বিবিধফাতওয়া  নং  ৩৯৭

সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে কি দেরি করার অবকাশ আছে?

সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে কি দেরি করার অবকাশ আছে?

সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে কি দেরি করার অবকাশ আছে?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্নঃ

আমার বিয়ের প্রায় দুই বছর হলো। কিন্তু বেশ কিছু কারণে এখনও আমি সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করতে পারছি না। কারণ,

ক। আমার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। বয়স কম, গ্রামের সাধারণ ঘরের মেয়ে। ছোটবেলা থেকে পুষ্টিকর খাবার খুব একটা খায়নি। স্বাস্থ্য জ্ঞানও কম। অনেক বিষয় এখনও তেমন কিছু বুঝে না।

খ। এখন এমনিতেই তার পেছনে আমার দৈনিক একটা সময় দিতে হয় বিভিন্ন কিছু শেখাতে, বোঝাতে। এই অবস্থায় সন্তান নিলে মা ও সন্তান দুইজনের পেছনেই আমার ভালো একটা সময় ব্যয় হয়ে যাবে। যার  কারণে দ্বীনের কাজের উপর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছি। এছাড়া আমি নিজেও অনেক কাজের আগ পিছ না বুঝেই তাড়াহুড়া করে ফেলি। এ কারণে অনেক সময় আর্থিক বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। এক কথায় আমি নিজেও এখনও ততটা দায়িত্ববান হতে পারিনি মনে হয়। আল্লাহ না করুন সব দিক সামলাতে গিয়ে দীনের কাজের এবং মা ও সন্তানের কিংবা নিজের কোনও ক্ষতি করে ফেলি কিনা ভাবছি।

উল্লেখ্য, আল্লাহ তাআলার মেহেরবানিতে অনেক আগ থেকে আমি একটি জিহাদী জামাতের সাথে যুক্ত আছি। সেখানে নিয়মিত কিছু কাজও করছি আলহামদুলিল্লাহ।

গ। আমাদের এক ভাইয়ের ব্যাপারে শুনেছি, চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ভাইয়ের তিনটি সন্তান হয়। ফলে তাঁর স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ওই ভাইকে ঘরেই অনেক সময় দিতে হতো। যার কারণে তিনি জিহাদের কাজে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না।

উল্লেখ্য, আমাকে আমার আব্বা-আম্মা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে এবং সামনেও দূরেই থাকতে হবে। আব্বা-আম্মা কাছে থাকলে বাচ্চাদের দেখা-শুনাতে তাঁদের যে সহায়তা পাওয়া যেত, তা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে,

১।  আমার স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক উন্নতির জন্য সন্তান নিতে কয়েক বছর দেরি করার অবকাশ আছে কিনা?

২।  আমার জন্য এবং আমার মতো যেসব ভাইকে পরিবার নিয়ে আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে একা থাকতে হয়, আমাদের জন্য এই সুযোগ আছে কিনা যে, ঘন ঘন সন্তান না নিয়ে মাঝে একটি ভালো সময় গ্যাপ দেবো, যেন সন্তানদেরকে সময় দিতে গিয়ে দ্বীনের কাজে ব্যাঘাত না ঘটে।

৩।  শরীয়তের দৃষ্টিতে ওপরের পরিস্থিতিগুলোর কোনও একটিতে পড়লে, সন্তান নিতে দেরি করা এবং দুই সন্তানের মাঝে দেরি করা কি গুনাহের কাজ বলে গণ্য হবে?

 

উত্তরঃ

মূল প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার পূর্বে কয়েকটি বিষয় আরজ করতে চাই,

এক. ইসলাম সন্তান লাভের মাধ্যম গ্রহণ এবং বেশি বেশি সন্তান কামনায় উৎসাহিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ. -البقرة: 187

“সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সহবাস হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক। …. সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে সহবাস করো এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন, তা অন্বেষণ করো।” -সূরা বাকারা ০২ : ১৮৭

আয়াতের তাফসীরে ইমাম আবুস সাউদ রহিমাহুল্লাহ (৯৮২ হি.) বলেন,

أي واطلُبوا ما قدّره الله لكم وقرَّره في اللوحِ من الوَلدِ وفيه أن المباشِرَ ينبغي أنْ يكونَ غرضُه الولدَ فإنه الحكمةُ في خلق الشهوة وشرع النكاحِ لا قضاء الشهوة. -تفسير أبي السعود (1/201 دار إحياء التراث العربي – بيروت)

“অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তোমাদের তাকদীরে যে সন্তান রেখেছেন, তা অন্বেষণ করো। এ থেকে বুঝে আসে, সহবাসের সময় সন্তান উদ্দেশ্য হওয়াই কাম্য। এটাই মানুষের মাঝে যৌনকামনা প্রদান ও বিয়ে বৈধ করার হিকমত। (শুধু) যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করা নয়।” -তাফসীরু আবিস সাউদ: ১/২০১ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)

হাদীসে এসেছে,

عن مَعْقِلِ بنِ يسارٍ، قال: جاء رجل إلى النبيٌ – صلَّى الله عليه وسلم – فقال: إني أصبتُ امرأةً ذاتَ حَسَبٍ وجَمَالٍ، وأنها لا تَلِدُ، أفاتزوجُها؟ قال: ” لا” ثم أتاهُ الثانيةَ فنهاه، ثم أتاه الثالثةَ، فقال: “تزوجوا الوَدُودَ الوَلُودَ فإني مكاثِرٌ بِكُمُ الأمم.” -سنن أبي داود ت الأرنؤوط (3/ 395 رقم:  2050 دار الرسالة العالمية، الطبعة: الأولى، 1430 هـ) صحيح ابن حبان – (9/ 364 رقم: 4057 مؤسسة الرسالة، بيروت الطبعة: الأولى، 1408 ه) وقال الحافظ ابن الصلاح في “شرح مشكل الوسيط” (3/ 528 دار كنوز إشبيليا، السعودية، الطبعة: الأولى، 1432 ه) : “وهو حسن الإسناد”.وقال الإمام ابن دقيق العيد في “الإلمام بأحاديث الأحكام” (1/ 493 دار النوادر، سوريا الطبعة: الأولى، 1434 هـ) : “رواه مُستَلِم بن سعيد، وقال أحمد بن حنبل فيه: شيخٌ ثقةٌ.”

“মাকিল বিন ইয়াসার রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করলো, আমি অভিজাত বংশের এক সুন্দরী রমনীর সন্ধান পেয়েছি, কিন্তু সে সন্তান প্রসব করে না (বন্ধ্যা)। আমি কি তাকে বিয়ে করবো? তিনি বললেন, না। অতঃপর সে ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এসে জিজ্ঞাসা করলে তখনও নিষেধ করলেন। তৃতীয়বার আসলে বললেন, তোমরা প্রেমময়ী ও অধিক সন্তান প্রসবা নারীদের বিয়ে করো। কেননা আমি (কিয়ামতের দিন) তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে (পূর্ববর্তী উম্মতের উপর) গর্ব করবো।” -সুনানে আবু দাউদ: ৩/৩৯৫ হাদীস নং: ২০৫০ (দারুল রিসালাতিল আলামিয়্যাহ)

বিশেষ করে মুজাহিদদের জন্য তো এ ব্যাপারে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া চাই। কারণ মুজাহিদের সন্তান মুজাহিদ হবে এটাই স্বাভাবিক। আর জিহাদের উদ্দেশ্যে সন্তান কামনাও একটি স্বতন্ত্র নেক কাজ। হাদীসে এসেছে,

عن أبي هريرة رضي الله عنه، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم، قال: “قال سليمان بن داود عليهما السلام: لأطوفن الليلة على مائة امرأة، أو تسع وتسعين كلهن، يأتي بفارس يجاهد في سبيل الله، فقال له صاحبه: إن شاء الله، فلم يقل إن شاء الله، فلم يحمل منهن إلا امرأة واحدة، جاءت بشق رجل، والذي نفس محمد بيده، لو قال: إن شاء الله، لجاهدوا في سبيل الله، فرسانا أجمعون.” –صحيح البخاري (4/22 رقم: 2819 دار طوق النجاة الطبعة: الأولى، 1422هـ) وصحيح مسلم (3/1276 رقم: 1654 ط. دار إحياء التراث العربي – بيروت)

“আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একদা সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি আজ রাতে একশ অথবা নিরানব্বই জন নারী (স্ত্রী/বাঁদীর)-র সাথে মিলিত হবো, যারা প্রত্যেকেই একটি করে সন্তান জন্ম দেবে, যারা হবে অশ্বারোহী, যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। তাঁর সঙ্গী বললো, ইনশাআল্লাহ (বলুন)। তিনি ইনশাআল্লাহ বললেন না। অতঃপর কেবল একজন স্ত্রীই গর্ভবতী হলো, তাও এক অপূর্ণাঙ্গ সন্তান প্রসব করলো। ওই মহান সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, তিনি যদি ইনশাআল্লাহ বলতেন, তাহলে সকলেই অশ্বারোহী হয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতো।” -সহীহ বুখারী: ৪/২২ হাদীস নং: ২৮১৯ (দারু তাওকিন নাজাহ); সহীহ মুসলিম: ৩/১২৭৬ হাদীস নং: ১৬৫৪ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ (২৫৬ হি.) এই হাদীসের শিরোনাম দিয়েছেন,

“باب من طلب الولد للجهاد

“অধ্যায়: জিহাদের উদ্দেশ্যে সন্তান কামনা করা”

হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২ হি.) বলেন,

أي: ينوي عند المجامعة حصول الولد ليجاهد في سبيل الله، فيحصل له بذلك أجر، وإن لم يقع ذلك. –فتح الباري (6/35 ط. دار الفكر)

“অর্থাৎ সহবাসের সময় নিয়ত করবে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য যেন সন্তান লাভ হয়। তাহলে সন্তান না হলেও (নিয়তের কারণে) সাওয়াব হবে।” -ফাতহুল বারী: ৬/৩৫ (দারুল ফিকর)

অপর দিকে অধিক ইবাদতের উদ্দেশ্যে সন্তান না হওয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে সুস্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عن سعد بن أبي وقاص، قال: “رد رسول الله صلى الله عليه وسلم على عثمان بن مظعون التبتل، ولو أذن له لاختصينا.” –صحيح البخاري (7/4 رقم: 5073 دار طوق النجاة، الطبعة الأولى: 1422هـ) صحيح مسلم (2/1020 رقم 1402 ط. دار إحياء التراث(

“সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান বিন মাযউনকে বৈরাগ্য থেকে নিষেধ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাঁকে অনুমতি দিতেন, তাহলে আমরাও (ঘর সংসার ছেড়ে শুধু ইবাদত বন্দেগির উদ্দেশ্যে) খাসি হয়ে যেতাম।” -সহীহ বুখারী: ৭/৪ হাদীস নং: ৫০৭৩ (দারু তাওকিন নাজাহ); সহীহ মুসলিম: ২/১০২০ হাদীস নং: ১৪০২ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)

হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহিমাহুল্লাহ (১০০৪ হি.) বলেন,

رد رسول الله صلى الله عليه وسلم على عثمان بن مظعون التبتل” أي: الانقطاع عن النساء، وكان ذلك من شريعة النصارى، فنهى النبي صلى الله عليه وسلم عنه أمته، ليكثر النسل ويدوم الجهاد. -مرقاة المفاتيح (5/2042 دار الفكر، بيروت – لبنان الطبعة: الأولى، 1422هـ)

“অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান বিন মাযউন রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বৈরাগ্য তথা স্ত্রী পরিহার করতে নিষেধ করেছেন। খ্রিস্টান ধর্মে বৈরাগ্যবাদ রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এ থেকে বারণ করেছেন, যেন উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং (এদের মাধ্যমে) জিহাদ চলমান থাকে।” -মিরকাতুল মাফাতীহ: ৫/২০৪২ (দারুল ফিকর)

হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২ হি.) বলেন,

يقال إن طلحة قال للزبير: أسماء بني أسماء الأنبياء وأسماء بنيك أسماء الشهداء، فقال: أنا أرجو أن يكون بني شهداء، وأنت لا ترجو أن يكون بنوك أنبياء، فأشار إلى أن الذي فعله أولى من الذي فعله طلحة. -فتح الباري (10/ 580 ط. دار الفكر)

“বলা হয়, তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বলেন, ‘আমার ছেলেদের নাম নবীদের নাম, আর আপনার ছেলেদের নাম শহীদদের নাম।’ যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমি আমার ছেলেদের শহীদ হওয়ার আশা রাখতে পারি, কিন্তু তুমি তোমার ছেলেদের নবী হওয়ার আশা করতে পারো না।’ (এ কথা বলে) যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু ইঙ্গিত করলেন, তাঁর কাজটি তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহুর চেয়ে উত্তম হয়েছে।” -ফাতহুল বারী: ১০/৫৮০ (দারুল ফিকর)

দুই. তবে শরীয়ত অধিক সন্তান কামনায় উৎসাহিত করলেও এতে বাধ্য করেনি। তাই অস্থায়ীভাবে গর্ভনিরোধক কোনও ব্যবস্থা অবলম্বন করা জায়েয, যদিও কোনও ওজর ছাড়া এমন করা অনুত্তম।-সহীহ মুসলিম: ২/১০৬৩ হাদীস নং: ১৪৩৮ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস); ফাতহুল বারী: ৯/৩০৭ (দারুল ফিকর); মওসুয়্যাহ ফিকহিয়্যাহ: ৩০/৮১ (ওযারাতুল আওকাফ, কুয়েত); ফাতহুল কাদীর: ৩/৪০০ (দারুল ফিকর); রদ্দুল মুহতার: ৩/১৭৫ (দারুল ফিকর)

হাদীসে এসেছে,

حدثنا مسدد، حدثنا يحيى بن سعيد، عن ابن جريج، عن عطاء، عن جابر، قال: «كنا نعزل على عهد النبي صلى الله عليه وسلم». -صحيح البخاري (7/33 رقم:  5207 دار طوق النجاة الطبعة: الأولى، 1422هـ)

“জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ‘আযল’ (স্ত্রী সহবাসের সময় বাহিরে বীর্যপাত) করতাম।”-সহীহ বুখারী: ৭/৩৩ হাদীস নং: ৫২০৭ (দারু তাওকিন নাজাহ)

হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২ হি.) বলেন,

وقد أخرجه مسلم أيضا من طريق أبي الزبير، عن جابر، قال: “كنا نعزل على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم، فبلغ ذلك نبي الله صلى الله عليه وسلم، فلم ينهنا”، ومن وجه آخر عن أبي الزبير، عن جابر: “أن رجلا أتى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: إن لي جارية وأنا أطوف عليها وأنا أكره أن تَحمل، فقال: اعزل عنها إن شئت، فإنه سيأتيها ما قُدِّر لها. فلبث الرجل، ثم أتاه، فقال: إن الجارية قد حبلت، قال: قد أخبرتك. فهذه الطرق صريحة في جواز العزل، وإن كان السياق يشعر بأنه خلاف الأولى.” -الفتح (9/306 ط. دار الفكر(

“ইমাম মুসলিম আবুয যুবায়ের রহিমাহুল্লাহর সূত্রেও জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমরা নবীজির যুগে ‘আযল’ করতাম। নবীজির কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি আমাদেরকে বারণ করেননি।’ ইমাম মুসলিম অপর সনদে আবুয যুবায়েরের সূত্রে জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললো, আমার একটি দাসী আছে। আমি তার সাথে সহবাস করি, কিন্তু সে গর্ভবতী হোক তা আমি পছন্দ করি না। তখন তিনি বললেন, তুমি ইচ্ছে করলে তার সাথে আযল করতে পারো, তবে তার তাকদীরে সন্তান থাকলে, তা হবেই। কিছুদিন পর লোকটি নবীজির কাছে এসে বললো, দাসীটি গর্ভবতী হয়ে গেছে। নবীজি বললেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম (তাকদীরে যা আছে তা হবেই)।” -ফাতহুল বারী: ৯/৩০৬ (দারুল ফিকর)

তিন. যদি গর্ভধারণের কারণে বাস্তবেই মা কিংবা বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার অথবা বাচ্চার লালনপালনে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা হয়, তাহলে অস্থায়ীভাবে কোনও গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা অবলম্বন করা জায়েয।-ফাতহুল বারী: ৯/৩০৭ (দারুল ফিকর) মওসুওয়্যাহ ফিকহিয়্যাহ: ৩০/৮২ (ওযারাতুল আওকাফ); আল-মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী, রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী (তৃতীয় সেমিনার, বিষয়: জন্মনিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্ত নং: ১) ইসলামী ফিকহ একাডেমী, ভারত (প্রথম ফিকহি সেমিনার, বিষয়: পরিবার পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত নং: ৪)

বিশেষ করে দুগ্ধপায়ী বাচ্চার ক্ষতি এড়ানোর জন্য অস্থায়ী গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণে কোনও সমস্যা নেই।-সুনানু আবি দাউদ: ৬/৩০ হাদীস নং: ৩৮৮১ (দারুল রিসালাতিল আলামিয়্যাহ); শরহু মুশকিলিল আসার: ৯/২৮৮ (মুয়াসসাসাতুল রিসালাহ); আল-মুতাসার মিনাল মুখতাসার: ১/৩২২ (আলামুল কুতুব); যাদুল মাআদ: ৫/১৩৫ (মুয়াসসাসাতুল রিসালাহ) মাওসুওয়্যাহ ফিকহিয়্যাহ: ৩১/৩৪৪ (ওযারাতুল আওকায়, কুয়েত)

উল্লেখ্য, দুগ্ধপান করানোর সর্বোচ্চ মেয়াদ চান্দ্র সাল হিসেবে দুই বছর। -রদ্দুল মুহতার: ৩/২০৯ (দারুল ফিকর)

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ … فَإِنْ أَرَادَا فِصَالًا عَنْ تَرَاضٍ مِنْهُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا. -البقرة: 233

“মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে। এ সময়কাল তাদের জন্য, যারা দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। …. আর তারা (পিতা-মাতা) পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে ( দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই) যদি দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তাতেও তাদের কোনও গুনাহ নেই।” -সূরা বাকারা ০২ : ২৩৩

চার. পুরুষের জন্য সন্তান প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্ট করা জায়েয নেই এবং স্বাভাবিক অবস্থায় নারীর জন্যও অপারেশন ইত্যাদির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে প্রজনন ক্ষমতা বিলোপ করা জায়েয নেই।-সূরা নিসা ০৪ : ১১৯; সহীহ বুখারী: ৬/১৪৭, ৭/৪ হাদীস নং: ৪৮৮৬, ৫০৭৩ (দারু তাওকিন নাজাত); সহীহ মুসলিম: ২/১০২০, ৩/১৬৭৮ হাদীস নং: ১৪০২, ২১২৫ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)

পাঁচ. উপর্যুক্ত বিষয়গুলো হৃদয়ঙ্গম করার পর এবার আপনার মূল প্রশ্নের উত্তর নিন;

১ম প্রশ্নের উত্তর:

সন্তান ধারণে আপনার স্ত্রীর অনুপযুক্ততা, সন্তান প্রতিপালনে আপনাদের অযোগ্যতা ইত্যাদির যে আশঙ্কা আপনি করছেন, তা বাস্তব, না আপনার মনের সংশয় ও হীনমন্যতা, তা আমাদের জানা নেই। আপনি নিজেও হয়তো বিষয়গুলোর যথার্থতা অনুধাবনে পরিপক্ক ও অভিজ্ঞ নন। তাই আপনি প্রথমে অভিজ্ঞ বন্ধু-বান্ধব এবং কোনও বিজ্ঞ দীনদার ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করুন, আপনার এই শঙ্কাগুলো বাস্তব কি না? যদি বাস্তব না হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে সন্তান লাভের হিম্মত করুন। স্ত্রীর বয়স তুলনামূলক একটু কম হওয়া বা স্বাস্থ্য সামান্য দুর্বল হওয়াকে সন্তান লাভের অন্তরায় মনে করা ঠিক হবে না। আমাদের পূর্বের প্রজন্মে এবং বর্তমানেও এমন মেয়েদের মা হওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমন যেন না হয় যে, শুধু মনের ওয়াসওয়াসা ও সংশয়ের কারণেই অধিক সন্তান লাভ, তাদের লালন পালন এবং নেক সন্তান রেখে যাওয়ার মর্যাদা থেকে বঞ্ছিত হতে হয়।

তবে হ্যাঁ, যদি অভিজ্ঞ দীনদার ডাক্তারের মতে বাস্তবেই আপনার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা এখন সন্তান হওয়ার উপযুক্ত না হয়, তাহলে আপনি অস্থায়ী গর্ভনিরোধক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিলম্ব করতে পারেন।

স্ত্রী-সন্তানের পেছনে মানুষের কিছু সময় ব্যয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের জীবনচরিত এমনই ছিলো।[1]  (দেখুন, সহীহ বুখারী: ১/১৩৬ হাদীস নং: ৬৮৬ দারু তাওকিন নাজাহ; উমদাতুল কারী: ২১/২১ দারু ইহইয়ায়িত তুরাস; হিলয়াতুল আওলিয়া: ১/২৪৫ দারুল ফিকর)

বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি না করে মধ্যপন্থায় স্ত্রী সন্তানের পেছনে সময় ব্যয় করাও নেক কাজ। স্ত্রী সন্তানের প্রতিপালন ও দীনের কাজ সমন্বয় করেই করতে হবে। সুতরাং এই ভয়ে সন্তান কামনা না করা ঠিক নয়। বাহ্যিকভাবে কিছু সময় নষ্ট মনে হলেও স্ত্রী-সন্তানের মাধ্যমে যে আত্মিক প্রশান্তি মিলে তা বাস্তবে ইবাদত-বন্দেগিসহ সকল কাজেই সহায়ক হয়। এ বিষয়ে আরও জানতে দেখুন: ফাতওয়া নং ২৮২-বিয়ে কি জিহাদের জন্য প্রতিবন্ধক?

২য় ও ৩য় প্রশ্নের উত্তর: যদি ঘন ঘন গর্ভধারণের দ্বারা স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার কারণে স্বামীর স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা হয়, তবে অস্থায়ীভাবে গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কোনও সমস্যা নেই। তাই যে কেউ এমন পরিস্থিতিতে দীনের কাজে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা করলে অস্থায়ী কোনও গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন। তবে একান্ত প্রয়োজন না হলে বাচ্চাকে দুধ ছাড়ানোর পরও গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা কাম্য নয়। কারণ দুধ ছাড়ানো পর্যন্ত দ্বিতীয় বাচ্চার গর্ভধারণ বিলম্বিত হলেও দুই বাচ্চার মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান হয়ে যায়।

আল্লাহ আমাদের সকলকে ইহতিদাল ও মধ্যপন্থার সঙ্গে জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন।

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

০২-১২-১৪৪৪ হি.

২১-০৬-২০২৩ ঈ.

[1]صحيح البخاري (1/ 136)

676 – حدثنا آدم، قال: حدثنا شعبة، قال: حدثنا الحكم، عن إبراهيم، عن الأسود، قال: سألت عائشة ما كان النبي صلى الله عليه وسلم يصنع في بيته؟ قالت: «كان يكون في مهنة أهله – تعني خدمة أهله – فإذا حضرت الصلاة خرج إلى الصلاة».

عمدة القاري شرح صحيح البخاري (21/ 21 دار إحياء التراث العربي – بيروت)

وفيه: أن خدمة الدار وأهلها سنة عباد الله الصالحين.

Related Articles

Back to top button