মাওলানা আব্দুল্লাহ রাশেদশাসকের রিদ্দা

মুরতাদ শাসকের অপসারণ : একটি সংশয় নিরসন

মুরতাদ শাসকের অপসারণ : একটি সংশয় নিরসন

মুরতাদ শাসকের অপসারণ : একটি সংশয় নিরসন

পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

শায়খ আবদুল্লাহ রাশেদ হাফিযাহুল্লাহ

 

সংশয় : শাসক যতক্ষণ সালাত কায়েম করবে বা প্রকাশ্যে কুফরের ঘোষণা না দেবে, ততক্ষণ তাকে অপসারণের জন্য বিদ্রোহ করা যাবে না।

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

কোনো কাফের কখনও মুসলমানদের উলূল আমর তথা নেতা বা শাসক হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا

“আল্লাহ কিছুতেই কাফেরদের জন্য মুমিনদের বিরুদ্ধে (প্রভাব বিস্তারের) কোন রাস্তা রাখবেন না।” সূরা নিসা: ১৪১

আর কাফেরদেরকে মুমিনদের নেতা বা শাসক হওয়ার সুযোগ দেয়ার অর্থ মুমিনদের বিরুদ্ধে রাস্তা করে দেয়া। এজন্য মুসলমানদের নেতা ও শাসক মুসলমানদের নিজেদের মধ্য থেকে হতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আদেশ মান্য করো এবং আদেশ মান্য করো রাসূলের ও তোমাদের (স্ব-ধর্মীয়দের) মধ্য থেকে যারা দায়িত্বশীল তাদের।” সূরা নিসা ৫৯

উলূল আমর مِنْكُمْ তথা মুসলমানদের নিজেদের মধ্য থেকে হওয়ার শর্ত করেছেন। শায়খ আব্দুল্লাহ আদদুমাইজি বলেন,

فقوله تعالى (منكم) نص على اشتراط أن يكون ولي الأمر من المسلمين ، قال د . محمود الخالدي : [ولم ترد كلمة (أولي الأمر) إلا مقرونة بأن يكونوا من المسلمين ، فدل على أن ولي الأمر يشترط أن يكون مسلما]. اهـ

“আল্লাহ তাআলার বাণী ‘তোমাদের মধ্য থেকে’ সুস্পষ্ট ভাষ্য যে, উলূল আমর মুসলমানদের মধ্য থেকে হওয়া শর্ত। ডক্টর মাহমুদ আলখালিদি বলেন, ‘উলূল আমর’ শব্দটি যত জায়গায় এসেছে, সব খানেই ‘মুসলমানদের মধ্য থেকে হওয়া’ কথাটির সাথে মিলে এসেছে। বোঝা গেল, উলূল আমর মুসলমান হওয়া শর্ত’।” -আলইমামাতুল উজমা: ১৫৭

এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। হাফেজ ইবনুল কায়্যিম রহ. (৭৫১ হি.) ইমাম ইবনুল মুনযির রহ. (৩১৮ হি.)-এর বক্তব্য বর্ণনা করেন,

أجمع كل من يحفظ عنه من أهل العلم أن الكافر لا ولاية له على مسلم بحال. اهـ

“নির্ভরযোগ্য সকল আহলে ইলম একমত যে, কোনো অবস্থায়ই কোনো মুসলমানের ওপর কোনো কাফেরের কর্তৃত্ব নেই।” -আহকামু আহলিযযিম্মাহ্ ১/৪৬৫

অতএব, কাফের কখনও মুসলমানদের শাসক হতে পারবে না। তদ্রূপ মুসলিম শাসক মুরতাদ হলে গেলে সে আর মুসলিমদের শাসক থাকবে না। তার শাসন কর্তৃত্ব বাতিল হয়ে যাবে এবং সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হয়ে যাবে। ইমাম নববী রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,

قال القاضي عياض: أجمع العلماءُ على أن الإمامةَ لا تنعقد لكافر وعلى أنه لو طرأ عليه الكفرُ انعزل.اهـ

“কাজী ইয়াজ রহ. (৫৪৪ হি.) বলেন, উলামায়ে কেরাম সবাই একমত যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং খলীফা যদি কাফের হয়ে যায় তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হবে যাবে।” -শরহুন নববী আলা সহীহ মুসলিম ১২/২২৯

এরপরও যদি সে শক্তিবলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় তাহলে জিহাদের মাধ্যমে অপসারিত করা মুসলিমদের দায়িত্ব। সে মুসলিমদের উপর চেপে বসা আগ্রাসী কাফের ছাড়া কিছু নয়। অন্য কোনো আসলী কাফের মুসলমানদের উপর চেপে বসলে যেমন অপসারণ জরুরি একেও তেমনই অপসারণ করা জরুরি। বরং সে আরও গুরুতর। কারণ, সে মুরতাদ। আর শরীয়তে মুরতাদের বিধান আসলী ও আদি কাফের থেকে শক্ত। কাফেরকে জিযয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে দেয়া যায়; কিন্তু নতুন করে মুসলমান না হলে মুরতাদকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। হত্যা করে ফেলা জরুরি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من بدل دينه فاقتلوه

“যে ব্যক্তি তার আপন দ্বীন (ইসলাম) পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা করে ফেলো।” -সহীহ বুখারী: ৬৫২৪

স্বাভাবিক এটাই যে, শাসক মুরতাদ হয়ে গেলেও ক্ষমতা ছাড়তে রাজী হয় না। তাই হাদীসে তার বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হযরত উবাদা ইবনে সামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

دعانا النبي صلى الله عليه وسلم فَبَايَعْنَاهُ. فكان فيما أخذ علينا أَنْ بَايَعَنَا على السمع والطاعة في مَنشَطِنا ومَكْرَهِنا، وعُسرنا ويُسرنا، وَأَثَرَة علينا، وَأَنْ لا نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَه. قَالَ: إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ. (متفق عليه وهذا لفظ مسلم. رقم الحديث: 1709،  تحقيق فؤاد عبد الباقي)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ডাকলেন এবং আমরা তাঁকে বাইয়াত দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের থেকে যে বিষয়ে বাইআত নিলেন তা হলো, আমরা আমাদের পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় বিষয়ে, সুখে-দুঃখে এবং আমাদের উপর যদি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া হয় তথাপিও (আমীরের কথা) শুনব ও আনুগত্য করব এবং আমরা শাসকদের সাথে শাসনকার্য নিয়ে বিবাদে জড়াব না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন তবে হ্যাঁ, যদি তোমরা কুফরে বাওয়াহ তথা সুস্পষ্ট কোন কুফর দেখতে পাও, যার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে- তাহলে ভিন্ন কথা।” -সহীহ মুসলিম: ১৭০৯

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,

يَنعَزِلُ بالكفر إجماعا فيجبُ على كل مسلمٍ القيامُ في ذلك، فمن قَوِيَ على ذلك فله الثوابُ، ومن داهن فعليه الإثمُ، ومن عَجَزَ وجبتْ عليه الهجرةُ من تلكَ الأرضِ. اهـ

“কুফরী করলে শাসক সর্বসম্মতিক্রমে অপসারিত হয়ে যাবে। তখন প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ হল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যে তাতে সক্ষম হবে, তার জন্য রয়েছে প্রতিদান। যে শিথিলতা করবে, সে গুনাহগার হবে। আর যে অক্ষম, তার জন্য আবশ্যক হল ওই ভূমি থেকে হিজরত করা।” –ফাতহুল বারী: ১৩/১৫৩

# কুফরে বাওয়াহ কী?

কুফরে বাওয়াহর অর্থ হাদীসেই স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে: عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ তথা যে কুফরের ব্যাপারে শরীয়তের অকাট্য দলীল প্রমাণ বিদ্যমান আছে। অর্থাৎ শাসক এমন কোনো কথা, কাজ বা আকীদায় নিপতিত হয়েছে, শরীয়তের অকাট্য দলীল প্রমাণ দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে যা কুফরে আকবার তথা বড় কুফর হওয়া প্রমাণিত এবং যেখানে তাকফীরেরও কোনো প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। হাফেজ ইবনে হাজার রহ. (৮৫২হি.) বলেন,

قوله عندكم من الله فيه برهان أي نص آية أو خبر صحيح لا يحتمل التأويل -فتح الباري ج: 13، ص: 8؛ ط. دار المعرفة – بيروت

“যে ব্যাপারে তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে অকাট্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে: অর্থাৎ এমন নস তথা আয়াত বা সহীহ হাদীস বিদ্যমান রয়েছে যাতে তাবীলের কোনো সুযোগ নেই।” –ফাতহুল বারী: ১৩/৮

# একটি গলদ ধারণা : ঘোষণা দিয়ে কাফের না হলে বিদ্রোহ জায়েয নয়

কেউ কেউ মনে করেন, শাসক যতক্ষণ সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে ইসলাম থেকে বের না হয়ে যাবে ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। অন্য কথায়, শাসক যতক্ষণ নিজেকে মুসলমান দাবি করবে ততক্ষণ বিদ্রোহ জায়েয হবে না। এ ধারণা শরীয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। উপর্যুক্ত হাদীস এ ধারণা খণ্ডন করছে। হাদীসে এ কথা বলা হয়নি যে, শাসক যখন নিজেকে কাফের ঘোষণা করবে তখন বিদ্রোহ করবে, অন্যথায় করবে না। বরং বলা হয়েছে, তোমরা যখন শাসকের মাঝে সুস্পষ্ট কুফর দেখতে পাবে তখন রুখে দাঁড়াবে। অর্থাৎ শাসক নিজেকে মুসলমান দাবি করলেও এবং মুসলমান মনে করলেও যখন শরীয়তের দলীলের আলোকে সে কাফের প্রমাণিত হবে তখন তার বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করবে। আল্লামা কাশ্মিরী রহ. (১৩৫২হি.) বলেন,

ودل أيضا أن أهل القبلة يجوز تكفيرهم وإن لم يخرجوا عن القبلة، وأنه قد يلزم الكفر بلا التزام وبدون أن يريد تبديل الملة، وإلا لم يحتج الرائي إلى برهان –إكفار الملحدين، ص: 22، ط. المجلس العلمي – باكستان

“হাদীসটি প্রমাণ করে, (কুফরে বাওয়াহ পাওয়া গেলে) কিবলা থেকে ফিরে না গেলেও আহলে কিবলাকে তাকফীর করা যাবে। আরো প্রমাণ করে, কুফর স্বীকার করে নেয়া এবং ধর্ম পরিবর্তনের ইচ্ছা ছাড়াও কাফের হতে পারে। অন্যথায় প্রত্যক্ষকারীর প্রমাণের প্রয়োজন পড়তো না।” –ইকফারুল মুলহিদিন: ২২

অর্থাৎ ব্যক্তি যদি স্পষ্ট বলেই দেয় যে, সে ইসলাম ছেড়ে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করছে কিংবা নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে তাহলে তো এটা সর্বজনবিদিতই যে, সে কাফের। আলেম-ওলামা থেকে জনসাধারণ এমনকি কাফেররা পর্যন্ত জেনে যাবে যে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তো আর দলীল-প্রমাণ দিয়ে তাকে কাফের প্রমাণের প্রয়োজন পড়বে না। দলীল প্রমাণ তো সেখানেই প্রয়োজন পড়ে যেখানে ব্যক্তি নিজেকে কাফের মনে করছে না বা কাফের বলে স্বীকার করছে না। মুসলিম মনে করছে বা মুসলিম দাবি করছে। সেক্ষেত্রে হাদীসে বলা হয়েছে যে, দলীল-প্রমাণ দিয়ে যদি কাফের প্রমাণ হয় তাহলে সে নিজেকে মুসলিম মনে করাতে বা দাবি করাতে কিছু যায় আসে না। সে কাফের। তাকে অপসারণ করতে হবে। শায়খ আব্দুল্লাহ আদদুমাইজি বলেন,

ومن مفهوم هذا الحديث أنه لا يشترط أن يعلن هذا الحاكم الردة عن الإسلام أو الكفر ، بل يكفي إظهاره لبعض المظاهر الموجبة للكفر قال الكشميري : “ودل – أي هذا الحديث – أيضًا على هذا أن أهل القبلة يجوز تكفيرهم وإن لم يخرجوا عن القبلة ، وأنه قد يلزم الكفر بلا التزام وبدون أن يريد تبديل الملة ، وإلا لم يحتج الرائي إلى برهان

فظاهر الحديث أن من طرأ عليه الكفر فإنه يجب عزله ، وهذا أهون ما يجب على الأمة نحوه ، إذ الواجب أن يقاتل ويباح دمه بسبب ردته امتثالاً لقوله – صلى الله عليه وسلم – في الحديث الذي رواه ابن عباس : « من بدل دينه فاقتلوه »

وقد سبق عند ذكر الشروط أن الكافر لا ولاية له على المسلم بحال وهذا السبب في عزل الإمام محل اتفاق بين العلماء ، ومجمع عليه عندهم ، قال أبو يعلي : “إن حدث منه ما يقدح في دينه ، نظرت فإن كفر بعد إيمانه فقد خرج عن الإمامة ، وهذا لا إشكال فيه لأنه قد خرج عن الملة ووجب قتله”  المعتمد في أصول الدين (ص 243) –الإمامة العظمى عند اهل السنة والجماعة، ص: 427

“এ হাদীস থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটি শর্ত নয় যে, উক্ত শাসক মুরতাদ হয়ে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার বা কাফের হয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেবে। বরং সে এমন কোনও কিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটানোই যথেষ্ট যা আবশ্যিকভাবে (তাকে) কাফের সাব্যস্ত করে। কাশ্মিরী রহ. বলেন –এরপর তিনি কাশ্মিরী রহ. এর উপর্যুক্ত বক্তব্যটি উল্লেখ করেন। তারপর বলেন, হাদীসের ভাষ্য এটিই যে, যার উপর কুফর পতিত হয়েছে তাকে অপসারণ করা আবশ্যক। এ শাসকের ব্যাপারে এটি উম্মতের সর্বনিম্ন কর্তব্য। কারণ, আবশ্যক তো হচ্ছে মুরতাদ হয়ে যাওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে কিতাল করা এবং তার রক্ত হালাল করা। যেমনটা ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আপন ধর্ম (ইসলাম) পরিত্যাগ করে তাকে হত্যা করে দাও’।

(খলীফা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়) শর্তাবলীর আলোচনায় গত হয়েছে যে, কোনো অবস্থায়ই মুসলিমের ওপর কাফেরের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এই সবব (অর্থাৎ রিদ্দাহ)-এর কারণে ইমামকে অপসারণের বিষয়টি সর্বসম্মত এবং এর ওপর ইজমা রয়েছে। আবু ইয়ালা রহ. (৪৫৮হি.) বলেন, ‘ইমামের মাঝে যদি দ্বীন বিনষ্ট করে এমন কিছু দেখা দেয় তাহলে বিবেচনা করতে হবে, সে যদি ঈমান থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যায় তাহলে সে আর ইমাম থাকবে না। এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। কারণ সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে এবং তাকে হত্যা করা আবশ্যক হয়ে গেছে’। (আলমুতামাদ ফি উসুলিদদীন: ২৪৩)” –আলইমামাতুল উজমা ইনদা আলহিলস সুন্নাতি ওয়ালজামাআহ : ৪২৭

# আরেকটি সংশয় : শাসক যতক্ষণ নামায কায়েম করবে বিদ্রোহ করা যাবে না

এ সংশয়ের ভিত্তি নিচের হাদীস:

عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « خِيَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ ». قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ نُنَابِذُهُمْ بِالسَّيْفِ فَقَالَ « لاَ مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ». صحيح مسلم: 4910

“আউফ বিন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে উত্তম শাসক হলো তারা, যাদেরকে তোমরা ভালবাসবে এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসবে, তোমরা তাদের জন্য দোয়া করবে, তারাও তোমাদের জন্য দোয়া করবে। আর তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট শাসক হল তারা, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করবে এবং তারাও তোমাদেরকে অপছন্দ করবে, যাদেরকে তোমরা লানত করবে এবং তারাও তোমাদেরকে লানত করবে। আরজ করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তরবারি দ্বারা তাদের মোকাবিলা করব না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: না, যতদিন তারা তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করে।” –সহীহ মুসলিম: ৪৯১০

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

قَالُوا أَفَلاَ نُقَاتِلُهُمْ؟ قَالَ « لاَ مَا صَلَّوْا ». صحيح مسلم: 4906

“সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করব না? রাসূল ﷺ উত্তর দেন, না, যতক্ষণ তারা নামায পড়ে।” -সহীহ মুসলিম: ৪৯০৬

এ দুই হাদীস থেকে কেউ কেউ মনে করে থাকেন, শাসক যত দিন নামায কায়েম করবে বা নামায পড়বে তত দিন বিদ্রোহ করা যাবে না।

এখানে প্রথমে বলে নিই যে, আমাদের শাসকগোষ্ঠী সাধারণত নিজেরাও নামায পড়ে না আর নামায কায়েমের তো প্রশ্নই আসে না। বরং বিভিন্ন বাহানা তুলে নামায বন্ধ করার চেষ্টা করে। গাজীপুরের ফ্যাক্টরির নামায বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা খুব দূরে নয়। যারা নামায পড়ে নিজ ইচ্ছায় নামায পড়ে, রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায বাধ্যতামূলক নয়। অতএব, এদের বেলায় সংশয়ের কোনো কারণ নেই যে, তারা নামাযী বা নামায কায়েমকারী।

দ্বিতীয়ত ‘যতক্ষণ নামায কায়েম করবে বা নামায পড়বে ততক্ষণ বিদ্রোহ জায়েয নয়’ – এর দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় যে, শাসক যতই কুফরী করুক, নামায পড়লে বা কায়েম করলে সে আর কাফের হবে না, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে ভুল। আমরা দেখেছি যে, কুরআন-সুন্নাহর দলীল দিয়ে অকাট্যভাবে কুফর প্রমাণিত এমন কোনো কুফর করলে ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়; যদিও সে নিজেকে মুসলিম মনে করে এবং মুসলিম দাবি করে। তার নামায-রোযা কোনো কাজে আসে না। যেমন কাদিয়ানী গোষ্ঠী। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যুগের মুনাফিকরাও তো মদিনার মসজিদে তাঁর পেছনে নামায আদায় করত; তাই বলে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চোখে ঈমানদার বলে স্বীকৃতি পায়নি। আল্লামা কাশ্মিরী রহ. (১৩৫২হি.) বলেন,

فمن أنكر شيئا من الضروريات … لم يكن من أهل القبلة، ولو كان مجاهدا بالطاعات، وكذلك من باشر شيئا من إمارات التكذيب كسجود الصنم والإهانة بأمر شرعي والاستهزاء عليه، فليس من أهل القبلة –إكفار الملحدين، ص: 17

“যে ব্যক্তি জরূরিয়্যাতে দ্বীনের কোনো একটাকেও অস্বীকার করে সে আহলে কিবলা (তথা ঈমানদার) বলে গণ্য হতে পারে না, যদিও ইবাদত-বন্দেগিতে খুব পাবন্দ হয়। তদ্রূপ সে ব্যক্তিও আহলে কিবলার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না যে এমন কোনো কর্মে লিপ্ত হয় যা (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) মিথ্যা প্রতিপন্ন করার আলামত। যেমন- মূর্তিকে সাজদা করা, শরীয়তের কোনো বিষয়ের অবমাননা করা কিংবা তা নিয়ে উপহাস করা।” -ইকফারুল মুলহিদিন: ১৭

আরও বলেন,

وكذلك … نكفر بكل فعل فعله شخص مسلم، أجمع المسلمون على أنه – أي ذلك الفعل – لا يصدر إلا من كافر حقيقة …  وإن كان صاحبه – أي من صدر منه – مسلما مصرحا بالإسلام مع فعله ذلك الفعل. “شرح شفاء” للخفاجي ملتقطا ملخصا. ومثله في “شرح الملا على القارئ” سواء. –إكفار الملحدين، ص: 58

“প্রত্যেক এমন কর্ম যার ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত যে, তা প্রকৃত কাফের ব্যতীত অন্য কারও থেকে প্রকাশ পেতে পারে না—কোনো মুসলমান তাতে লিপ্ত হলে এর দ্বারা আমরা তাকে তাকফীর করব, যদিও উক্ত কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হওয়ার পরও সুস্পষ্টরূপে নিজেকে মুসলমান হিসেবে ঘোষণা দেয়।” -ইকফারুল মুলহিদিন : ৫৮

আর যদি এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হয় যে, কাফের হয়ে যাবে তবে বিদ্রোহ করা যাবে না, তাহলে এটিও নিঃসন্দেহে ভুল। আমরা দেখেছি যে, হাদীসে মুরতাদকে হত্যা করে ফেলতে বলা হয়েছে। শাসক হলে কিতালের মাধ্যমে অপসারণ করতে বলা হয়েছে। এটি শরীয়তের সর্বসম্মত মাসআলা; যেমনটা কাজী ইয়াজ রহ. ও ইবনে হাজার রহ.-এর বক্তব্যে উল্লেখিত হয়েছে।

যখন এ উভয় ধারণা ভুল তখন হাদীসের আসল উদ্দেশ্য কী?

  • হাদীসে অপসারণের ভিন্ন দুটো কারণ বলা হয়েছে

আসলে হাদীস তিনটিতে কোনো বিরোধ নেই। উবাদা বিন সামেত রাযি.-এর হাদীসে বিদ্রোহ আবশ্যক হওয়ার একটি কারণ বলা হয়েছে যে, যদি শাসক মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে কিতাল করতে হবে। আর শেষের দুটো হাদীসে বিদ্রোহ আবশ্যক হওয়ার আরও দুটো কারণ বলা হয়েছে: নামায ছেড়ে দেয়া বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায কায়েম না করা। অর্থাৎ মুরতাদ হয়ে গেলে যেমন বিদ্রোহ করতে হবে, নামায ছেড়ে দিলে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায কায়েম না করলেও বিদ্রোহ করতে হবে। নামায দ্বীনের খুঁটি। যে শাসক নামায ছেড়ে দেবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায কায়েমের ব্যবস্থা করবে না সে মুসলমানদের শাসক হতে পারে না, তাকে অপসারণ করতে হবে, যদিও কিতালের মাধ্যমে হয়। কাজী ইয়াজ রহ. (৫৪৪হি.) এর বক্তব্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে,

أجمع العلماءُ على أن الإمامةَ لا تنعقد لكافر وعلى أنه لو طرأ عليه الكفرُ انعزل. … وكذا لو ترك إقامة الصلوات والدعاء إليها اهـ

“উলামায়ে কেরাম সবাই একমত যে, কোনো কাফেরকে খলীফা নিযুক্ত করলে সে খলীফা হবে না এবং খলীফা যদি কাফের হয়ে যায় তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হবে এমনিভাবে শাসক যদি নামায প্রতিষ্ঠা করা ও নামাযের দিকে আহ্বান করা ছেড়ে দেয় তাহলেও।” -শরহে নববী আলা সহীহ মুসলিম ১২/২২৯

শায়খ আব্দুল্লাহ আদদুমাইজি বলেন,

الثاني : ترك الصلاة والدعوة إليها : كما أن من الأسباب الموجبة لعزل الإمام ترك الصلاة والدعوة إليها ، إما جحودًا فهذا كفر ويدخل في السبب الآنف الذكر ، وإما تهاونًا وكسلاً فعلى رأي بعض العلماء أنه معصية وكبيرة من الكبائر ، وعلى الرأي الآخر أنه كفر … فعلى أي الحالين يجب عزل الإمام الذي يترك الصلاة عملاً بالأحاديث الواردة في ذلك … وقد سبق ذكر كلام القاضي عياض وادعاؤه إجماع العلماء على عزل الإمام “لو ترك إقامة الصلاة والدعوة إليها” –الإمامة العظمى عند أهل السنة والجماعة، ص: 428-429

“অপসারণ আবশ্যক হওয়ার দ্বিতীয় কারণ নামায ছেড়ে দেয়া এবং নামাযের প্রতি আহ্বান ছেড়ে দেয়া। যদি নামায অস্বীকার করে তাহলে তো কুফর। এটি পূর্বোল্লিখিত কারণ (তথা রিদ্দাহ)-এর অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যদি গুরুত্বহীনতা ও অলসতা করে ছেড়ে দেয় তাহলে কতক উলামার মতে তা নাফরমানি এবং কবীরা গুনাহ। আর অন্য মত অনুযায়ী তা কুফর। … (কুফর-ফিসক) যা-ই হোক উভয় অবস্থায়ই হাদীসের নির্দেশানুসারে নামায তরককারী শাসককে অপসারণ করে দিতে হবে। … কাজী ইয়াজ রহ.-এর বক্তব্য বিগত হয়েছে যে, তিনি ইজমার দাবি করেছেন: ‘যদি ইমাম নামায কায়েম এবং নামাযের প্রতি আহ্বান ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে অপসারণ করে দিতে হবে’।” –আলইমামাতুল উজমা ইনদা আহলিস সুন্নাতি ওয়ালজামাআহ: ৪২৮-৪২৯

# সারকথা

  • মুমিনের ওপর কাফেরের কোনো কর্তৃত্ব নেই। কাফের কখনো মুমিনদের শাসক হতে পারে না। তদ্রূপ, শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে শরীয়তের দৃষ্টিতে সে আর মুসলমানদের শাসক থাকে না। তাকে অপসারণ করা উম্মতের ফরজ দায়িত্ব।
  • কাফের হওয়ার জন্য সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া আবশ্যক নয়, অকাট্যভাবে প্রমাণিত কোনো কুফর করাই যথেষ্ট। এরপর ব্যক্তি নিজেকে মুসলমান মনে করলেও, মুসলমান দাবি করলেও, এমনকি নামায-রোযাসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিতে পাবন্দ হলেও এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায কায়েমের ইন্তেজাম করলেও সে কাফের। এসব কিছু তাকে কুফর থেকে বাঁচাতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার কৃত কুফর থেকে প্রকাশ্য তাওবা করে ফিরে আসবে।
  • যখন অকাট্য দলীল-প্রমাণ দিয়ে কাফের প্রমাণিত হবে, তখন তার ওপর মুরতাদের বিধান প্রয়োগ হবে এবং তাকে অপসারণ করতে হবে। ভালোয় ভালোয় অপসারণ হয়ে গেলে তো ভালোই, অন্যথায় আগ্রাসী কাফেরের মত কিতালের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করতে হবে। এটি উম্মতের ফরয দায়িত্ব। শাসক নিজেকে মুসলিম মনে করা, মুসলিম দাবি করা, নামায পড়া বা নামায কায়েম করা—এতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। সর্বাবস্থায় তাকে অপসারণ করতে হবে। ওয়াল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা আলাম।

الحمد لله الذي بنعمته تتم الصالحات وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله وأصحابه أجمعين.

আরও পড়ুনঃ ইমাম মাহদির আগমন : সংশয় ও বাস্তবতা

Related Articles

Back to top button