সাদাকা করার জন্য অতিরিক্ত আয়ে সময় দেওয়া উত্তম,না ইলম অর্জনে?
সাদাকা করার জন্য অতিরিক্ত আয়ে সময় দেওয়া উত্তম, না ইলম অর্জনে?
সাদাকা করার জন্য অতিরিক্ত আয়ে সময় দেওয়া উত্তম,না ইলম অর্জনে?
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
প্রশ্ন:
আমি একজন অবিবাহিত ইন্টার্ন ডাক্তার। আমার পরিবার সচ্ছল। মাসিক যে বেতন পাই, তাতে আমার খরচ ভালোভাবে চলে যায়। বিকালে বা রাতে আমার কিছু অতিরিক্ত কাজ করার সুযোগ হয়, তাতে প্রতিদিন ৫০০-১০০০ টাকা অতিরিক্ত আয় করা যায়। এই অতিরিক্ত আয়ের পুরো টাকাটাই বিভিন্ন দীনি প্রজেক্ট কিংবা মাদরাসায় দান করে দিই।
অতিরিক্ত আয়ের পেছনে ব্যয়কৃত সময়ে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির অথবা ইসলামী বই পড়ায় ব্যয় করলে আমার যে আত্মশুদ্ধি হয়, তা আমি সহজেই অনুভব করি। কোনো মাদরাসায় ১০০ পিস কুরআন হাদিয়া দিলে আত্মতৃপ্তি হলেও নফল ইবাদতের মাধ্যমে ব্যক্তিগত আত্মিক যে উন্নতি আমি লাভ করি, তা অনুভব করি না।
এখন আমার প্রশ্ন হল, আমি কি নফল ইবাদতে সময় দিবো, না আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য অতিরিক্ত আয়ে সময় দিবো?
-মুআয
উত্তর:
আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য হালাল পথে বাড়তি কিছু উপার্জনের সুযোগ থাকলে তা কাম্য। আবু মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে,
قال النبي صلى الله عليه و سلم (على كل مسلم صدقة) . قالوا فإن لم يجد؟ قال (فيعمل بيديه فينفع نفسه ويتصدق) -صحيح البخاري: 5676، صحيح مسلم: 2380
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রত্যেক মুসলিমের সাদাকা করার আবশ্যকতা রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, যদি তার সামর্থ্য না থাকে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে তার দুটি হাতের মাধ্যমে উপার্জন করবে, নিজেরও উপকার করবে, সাদাকাও করবে।” -সহীহ বুখারী: ৫৬৭৬, সহীহ মুসলিম: ২৩৮০
অন্য হাদীসে এসেছে,
عن أبي مسعود، قال: لما أمرنا بالصدقة كنا نتحامل، فجاء أبو عقيل بنصف صاع، وجاء إنسان بأكثر منه، فقال المنافقون: إن الله لغني عن صدقة هذا، وما فعل هذا الآخر إلا رئاء، فنزلت: {الذين يلمزون المطوعين من المؤمنين في الصدقات، والذين لا يجدون إلا جهدهم}. -صحيح البخاري: 4391، صحيح مسلم: 2402
“আবু মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা যখন আমাদেরকে সাদাকার আদেশ দিলেন, তখন আমরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বোঝা বহন করতাম (এবং সাদাকা করতাম)। একদিন আবু আকীল আধা সা পরিমাণ খেজুর নিয়ে আসেন, অপর এক ব্যক্তি আরও বেশি সাদাকা নিয়ে আসেন। তখন মুনাফিকরা বলল, আল্লাহ তাআলার আবু আকীলের (সামান্য) সাদাকার প্রয়োজন নেই, আর এতো লোক দেখানোর জন্য (অনেক) সাদাকা করছে। তখন এই আয়াত নাযিল হয়, ‘মুমিনদের মধ্য হতে যারা নফল সাদাকা করে এবং যারা নিজেদের সাধ্যানুযায়ী সামান্য দান করে, (মুনাফিকরা) তাদের সমালোচনা করে, (তাদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, আল্লাহ তাআলা তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপের বদলা নেবেন এবং তাদের জন্য রয়েছে, কঠোর শাস্তি)’।” -সহীহ বুখারী: ৪৩৯১ সহীহ মুসলিম: ২৪০
ইমাম আবু বকর খাল্লাল রহিমাহুল্লাহ (৩১১ হি.) বলেন,
حدثنا أبو بكر المروذي، قال: سمعت رجلا، يقول لأبي عبد الله رحمه الله: إني في كفاية، فقال: «الزم السوق تصل به الرحم وتعود به» -الحث على التجارة والصناعة، ص(25)
“আবু বকর মারওয়াযী আমাদের নিকট বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি আবু আব্দুল্লাহকে (ইমাম আহমদ রহিমাহুল্লাহকে) বলেন, আমার তো প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হয় পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। ইমাম আহমদ রহিমাহুল্লাহ বললেন, (এরপরও) তুমি বাজারে যাও, ব্যবসা-বাণিজ্য কর। এর মাধ্যমে তুমি আত্মীয়দের সহায়তা ও অসুস্থদের সেবা করতে পারবে।” -আল-হাসসু আলাত তিজারাতি ওয়াস সানাআহ, পৃ: ২৫
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ (৭২৮ হি.) উপার্জনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন,
ومنه ما يكون مستحبا: مثل هذا إذا اكتسب ما يتصدق به؛ فقد ثبت في الصحيحين عن أبي موسى عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال: على كل مسلم صدقة قالوا: يا رسول الله فمن لم يجد. قال: يعمل بيده ينفع نفسه ويتصدق … اهـ
“উপার্জনের একটা পর্যায় হলো মুস্তাহাব। যেমন (নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ এবং ঋণ পরিশোধের বাহিরে নফল) সাদাকা করার জন্য উপার্জন করা। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবু মুসা রাযিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের সাদাকা করার আবশ্যকতা রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, যদি তার সামর্থ্য না থাকে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে তার দুটি হাতের মাধ্যমে উপার্জন করবে, নিজেরও উপকার করবে সাদাকাও করবে …।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ৮/৫৩৭
তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যিকির, তিলাওয়াত, নফল সালাত ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের আত্মিক উন্নতি সাধন ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ (7) وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ. -الانشراح: 7، 8
“অতএব তুমি যখন অবসর পাও, তখন (ইবাদতে) নিজেকে পরিশ্রান্ত কর। এবং নিজ প্রতিপালকের প্রতিই মনোযোগী হও।” -সূরা ইনশিরাহ: ৭, ৮
আয়াতের তাফসীরে শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,
“বলা বাহুল্য, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল প্রচেষ্টা ও ব্যস্ততা দীনকে কেন্দ্র করেই ছিল। তাবলীগ, তালীম, জিহাদ, প্রশাসন ইত্যাদি সমস্ত কাজই দীনের জন্য হত এবং এ কারণে তাঁর সব কাজ ইবাদতেরও মর্যাদা রাখত। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা হচ্ছে, আপনি যখন এসব কাজ শেষে অবসর পাবেন, তখন খালেস ইবাদত, যেমন নফল নামায, মৌখিক যিকির ইত্যাদি এ পরিমাণ করবেন, যাতে দেহ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর দ্বারা বোঝা গেল, যারা দীনের খেদমতে নিয়োজিত, তাদেরও কিছু সময় খালেস নফল ইবাদতের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। এর দ্বারাই আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠ হয় এবং এর দ্বারাই অন্যান্য দীনি কাজে বরকত সৃষ্টি হয়।” -তাওযীহুল কুরআন: ৩/৭২৭
ইমাম সারাখসী রহিমাহুল্লাহ (৪৮৭ হি.) বলেন,
إنه بعدما اكتسب مالا بد له منه هل الاشتغال بالكسب أفضل أم التفرغ للعبادة؟ قال بعض الفقهاء رحمهم الله: الاشتغال بالكسب أفضل. وأكثر مشايخنا رحمهم الله على أن التفريغ للعبادة أفضل …إن الأنبياء والرسل عليهم السلام ما اشتغلوا بالكسب في عامة الأوقات، ولا يخفى على أحد أن اشتغالهم بالعبادة في عمرهم كان أكثر من إشتغالهم بالكسب، ومعلوم أنهم كانوا يختارون لأنفسهم أعلى الدرجات، ولا شك أن أعلى مناهج الدين طريق المرسلين عليهم السلام. –الكسب ص: 103 (ط. مكتبة المطبوعات الإسلامية) والمبسوط: 30\251 (ط. دار المعرفة)
“প্রয়োজনীয় সম্পদ উপার্জনের পর (সাদাকা ইত্যাদির জন্য অতিরিক্ত) উপার্জন করা উত্তম, না নফল ইবাদতের জন্য অবসর থাকা উত্তম? কতক ফকিহের মতে অতিরিক্ত উপার্জনে লিপ্ত থাকা উত্তম। তবে আমাদের অধিকাংশ মাশায়েখের মতে ইবাদতের জন্য ফারেগ থাকা উত্তম। (কেননা) নবী-রাসূলগণ বেশিরভাগ সময়ই উপার্জনে লিপ্ত হননি। সকলেই জানে, উপার্জনের তুলনায় ইবাদত-বন্দেগিতেই তাঁদের জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। আর তারা তো নিজেদের জন্য উচ্চমর্যাদার বিষয়টিই গ্রহণ করেছেন। নিঃসন্দেহে নবী-রাসূলগণের পথই দীনের সর্বোত্তম আদর্শ।” -কিতাবুল কাসব, পৃ: ১০৩ (মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়্যাহ); মাবসুতে সারাখসী: ৩০/২৫১ (দারুল মারেফা)
অধিকন্তু সংশয় মুক্তভাবে দীনের উপর অটল অবিচল থাকার জন্য এবং হালাল-হারাম চিনে সহীহ পথে চলার জন্য ইলম অর্জনের বিকল্প নেই। যদি এতটুকু সহীহ ইলম আপনার অর্জন না হয়ে থাকে, তাহলে তা অর্জন করা আপনার জন্য শুধু উত্তমই নয়, বরং ফরয।
তাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফারেগ সময়টুকুতে নফল ইবাদাত ও ইলম অর্জনকে অগ্রাধিকার দিন এবং পাশাপাশি সাধ্য অনুযায়ী কিছু দান সাদাকা করারও চেষ্টা করে যাবেন।
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
১৮-০৫-১৪৪৫ হি.
০৩-১১-২০২৩ ঈ