করোনাভাইরাস : কখন আমাদের তাওবাহ কবুল হবে?
উলামায়ে কেরামের প্রতি : করোনা ভাইরাস : কখন আমাদের তাওবাহ কবুল হবে?
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
শায়খ আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আলমাহদী হাফিযাহুল্লাহ
করোনা ভাইরাস। মহান আল্লাহর এমন এক মাখলুক, যা মশা-মাছির চেয়েও ক্ষুদ্র। এই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সমগ্র বিশ্ব আজ স্তব্ধ। নিজেদের সামান্য শক্তির দাপটে যামানার ফিরাউন নমরুদরা যখন পা মাটিতে রাখতে পারছিলো না, তখন আল্লাহ দেখিয়ে দিলেন, তোমরা যতো শক্তিশালীই হও, তোমাদের ধ্বংস করার জন্য মশারও প্রয়োজন নেই!
أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَانُوا أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَأَثَارُوا الْأَرْضَ وَعَمَرُوهَا أَكْثَرَ مِمَّا عَمَرُوهَا. الروم:9
“তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? তাহলে দেখতো তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছিলো? তারা ছিলো শক্তিতে এদের অপেক্ষা প্রবল! ভূমিকে এরা যেই পরিমাণ আবাদ করেছে, তার চেয়ে বেশি চাষাবাদ করেছিলো তারা!” -সূরা রূম:৯
আল্লাহর এই ক্ষুদ্র মাখলুক, যা খালি চোখে দেখা যায় না, তার প্রকোপে সমগ্র বিশ্ব আজ অবরুদ্ধ। প্রাচীন পরাশক্তি রোম-ইটালি এবং আধুনিক পরাশক্তি চীন, আমেরিকা থেকে শুরু করে খাদেমুল হারামাইনের মামলাকা পর্যন্ত – সমগ্র বিশ্বই আজ রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করে একসঙ্গে গৃহবন্দী।
দুনিয়াতে আল্লাহ যে আযাব দেন, তা বস্তুত আযাব নয়; আযাবের সামান্য নমুনা মাত্র। কিন্তু আযাবের এই সামান্য নমুনার উত্তাপেই যমানার কুখ্যাত যে দাম্ভিকেরা আল্লাহকে গালি দিতো, আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), দ্বীন ও শরীয়ত নিয়ে বিদ্রূপ করতো, তারাও আজ সেই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও শরীয়তের মালিক আল্লাহর করুণার জন্য ভিক্ষার ঝুলি বাড়িয়ে বসেছে। হ্যাঁ, এটাই তাদের চরিত্র!
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ. عنكبوت:65
“যখন তারা নৌযানে আরোহণ করে, একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহকে ডাকে। অত:পর যখন তিনি তাদের বিপদমুক্ত করে তীরে নিয়ে আসেন, তখন তারা তাঁর সঙ্গে শিরক করে।” -সূরা আনকাবূত: ৬৫
কিন্তু আমরা যারা মুসলিম, আমাদের কী করণীয় এবং আমরা কী করছি?
যারা অপরাধী এবং যারা অপরাধী নয়, হাদীসে তাদের তুলনা করা হয়েছে হয়েছে জাহাজের নিচ তলা আর দোতলার যাত্রীর সাথে। নিচ তলার যাত্রীরা পানির প্রয়োজনে যদি জাহাজ ফুটো করে, আর দোতলার লোকেরা যদি তা প্রতিহত না করে, তাহলে জাহাজ যেমন দুই দলকেই নিয়েই পানিতে তলিয়ে যাবে, ঠিক তেমনি – যারা অপরাধী নয়, তারা যদি অপরাধীদের অপরাধ বন্ধ না করে, তবে আল্লাহর আযাবও উভয় দলকে পাকড়াও করবে।
বড়ো শানদার ও যথার্থ উদাহরণ!
দোতলার লোকেরা যদি মনে করে –
আমরা নিজেরাই তো এখনো জাহাজের নিরাপত্তা বিধিগুলো পূর্ণ মেনে চলছি না, সুতরাং আগে আমাদের নিজেদের আমল ঠিক করি, তারপর অন্যদের চিন্তা করি!
দোতলায় অনুমোদনের চেয়ে দুজন যাত্রী বেশি উঠেছে, সুতরাং নসীহত করে ‘ইছারে’র জন্য দুজনকে প্রস্তুত করি, তারা নেমে যাক।
দোতলার নিরাপত্তার জন্য ২০টি বয়ার দরকার। আছে ১৮টি। আরো দুটি বয়ার ব্যবস্থা কর!
নাবিকের সামনে দুজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে, সামনে ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না, আগে তাদেরকে সরিয়ে দাও!
আমাদের এই আমলগুলো ঠিক হলে নিচ তলার লোকেরা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে!
কিংবা দোতলার কয়েকজন হয়তো দায়িত্ব নিয়ে নিচতলার লোকদের অনুনয় বিনয় করে তাদের এই দুষ্কর্মের ভয়াবহতা বোঝাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু নিচতলার লোকেরা বুঝলো না। তারপর দোতলার লোকেরা, ‘আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করেছি; আমাদের আর কী করার আছে’, বলে থেমে গেলো।
এমন চিন্তা কি সঠিক হবে?
প্রিয় পাঠক! কী মনে করেন?
দোতলার লোকেরা কি এভাবে নিজেদের আমলগুলো আরো সুন্দর, নিখুঁত এবং মানসম্মত করলে বেঁচে যাবে? নাকি বাঁচার একমাত্র পথ হলো নিচ তলার সেই দুষ্কৃতিকারীদের হাতগুলো শক্ত করে চেপে ধরা? আর তাতেও যদি তারা না থামে, তাহলে তাদের হাতগুলো ভেঙ্গে দেয়াই কি একমাত্র বাঁচার উপায় নয়? এই মুহূর্তে এটাই দোতলার ভালো মানুষগুলোর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল নয় কি?
সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল ছেড়ে দিয়ে নিজেদের আমল ঠিক করার দাবি বোকামি কিংবা প্রতারণা নয় কি?
আফসোসের বিষয়, দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দী ধরে আমরা সেই বোকামি ও প্রতারণাই করে চলেছি। নিজেদের সাথে এবং উম্মাহর সাথে।
আজ যখন করোনা ভাইরাসের আযাবে সমগ্র বিশ্ব বিপর্যস্ত, ঠিক তখনো অজস্র নাফরমানিতে বিশ্ব নিমজ্জিত। কুফরি বিশ্ব তো বটেই, মুসলিম বিশ্বও আজ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম পাপগুলোতে নিমজ্জিত। মান ও পরিমাণ সব দিক থেকেই আজকের আধুনিক জাহেলিয়াত ছাড়িয়ে গেছে স্বীকৃত জাহেলিয়াতকেও। যে এক একটি পাপের বিস্তৃতির কারণে আল্লাহ এক একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এমন সব পাপ এখন চলছে একসঙ্গে এবং আরো নিকৃষ্ট উপায়ে চলছে।
জাহেলি যুগে লোকলজ্জার ভয়ে কন্যা সন্তানদের হত্যা করা হতো। আজকের আধুনিক জাহেলিয়াতে যারা কুকুর বিড়ালে পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে, তারাও অভাবের ভয়ে উভলিঙ্গের সন্তানদের হত্যা করে। জাহেলি যুগে পিতারা সন্তানদের হত্য করতো। আধুনিক জাহেলিয়াতে মায়েরাও নিজের সন্তানদের হত্যা করে। লূত আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের পুরুষদের সমকামিতার কারণে আল্লাহ তাদের সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এখন পুরুষ সমকামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে নারী সমকাম এবং শিশুকামও। তখন ছিলো তা ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত। এখন চলছে আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় বৈধতা দিয়ে এবং আইনি সমর্থন-সহায়তা দিয়ে। আগে যিনা ব্যভিচার হত অপরাধ হিসেবে, এখন হয় বৈধ পেশা হিসেবে। এই পেশা এবং যারা এ পেশায় যুক্ত তাদের ঘৃণা করাও নিষিদ্ধ। জাহেলি যুগে মাহারিমদের পরস্পরে ব্যভিচারের কথা শোনা যায় না, এখন সেটাও চলছে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়ে, মহাসমারোহে আয়োজন করে। জাহেলি যুগে হত্যা লুণ্ঠন ও জুলুম নির্যাতন হত বিচ্ছিন্ন। বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতিতে জাতিতে। এখন তা চলছে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আন্তর্জাতিক ঐক্যের মাধ্যমে। জাতিসংঘ শান্তি মিশন ও পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ও শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দিয়ে। অপরাধের এই চিত্রগুলো করোনাস্তব্ধ পৃথিবীতেও বন্ধ হয়নি; চাক্ষুস মৃত্যুর সামনে মৃত্যুভয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক ভাটা পড়েছে কেবল।
আমরা কি সেগুলো বন্ধ করেছি, কিংবা করার চেষ্টা করেছি?
মনে রাখবেন, আমরা দাওয়াত, তাবলীগ, তালীম, তাযকিয়া, ওয়াজ নসীহত এবং এরকম অনেক দ্বীনি কাজই করছি, কিন্তু আপন জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলো আমর বিল মারূফ বা নাহী আনিল মুনকার নয়। মুনকারের একমাত্র শরঈ সমাধান আমর বিল মারূফ এবং নাহী আনিল মুনকার। এছাড়া কস্মিনকালেও মুনকারের সমাধান হবে না! হবে না!!
আলহামদুলিল্লাহ, উম্মাহর কর্ণধার উলামায়ে কেরামের অনেকেই উম্মাহকে তাওবার প্রতি আহ্বান করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবেই উলামায়ে কেরাম তওবার কথা বলছেন। পাকিস্তানে আজ আল্লামা তাকী উসমানির নেতৃত্বে সকল উলামায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধভাবে তাওবার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের এই তওবা কী মহান রবের দরবারে কবুল হবে?
তওবার অনিবার্য শর্ত হলো, গুনাহ থেকে ফিরে আসা। কিন্তু সমগ্র মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধভাবে আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকারের ফরিযা ছেড়ে যে গুনাহ করেছি, তা থেকে কি আমরা ফিরে এসেছি?
নির্যাতিত মানব জাতিকে মুক্ত করার ফরজে আইন জিহাদ ছেড়ে দিয়ে আমরা যে গুনাহ করেছি, তা থেকে কি ফিরে এসেছি?
বড়ো বড়ো সকল মুনকারের প্রতিষেধক খলীফা নিয়োগ ও খিলাফত প্রতিষ্ঠা, হুদূদ কিসাসসহ শরীয়তের বিধান দ্বারা শাসন করার ফরিযা ছেড়ে যে গুনাহে লিপ্ত হয়েছি, তা কি এই মুহূর্তেও ছাড়তে পেরেছি?
যদি বলি সামর্থ্য নেই, তাহলে তা অর্জন না করার গুনাহ থেকে কি ফিরতে পেরেছি?
কিংবা এই গুনাহগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তা তা আমাদের কর্ম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছি?
হাদীসে এসেছে-
لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطّ، حَتّى يُعْلِنُوا بِهَا، إِلّا فَشَا فِيهِمُ الطّاعُونُ، وَالْأَوْجَاعُ الّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الّذِينَ مَضَوْا، وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ، إِلّا أُخِذُوا بِالسِّنِينَ، وَشِدّةِ الْمَئُونَةِ، وَجَوْرِ السّلْطَانِ عَلَيْهِمْ، وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ، إِلّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السّمَاءِ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا، وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللهِ، وَعَهْدَ رَسُولِهِ، إِلّا سَلّطَ اللهُ عَلَيْهِمْ عَدُوّا مِنْ غَيْرِهِمْ، فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ، وَيَتَخَيّرُوا مِمّا أَنْزَلَ اللهُ، إِلّا جَعَلَ اللهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ.
যখন কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়বে এমনকি তারা সেগুলো প্রচার করতে থাকবে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ (মহামারী) দেখা দেবে এবং এমন সব ব্যাধি ও কষ্ট ছড়িয়ে পড়বে, যা আগের মানুষদের মাঝে দেখা যায়নি।
যখন কোনো সম্প্রদায় ওজন ও মাপে কম দেবে তখন তাদের উপর নেমে আসবে দুর্ভিক্ষ, কঠিন অবস্থা এবং শাসকের যুলুম-অত্যাচার।
যখন কোনো কওম তাদের সম্পদের যাকাত আদায় করবে না তখন তাদের প্রতি আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। যদি জন্তু-জানোয়ার না থাকতো তাহলে আর বৃষ্টিপাত হতো না।
আর যখন কোনো জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে তখন আল্লাহ তাদের উপর কোনো বহিঃশত্রু চাপিয়ে দেবেন…
যখন কোনো সম্প্রদায়ের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করবে না আর আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানসমূহের কিছু গ্রহণ করবে আর কিছু ত্যাগ করবে তখন আল্লাহ তাদেরকে পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহ ও বিবাদে জড়িয়ে দেবেন।
-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪০১৯; হাদীসটি হাসান
আশা করি, সম্মানিত উলামায়ে কেরাম মেহেরবানি করে বিষয়টির প্রতি একটু সুদৃষ্টি দেবেন।