জিহাদ-কিতাল:ফাতওয়া  নং  ২৩৩

জিহাদের মুখাতাব কি শুধুই শাসকশ্রেণি?

জিহাদের মুখাতাব কি শুধুই শাসকশ্রেণি?

 

 

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্ন:

জিহাদের মুখাতাব কারা? জিহাদের হুকুম দ্বারা শরীয়ত কাকে সম্বোধন করেছে এবং তা কার জন্য প্রযোজ্য? জিহাদের মুখাতাব কি শুধুই শাসকশ্রেণি বা আহলুল হাল ওয়াল আকদ? না, প্রত্যেক মুসলিম? আমরা জানতাম, জিহাদের বিধান সবার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু ইদানিং কিছু কথা শুনে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছি। কেউ কেউ বলছেন, জিহাদের মুখাতাব শুধু শাসকশ্রেণি এবং জিহাদের দায়িত্বও শুধু তাদের। সাধারণ মানুষ জিহাদের মুখাতাব নয়। আশা করি বিষয়টি দলিলের আলোকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলে অনেক উপকৃত হতাম।

বিনীত

আব্দুর রহমান

চাঁদপুর

উত্তর:

الحمد لله وحده والصلاة والسلام على من لا نبي بعده.

প্রথম কথা

ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুরা ইসলামের প্রাক্কাল থেকেই ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্র করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, যখন থেকে মুসলিমরা পশ্চিমাদের চিন্তা, দর্শন, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ক্ষমতার প্রতাপে প্রভাবিত হতে শুরু করেছে, তখন থেকে অনেক মুসলিমও জেনে না জেনে কিংবা শত্রুর প্রোপাগাণ্ডা ও অপপ্রচারের শিকার হয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে নানান রকম অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এক শ্রোণির আলেমও এই ধ্বংসাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর থেকে; ইসলামের শীর্ষ চূড়া জিহাদ ও কিতালের বিধানগুলো এই অপপ্রচারের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। একদিকে পৃথিবীর যেখানেই জিহাদ ও কিতালের মতো পবিত্র ইবাদত আঞ্জাম দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, কাফেররা তাকেই সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ, উগ্রবাদ, কট্টরপন্থা ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সাদা চোখে ধূলা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে, অপরদিকে কিছু মুসলিম তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে; তাদের সুরে সুর মিলাচ্ছে। কেউ কেউ আরও এক কদম অগ্রসর হয়ে বলছেন, দিফায়ী জিহাদের জন্যও ইমাম ও খলীফা লাগবে, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র লাগবে, পৃথিবীর সকল মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ আমির লাগবে, শত্রুর সমপরিমাণ শক্তি লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা শরীয়তের মাসআলা ও ফতোয়া বলেই তারা প্রচার করছেন। এমনই একটি বিষয় হচ্ছে, সকল মুসলিম জিহাদের মুখাতাব নয়। সুতরাং জিহাদ করা সকলের দায়িত্বও নয়। জিহাদের দায়িত্ব শাসকদের এবং শাসকরাই জিহাদের বিধানের মুখাতাব। সুতরাং তারা জিহাদ না করলে সাধারণ মানুষের উপর কোনো দায় দায়িত্ব বর্তাবে না। কারো কারো আচরণ উচ্চারণ থেকে মনে হয়, শুধু সাধারণই নয়; সমাজের উলামা ও বিশিষ্টজনদের উপরও কোনো দায়িত্ব আরোপিত হবে না।

যেহেতু বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার আছে, তাই আমরা বিষয়টির উপর একটু বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ।

মুখাতাব অর্থ

‘মুখাতাব’ শব্দটি আরবী। অর্থ ‘সম্বোধিত ব্যক্তি’। এখানে উদ্দেশ্য, শরীয়ত জিহাদের যে বিধান দিয়েছে এবং জিহাদের যে খেতাব ও সম্বোধন করেছে, তাতে কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে? কারা এই খেতাব ও সম্বোধনের মুখাতাব বা সম্বোধিত ব্যক্তি? উক্ত খেতাব সকল মুসলিমের জন্যই প্রযোজ্য এবং সকলেই জিহাদে আদিষ্ট? না, শুধু শাসক ও বিশিষ্টজনদের জন্য প্রযোজ্য এবং শুধু তারাই জিহাদে আদিষ্ট?

মূলত এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা এ কথারই মিমাংসা করার চেষ্টা করব যে, ইসলাম জিহাদের বিধান প্রকৃতপক্ষে কাদেরকে লক্ষ্য করে দিয়েছে? শাসক-শাসিত ও সাধারণ-বিশিষ্ট সকলকে? না, শুধু শাসক শ্রেণি কিংবা বিশিষ্ট ও নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে?

জিহাদের বিধান

আমরা সকলেই জানি, জিহাদ ইসলামের ফরজ বিধান। কখনো তা ফরজে আইন, কখনো ফরজে কেফায়া। কাজি ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালুসি রহ. (মৃত্যু: ৫৪১ হি.) বলেন,

والذي استمر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين. اهـ. –تفسير ابن عطية:1/289

“যে বিষয়টির উপর ইজমা চলে আসছে তা হল, উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরজে কেফায়া। যদি মুসলমানদের একাংশ তা আদায় করে, তাহলে অন্যদের থেকে এর দায়-ভার সরে যাবে। তবে যদি শত্রু কোনো ইসলামী ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়, তখন তা ফরজে আইন হয়ে যায়।” -তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ্: ১/২৮৯

ইবনে কুদামা রহ. (মৃত্যু: ৬২০ হি.) বলেন,

ويتعين الجهاد في ثلاثة مواضع: احدها: إذا التقا الزحفان وتقابل الصفان حرم على من حضر الانصراف وتعين عليه المقام … الثاني: إذا نزل الكفار ببلد تعين على أهله قتالهم ودفعهم، الثالث: إذا استنفر الامام قوما لزمهم النفير معه. اهـ -المغني، ج: 10، ص:361

“তিন অবস্থায় জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়:

১.         যখন (মুসলিম-কাফের) দুই বাহিনী পরস্পর সম্মুখ সমরে দাঁড়ায়, তখন উপস্থিত ব্যক্তিদের উপর দৃঢ়পদে জিহাদ করা ফরজে আইন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তাদের জন্য জিহাদ থেকে ফিরে যাওয়া হারাম।

২. কোনো এলাকায় কাফেররা আক্রমণ চালালে তার অধিবাসীদের উপর ফরজে আইন, তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা এবং তাদের প্রতিহত করা।

৩.ইমাম যদি কোনো দলকে জিহাদের জন্য আহ্বান করেন, তাদের উপর ফরজে আইন, তাঁর নির্দেশে জিহাদে বের হওয়া।” -আলমুগনী; খণ্ড: ১০, পৃষ্ঠা:  ৩৬১

ফরজে আইন ও ফরজে কেফায়ার অর্থ

একথাও আমাদের সকলেরই জানা যে, ফরজে আইন অর্থ, যা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর ফরজ হয়। সুতরাং জিহাদে সক্ষম যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি; চাই সে সাধারণ হোক বা বিশিষ্টজন হোক, শাসক হোক বা শাসিত হোক, যদি উপরোক্ত তিনটি অবস্থার একটিতে উপনীত হয়, তার উপরই জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে, যেমন ওয়াক্ত হলে নামায এবং রমজান আসলে রোযা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের উপর ফরজে আইন হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, কারো উপর একটি বিধান ফরজে আইন হওয়ার অর্থই তিনি বিধানটির মুখাতাব। কারণ কেউ যদি একটি বিধানের মুখাতাবই না হয়, তাহলে তার উপর তা ফরজে আইন হওয়ার প্রশ্ন অবান্তর!

একইভাবে জিহাদ যখন ফরজে কেফায়া, তখনও সকল মুসলিম জিহাদের ‍মুখাতাব। কারণ ফরজে কেফায়ার অর্থ হচ্ছে, যা শাসক শাসিত, সাধারণ বিশিষ্ট নির্বিশেষে ব্যাপকভাবে সকলের উপর ফরজ হয়। তবে কিছু লোক দ্বারা যদি কাজটি সম্পাদিত হয়ে যায়, বাকিরা তা থেকে দায়মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু কাজটি যদি কেউই না করে, বা পর্যাপ্ত পরিমাণ লোকে না করার কারণে অনাদায়ী থাকে, তাহলে সকল মুসলিমই দায়বদ্ধ থাকে এবং গুনাহগার হয়।

ইবনে কুদামা রহ. (৬২০ হি.)  বলেন,

معنى فرض الكفاية، الذي إن لم يقم به من يكفي، أثم الناس كلهم، وإن قام به من يكفي، سقط عن سائر الناس. فالخطاب في ابتدائه يتناول الجميع، كفرض الأعيان، ثم يختلفان في أن فرض الكفاية يسقط بفعل بعض الناس له، وفرض الأعيان لا يسقط عن أحد بفعل غيره. –المغني: 9\196

“ফরজে কিফায়ার অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজন পরিমাণ লোক তা আদায় না করলে সকলে গুনাহগার হবে, আর প্রয়োজন পরিমাণ লোক আদায় করলে, বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। অতএব, শুরুতে ফরজে কিফায়ার খেতাব ফরজে আইনের মতো সকলের উপরই বর্তায়। তবে ব্যবধান হলো, কিছু সংখ্যক লোকের আদায়ের দ্বারা ফরজে কিফায়ার দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়, পক্ষান্তরে ফরজে আইন একজনের আদায়ের দ্বারা আরেকজনের দায়িত্ব আদায় হয় না।” -আলমুগনি: ৯/১৯৬

ইমাম সারাখসী রহ. (৪৮৩ রহ.) বলেন,

والجهاد قربة باعتبار إعلاء كلمة الله وإعزاز الدين ولما فيه من توهين المشركين ودفع شرهم عن المسلمين ولهذا سماه رسول الله عليه السلام سنام الدين  وكان أصله فرضا لأن إعزاز الدين فرض ولكنه فرض كفاية لأن المقصود وهو كسر شوكة المشركين ودفع شرهم وفتنتهم يحصل ببعض المسلمين فإذا قام به البعض سقط عن الباقين.- اصول السرخسي 2/ 292

ثم الفرض نوعان فرض عين وفرض كفاية ففرض العين على كل أحد إقامته نحو أركان الدين. وفرض الكفاية ما إذا قام به البعض سقط عن الباقين لحصول المقصود. وإن اجتمع الناس على تركه كانوا مشتركين في المأثم كالجهاد، فإن المقصود به إعلاء كلمة الله تعالى وإعزاز الدين، فإذا حصل هذا المقصود من بعض المسلمين سقط عن الباقين، وإذا قعد الكل عن الجهاد حتى استولى الكفار على بعض الثغور اشترك المسلمون في المأثم بذلك. وكذا غسل الميت والصلاة عليه والدفن كل ذلك فرض كفاية إذا قام به البعض سقط عن الباقين، وإن امتنعوا من ذلك حتى ضاع ميت بين قوم مع علمهم بحاله كانوا مشتركين في المأثم فأداء العلم إلى الناس فرض كفاية إذا قام به البعض سقط عن الباقين لحصول المقصود، وهو إحياء الشريعة وكون العلم محفوظا بين الناس بأداء البعض، وإن امتنعوا من ذلك حتى اندرس شيء بسبب ذلك كانوا مشتركين في المأثم. – المبسوط للسرخسي 30/ 263

“জিহাদ ইবাদত হয়েছে এজন্য যে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কালিমা ‍বুলন্দ হয় এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়; এর মাধ্যমে মুশরিকদের অপদস্থ করা হয় এবং মুসলিমরা তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পায়। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদকে দ্বীনের চূড়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ জিহাদ মৌলিকভাবে ফরজ। কেননা দ্বীন প্রতিষ্ঠা (প্রত্যেক মুসলিমের) উপর ফরজ। তবে তা ফরজে কেফায়া। কেননা জিহাদের উদ্দেশ্য হলো কাফেরদের শক্তি খর্ব করা এবং তাদের অনিষ্ট ও ফেতনা হতে মুসলিমদের রক্ষা করা। আর এ উদ্দেশ্য কিছু লোকের জিহাদের দ্বারাও অর্জিত হয়ে যায়। ফলে কিছু লোক জিহাদ করলে অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পায়।” -উসূলুস সারাখসী: ২/২৯২

তিনি অন্যত্র বলেন,

“ফরজ দুপ্রকার: ফরজে আইন ও ফরজে কেফায়া। ফরজে কেফায়া হলো, যা আদায় করা প্রত্যেকের উপর ফরজ। যেমন (নামায-রোযা ও অন্যান্য) আরকানে দ্বীন। আর ফরজে কেফায়া হলো, যা কিছু মানুষ আদায় করলে উদ্দেশ্য অর্জন হয়ে যাওয়ায় অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পায়, কিন্তু যদি সবাই মিলে তা পরিত্যাগ করে, তাহলে সবাই গুনাহগার হয়। যেমন জিহাদ। কেননা জিহাদের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তায়ালার কালিমা ‍বুলন্দ করা এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। যদি এ উদ্দেশ্য কিছু মুসলিমের দ্বারা অর্জিত হয়ে যায়, তাহলে অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পায়। কিন্তু যদি সবাই জিহাদ ত্যাগ করার কারণে কাফেররা কোন সীমান্ত দখল করে নেয়, তাহলে সকল মুসলমান গুনাহগার হবে। তেমনি মাইয়েতের গোসল, জানাযা ও দাফন সবগুলোই ফরজে কেফায়া। কিছু মুসলিম তা পালন করলে, অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাবে। কিন্তু যদি কেউই তা না করে, ফলে কোনো অঞ্চলের লোকদের জানা থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনো মাইয়িত কাফন-দাফন থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তারা সবাই গুনাহগার হবে। মানুষের নিকট ইলম পৌঁছানো ফরজে কেফায়া, যদি কিছু মানুষ তা আঞ্জাম দেয় তাহলে অন্যরা দায়িত্ব হতে মুক্তি লাভ করবে। কেননা কিছু মানুষের দ্বারা শরীয়া পুনর্জীবিত করা এবং মানুষের মাঝে ইলমের সংরক্ষণের উদ্দেশ্য অর্জন হয়ে যায়। কিন্তু যদি সবাই এ থেকে বিরত থাকে, ফলে (দ্বীনের) কোন বিষয় বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে।” -মাবসূতে সারাখসী: ৩০/২৬৩

উল্লিখিত আলোচনা থেকে খুব সহজেই অনুমেয় যে, জিহাদ যখন ফরজে কেফায়া, তখনও সকল মুসলিম জিহাদের মুখাতাব। কারণ কেউ জিহাদের মুখাতাব না হলে, তার উপর জিহাদ ফরজ হওয়া এবং তা না করার কারণে গুনাহগার হওয়ার সুযোগ নেই।

ইকামাতে দ্বীনের জন্য জিহাদ

ইসলাম আল্লাহর নাযিলকৃত একমাত্র দ্বীন। এ দ্বীন আল্লাহ তাআলার আদেশ, নিষেধ ও তাঁর পছন্দনীয় বিধি বিধানের সমষ্টি। আল্লাহ তাআলা তা নাযিল করেছেন যমিনে বাস্তবায়নের জন্য এবং তা দ্বারা মানব জাতিকে পরিচালনার জন্য। অন্য সকল বাতিল ধর্ম ও মতবাদের উপর এ দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ.} [الصف: 9]}

“তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, অন্য সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করার জন্য; যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” –সুরা সফ : ৯

বলা বাহুল্য, দ্বীন কায়েমের এ দায়িত্ব দ্বীনের অনুসারী সকলের। আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে সকল নবী রাসূলকে আল্লাহ এ দায়িত্ব দিয়েই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উম্মতের উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

দ্বীন কায়েমের মাধ্যম হিসেবেই আল্লাহ তাআলা জিহাদ ফরজ করেছেন। অতএব দ্বীন কায়েম যেমন শাসক শাসিত সকলের দায়িত্ব, জিহাদও তেমনি তাদের সকলের দায়িত্ব। কোরআনে কারীমে এক্ষেত্রে কোনো বিভাজন করা হয়নি এবং কোনো শর্তও আরোপ করা হয়নি।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ.}  [الأنفال: 39]}

“তোমরা তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাক, যতক্ষণ না যাবতীয় ফিতনার অবসান হয় এবং দ্বীন পূর্ণাঙ্গরূপে আল্লাহর হয়ে যায়।” –সুরা আনফাল : ৩৯

আরও ইরশাদ করেন,

قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ. [التوبة: 29]

“তোমরা কিতাল কর আহলে কিতাবের সেসব লোকের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম করে না এবং সত্য দ্বীন গ্রহণ করে না; যতক্ষণ না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া প্রদান করে।

–সুরা তাওবা : ২৯

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

أمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله ويقيموا الصلاة ويؤتوا الزكاة. –صحيح البخاري: 25

“আমি ততক্ষণ পর্যন্ত লোকদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে আদিষ্ট, যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ নেই, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে।” -সহীহ বুখারি: ২৫

এই বিবেচনায়ও জিহাদ মৌলিকভাবে উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের উপর ফরজ। তবে যদি কিছু মানুষের জিহাদ করার দ্বারা মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যায়, তাহলে বাকিরা দায়মুক্ত হয়ে যায়। কারণ জিহাদের মূল উদ্দেশ্য, কুফরের দাপট চূর্ণ করে ইসলামকে বিজয়ী করা; মারামারি কাটাকাটি নয়। এ কারণেই স্বাভাবিক অবস্থায় জিহাদ ফরজে কিফায়া। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্য অর্জন না হলে সকলেই ফরজ ত্যাগের দায়ে গোনাহগার হয়। আর যখন সকল মানুষের অংশ গ্রহণ ব্যতীত উদ্দেশ্য হাসিল না হয়, তখন জিহাদ সকলের উপর ফরজে আইন হয়ে যায় এবং সকলকেই তখন জিহাদে যুক্ত হতে হয়। উসূলবিদ ও ফুকহায়ে কেরামের অনেকেই জিহাদের এই দিকটি তাদের নিজ নিজ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।

ইমাম নাসাফি রহ. (৭১০ হি.) স্বীয় গ্রন্থ ‘মানারুল উসূল’ এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘কাশফুল আসরার’ এ বলেন,

ثم الجهاد، الذي شرع لإعلاء الدين. وهو فرض عين فى الأصل. لأن إعلاء الدين فرض على كل مسلم. لكن المقصود لما كان كسر شوكة المشركين ودفع شرهم عن المسلمين –وهو يحصل بالبعض- صار من فروض الكفاية. فيسقط بقيام البعض عن الباقين. –كشف الأسرار شرح المنار للمصنف: 2\395

“অতঃপর জিহাদ, যা বিধিত হয়েছে দ্বীন সমুন্নত করার জন্য। এ জিহাদ মৌলিকভাবে ফরজে আইন। কেননা দ্বীন প্রতিষ্ঠা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। কিন্তু জিহাদের ‍উদ্দেশ্য যেহেতু কাফেরদের শক্তি খর্ব করা ও তাদের অনিষ্ট হতে মুসলিমদের রক্ষা করা, আর এ উদ্দেশ্য কিছু লোকের জিহাদের দ্বারাও অর্জিত হয়ে যায়, তাই জিহাদ ফরজে কেফায়া হয়েছে। ফলে কিছু লোক জিহাদ করলে অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাবে।” -কাশফুল আসরার শরহুল মানার: ২/৩৯৫

উসূলে বাযদাবির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আলকাফি’তে ইমাম হুসামুদ্দিন সিগনাকি রহ. (৭১৪ হি.) বলেন,

(ثم الجهاد شرع لإعلاء الدين فرض في الأصل) هذا يقتضي كونه من فروض الأعيان؛ لأن إعلاء الدين فرض على كل مسلم، … (لكن الواسطة هاهنا هي المقصودة) يعني أن كفر الكافر هو المقصود بالإعدام؛ لأن فرضية الجهاد لكفر الكافر فإذا حصل هذا المقصود وهو الإعدام يسقط عمن لم يجاهد، (فلذلك صار من فروض الكفاية). ألا ترى أن الجهاد عند النفير العام صار من فروض الأعيان باعتبار الأصل. – الكافي شرح البزدوي للسغناقي (ت714هـ): 4/ 1994-1995

“অতঃপর জিহাদ, যা বিধিত হয়েছে দ্বীন সমুন্নত করা জন্য। যা মূলত ফরজ। এর দাবী ছিল জিহাদ ফরজে আইন হওয়া। কারণ দ্বীন সমুন্নত করা প্রত্যেক মুসলিমের ‍উপর ফরজ। কিন্তু জিহাদের ‍উদ্দেশ্য হল কাফেরের কুফরী নির্মূল করা। এজন্যই জিহাদ ফরজ করা হয়েছে। তাই যদি কিছু লোকের দ্বারা এ উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যায়, তাহলে যারা জিহাদ করেনি, তারাও দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়। এ কারণেই নাফীরে আমের সময় জিহাদ তার মূলরূপে ফিরে আসে এবং সবার উপর ফরজে আইন হয়ে যায়।” -আলকাফী শরহুল বাযদাবী: ৪/১৯৯৪-১৯৯৫

ইমাম আব্দুল আযিয বুখারি রহ. (৭৩০ হি.) উসূলে বাযদাবির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘কাশফুল আসরার’এ বলেন,

ثم الجهاد” ….. “فرض في الأصل” أي أصله فرض على الجميع؛ لأن إعلاء الدين فرض على الكل، “لكن الواسطة هاهنا” وهي كسر شوكة المشركين ودفع شرهم “هي المقصودة” بالرد والإعدام؛ لأن شرعية الجهاد لإزالة الكفر وإعدامه “فصارت” هذه العبادة “من فروض الكفاية”؛ لأن المقصود يحصل ببعض المسلمين بمنزلة صلاة الجنازة حتى لو لم يحصل كما في النفير العام يجب على كل فرد كالصلاة والصوم. -كشف الأسرار شرح أصول البزدوي لعبد العزيز البخاري (ت730هـ): 4/ 138-139

“অতঃপর জিহাদ … তা মূলত ফরজ। অর্থাৎ মূল জিহাদ সকলের উপরই ফরজ। কেননা দ্বীন প্রতিষ্ঠা সকলের উপর ফরজ। কিন্তু যেহেতু জিহাদের ‍উদ্দেশ্য হল কাফেরদের দাপট চূর্ণ করা ও তাদের অনিষ্ট নির্মূল করা, তাই এই ইবাদতটি ফরজে কেফায়া হয়েছে। কারণ এ ‍উদ্দেশ্য কিছু মুসলমানের দ্বারাই অর্জিত হয়ে যায়; যেমন জানাযার নামায। এজন্যই যদি কিছু মুসলমানের জিহাদের দ্বারা উদ্দেশ্যটি অর্জিত না হয়, যেমন নফীরে আমের (কাফেরদের আক্রমণের) সময়, তখন প্রত্যেক মুসলিমের উপর নামায-রোযার মতোই জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়।” -কাশফুল আসরার: ৪/১৩৮-১৩৯

ইমাম সারাখসি রহ. (৪৮৩ হি.) বলেন,

ثم أمروا بالقتال مطلقا بقوله تعالى: {وقاتلوا في سبيل الله واعلموا أن الله سميع عليم} -البقرة: 244 .

فاستقر الأمر على هذا. ومطلق الأمر يقتضي اللزوم، إلا أن فريضة القتال لمقصود إعزاز الدين وقهر المشركين، فإذا حصل المقصود بالبعض سقط عن الباقين، بمنزلة غسل الميت وتكفينه والصلاة عليه ودفنه. إذ لو افترض على كل مسلم بعينه، وهذا فرض غير موقت بوقت، لم يتفرغ أحد لشغل آخر من كسب أو تعلم. وبدون سائر الأشغال لا يتم أمر الجهاد أيضا، فلهذا كان فرضا على الكفاية. -شرح السير الكبير، ص: 188-189

“এরপর মুসলমানদেরকে জিহাদের নিঃশর্ত আদেশ দেয়া হল এবং বলা হল, ‘তোমরা আল্লাহর পথে কিতাল করো এবং জেনে রাখো আল্লাহ সবকিছু শোনেন এবং জানেন।’ –সুরা বাকারা: ২৪৪

এটাই চূড়ান্ত নির্দেশ স্থির হল। এ নিঃশর্ত নির্দেশের দাবী ছিল, জিহাদ ফরজে আইন হওয়া। কিন্তু যেহেতু জিহাদের উদ্দেশ্য হল দ্বীনের বিজয় ও কাফেরদের দমন, সুতরাং কিছু লোকের দ্বারা তা অর্জিত হলে অবশিষ্টরা দায়মুক্ত হয়ে যায়, যেমন মাইয়েতের গোসল, কাফন, দাফন ও জানাযা। কারণ জিহাদ যদি প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজে আইন হয়, তাহলে কেউই ইলম অর্জন, উপার্জন ইত্যাদির মতো অন্যান্য জরুরি কাজের সুযোগ পাবে না। কেননা জিহাদ নির্দিষ্ট সময়ে সীমিত নয়। অথচ অন্যান্য কাজ ব্যতীত খোদ জিহাদের আমলটিও পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। একারণেই জিহাদ ফরজে কেফায়া হয়েছে।” -শারহুস সিয়ারিল কাবীর, পৃ: ১৮৮-১৮৯

জিহাদের হাকিকত ও স্বরূপ

তৃতীয়ত জিহাদের হাকিকত ও স্বরূপ হচ্ছে, আমর বিলমা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার, দাওয়াহ ইলাল্লাহ, জুলুম প্রতিহত করা এবং মুসলিম ভূমি ও মুসলিমদের সুরক্ষা। আর এ সবগুলো বিধানের মুখাতাব সকল মুসলিম। সুতরাং জিহাদের মুখাতাবও সকল মুসলিম। নিম্নে জিহাদের প্রকৃতি ও স্বরূপ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করা হল।

ক. আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার ও দাওয়াহ ইলাল্লাহ

পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় মারূফ ও সৎ কাজ ঈমান। জিহাদের নীতি অনুযায়ী প্রথমে মৌখিকভাবে কাফেরকে ঈমান গ্রহণেরই দাওয়াত দেয়া হয়। আর সবচেয়ে বড় মুনকার ও অসৎ কাজ হলো, কুফর। জিহাদে প্রথমেই কাফেরকে তার কুফর থেকে ফিরে আসার আহ্বান করা হয়। ফিরে না আসলে অন্তত মুসলিমদের বশ্যতা স্বীকার করে যিম্মি হয়ে থাকার আহ্বান জানানো হয়, যাতে অন্যদের মাঝে কুফরের ফিতনা ছড়াতে না পারে। এ দাওয়াতও গ্রহণ না করলে তখন জিহাদ করা হয়। এ জন্যই জিহাদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,

كِتَابُ الْجِهَادِ… وَهُوَ لُغَةً: مَصْدَرُ جَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ. وَشَرْعًا: الدعاء إلى الدين الحق وقتال من لم يقبله. -الدر المختار، ص: 329

“জিহাদ অধ্যায়: … শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে, সত্য ধর্মের দিকে আহ্বান করা এবং যে উক্ত আহ্বানে সাড়া দিবে না, তার বিরুদ্ধে কিতাল করা।” -আদদুররুল মুখতার, পৃ: ৩২৯

ইমাম সারাখসি রহ. (৪৮৩ হি.) বলেন,

لأن الجهاد أمر بالمعروف ونهي عن المنكر وهو الشرك، وإعانة الضعيف من المسلمين بدفع أذى المشركين عنهم، وإرشاد الأخرق وهو المشرك. -شرح السير الكبير، ص: 29

“জিহাদ হল সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ অর্থাৎ শিরক হতে নিষেধ করা। দুর্বল মুসলিমদেরকে কাফেরদের অনিষ্ট হতে রক্ষার মাধ্যমে সাহায্য করা। পথহারা নির্বোধ মুশরিকদের পথ দেখানো।” -শারহুস সিয়ারিল কাবীর, পৃ: ২৯

তিনি আরও বলেন,

فأما بيان المعاملة مع المشركين فنقول الواجب دعاؤهم إلى الدين وقتال الممتنعين منهم من الإجابة لأن صفة هذه الأمة في الكتب المنزلة الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر وبها كانوا خير الأمم قال الله تعالى {كنتم خير أمة أخرجت للناس} [آل عمران: 110] الآية ورأس المعروف الإيمان بالله تعالى فعلى كل مؤمن أن يكون آمرا به داعيا إليه وأصل المنكر الشرك فهو أعظم ما يكون من الجهل والعناد لما فيه إنكار الحق من غير تأويل فعلى كل مؤمن أن ينهي عنه بما يقدر عليه. -المبسوط للسرخسي: 10/ 2

“মুশরিকদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে আমরা বলব, তাদেরকে দ্বীনের প্রতি আহ্বান করা এবং যারা সেই আহ্বানে সাড়া দিবে না, তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা ওয়াজিব। কেননা আসমানী কিতাবসমূহের বিবরণ অনুযায়ী এই উম্মাহর বৈশিষ্ট্য হলো, আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার। এর মাধ্যমেই তারা শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠতম উম্মত, যাদেরকে মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে’ [সুরা আলে ইমরান: ১১০]।

আর সর্বোচ্চ মারূফ ও নেক কাজ হলো, আল্লাহর প্রতি ঈমান। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য, ঈমানের আদেশ করা, ঈমানের প্রতি আহ্বান করা। আর সর্বোচ্চ অন্যায় হলো শিরক। এটা সবচেয়ে বড় অজ্ঞতা ও হঠকারিতা। কেননা এতে কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীতই হককে অস্বীকার করা হয়। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য, সামর্থ্য অনুযায়ী তাতে বাধা দেয়া।” -মাবসূতে সারাখসী: ১০/২

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. (১১৭৬ হি.) বলেন,

اعلم أن أتم الشرائع وأكمل النواميس هو الشرع الذي يؤمر فيه بالجهاد، وذلك لأن تكليف الله عباده بما أمر ونهى – مثله كمثل رجل مرض عبيده، فأمر رجلا من خاصته أن يسقيهم دواء، فلو أنه قهرهم على شرب الدواء، وأوجره في أفواههم لكان حقا، لكن الرحمة اقتضت أن يبين لهم فوائد الدواء؛ ليشربوه على رغبة فيه، وأن يخلط معه العسل؛ ليتعاضد فيه الرغبة الطبيعية والعقلية.

ثم إن كثيرا من الناس يغلب عليهم الشهوات الدنية والأخلاق السبعية ووساوس الشيطان في حب الرياسات، ويلصق بقلوبهم رسوم آبائهم، فلا يسمعون تلك الفوائد، ولا يذعنون لما يأمر به النبي صلى الله عليه وسلم، ولا يتأملون في حسنة، فليست الرحمة في حق أولئك أن يقتصر على إثبات الحجة عليهم، بل الرحمة في حقهم أن يقهروا؛ ليدخل الإيمان عليهم على رغم أنفهم بمنزلة إيجاد الدواء المر، ولا قهر إلا بقتل من له منهم بكناية شديدة وتمنع قوى، أو تفريق منعتهم وسلب أموالهم حتى يصيروا لا يقدرون على شيء، فعند ذلك يدخل أتباعهم وذراريهم في الإيمان برغبة وطوع، ولذلك كتب رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى قيصر كان عليك إثم الأريسيين.

وربما كان أسرهم وقهرهم يؤدي إلى إيمانهم، وإلى هذا أشار النبي صلى الله عليه وسلم حيث قال: عجب الله من قوم يدخلون الجنة في السلاسل.

وأيضا فالرحمة التامة الكاملة بالنسبة إلى البشر أن يهديهم الله إلى الاحسان، وأن يكبح ظالمهم عن الظلم، وأن يصلح ارتفاقاتهم وتدبير منزلهم وسياسة مدينتهم، فالمدن الفاسدة التي يغلب عليها نفوس السبعية، ويكون لهم تمنع شديد إنما هو بمنزلة الأكلة في بدن الإنسان لا يصح الإنسان إلا بقطعه، والذي يتوجه إلى إصلاح مزاجه وإقامة طبيعته لا بد له من القطع، والشر القليل إذا كان مفضيا إلى الخير الكثير واجب فعله،

ولك عبرة بقريش ومن حولهم من العرب كانوا أبعد خلق الله عن الاحسان وأظلمهم على الضعفاء، وكانت بينهم مقاتلات شديدة، وكان بعضهم يأسر بعضا، وما كان أكثرهم متأملين في الحجة ناظرين في الدليل فجاهدهم النبي صلى الله عليه وسلم وقتل أشدهم بطشا وأحدهم نفسا حتى ظهر أمر الله، وانقادوا له، فصاروا بعد ذلك من أهل الإحسان، واستقامت أمورهم، فلو لم يكن في الشريعة جهاد أولئك لم يحصل اللطف في حقهم. (حجة الله البالغة: 2/264 ط. دار الجيل: 1426هـ)

“পরিপূর্ণ দ্বীন ও পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত তা-ই, যাতে জিহাদের বিধান রয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের যে আদেশ-নিষেধ করেছেন, তার দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মতো, যার গোলামগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে তার ঘনিষ্ঠ কাউকে গোলামদের ওষুধ খাওয়াতে বলল। এখন যদি সেই ব্যক্তি ওদেরকে ওষুধ খেতে বাধ্য করে এবং (জোরপূর্বক) তাদের মুখে ওষুধ ঢেলে দেয়, তাহলে তা ন্যায়সঙ্গতই হবে। তবে দয়া ও উদারতার দাবি হলো, তাদেরকে ওষুধের উপকারিতা বুঝিয়ে দেয়া, যেন তারা সাগ্রহে তা সেবন করে এবং ওষুধের সাথে মধু মিশিয়ে দেয়া, যেন বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহের পাশাপাশি স্বভাবগত আগ্রহও সৃষ্টি হয় এবং একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে।

কিন্তু নেতৃত্বের মোহে অনেক মানুষের উপর নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি, পশুত্ব ও শয়তানের কুমন্ত্রণা প্রবল হয় এবং তাদের অন্তর বাপ-দাদার রীতি নীতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই তারা সেই উপকারিতাগুলো শুনতে চায় না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদেশ দেন, তা মেনে নেয় না, কল্যাণকর বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে শুধু ইসলামের সত্যতার প্রমাণ পেশ করাই যথেষ্ট নয়। বরং তাদের প্রতি করুণার দাবি হলো, তাদের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করা, যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করে, অনেকটা (জোরপূর্বক) তিক্ত ওষুধ পান করানোর মতো। আর তাদের উপর প্রভাব বিস্তারের পদ্ধতি হলো, তাদের মধ্যে যারা শক্তিশালী ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী, তাদের হত্যা করা কিংবা তাদের দলকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া এবং ধনসম্পদ ছিনিয়ে নেয়া, যেন (ইসলামের বিপক্ষে) তাদের কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর মতো কোন শক্তিই অবশিষ্ট না থাকে। তখনই তাদের অনুসারী ও সন্তান-সন্ততিরা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করবে। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়সারের নিকট প্রেরিত চিঠিতে লিখেছিলেন, (যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ না কর) তাহলে তোমাকে তোমার অনুসারীদের (ইসলাম গ্রহণ না করার) গুনাহের ভারও বহন করতে হবে।

আবার কখনো তাদেরকে বন্দী ও পর্যুদস্ত করা তাদের ঈমানের কারণ হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عجب الله من قوم يدخلون الجنة في السلاسل

‘আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তিদের দেখে খুশি হন, যাদেরকে শিকলে বন্দী করে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়’। -সহীহ বুখারী: ৩০১০

তাছাড়া এটাও মানবজাতির প্রতি পূর্ণাঙ্গ অনুগ্রহের দাবী যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদেরকে (পরস্পরের প্রতি) অনুগ্রহ করার দিকে পথপ্রদর্শন করবেন, যালেমদের যুলুম হতে বিরত রাখবেন, এবং মানুষের সুযোগ-সুবিধা, গার্হস্থ্য ও শহর-নগর পরিচালনার বিষয়গুলো বিশুদ্ধ করবেন। কিন্তু যে শহর-নগরগুলোর ক্ষমতা, প্রতাপ ও শক্তির অধিকারী; পশুস্বভাব মন্দ লোকেরা দখল করে নেয়, তারা হচ্ছে মানব দেহের ক্যান্সারের ন্যায়। তা কেটে ফেলা ব্যতীত মানুষ সু্স্থতা লাভ করতে পারে না। যে ব্যক্তি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়, তার জন্য তা কেটে ফেলার কোনো বিকল্প নেই। সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে প্রভূত কল্যাণ অর্জন করা গেলে তো সেই ক্ষতি মেনে নিতেই হয়।

এ বিষয়ে কুরাইশ ও তাদের পার্শ্ববর্তী আরবদের ঘটনা আমাদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তারা একে অপরের প্রতি অনুগ্রহ করা থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল। দুর্বলদের উপর জুলুমে ছিল সর্বাগ্রে। পরস্পর ঘোরতর যুদ্ধে লিপ্ত হত, একে অপরকে বন্দী করত। তাদের অধিকাংশই দলিল-প্রমাণ নিয়ে চিন্তাভাবনা করত না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে জিহাদ করলেন এবং তাদের মধ্যে যারা প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী ছিল, তাদের হত্যা করলেন। ফলে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হল এবং কুরাইশ ও অন্যান্য আরবরা রাসূলের অনুগত হয়ে একে অপরের প্রতি অনুগ্রহশীল হয়ে গেল। তাদের অবস্থার সংশোধন হয়ে গেল। যদি শরীয়তে তাদের সাথে যুদ্ধের আদেশ না থাকত, তাহলে তাদের প্রতি দয়া করা হত না।” -হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ: ২/২৬৪

ফুকাহায়ে কেরামের উপরোক্ত বক্তব্যগুলোতে আমরা পরিষ্কার দেখতে পেলাম, তাঁরা সকলেই খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, জিহাদের হাকিকত ও স্বরূপ হচ্ছে, আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার এবং দাওয়াহ ইলাল্লাহ।

খ. ইসলাম, মুসলিম ভূমি ও মুসলিমদের প্রতিরক্ষা

ঈমান-কুফরের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। কাফেররা আল্লাহ তাআলার দ্বীনের দুশমন। সে কারণে এ দ্বীনের অনুসারী মুসলিমদেরও দুশমন। তারা চায়, যে কোনোভাবে এ দ্বীন মিটিয়ে দিতে। এ দ্বীনের অনুসারীদেরকে তাদেরই মতো কাফের বানিয়ে ফেলতে। এক্ষেত্রে তারা চেষ্টার বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। ইরশাদ হচ্ছে,

[النساء: 89]{ وَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ كَمَا كَفَرُوا فَتَكُونُونَ سَوَاءً }

“তারা মনেপ্রাণে কামনা করে, তোমরাও যদি কাফের হয়ে যেতে, যেমন তারা কাফের হয়েছে! যাতে তোমরা ও তারা সমান হয়ে যাও!” –সুরা নিসা: ৮৯

[البقرة: 120]{وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ}

“ইহুদি ও নাসারারা তোমার প্রতি কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ কর।” –সুরা বাকারা: ১২০

[وَلَا يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا } [البقرة: 217}

“তারা অবিরত তোমাদের সঙ্গে কিতাল করতে থাকবে, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফেরাতে পারে; যদি সক্ষম হয়।” –সুরা বাকারা: ২১৭

[إِنَّهُمْ إِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ يَرْجُمُوكُمْ أَوْ يُعِيدُوكُمْ فِي مِلَّتِهِمْ وَلَنْ تُفْلِحُوا إِذًا أَبَدًا} [الكهف: 20}

“যদি তারা তোমাদের সন্ধান পেয়ে যায়, তবে তারা তোমাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য করবে।” –সুরা কাহাফ: ২০

কাফেরদের এ সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে ইসলাম, মুসলিম ও মুসলিম ভূমি সংরক্ষিত রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা জিহাদ ও ই’দাদের বিধান দিয়েছেন এবং যারা ঈমানের দাওয়াত গ্রহণ করবে না, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে বলেছেন।

ইমাম জাসসাস রহ. (৩৭০ হি.) বলেন,

وليس بعد الإيمان بالله ورسوله فرض آكد ولا أولى بالإيجاب من الجهاد، وذلك أنه بالجهاد يمكن إظهار الإسلام وأداء الفرائض، وفي ترك الجهاد غلبة العدو ودروس الدين، وذهاب الإسلام. – أحكام القرآن للجصاص ط العلمية (3/ 149)

“আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমানের পর জিহাদের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম ফরজ আর নেই। কারণ, জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামের বিজয় ও ফরজসমূহ আদায় করা সম্ভব। পক্ষান্তরে জিহাদ ছেড়ে দিলে শত্রুরা বিজয়ী হয়ে যাবে, দ্বীন মিটে যাবে এবং ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে।” -আহকামুল কুরআন: ৩/১৪৯

অতএব, জিহাদের হাকিকত দাঁড়াচ্ছে: দাওয়াহ ইলাল্লাহ, আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার, জুলুম প্রতিহতকরণ এবং মুসলিম ও মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষা। বলার অপেক্ষা রাখে না,  এ সবগুলো বিষয়ই সামর্থ্য অনুযায়ী সকল মুসলিমের দায়িত্ব। ভালো কাজের দাওয়াত দেয়া, মন্দ দেখলে প্রতিহত করা, মুসলিমদের সুরক্ষা দেয়া ও তাদের উপর থেকে জুলুম প্রতিহত করা সবগুলো কাজই সকল মুসলিমের উপর ফরজ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে জিহাদও মূলত সকল মুসলিমের উপর ফরজ এবং সকলেই জিহাদের বিধানের মুখাতাব। এবিষয়ে আমরা সংক্ষেপে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি।

আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের মুখাতাব সকল মুসলিম এবং দায়িত্ব সকলের

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ} [آل عمران: 110]}

“তোমরা শ্রেষ্ঠতম উম্মত, মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজে বাধা দাও এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখ।” –সুরা আলে ইমরান: ১১০

لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (78) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79)} [المائدة: 78،79 ]

“বনি ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফুরি করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের যবানীতে লা’নত করা হয়েছিল। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং সীমালংঘন করত। তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে বাধা দিত না। বস্তুত তাদের এই কর্ম ছিল অতি মন্দ।” –সুরা মায়েদা: ৭৮-৭৯

[لَوْلَا يَنْهَاهُمُ الرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ عَنْ قَوْلِهِمُ الْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَصْنَعُونَ} [المائدة: 63}

“তাদের দরবেশ ও উলামা তাদেরকে গুনাহের কথা বলতে ও হারাম খেতে নিষেধ করছে না কেন? বস্তুত তাদের এ কর্ম অতি মন্দ!” –সুরা মায়েদা: ৬৩

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه، وذلك أضعف الإيمان. -صحيح مسلم، رقم: 186؛ ط. دار الجيل بيروت + دار الأفاق الجديدة ـ بيروت

“তোমাদের যে কেউ কোন মন্দ কাজ দেখবে, সে যেন স্বহস্তে (শক্তিবলে) তা প্রতিহত করে। যদি তাতে সক্ষম না হয়, তাহলে যেন তার যবান দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তাতেও সক্ষম না হয়, তাহলে অন্তর দিয়ে। আর এটি হচ্ছে দুর্বলতম ঈমান।” -সহীহ মুসলিম: ১৮৬

অন্য হাদিসে ইরশাদ করেন,

إن الناس إذا رأوا الظالم فلم يأخذوا على يديه أوشك أن يعمهم الله بعقاب. -سنن ابي داود، رقم: 4338؛ ط. دار الرسالة العالمية، ت: شعَيب الأرنؤوط – محَمَّد كامِل قره بللي. قال الأرنؤوط رحمه الله تعالى: إسناده صحيح. اهـ

“যখন লোকজন জালেমকে (জুলুম করতে) দেখেও তার হাত না আটকাবে, তখন অচিরেই আল্লাহ তাআলা ব্যাপকভাবে তাদের উপর আযাব নাযিল করবেন।” -আবু দাউদ ৪৩৩৮

অন্য হাদিসে এসেছে,

ما من قوم يعمل فيهم بالمعاصى ثم يقدرون على أن يغيروا ثم لا يغيروا إلا يوشك أن يعمهم الله منه بعقاب. -سنن ابي داود، رقم: 4338؛ ط. دار الرسالة العالمية، ت: شعَيب الأرنؤوط – محَمَّد كامِل قره بللي. قال الأرنؤوط رحمه الله تعالى: إسناده صحيح. اهـ

“যখন কোন সম্প্রদায়ে গুনাহের কাজ হয়, আর সম্প্রদায়ের অন্য লোকেরা তা প্রতিহত করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিহত না করে, তখন অতিশীঘ্রই আল্লাহ তাআলা ব্যাপকভাবে তাদের উপর আযাব নাযিল করেন।” -আবু দাউদ ৪৩৩৮

এছাড়াও আরো অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের কথা এসেছে। এসব আয়াত হাদিসে শাসক শাসিতের মাঝে কোনো ব্যবধান করা হয়নি। ব্যাপকভাবে প্রত্যেক মুমিনকেই তার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাজেই সকলের উপরই তা ফরজ। সংশ্লিষ্ট নসগুলোর ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরামও বিষয়টি সুস্পষ্ট করে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-

ইমাম নববী রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,

ثم إن الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر فرض كفاية إذا قام به بعض الناس سقط الحرج عن الباقين وإذا تركه الجميع أثم كل من تمكن منه بلا عذر ولا خوف. ثم إنه قد يتعين كما إذا كان في موضع لا يعلم به الا هو أو لا يتمكن من إزالته إلا هو وكمن يرى زوجته أو ولده أو غلامه على منكر أو تقصير في المعروف … قال العلماء ولا يختص الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر بأصحاب الولايات بل ذلك جائز لآحاد المسلمين قال إمام الحرمين والدليل عليه إجماع المسلمين فإن غير الولاة في الصدر الأول والعصر الذي يليه كانوا يأمرون الولاة بالمعروف وينهونهم عن المنكر مع تقرير المسلمين إياهم وترك توبيخهم على التشاغل بالأمر بالمعروف والنهي عن المنكر من غير ولاية والله أعلم. -شرح صحيح مسلم للنووي: 2/24

“আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার ফরজে কেফায়া। যদি কিছু লোক তা পালন করে, অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর যদি কেউ না করে তাহলে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই গুনাহগার হবে, যে তা করতে সক্ষম ছিল এবং তার কোনো ওজর বা ভয় ছিল না। আবার কখনো তা ফরজে আইনও হয়ে যায়। যেমন কেউ যদি এমন স্থানে থাকে, যেখানে সে ব্যতীত অন্য কেউ অন্যায় কাজ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টা জানে না কিংবা অন্য কেউ তাতে বাধা দিতে সক্ষম নয়। একইভাবে যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তান বা গোলামকে অন্যায় কাজ করতে বা দায়িত্বে ক্রটি করতে দেখে। উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার শাসকবর্গের সাথে খাস নয়; বরং যে কোন মুসলিমের জন্যই তা বিধিত। ইমামুল হারামাইন বলেন, এর দলিল হল মুসলিমদের ইজমা। কেননা ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় যুগের লোকেরা শাসক না হয়েও শাসকদেরকে আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার করতেন, আর অন্যরা একে সমর্থন করতেন। শাসক না হয়েও আমল বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার করার কারণে তাদেরকে কেউ তিরস্কার করতেন না।” -শরহু সহিহি মুসলিম: ২/২৪

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,

والأمر بالمعروف والنهي عن المنكر فرض على كل مسلم؛ لكنه من فروض الكفايات؛ فإن قام بهما من يسقط به الفرض من ولاة الأمر أو غيرهم؛ وإلا وجب على غيرهم أن يقوم من ذلك بما يقدر عليه. -مجموع الفتاوى: 11/ 94

“আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। তবে তা ফরজে কেফায়া। যদি শাসকবর্গ বা অন্য কেউ ফরজ আদায় হওয়া পরিমাণ করে, তবে তো ভাল। অন্যথায় সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যদের উপর তা ফরজ হবে।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ১১/৯৪

তিনি আরো বলেন,

وإذا كان جماع الدين وجميع الولايات هو أمر ونهي؛ فالأمر الذي بعث الله به رسوله هو الأمر بالمعروف والنهي الذي بعثه به هو النهي عن المنكر وهذا نعت النبي والمؤمنين؛ كما قال تعالى: {والمؤمنون والمؤمنات بعضهم أولياء بعض يأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر} . وهذا واجب على كل مسلم قادر وهو فرض على الكفاية ويصير فرض عين على القادر الذي لم يقم به غيره والقدرة هو السلطان والولاية فذوو السلطان أقدر من غيرهم؛ وعليهم من الوجوب ما ليس على غيرهم. فإن مناط الوجوب هو القدرة؛ فيجب على كل إنسان بحسب قدرته قال تعالى: {فاتقوا الله ما استطعتم}. -مجموع الفتاوى: 28/ 65

“যেহেতু সমগ্র দ্বীন ও সকল কর্তৃত্বের মূল হলো আমর ও নাহী, তো যেই আমর ও নাহী দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন তা হলো, আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার। এটা নবী ও মুমিনদের গুণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিন নর-নারী পরস্পরে একে অন্যের সহযোগী। তারা সৎ কাজের আদেশ করে অসৎ কাজে বাধা দেয়’। [সুরা তাওবা: ৭১] এটা প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের উপর ফরজ। তা ফরজে কেফায়া, কিন্তু যখন অন্য কেউ না করে তখন সক্ষম ব্যক্তির উপর তা ফরজে আইন হয়ে যায়। সামর্থ্য হলো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ অন্যদের তুলনায় অধিক সক্ষম। এজন্য তাদের উপর এ দায়িত্ব অন্যদের তুলনায় বেশি। কারণ দায়িত্বের ভিত্তি হলো সামর্থ্য। তাই সামর্থ্য অনুপাতেই প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তা ওয়াজিব হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর’। [সুরা তাগাবুন: ১৬]” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৬৫

তিনি অন্যত্র বলেন,

وكذلك الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر لا يجب على كل أحد بعينه بل هو على الكفاية كما دل عليه القرآن ولما كان الجهاد من تمام ذلك كان الجهاد أيضا كذلك فإذا لم يقم به من يقوم بواجبه أثم كل قادر بحسب قدرته؛ إذ هو واجب على كل إنسان بحسب قدرته؛ كما قال النبي صلى الله عليه وسلم {من رأى منكم منكرا فليغيره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان}. -مجموع الفتاوى: 28/ 126

“তেমনিভাবে আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার নির্দিষ্টভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরজ নয়। বরং তা ফরজে কেফায়া, যেমনটা কুরআন হতে প্রমাণিত। জিহাদ যেহেতু আমর বিল মারুফের পূর্ণাঙ্গতা, তাই জিহাদও ফরজে কেফায়া। যদি কেউ এই দায়িত্ব পালন না করে, তবে প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুপাতে গুনাহগার হবে। কেননা তা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর সামর্থ্য অনুপাতেই ফরজ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের যে কেউ কোন মন্দ কাজ দেখবে, সে যেন স্বহস্তে (শক্তিবলে) তা প্রতিহত করে। যদি তাতে সক্ষম না হয়, তাহলে যেন তার যবান দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তাতেও সক্ষম না হয়, তাহলে অন্তর দিয়ে। আর এটি হচ্ছে দুর্বলতম ঈমান।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/১২৬

আরও বলেন,

وقد تبين بهذا أن الدعوة إلى الله تجب على كل مسلم؛ لكنها فرض على الكفاية وإنما يجب على الرجل المعين من ذلك ما يقدر عليه إذا لم يقم به غيره وهذا شأن الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر وتبليغ ما جاء به الرسول والجهاد في سبيل الله وتعليم الإيمان والقرآن. -مجموع الفتاوى: 15/ 166

“পূর্বোক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট হল, আল্লাহর দিকে আহ্বান করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। তবে তা ফরজে কেফায়া। নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী তা ফরজ হয়, যখন অন্য কেউ তা না করে। আমর বিল মারূফ, নাহী আনিল মুনকার, রাসূলের আনীত দ্বীনের তাবলীগ, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ এবং ঈমান ও কুরআন শিক্ষা দেয়ার বিধানও এটাই।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ১৫/১৬৬

ইমাম গাযালি রহ. (৫০৫ হি.) বলেন,

الشرط الرابع كونه مأذوناً من جهة الإمام والوالي فقد شرط قوم هذا الشرط ولم يثبتوا للآحاد من الرعية الحسبة وهذا الاشتراط فاسد فإن الآيات والأخبار التي أوردناها تدل على أن كل من رأى منكرا فسكت عليه عصى إذ يجب نهيه أينما رآه وكيفما رآه على العموم فالتخصيص بشرط التفويض من الإمام تحكم لا أصل له. -إحياء علوم الدين: 2/315

“চতুর্থ শর্ত হল, ইমাম ও শাসকের পক্ষ হতে অনুমতি। কেউ কেউ এই শর্ত আরোপ করেছেন। তারা যে কোন ব্যক্তির জন্য আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার করার অনুমতি দেননি। কিন্তু এটি একটি বাতিল শর্ত। আমরা এখানে যে সকল আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করেছি, তা প্রমাণ করে, যে কেউ অন্যায় কাজ দেখে চুপ থাকবে সে গুনাহগার হবে। ব্যক্তির ওয়াজিব দায়িত্ব হল, যেখানেই যেভাবেই অন্যায় কাজ দেখবে, তাতেই বাধা দিবে। অতএব ইমামের অনুমতির শর্ত হঠকারিতা; যার কোন দালিলিক ভিত্তি নেই।” -ইহইয়াউ উলূমিদ দ্বীন: ২/৩১৫

তিনি আরও বলেন,

اعلم أن كل قاعد في بيته أينما كان فليس خاليا في هذا الزمان عن منكر من حيث التقاعد عن إرشاد الناس وتعليمهم وحملهم على المعروف ……… وكذا كل من تيقن أن في السوق منكرا يجري على الدوام أو في وقت بعينه وهو قادر على تغييره فلا يجوز له أن يسقط ذلك عن نفسه بالقعود في البيت بل يلزمه الخروج فإن كان لا يقدر على تغيير الجميع وهو محترز عن مشاهدته ويقدر على البعض لزمه الخروج لأن خروجه إذا كان لأجل تغيير ما يقدر عليه فلا يضره مشاهدة ما لا يقدر عليه وإنما يمنع الحضور لمشاهدة المنكر من غير غرض صحيح. -إحياء علوم الدين (2/342 )

“বর্তমান যমানায় যে কেউ ঘরে বসে থাকবে, সে অন্যায়ে লিপ্ত রয়েছে। কেননা সে মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেয়া, ইলম শিক্ষা দেয়া ও ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা হতে বিরত রয়েছে। ….. তেমনিভাবে যে ব্যক্তি নিশ্চিতরূপে জানে যে, বাজারে কোনো অন্যায় কাজ প্রতিনিয়ত বা নির্দিষ্ট কোনো সময়ে হচ্ছে এবং সে তা প্রতিহত করতে সক্ষম, তাহলে তার জন্য ঘরে বসে থেকে তা (প্রতিহত করা) থেকে বিরত থাকা জায়েয নয়; বরং তার জন্য আবশ্যক, বাজারে গিয়ে তা প্রতিহত করা। যদি পুরোটা প্রতিহত করার সামর্থ্য না রাখে; বরং আংশিক প্রতিহত করার সামর্থ্য রাখে এবং মন্দ দেখা থেকে বিরত থাকায় সচেষ্ট হয়, তাহলেও তার জন্য যাওয়া ওয়াজিব। কেননা এক্ষেত্রে সে বের হচ্ছে যতটুকু পারে ততটুকু অন্যায়ে বাধা দেয়ার জন্য। তাই যে অন্যায় সে প্রতিহত করতে পারছে না, তা দেখতে হলেও সমস্যা নেই। অন্যায় কাজ দেখতে যাওয়া তো তখন নিষিদ্ধ, যখন তাতে কোন ভালো উদ্দেশ্য থাকে না।” – ইহইয়াউ উলূমিদ দ্বীন: ২/৩৪২

সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার ড. মূসা শাহীন লিখেন,

وعموم الحديث في قوله “من رأى منكم منكرا” يشمل العالم والجاهل، فكل من يعلم أنه منكر يجب عليه أن ينكره، ولا يختص الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر بالعلماء وأصحاب الولايات. كل ما في الأمر أن الذي يأمر وينهي هو العالم بما يأمر به وينهي عنه، وذلك يختلف باختلاف الآمر والمأمور به، فإن كان المأمور به من الواجبات الظاهرة كالصلاة والصيام، أو كان المنهي عنه من المحرمات الواضحة كالزنا والخمر، فكل المسلمين علماء بها، واجب على آحادهم كما هو واجب على علمائهم وإن كان وجوبه على العلماء بصفة أشد، إذ فيهم قوة الإنكار، ولهم تزيد الاستجابة، ومنهم تؤخذ أحكام الشريعة. وإن كان المأمور به أو المنهي عنه من دقائق الأفعال والأقوال، كان الأمر بالمعروف واجب العلماء. -فتح المنعم شرح صحيح مسلم لموسى شاهين (ت1430هـ): 1/186

“তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় কাজ দেখে, -হাদিসের এ বাক্যটি তার ব্যাপকতার কারণে আলেম ও জাহেল উভয়কেই শামিল করে। তাই যে ব্যক্তি জানে এটা অন্যায়, তার জন্যই তাতে বাধা দেয়া ওয়াজিব। আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার আলেম ও শাসকদের সাথে খাস নয়। বরং যে ব্যক্তি আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার করছে, তার ‘মামুর বিহি’ (অর্থাৎ যে বিষয়ের আদেশ করছে) কিংবা ‘মানহী আনহু’ (অর্থাৎ যা হতে বারণ করছে তা) সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়াই যথেষ্ট। আর এটা ‘আমের’ (আদেশদাতা) ও ‘মামুর বিহি’ হিসেবে একেক জায়গায় একেক রকম হয়। যদি ‘মামুর বিহি’ নামায-রোযার মতো সুস্পষ্ট বিধান হয় কিংবা ‘মানহী আনহু’ মদ-যিনার মতো স্পষ্ট হারাম হয়, তবে তো প্রত্যেক মুসলিমই সে সম্পর্কে জ্ঞাত। যদিও আলেমদের ‍উপর এ দায়িত্ব বেশি বর্তায়। কেননা তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা বেশি, তাদের কথা মানুষ বেশি মানে এবং তাদের থেকেই শরীয়তের বিধান গ্রহণ করা হয়। আর যদি ‘মামুর বিহি’ কিংবা ‘মানহী আনহু’ সুক্ষ্ম কথা বা কাজ হয়, তবে সে ক্ষেত্রে আমর বিল মারূফ শুধু আলেমদের দায়িত্ব হবে।” -ফাতহুল মুনয়িম: ১/১৮৬

উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব এবং প্রত্যেকেই এই বিধানের মুখাতাব। বলা বাহুল্য, জিহাদও মুলত আমর বিল মা’রুফ ও নাহি আনিল মুনকার। সুতরাং জিহাদও প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব এবং প্রত্যেকেই জিহাদের বিধানের ‍মুখাতাব।

মুসলিমের নুসরত ও প্রতিরক্ষার মুখাতাব সকল মুসলিম, দায়িত্বও সকলের

মুসলিমদের নুসরত ও প্রতিরক্ষাও প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ –التوبة: 71

“মুমিন নর-নারীরা একে অপরের বন্ধু।” –সুরা তাওবা: ৭১

আরো ইরশাদ করেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ –الحجرات: 10

“মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” –সুরা হুজুরাত ১০

যখন মুসলিমরা পরস্পর ভাই ও বন্ধু, তখন ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের দাবি এটাই যে, পরস্পর দয়াপরবশ হবে। একে অপরের সুখে সুখী হবে, দুঃখে দুঃখী হবে। প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

مثل المؤمنين فى توادهم وتراحمهم وتعاطفهم مثل الجسد إذا اشتكى منه عضو تداعى له سائر الجسد بالسهر والحمى. –صحيح البخاري: 5665، صحيح مسلم: 6751

“পরস্পর ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতায়; মুমিনদের অবস্থা একটি দেহের মতো। যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ তার জন্য বিনিদ্র ও জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়ে।” -সহীহ বুখারি ৫৬৬৫, সহীহ মুসলিম ৬৭৫১

অন্য হাদিসে ইরশাদ করেন,

المسلم أخو المسلم لا يظلمه ولا يخذله ولا يحقره. –صحيح مسلم: 6706

“এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে না তার উপর জুলুম করতে পারে, না তাকে জুলমের সামনে অসহায় ছেড়ে দিতে পারে, আর না তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারে।” -সহীহ মুসলিম: ৬৭০৬

হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,

قوله لا يظلمه هو خبر بمعنى الامر فإن ظلم المسلم للمسلم حرام وقوله ولا يسلمه أي لا يتركه مع من يؤذيه ولا فيما يؤذيه بل ينصره ويدفع عنه وهذا أخص من ترك الظلم وقد يكون ذلك واجبا وقد يكون مندوبا بحسب اختلاف الأحوال وزاد الطبراني من طريق أخرى (آخر) عن سالم ولا يسلمه في مصيبة نزلت به. –فتح الباري: 5\97

“হাদীসেلا يظلمه  (এক মুমিন অন্য মুমিনের উপর জুলুম করতে পারে না) বাক্যটি সংবাদসূচক হলেও উদ্দেশ্য আদেশ। কেননা, এক মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের উপর জুলুম করা হারাম।ولا يسلمه  অর্থাৎ সে তাকে এমন কারো হাতে ছেড়ে রাখতে পারে না, যে তাকে কষ্ট দেবে; কিংবা এমন কোন অবস্থায়ও না, যা তাকে কষ্ট দেবে। বরং সে তার সাহায্য করবে। তার প্রতিরক্ষা করবে। জুলুম পরিত্যাগ করার নির্দেশের পর এ নির্দেশটি বিশেষায়িত একটি স্বতন্ত্র নির্দেশ। অবস্থা অনুযায়ী কখনো তা ফরজ, কখনো মুস্তাহাব। ত্ববারানী রহ. সালেম রহ. থেকে অন্য একটি সূত্রে অতিরিক্ত এ কথাটিও বর্ণনা করেছেন যে, ‘তার উপর আপতিত কোন মসবিতে তাকে ছেড়ে রাখতে পারে না’। -ফাতহুল বারি: ৫/৯৭

বুঝা গেল, বিপদগ্রস্ত ও মাজলুম মুসলিমকে সাহায্য করা এবং জুলুম ও বিপদ থেকে উদ্ধার করা ফরজ। একারণেই ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন,

ودفع الاعتداء عن المسلمين واجبٌ على كلّ مسلمٍ قادرٍ عليه كما ذكر ذلك الفقهاء في كتاب الجهاد . -الموسوعة الفقهية الكويتية: 6/ 261

“আক্রমণ হতে মুসলিমদের রক্ষা করা সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিমের ‍উপর ফরজ, যেমনটা ফুকাহায়ে কেরাম জিহাদ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।” -মাওসূআ’হ ফিকহিয়্যাহ: ৬/২৬১

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَ مَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا﴾ النساء: 75

“তোমাদের কী হলো! তোমরা কিতাল করছ না আল্লাহর রাস্তায় এবং ঐ সকল অসহায় নর-নারী ও শিশুদের (উদ্ধারের) জন্য, যারা ফরিয়াদ করে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে বের করে নিন এ জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা জালিম! আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কোনো অভিভাবক নির্ধারণ করে দিন এবং নিযুক্ত করে দিন আপনার পক্ষ থেকে কোনো সাহায্যকারী?” –সুরা নিসা: ৭৫

এটি সর্বসম্মত একটি মাসআলা। কোনো মুসলিম আক্রান্ত হলে, সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করা এবং শত্রুকে প্রতিহত করা প্রত্যেক মুসলিমের উপরই ফরজ। এতে কোনো দ্বিমত নেই। ফুকাহায়ে কেরাম স্পষ্ট করেই বিষয়টি আলোচনা করেছেন। এখানে নমুনা হিসেবে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি-

ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (মৃত্যু: ৩৭০ হি.) বলেন,

ومعلوم في اعتقاد جميع المسلمين أنه إذا خاف أهل الثغور من العدو، ولم تكن فيهم مقاومة لهم فخافوا على بلادهم وأنفسهم وذراريهم أن الفرض على كافة الأمة أن ينفر إليهم من يكف عاديتهم عن المسلمين، وهذا لاخلاف فيه بين الأمة إذ ليس من قول أحد من المسلمين إباحة القعود عنهم حتى يستبيحوا دماء المسلمين وسبي ذراريهم. اهـ -أحكام القرآن: 4/312

“সকল মুসলমানের প্রসিদ্ধ আকীদা হল, যখন সীমান্তবর্তী মুসলমানরা শত্রুর (দ্বারা আক্রান্ত হবার) আশঙ্কা করে; আর তাদের মাঝে শত্রু প্রতিরোধের ক্ষমতা বিদ্যমান না থাকে; ফলে তারা নিজ পরিবার-পরিজন, দেশ ও জানের ব্যাপারে শঙ্কা-গ্রস্ত হয়, তখন পুরো উম্মাহর উপর ফরজ হয়ে যায়, শত্রুর ক্ষতি থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে পারে পরিমাণ লোক তাদের সাহায্যে জিহাদে বের হওয়া। এবিষয়ে উম্মাহর মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। এমন কথা কোনো মুসলমানই বলেনি যে, শত্রুরা মুসলমানদের রক্ত প্রবাহিত করবে, তাদের পরিবার-পরিজনকে বন্দী করবে, আর অন্য মুসলমানদের জন্য তাদেরকে সাহায্য না করে বসে থাকা বৈধ হবে।” -আহকামুল কুরআন: ৪/৩১২

কাজি ইবনে আতিয়্যা আন্দালুসি রহ. (মৃত্যু: ৫৪১ হি.) বলেন,

والذي استمر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين. اهـ. –تفسير ابن عطية 1/289

“যে বিষয়টির উপর ইজমা চলে আসছে তা হল, উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরজে কেফায়া। যদি মুসলমানদের একাংশ তা আদায় করে, তাহলে অন্যদের থেকে এর দায়-ভার সরে যাবে। তবে যদি শত্রু কোনো ইসলামী ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়, তখন তা ফরজে আইন হয়ে যায়।” -তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ্: ১/২৮৯

ইমাম কুরতুবী রহ. (মৃত্যু: ৬৭১ হি.) বলেন,

وقد تكون حالة يجب فيها نفير الكل، وهي: الرابعة- وذلك إذا تعين الجهاد بغلبة العدو على قطر من الأقطار، أو بحلوله بالعقر، فإذا كان ذلك وجب على جميع أهل تلك الدار أن ينفروا ويخرجوا إليه خفافا وثقالا، شبابا وشيوخا، كل على قدر طاقته، من كان له أب بغير إذنه ومن لا أب له، ولا يتخلف أحد يقدر على الخروج، من مقاتل أو مكثر. فإن عجز أهل تلك البلدة عن القيام بعدوهم كان على من قاربهم وجاور هم أن يخرجوا على حسب ما لزم أهل تلك البلدة، حتى يعلموا أن فيهم طاقة على القيام بهم ومدافعتهم. وكذلك كل من علم بضعفهم عن عدوهم وعلم أنه يدركهم ويمكنه غياثهم لزمه أيضا الخروج إليهم، فالمسلمون كلهم يد على من سواهم، حتى إذا قام بدفع العدو أهل الناحية التي نزل العدو عليها واحتل بها سقط الفرض عن الآخرين. ولو قارب العدو دار الإسلام ولم يدخلوها لزمهم أيضا الخروج إليه، حتى يظهر دين الله وتحمى البيضة وتحفظ الحوزة ويخزى العدو. ولا خلاف في هذا. اهـ -تفسير القرطبي:  8/151-152

“কোনো কোনো অবস্থায় সকলের উপরই জিহাদে বেরিয়ে পড়া ফরজ হয়ে যায়। চতুর্থ মাসআলায় এটাই বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। উক্ত অবস্থা হল, যখন কোনো (মুসলিম) ভূখণ্ডে শত্রু দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলার কারণে বা কোনো ভূখণ্ডে শত্রু ঢুকে পড়ার কারণে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় উক্ত ভূখণ্ডের হালকা-ভারি, যুবক-বৃদ্ধ সকল অধিবাসীর উপর ফরজ শত্রুর মোকবেলায় জিহাদে বেরিয়ে পড়া। প্রত্যেকে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী শত্রু প্রতিহত করবে। যার পিতা নেই সে তো যাবেই, যার পিতা আছে সেও পিতার অনুমতি ছাড়াই বেরিয়ে পড়বে। যুদ্ধ করতে সক্ষম কিংবা (অন্তত মুজাহিদদের) সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম, এমন কেউ বসে থাকবে না। ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম হয়, তাহলে উক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মতো তাদের নিকটবর্তী এবং প্রতিবেশীদের উপরও আবশ্যক জিহাদে বের হয়ে পড়া; যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারবে যে, এখন তাদের শত্রু প্রতিহত করার এবং তাদেরকে বিতাড়িত করার সামর্থ্য অর্জন হয়েছে। তেমনি যে ব্যক্তিই জানতে পারবে যে, তারা শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম এবং সে বুঝতে পারছে, সে তাদের কাছে পৌঁছতে এবং তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম হবে; তার উপরই আবশ্যক সাহায্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। কারণ সকল মুসলমান তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে এক হস্তের ন্যায়। তবে যে এলাকায় শত্রু আগ্রাসন চালিয়েছে, তারা নিজেরাই যদি শত্রু প্রতিহত করতে পারে, তাহলে অন্যদের উপর থেকে ফরজ দায় সরে যাবে। যদি এমন হয় যে, শত্রুরা দারুল ইসলামের নিকটবর্তী হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও দারুল ইসলামে আক্রমণ করেনি, তাহলেও তাদের উপর ফরজ, শত্রু প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। যাতে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী থাকে, ইসলামী ভূখণ্ড সংরক্ষিত থাকে এবং শত্রু অপদস্থ ও পরাস্ত হয়। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।” -তাফসীরে কুরতুবী: ৮/১৫১-১৫২

আল্লামা শামী রহ. (মৃত্যু: ১২৫২ হি.) বলেন,

الجهاد إذا جاء النفير إنما يصير فرض عين على من يقرب من العدو، فأما من وراءهم ببعد من العدو فهو فرض كفاية عليهم، حتى يسعهم تركه إذا لم يحتج إليهم. فإن احتيج إليهم بأن عجز من كان يقرب من العدو عن المقاومة مع العدو أو لم يعجزوا عنها، لكنهم تكاسلوا ولم يجاهدوا: فإنه يفترض على من يليهم فرض عين كالصلاة والصوم، لا يسعهم تركه ثم وثم إلى أن يفترض على جميع أهل الإسلام شرقا وغربا على هذا التدريج. اهـ -رد المحتار: 3/238

“যদি শত্রুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়, তাহলে (প্রথমত) জিহাদ ফরজে আইন হয় ঐসব মুসলমানের উপর, যারা শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী। শত্রু থেকে যারা দূরে অবস্থান করছে, (শত্রু প্রতিহত করতে) যদি তাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হয়, তাহলে তাদের উপর জিহাদ (ফরজে আইন নয়; বরং) ফরজে কেফায়া। তাই তারা জিহাদে শরীক না হওয়ারও অবকাশ আছে। তবে শত্রুর নিকটে যারা রয়েছে, তারা যদি শত্রু প্রতিরোধে অপারগ হয় বা অলসতাবশত জিহাদ না করে, ফলে শত্রু প্রতিহত করতে দূরবর্তীদের সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে; যেমন নামাজ-রোজা ফরজে আইন। তখন আর তাদের জিহাদ না করার অবকাশ থাকবে না। এভাবে তাদের পরের এবং তাদের পরের পরের মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হতে থাকবে। পর্যায়ক্রমে পূর্ব থেকে পশ্চিম; সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে।” -রদ্দুল মুহতার: ৩/২৩৮

আরো দেখুন, বাদায়েউস সানায়ে’: ৭/৯৮, গিয়াসুল উমাম, পৃষ্ঠা: ১৯১, আল-মাজমূ’: ১৯/২৬৯, মারাতিবুল ইজমা: ১/১১৯, আলবাহরুর রায়েক: ১৩/২৮৯

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল, আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার, দাওয়াহ ইলাল্লাহ, মাজলুমকে সাহায্য করা এবং ইসলাম ও মুসলিমের নুসরত ও প্রতিরক্ষা ইত্যাদির মুখাতাব সকল মুসলিম এবং এগুলো সকল মুসলিমের উপর ফরজ। আর জিহাদ মূলত এসব আমলেরই একটি বিশেষ রূপ বা এসব উদ্দেশ্যেই ফরজ করা হয়েছে। উসূলবিদ ও ফুকাহায়ে কেরাম স্পষ্ট করেই বিষয়গুলো বলেছেন, যেমনটি আমরা উপরে তাঁদের উদ্ধৃতিগুলো আলোচনা করেছি। অতএব, জিহাদের মুখাতাবও শাসক-শাসিত, সাধারণ বিশিষ্ট সকল মুসলিম এবং সকলের উপরই জিহাদ ফরজ। একারণেই আমরা দেখি, কুরআন সুন্নাহ’য় যে ধরনের খেতাবের মাধ্যমে সালাত সাওমের মতো বিধানগুলো ফরজ করা হয়েছে, ঠিক একই ধরনের খেতাবের দ্বারা জিহাদও ফরজ করা হয়েছে।

কুরআনে কারীমে জিহাদের খেতাব ও সম্বোধন

সালাতের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়েছে-

أَقِيمُوا الصَّلَاةَ

“তোমরা নামায কায়েম করো।” –সুরা বাকারা: ৪৩

সাওমের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ

“হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে।” –সুরা বাকারা: ১৮৩

তেমনি জিহাদের ক্ষেত্রেও আমভাবে সকল ঈমানদারকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ} [التوبة: 123] }

“হে মুমিনগণ! কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী, তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।” –সুরা তাওবা: ১২৩

قَاتِلُوا الْمُشْرِكِين }[التوبة: 36] }

“তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো।” –সুরা তাওবা: ৩৬

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ} [التوبة: 38]}

“হে মুমিনগণ! তোমাদের কি হল? যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে কিতালে বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়!” –সুরা তাওবা: ৩৮

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ} [البقرة: 216]}

“তোমাদের উপর জিহাদ ফরজ করা হয়েছে।” –সুরা বাকারা: ২১৬

সুতরাং যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ব্যাপকভাবে সুস্পষ্ট করে সকল মুমিনকে খেতাব করে কিতালের নির্দেশ দিচ্ছেন, সেখানে কোনো শরঈ দলিল ছাড়া এমন কথা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয় যে, জিহাদের মুখাতাব শুধু বিশেষ শ্রেণি; সকল মুমিন নয়।

অধিকন্তু উমুমি খেতাবের পাশাপাশি জিহাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা খুসুসি খেতাবও করেছেন এবং একা হলেও কিতাল করার সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করেছেন।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

 [فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا}[النساء: 84}

“সুতরাং আপনি আল্লাহর রাস্তায় কিতাল করুন। আপনার উপর আপনার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার বর্তাবে না। আপনি মুমিনদেরকে (জিহাদের জন্য) উৎসাহিত করতে থাকুন। শীঘ্রই আল্লাহ কাফেরদের শক্তি-সামর্থ্য খর্ব করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা শক্তি-সামর্থ্যে পরাক্রমশালী এবং তাঁর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।” –সুরা নিসা ৮৪

ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালুসি রহ. (৫৪২ হি.) বলেন,

هذا أمر في ظاهر اللفظ للنبي عليه السلام وحده، لكن لم نجد قط في خبر أن القتال فرض على النبي صلى الله عليه وسلم دون الأمة مدة ما، المعنى- والله أعلم- أنه خطاب للنبي عليه السلام في اللفظ، وهو مثال ما يقال لكل واحد في خاصة نفسه، أي أنت يا محمد وكل واحد من أمتك القول له فَقاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ ولهذا ينبغي لكل مؤمن أن يستشعر أن يجاهد ولو وحده، ومن ذلك قول النبي عليه السلام «والله لأقاتلنهم حتى تنفرد سالفتي» وقول أبي بكر وقت الردة: «ولو خالفتني يميني لجاهدتها بشمالي». – المحرر الوجيز في تفسير الكتاب العزيز: 2\86

“বাহ্যত দেখা যায় এ আয়াতের আদেশ শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একার জন্য। তবে কোন হাদিসেই আমরা এ কথা পাইনি যে, কোনো যামানায় জিহাদ উম্মত বাদে শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ফরজ ছিল। (কাজেই)- ওয়াল্লাহু আ’লাম- আয়াতে বাহ্যত যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে, তবে এটি পৃথক পৃথক সকলকে বলারই নামান্তর। অর্থাৎ, হে মুহাম্মাদ! আপনার এবং আপনার উম্মতের সকলের প্রতিই নির্দেশ, ‘তুমি একা হলেও আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে বের হও। তোমার উপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার বর্তাবে না’। এজন্য প্রতিটি মুমিনের এই অনুভূতি রাখা উচিৎ যে, সে একা হলেও জিহাদ করে যাবে।

(এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী) এ অর্থেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি একা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করব।’

একই অর্থে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আরবের) অনেক লোক যখন মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল, হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন, ‘আমার ডান হস্ত আমার সঙ্গ না দিলে বাম হস্ত দিয়েই (অর্থাৎ কেউ আমার সাথে না থাকলে) আমি (একাই) তাদের (মুরতাদদের) বিরুদ্ধে জিহাদ করব।” -তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ: ২/৮৬

অন্যান্য মুফাসসিরিনে কেরামও ইবনে আতিয়্যাহ রহ. এর সাথে সহমত পোষণ করেছেন। ইমাম কুরতুবি রহ. ইবনে আতিয়্যাহ রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন,

ولهذا ينبغي لكل مؤمن أن يجاهد ولو وحده. –تفسير القرطبي: 5\293

“এ জন্য প্রত্যেক মুমিনের উচিৎ জিহাদ করা; যদিও সে একা হয়।” -তাফসীরে কুরতুবি: ৫/২৯৩

আবু হাইয়ান আন্দালুসী রহ. (৭৪৫ হি.) ইবনে আতিয়্যাহ রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করার পর বলেন,

ومعنى لا تكلف إلا نفسك: أي: لا تكلف في القتال إلا نفسك، فقاتل ولو وحدك. –البحر المحيط: 3\731

“তোমার উপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার বর্তাবে না- এ বাণীর অর্থ কিতালের ব্যাপারে তোমার উপর শুধু তোমার নিজের দায়িত্ব বর্তাবে। কাজেই তুমি কিতাল কর; যদি একা হও তবুও।” -আলবাহরুল মুহীত: ৩/৭৩১

আল্লামা ইবনে হাযম রহ. (৪৫৬ হি.) বলেন,

قال تعالى: {فقاتل في سبيل الله لا تكلف إلا نفسك} [النساء: 84] وهذا خطاب متوجه إلى كل مسلم، فكل أحد مأمور بالجهاد وإن لم يكن معه أحد، وقال تعالى: {انفروا خفافا وثقالا} [التوبة: 41] ، وقال تعالى: {فانفروا ثبات أو انفروا جميعا} [النساء: 71] . -المحلى بالآثار (5/ 421)

“আল্লাহ তায়ালা বলেন, (হে নবী) আপনি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করুন [সুরা নিসা ৮৪]। এই খেতাব-সম্বোধন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য। তাই প্রত্যেকেই জিহাদের জন্য আদিষ্ট, যদিও তার সাথে কেউই না থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা হালকা-ভারী উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বের হও’ [সুরা তাওবা: ৪১]। আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা পৃথক পৃথক বাহিনীরূপে (জিহাদের জন্য) বের হও কিংবা সকলে এক সঙ্গে বের হও’ [সুরা নিসা: ৭১]।” -আল-মুহাল্লা: ৫/৪২১

ফুকাহায়ে কেরামের সুস্পষ্ট বক্তব্য

এসব দলিলের ভিত্তিতে ফুকাহায়ে কেরামও বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন এবং তাঁরা সুস্পষ্ট ‘মুখাতাব’ শব্দটি ব্যবহার করেই বলেছেন, সকল মুমিনই জিহাদের মুখাতাব।

ইমাম সিরাজুদ্দিন আলি আততাইমি (হানাফি) রহ. (৫৬৯ হি.) বলেন,

الجهاد فرض كفاية إذا لم يكن النفير عاما، فإذا قام به البعض يسقط عن الباقين. فإذا صار النفير عاما فحينئذ يصير من فروض الأعيان، يخاطب به المخاطبون من أهل الإيمان، يخرج الرجال والنساء والعبيد بغير إذن مواليهم. –الفتاوى السراجية: 291

“যখন নফীরে আম না হয়, তখন জিহাদ ফরজে কেফায়া। কিছু মানুষ তা আদায় করলে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়। আর যখন নফীরে আম হয়, তখন জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। ঈমানদার সকলেই তার মুখাতাব হয়। তখন পুরুষ, নারী, গোলাম সকলেই জিহাদে বের হবে। মনিব ও অভিভাবকের অনুমতির প্রয়োজন হবে না।” -আলফাতাওয়াস সিরাজিয়্যাহ, পৃ: ২৯১

ইমাম ইবনে কুদামা রহ. (৬২০ হি.)  বলেন,

معنى فرض الكفاية، الذي إن لم يقم به من يكفي، أثم الناس كلهم، وإن قام به من يكفي، سقط عن سائر الناس. فالخطاب في ابتدائه يتناول الجميع، كفرض الأعيان، ثم يختلفان في أن فرض الكفاية يسقط بفعل بعض الناس له، وفرض الأعيان لا يسقط عن أحد بفعل غيره. –المغني: 9\196

“ফরজে কিফায়ার অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজন পরিমাণ লোকে তা আদায় না করলে সকলে গুনাহগার হবে, আর প্রয়োজন পরিমাণ লোকে আদায় করলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। অতএব, শুরুতে ফরজে কিফায়ার খেতাব ফরজে আইনের মতো সকলের উপরই বর্তায়। তবে ব্যবধান হলো, কিছু সংখ্যক লোকের আদায়ের দ্বারা ফরজে কিফায়ার দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়, পক্ষান্তরে ফরজে আইন একজনের আদায়ের দ্বারা আরেকজনের দায়িত্ব আদায় হয় না।” -আলমুগনি: ৯/১৯৬

ইমাম নাজমুদ্দিন যাহেদি (হানাফি) রহ. (৬৫৮ হি.) বলেন,

والغزو والجهاد تارة يكون فرضا من فروض الأعيان، يخاطب بهما كافة المسلمين من أهل الإيمان. –المجتبى شرح القدوري للزاهدي (ت658هـ، ص: 1542

“যুদ্ধ ও জিহাদ কখনো ফরজে আইন হয়, তখন ঈমানদার প্রত্যেক মুসলিমই এর মুখাতাব হয়।” -আলমুজতাবা, পৃ: ১৫৪২

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,

قال تعالى عن إبراهيم: {ربنا وابعث فيهم رسولا منهم يتلو عليهم آياتك ويعلمهم الكتاب والحكمة ويزكيهم} … فهذه أربعة أمور أرسله بها: تلاوة آياته عليهم وتزكيتهم وتعليمهم الكتاب والحكمة … فاستماع آيات الله والتزكي بها أمر واجب على كل أحد … وأما العلم بالكتاب والحكمة فهو فرض على الكفاية؛ لا يجب على كل أحد بعينه أن يكون عالما بالكتاب: لفظه ومعناه، عالما بالحكمة جميعها؛ بل المؤمنون كلهم مخاطبون بذلك وهو واجب عليهم كما هم مخاطبون بالجهاد. بل وجوب ذلك أسبق وأوكد من وجوب الجهاد؛ فإنه أصل الجهاد. ولولاه لم يعرفوا علام يقاتلون. ولهذا كان قيام الرسول والمؤمنين بذلك قبل قيامهم بالجهاد. فالجهاد سنام الدين وفرعه وتمامه، وهذا أصله وأساسه وعموده. -مجموع الفتاوى: 15/ 389-390

“আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দোয়া বর্ণনা করে বলেন, “হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্যে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদেরই মধ্য হতে হবে এবং যে তাদের সামনে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দিবে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে [সুরা বাকারা: ১২৯]। এখানে চারটি বিষয় রয়েছে, যার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর আয়াতসমূহ মানুষকে শোনানো, তাদের পরিশুদ্ধ করা এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া। অতএব আল্লাহ তায়ালার আয়াতসমূহ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা এবং তার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হওয়া প্রত্যেকের উপর ওয়াজিব। আর কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা ফরজে কেফায়া, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য কুরআনের সম্পূর্ণ শব্দ ও অর্থের আলেম হওয়া, সব রকম হিকমতের আলেম হওয়া ওয়াজিব নয়। বরং এর মুখাতাব হলো সকল মুমিন এবং এটা তাদের উপর সমষ্টিগতভাবে ওয়াজিব, যেমনিভাবে তারা সকলেই জিহাদের মুখাতাব। বরং এর গুরুত্ব জিহাদের চেয়েও বেশি ও অগ্রগণ্য। কেননা তা জিহাদের ভিত্তি। নতুবা তারা বুঝতেই পারবে না তারা কি জন্য জিহাদ করবে। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনগণ জিহাদের পূর্বে ইলম শিখেছেন। জিহাদ হলো দ্বীনের চূড়া ও পূর্ণাঙ্গতা, আর ইলম হলো দ্বীনের ভিত্তি ও স্তম্ভ।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ১৫/৩৮৯-৩৯০

দীর্ঘ আলোচনার সারকথা

উপরের আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হল যে, প্রত্যেক মুমিনই জিহাদের মুখাতাব এবং প্রত্যেকের জন্যই জিহাদের বিধান প্রযোজ্য। হোক সে পুরুষ বা নারী, শাসক বা শাসিত। তবে জিহাদ যখন ফরজে কেফায়া থাকে, তখন কারো দ্বারা দায়িত্বটি আদায় হয়ে গেলে বাকিরা দায়মুক্ত হয়ে যায়। অন্যথায় সবাই গোনাহগার হয়। আর যখন ফরজে আইন হয়, তখন সকলকেই তা আদায় করতে হয়।

ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উলূল আমরের

তবে হ্যাঁ, জিহাদ মৌলিকভাবে একটি ইজতেমায়ী কাজ; যদিও ইনফেরাদি জিহাদেরও কিছু ক্ষেত্র আছে। স্বভাবতই যে কোনো ইজতেমায়ী কাজে ইন্তেজাম ও ব্যবস্থাপনার বিষয় থাকে। ব্যবস্থাপনা কখনো সবাই করে না এবং তা সম্ভবও না। এজন্য জিহাদ ও কিতালের মুখাতাব সকলে হলেও উলুল আমর ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাই প্রথম স্তরের মুখাতাব এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও তাদের। বাকিদের দায়িত্ব তাদের অনুসরণ করা।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের অনেক কিতাবেই একটি হাদীস এসেছে, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقد عصى الله ومن يطع الأمير فقد أطاعني ومن يعص الأمير فقد عصاني وإنما الإمام جنة يقاتل من ورائه ويتقى به فإن أمر بتقوى الله وعدل فإن له بذلك أجرا وإن قال بغيره فإن عليه منه. -صحيح البخاري:2957

“যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালারই আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করল, সে আল্লাহ তায়ালারই নাফরমানি করল। যে ব্যক্তি (শরীয়ত স্বীকৃত) আমীরের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। আর যে আমীরের নাফরমানি করল, সে আমারই নাফরমানি করল। ইমাম হচ্ছে ঢালস্বরূপ। তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ করা হয় এবং তাঁরই মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়। যদি সে আল্লাহর তাকওয়ার নির্দেশ দেয় এবং সুবিচার করে, তবে সে এর বিনিময়ে (মহা) প্রতিদান পাবে, আর যদি সে এর বিপরীত করে, তবে এর দায় তাকেও বহন করতে হবে।” -সহীহ বুখারী: ২৯৫৭

ইবনে কুদামা রহ. (৬২০ হি.) বলেন,

وأمر الجهاد موكول إلى الإمام واجتهاده، ويلزم الرعية طاعته فيما يراه من ذلك. -المغني لابن قدامة: 9/ 202

“জিহাদের বিষয় ইমাম ও তার ইজতিহাদের উপর ন্যস্ত। জনসাধারণের জন্য আবশ্যক, মাসলাহাতের বিবেচনায় তিনি যে নির্দেশ দেন, তা মেনে চলা।” -আলমুগনি: ৯/২০২

তিনি আরও বলেন,

وواجب على الناس إذا جاء العدو، أن ينفروا؛ المقل منهم، والمكثر، ولا يخرجوا إلى العدو إلا بإذن الأمير … لأن أمر الحرب موكول إليه، وهو أعلم بكثرة العدو وقلتهم، ومكامن العدو وكيدهم، فينبغي أن يرجع إلى رأيه، لأنه أحوط للمسلمين. -المغني لابن قدامة: 9/ 213-214

“শত্রু এসে পড়লে ধনী-গরীব সকলের জন্য বের হয়ে পড়া ফরজ। তবে আমিরের অনুমতি ছাড়া শত্রুর দিকে রওয়ানা দেবে না। … কারণ, যুদ্ধের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তারই উপর ন্যস্ত। শত্রুর সংখ্যা কম না বেশি এবং শত্রুর গোপন ঘাঁটি ও কৌশল-ষড়যন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে তিনিই ভাল অবগত। অতএব তার মতামত মেনে নেয়া চাই। এটাই মুসলামনদের জন্য অধিক সতর্কতার দাবি।” –আলমুগনি: ৯/২১৩

খতিব শারবিনি রহ. (৯৭৭ হি.) বলেন,

لا تتسارع الطوائف والآحاد منا إلى دفع ملك منهم عظيم شوكته دخل أطراف بلادنا لما فيه من عظم الخطر. -مغني المحتاج إلى معرفة معاني ألفاظ المنهاج: 6/ 24

“কাফেরদের শক্তিধর কোন সম্রাট আমাদের রাষ্ট্রের সীমান্তে প্রবেশ করলে (আমীরের অনুমতি ও নির্দেশনা ছাড়া) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বা সাধারণ জনগণ তাকে প্রতিহত করতে তাড়াহুড়ো করে কোন ব্যবস্থা নেবে না। কেননা, এতে ভীষণ বিপদের আশঙ্কা আছে।” -মুগনিল মুহতাজ: ৬/২৪

একটি সংশয় নিরসন

এরকম কথা ফুকাহায়ে কেরামের আরো অনেকেই বলেছেন। এখানে আমরা নমুনা হিসেবে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করলাম। জিহাদ ও কিতালে ইমামুল মুসলিমিনের দায়িত্ব ও সাধারণ মানুষের জন্য তার আনুগত্য বিষয়ক এসব বক্তব্য এবং হাদীসের কিছু নস থেকে কেউ কেউ মনে করেন, ইমাম ব্যতীত কিংবা ইমামের অনুমতি ব্যতীত কোনো অবস্থায়ই মুসলিমদের জন্য জিহাদ ও কিতাল করার সুযোগ নেই। কেউ কেউ মনে করেন, ইমাম না থাকলে বা ইমাম কাজটি আঞ্জাম না দিলে জিহাদের দায়িত্ব বর্তায় শুধুই ইমামের পরবর্তী স্তরের উলুল আমর তথা সমাজের নেতৃস্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপর। তারা যদি উক্ত দায়িত্ব আদায় না করেন, সাধারণ মানুষের উপর কোনো দায় বর্তায় না।

বস্তুত দুটি ধারণাই ভুল। ইমামের বিধানটি মূলত তখনকার জন্য প্রযোজ্য, যখন ইমামুল মুসলিমিন থাকেন এবং তিনি জিহাদের কাজ আঞ্জাম দেন। তখন অন্যদের দায়িত্ব হল, তার নির্দেশের বাইরে না যাওয়া; বরং তার নির্দেশ অনুযায়ী জিহাদের কাজ আঞ্জাম দেয়া। পক্ষান্তরে মুসলিমদের যদি ইমাম না থাকেন বা তিনি জিহাদের কাজ আঞ্জাম না দেন অথবা ফরজ জিহাদ থেকে বারণ করেন, তখন তাকে উপেক্ষা করে জিহাদ করাই মুসলিমদের উপর ফরজ। বিষয়টি আমরা সামনে স্বতন্ত্র শিরোনামে দলিল প্রমাণসহ আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

জিহাদের দায়িত্ব শুধু উলুল আমরেরও নয়

একইভাবে ইমামের পরবর্তী উলুল আমরের বিষয়টিও যেমন আমরা উপরে আলোচনা করেছি। অর্থাৎ মূলত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটা তাদের। বাকিদের দায়িত্ব তাদের অনুসরণ করে কাজটি আঞ্জাম দেয়া। কিন্তু ইমামের মতো তারাও যদি কাজটি না করেন, তখন বাকিরা দায়মুক্ত হয়ে যায় না; বরং তাদের দায়িত্ব বেড়ে যায়। সামর্থ্য অনুযায়ী কাজটি সম্পাদনের জন্য এগিয়ে আসা সকলের দায়িত্ব হয়ে যায়। কিছুই না করতে পারলে অন্তত উলুল আমরের পেছনে লেগে থাকা, তাদের কাছে আবেদন নিবেদন করতে থাকা, তাড়া দিতে থাকা এবং জিহাদের জন্য সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু ব্যয় করার চেষ্টা করা তাদের দায়িত্ব। অন্তত এতটুকু না করলে সাধারণ মানুষও দায়মুক্ত হতে পারবে না। যেমন একজন মাইয়েতের কাফন দাফনের ব্যবস্থা যদি উলুল আমর ব্যক্তিরা না করেন, সাধারণ মানুষের দায়িত্ব এগিয়ে আসা এবং তার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা। অন্যথায় সবাই গুনাহগার হবে। উলুল আমরের না করার অজুহাতে সাধারণ মানুষ তাদের দায় থেকে মুক্ত হবে না। জিহাদ যখন ফরজে আইন, বিষয়টি তখন একদমই পরিষ্কার। কারণ ফরজে আইন মানেই প্রত্যেকের উপর ফরজ, একজনের আদায় করা বা না করার সঙ্গে আরেকজনের দায়িত্ব আদায় হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রত্যেককেই তা আদায় করতে হয়। এজন্যই ফুকাহায়ে কেরাম ফরজে আইন জিহাদের নজির হিসেবে নামায ও রোযার উদাহরণ দিয়েছেন।

আর জিহাদ যখন ফরজে কেফায়া, তখন যদি তা অনাদায়ী থাকে, তবুও একই কথা। কেউই তার দায় থেকে মুক্ত হতে পারবে না। এজন্যই ফুকাহায়ে কেরাম ফরজে কেফায়া জিহাদের নজির হিসেবে জানাযা ও কাফন দাফনের কথা উল্লেখ করেছেন। আলাউদ্দিন হাসকাফি রহ. (১০৮৮ হি.) আদ্দুররুল মুখতারে বলেন,

وإياك أن تتوهم أن فرضيته تسقط عن أهل الهند بقيام أهل الروم مثلا بل يفرض على الأقرب فالأقرب من العدو إلى أن تقع الكفاية فلو لم تقع إلا بكل الناس فرض عينا كصلاة وصوم ومثله الجنازة والتجهيز وتمامه في الدرر. ‫‫ ‫

“তুমি এমন ধারণা করো না যে, রোমের মুসলমানরা জিহাদ করলে হিন্দুস্তানের লোকেরা জিহাদের ফরজ দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। বরং শত্রু প্রতিরোধে যথেষ্ট হওয়া পর্যন্ত; সর্বপ্রথম শত্রুর নিকটবর্তীদের উপর, তারপর তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর –এ ধারাবাহিকতায় ফরজ হতে থাকবে। যদি সকল মুসলিমের অংশগ্রহণ ব্যতীত প্রতিরোধ সম্ভব না হয়, তাহলে নামায রোযার মতো সকলের উপর ফরজে আইন হয়ে যাবে। মৃত ব্যক্তির জানাযা ও কাফন দাফনের বিধানও এই রকম।…”

উক্ত বক্তব্যের ব্যাখায় আল্লামা শামি রহ. (১২৫২ হি.) বলেন,

… قال في النهر: ويدل عليه ما في البدائع.

ولا ينبغي للإمام أن يخلي ثغرا من الثغور من جماعة من المسلمين (وفي نسخة البدائع: “من الغزاة” بدلا “من المسلمين”) فيهم غناء وكفاية، لقتال العدو فإن قاموا به سقط عن الباقين، وإن ضعف أهل ثغر عن مقاومة الكفرة وخيف عليهم من العدو، فعلى من وراءهم من المسلمين الأقرب فالأقرب أن ينفروا إليهم، وأن يمدوهم بالسلاح والكراع والمال لما ذكرنا إنه فرض على الناس كلهم ممن هو من أهل الجهاد، ولكن سقط الفرض عنهم لحصول الكفاية بالبعض فما لم يحصل لا يسقط اهـ.

قلت: وحاصله أن كل موضع خيف هجوم العدو منه فرض على الإمام أو على أهل ذلك الموضع حفظه. وإن لم يقدروا فرض على الأقرب إليهم إعانتهم إلى حصول الكفاية بمقاومة العدو…..

ونقل صاحب النهاية عن الذخيرة أن الجهاد إذا جاء النفير إنما يصير فرض عين على من يقرب من العدو، فأما من وراءهم ببعد من العدو فهو فرض كفاية عليهم، حتى يسعهم تركه إذا لم يحتج إليهم فإن احتيج إليهم بأن عجز من كان يقرب من العدو عن المقاومة مع العدو أو لم يعجزوا عنها، لكنهم تكاسلوا ولم يجاهدوا فإنه يفترض على من يليهم فرض عين كالصلاة والصوم، لا يسعهم تركه ثم وثم إلى أن يفترض على جميع أهل الإسلام شرقا وغربا على هذا التدريج ونظيره الصلاة على الميت، فإن من مات في ناحية من نواحي البلد فعلى جيرانه وأهل محلته أن يقوموا بأسبابه، وليس على من كان ببعد من الميت أن يقوم بذلك، وإن كان الذي ببعد من الميت يعلم أن أهل محلته يضيعون حقوقه أو يعجزون عنه كان عليه أن يقوم بحقوقه كذا هنا اهـ. – رد المحتار:4/124

“আননাহরুল ফায়েকে বলা হয়েছে, ‘বাদায়ে’ কিতাবের নিম্নোক্ত বক্তব্যটি উপরের মাসআলার দলীল:

ইমামের জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি-সামর্থ্য রাখে, এমন একটি মুজাহিদ দল থেকে মুসলমানদের কোনো একটি সীমান্তও খালি রাখা বৈধ নয়। তারা যদি শত্রুর বিরুদ্ধে কিতালে যথেষ্ট হয়, তাহলে অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে কোনো সীমান্তের লোকেরা যদি কাফেরদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে দুর্বল হয় এবং তারা শত্রুর কবলে পড়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে প্রথমে তাদের পেছনে অবস্থানকারী সর্বাধিক নিকটবর্তী মুসলমানদের জন্য, তারপর ক্রমান্বয়ে তাদের নিকটবর্তীদের জন্য বের হয়ে পড়া; অস্ত্র, ঘোড়া এবং মাল দিয়ে সাহায্য করা আবশ্যক। কারণ, আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, জিহাদ করার সামর্থ্য রাখে এমন সকলের উপরই জিহাদ ফরজ। কিছু লোকের মাধ্যমে কাজটি পূর্ণ হয়ে যায় বিধায় অন্যরা ফরজ থেকে অব্যাহতি পায়। সুতরাং যখন কিছু লোকের মাধ্যমে আদায় হবে না, তখন বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হবে না।’ নাহরের বক্তব্য সমাপ্ত

(শামি রহ. বলেন), আমি বলি, উপরের আলোচনার সারকথা হল, যেখানেই শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা আছে, ইমাম বা স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর সে স্থানটিকে হেফাজত করা ফরজ। তারা সক্ষম না হলে তাদের নিকটবর্তীদের জন্য তাদের সাহায্য করা ফরজ;  যাবৎ না শত্রু প্রতিরোধের যথেষ্ট ব্যবস্থা হয়।

‘নিহায়া’ গ্রন্থকার ‘যাখিরা’ গ্রন্থ থেকে বর্ণনা করেন, শত্রুরা যদি মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়, তাহলে (প্রথমত) জিহাদ ফরজে আইন হয় সে সকল মুসলমানের উপর, যারা শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী। শত্রু থেকে যারা দূরে অবস্থান করছে, (শত্রু প্রতিহত করতে) যদি তাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হয়, তাহলে তাদের উপর জিহাদ (ফরজে আইন নয়; বরং) ফরজে কেফায়া। সে ক্ষেত্রে তাদের জিহাদে শরীক না হওয়ারও অবকাশ আছে; যদি শত্রু প্রতিরোধে তাদের প্রয়োজন না থাকে। তবে শত্রুর নিকটে যারা রয়েছে, তারা যদি শত্রু প্রতিরোধে অপারগ হয় বা অলসতাবশত জিহাদ না করে, ফলে শত্রু প্রতিহত করতে দূরবর্তীদের সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে দূরবর্তীদের উপরও জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে; যেমন নামায, রোযা ফরজে আইন। তখন আর তাদের জিহাদ না করার অবকাশ থাকবে না। এভাবে তাদের পরের এবং তাদের পরের মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হতে থাকবে। পর্যায়ক্রমে পূর্ব থেকে পশ্চিম; সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে। এর উদাহরণ মৃত ব্যক্তির জানাযার মতো। শহরের এক কোণে কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির প্রতিবেশী এবং মহল্লাবাসীদের উপর তার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। তার থেকে দূরে অবস্থানকারীদের উপর এগুলো করা আবশ্যক না। কিন্তু দূরে অবস্থানকারী যদি জানতে পারে যে, মৃত ব্যক্তির মহল্লাবাসী তার হক্ব আদায় করছে না কিংবা তাদের সে সামর্থ্য নেই, তাহলে তার উপর মৃত ব্যক্তির হক্বসমূহ আদায় করা আবশ্যক। জিহাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনই।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪

খতিব শারবিনি রহ. (৯৭৭ হি.) বলেন,

ويأثم بتعطيل فرض الكفاية كل من علم بتعطيله وقدر على القيام به وإن بعد عن المحل، وكذا يأثم قريب منه لم يعلم به لتقصيره في البحث عنه، ويختلف هذا بكبر البلد وصغره. اهـ -مغني المحتاج: 6/16

“ফরজে কেফায়া আদায় না হলে প্রত্যেক এমন ব্যক্তি গুনাহগার হবে, যে জানে যে, তা আদায় হয়নি এবং সে তা আদায়ে সক্ষম; যদিও (ঘটনাস্থল থেকে) তার অবস্থান দূরে হয়। আর নিকটস্থ ব্যক্তি যদি না জেনে থাকে, তাহলে যথাযথ অনুসন্ধান না করার কারণে সেও গুনাহগার হবে। এলাকা ছোট-বড় হওয়ার ভিত্তিতে দূর-নিকটের ব্যবধান হবে।” –মুগনিল মুহতাজ ৬/১৬

শায়খ আব্দুল কারীম যায়দান রহ. (১৪৩৫ হি.) বলেন,

وإنما يأثم الجميع إذا لم يحصل الواجب الكفائي لأنه مطلوب من مجموع الأمة، فالقادر على الفعل عليه أن يفعله، والعاجز عنه عليه أن يحث القادر ويحمله على فعله. فإذا لم يحصل الواجب كان ذلك تقصيرا من الجميع: من القادر لأنه لم يفعله، ومن العاجز لأنه لم يحمل القادر على فعله ويحثه عليه. اهـ -الوجيز في أصول الفقه: 36

“ফরজে কিফায়া আদায় না হলে সকলেই গুনাহগার হওয়ার কারণ হচ্ছে, তা উম্মাহর সমষ্টি থেকে আদায় হওয়া উদ্দেশ্য। সক্ষম ব্যক্তির জন্য আবশ্যক তা আদায় করা আর অক্ষমের দায়িত্ব হল, তাকে উৎসাহ দেয়া ও উদ্বুদ্ধ করা। ফরজটি যখন আদায় হয়নি, তখন সকলেরই অবহেলা হয়েছে। সক্ষম ব্যক্তি না করার কারণে আর অক্ষম ব্যক্তি সক্ষমকে উৎসাহ না দেয়া ও উদ্বুদ্ধ না করার কারণে।” –আলওয়াজিয ফি উসূলিল ফিকহ: ৩৬

উপরোক্ত বক্তব্যগুলো থেকে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, জিহাদের দায়িত্ব শুধু ‘উলুল আমর’ বা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নয়; বরং এ দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলিমের। যদি দায়িত্বটি যথাযথ আদায় না হয়, তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে এবং সকলকেই নিজ নিজ সুযোগ সামর্থ্য অনুযায়ী তার দায় বহন করতে হবে।

‘উলুল আমর’ মানসূস নয়; পরিবর্তনশীল

তাছাড়া আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ‘উলুল আমর’ কে বা কারা, তা শরীয়তের পক্ষ থেকে মানসূস বা সুনির্দিষ্ট নয়; বরং তা বিভিন্ন কারণেই পরিবর্তনযোগ্য। বিশেষ করে উলুল আমর যদি তার ফরজ দায়িত্ব আদায় না করে, এমনিতেই ‘উলুল আমর’-এর মর্যাদা হারায়। অপরদিকে মুসলিমদের আক্রান্ত হওয়ার মতো জরুরি ও আপদকালীন সময়, যোগ্য যারা এগিয়ে এসে দায়িত্ব আদায় করেন, তখন এই কাজের মাধ্যমেই তারা উলুল আমর-এর মর্যাদায় সমাসীন হন। এরকম আপদকালীন জরুরি অবস্থায়; দায়িত্বপ্রাপ্ত উলুল আমর ব্যক্তিবর্গ যখন এগিয়ে আসেন না, তখন যোগ্যদের দায়িত্ব, এগিয়ে এসে হাল ধরা, আক্রান্ত মুসলিমদের উদ্ধার করা। মুসলিমদের শত্রুর খোরাকে পরিণত হওয়ার পরও; আমি উলুল আমর নই, এমন অজুহাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুসলিমদের ধ্বংস হওয়ার তামাশা দেখতে থাকার কোনো সুযোগ ইসলামী শরীয়াহ’য় নেই। বরং এঅবস্থায় যারা এগিয়ে এসে দায়িত্ব আঞ্জাম দিবেন, তারা যেমন শরীয়তের দৃষ্টিতে উলুল আমর হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন, তেমনি পূর্বপ্রতিষ্ঠিত উলুল আমর ব্যক্তিরা যদি এমন ফরজ ও গুরুদায়িত্ব থেকে পিছিয়ে থাকেন, তারা অতি অবশ্যই উলুল আমর’-এর মর্যাদা হারাবেন। এটি শুধু শরঈ বিধানই নয়; আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের তাকবিনি বিধানও বটে। আল্লাহ আয়ালা ইরশাদ করেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ. المائدة: 54

“হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দ্বীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালোবাসবে। তারা হবে মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” –সুরা মায়েদা: ৫৪

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ (38) إِلَّا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (39) -التوبة

“হে মুমিনগণ! তোমাদের কি হল? যখন তোমাদেরকে আল্লহর পথে জিহাদে বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়? তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে পার্থিব জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে গেছ? তবে (স্মরণ রেখ) আখেরাতের মোকাবেলায় পার্থিব জীবনের আনন্দ অতি সামান্য। তোমরা যদি জিহাদে বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তি দেবেন এবং তোমাদেরকে পরিবর্তন করে অন্য এক সম্প্রদায় আনয়ন করবেন এবং তোমরা তাঁর কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখেন।” –সুরা তাওবা: ৩৯

প্রথম আয়াতে দ্বীন বিমুখ হলে আল্লাহ নতুন একটি দ্বীনদার সম্প্রদায়ের আগমন ঘটাবেন বলে ধমক দিয়েছেন। দ্বিতীয় আয়াতে জিহাদে না গেলে মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করবেন এবং তাদের পরিবর্তন করে অন্য এমন একটি সম্প্রদায়ের আগমণ ঘটাবেন বলে ধমক দিয়েছেন, যারা জিহাদ করবে। উক্ত দ্বীনদার ও মুজাহিদ শ্রেণির যে ছয়টি বৈশিষ্ট্য প্রথমোক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন, ফরজ জিহাদ ত্যাগকারীর জন্য উক্ত বৈশিষ্ট্যের ধারক হওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। সুতরাং যারা আল্লাহর কাছে দ্বীনদার হিসেবেই স্বীকৃত নয়; তাদের জন্য দ্বীনদার মুসলিমদের ‘উলুল আমর’ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

একটি দুঃখজনক বিষয়

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে মুসলিম নামধারী যেসব গণতন্ত্রী শাসক; অসংখ্য কুফর শিরকে লিপ্ত, তাদেরকেও এক শ্রেণির কিছু আলেম মুসলিমদের ‘উলুল আমর’ হিসেবে প্রমাণ করার এবং প্রচার করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়; বরং এদের মতো যেসব শাসক নিজেরাই ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত, তাদের অনুমতি ব্যতীত আক্রান্ত মুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া এবং দিফায়ী জিহাদ করা পর্যন্ত হারাম ফতোয়া দিচ্ছেন (নাউযুবিল্লাহ)। এসব আলেম সম্পর্কে মুফতি কেফায়াতুল্লাহ রহ.র একটি ফতোয়া উদ্ধৃত করছি। সমঝদারদের জন্য আশা করি এতটুকুই যথেষ্ট ইনশাআল্লাহ।

প্রচলিত আইনের শাসকদের ‘উলুল আমর’ মনে করলে, তাকে ইমাম বানানো জায়েয নয়

মুফতি কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি রহ.র ফতোয়াটি নিম্নরূপ:

خلاف شرع حکم کرنے والے حکمران طاغوت ہیں ان کو “اولی الامر” میں داخل کرنےوالے کی امامت نا‍‍‌جائز ہے۔

(سوال) جو شخص آیت شریفہ “واولی الامر منکم” کو حکام آئین موجودہ  پر محمول کرتا ہو اور حکام آئین موجودہ کے حکم کو اس آیت شریفہ سے استدلال کر کے واجب العمل کہتا ہو تو ایسے شخص کا شریعت میں کیا حکم ہے اور اس  شخص کے ‍‍‌پیچھے نماز پڑھنا جائز ہے یا نہیں؟

المستفتی نمبر 1462 مولوی محمد شفیغ صاحب مدرس اول مدرسہ اسلامیہ شہرملتان 23 ربیع الاول 1356ھ م 3 جون 1937۔

(جواب 144 ) “و اولی الامر منکم” سے علماء یا حکام مسلمین مراد ہیں۔ یعنی ایسے حکام جو مسلمان ہوں اور خدا و رسول صلی اللّہ علیہ و سلم کے حکم کے موافق احکام جاری کریں۔ ایسے مسلمان حاکم جو خدا اور رسول کے احکام کے خلاف حکم جاری کریں “من لم یحکم بما انزل اللّہ فاولئک ھم الکافرون” میں داخل ہیں اور خدا اور رسول کے خلاف حکم جاری کرنےوالوں کو قرآن پاک میں طاغوت فرمایا گیا ہے۔ اور طاغوت کی اطاعت حرام ہے۔ پس جو شخص ایسے حکام کو جو الہی شریعت اور آسمانی قانون کے خلاف حکم کرتے ہیں  “اولی الامرمنکم” میں داخل قرار دے، وہ قرآن پاک کی نصوص صریحہ کی مخالفت کرتا ہے۔ انگریزی قانون کے ماتحت خلاف شرع حکم کرنے والے خواہ غیر مسلم ہوں،خواہ نام کے مسلمان طاغوت ہیں۔ اولی الامر میں کسی طرح داخل نہیں ہو سکتے۔ ان کو اولی الامر میں داخل کرنےوالا یا مجنون ہے یا جاہل یا فاسق۔ اور ایسی حالت میں اس کو مقتدا بنانا اور امام مقرر کرنا ناجائز ہے۔ فقط محمد کفایت اللّہ کان اللّہ لہ۔ كفاية المفتي: 1/139

“শরীয়াহ পরিপন্থী বিধান আরোপকারী শাসক তাগুত। যে ব্যক্তি তাকে ‘উলুল আমর’ গণ্য করে, তার ইমামতি নাজায়েয।

প্রশ্ন: যে ব্যক্তি আয়াতে বর্ণিত ‘উলিল আমরি মিনকুম’কে বর্তমান আইনের শাসকদের উপর প্রয়োগ করে এবং এধরনের শাসকদের আইন ও বিধান মানা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে আয়াত দিয়ে দলিল দেয়, শরীয়তে এমন ব্যক্তির হুকুম কি এবং তার পেছনে নামায পড়া জায়েয কি না?

উত্তর: ‘উলুল আমর’ দ্বারা উলামা বা মুসলিম শাসক উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন মুসলিম শাসক, যে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান অনুযায়ী আইন জারি করে। যে মুসলিম শাসক আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের বিপরীত আইন জারি করে, সে ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারা কাফের’ [সুরা মায়েদা: ৪৪], এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এমন ব্যক্তিকে কুরআনে তাগুত বলা হয়েছে। আর তাগুতের আনুগত্য হারাম। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন শাসকদের উলুল আমর মনে করে, সে কুরআনের সুস্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচারী। ইংরেজদের আইন অনুযায়ী শরীয়তের খেলাফ বিধান আরোপকারী; অমুসলিম হোক বা নামধারী মুসলিম হোক, সে তাগুত। কিছুতেই সে উলুল আমরের অন্তুর্ভুক্ত হতে পারে না। যে ব্যক্তি তাকে উলুল আমর গণ্য করবে, সে হয় পাগল, না হয় মুর্খ, না হয় ফাসেক। এমন ব্যক্তিকে অনুসৃত ও ইমাম বানানো জায়েয নেই।” -কেফায়াতুল মুফতি: ১/১৩৯

দিফায়ী জিহাদে ইমামের শর্ত!

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জিহাদের জন্য ইমামের শর্ত। আমরা আগেই বলেছি, জিহাদ ও কিতালে ইমামের দায়িত্ব এবং সাধারণ মুসলিমদের তার আনুগত্য বিষয়ক কিছু নস ও ফিকহের কিছু বক্তব্য থেকে কেউ কেউ মনে করেন, দিফায়ী জিহাদের জন্যও ইমাম থাকা শর্ত। আমাদের যেহেতু এখন ইমাম নেই কিংবা আমাদের শাসকরা যেহেতু জিহাদ করছেন না, সুতরাং আমাদের উপর জিহাদ ফরজ নয় বা আমাদের জন্য জিহাদ করার অবকাশ নেই। এরা যদিও সকল মুসলিমের জিহাদের মুখাতাব হওয়া অস্বীকার করে না, কিন্তু প্রকারান্তরে ফলাফল একই দাঁড়ায়। অর্থাত এদের দৃষ্টিতেও শাসকরা জিহাদ না করলে সাধারণ মানুষের উপর কোনো দায় দায়িত্ব বর্তায় না।

প্রথম কথা হচ্ছে, জিহাদ ফরজ হওয়া কিংবা আদায় করা; কোনোটার জন্যই ইমাম শর্ত নয়। এমনকি ইকদামি জিহাদের জন্যও ইমাম শর্ত নয়। এমন কথা না কোরআন সুন্নাহর কোথাও আছে, না ফুকাহায়ে কেরামের কেউ বলেছেন। ফুকাহায়ে কেরাম যেটা বলেছেন, সেটা হল, মুসলিমদের যদি ইমাম থাকে এবং তিনি জিহাদের কাজ আঞ্জাম দেন, তাহলে সাধারণ মানুষের দায়িত্ব তার অধীনে জিহাদ করা। ইমামের সঙ্গে জিহাদ করা বা জিহাদে ইমামের আনুগত্য বিষয়ক নসগুলোর ব্যাখ্যাও ফুকাহায়ে কেরাম এভাবেই করেছেন। কিন্তু বর্তমানে যারা ঢালাওভাবে জিহাদের জন্য ইমামের শর্ত করেন, তারা মূলত নসগুলো এবং ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্যগুলো ভুল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন।

অপরদিকে একথাগুলোও ফুকাহায়ে কেরাম স্পষ্ট করে বলেছেন যে, মুসলিমদের ইমাম যদি কোনো কারণে উপস্থিত না থাকেন বা একদম মুসলিমদের কোনো ইমামই না থাকেন কিংবা ইমাম জিহাদের কাজ আঞ্জাম না দেন অথবা দিফায়ী জিহাদে তার অনুমতি নেয়ার সুযোগ না থাকে, এমনকি তিনি যদি দিফায়ী জিহাদ করতে নিষেধ করেন, তবুও দিফায়ী জিহাদ ফরজ এবং ইমামের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তা আদায় করাও ফরজ। সামনে আমরা ফুকাহায়ে কেরামের এবিষয়ক বক্তব্যগুলো উদ্ধৃত করব ইনশাআল্লাহ।

ইমাম ব্যতীত জিহাদ বৈধ নয়, রাফেজি শিয়াদের আকিদা

জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত বা ইমাম ব্যতীত জিহাদ করা যাবে না, এটি মুসলিমদের আকিদা নয়। এটি রাফেজি শিয়াদের আকিদা। শিয়াদের এই ফেরকা সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র ফতোয়া হল, তারা মুসলিম নয়; কাফের।

আব্দুল কাদের জিলানি রহ. (৫৬১ হি.) বলেন,

فقد شبهت مذاهب الروافض باليهودية، قال الشعبي: محبة الروافض محبة  اليهود، قالت اليهود: لا تصلح الإمامة إلا لرجل من آل داود، وقالت الرافضة: لا تصلح الإمامة إلا لرجل من ولد على بن أبي طالب؛ وقالت اليهود: لا جهاد في سبيل الله حتى يخرج المسيح الدجال، وينزل بسبب من السماء، وقالت الروافض: لا جهاد في سبيل الله حتى يخرج المهدي وينادي مناد من السماء. -الغنية لطالبي طريق الحق عز وجل مع حاشية أبي عبد الرحمن صلاح بن محمد، دار الكتب العلمية، بيروت، ج:1، ص: 184

“রাফেজিদের মাযহাব ইহুদি ধর্মের সদৃশ। শা’বি রহ. বলেন, রাফেজিদেরকে ভালোবাসা ইহুদিদেরকে ভালোবাসার নামান্তর। কারণ ইহুদিরা বলে, ইমামত একমাত্র দাউদ আ.-র বংশধর এক ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। আর রাফেজিরা বলে, ইমামত একমাত্র আলী রা.-র বংশধর এক ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। এমনিভাবে ইহুদিরা বলে, আল্লাহর রাস্তায় কোনো জিহাদ নেই, যতক্ষণ না মাসীহুদ দাজ্জাল একটি মাধ্যম ব্যবহার করে আকাশ থেকে অবতরণ করবে। আর রাফেজিরা বলে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ নেই, যতক্ষণ না ইমাম মাহদি বের হবেন এবং আকাশ থেকে একজন আহ্বায়ক আহ্বান করবেন।” –আলগুনইয়াহ লিতালিবি তারিকিল হাক, আবু আব্দুর রহমান সালাহ কৃত টীকাসহ: ১/১৮৪

ইবনু আবিল ইয আলহানাফি রহ. (৭৪৬ হি.) বলেন,

قوله: (وَالْحَجُّ وَالْجِهَادُ مَاضِيَانِ مَعَ أُولِي الْأَمْرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، بَرِّهِمْ وَفَاجِرِهِمْ، إلى قِيَامِ السَّاعَة، لَا يُبْطِلُهُمَا شَيْءٌ وَلَا يَنْقُضُهُمَا). ش: يُشِيرُ الشَّيْخُ رحمه الله إلى الرَّدِّ على الرَّافِضَة، حَيْثُ قَالُوا: لَا جِهَادَ في سَبِيلِ الله حتى يَخْرُجَ الرِّضَا مِنْ آلِ مُحَمَّدٍ، وَيُنَادِي مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: اتَّبِعُوهُ!! وَبُطْلَانُ هَذَا الْقَوْلِ أَظْهَرُ مِنْ أَنْ يُسْتَدَلَّ عليه بِدَلِيلٍ. -شرح العقيدة الطحاوية لإبن أبى العز الحنفي، تحقيق أحمد محمد شاكر: 2/ 443

“ত্বাহাবি রহ. এর বক্তব্য, ‘নেককার হোক ফাসেক হোক, মুসলিম উলুল আমরদের সাথে মিলে কিয়ামত পর্যন্ত হজ্জ ও জিহাদ চলমান থাকবে। কোনো কিছুই তা বাতিল ও নস্যাৎ করতে পারবে না’।

ব্যাখ্যা: শায়খ রহ. রাফেজিদের খণ্ডনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। রাফেজিরা বলে, ‘যতদিন মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বংশ থেকে রেজা আত্মপ্রকাশ না করবে এবং আকাশ থেকে ঘোষণা না আসবে যে, তোমরা তার অনুসরণ কর, ততদিন ফি সাবিলিল্লাহ কোনো জিহাদ করা যাবে না’।

একথাটির বাতুলতা এতই সুস্পষ্ট, যার জন্য দলীল প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন।”–শরহুল আকিদাতিত ত্বাহাবিয়্যাহ, ইবনু আবিল ইয: ২/৪৪৩

আরও দেখুন, ইমাম আবুল হাসান আশআরি রহ. (৩২৪ হি.) রচিত ‘মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন ওয়া ইখতিলাফুল মুসাল্লীন: ২/২৩৬

ঈসা আ. কর্তৃক দাজ্জালকে হত্যা করা পর্যন্ত জিহাদ চলমান থাকবে

পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র আকিদা হল, হযরত ঈসা আ. কর্তৃক দাজ্জালকে হত্যা করা পর্যন্ত অবিরত জিহাদ চলবে। হাদীসে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, জিহাদ শরীয়তের এমন একটি বিধান, যা কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। সহীহ বুখারীর বর্ণনায় এসেছে,

2695 – عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( الخيل معقود في نواصيها الخير إلى يوم القيامة ) – صحيح البخاري: 3/ 1047

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঘোড়ার কপালের কেশগুচ্ছে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ রয়েছে।” -সহীহ বুখারী: ৩/১০৪৭

সহীহ মুসলিমে এসেছে,

لا تزال طائفة من أمتى يقاتلون على الحق ظاهرين إلى يوم القيامة – قال – فينزل عيسى ابن مريم -صلى الله عليه وسلم- فيقول أميرهم تعال صل لنا، فيقول لا، إن بعضكم على بعض أمراء، تكرمة الله هذه الأمة.- صحيح مسلم للنيسابوري: 1/ 95

“কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের একদল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাকবে। অবশেষে ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন। তখন মুসলিমদের আমির বলবেন, আসুন। আমাদের ইমামত করুন। তিনি উত্তর দিবেন, না, আপনাদেরই একজন অন্যদের ইমাম হবেন। এ হল এ উম্মতের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ সম্মাননা।” -সহীহ মুসলিম: ১/৯৫

অন্য এক হাদিসে এসেছে,

-2534  حدثنا سعيد بن منصور حدثنا أبو معاوية حدثنا جعفر بن برقان عن يزيد بن أبى نشبة عن أنس بن مالك قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- : ثلاثة من أصل الإيمان : الكف عمن قال لا إله إلا الله ولا تكفره بذنب ولا تخرجه من الإسلام بعمل والجهاد ماض منذ بعثنى الله إلى أن يقاتل آخر أمتى الدجال لا يبطله جور جائر ولا عدل عادل والإيمان بالأقدار.- سنن أبي داود للسجستاني: 2/ 324

“আনাস ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈমানের মূল হল তিনটি বিষয়, (এক) যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ কালেমা পাঠ করে মুসলিম হয়েছে, তাকে হত্যা ও কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকা; কোনো পাপের কারণে তাকে কাফের না বলা; (শিরক ও কুফরি ছাড়া) অন্য কোনো আমলের কারণে তাকে ইসলাম হতে বহিষ্কার না করা। (দুই) যখন থেকে আল্লাহ্ আমাকে নবী করেছেন, তখন থেকেই জিহাদ চালু রয়েছে এবং চলতে থাকবে এই পর্যন্ত যে, আমার উম্মতের শেষ দলটি দাজ্জালের সাথে কিতাল করবে। কোনো অত্যাচারীর জুলুম এবং কোনো ন্যায়পরায়নের ইনসাফের দ্বারা জিহাদ বন্ধ হবে না। (তিন) তাকদিরের প্রতি ঈমান তথা ভালোমন্দ সব কিছু আল্লাহর পক্ষ হতে হয় বলে বিশ্বাস করা।” -সুনানে আবু দাউদ: ২/৩২৪

ইমামে ‘জায়েরে’র সঙ্গেও জিহাদ করা আবশ্যক

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র আকিদা হল, ‘ইমামে আদেল’ তথা ন্যায়পরায়ণ ইমামের সঙ্গে যেমন জিহাদ করতে হয়, তেমনি ‘ইমামে জায়ের’ তথা জালেম শাসকের সঙ্গেও জিহাদ করা আবশ্যক। জালেম ও অত্যাচারী শাসকের সঙ্গে জিহাদ করার বিষয়ে যেহেতু মানুষের মধ্যে দ্বিধা সংশয় থাকতে পারে এবং একারণে জিহাদ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এজন্য হাদীসে বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে,

– 2535 الجهاد واجب عليكم مع كل أمير برا كان أو فاجرا والصلاة واجبة عليكم خلف كل مسلم برا كان أو فاجرا وإن عمل الكبائر والصلاة واجبة على كل مسلم برا كان أو فاجرا وإن عمل الكبائر .- سنن أبي داود للسجستاني: 2/ 325

“শাসকের সাথে মিলে জিহাদ করা তোমাদের উপর ফরজ, চাই সে নেককার হোক বা ফাসেক। প্রত্যেক মুসলিমের পেছনে নামায পড়া তোমাদের উপর ফরজ, সে (ইমাম) নেককার হোক অথবা ফাসেক, যদিও সে করীরা গুনাহ করে। প্রত্যেক মুসলিমের জানাযা পড়া ফরজ, সে নেককার হোক বা ফাসেক, যদিও সে কবীরা গুনাহ করে।” -সুনানে আবু দাউদ: ২/৩২৫

এই মর্মে আরও অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন কিতাবে। উল্লেখিত হাদীসটির বচনশৈলী থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার, তা হচ্ছে, কেউ যেন ইমাম ফাসেক হওয়ার অজুহাতে জিহাদ বর্জন না করে, ইমাম ফাসেক হওয়ার অজুহাতে সালাতের জামাত বর্জন না করে এবং মাইয়েতকে ফাসেক হওয়ার অজুহাতে জানাযাহীন না রাখে, এবিষয়ে সতর্ক করার জন্যই মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসটি বলেছেন। কারণ জিহাদ, জামাত এবং জানাযা এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা এমন অজুহাতে ছাড়ার সুযোগ নেই। সুতরাং ভাল ও যোগ্য ইমাম থাকলে যেমন এগুলো আদায় করতে হবে, তেমনি ভাল ইমাম না থাকলে মন্দ ইমামের সঙ্গে হলেও আদায় করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই এগুলো ছাড়া যাবে না।

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হাদীসটি বললেন, জিহাদ চালু রাখার জন্য; যে হাদীস বলে সতর্ক করলেন, জিহাদ যেন কোনো অবস্থায়ই বন্ধ করা না হয়, সেই হাদীসটি দেখিয়েই আজকাল এক শ্রেণির জ্ঞানপাপীরা বলছে, এখন জিহাদ করা যাবে না। তারা হাদীসটির অপব্যাখ্যা করে বলছে, হাদীসে যেহেতু ইমামের সঙ্গে জিহাদ করতে বলা হয়েছে; চাই ইমাম আদেল হোক আর জায়ের হোক, সুতরাং ইমাম ছাড়া জিহাদ করা যাবে না। লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম!

ইমাম না থাকলেও জিহাদ বিলম্বিত করা যাবে না

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র আকিদা হল, ইমামুল মুসলিমিন না থাকলেও জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। ইমাম না থাকার ওজরে জিহাদ মওকুফ বা বিলম্বিত করা যাবে না।

ইবনে কুদামা মাকদিসি রহ. (৬২০ হি.) বলেন,

فان عدم الإمام لم يؤخر الجهاد لأن مصلحته تفوت بتأخيره، وإن حصلت غنيمة قسموها على موجب الشرع، قال القاضي وتؤخر قسمة الأماء حتى يقوم إمام احتياطا للفروج.اهـ -المغني: 10/374

“যদি ইমাম না থাকে তাহলে এ কারণে জিহাদ পিছিয়ে দেয়া যাবে না। কেননা, পিছিয়ে দেয়ার দ্বারা জিহাদে নিহিত মাসলাহাত ও কল্যাণসমূহ হাতছাড়া হয়ে যাবে। গনীমত লাভ হলে হকদারদের মাঝে শরীয়তে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী বণ্টন করে নেবে। তবে কাজী রহ. বলেন, ইমাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত লজ্জাস্থান হালাল হওয়ার মতো গুরুতর বিষয়ে সতর্কতাবশত দাসীদের বণ্টন স্থগিত রাখবে।” -আলমুগনী ১০/৩৭৪

ক্ষেত্র বিশেষে ইমাম নিষেধ করলেও জিহাদ করা জরুরি

ফকীহগণ লিখেছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে ইমামের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জিহাদে বের হওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। তাদের এ কথা থেকেও প্রমাণিত হয়, জিহাদের মুখাতাব শুধুমাত্র ইমাম বা শাসকশ্রেণি নয়। একইভাবে জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত নয়।

ইমাম সারাখসী রহ. (৪৮৩ হি.) বলেন,

وإن نهى الإمام الناس عن الغزو والخروج للقتال فليس ينبغي لهم أن يعصوه إلا أن يكون النفير عاما، لأن طاعة الأمير فيما ليس فيه ارتكاب المعصية واجب، كطاعة السيد على عبده فكما أن هناك بعد نهي المولى لا يخرج إلا إذا كان النفير عاما فكذلك ها هنا. -شرح السير الكبير، ص: 1457

“ইমাম যদি লোকজনকে যুদ্ধ করতে এবং কিতালে বের হতে নিষেধ করেন, তাহলে তাদের জন্য তার আদেশ অমান্য করা জায়েয নয়। তবে যদি নাফিরে আম হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা। কেননা যেখানে আমিরের আনুগত্য করতে গেলে নাফরমানীতে লিপ্ত হতে হয় না, সেখানে আমিরের আনুগত্য ফরজ। যেমন গোলামের জন্য মনিবের আনুগত্য ফরজ। সেখানে যেমন মনিব নিষেধ করলে গোলাম জিহাদে যাবে না, তবে নাফিরে আম হলে (নিষেধ করলেও) যাবে, এখানে (ইমামের ক্ষেত্রে)ও বিষয়টি তেমনই।” -শরহুস সিয়ারিল কাবির: ১৪৫৭

ইবনে হাযম রহ. (মৃত ৪৫৬ হি.) বলেন,

وَقَدْ قَالَ تَعَالَى: {قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً} [التوبة: 123] فَلَمْ يَخُصَّ بِأَمْرِ الْإِمَامِ وَلَا بِغَيْرِ أَمْرِهِ وَلَوْ أَنَّ إمَامًا نَهَى عَنْ قِتَالِ أَهْلِ الْحَرْبِ لَوَجَبَتْ مَعْصِيَتُهُ فِي ذَلِكَ، لِأَنَّهُ أَمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ لَهُ.

وَقَالَ تَعَالَى: {فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلا نَفْسَكَ} [النساء: 84] وَهَذَا خِطَابٌ مُتَوَجِّهٌ إلَى كُلِّ مُسْلِمٍ، فَكُلُّ أَحَدٍ مَأْمُورٌ بِالْجِهَادِ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ مَعَهُ أَحَدٌ، وَقَالَ تَعَالَى: {انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالا} [التوبة: 41] ، وَقَالَ تَعَالَى: {فَانْفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انْفِرُوا جَمِيعًا} [النساء: 71] . -المحلى بالآثار: 5\421، دار الفكر، بيروت

“আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী, তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়।’ আয়াতে জিহাদকে ইমামের আদেশ বা অন্য কারও আদেশের সাথে খাস করা হয়নি। বরং কোনো ইমাম যদি হারবীদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে নিষেধ করেন, তাহলে তার এ নির্দেশ অমান্য করা আবশ্যক। কারণ, তিনি অন্যায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই তার এ কথা শোনা ও মানা যাবে না।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘সুতরাং তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর। তোমার উপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার নেই।’ আল্লাহ তাআলার এ খেতাব-সম্বোধন প্রতিটি মুমিনকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছে। কাজেই প্রত্যেকেই জিহাদের আদেশে আদিষ্ট, যদিও তার সাথে কেউ না থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা (জিহাদের জন্য) বের হয়ে পড় হালকা অবস্থায় থাক বা ভারী অবস্থায় থাক’। তিনি আরো বলেন, ‘অতঃপর পৃথক পৃথক বাহিনীরূপে (জিহাদের জন্য) বের হও কিংবা সকলে একই সঙ্গে বের হও’।” –আলমুহাল্লা: ৫/৪২১

ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনি রহ. (৪৭৮ হি.) বলেন,

فإذا شغر الزمان عن كاف مستقل بقوة ومنة، فكيف تجري قضايا الولايات، وقد بلغ تعذرها منتهى الغايات. فنقول:

أما ما يسوغ استقلال الناس [فيه] بأنفسهم ولكن الأدب يقتضي فيه مطالعة (مطاوعة) ذوي الأمر، ومراجعة مرموق العصر، كعقد الجمع، وجر العساكر إلى الجهاد، واستيفاء القصاص في النفس والطرف، فيتولاه الناس عند خلو الدهر.

ولو سعى عند شغور الزمان طوائف من ذوي النجدة والبأس في نفض الطرق عن السعاة في الأرض بالفساد، [فهو] من أهم أبواب الأمر بالمعروف، والنهي عن المنكر.

وإنما ينهى آحاد الناس عن شهر الأسلحة استبدادا إذا كان في الزمان [وزر] قوام على أهل الإسلام، فإذا خلا الزمان عن السلطان، وجب البدار على حسب الإمكان إلى درء البوائق عن أهل الإيمان.

ونهينا الرعايا عن الاستقلال بالأنفس من قبيل [الاستحثاث] على ما هو الأقرب إلى الصلاح، والأدنى إلى النجاح، فإن ما يتولاه السلطان من أمور السياسة أوقع وأنجع، وأدفع للتنافس، وأجمع لشتات الرأي. (و) في تمليك الرعايا أمور الدماء، وشهر الأسلحة، وجوه من الخبل لا [ينكرها] ذوو العقل.

وإذا لم يصادف الناس قواما بأمورهم يلوذون به فيستحيل أن يؤمروا بالقعود عما يقتدرون عليه من دفع الفساد، فإنهم لو تقاعدوا عن الممكن، عم الفساد البلاد والعباد. –غياث الإمم في التياث الظلم: 1\386-387

“যদি এমন যামানা আসে, যখন শক্তি ও সক্ষমতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগ্য কোন ইমাম নেই, তাহলে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব কিভাবে পরিচালিত হবে; অথচ তা অক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে? (এর সমাধানে) বলবো,

যেসব বিষয় জনগণ নিজেরাই আদায় করে নেয়ার বৈধতা আছে, তবে আদব হল দায়িত্বশীল ও বিশিষ্টজনদের অবগতি ও নির্দেশনা সাপেক্ষে করা; যেমন জুমআ কায়েম, জিহাদের জন্য বাহিনী প্রেরণ, হত্যা বা যখমের কেসাস নেয়া; ইমাম না থাকাকালে জনগণ নিজেরাই সেগুলো আঞ্জামের ব্যবস্থা নেবে।

ইমাম না থাকার সময় যদি শক্তিধর কিছু দল যমিনে সন্ত্রাস ও ফাসাদ বিস্তারকারীদের থেকে জনচলাচলের পথঘাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে তা (শুধু বৈধই নয়, বরং) অতি গুরুত্বপূর্ণ আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের কাজ হবে।

(ইমামের অনুমতি ব্যতীত) জনগণ নিজেরাই (এসব বিষয়ে) পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা নিষেধ করেছিলাম অধিকতর শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও কামিয়াবি অর্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য। কেননা, সুলতান নিজে যে বিষয়ের পদক্ষেপ নেন ও পরিচালনা করেন, সেটি তুলনামূলক অধিক কার্যকর ও সফল হয়। বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা কম হয়। জনগণকে বিচার আচার ও অস্ত্র প্রয়োগের স্বাধীনতা দিয়ে দিলে অনেক রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যা কোন বিবেকবান ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু জনগণের সার্বিক দেখাশোনার মতো যোগ্য ইমাম যদি না থাকে, যার কাছে তারা আশ্রয় নেবে, তাহলে যতটুকু ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করার সামর্থ্য তাদের আছে, ততটুকুও আঞ্জাম না দিয়ে বসে থাকতে আদেশ দেয়া একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, যতটুকু সামর্থ্যে আছে, ততটুকু যদি আঞ্জাম না দেয়, তাহলে দেশ-জনগণ সবকিছুই ফাসাদে ভরে যাবে।” -গিয়াসুল উমাম ১/৩৮৬-৩৮৭

শায়খ ইবনে উলাইশ মালেকি রহ. (১২৯৯ হি.) বলেন,

وَعَنْ ابْنِ الْقَاسِمِ إنْ طَمِعَ قَوْمٌ فِي فُرْصَةٍ فِي عَدُوٍّ قُرْبَهُمْ وَخَشُوا إنْ أَعْلَمُوا الْإِمَامَ يَمْنَعُهُمْ فَوَاسِعٌ خُرُوجُهُمْ وَأَحَبُّ إلَىَّ أَنْ يَسْتَأْذِنُوهُ قَالَ ابْنُ حَبِيبٍ سَمِعْت أَهْلَ الْعِلْمِ يَقُولُونَ إنْ نَهَى الْإِمَامُ عَنْ الْقِتَالِ لِمَصْلَحَةٍ حُرِّمَتْ مُخَالَفَتُهُ إلَّا أَنْ يَزْحَمَهُمْ الْعَدُوُّ وَقَالَ ابْنُ رُشْدٍ طَاعَةُ الْإِمَامِ لَازِمَةٌ، وَإِنْ كَانَ غَيْرَ عَدْلٍ مَا لَمْ يَأْمُرْ بِمَعْصِيَةٍ وَمِنْ الْمَعْصِيَةِ النَّهْيُ عَنْ الْجِهَادِ الْمُتَعَيِّنِ. -فتح العلي المالك في الفتوى على مذهب الإمام مالك: 1/ 392

“ইবনুল কাসিম রহ. থেকে বর্ণিত, কিছু লোক তাদের নিকটস্থ কোনো শত্রুকে বাগে পেল। তাদের আশঙ্কা হল, ইমামুল মুসলিমিনকে জানালে তিনি বারণ করবেন। তাহলে এমতাবস্থায় (অনুমতি ছাড়াই) জিহাদে বের হওয়া বৈধ হবে। তবে আমার কাছে অধিক ভাল মনে হয় অনুমতি নিয়ে নেয়া।

ইবনে হাবীব রহ. বলেন, আমি আহলে ইলমদের বলতে শুনেছি, ইমাম কোনো মাসলাহাতের প্রতি লক্ষ্য করে কিতাল করতে নিষেধ করলে, তার বিরুদ্ধাচরণ করা হারাম। তবে যদি শত্রু আক্রমণ করে বসে তাহলে ভিন্ন কথা। ইবনে রুশদ রহ. বলেন, ইমাম ন্যায়পরায়ণ না হলেও তার আনুগত্য আবশ্যক, যতক্ষণ না কোন গুনাহের আদেশ দেন। আর ফরজে আইন জিহাদে বাধা দেয়া গুনাহের কাজ।” -ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক: ১/৩৯২

ইবনে আসাকির রহ. (৫৭১ হি.) আহমাদ ইবনে সা’লাবা আলআমিলি রহ. থেকে বর্ণনা করেন,

سئل وكيع بن الجراح عن قتال العدو مع الإمام الجائر قال: إن كان جائرا وهو يعمل في الغزو بما يحق عليه فقاتل معه، وإن كان يرتشي منهم ويهادنهم فقاتل على حيالك. اهـ -تاريخ دمشق: 71/47

“জালেম ইমামের সাথে মিলে শত্রুর (তথা কাফেরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে ওয়াকি’ ইবনুল জাররাহ রহ. (১৯৭ হি.) এর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি উত্তর দেন, জালেম হলেও যদি যথাযথভাবে জিহাদ করে, তাহলে তার সাথে মিলেই যুদ্ধ কর। পক্ষান্তরে সে যদি শত্রুদের থেকে ঘুষ নিয়ে সন্ধি করে, তাহলে তুমি তোমার নিজের মতো করে জিহাদ কর।” -তারিখে দিমাশক ৭১/৪৭

খতীব শারবিনী শাফিয়ি রহ. (৯৭৭ হি.) বলেন,

[ فصل ] فيما يكره من الغزو ، ومن يحرم أو يكره قتله من الكفار ، وما يجوز قتالهم به ( يكره غزو بغير إذن الإمام أو نائبه ) تأدبا معه ، ولأنه أعرف من غيره بمصالح الجهاد ، وإنما لم يحرم ؛ لأنه ليس فيه أكثر من التغرير بالنفوس وهو جائز في الجهاد  …

تنبيه : استثنى البلقيني من الكراهة صورا .

إحداها : أن يفوته المقصود بذهابه للاستئذان .

ثانيها : إذا عطل الإمام الغزو وأقبل هو وجنوده على أمور الدنيا كما يشاهد .

ثالثها : إذا غلب على ظنه أنه لو استأذنه لم يأذن له . اهـ -مغنى المحتاج: 17/287

“ইমাম বা তার নায়েবের অনুমতি ছাড়া জিহাদ মাকরুহ। … তবে বুলকিনি রহ. কয়েক সূরতকে এর ব্যতিক্রম বলেছেন।

১. অনুমতি নিতে গেলে যদি জিহাদের মূল উদ্দেশ্য হাতছাড়া হয়ে যায়।

২. যদি ইমাম ও তার সৈন্য-সামন্ত জিহাদ ছেড়ে দুনিয়ার ভোগ বিলাসে লিপ্ত হয়ে যায়।

৩. যদি প্রবল ধারণা হয় যে, অনুমতি চাইলে অনুমতি দেবে না।” –মুগনিল মুহতাজ: ১৭/২৮৭

জিহাদের জন্য ইমাম বিষয়ক উপরোক্ত আলোচনায় আমরা সুস্পষ্ট দেখলাম, ইমাম ব্যতীত জিহাদ নেই বা জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত, এটি রাফেজি শিয়াদের আকিদা। পক্ষান্তরে মুসলিমদের আকিদা হচ্ছে, ইমাম থাকলে এবং শরীয়াহ মোতাবেক জিহাদের দায়িত্ব আঞ্জাম দিলে, তার আনুগত্য করে সাধারণ মানুষকেও জিহাদ করতে হবে। এমনকি ইমাম যদি জালেম হয় তুবও। আর যদি ইমাম না থাকেন বা থেকেও জিহাদের দায়িত্ব আঞ্জাম না দেয় কিংবা ফরজ জিহাদ করতে নিষেধ করে, তাহলে তার এই নিষেধাজ্ঞা মানা জায়েয নয়; বরং তার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জিহাদ করা মুসলিমদের উপর ফরজ।

শরীয়তের অনেক ইজতেমায়ী ফরিযাই এরকম

এটি শুধু জিহাদের বিধানই নয়; মুসলিমদের আরো অনেক ইজতেমায়ী আমল ও ফরজে কেফায়ার বিধানই এরকম। কাজগুলো আঞ্জাম দেয়ার ও ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্ব শাসক ও উলুল আমরের এবং তারাই আওয়ালীনে মুখাতাব। উলুল আমর ও ইমামুল মুসলিমিন যখন মুসলিমদের এই ইজতেমায়ী কাজগুলো আঞ্জাম দেন, তখন অন্যদের দায়িত্ব তাদের আনুগত্য করা। পক্ষান্তরে যখন উলুল আমর ও শাসকগণ কাজটি আঞ্জাম দিবেন না, তখন সাধারণ থেকে সাধারণ প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব কাজটি আঞ্জাম দেয়ার জন্য সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিছুতেই শরীয়তের বিধানটিকে অকার্যকর ছেড়ে রাখার সুযোগ নেই। তাতে সকল মুসলিমই গোনাহগার হবে।

ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনি রহ. (৪৭৮ হি.) বলেন,

للناس حالتان: إحداهما – أن يعدموا قدوة وأسوة وإماما يجمع شتات الرأي، ويردوا إلى الشرع المجرد من غير داعٍ وحادٍ، فإن كانوا كذلك، فموجب الشرع -والحالة هذه- في فروض الكفايات أن يحرج المكلفون القادرون لو عطلوا فرضا واحدا. ولو أقامه من فيه الكفاية سقط الفرض عن الباقين.فلا يثبت لبعض المكلفين توجيه الطلب على آخرين فإنهم ليسوا منقسمين إلى داع ومدعو، وحاد ومحدو، وليس [الفرض] متعينا على كل مكلف، فلا يعقل تثبيت التكليف في فروض الكفايات مع عدم الوالي إلا كذلك.

فليضرب في ذلك الجهاد مثلا، فنقول: لو شغر الزمان عن وال، تعين على المسلمين القيام بمجاهدة الجاحدين، وإذا قام به عصب فيهم كفاية سقط الفرض عن سائر المكلفين. -غياث الأمم في التياث الظلم (ص: 267)

“মুসলিমরা দু’টি অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে:

এক. এমন একজন ইমাম তাদের নেই, যিনি তাদের নেতৃত্ব দেবেন, তাকে অনুসরণ করে চলা যাবে এবং যিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেন। বরং তারা কোনোরকম আহ্বানকারী এবং পরিচালক ছাড়াই (নিজেদের মতো করে) শরীয়াহ পালন করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ফরজে কেফায়া যত বিধান আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে শরীয়াহ’র হুকুম হল, সে সব ফরজ আঞ্জাম দেয়ার সামর্থ্য যাদের আছে, তারা যদি কোনো একটি ফরজ আঞ্জাম দেয়া থেকেও বিরত থাকে, তাহলেও গুনাহগার হবে। হ্যাঁ, প্রয়োজন পরিমাণ লোক যদি কাজটি আঞ্জাম দিয়ে দেয়, তাহলে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। এখানে এমন ভাবার সুযোগ নেই যে, এই খেতাব ও সম্বোধন অন্যদের জন্য; আমার জন্য নয়। কারণ, এ অবস্থায় এমন কোনো বিভক্তি নেই যে, কিছু লোক পরিচালকের আসনে আছে আর বাকিরা পরিচালিতের সারিতে (বরং সকলেই দায়িত্বশীল)। তাছাড়া বিধানটি (নামায রোযার মতো) সকলের উপর ফরজে আইনও নয়। কাজেই ইমাম না থাকা অবস্থায় ফরজে কেফায়াগুলোর দায়িত্বভার এভাবে বর্তানোই যুক্তিযুক্ত।

এখানে আমরা উদাহরণস্বরূপ জিহাদের কথা বলতে পারি। ইমাম না থাকলে জিহাদ করার দায়িত্বভার মুসলিম জনসাধারণের উপরই বর্তায়। হ্যাঁ, যথেষ্ট পরিমাণ মুসলিম যদি তা আদায় করে ফেলে, বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়।

এ হলো ইমাম না থাকার সময়ের বিধান। পক্ষান্তরে যদি ইমাম থাকেন (প্রভাব প্রতিপত্তি ও শক্তিমত্তার কারণে) যাকে লোকজন মেনে চলে, তাহলে বাহিনী প্রেরণ, জিহাদের ব্যবস্থাপনা এবং চুক্তি সম্পাদনার দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই আঞ্জাম দিবেন” -গিয়াসুল উমাম ২৬৭-২৬৮

হুদূদ কায়েমের আলোচনায় ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,

لو فرض عجز بعض الأمراء عن إقامة الحدود والحقوق أو إضاعته لذلك لكان ذلك الفرض على القادر عليه.  وقول من قال لا يقيم الحدود الا السلطان ونوابه إذا كانوا قادرين فاعلين بالعدل كما يقول الفقهاء الأمر الى الحاكم إنما هو العادل القادر فاذا كان مضيعا لأموال اليتامى أو عاجزا عنها لم يجب تسليمها اليه مع امكان حفظها بدونه وكذلك الأمير إذا كان مضيعا للحدود أو عاجزا عنها لم يجب تفويضها اليه مع إمكان إقامتها بدونه. -مجموع الفتاوى لابن تيمية (34/ 176)

“যদি এমন হয় যে, কোনো একজন আমির হুদূদ কায়েম করতে এবং মানুষের হক বুঝিয়ে দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন কিংবা (সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও) করছেন না, তাহলে (জনসাধারণের মধ্যে) যাদের সক্ষমতা আছে, এসবের দায়-দায়িত্ব তাদের উপর বর্তাবে। আর (আইম্মায়ে কেরাম) যারা বলেছেন, সুলতান ও তার নায়েবগণ ছাড়া অন্য কেউ হুদূদ কায়েম করতে পারবে না, তাদের এ কথা সে সময় প্রযোজ্য, যখন সুলতান ও তার নায়েবগণ সেগুলো কায়েম করতে সক্ষম এবং ইনসাফের সাথে কায়েমও করছেন। যেমন ফুকাহায়ে কেরাম (অনেক ক্ষেত্রে) বলেছেন, ‘এ বিষয়টির দায়িত্ব শাসকের’ এর দ্বারা ঐ শাসক উদ্দেশ্য, যিনি ন্যায়পরায়ণ এবং সক্ষম। পক্ষান্তরে যখন (তার ব্যাপারে জানা আছে যে,) তিনি ইয়াতিমদের মালের যথাযথ হেফাজত করবেন না বা করতে অক্ষম, তখন অন্য পন্থায় হেফাজত করা সম্ভব হলে, তার হাতে সোপর্দ করার আবশ্যকীয়তা থাকবে না। এমনিভাবে আমির যদি এমন হন যে, তিনি হদসমূহ যথাযথ কায়েম করেন না কিংবা কায়েম করতে অক্ষম, তাহলে অন্যভাবে কায়েম করা সম্ভব হলে, তার হাতে সোপর্দ করার আবশ্যকীয়তা থাকবে না।” -মাজমুউল ফাতাওয়া ৩৪/১৭৬

অবশ্য হদূদ কিসাস আদৌ ইমাম ও তাঁর প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কেউ প্রয়োগ করতে পারবে কি না, কোন ক্ষেত্রে পারবে কোন ক্ষেত্রে পারবে না, বিষয়টি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ এবং এতে ফুকাহায়ে কেরামের মতভেদ রয়েছে। আমরা এখানে সে বিশ্লেষণে যাচ্ছি না।

ইবনে তাইমিয়া রহ. আরো বলেন,

وإذا كان جماع الدين وجميع الولايات هو أمر ونهي؛ فالأمر الذي بعث الله به رسوله هو الأمر بالمعروف والنهي الذي بعثه به هو النهي عن المنكر وهذا نعت النبي والمؤمنين؛ كما قال تعالى: {والمؤمنون والمؤمنات بعضهم أولياء بعض يأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر} . وهذا واجب على كل مسلم قادر وهو فرض على الكفاية ويصير فرض عين على القادر الذي لم يقم به غيره والقدرة هو السلطان والولاية فذوو السلطان أقدر من غيرهم؛ وعليهم من الوجوب ما ليس على غيرهم. فإن مناط الوجوب هو القدرة؛ فيجب على كل إنسان بحسب قدرته قال تعالى: {فاتقوا الله ما استطعتم}. -مجموع الفتاوى: 28/ 65

“যেহেতু সমগ্র দ্বীন ও সকল কর্তৃত্বের মূল হলো আমর ও নাহী, তো যেই আমর ও নাহী দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন তা হলো, আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার। এটা নবী ও মুমিনদের গুণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিন নর ও নারী পরস্পরে একে অন্যের সহযোগী। তারা সৎ কাজের আদেশ করে অসৎ কাজে বাধা দেয়’ [সুরা তাওবা: ৭১]। এটা প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের উপর ফরজ। তা ফরজে কেফায়া, কিন্তু যখন অন্য কেউ তা না করে তখন সক্ষম ব্যক্তির উপর তা ফরজে আইন হয়ে যায়। সামর্থ্য হলো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ অন্যদের তুলনায় অধিক সক্ষম। এজন্য তাদের উপর এ দায়িত্ব অন্যদের তুলনায় বেশি। কারণ দায়িত্বের ভিত্তি হলো সামর্থ্য। তাই সামর্থ্য অনুপাতেই প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তা ওয়াজিব হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর’। [সুরা তাগাবুন: ১৬]” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৬৫

তিনি আরো বলেন,

وقد تبين بهذا أن الدعوة إلى الله تجب على كل مسلم؛ لكنها فرض على الكفاية وإنما يجب على الرجل المعين من ذلك ما يقدر عليه إذا لم يقم به غيره وهذا شأن الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر وتبليغ ما جاء به الرسول والجهاد في سبيل الله وتعليم الإيمان والقرآن. -مجموع الفتاوى: 15/ 166

“পূর্বোক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট হল, আল্লাহর দিকে আহ্বান করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। তবে তা ফরজে কেফায়া। নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী তা ফরজে আইন হয়, যখন অন্য কেউ তা না করে। আমর বিল মারূফ, নাহী আনিল মুনকার, রাসূলের আনীত দ্বীনের তাবলীগ, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ এবং ঈমান ও কুরআন শিক্ষা দেয়ার বিধানও এটাই।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ১৫/১৬৬

এ জাতীয় ফরজ বিধানের কিছু দৃষ্টান্ত

দৃষ্টান্ত-১: জুমআহ

হানাফি ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, জুমআর নামায সহীহ হওয়ার জন্য ইমামের অনুমতি শর্ত। কারণ এটি মুসলিমদের একটি ইজতেমায়ী আমল। সুতরাং ইমামের অনুমতি ছাড়া কেউ জুমআ পড়ালে হবে না। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা এও বলেছেন যে, যদি ইমাম না থাকে, বা তার অনুমতি নেয়ার ব্যবস্থা না থাকে কিংবা বিনা কারণে ইমাম জুমআ পড়তে বাধা দেন, তাহলে জনগণ একজনকে ইমাম বানিয়ে জুমআ আদায় করে নেবে। এ কারণে দারুল হারবেও জুমআ পড়তে হয়, অথচ সেখানে তো ইমামই নেই।

‘আলমাওসূআ’তুল ফিকহিয়্যাহ আলকুয়েতিয়্যাহ’য় সুলতানের শর্ত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,

الشرط الثاني: واشترطه الحنفية، إذن السلطان بذلك، أو حضوره، أو حضور نائب رسمي عنه، إذ هكذا كان شأنها على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم وفي عهود الخلفاء الراشدين.

هذا إذا كان ثمة إمام أو نائب عنه في البلدة التي تقام فيها الجمعة، فإذا لم يوجد أحدهما، لموت أو فتنة أو ما شابه ذلك، وحضر وقت الجمعة كان للناس حينئذ أن يجتمعوا على رجل منهم ليتقدمهم فيصلي بهم الجمعة.

أما أصحاب المذاهب الأخرى فلم يشترطوا لصحة الجمعة أو وجوبها شيئا مما يتعلق بالسلطان، إذنا أو حضورا أو إنابة.-الموسوعة الفقهية الكويتية، 27/197، وزارة الأوقاف

“জুমআর জন্য দ্বিতীয় শর্ত –এই শর্তটি হানাফী মাযহাব মতে প্রযোজ্য– সুলতানের অনুমতি বা উপস্থিতি কিংবা তাঁর রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির উপস্থিতি। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের যামানায় এভাবেই জুমআর নামায আদায় করা হত।

অবশ্য এই শর্তটি তখনই প্রযোজ্য, যখন জুমআ আদায়ের শহরে ইমাম বা তার পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি উপস্থিত থাকেন। পক্ষান্তরে মৃত্যু, ফিতনা কিংবা এজাতীয় কোনো কারণে যদি তাদের কেউ না থাকেন এবং জুমআর সময় উপস্থিত হয়ে যায়, তখন মুসলমানদের দায়িত্ব হল, একমত হয়ে কোনো একজনকে ইমাম বানানো, যাতে তিনি সকলকে নিয়ে জুমআ আদায় করতে পারেন।

কিন্তু অন্যান্য মাযহাবের ওলামায়ে কেরাম জুমআ সহীহ বা ওয়াজিব হওয়ার জন্য সুলতানের সাথে সম্পৃক্ত; যেমন সুলতানের অনুমতি প্রদান, তাঁর উপস্থিতি বা তাঁর নায়েবের উপস্থিতি- এ জাতীয় কোনো শর্তই আরোপ করেননি।” -আলমাউসূয়াতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুয়েতিয়্যাহ: ২৭/১৯৭, ওযারাতুল আওকাফ

ইমাম ত্বহাবী রহ. (৩২১ হি.) বলেন,

وذكر عن محمد أن أهل مصر لو مات واليهم جاز أن يقدموا رجلا يصلي بهم الجمعة حتى يقدم عليهم وال. قال أبو جعفر روى مالك عن الزهري قال شهدت العيد مع علي رضي الله عنه وعثمان محصور فجاء فصلى ثم انصرف فخطب وهذا أصل من أن كل سبب يخلف الإمام عن الحضور إذ على المسلمين إقامة رجل يقوم به وهذا كما فعل المسلمون يوم مؤتة لما قتل الأمراء اجتمعوا على خالد بن الوليد. -مختصر اختلاف العلماء: 1/345، دار البشائر الإسلامية.

“ইমাম মুহাম্মাদ রহ. থেকে বর্ণিত, কোনো শহরবাসীর শাসনকর্তা যদি মৃত্যু বরণ করেন তাহলে তাদের জন্য জায়েয, একজন ব্যক্তিকে সামনে বাড়িয়ে দেয়া, যিনি নতুন শাসনকর্তা আসার পূর্ব পর্যন্ত তাদের নিয়ে জুমআ আদায় করবেন। আবু জাফর (ত্বাহাবি রহ.) বলেন, মালেক রহ. যুহরি রহ. থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমি আলী রা.র সঙ্গে ঈদের সালাতে উপস্থিত হয়েছি; (খলিফাতুল মুসলিমিন) উসমান রা. তখন অবরুদ্ধ। আলী রা. এসে সালাত আদায় করলেন, সালাত শেষ করে খুতবা প্রদান করলেন।’

যেসব কাজে ইমামুল মুসলিমিন উপস্থিত হতে পারেন না, সেসব কাজের এটি একটি মূলনীতি। মুসলিমদের দায়িত্ব তখন এমন একজন ব্যক্তি ঠিক করা, যিনি সেই কাজটি আঞ্জাম দিবেন। যেমন মুতার যুদ্ধে যখন একে একে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিযুক্ত) সকল আমির শহীদ হয়ে গেলেন, তখন সবাই মিলে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.কে আমির নিযুক্ত করলেন।” -মুখতাসারু ইখতিলাফিল উলামা ১/৩৪৫, দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়্যাহ

তাহের বিন আহমাদ আল-বুখারী রহ. (৫৪২ হি.) বলেন,

وإن لم يكن ثمة قاض ولا خليفة الميت فاجتمعت العامة على تقديم رجل جاز لمكان الضرورة.-خلاصة الفتاوى:  1/208

“কিন্তু যদি সেখানে কোনো কাজী (বিচারক) বা মৃত শাসকের প্রতিনিধি না থাকেন, আর জনসাধারণ নিজেদের কাউকে অগ্রসর করার ব্যাপারে একমত হয়, তবে জরুরতের কারণে তা সহীহ হবে।” -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২০৮

সিরাজুদ্দিন আলী বিন উসমান আল-হানাফী রহ. (৫৬৯ হি.) বলেন,

وَالِي مِصْرٍ مَاتَ فَصَلَّى بِهِمْ خَلِيفَةُ الْمَيِّتِ أَوْ صَاحِبُ الشُّرَطِ أَوْ الْقَاضِي جَازَ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ ثَمَّةَ وَاحِدٌ مِنْهُمْ وَاجْتَمَعَ النَّاسُ عَلَى رَجُلٍ فَصَلَّى بِهِمْ جَازَ، -السِّرَاجِيَّةِ، ص: 105

“যদি কোনো শহরের শাসনকর্তা মারা যান, ফলে মৃত শাসকের প্রতিনিধি, পুলিশপ্রধান বা কাজী তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করেন, তাহলে তা জায়েয হবে। একইভাবে সেখানে যদি উপরোক্ত কেউ না থাকেন আর জনসাধারণ কারো ব্যাপারে একমত হয় এবং তিনি তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করেন তবে তাও জায়েয।” -আলফাতাওয়াস সিরাজিয়্যাহ ১০৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ

মালিকুল উলামা কাসানী রহ. (৫৮৭ হি.) বলেন,

وأما السلطان فشرط أداء الجمعة عندنا حتى لا يجوز إقامتها بدون حضرته أو حضرة نائبه، وقال الشافعي السلطان ليس بشرط؛ …هذا إذا كان السلطان أونائبه حاضرا، فأما إذا لم يكن إماما (إمام) بسبب الفتنة أو بسبب الموت ولم يحضر وال آخر بعد حتى حضرت الجمعة ذكر الكرخي أنه لا بأس أن يجمع الناس على رجل حتى يصلي بهم الجمعة، وهكذا روي عن محمد ذكره في العيون؛ لما روي عن عثمان – رضي الله عنه – أنه لما حوصر قدم الناس عليا – رضي الله عنه – فصلى بهم الجمعة. -بدائع الصنائع: 1/588

“আমাদের নিকট জুমআ আদায়ের জন্য সুলতান শর্ত। সুলতান বা তার নায়েবের উপস্থিতি ছাড়া জুমআ কায়েম করা সহীহ নয়। ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, সুলতান শর্ত নয়। … এই বিধান হল, যখন সুলতান বা তার প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। পক্ষান্তরে ফেতনা কিংবা মৃত্যুর কারণে যদি সুলতান না থাকেন এবং আরেকজন নিয়োগের আগেই জুমআর সময় হয়ে যায়, ইমাম কারখি রহ. বলেছেন, এক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা নেই যে, জনসাধারণ কোনো একজন ব্যক্তির উপর একমত হবে, যাতে তিনি তাদেরকে নিয়ে জুমআ আদায় করতে পারেন। ‘আলউয়ূন’ কিতাবে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. থেকে এমনটিই বর্ণিত হয়েছে। কারণ উসমান রা.কে যখন অবরুদ্ধ করা হয়, মানুষ আলী রা.কে আগে বাড়িয়ে দেয়। তিনি তাদের নিয়ে জুমআ আদায় করেন।” -বাদায়েউস সানায়ে ১/৫৮৮; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ

কাজীখান রহ. (৫৯২ হি.) বলেন,

وإن لم يكن ثمة قاض ولا خليفة الميت فاجتمعت العامة على تقديم رجل جاز لمكان الضرورة، -قاضي خان: 1/109، دار الكتب العلمية.

“কিন্তু যদি সেখানে কোনো কাজী (বিচারক) বা মৃত শাসকের প্রতিনিধি না থাকেন, আর জনসাধারণ কাউকে অগ্রসর করার ব্যাপারে একমত হয়, তবে জরুরতের কারণে তা জায়েয হবে।” -ফাতাওয়া কাজীখান ১/১০৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ

‘হেদায়া’ গ্রন্থকার আল্লামা আলী আলমারগিনানী রহ. (৫৯৩ হি.) বলেন,

والي مصر مات، ولم يبلغ الخليفة موته حتى مضت بهم جمع، فإن صلى بهم خليفة الميت أو صاحب شرطة أو متولى القضاء جاز، لأنه فوض إليهم أمر العامة. ولو اجتمعت العامة على أن يقدموا رجلا، لم يأمره القاضي، ولا خليفة الميت لا يجوز، ولم يكن لهم جمعة، لأنهم لم يفوض إليهم أمورهم. إلا إذا كان لم يكن ثمة قاض ولا خليفة الميت، بأن كان الكل هو الميت، فحينئذ جاز للضرورة، ألا ترى أن عليا رضي الله عنه صلى بالناس. -التجنيس والمزيد للمرغيناني: 2/200، ادارة القرآن، كراتشي.

“কোনো শহরের শাসনকর্তা মৃত্যু বরণ করলেন। খলীফার কাছে তার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছল না। এমতাবস্থায় কয়েক জুমআ অতিক্রান্ত হয়ে গেল এবং মৃতের প্রতিনিধি, পুলিশপ্রধান বা কাজী (বিচারক) তাদেরকে নিয়ে নামায আদায় করলেন, তাহলে তাদের জুমআ সহীহ হবে। কারণ জনগণের বিষয় আশয় দেখভালের দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত। কিন্তু যদি জনসাধারণ কোনো ব্যক্তিকে অগ্রসর করার ব্যাপারে একমত হয়; যাকে কাজী বা মৃতের প্রতিনিধি আদেশ করেননি, তাহলে জায়েয হবে না এবং জুমআও সহীহ হবে না। কারণ জনগণের দেখভালের দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত নয়।

তবে হ্যাঁ, সেখানে যদি কাজী বা মৃত্যু বরণকারীর কোনো প্রতিনিধি না থাকে, যেমন মৃত ব্যক্তিই এই সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন, তাহলে এমতাবস্থায় জরুরতের কারণে তা জায়েয হবে। দেখেন না, আলী রা. লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করেছেন!” -আত তাজনীস ওয়াল মাযীদ: ২/২০০; ইদারাতুল কুরআন, করাচি

আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রহ. (১২৫২ হি.) বলেন,

ولذا لو مات الوالي أو لم يحضر لفتنة ولم يوجد أحد ممن له حق إقامة الجمعة نصب العامة لهم خطيبا للضرورةكما سيأتي مع أنه لا أمير ولا قاضي ثمة أصلا وبهذا ظهر جهل من يقول لا تصح الجمعة في أيام الفتنة مع أنها تصح في البلاد التي استولى عليها الكفار كما سنذكره فتأمل -رد المحتار 2/138، دار الفكر، بيروت

“যদি শাসনকর্তা মৃত্যুবরণ করেন অথবা ফিতনার কারণে উপস্থিত না হতে পারেন এবং এমন কাউকে না পাওয়া যায়, যার জুমআ কায়েমের অধিকার রয়েছে, তাহলে জরুরতের কারণে সাধারণ মানুষ নিজেদের জন্য একজন খতীব নির্ধারণ করে নেবে, যেমনটি সামনে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। অথচ এখানে আমীর কিংবা কাজী কেউ-ই নেই। আমাদের এ বক্তব্য থেকে ওই সব লোকের অজ্ঞতা স্পষ্ট হয়, যারা বলে, ফেতনার দিনগুলোতে জুমআ সহীহ হবে না। অথচ ওই সমস্ত শহরেও জুমআ সহীহ, যেগুলো কাফেররা দখল করে নিয়েছে, যেমনটি আমরা সামনে উল্লেখ করব।” -রদ্দুল মুহতার: ২/১৩৮, দারুল ফিকর, বৈরুত

সামনে গিয়ে বলেন,

لو منع السلطان أهل مصر أن يجمعوا إضرارا وتعنتا فلهم أن يجمعوا على رجل يصلي بهم الجمعة …..فلو الولاة كفارا يجوز للمسلمين إقامة الجمعة ويصير القاضي قاضيا بتراضي المسلمين ويجب عليهم أن يلتمسوا واليا مسلما. اهـ. -رد المحتار 2/143- 144

“সুলতান যদি একগুঁয়েমিবশত এবং ক্ষতি সাধনের জন্য কোনো এলাকার লোকজনকে জুমআ আদায়ে নিষেধ করেন, তাহলে তাদের দায়িত্ব, নিজেরা সম্মতিক্রমে একজনকে জুমআর জন্য নির্ধারণ করে নিবে, যিনি তাদের নিয়ে জুমআ আদায় করবেন। …. যদি শাসকরা কাফের হয়, তাহলেও মুসলমানদের জন্য জুমআ কায়েম করা সহীহ। এক্ষেত্রে মুসলমানদের সন্তুষ্টিক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত কাজী শরঈ কাজী হিসেবে পরিগণিত হবেন। আর মুসলমানদের ওপর ফরজ হবে, একজন মুসলমান প্রশাসক তালাশ করা।” -রদ্দুল মুহতার ২/১৪৪, দারুল ফিকর, বৈরুত

এবিষয়ে নিম্নোক্ত দুটি ফতোয়া দেখা যেতে পারে:

‘দারুল হারবে জুমআর নামাযের বিধান কি?’

https://fatwaa.org/2020/06/24/1166/

‘জুমুআর সালাত সহীহ হওয়ার শর্ত কি?’

https://fatwaa.org/2020/07/18/1413/

দৃষ্টান্ত- ২: ‘কাযা’ ও শরীয়াহ বিচার ব্যবস্থা

একইভাবে কুরআন সুন্নাহ মতে বিচার কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য কাজি (বিচারক) নিয়োগ দেয়া এবং শরীয়াহ বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা মুসলিমদের উপর ফরজ। প্রধানত এটি ইমামুল মুসলিমিনের দায়িত্ব। কিন্তু যখন ইমাম না থাকে, তখন মুসলমানদের দায়িত্ব নিজেদের একজনকে কাজি নিয়োগ করে নেয়া এবং বিচার আচারের ক্ষেত্রে শরীয়াহসম্মত ইনসাফের জন্য তার শরণাপন্ন হওয়া। তবুও শরীয়াহ বিচার ব্যবস্থাকে অকার্যকর রেখে মুসলিমদের জীবন যাপনের সুযোগ নেই। এতে সামর্থ্যবান সকলেই ফরজ ত্যাগের দায়ে গোনাহগার হবে।

ইবনুল হুমাম রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,

وإذا لم يكن سلطان ولا من يجوز التقلد منه كما هو في بعض بلاد المسلمين غلب عليهم الكفار كقرطبة في بلاد المغرب الآن وبلنسية وبلاد الحبشة وأقروا المسلمين عندهم على مال يؤخذ منهم يجب عليهم أن يتفقوا على واحد منهم يجعلونه واليا فيولى قاضيا أو يكون هو الذي يقضي بينهم وكذا ينصبوا لهم إماما يصلي بهم الجمعة. اهـ -فتح القدير: 7/264

“যদি সুলতানও না থাকে এবং এমন কেউও না থাকে, যার পক্ষ থেকে কাযি নিয়োগ বৈধ; যেমনটা বর্তমানে কিছু মুসলিম ভূমিতে বিরাজ করছে, যেগুলোতে কাফেররা দখলদারিত্ব বসিয়েছে এবং মালের বিনিময়ে মুসলিমদের বসবাসের সুযোগ দিচ্ছে; যেমন বর্তমান মাগরিবের করডোবা, ভ্যালেন্সিয়া এবং (আফ্রিকার) হাবশা ভূমি, তাহলে সেখানকার মুসলমানদের ফরজ দায়িত্ব হলো, সকলে মিলে একজনকে তাদের শাসক নিযুক্ত করা। এরপর তিনি একজনকে কাজি নিয়োগ দেবেন, কিংবা তিনি নিজেই কাজি হিসেবে তাদের বিচারাচার মীমাংসা করবেন। তদ্রূপ এঅবস্থায় তাদের আরেকটা ফরজ দায়িত্ব হলো, জুমআর জন্য একজন ইমাম নিয়োগ দেয়া, যিনি তাদের নিয়ে জুমআ আদায় করবেন।” –ফাতহুল কাদির ৭/২৬৪

দৃষ্টান্ত-৩: তা’লীম তাআল্লুম ও ইলমচর্চা

একইভাবে এই পরিমাণ ইলমচর্চা ও ইলমের গভীরতা মুসলিমদের মধ্যে থাকা জরুরি, যার দ্বারা মুসলিম সমাজের যে কোনো সমস্যার ইলমি সমাধানের প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব। এটা মুসলিমদের উপর ফরজে কেফায়া, যা সমষ্টিগতভাবে সকলের উপর ফরজ। কিছু লোকের দ্বারা আদায় হয়ে গেলে সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আনাদায়ী থাকলে সবাই গোনাহগার হবে। তবে এই ইলমচর্চার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মূলত ইমামুল মুসলিমিনের। কিন্তু ইমাম যদি না থাকে, কিংবা থেকেও এই দায়িত্ব আদায় না করে, সর্বস্তরের মুসলমানের দায়িত্ব যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী তা আদায় করার চেষ্টা করা। যেমন বর্তমান অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোতে সর্বস্তরের জনগণ ও আলেম উলামারা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, ওয়াজ মাহফিল, বয়স্ক শিক্ষা, প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে করে আসছেন।

ইমাম সারাখসী রহ. (৪৮৩ রহ.) বলেন,

ثم الفرض نوعان فرض عين وفرض كفاية ففرض العين على كل أحد إقامته نحو أركان الدين. وفرض الكفاية ما إذا قام به البعض سقط عن الباقين لحصول المقصود. وإن اجتمع الناس على تركه كانوا مشتركين في المأثم كالجهاد، فإن المقصود به إعلاء كلمة الله تعالى وإعزاز الدين، فإذا حصل هذا المقصود من بعض المسلمين سقط عن الباقين، وإذا قعد الكل عن الجهاد حتى استولى الكفار على بعض الثغور اشترك المسلمون في المأثم بذلك. وكذا غسل الميت والصلاة عليه والدفن كل ذلك فرض كفاية إذا قام به البعض سقط عن الباقين، وإن امتنعوا من ذلك حتى ضاع ميت بين قوم مع علمهم بحاله كانوا مشتركين في المأثم فأداء العلم إلى الناس فرض كفاية إذا قام به البعض سقط عن الباقين لحصول المقصود، وهو إحياء الشريعة وكون العلم محفوظا بين الناس بأداء البعض، وإن امتنعوا من ذلك حتى اندرس شيء بسبب ذلك كانوا مشتركين في المأثم. – المبسوط للسرخسي: 30/ 263

“ফরজ দুই প্রকার: ফরজে আইন ও ফরজে কেফায়া। ফরজে কেফায়া হলো, যা আদায় করা প্রত্যেকের উপর ফরজ। যেমন (নামায-রোযা ও অন্যান্য) আরকানে দ্বীন। আর ফরজে কেফায়া হলো, যা কিছু মানুষ আদায় করলে উদ্দেশ্য অর্জন হয়ে যাওয়ায় অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পায়, কিন্তু যদি সবাই মিলে তা পরিত্যাগ করে, তাহলে সবাই গুনাহগার হয়। যেমন জিহাদ। কেননা জিহাদের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তায়ালার কালিমা ‍বুলন্দ করা এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। যদি এ উদ্দেশ্য কিছু মুসলিমের দ্বারা অর্জিত হয়ে যায়, তাহলে অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পায়। কিন্তু যদি সবাই জিহাদ ত্যাগ করার কারণে কাফেররা কোন সীমান্ত দখল করে নেয়, তাহলে সকল মুসলমান গুনাহগার হবে। তেমনি মাইয়েতের গোসল, জানাযা ও দাফন সবগুলোই ফরজে কেফায়া। কিছু মুসলিম তা পালন করলে, অন্যরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাবে। কিন্তু যদি কেউই তা না করে, ফলে কোনো অঞ্চলের লোকদের জানা থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনো মাইয়িত কাফন-দাফন থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তারা সবাই গুনাহগার হবে। মানুষের নিকট ইলম পৌঁছানো ফরজে কেফায়া, যদি কিছু মানুষ তা আঞ্জাম দেয় তাহলে অন্যরা দায়িত্ব হতে মুক্তি লাভ করবে। কেননা কিছু মানুষের দ্বারা শরীয়াহকে জীবন্ত রাখা এবং মানুষের মাঝে ইলম সংরক্ষণের উদ্দেশ্য অর্জন হয়ে যায়। কিন্তু যদি সবাই এ থেকে বিরত থাকে, ফলে (দ্বীনের) কোনো বিষয় বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে।” -মাবসুতে সারাখসী: ৩০/২৬৩

ইবনে তাইমিয়া রহ.র একটি উদ্ধৃতি আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, যেখানে তিনি বলেছেন,

وقد تبين بهذا أن الدعوة إلى الله تجب على كل مسلم؛ لكنها فرض على الكفاية وإنما يجب على الرجل المعين من ذلك ما يقدر عليه إذا لم يقم به غيره وهذا شأن الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر وتبليغ ما جاء به الرسول والجهاد في سبيل الله وتعليم الإيمان والقرآن. -مجموع الفتاوى: 15/ 166

“পূর্বোক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট হল, আল্লাহর দিকে আহ্বান করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। তবে তা ফরজে কেফায়া। নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী তা ফরজে আইন হয়, যখন অন্য কেউ তা না করে। আমর বিল মারূফ, নাহী আনিল মুনকার, রাসূলের আনীত দ্বীনের তাবলীগ, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ এবং ঈমান ও কুরআন শিক্ষা দেয়ার বিধানও এটাই।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ১৫/১৬৬

হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. (১৩৬২ হি.) বলেন,

علومِ دینیہ میں  تبحر مجموعہ مسلمین پر فرضِ کفایہ ہے، یعنی قوم میں اتنے جامع علومِ ادیان کے موجود رہنے کا انتظام رکھنا ضروری ہے جس سے عام مسلمین کی دینی حاجتیں، تبلیغِ احکام و جوابِ اسئلہ وغیرہ پوری ہوسکیں، اگر ایسا انتظام نہ کیا جائے گا تو تمام قوم عاصی و آثم (گناہ گار) ہوگی ۔۔۔۔۔ پھر جس وقت تک بیت المال منتظم تھا، بیت المال سےوصول ہوجانا عامۂ مسلمین سے وصول ہوجانے کی صورت تھی، چناںنچہ فقہاء نے قضاۃ  و علما ء ومفتیین وأمثالہم کی کفایت کا بیان بیت المال میں سے ہونا تصریحاً لکھا ہے، اور جب سے بیت المال منتظم نہیں رہا، اب اس کی صورت صرف یہی ہے کہ سب مسلمان متفق و مجتمع ہوکر تھوڑا تھوڑا سب ان حضرات کی خدمت بہ قدر کفایت کریں، خواہ مدرسہ کی شکل میں ہو جس میں ضوابط و قواعد مقرر ہوتے ہیں، اور ان صاحبوں کی تنخواہیں اور وظیفے مقرر ہوتے ہیں، اور یہ سہل اور أقرب إلی الضبط(آسان اور انتظامی لحاظ سے بہتر ) ہے،  اور خواہ توکل کی صورت میں ہو جس میں کوئی مقدار معین نہیں، جو کسی کو توفیق ہوئی بلا واسطہ کسی مہتمم وغیرہ کے خود ان کی نذر کردے، اور یہ أقرب إلی الخلوص (خلوص کے قریب) ہے۔  اصلاح انقلاب امت: 2/191-192 ط.ادارة المعارف كراچي؛ العلم والعلماء،مرتبه  زيد مظاہري، ص: 89 ط. اداره افادات اشرفيه دوبگّا، ہردوئی روڈ، لكھنؤ

“দ্বীনী ইলমে পাণ্ডিত্য সমষ্টিগতভাবে মুসলমানদের উপর ফরজে কেফায়া। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পরিমাণ বিজ্ঞ আলেমের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাদের দ্বারা সব মুসলমানের দ্বীনী প্রয়োজন, যথা তাদের নিকট শরীয়তের বিধান পৌঁছানো, তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া ইত্যাদি পূর্ণ হয়। যদি এই ব্যবস্থা না করা হয়, তবে পুরো জাতি গুনাহগার হবে। যতদিন পর্যন্ত বাইতুল মালের ইন্তেজাম ছিল, ততদিন আলেমদের ভাতা বাইতুল মাল থেকে হওয়া মুসলিমদের থেকে হওয়ারই নামান্তর ছিল। এজন্যই ফুকাহায়ে কেরাম আলেম, মুফতি ও কাযী প্রমুখের ভাতা বাইতুল মাল থেকে দেয়ার সুস্পষ্ট বিবরণ দিয়েছেন। আর এখন যেহেতু বাইতুল মালের ইন্তেজাম নেই, তাই এর পদ্ধতি শুধু এটাই হতে পারে যে, সব মুসলমান অল্প অল্প করে আলেমদের জীবিকার ব্যবস্থা করবে। এটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও হতে পারে, যেখানে নির্দিষ্ট নিয়মে তাদের জন্য নির্ধারিত ভাতা থাকে। আর এটাই সহজ ও ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে উত্তম পদ্ধতি। অথবা তাওয়াক্কুলের সুরতেও হতে পারে। যাতে ভাতার নির্ধারিত কোনো পরিমাণ থাকবে না। যার যতটুকু তাওফিক হবে সে মুহতামিম বা কারো মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি আলেমদের দিয়ে দিবে। এ পদ্ধতি ইখলাসের অধিক নিকটবর্তী। -ইসলাহে ইনকিলাবে উম্মত: ২/১৯১-১৯২; আলইলমু ওয়ালউলামা, যায়েদ মাজাহেরী, পৃ: ৮৯

কতই না বাস্তব বলেছেন ইমাম জাসসাস রহ. (৩৭০ হি.)

সুতরাং শরীয়তের অন্যান্য ফরজে কেফায়াই যখন ইমাম না থাকলেও আদায় করা জরুরি, সেগুলোর মুখাতাব সকল মুসলিম এবং অনাদায়ী থাকলে সকলেই গুনাহগার হয়, তখন জিহাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ জিহাদ হচ্ছে ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং অন্য সকল বিধানের বুনিয়াদ ও রক্ষাকবচ। জিহাদ না থাকলে শরীয়তের কোনো বিধানই বহাল থাকে না; যেমনটি আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। ইমাম জাসসাস রহ. বলেন,

وليس بعد الإيمان بالله ورسوله فرض آكد ولا أولى بالإيجاب من الجهاد، وذلك أنه بالجهاد يمكن إظهار الإسلام وأداء الفرائض، وفي ترك الجهاد غلبة العدو ودروس الدين، وذهاب الإسلام. – أحكام القرآن للجصاص ط العلمية: 3/ 149

“আল্লাহ ও রাসূলের উপর ঈমানের পর জিহাদের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম ফরজ আর নেই। কারণ, জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামের বিজয় ও ফারায়েজসমূহ আদায় করা সম্ভব। পক্ষান্তরে জিহাদ ছেড়ে দিলে শত্রুরা বিজয়ী হয়ে যাবে, দ্বীন মিটে যাবে এবং ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে।” -আহকামুল কুরআন ৩/১৪৯

والله سبحانه وتعالى أعلم وعلمه أتم وأحكم، أستغفر الله وأتوب إليه، وصلى الله تعالى عليه وعلى آله وصحبه وسلم تسليما كثيرا كثيرا.

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

১৯-০৬-১৪৪৩ হি.

২৪-০১-২০২২ ঈ.

Related Articles

Back to top button