রমজান

কীভাবে মাহে রমযানের প্রস্তুতি নেব? || ২য় মজলিস

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ

الحمد لله رب العالمين ، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين،

أما بعد فقد قال الله تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়ামকে ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল; যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।” [সূরা বাকারা ০২: ১৮৩]

سبحانك لا علم لنا إلا ما علمتنا إنك أنت العليم الحكيم.

রমযানে রোযা রাখার মাধ্যমে তাকওয়ার অনুশীলন হয়। তবে অনুশীলন করার মানেই মুত্তাকী হয়ে যাওয়া নয়। যেমন ইফতা পড়া মানেই মুফতী হয়ে যাওয়া নয়। ডাক্তারি পড়া মানেই ডাক্তার হয়ে যাওয়া নয়। বরং যার মধ্যে একটা স্থিতিশীল স্থির যোগ্যতা তৈরি হয়, সেই মুফতী হয়, ডাক্তার হয়। অনুরূপ তাকওয়ার বিষয়টিও। আপনি এক দুদিন কষ্ট করে ফেললেই তাকওয়া অর্জিত হয়ে যাবে না। বরং তাকওয়ার সিফাতগুলোকে নিজের ভেতরে স্থির করে ফেলতে হবে।

তাকওয়া সংক্রান্ত তিনটি আয়াত তা হতে প্রাপ্ত গুণাবলি

পবিত্র কুরআনে তিনটি স্থান এমন রয়েছে যেখানে মুত্তাকীদের অনেকগুলো সিফাত একত্রে আলোচিত হয়েছে-

প্রথম স্থানটি হলো, সূরা বাকারার শুরুর কয়েকটি আয়াত-

  • الم (1) ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ (2) الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ (3) وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ (4) أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (5)

 

অর্থ: “আলিফ লাম মীম। এটি এমন কিতাব যার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত। (মুত্তাকী তারা) যারা গায়েবের প্রতি ঈমান রাখে এবং সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। এবং যারা আপনার প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের উপর এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের উপর ঈমান রাখে এবং তারা আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। তাঁরা অপন রবের পক্ষ থেকে হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁরাই সফলকাম।” [সূরা বাকারা, ০২:০১-০৫]

 

আয়াতগুলোতে প্রাপ্ত গুণগুলো হলো-

  • ايمان بالغيب (অদৃশ্যের প্রতি ঈমান)
  • إقامة الصلاة (সালাত কায়েম করা)
  • إنفاق من رزق الله تعالى (নিজের যা আছে তা থেকেই দান করা)
  • إيمان بالقرآن (কুরআনের প্রতি ঈমান)
  • إيمان بالكتب السابقة (পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান)
  • اليقين بالآخرة (আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস)

 

ঈমান ও ইয়াকীন উভয়টির অর্থই ‘বিশ্বাস’। তবে ইয়াকীন হলো ‘দৃঢ় বিশ্বাস’। এমন দৃঢ় বিশ্বাস যে, সব সময় মাথায় কাজ করে, আমাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। আখিরাতের প্রতি ইয়াকীন হচ্ছে এটাই। সুতরাং মুত্তাকীর একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো, আখিরাতকে সবসময় মাথায় রাখা।

দ্বিতীয় স্থান সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াত:

 

  • لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ (177)

 

অর্থ: পুণ্য তো কেবল এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে। বরং পুণ্য হলো, কোনো ব্যক্তি সে ঈমান রাখলো আল্লাহর প্রতি, শেষদিন ও ফেরেশতাদের প্রতি এবং আল্লাহর কিতাব ও নবীগণের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির এবং সওয়ালকারীদেরকে এবং দাস মুক্তিতে। আর সালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং যারা কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে। আর যারা সংকটে, কষ্টে ও যুদ্ধকালে ধৈর্যধারণ করে। এরাই তারা যারা জীবনকে সত্য করে দেখিয়েছে এবং এরাই মুত্তাকী। [ সূরা বাকারা, ০২:১৭৭]

 

 

এ আয়াতে প্রাপ্ত গুণগুলো হলো-

  • إيمان بالله (আল্লাহর প্রতি ঈমান)
  • إيمان باليوم الآخر (আখিরাতের প্রতি ঈমান)
  • إيمان بالملائكة (ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান)
  • إيمان بالكتب (আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান)
  • الإيمان بالنبيين (সমস্ত নবীর প্রতি ঈমান)
  • إيتاء المال على حبه أي حب الله أو حب المال

(আল্লাহর ভালোবাসায় সম্পদ দান করা কিংবা সম্পদের ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও দান করা)

  • إقامة الصلاة (সালাত কায়েম করা)
  • إيتاء الزكاة (যাকাত প্রদান করা)
  • إيفاء العهد (চুক্তি পূর্ণ করা)
  • الصبر في البأساء (অভাব-অনটনে সবর করা)
  • الصبر في الضراء (অসুস্থতায় সবর করা)
  • الصبر وقت البأس (যুদ্ধক্ষেত্রে সবর করা)

৩য় স্থানটি হলো, সূরা আলে-ইমরানের ১৩৩-১৩৫ নং আয়াত-

  • وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ (133) الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134) وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ (135)

“এবং নিজ রবের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য দ্রুত অগ্রসর হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতুল্য। তা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তারা ঐসব লোক যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে এবং যারা নিজেদের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আর আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন। আর তারা যখন অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলে, (তখনি) আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তারা তাদের গুনাহের কারণে মাফ চায়। আর আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে গুনাহ ক্ষমা করতে পাারে? আর তারা জেনে শুনে তাদের (মন্দ) কর্মে অবিচল থাকে না।” [সূরা আলে-ইমরান ০৩: ১৩৩-১৩৫]

এ আয়াতগুলোতে প্রাপ্ত গুণাবলি-

  • إنفاق في السراء- স্বচ্ছল অবস্থায় দান করা
  • إنفاق في الضراء – অস্বচ্ছল অবস্থায় দান করা
  • كظم الغيظ- গোস্বা দমন করা
  • العفو عن الناس- মানুষকে ক্ষমা করা
  • ذكر الله والاستغفار بعد الذنب من غير تأخير

গুনাহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ করা এবং তাওবা-ইস্তেগফার করে ফিরে আসা

  • عدم الإصرار على الذنب.গুনাহের উপর স্থির না থাকা

এখানে লক্ষ করে দেখুন, মুত্তাকীদের অনেকগুলো সিফাত উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এক জায়গায়ও এ কথা বলা হয়নি যে, সিয়াম পালন করা মুত্তাকীদের সিফাত। কারণ সিয়াম তো হলো, তাকওয়া অর্জনের বিশেষ কোর্স। তাই সিয়াম পালনকে আলাদাভাবে সিফাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।

সিয়াম পালন মানে মুত্তাকী হয়ে যাওয়া নয়। বরং সিয়াম পালনের মাধ্যমে মুত্তাকী হওয়ার কোর্স করা হয়ে থাকে। মুত্তাকী হতে হলে কী কী গুণ লাগবে এগুলো তো আমরা উপরের তিনটি আয়াতে বেশ সমৃদ্ধভাবে পেয়েই গেছি। এর অর্থ হলো, সিয়াম পালন কালে আমরা তাকওয়ার কোর্সে ওই সিফাতগুলো অর্জন হচ্ছে কিনা সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।

তাহলে প্রথম কথা হলো, যখন আমাদের রমযান শুরু হয়ে যাবে তখন সিয়াম পালনকালে আমাদের মধ্যে উপর্যুক্ত গুণগুলো স্থিরভাবে তৈরি হচ্ছে কিনা এই ফিকির রাখতে হবে।

আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমরা দুর্বল। সবসময়ই দুর্বল। তাই রমযান আসার পর থেকে যদি ফিকির শুরু করি তাহলে শুরু করতে করতে রমযান হয়তো আমাদের থেকে বিদায় নিবে। আল্লাহ হেফাযত করুন। রমযানকে আপন করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন।

রমযানের আগেই রমযানের প্রস্তুতি নিবো কেন?

বান্দার উপর তার হায়াতের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর তরফ থেকে নেয়ামত। যখন বান্দা এ নেয়ামতের শোকর আদায় করে, আল্লাহ নেয়ামত আরও বাড়িয়ে দেন, বান্দাকে আরও তাওফীক দান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَئِن شكرتم لأزيدنكم. –إبراهيم: 7

“যদি তোমরা শোকর আদায় কর, আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বাড়িয়ে দিব।” -সূরা ইবরাহীম ১৪:০৭

মনে রাখবেন, আমরা সবাই ভুলে গেলেও আল্লাহ ভুলেন না। আপনি আল্লাহর দেওয়া ছোট থেকে ছোট নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করবেন, আর সেটা আল্লাহর নজর থেকে ছুটে যাবে বা আল্লাহ সে শুকরিয়ার মূল্যায়ন করবেন না; তা কখনোই হতে পারে না। আল্লাহ এর থেকে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَكَانَ سَعْيُكُمْ مَشْكُورًا. –الدهر: 22

“তোমাদের চেষ্টাগুলো সবসময় মূল্যায়িত হয়” -সূরা দাহর ৭৬: ২২

 

(كَانَ) এই শব্দটিই বলে দিচ্ছে যে, এটা আল্লাহর চিরাচরিত রীতি। সবসময় এমনই হয়ে আসছে।

গভীর রাতে অনেক সময় নিজের অজান্তেই বান্দার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মূলত রাব্বুল আলামীন গাফেল বান্দাকেও এভাবে মাঝে মাঝে জাগ্রত করে দেন। কিন্তু যদি বান্দা ওই সুযোগটি কাজে লাগায় তাহলে সে তার হায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এ সময়টির মূল্যায়ন করার কারণে দেখা যাবে, আল্লাহ তাকে পরবর্তীতে আরও উঠার তাওফীক দিবেন। এভাবে এক সময় আরও আগে উঠার সে তাওফীকপ্রাপ্ত হবে। পক্ষান্তরে বান্দা যখন সেটাকে কদর না করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে ধীরে ধীরে তার গাফলত আরও চেপে বসে। এক সময় দেখা যায় তার ফজরের জামাত ছুটে যায়। আর এই অবমূল্যায়ন যদি চলতেই থাকে তাহলে এক সময় ফজরও কাযা হয়ে যায়।

এভাবে প্রতিটি মুহূর্তের শোকর (মূল্যায়ন) বান্দাকে আগে বাড়িয়ে দেয়। আর প্রতিটি মুহূর্তের না-শোকর (অবমূল্যায়ন) বান্দাকে পিছিয়ে দেয়। এটাই চরম বাস্তবতা।

তাই আল্লাহ যখন দেখবেন বান্দা রমযানের আগেই সময়গুলোর কদর করছে, বেশি বেশি ইবাদতের চেষ্টা করছে, মুত্তাকীদের গুণগুলো অর্জনের চেষ্টা করছে; তখন রমযানে আল্লাহ তাকে আরও নেয়ামত বাড়িয়ে দিবেন, নেক আমলের আরও বেশি তাওফীক দান করবেন, তাকওয়ার গুণগুলো তাকে দিয়েই দিবেন ইনশাআল্লাহ।

তাছাড়া পুরোটা বছর আমরা কত কত গুনাহের মধ্যে নিমজ্জিত থাকি। জানা-অজানা নানা গুনাহে লিপ্ত হই। সুতরাং পুরো ১১ মাসের মন্দ আমল ও বাজে অভ্যাসগুলো যদি কোনো বাধা ছাড়াই রমযানে প্রবেশ করে তাহলে রমযানে এসে সেগুলোতে ব্রেক দিতে দিতে রমযানের বেশিরভাগ সময় চলে যাবে; রমযান থেকে বেশি উপকৃত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই আমার মন্দ আমল এবং বাজে অভ্যাসগুলো যেন রমযানের গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় না ফেলতে পারে, এর জন্য আগে থেকে ব্রেক দিতে হবে।

রমযানের পূর্বেই আমরা যেসব প্রস্তুতি নেব, তন্মধ্যে প্রথম ও প্রধান প্রস্তুতি হলো-

১। তাওবার মাধ্যমে রমযানের পূর্বেই আল্লাহর দিকে ফিরে আসা

বছরে ইবাদতের সবচেয়ে বড় আয়োজনের নাম রমযান। যেকোনো মাহফিলে বা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে মূল আয়োজন যেদিন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, কেউই সেদিন থেকে প্রস্তুতি শুরু করে না। পৃথিবীর কোনো আয়োজনে এমন দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবে না। আয়োজন যত বড় ধরনের হয়, তার প্রস্তুতি তত আগে থেকে শুরু হয়। কোনো আয়োজনের প্রস্তুতি যদি মূল আয়োজনের দিন থেকে শুরু হয়, বুঝতে হবে সে আয়োজন হয় খুবই ছোট অথবা আয়োজকদের কাছে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান নয়।

আয়োজন কতটা গোছানো ও সুন্দর হবে তা নির্ধারণ করা হবে, এর জন্য প্রস্তুতি কী ধরনের নেওয়া হয়েছে তারই আলোকে।

আমরা তো ঊর্ধ্বজগতের বিষয়গুলো দেখি না। যদি দেখার সুযোগ থাকতো তাহলে হয়তো রমযানকে কেন্দ্র করে ফেরেশতাদের অনেক ছুটাছুটি আমরা দেখতে পেতাম। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করার জন্য তারা ছুটাছুটি করছে। জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেয়ার জন্য এবং শয়তানদের শিকল পড়ানোর জন্য ছুটাছুটিতে তারা ব্যস্ত।

রমযানে আল্লাহর নেক বান্দাদের কত অগণিত নেক আমল ঊর্ধ্বজগতে উঠবে। সেগুলো নেয়ার জন্য ফেরেশতাদের মাঝে প্রস্তুতিপর্ব চলমান থাকে। কে কোন আমল নিয়ে উপরে উঠবে? কার দায়িত্বে কী থাকবে সে সব দায়িত্ব বিলি-বণ্টনের বিষয় নিয়ে তারা ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে… । রোযার মতো বিশেষ আমল, যার প্রতিদান স্বয়ং রাব্বুল আলামীন দিবেন, এই সুমহান ও মহাগুরুত্বপূর্ণ আমলকে বহন করে নেয়ার যিম্মাদারী নিয়েই তাদের ছুটাছুটি ও কর্মতৎপরতার নানা আয়োজন। এমন আরও কত কিছুই না আমরা দেখতে পারতাম, যদি দেখা সম্ভব হতো!

সিয়াম: ঊর্ধ্বজগতের সাথে সম্পর্ক গড়ার অন্যতম উপায়

এগুলো ভাবার বিষয়। বান্দার সিয়ামের আমলটি দেখার জন্য আল্লাহ তাআলা অপেক্ষায় আছেন। এই আমল নিয়ে বান্দা যখন আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন এর বদলা আল্লাহ তাআলা সরাসরি বান্দাকে দিবেন। তখন কেমন আনন্দ হবে সেটা আল্লাহই জানেন। অন্যান্য ইবাদতের বদলা সরাসরি আল্লাহ তাআলা বান্দাকে দিবেন, এমন বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায় না। এ সংক্রান্ত হাদীসটিতে কতটা মহব্বতের প্রকাশ ঘটেছে একটু লক্ষ করুন-

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ جَعَلَ حَسَنَةَ ابْنِ آدَمَ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ إِلَّا الصَّوْمَ، وَالصَّوْمُ لِي، وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، وَلِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ إِفْطَارِهِ، وَفَرْحَةٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ “. (مسند أحمد: 4256)

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তাআলা বনি আদমের প্রতিটি নেক আমলের বদলা দশগুণ থেকে নিয়ে সাতশত গুণ পর্যন্ত দান করেন। তবে রোযার বিষয়টি ভিন্ন। (কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন,) রোযা আমার। তাই এর প্রতিদান আমি (নিজে) দিব। রোযাদার ব্যক্তির দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি তার ইফতারের সময়। অপরটি কিয়ামতের দিন (রবের সাক্ষাতের সময়)। আর রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়।” [মুসনাদে আহমদ: ৪২৫৬]

হাদীসটি ব্যাখ্যা করা যাক-

আরবীতে (الكتاب لي) কথাটির অর্থ হলো, কিতাবটি আমার। এর সাথে মিলালে (الصومُ لي) কথাটির অর্থ দাঁড়ায়, রোযা আমার।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে ঈমান হলো, অন্তরের ইবাদত। সালাত ও সিয়াম হলো, নিরঙ্কুশ শারীরিক ইবাদত। আর যাকাত নিরঙ্কুশ আর্থিক ইবাদত। আর হজ শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতের সমষ্টি।

যদিও ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো, সালাত; কিন্তু সালাত ও সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হলো, সালাতে বান্দা যেসব কাজ করে এগুলো শুধুই বান্দার শানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সালাতে বান্দা রবের সামনে মাথা ঝুঁকায়, মস্তক মাটিতে লুটায়।

পক্ষান্তরে সিয়াম এমন একটি ইবাদত যা আল্লাহর শানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা পানাহার থেকে পবিত্র। স্ত্রী, সন্তানাদি থেকে পবিত্র। সুতরাং বান্দা যখন সিয়ামের আমল নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে তখন কেমন যেন রব বলবেন, আমার বান্দা আমারই নির্দেশে আমার মতো কাজ করে দেখিয়েছে। সে পানাহার ও শাহওয়াত থেকে বিরত থেকেছে। সুতরাং সে যা করেছে সেটি আমার। অন্যান্য ইবাদত তার নিজের। সুতরাং সে যেহেতু আমার কাজটি করে দেখিয়েছে, তাই তাকে আমি নিজ হাতে প্রতিদান দেব। মূলত সিয়ামের মাধ্যমে বান্দার ঊর্ধ্বজগতের সাথে সম্পর্ক খুব দ্রুত ঘটে।

এ আমলটি আল্লাহর কাছে এতটাই প্রিয় যে, তা নিয়ে যখন আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হবে তখন দশ গুণ আর সাতশত গুণ, এসবের হিসাব থাকবে না। তখন তিনি বান্দাকে কী দিবেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। শুধু যা দরকার তা হলো, বান্দা যেন ইহতিসাবের সাথে রোযাগুলো রাখে। আমরা আল্লাহর নির্দেশে পানাহার ইত্যাদি বন্ধ করে দিয়েছি, এই অনুভূতি ধারন করব এবং এর বিনিময় আমরা সরাসরি রবের কাছ থেকে পাব, এই বোধ নিয়ে রোজাগুলো রাখতে থাকব। সবাই করছে, তাই আমিও করছি… যদি এমন মানসিকতা ও অভ্যাসের সঙ্গে সিয়ামগুলো রাখি, তবে তাতে সিয়ামের প্রকৃত মাহাত্ম্য অর্জিত হবে না। সিয়াম হচ্ছে আল্লাহর সাথে এবং ঊর্ধ্বজগতের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার বিরাট মাধ্যম। সুতরাং এখানে এসে যদি আল্লাহ চেয়ে থাকেন বান্দার দিকে, আর বান্দা চেয়ে থাকে আরেকজনের দিকে; তাহলে সেই সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হবে? তাই অন্যের দিকে না তাকিয়ে সিয়াম পালন করতে হবে শুধুই আল্লাহর হুকুমের দিকে তাকিয়ে। আর এটাই হলো, ইহতিসাব।

সিয়ামের মধ্যে মহব্বতের পর্যায়টা বুঝার জন্য হাদীসের শেষাংশই যথেষ্ট। যেখানে বলা হয়েছে, “রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়”।

মানুষ যখন পানাহার থেকে বিরত থাকে তখন দুটি বিষয় ঘটে। মুখের ভেতরে নাড়াচাড়া বন্ধ থাকে। ফলে মুখের মধ্যে একটা গুমোট গন্ধ তৈরি হয়। আবার পেট খালি থাকার কারণে ভেতর থেকেও একটা গুমোট গন্ধ বের হয়। এই সবটাই হয় আল্লাহর নির্দেশে পানাহার পরিত্যাগের কারণে। তাই আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে গুমোট গন্ধ তৈরি হলেও তা আল্লাহর কাছে অনেক দামি হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে তা মিশকের ন্যায় সুগন্ধিময় হয়, যদিও আমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারি না। একইভাবে মানুষের দেহ থেকে প্রবাহিত রক্ত যখন বের হয়ে আসে আমরা বলি যে, এই রক্ত নাপাক। এবং এর কারণে ওযু ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু এই নাপাক রক্তই যখন আল্লাহর দ্বীনের জন্য কারো দেহ থেকে ঝরে, তখন যেহেতু আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে ঝরেছে তাই কিয়ামতের দিন এই (নাপাক) রক্ত থেকেই মিশকের সুগন্ধি বের হতে থাকবে। মূলত আল্লাহর হুকুমকে কেন্দ্র করেই সবকিছুর ফলাফল প্রকাশ পেতে থাকে।

যাই হোক কথা লম্বা হয়ে গেল…

এমন মহান রব যিনি আমাদের মতো তুচ্ছ বান্দাদের রোযার প্রতিদান স্বয়ং নিজে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন, যার কাছে রোযামুখে আমাদের শুকনো মুখের গন্ধ মিশকের চেয়ে বেশি প্রিয়, এমন রবের দিকে আমাদের অবশ্যই ফিরে আসা উচিত। রমযানে নয়, রমযানের আগেই ফিরে আসা উচিত।

রমযান শুরু হলে ফিরে আসবো এমন পরিকল্পনা নয়, বরং এখনই ফিরে আসার সংকল্প করি। আমাদের এখনকার চেষ্টার উপর সামনের ফয়সালা হবে।

বান্দার দিকে আল্লাহর ক্ষমা দ্বিগুণ গতিতে ছুটে

নিম্নোক্ত আয়াতটির অর্থ একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ি সবাই…

  • وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ (133) الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134) وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ (135) –آل عمران: 133-135

“এবং নিজ রবের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য দ্রুত অগ্রসর হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতুল্য। তা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তারা ঐসব লোক যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে এবং যারা নিজেদের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আর আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন। আর তারা যখন অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলে, (তখনি) আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তারা তাদের গুনাহের কারণে মাফ চায়। আর আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে গুনাহ ক্ষমা করতে পাারে? আর তারা জেনে শুনে তাদের (মন্দ) কর্মে অবিচল থাকে না।” [সূরা আলে-ইমরান ০৩: ১৩৩-১৩৫]

এখানে প্রথম আয়াতটি লক্ষ করুন। আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাদেরকে মাগফিরাতের দিকে ছুটে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। লক্ষণীয় হলো, (سَارِعُوا) শব্দটি বাবে মুফাআলা থেকে ব্যবহৃত হয়েছে। তাফসীরে মাতুরিদিতে এসেছে-

(سَارِعُوا) শব্দটি যেহেতু বাবে মুফাআলা থেকে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই এখানে ছুটে আসা উভয়পক্ষ থেকেই হবে। বাবে মুফাআলার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, দুই পক্ষ থেকেই কাজটি পাওয়া যাওয়া।

সুতরাং আয়াতে যেহেতু বলা হয়েছে (سَارِعُوا) অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর ক্ষমার দিকে ছুটে আসো, বুঝা যাচ্ছে, তোমরা ক্ষমার দিকে ছুটলে, ক্ষমাও তোমাদের দিকে ছুটে আসবে।

প্রিয় ভাইগণ! আপনারাই বলুন, এখানে উভয় তরফের প্রতিযোগিতায় কোন্ পক্ষ এগিয়ে থাকবে? বান্দা, নাকি আল্লাহর ক্ষমা?

বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে-

وَإِنِ اقْتَرَبَ إِلَيَّ شِبْرًا، تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنِ اقْتَرَبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا، اقْتَرَبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً. –صحيح البخاري: 7536 صحيح مسلم: 2675

“বান্দা যদি আমার দিকে এক বিঘত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। আর যদি সে আমার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক বা’ (باع) পরিমাণ (সোজা দাঁড়িয়ে দুহাত দুদিকে প্রসারিত করলে যেটুকু হয়) অগ্রসর হই। যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে আসি।” -সহীহ বুখারী: ৭৫৩৬; সহীহ মুসলিম: ২৬৭৫

ক্ষমার গতির এক অনন্য উদাহরণ

বনি ইসরাঈলের এক ব্যক্তি ১০০ জনকে হত্যা করার পর তওবার উদ্দেশ্যে যখন ভালো লোকদের বস্তির দিকে রওয়ানা হলো, পথিমধ্যে তার মৃত্যু ঘটলো। তখন রহমতের ফেরেশতা এবং আযাবের ফেরেশতা উভয়পক্ষই তার রূহ নিয়ে যাওয়ার জন্য আসলো। পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা অপর এক ফেরেশতাকে ফায়সালা করে দেয়ার জন্য পাঠালেন। সেই ফেরেশতা এসে ফায়সালা দিল, কোনদিকে পথ বেশি, আর কোনদিকে কম; সে হিসেবে ফায়সালা হবে। যদি ভালো লোকদের বস্তির দিকে সে বেশি পথ গিয়ে থাকে তাহলে রহমতের ফেরেশতারা রূহ নিবে। আর যদি কম গিয়ে থাকে তাহলে আযাবের ফেরেশতারা নিবে।

মূলত সেই ব্যক্তি কম পথ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ভালো লোকদের বস্তিকে কাছে এনে দিলেন আর পিছনে রেখে আসা মন্দ লোকদের বস্তিকে দূর করে দিলেন। মুসনাদে আহমদে এসেছে-

فَقَرَّبَ اللَّهُ مِنْهُ الْقَرْيَةَ الصَّالِحَةَ، وَبَاعَدَ عَنْهُ الْقَرْيَةَ الْخَبِيثَةَ، فَأَلْحَقُوهُ بِأَهْلِهَا

(সুতরাং আল্লাহ নেককারদের বস্তি তার কাছাকাছি করে দিলেন, আর বদকারদের বস্তিকে তার থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। ফলে রহমতের ফেরেশতারা তাকে নেককারদের সাথে যুক্ত করে নিল।)

গভীরভাবে লক্ষ করলে এ হাদীসেও মূলত আমরা আল্লাহ তাআলার একই নীতি দেখতে পাই। অর্থাৎ সে যখন আল্লাহর ক্ষমার দিকে সামান্য পথও অতিক্রম করলো, আল্লাহর ক্ষমা তার দিকে দ্বিগুণ গতিতে ছুটে আসলো। তাই নেক লোকদের বস্তি তার কাছাকাছি এনে দেয়া হলো।

আল্লাহর কাছে বান্দার সবচেয়ে প্রিয় আমল—গুনাহের পর ফিরে আসা

উপরের আয়াতে উল্লেখ হয়েছে,

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ (135) –آل عمران: 135

“এবং তারা যখন অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলে, (তখনি) আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তারা তাদের গুনাহের কারণে মাফ চায়। আর আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে গুনাহ ক্ষমা করতে পাারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের (মন্দ) কর্মে অবিচল থাকে না।” -সূরা আলে-ইমরান ০৩: ১৩৫

মানুষ দুর্বল। সে ভুল করবেই। কিন্তু ভুল করে গো ধরে বসে থাকাটা দূষণীয়।

আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, মুত্তাকী ব্যক্তিও গুনাহ করে ফেলতে পারে। এটা তাকওয়া পরিপন্থি নয়; যখন বান্দা সাথে সাথে লজ্জিত হয়ে ফিরে আসে।

হ্যাঁ, তাকওয়ার পরিপন্থি হলো, গুনাহের পর ফিরে না আসা। ক্ষমা না চাওয়া।

এক হাদীসে এসেছে-

عَنِ الْحَسَنِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَوْ عَمِلْتُمْ بِالْخَطَايَا حَتَّى تَبْلُغَ السَّمَاءَ، ثُمَّ تُبْتُمْ، تَابَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ»- الزهد والرقائق لابن المبارك: 1049

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যদি তোমরা এতটা গুনাহ কর যে, আসমান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে; অতঃপর তাওবা কর, আল্লাহ তোমাদের তাওবা কবুল করবেন।” -আয-যুহদ, ইবনুল মুবারক: ১০৪৯

 

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

يا ابن آدم إنك ما دعوتني ورجوتني غفرت لك على ما كان فيك ولا أبالي، يا ابن آدم لو بلغت ذنوبك عنان السماء ثم استغفرتني غفرت لك، ولا أبالي، يا ابن آدم إنك لو أتيتني بقراب الأرض خطايا ثم لقيتني لا تشرك بي شيئا لأتيتك بقرابها مغفرة. -رواه الترمذي(3540) وقال: هذا حديث حسن.

“হে আদম সন্তান! তুমি আমার কাছে যত দোয়া করবে এবং আশা করবে, তোমাকে আমি ক্ষমা করে দেব; তোমার যত পাপই থাকুক না কেন। কোনো পরোয়া করব না। হে আদম সন্তান! তোমার পাপরাশি যদি আকাশের মেঘমালায়ও উপনীত হয়, এরপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, তবুও আমি সব ক্ষমা করে দিব, এতে আমার কোনো পরওয়া নেই। হে আদম সন্তান! তুমি যদি জমিন পরিমাণ পাপরাশি নিয়েও আমার কাছে এসে উপস্থিত হও, আর আমার সঙ্গে যদি কিছুর শরীক না করে থাক, তবে আমি সেই পরিমাণ ক্ষমা ও মাগফিরাত তোমাকে দান করব।” –জামে তিরমিযী: ৩৫৪০

জামে তিরমিযীতে এসেছে-

عَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ، فَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ. –جامع الترمذي: 2499

“আদম সন্তান প্রত্যেকে গুনাহ করে, আর সর্বোত্তম তারাই, যারা গুনাহের পর ফিরে আসে।” -জামে তিরমিযী: ২৪৯৯

সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে এসেছে-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللهُ بِكُمْ، وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ، فَيَسْتَغْفِرُونَ اللهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ». –صحيح مسلم: 2749

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! যদি তোমরা গুনাহ না কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে হটিয়ে এমন জাতিকে নিয়ে আসবেন, যারা গুনাহ করবে। অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে এবং তিনি ক্ষমা করে দিবেন।” -সহীহ মুসলিম: ২৭৪৯

বান্দা যে বান্দা, এটা তার গুনাহের পর অনুতপ্ত হওয়ার দ্বারা খুব বেশি ফুটে উঠে। তখন তার অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, আল্লাহর কাছে অনেক অনেক পছন্দের হয়।

দেখবেন, দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের একটি হলো, কোন বান্দা আল্লাহর কাছে হাত তুলে কান্নারত হয়ে ক্ষমা চাচ্ছে। এটা আপনি দেখলে আপনার কাছেই ভালো লাগবে। তাহলে যিনি তার খালেক, সেই খালেকের কাছে কেমন লাগবে?

যদি বান্দার গুনাহ না হতো, তাহলে সে ওজবের কারণে ধ্বংস হয়ে যেত।

মাগফিরাত ও রহমত যেন সহোদরা বোন

মনে রাখবেন, আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত একসাথে চলে। যেখানে ক্ষমা, সেখানেই রহমত চলে আসবে। আর যেখানে বান্দা রহমত প্রাপ্ত হবে, সেখানেই ক্ষমা চলে আসবে। কুরআনে (غفور رحيم) একত্রে অগণিত জায়গায় এসেছে। এর বাইরে নিচের কয়েকটি আয়াত লক্ষ করুন…

نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ. –الحجر: 49

“আমার বান্দাদের জানিয়ে দাও, নিশ্চয় আমি ক্ষমাশীল, দয়ালু।” -সূরা হিজর ১৫: ৪৯

وَرَبُّكَ الْغَفُورُ ذُو الرَّحْمَةِ. –الكهف: 58

“তোমার ক্ষমাশীল রব রহমওয়ালা।” -সূরা কাহাফ ১৮: ৫৮

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ – الزمر:53

“বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর সীমালঙ্ঘন করেছে; আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” – সূরা যুমার ৩৯: ৫৩

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- الأعراف:23

“তাঁরা বলল, হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।” – সূরা আরাফ ০৭: ২৩

তাই রমযানে ও রমযানের আগে দুটার যেকোনো একটা মঞ্জুর করাতে পারলে অপরটা অটোমেটিক অর্জিত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

আপনি তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসলে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলে, ক্ষমার অধিকারী হতে পারেন।

আবার বেশি বেশি ইবাদতে মাকসূদার দিকে ধাবিত হয়ে, মসজিদ মুখী হয়ে আপনি রহমত প্রাপ্ত হতে পারেন।

ইবাদত আমাদের জীবনের মূল মাকসূদ। ইবাদতের জন্যই আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই ইবাদত করার জন্য আমরা দিন-রাত নানা ধরনের আসবাবে ডুবে থাকি। তবে লক্ষ করুন, যখন আমরা মসজিদে গমন করি তখন সরাসরি মাকসূদে প্রবেশ করি। যেখানে শুধু রহমতই রহমত। তাই আমরা দোয়া পড়ি-

اللّهُمَ افْتَحْ لِيْ اَبْوَابَ رَحْمَتِكَ  (হে আল্লাহ! আমার জন্য রহমতের সব দরজা খুলে দিন।)

আসবাবকেও মাকসূদ বানিয়ে দেওয়ার সুন্দর উপায় আছে। সংক্ষেপে বললে দুইভাবে আসবাবগুলোকে মাকসূদ বানিয়ে দেওয়া যায়। এক. আসবাবগুলোকে সুন্নত তরিকায় আদায় করা। দুই. আসবাবগুলো পালনকালে বেশি বেশি যিকরুল্লাহয় লিপ্ত থাকা। মূলত যিকরুল্লাহ হলো সবচেয়ে বড় মাকসাদ। তাই যিকরুল্লাহকে কুরআনে সবচেয়ে বড় বলা হয়েছে। (وَلَذِكْرُ اللهِ اَكْبَرُ) তাই যিকরুল্লাহ দিয়ে ইবাদতে মাকসূদাহগুলো আরও উন্নত রূপ ধারণ করে। আর যিকরুল্লাহ দিয়ে আমাদের জীবনের আসবাবগুলোকে মাকসূদ বানিয়ে দেওয়া যায়। যখন আমরা আসবাবের মধ্যে ডুবে থাকি, তখন যিকরুল্লাহ জারি থাকলে সেই সময়গুলোও আমার জীবনের মাকসূদে পরিণত হয়।

এ কারণেই কুরআন হাদীসে অধিক যিকির তথা দোয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কারণ, মানযিলে মাকসাদে পৌঁছে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে সহজ উপায় আর নেই। আপনি হাঁটছেন কোনো একটি মাকসাদে। এই হাঁটা যা কয়েকটি মাধ্যম পেরিয়ে হয়তো মূল মাকসাদের সাথে গিয়ে মিলিত হবে, কিন্তু আপনি যিকরুল্লাহ’র মাধ্যমে আসবাবগুলো পালনের সময়গুলোকেও মাকসূদ বানিয়ে দিতে পারছেন।

আর বান্দা যত বেশি নিজেকে মূল মাকসূদের সাথে জুড়ে রাখতে পারবে, ততবেশি সে রহমত প্রাপ্ত হবে।

ক্ষমা ও রহমত বান্দার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি

আমরা নামাযের শেষে যে দোয়ায়ে মাসূরাহ পড়ি সেখানে শেষ কথাগুলো দেখুন..

فأغفر لي مغفرة من عندك وارحمني ، إنك أنت الغفور الرحيم

… “সুতরাং আপনি আমাকে আপনার পক্ষ থেকে মাগফিরাত দান করুন এবং দয়া করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।”

জিহাদের আমলে রহমত ও মাগফিরাত রয়েছে।

وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا (95) دَرَجَاتٍ مِنْهُ وَمَغْفِرَةً وَرَحْمَةً وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا (96) –النساء: 95، 96

“যারা ঘরে বসে থাকে আল্লাহ তাদের উপর মুজাহিদদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে মহাপুরস্কার দান করেছেন। অর্থাৎ বিশেষভাবে নিজের পক্ষ হতে উচ্চ মর্যাদা, মাগফিরাত ও রহমত। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”  -সূরা নিসা ০৪: ৯৫-৯৬

 

অপর এক আয়াতে-

وَلَئِنْ قُتِلْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ مُتُّمْ لَمَغْفِرَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَحْمَةٌ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ (157) –آل عمران: 157

“তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মারা যাও, তবুও আল্লাহর পক্ষ হতে (প্রাপ্তব্য) মাগফিরাত ও রহমত সেই সব বস্তু হতে ঢের শ্রেয়, যা তারা সঞ্চয় করেছ।” -সূরা আলে-ইমরান ০৩: ১৫৭

সুতরাং যদি কেউ জিহাদের জন্য প্রচেষ্টা করে, দৌড়ঝাপ করে, সে অনেক অনেক রহমত এবং মাগফিরাতের উপযুক্ত হয়ে যাবে।

সহীহ মুসলিমে এসেছে-

عن أبي هريرة رضي الله عنه يقول: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم “إذا كان رمضان فتحت أبواب الرحمة، وغلقت أبواب جهنم، وسلسلت الشياطين”.- صحيح مسلم

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন রমযান শুরু হয় রহমতের সকল দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের সকল দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের জিঞ্জির পড়িয়ে দেয়া হয়।” [সহীহ মুসলিম: ১০৭৯]

আমরা যখন মসজিদে প্রবেশ করি সেক্ষেত্রেও এমন একটি দোয়া আমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যেখানে রহমতের সব দরজা খুলে দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। (اللهُمَّ افْتَحْ لِيْ اَبْوَابَ رَحْمَتِكَ)

তবে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রমযানের বাইরে স্থানের সাথে খাস থাকে। পক্ষান্তরে রমযানে কোনো স্থানের সাথে নির্দিষ্ট না থেকে সময়ের সাথে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং রমযানের পুরো ত্রিশ দিনে বান্দা যেকোনো স্থানে অবস্থান করে রহমতের অবারিত বর্ষণে সিক্ত হতে পারে।

এ কারণেই রহমতের এমন অবারিত মৌসুমেও যখন কেউ আল্লাহর ক্ষমা লাভ করতে না পারে, তার জন্য হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বদদোয়া করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে ‘আমীন’ বলেছেন।

আল্লাহ তাআলা রমযান আসার পূর্বেই আমাদেরকে পূর্ণ ক্ষমা করে দিন এবং রমযানে খুলে যাওয়া রহমতের সকল দরজা থেকে প্রতিটি মুহূর্তে রহমত অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন।

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.

***

আরো পড়ুন-

কীভাবে মাহে রমযানের প্রস্তুতি নেব? || ১ম মজলিস

কীভাবে মাহে রমযানের প্রস্তুতি নেব? || আপনার নামায সুন্দর থেকে সুন্দরতর করুন || ৩য় মজলিস

Related Articles

Back to top button