইংরেজ খেদাও এবং খিলাফত রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়াজ-নসীহতের ময়দানে আত্মনিয়োগ করেন।
তাঁরা যতটুকু পেরেছেন করে গেছেন। উম্মাহর ভবিষ্যত এখন বর্তমানদের হাতে। উম্মাহর নেতৃত্বে এখন তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। ‘আমরা নেতৃত্ব চাই না’ এই ধারণা, এই স্লোগান ছুঁড়ে ফেলতে হবে। বরং আমরা জাতিকে নেতৃত্ব দিবো- যতদিন না আল্লাহর যমিন আল্লাহর শাসনের অধীনে ফিরে আসে। এরপর আমরা বলতে পারি, আমরা নেতৃত্ব চাই না। এর আগে নয়। ওয়াল্লাহু আলাম।
এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত তাহকীকের জন্য নিম্নোক্ত কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে;
০১. ফতোয়া শামী, কিতাবুল কাজা (বিশেষত শুরু অংশ)।
০২. ইলাউস সুনান, কিতাবুল কাজার শুরু অংশ।
০৩. তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, কিতাবুল ইমারার শুরু অংশ।
০৪. ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ -এর ‘আসসিয়াসাতুশ শারঈয়াহ’ এবং মাজমুউল ফাতাওয়ার ‘কিতাবুল জিহাদ (২৮ নং খণ্ড)।
০৫. ইমাম জুওয়াইনি রহিমাহুল্লাহ -এর ‘গিয়াসুল উমাম’।
***
বিশেষ ফায়েদার দিকে লক্ষ করে ‘ফায়েদা’ শিরোনামে আহলে ইলমদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি;
ফায়েদা -০১: নেতৃত্ব দেওয়া দীনের সুমহান দায়িত্ব ও একটি নেক কাজ । মুসলিমদের হাতে নেতৃত্ব থাকা ব্যতীত মুসলিমদের দীন দুনিয়া উভয়টি অচল ।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ (৭২৮ হি.) বলেন,
يجب أن يعرف أن ولاية أمر الناس من أعظم واجبات الدين، بل لاقيام للدين ولا للدنيا إلا بها. فان بنى آدم لا تتم مصلحتهم إلا بالاجتماع لحاجة بعضهم إلى بعض. ولابد لهم عند الاجتماع من رأس. حتى قال النبى: (إذا خرج ثلاثة فى سفر فليؤمروا أحدهم). رواه أبو دواد من حديث أبى سعيد وابى هريرة. وروى الإمام أحمد فى المسند عن عبد الله بن عمرو أن النبى قال: (لا يحل لثلاثة يكونون بفلاة من الأرض إلا أمروا عليهم أحدهم)

. فأوجب تأمير الواحد فى الاجتماع القليل العارض فى السفر تنبيها بذلك على سائر أنواع الاجتماع. ولأن الله تعالى أوجب الأمر بالمعروف والنهى عن المنكر. ولا يتم ذلك إلا بقوة وإمارة. وكذلك سائر ما أوجبه من الجهاد والعدل وإقامة الحج والجمع والأعياد ونصر المظلوم وإقامة الحدود لا تتم إلا بالقوة والامارة. –مجموع الفتاوى: 28\390
“জেনে রাখা আবশ্যক যে, জনগণের নেতৃত্ব দেওয়া দীনের সুমহান আবশ্যিক দায়িত্ব। শুধু তাই নয়, এটি ব্যতীত বরং দীন-দুনিয়া কোনোটাই চলতে পারে না। কেননা, পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধ হওয়া ব্যতীত মানব জাতির মাসলাহাত সমূহের পরিপূর্ণতা সম্ভব নয়। কারণ, তারা একে অপরের মুখাপেক্ষী। আর ঐক্যবদ্ধ হতে গেলে তাদের একজন নেতা আবশ্যক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এমনটি পর্যন্ত বলেছেন: إذا خرج ثلاثة فى سفر فليؤمروا أحدهم –‘‘তিন ব্যক্তি সফরে বের হলে তারা যেন একজনকে নিজেদের আমীর বানিয়ে নেয়।’’ ইমাম আবু দাউদ রহিমাহুল্লাহ হাদীসটি হযরত আবু সায়িদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ রহিমাহুল্লাহ মুসনাদে আহমদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: لايحل لثلاثة يكونون بفلاة من الأرض إلا أمروا عليهم أحدهم – “যে কোনো তিন ব্যক্তির জন্য কোনো মরু ময়দানে অবস্থান করা জায়েয হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের একজনকে নিজেদের আমীর বানিয়ে নেয়।”

সফরের হালতে সৃষ্টি হওয়া ছোট্ট একটি জামাআতের বেলায়ও একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন, একথা বুঝানোর জন্য যে, সব ধরনের জামাআতের ক্ষেত্রেই আমীর বানিয়ে নেওয়া আবশ্যক। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা ‘আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার’ ফরয করেছেন। আর তা প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব ব্যতীত পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তদ্রূপ জিহাদ, ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা; হজ, জুমআ ও ঈদ কায়েম করা; মাজলুমকে সাহায্য করা, হদসমূহ কায়েম করা ইত্যাদিসহ আল্লাহ তাআলার ফরযকৃত যাবতীয় বিধান প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব ব্যতীত পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০
ফায়েদা ০২: দারুল হারবেও মুসলিমরা নেতৃত্ব শূন্য থাকতে পারবে না
ইমাম সারাখসি রহিমাহুল্লাহ (৪৯০ হি.) বলেন,
لا يجوز ترك المسلمين سدى ليس عليهم من يدبر أمورهم في دار الإسلام ولا في دار الحرب. -شرح السير الكبير (ص: 803)
“পরিচালনা করবে মতো কোনো অভিভাবকহীন অবস্থায় মুসলিমদেরকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে রাখা জায়েয নয়; দারুল ইসলামেও না, দারুল হারবেও না।” –শারহুস সিয়ালিল কাবীর: ৮০৩
ইবনুল হুমাম রহিমাহুল্লাহ (৮৬১ হি.) বলেন,
وإذا لم يكن سلطان ولا من يجوز التقلد منه -كما هو في بعض بلاد المسلمين غلب عليهم الكفار، كقرطبة في بلاد المغرب الآن وبلنسية وبلاد الحبشة، وأقروا المسلمين عندهم على مال يؤخذ منهم: يجب عليهم أن يتفقوا على واحد منهم يجعلونه واليا فيولى قاضيا أو يكون هو الذي يقضي بينهم، وكذا ينصبوا لهم إماما يصلي بهم الجمعة. -فتح القدير: 7\264
“যখন সুলতান অথবা এমন (কর্তৃত্বের অধিকারী) ব্যক্তি না থাকে, যিনি কাজী নিয়োগ দিতে পারেন; যেমন বর্তমান মাগরিবের কর্ডোবা, ভ্যালেন্সিয়া ও আবিসিনিয়ার মতো যেসব মুসলিম রাষ্ট্রে কাফেররা দখল দারিত্ব কায়েম করেছে এবং মুসলিমদের থেকে সম্পদ গ্রহণের বিনিময়ে তাদেরকে সেখানে বহাল রেখেছে: সেসব অঞ্চলের মুসলিমদের ওপর ফরয, একমত হয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে শাসক নির্ধারিত করা, যিনি তাদের জন্য বিচারক নিয়োগ দিবেন কিংবা নিজে তাদের বিচারকার্য সম্পাদন করবেন। একইভাবে তাদের ওপর ফরয একজন ইমাম নিয়োগ করা, যিনি তাদের নিয়ে জুমআ আদায় করবেন।” -ফাতহুল কাদীর: ৭/২৬৪
আরও দেখুন রদ্দুল মুহতার: ৮/৪৩
ফায়েদা ০৩: নেতৃত্বহীন অবস্থায় জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে
জুওয়াইনি রহিমাহুল্লাহ (৪৭৮ হি.) বলেন,
وإنما ينهى آحاد الناس عن شهر الأسلحة استبدادا إذا كان في الزمان [وزر] قوام على أهل الإسلام، فإذا خلا الزمان عن السلطان، وجب البدار على حسب الإمكان إلى درء البوائق عن أهل الإيمان. … وإذا لم يصادف الناس قواما بأمورهم يلوذون به فيستحيل أن يؤمروا بالقعود عما يقتدرون عليه من دفع الفساد، فإنهم لو تقاعدوا عن الممكن، عم الفساد البلاد والعباد. –غياث الأمم: 387
“নিজেরা অস্ত্র প্রয়োগ করা থেকে জনগণকে বারণ করা হবে তো তখন, যখন মুসলিমদের দেখাশুনা করার মতো দায়িত্বশীল থাকবে। পক্ষান্তরে যখন কোনো সুলতান থাকবে না, ঈমানদারকে উপর থেকে ধ্বংসাত্মক বিপদাপদ প্রতিহত করার ময়দানে সামর্থ্যানুসারে এগিয়ে আসা তখন আবশ্যক। … জনগণের সার্বিক দেখাশুনার মতো যোগ্য ইমাম যদি না থাকে, যার কাছে তারা আশ্রয় নেবে: তাহলে যতটুকু ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করার সামর্থ্য তাদের আছে, ততটুকুও আঞ্জাম না দিয়ে বসে থাকতে আদেশ দেওয়া একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, যতটুকু সামর্থ্যে আছে, ততটুকুও যদি আঞ্জাম না দেয়, তাহলে দেশ-জনগণ সবকিছুই ফাসাদে ভরে যাবে।” -গিয়াসুল উমাম: ৩৮৭
ফায়েদা ০৪: যোগ্য লোকদেরকে দায়িত্ব নিতে উদ্বুদ্ধ করা জনগণের দায়িত্ব
শাতিবি রহিমাহুল্লাহ (৭৯০ হি.) বলেন,
فمن كان قادرا على الولاية؛ فهو مطلوب بإقامتها، ومن لا يقدر عليها؛ مطلوب بأمر آخر، وهو إقامة ذلك القادر وإجباره على القيام بها؛ فالقادر إذًا مطلوب بإقامة الفرض، وغير القادر مطلوب بتقديم ذلك القادر. -الموافقات (1/ 284)
“দায়িত্ব নিতে যে সক্ষম তাঁর থেকে কাম্য হচ্ছে দায়িত্ব নেওয়া। দায়িত্ব নিতে যে সক্ষম নয় তার থেকে কাম্য হচ্ছে আরেকটি বিষয়। সেটি হলো, সেই যোগ্য জনকে দাঁড় করানো এবং দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা।” –আল-মুওয়াফাকাত: ১/২৮৪
ফায়েদা ০৫: নেতৃত্বহীন জাতির পরিচালনায় এগিয়ে আসা উলামায়ে কেরামের অবশ্য কর্তব্য
জুওয়াইনি রহিমাহুল্লাহ (৪৭৮ হি.) বলেন,
فإذا شغر الزمان عن الإمام وخلا عن سلطان ذي نجدة وكفاية ودراية، فالأمور موكولة إلى العلماء … وصار علماء البلاد ولاة العباد. –غياث الأمم: 391
“প্রজ্ঞাসম্পন্ন শক্তিধর কোনো ইমাম বা সুলতান না থাকার সময়ে নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের দায়-দায়িত্ব আলেমদের উপর বর্তাবে। … আলেমগণ তখন শাসকদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাবেন।” -গিয়াসুল উমাম: ৩৯১
ফায়েদা ০৬: প্রয়োজনের সময় যোগ্য লোকদের দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসা কর্তব্য
মাওয়ারদি রহিমাহুল্লাহ (৪৫০ হি.) বলেন,
فإذا ثبت وجوب الإمامة ففرضها على الكفاية كالجهاد وطلب العلم. فإذا قام بها من هو من أهلها سقط فرضها على الكفاية، وإن لم يقم بها أحد خرج من الناس فريقان: أحدهما: أهل الاختيار حتى يختاروا إماما للأمة. والثاني: أهل الإمامة حتى ينتصب أحدهم للإمامة. -الأحكام السلطانية للماوردي (ص: 17)
“যখন সাব্যস্ত হলো যে, ইমামত আবশ্যক, সুতরাং পরের কথা হলো, এটি ফরযে কিফায়া; যেমন জিহাদ এবং ইলম অর্জন। যোগ্য লোক যদি (সকল শর্তসহ) ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করে নেয় তাহলে ফরযে কেফায়া (সকলের তরফ থেকে) আদায় হয়ে যাবে। যদি কেউই (এখনও) যথাযথভাবে দায়িত্বটি গ্রহণ না করে থাকে (এবং ইমামতের পদটি শূন্য পড়ে থাকে) তাহলে দুই শ্রেণির (যোগ্য) লোককে (এটির তৎপরতায়) সামনে আসতে হবে। এক. আহলুল ইখতিয়ার। তারা (যোগ্য) একজনকে উম্মাহর ইমাম নির্বাচন করবে। দুই. ইমাম হওয়ার গুণাবলি সম্পন্ন লোকজন। তাদের একজন ইমামতের দায়িত্বটি গ্রহণ করবে।” –আল-আহকামুস সুলতানিয়া: ১৭
ফায়েদা ০৭: জনস্বার্থে ও দীন কায়েমের উদ্দেশ্যে নেতৃত্ব চাওয়া নিষেধ নয়
জফর আহমাদ থানবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
إن طلب الإمارة والقضاء من حيث الإمارة والحكومة لحب المال والرياسة والشرف: منهي عنه مطلقا، سواء كان بالقلب وحده أو باللسان أيضا؛ لكونه من ناحة الدنيا لا الدين. وأما طلبها لا من حيث الإمارة، بل إرادة الإصلاح بين الناس وإقامة العدل فيهم والقضاء بالحق لما فى العدل من الأجر الجزيل: فليس بمنهي عنه، لا بالقلب ولا باللسان. –إعلاء السنن: 15\46-47
“সম্পদ, নেতৃত্ব এবং মান-মর্যাদার লোভে আমীর অথবা কাজীর পদ এই দৃষ্টিকোণ থেকে চাওয়া যে এটি একটি নেতৃত্ব ও হুকুমত: তা সর্বাবস্থায় নিষেধ; শুধু মনে মনে কামনা করুক কিংবা মুখেও চেয়ে থাকুক। যেহেতু এক্ষেত্রে দুনিয়াবি দিক থেকে চাওয়া হচ্ছে, দীনের তাগাদায় নয়। পক্ষান্তরে এ দৃষ্টিকোণ থেকে নয় যে এটি একটি নেতৃত্ব; বরং মানুষদের মাঝে সঠিকভাবে মীমাংসা করে দেওয়া, আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং হকপন্থায় বিচারাচার করার নিয়তে তা চাওয়া- যেহেতু ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাঝে অনেক ফযীলত: এ দৃষ্টিকোণ থেকে চাওয়া নিষেধ নয়। না মনে মনে কামনা করা নিষেধ, না মুখে চাওয়া নিষেধ।” –ইলাউস সুনান: ১৫/৪৬-৪৭
আরও দেখুন তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম: ৯/১৬৭-১৬৮
ফায়েদা ০৮: যিনিই একমাত্র যোগ্য, নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া তাঁর জন্য আবশ্যক
জুওয়াইনি রহিমাহুল্লাহ (৪৭৮ হি.) বলেন,
فأما إذا اتحد من يصلح، وفي العصر من يختار ويعقد، فهذا ينقسم قسمين: أحدهما – أن يمتنع من هو من أهل العقد عن الاختيار والعقد، بعد عرض الأمر عليه على قصد، فإن كان كذلك فالمتحد في صلاحه للإمامة يدعو الناس، ويتعين إجابته واتباعه على حسب الاستطاعة بالسمع والطاعة. -غياث الأمم في التياث الظلم (ص: 318)
“ইমাম হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন যদি শুধু একজন লোকই থেকে থাকেন … অপরদিকে আহলুল (হল ওয়াল) আকদ যারা, তাদের সামনে পেশ করার পরও বিনা কারণে তাঁরা ইমাম নিয়োগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন: তাহলে ইমাম হওয়ার মতো একক যোগ্যতা সম্পন্ন যিনি আছেন, তিনি (তিনি নিজেই মাঠে নেমে আসবেন এবং) জনসাধারণকে নিজের দিকে আহ্বান করবেন।” –গিয়াসুল উমাম: ৩১৮
তিনি আরও বলেন,
أن الذي تفرد بالاستحقاق يجب عليه أن يتعرض للدعاء إلى نفسه، والتسبب إلى تحصيل الطاعة، والانتهاض لمنصب الإمامة. -غياث الأمم في التياث الظلم (ص: 323)
“যোগ্যতা বলে খলীফা হওয়ার উপযুক্ত যদি কেবল একজন লোকই থাকেন, তাহলে তাঁর জন্য আবশ্যক: লোকজনকে নিজের দিকে আহ্বান করা, তাঁর প্রতি লোকদের আনুগত্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালানো এবং ইমামের পদটি লাভের জন্য উঠে দাঁড়ানো।” –গিয়াসুল উমাম: ৩২৩
ইবনে আবিদীন শামী রহিমাহুল্লাহ (১২৫২ হি.) বলেন,
أما إذا تعين بأن لم يكن أحد غيره يصلح للقضاء وجب عليه الطلب صيانة لحقوق المسلمين ودفعا لظلم الظالمين. -الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (5/ 366)“পক্ষান্তরে কাজীর পদটি যদি তাঁর জন্য অবধারিত হয়ে পড়ে; যেমন ধরুন কাজী হওয়ার উপযুক্ত সে ব্যতীত আর কেউ নেই: তাহলে তাঁর জন্য পদটি চেয়ে নেওয়া আবশ্যক। মুসলিমদের অধিকার সমূহ রক্ষার্থে এবং জালেমদের জুলুম প্রতিহত করণের স্বার্থে।” –রদ্দুল মুহতার: ৫/৩৬৬
ফায়েদা ০৯: একমাত্র যিনি যোগ্য, দায়িত্ব গ্রহণ না করে ইবাদতে মগ্ন হয়ে যাওয়া তাঁর জন্য নাজায়েয
জুওয়াইনি রহিমাহুল্লাহ (৪৭৮ হি.) বলেন,
أن الذي تفرد بالاستحقاق يجب عليه أن يتعرض للدعاء إلى نفسه، والتسبب إلى تحصيل الطاعة، والانتهاض لمنصب الإمامة. فإن لم يعدم من يطيعه، وآثر التقاعد، والاستخلاء لعبادة الله [عز وجل] مع علمه بأنه لا يسد أحد مسده – كان ذلك عندي من أكبر الكبائر، وأعظم الجرائر، وإن ظن ظان أن انصرافه وانحرافه سلامة، كان ما حسبه باطلا قطعا. -غياث الأمم في التياث الظلم (ص: 323)
“… … … (খিলাফতের একমাত্র যোগ্যতা সম্পন্ন লোকটি যদি) তাঁর আনুগত্যে সাড়া দেয়ার মতো মানুষের অভাব না দেখেন, এতদসত্ত্বেও যদি তিনি বসে থাকাকে অগ্রাধিকার দেন, ইবাদতে মনোনিবেশ করাকে প্রাধান্য দেন, অথচ তিনি জানেন যে, তাঁর এ শূন্যতা অন্য কেউ পূরণ করতে পারবে না: তাহলে আমার মতে এটি (শুধু কবীরা গুনাহই না, বরং) আকবারুল কাবায়ির এবং অতি ভয়ানক অপরাধ। কেউ যদি এমনটা মনে করে যে, দূরে থাকাই তো নিরাপদ তাহলে সে যে ধারণা করেছে কোনও সন্দেহ নেই যে এটি সম্পূর্ণ একটি বাতিল ধারণা।” –গিয়াসুল উমাম: ৩২৩
ফায়েদা ১০: যোগ্যদের মধ্য থেকে কেউই এগিয়ে না আসলে সকল যোগ্য গুনাহগার হবে
ইনায়া গ্রন্থকার (৭৮৬ হি.) বলেন,
فإذا كان في البلد قوم يصلحون للقضاء فامتنع كل واحد منهم عن الدخول فيه أثموا إن كان السلطان بحيث لا يفصل بينهم وإلا فلا، ولو امتنع الكل حتى قلد جاهل اشتركوا في الإثم لأدائه إلى تضييع أحكام الله تعالى. -العناية شرح الهداية (7/ 262)
“কাজী হওয়ার মতো একদল লোক এলাকায় আছেন। কিন্তু কাজীর পদটি গ্রহণ করতে সকলেই অস্বীকৃতি জানায়। তাহলে সকলেই গুনাহগার হবেন। … যোগ্যদের সকলে বিরত থাকার ফলে শেষে যদি কোনো অজ্ঞকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে সকল যোগ্য গুনাহগার হবেন। কারণ, এটি আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান বিনষ্ট হওয়ার দিকে ঠেলে দিবে।” –ইনায়া: ৭/২৬৩
অর্থাৎ যেহেতু অজ্ঞ লোকের পক্ষে সঠিক বিচারাচার করা সম্ভব হবে না। সে হালালকে হারাম করবে হারামকে হালাল করবে । এর গুনাহ সকলের ঘাড়ে বর্তাবে।
ফায়েদা ১১: প্রয়োজনের সময় নিজের যোগ্যতা তুলে ধরে পদ চাওয়া জায়েয, যেমনটা করেছেন ইউসুফ আলাইহিস সালাম
ইবনে আতিয়া আন্দালুসি রহিমাহুল্লাহ (৫৪২ হি.) বলেন,
فجائز للفاضل أن يعمل وأن يطلب العمل إذا رأى ألا عوض منه. وجائز أيضا للمرء أن يثني على نفسه بالحق إذا جهل أمره. –تفسير ابن عطية = المحرر الوجيز في تفسير الكتاب العزيز (3/ 256)
“দীনদার মহৎ ব্যক্তির জন্যও পদ নেওয়া এবং পদ তলব করা জায়েয- যখন দেখেন যে, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে পারার মতো যোগ্য কেউ নেই । যদি তাঁর যোগ্যতার বিষয়টি লোকজনের জানা না থাকে, তাহলে নিজের মাঝে বিদ্যমান বাস্তবিক গুণ-জ্ঞান তুলে ধরতেও সমস্যা নেই।”–তাফসীরে ইবনে আতিয়া: ৩/২৫৬
আরও দেখুন ইলাউস সুনান: ১৫/৪৮
***

আরও পড়ুনঃ ঝড়ের পূর্বাভাস: বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন এর জন্য বিকল্প পথ

Related Articles

Back to top button