আগ্রাসনআমেরিকানশায়খ হাবিবুল্লাহ নাদিম

আফগান যুদ্ধে আমেরিকার নয়া পলিসি (১ম পর্ব)

আফগান যুদ্ধে আমেরিকার নয়া পলিসি (১ম পর্ব)

শায়খ হাবিবুল্লাহ নাদিম হাফিযাহুল্লাহ

 

সাম্রাজ্যবাদী নব্য ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম দেশগুলোকে কখনো শান্তিতে থাকতে দেয় না। একের পর এক ‘কাইন্ড অব ওয়ার’ (যুদ্ধের ধরন) আবিষ্কার করতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থায়ই যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত হতে দেয় না। এক পথে ব্যর্থ হলে নতুন পথ ধরে। সব যুদ্ধে তার মূল উদ্দেশ্য থাকে, পৃথিবীর সকল শক্তিকে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সামনে অবনত করা, সবাইকে তার মধ্যে লীন হতে বাধ্য করা। কেউ যেন তার কোনো পদক্ষেপের ব্যাপারে উচ্চবাচ্য না করে, এ ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। মার্কিনিরা বিভিন্ন অঞ্চলের সম্পদ চুরি করবে, সকলের সভ্যতা-সংস্কৃতির স্বকীয়তা মুছে দিয়ে সবার ওপর অপরিহার্যভাবে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা-সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবে, ইসলামের নাম-নিশানা বা স্বাতন্ত্র্য পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তথাকথিত মানবাধিকারের নামে মুসলমানদের দীনি অধিকার কেড়ে নেবে, তার অর্থনীতিকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত করবে আর তার যেকোনো প্রতিপক্ষ মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই তাদের স্কন্ধে দাসত্বের শৃঙ্খল পরাবে।

সর্বোপরি আমেরিকার লক্ষ্য হচ্ছে, তার ঘোরতর শত্রুরাও তার ইচ্ছার সামনে নতি স্বীকার করবে এবং স্বেচ্ছায় বা বাধ্যগতভাবে তাদের কর্তৃত্ব বরণ করে নেবে। যদি তার এই লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে কোনো এক পন্থা ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে সে তার থিংক ট্যাংকগুলোর নির্দেশনা অনুসারে নিত্যনতুন পন্থা আবিষ্কার করে। তবুও যেকোনো মূল্যে তার লক্ষ্য পূরণ করেই ছাড়ে। এটাই তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের (১৯৭৯-১৯৮৯) সময় থেকে অদ্যাবধি আফগান জাতির ওপর আমেরিকা বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। সময়ে সময়ে তার ধারা ও পদ্ধতি বদলেছে। যার সংক্ষিপ্ত চিত্রায়ন নিম্নরূপ :

  1. সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় আমেরিকার স্ট্যাটেজি ছিল, আফগানিস্তান থেকে রুশদের বিতাড়িত করা। পৃথিবীর এক সুপার পাওয়ারকে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করিয়ে পথের কাঁটা দূর করা। তবে এর পাশাপাশি সে লক্ষ রেখেছে, চূড়ান্ত বিজয় যেন মুজাহিদদের অর্জন না হয়—যার প্রভাবে সেখানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
  2. মুজাদ্দেদি ও রব্বানির শাসনের মধ্যবর্তী সময়ে আফগান গৃহযুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা আমেরিকার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের পথে বড় ধরনের কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। যার কারণে আমেরিকা এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সমাধান না করে এটাকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে, সময়ে সময়ে এতে বরং ইন্ধন জুগিয়েছে। এভাবে আফগানিস্তান থেকে সে তার স্বার্থসিদ্ধি করে নিয়েছে। যেমন : অনেক সস্তায় প্রচুর পরিমাণ আফিম চাষ করিয়ে নিয়েছে, বিভিন্ন তেল কোম্পানি চালু করেছে এবং বিশেষভাবে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে বিদ্যুৎ স্থানান্তর করার জন্য পাওয়ার ট্রান্সমিশনের পাইপলাইন বসিয়েছে।
  3. আফগান জাতির এহেন দুর্দশার সময় আল্লাহ তাআলা তালেবানের উত্থান ঘটালেন। তাদের উত্থান চারটি ক্ষেত্রে আমেরিকার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত করল—
  • তালেবান ইসলামি ইমারাহ প্রতিষ্ঠা করে আফগান গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাল এবং অধিকাংশ অঞ্চলের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল।
  • তালেবান আমেরিকার পাওয়ার ট্রান্সমিশনের পাইপলাইন বসানোর প্রকল্প নাকচ করে দিলো; যেগুলো এমন সব ঠুনকো শর্তের ভিত্তিতে সূচনা করা হয়েছিল, যা সুস্পষ্টভাবে আফগান জাতির অধিকার লঙ্ঘন করে। আর এমনিও আমেরিকা অন্যান্য অঞ্চলে গৃহীত প্রকল্পে যেসব শর্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে, আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অমানবিকতার প্রদর্শন ঘটিয়ে তা পালন করা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে।
  • আফগানিস্তানে আফিম চাষ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে আমেরিকার স্বপ্নের অবসান ঘটে এবং তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
  • ইমারাতে ইসলামিয়্যাহর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উত্তরাঞ্চলীয় জোট ব্যর্থ হয়। অবশেষে ২০০১ সালে মার্কিন সেনাদের আক্রমণের আগ মুহুর্তে তাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। তখন আর আমেরিকার সামনে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পথে নামা ছাড়া গত্যন্তর থাকেনি।
  1. ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলের সূচনালগ্নে মার্কিন সেনারা আফগান যুদ্ধে বিজয় অর্জন অসম্ভব হওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়। বিশেষ করে হেলমান্দ প্রদেশে মার্কিন সেনাদের ‘খিঞ্জার’ অপারেশনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরে পরাজয়ের ব্যাপারে তাদের আর কোনো সংশয়ই বাকি থাকেনি। কারণ সেই ভয়ানক অপারেশন ছিল আমেরিকার তূণীরের শেষ তির।

ওবামা দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার আগ দিয়ে মার্কিন সেনারা পড়েছিল এক বিপাকে—তারা না পারছিল আফগান যুদ্ধে বিজয়ের কোনো স্বপ্ন দেখতে আর না পারছিল আফগানিস্তানের আফিম সরবরাহকেন্দ্র ছেড়ে একেবারে চলে যেতে। এছাড়াও আরেকটি বাধা তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, যা এগুলোর চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না।

মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তানে অবস্থান জারজ রাষ্ট্র ইসরায়েলের স্বপ্ন পূরণের জন্য বড় প্রয়োজন ছিল। কারণ ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার আগে যদি মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানের ভূমি ত্যাগ করে, তাহলে তাদের স্বপ্ন চিরকাল অধরাই থেকে যাবে এবং এত প্ল্যান-পরিকল্পনা সব ভেস্তে যাবে। উপরন্তু আশঙ্কা রয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ ইসরায়েলের অবৈধ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হবে, চারিদিকে জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ও জাগরণের স্বর সরব হবে। এ কারণে ইসরায়েল অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আফগান যুদ্ধে মনোনিবেশ করল এবং মার্কিন সেনাদের পাশে থেকে আফগান যুদ্ধে নিজেদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রদর্শন করল। বিশেষত এয়ার স্ট্রাইক ও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর দ্বারা মার্কিন সেনাদের ভালোরকম সহায়তা করল। ইসরায়েল এক্ষেত্রে ফিলিস্তিন, লেবানন ও আরব অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধলব্ধ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাল। তাদের ডেথ স্কোয়াড ও বিশেষ বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল।

  1. ট্রাম্প এসে আফগান যুদ্ধের ব্যাপারে নতুন ধারণা উপস্থাপন করল। সে Mercenary War এর অবসান ঘটিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী ধারা অনুসরণের চিন্তা করল। অর্থাৎ এতকাল তারা ভাড়াটে সৈনিকদের দ্বারা যুদ্ধ করিয়েছে; কিন্তু দীর্ঘকালব্যাপী এই যুদ্ধে ব্যর্থতা লাভ করার পর এখন তারা ব্রিটিশদের অনুরূপ পলিসি কাজে লাগিয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে নিতে চাচ্ছে। তবুও কোনোভাবে তারা স্থায়ীভাবে পিছু হটতে বা চূড়ান্তভাবে নিবৃত্ত হতে রাজি নয়। ব্রিটিশরা যেমন সুকৌশলে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়েছিল এবং অন্য সবকিছুর পাশাপাশি আফিম থেকেও ব্যাপক লাভবান হয়েছিল, এতকাল পর এসে আমেরিকাও এখন একই পন্থা কাজে লাগাতে চাচ্ছে।

কিন্তু আমেরিকা কীভাবে তার এই সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে এবং আফগানিস্তানকে তার লক্ষ্য পূরণের ভূমিতে পরিণত করবে, আজকের এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর পরবর্তী পর্বে ইনশাআল্লাহ এ সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা হবে।

 

উস্তাদ মুস্তফা হামিদ আবুল ওয়ালিদ মিসরি হাফিজাহুল্লাহ রচিত দাঈশ ফী আফগানিস্তান : জুযয়ুম মিনাল হারবিল জাদীদাহঅবলম্বনে প্রণীত।

তথ্যসূত্র : মাসিক আস-সুমুদ, পঞ্চদশ বর্ষ, ১৭৩ নম্বর সংখ্যা

Related Articles

Check Also
Close
Back to top button