প্রশ্ন: ১. বাংলাদেশের মানুষ আরাফার রোযা কোন দিন রাখবে?
২. অযু বিহীন মুসহাফ স্পর্শ করে তিলাওয়াত করার বিধান কি?
৩. পশু খাসি করার বিধান কি? এটা সূরা নিসার ১১৯ নং আয়াতের নিষেধে পড়বে কি না?
৪. মুহাসাবার আলোচনায় যদি কেউ সূরা বনি ইসরাঈলের ১৪ নং আয়াত দিয়ে ইস্তিদলাল করে তাহলে কি তা সহীহ হবে?
-আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ
উত্তর: ১. বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের ৯ যিলহজ আরাফার রোযা রাখবে। সৌদি আরবের ৯ যিলহজ নয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২১৯৮; আল-মুফহিম: ৩/১৪২ (দারু ইবনি কাসীর); বাদায়েউস সানায়ে: ২/৮৩ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ), আল-মুহিতুল বুরহানী: ৩/৩৪১, ৩৪২ (ইদারাতুল কুরআন, করাচি); আল-ফাতাওয়াল ওয়ালওয়ালিজিয়্যাহ: ১/২৩৬ (দারুল কুতুব); আত-তাজনীস ওয়াল মাযীদ: ২/৪২৩ (ইদারাতুল কুরআন); তাবয়ীনুল হাকায়িক: ১/৩২১ (আল-আমীরিয়্যাহ, বোলাক)
উত্তর: ২. অযু বিহীন মুসহাফ স্পর্শ করা যাবে না। তবে স্পর্শ না করে তিলাওয়াত করা যাবে। গোসল ফরয অবস্থায় স্পর্শও করা যাবে না, তিলাওয়াতও করা যাবে না।
হাদীসে এসেছে,
لا يمس القرآن إلا طاهر. -موطأ مالك: 1/199 (ط. دار إحياء التراث) وقال ابن كثير في ” تفسيره” (7/545 ط. دار طيبة) : “وهذه وجادة جيدة. قد قرأها الزهري وغيره، ومثل هذا ينبغي الأخذ به.”
“পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ যেন কুরআন স্পর্শ না করে।” -মুআত্তা মালিক: ১/১৯৯
অপর হাদীসে এসেছে,
عن علي، قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقرئنا القرآن على كل حال ما لم يكن جنبا. –أخرجه الترمذي (146) وقال: حديث علي حديث حسن صحيح. وبه قال غير واحد من أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم، والتابعين، قالوا: يقرأ الرجل القرآن على غير وضوء، ولا يقرأ في المصحف إلا وهو طاهر.
“আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, গোসল ফরয না হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সকল অবস্থায়ই কুরআন শিক্ষা দিতেন।” –জামে তিরিমিযী, হাদীস: ১৪৬
ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন: “আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসটি সহীহ। সাহাবী ও তাবিঈগণের একাধিক আলেম এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেন, অযু ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত করা যায়। তবে অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করে পড়া যায় না।”
উত্তর: ৩. পশু খাশি করা জায়েয। এটা সূরা নিসার ১১৯ নং আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। ঠিক যেমন নারীদের নাক কান ছিদ্র করা উক্ত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়। একারণেই নববী যুগ থেকে উম্মতে মুসলিমার মাঝে এ দুটি বিষয়ের উপর আমল চলে আসছে।
হাদীসে এসেছে-
أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ ضَحّى بِكَبْشَيْنِ سَمِينَيْنِ عَظِيمَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ مُوْجَيَيْنِ. –رواه ابن ماجه (4/301 رقم:3122 ط. دار الرسالة العالمية) وقال البوصيري في “مصباح الزجاجة” (3/ 222) : “هذا إسناد حسن.” ويشهد له حديث أنس عند أبي عوانة (3220) وقال الحافظ ابن حجر في “تغليق التعليق” (5/ 4) : “ورواه بلفظ “سمينين” الحافظ أبو عوانة في مسنده الصحيح … وهذا الإسناد صحيح.”
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বড় শিং বিশিষ্ট সাদা-কালো বর্ণের হৃষ্টপুষ্ট খাসি-দুম্বা জবাই করেছেন।” -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৩১২২
উত্তর: ৪. সূরা বনি ইসরাঈলের ১৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
{اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا} [الإسراء: 14]
“তোমার আমলনামা পড়। আজ তোমার নিজের হিসেবের জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।” –সূরা বনি ইসরাঈল: ১৪
এই আয়াতে যদিও সরাসরি মুহাসাবার নির্দেশ দেয়া হয়নি, তবে এখানে অবশ্যই ব্যক্তির নিজের মুহাসাবার ইঙ্গিত আছে। আর মুহাসাবা যে জরুরি সে নির্দেশ কুরআন-সুন্নাহয় আরো স্পষ্টভাবেও এসেছে। ইরশাদ হচ্ছে,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (18) وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (19) لَا يَسْتَوِي أَصْحَابُ النَّارِ وَأَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمُ الْفَائِزُونَ (20) -الحشر: 18 – 20
“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামী কালের জন্য সে কী অগ্রীম পাঠিয়েছে এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কিছু কর সে সম্পর্কে আল্লাহ পুরোপুরি অবগত। তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল, ফলে আল্লাহ তাকে আত্মভোলা করে দেন। বস্তুত তারাই অবাধ্য। জাহান্নামবাসী ও জান্নাতবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতবাসীগণই কৃতকার্য।” –সূরা হাশর ৫৯ :১৮-২০
আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ (৭৭৪ হি.) বলেন,
أي: حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وانظروا ماذا ادخرتم لأنفسكم من الأعمال الصالحة ليوم معادكم وعرضكم على ربكم. –تفسير ابن كثير (8/77 ط. دار طيبة)
“অর্থাৎ তোমরা আখিরাতে হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে দুনিয়াতেই নিজেরা নিজেদের আমলের হিসাব নাও এবং কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য তোমরা কি নেক আমল সঞ্চয় করেছ তা ভেবে দেখ।” -তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৮/৭৭
জামে তিরমিযীতে এসেছে,
عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «الكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ المَوْتِ، وَالعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ.» هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ. وَمَعْنَى قَوْلِهِ: مَنْ دَانَ نَفْسَهُ يَقُولُ حَاسَبَ نَفْسَهُ فِي الدُّنْيَا قَبْلَ أَنْ يُحَاسَبَ يَوْمَ القِيَامَةِ ” وَيُرْوَى عَنْ عُمَرَ بْنِ الخَطَّابِ، قَالَ: ” حَاسِبُوا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوا، وَتَزَيَّنُوا لِلْعَرْضِ الأَكْبَرِ، وَإِنَّمَا يَخِفُّ الحِسَابُ يَوْمَ القِيَامَةِ عَلَى مَنْ حَاسَبَ نَفْسَهُ فِي الدُّنْيَا». –جامع الترمذي ت شاكر (4/638 رقم: 2459)
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘বুদ্ধিমান (সুপুরুষ) তো সে ব্যক্তি যে (নফসের কাছে পরাজিত হয়নি, বরং) নিজের নফসকে কাবু করতে পেরেছে এবং (মৃত্যু এসে যাওয়ার আগেই) মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করেছে। আর (নির্বোধ) কাপুরুষ তো সে ব্যক্তি যে (নফসকে কাবু তো করতে পারেনি, বরং) নফসের চাহিদার অনুগামী হয়ে পড়েছে (এবং নাফরমানিতে ডুবে আছে) এতদসত্ত্বেও আল্লাহর কাছে (মাফ পেয়ে যাওয়ার এবং জান্নাত লাভ করার) আশা করছে।’ (তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ বলেন) নফসকে কাবু করতে পারার অর্থ হচ্ছে, কিয়ামতের দিন হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার আগে দুনিয়াতেই নিজের হিসাব নিজে নিয়েছে। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘তোমাদের থেকে হিসাব নেয়ার আগেই তোমরা নিজেদের হিসাব নিজেরা নাও। মহান দিবসে রবের সামনে হাজির হওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর। কিয়ামতের দিন হিসাব সহজ হবে তাদের, যারা দুনিয়াতে নিজেদের হিসাব নিজেরাই নেয়’।” –জামে তিরমিযী, হাদীস: ২৪৫৯
والله تعالى أعلم بالصواب
-আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
২১-০৪-১৪৪৭ হি.
১৪-১০-২০২৫