রমজান

কীভাবে মাহে রমযানের প্রস্তুতি নেব? || আপনার নামায সুন্দর থেকে সুন্দরতর করুন || ৩য় মজলিস

কীভাবে মাহে রমযানের প্রস্তুতি নেব?

আপনার নামায সুন্দর থেকে সুন্দরতর করুন

৩য় মজলিস

মাওলানা আবু মিকদাদ হাফিযাহুল্লাহ

 

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ

الحمد لله رب العالمين ، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين،

أما بعد فقد قال الله تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়ামকে ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল; যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।” [সূরা বাকারা ০২: ১৮৩]

سبحانك لا علم لنا إلا ما علمتنا إنك أنت العليم الحكيم.

আমরা যেসব বিষয়ের উন্নতি চাই, যদি তার অনুশীলন রমযানের পূর্বেই শুরু করা যায়, তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা আমাদের এ প্রচেষ্টার উত্তম জাযা দিবেন এবং আমাদেরকে রমযান সঠিকভাবে পালন করার তাওফীক দান করবেন ইনশাআল্লাহ।

 

রমযানের পূর্বেই আমরা যেসব প্রস্তুতি নেব, তন্মধ্যে দ্বিতীয় প্রস্তুতি হলো-

০২. এখন থেকেই নামাযকে সুন্দর ও উন্নত করা

নামাযের বিষয়ে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঐতিহাসিক উক্তি

হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর গভর্নরদের কাছে যে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন তার বর্ণনা মুয়াত্তা মালেকে এসেছে-

إِنَّ أَهَمَّ أَمْرِكُمْ عِنْدِي الصَّلاَةُ، مَنْ حَفِظَهَا وَحَافَظَ عَلَيْهَا، حَفِظَ دِينَهُ، وَمَنْ ضَيَّعَهَا، فَهُوَ لِمَا سِوَاهَا أَضْيَعُ. -1/6 ط. دار إحياء التراث العربي

“নিশ্চয় আমার নিকট তোমাদের যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নামায। যে নামাযের হেফাযত করবে এবং ধারাবাহিকভাবে সাথে সংরক্ষণ করতে থাকবে, সে তো তার দ্বীনের হেফাযত করলো। আর যে নামায নষ্ট করলো, সে অন্য সকল বিষয় আরও বেশি নষ্ট করবে।” [মুয়াত্তা মালেক: ১/৬]

আমরাও যদি এই নীতির উপর চলতে পারি, তাহলে আমাদের জীবনেও বরকত আসবে। অন্য সকল কাজ আরও সুন্দরভাবে আঞ্জাম পাবে।

 

একটি চমৎকার মূলনীতি

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বলেছেন,

حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ. –البقرة: 238

“তোমরা সকল নামায এবং (বিশেষ করে) মধ্যবর্তী নামাযের প্রতি যত্নবান থাক এবং তোমরা আল্লাহর সামনে স্থিরভাবে দাঁড়াও।” –সূরা বাকারা ০২: ২৩৮

 

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম মাতুরিদী রহিমাহুল্লাহ তাঁর তাফসীরে মাতুরিদীতে বলেন, (حَافِظُوا) শব্দটি যেহেতু বাবে মুফাআলাহ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই তার মধ্যে সংরক্ষণের বিষয়টি দুই তরফ থেকেই থাকবে। অর্থাৎ বান্দা যখন নামাযকে যথাযথভাবে হেফাযত করবে, তখন নামাযও বান্দাকে হেফাযত করতে থাকবে। এ কারণেই অপর এক আয়াতে এসেছে,

إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ. –العنكبوت: 45

“নিশ্চয় নামায অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করে।” -সূরা আনকাবুত ২৯: ৪৫

নামাযের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো দৃঢ়তার সাথে অনুশীলন করতে পারি

অযুতে মিসওয়াক যেন না ছুটে

মানুষের মুখের ভেতরে আল্লাহ তাআলা যে লালা দিয়েছেন, তা খুব দ্রুত যেকোনো খাবারকে হজমের উপযুক্ত করে ফেলে, পঁচিয়ে ফেলে। তাই আমরা দেখি, মুখ কিছুক্ষণ বন্ধ রাখলে মুখে দুর্গন্ধ হয়ে যায়। মানুষ যখন ঘুম থেকে উঠে, দীর্ঘসময় মুখ বন্ধ থাকার কারণে ভেতরের লালাগুলোর কারণে দুর্গন্ধ হয়। এ কারণে শুধু মিসওয়াক করলেই মুখের দুর্গন্ধ দূর হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করতেন আমরা জানি। দাঁত পরিচ্ছন্ন করার জন্য মিসওয়াক করতেন। আবার মিসওয়াক দিয়ে জিহ্বা পরিষ্কার করতেন। জিহ্বা পরিষ্কার রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আবার দেখেন শুধু কুলি করলে মুখের ভেতরের অংশের দুর্গন্ধ দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাই খুব গুরুত্বের সাথে ভালো করে কুলি করতেন। একটু লক্ষ করি, এভাবে যদি নিয়মিত করা হয়, তাহলে মুখে কোনো ধরনের দুর্গন্ধ থাকার সুযোগ কি আছে? [দেখুন, সহীহ মুসলিম: ২৫৪]

মানুষ যখন একে অপরের সাথে কথা বলে, তখন মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসলে সামনের ব্যক্তি সার্বক্ষণিক কষ্ট পেতে থাকে। এগুলো প্রত্যেকের লক্ষ করা উচিত।

তবে আরেকটি বিষয়। কারো মুখে দুর্গন্ধ হলে তাকে সরাসরি লজ্জিত করাও উচিত নয়। এর দ্বারা সে অনেক বেশি কষ্ট পায়, অনেক সময় সবার সামনে কাউকে সরাসরি বলা হলে সে অনেক বেশি লজ্জিত হয়।

আমরা হাদীসের ভাণ্ডার খুঁজে একটি হাদীসও পাব না, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে সরাসরি এমন কিছু বলে লজ্জিত করেছেন। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাটা ছিল এমন যে, সবাই বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এতবেশি মিসওয়াক করতেন যেন তাঁর মাড়ির চামড়া উঠে যাবে। এগুলো সাহাবায়ে কেরাম প্রচুর পরিমাণে দেখেছেন। এতবেশি দেখেছেন যে, তাঁরা দেখে দেখে শিখে ফেলেছেন। তাঁদেরকে আলাদাভাবে তাম্বীহ করতে হয়নি।

হাদীসে এসেছে—হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ঢুকে সর্বপ্রথম মিসওয়াকের আমলটি করতেন। এমনকি মৃত্যুর সময়ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ বাহ্যিক আমল ছিল উত্তমরূপে মিসওয়াক। উম্মতকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আর কী হতে পারে? [দেখুন: সহীহ বুখারী: ৪৪৫১; সহীহ মুসলিম: ২৫৩; আল-মুজামুল আওসাত: ৬৫২৫]

অধিক পরিমাণে মিসওয়াকের আরেকটি ভালো দিক হলো, কিছু সময় পর পর মিসওয়াক করা হলে নতুন করে সজীবতা তৈরি হয় এবং কাজে উদ্যম আসে। এটি একটি পরীক্ষিত বিষয়। সুতরাং যার রিসালাত পুরো বিশ্ববাসীর জন্য এবং যার ফিকির কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের জন্য, তাঁর উদ্যম স্বাভাবিকভাবেই অনেক অনেক বেশি থাকার কথা।

তাই আমাদেরও উচিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বাইরেও মাঝে মাঝে মিসওয়াক করা। এতে করে কাজে উদ্যম আসবে, মিসওয়াকের সাথে সম্পর্কও গভীর হবে ইনশাআল্লাহ।

অযুতে পানি অপচয় না হয়

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযুর ক্ষেত্রে পানি অপচয়ের ব্যাপারে জনৈক সাহাবীকে তাম্বীহ করেছেন।

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِي، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِسَعْدٍ وَهُوَ يَتَوَضَّأُ، فَقَالَ: «مَا هَذَا السَّرَفُ يَا سَعْدُ؟» قَالَ: أَفِي الْوُضُوءِ سَرَفٌ؟ قَالَ: «نَعَمْ، وَإِنْ كُنْتَ عَلَى نَهْرٍ جَارٍ. –سنن ابن ماجه: 425

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যখন তিনি অযু করছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সাদ! এটা কি ধরনের অপচয়?” তখন সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “অযুতেও অপচয় হয়?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, যদিও তুমি প্রবাহিত নদীতে অযু কর।” -সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২৫

 

বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি করা উচিত। নদীর পানি নদীতেই থেকে যাচ্ছে, তারপরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাম্বীহ করছেন। মূলত পানির মতো এতবড় নেয়ামতের কদর যেন উম্মত শিখে তার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। লক্ষ করুন, এখানে অযুতে পানি অপচয়কে ‘সারাফ’ বলা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,

وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ. –الأنعام: 141

“আর তোমরা অপচয় করো না, নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।” -সূরা আনআম ০৬: ১৪১

 

সুতরাং যে অযুতে আল্লাহ তাআলাকে নারাজ করে আসা হয়েছে, সে অযু দিয়ে আমরা সুন্দর নামায কীভাবে আশা করতে পারি?

 

হাদীসে মূলত আল্লাহর নেয়ামতের অবমূল্যায়ন যেন না হয়, তা শিখানো হয়েছে। আমরা অঢেল পেয়েছি বিধায় অযথা অঢেল খরচ করব, এই দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহ পছন্দ করেন না।

 

এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দেয়া ছোট ছোট নেয়ামতকেও আমাদের নিকট বড় করে দেখাতেন। [দেখুন, শামায়েলে তিরমিযী: ২২৬] এখানে দ্বীনের মানসিকতাটা শিখার বিষয়।

যদি চেষ্টা করা হয়, তাহলে টেপ থেকে অযু করলেও এক বদনার চেয়েও কম পানি ব্যবহার করে অযু করা যায়। আমরা টেপে অযু করে অযুর পানিটা বালতিতে জমা করে পরীক্ষা করে দেখতে পারি।

 

অযুর পর কালিমায়ে শাহাদাহ ও দোয়া পড়া

সুনানে তিরমিযীতে এসেছে-

من توضأ فأحسن الوضوءَ ثم قال : أشهد أن لا إله َ الا اللهُ وحده لا شريك له، وأشهد أنَّ محمدًا عبدُه ورسولُه .
اللهم اجعلني من التوابين، واجعلني من المتطهِّرين، فُتحت له ثمانيةُ أبوابِ الجنةِ، يدخل من أيّها شاءَ. –رواه الترمذي: 55

যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অযু করার পর এই কথা বলবে,

(أشهد أن لا إله َ الا اللهُ وحده لا شريك له، وأشهد أنَّ محمدًا عبدُه ورسولُه .
اللهم اجعلني من التوابين، واجعلني من المتطهِّرين)

তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেয়া হবে, সে যেটা দিয়ে চাইবে প্রবেশ করবে। -জামে তিরমিযী: ৫৫

(দোয়ার অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে আত্মিক পবিত্রতা দান করুন এবং আমাকে বাহ্যিক পবিত্রতাও দান করুন।)

মনে রাখব, আমরা নামাযের মতো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকে সুন্দর করতে চাচ্ছি। তাই চতুর্দিক থেকে আমাদেরকে বেষ্টন করে আসতে হবে। সৌন্দর্যের চাদরে নামাযকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলতে হবে।

আমরা অনেক সময় দোয়া পড়ি, দোয়া করি না। দোয়া পড়াটা অনেকটা পাখির কথা বলার মতো হয়ে যায়। কী বলছি সেটার বিন্দুমাত্র অনুভূতি মনে থাকে না। তাই আমাদেরকে দোয়াগুলো বুঝে বুঝে করতে হবে। শুধু আওড়ে গেলে ওই মাপের ফায়দা অর্জিত হবে না।

এটি অনেক উঁচু মাপের ফযীলতের হাদীস। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এর ব্যাপারে এসেছে যে, তাঁকে জান্নাতের সকল দরজা-ই ডাকতে থাকবে। মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেছেন, তাঁর এই ফযীলতের কারণ হলো, তাঁর মাঝে সব ধরনের গুণের সমাবেশ ঘটেছে। [দেখুন, সহীহ বুখারী: ১৮৯৭]

একইভাবে উপর্যুক্ত হাদীসের ব্যাপারেও মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেছেন, কেউ যদি উত্তমভাবে অযু করে এই দোয়া পড়ে, তাহলে এই অযু যেহেতু ইসলামের সবচেয়ে বড় ইবাদতের জন্য মাধ্যম, তাই এই বড় ইবাদতই তার জন্য অন্য সকল ইবাদতের পথ খুলে দিবে। তবে জরুরি হলো, এই নামায সুন্দর হতে হবে এবং এর জন্য করা অযুও সুন্দর হতে হবে। এখানে কালিমায়ে শাহাদার মাধ্যমে মূলত ঈমান ও সর্বোত্তম ইবাদতের সমাবেশ ঘটেছে। তাই তার জন্য এতবড় ফযীলত অর্জিত হবে।

 

জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করুন

সহীহ বুখারীতে এসেছে-

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «صَلاَةُ الجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلاَةَ الفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً». –صحيح البخاري: 645

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একাকী নামাযের চেয়ে জামাতে আদায়কৃত নামায ২৭গুণ বেশি মর্যাদা রাখে। [সহীহ বুখারী: ৬৪৫]

এগুলো এতই ফযীলতের বিষয় যে, কেউ হয়তো ৫০ বছর হায়াত পেয়েছে। কিন্তু এগুলোর কারণে তার হায়াত কয়েক হাজার বছরের সমান হয়ে যায়। একজন ৫০ বছরে একই ইবাদত করে যা অর্জন করে, অপরজন একই ইবাদত একটু তরীকা অনুযায়ী করার কারণে ৫০ হাজার বছরের কাজ করে ফেলে।

 

মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করুন

মুসতাদরাকে হাকেমে এসেছে-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «لَا صَلَاةَ لِجَارِ الْمَسْجِدِ إِلَّا فِي الْمَسْجِدِ». –المستدرك: 898

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মসজিদের প্রতিবেশীর জন্য মসজিদ ছাড়া কোনো নামাযই নেই।” -মুসতাদরাকে হাকেম: ৮৯৮

মসজিদে গিয়ে সামনের কাতারে থাকার চেষ্টা করব। মনে রাখব, যারা সামনের কাতারে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকে, তারা কল্যাণের পথে অগ্রগামী থাকে। আর যাদেরকে দেখব সামনে কাতার ফাঁকা রেখে পেছনে দাঁড়াতে পছন্দ করে, বুঝব যে, তারা দ্বীনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পেছনে পড়ে থাকাকেই পছন্দ করে।

আল্লাহর পথের সকল মুজাহিদ এ বিষয়ে সজাগ থাকা চাই।

 

নামাযের আগে ও পরে ফারেগ থাকুন

নামাযের আগেই ব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে যাওয়া। নামাযের পরপরও ব্যস্ততা না রাখা। তাহলে নামায সুন্দর হবে, মানসম্পন্ন হবে।

নামাযে দিলকে আল্লাহর জন্য ফারেগ রাখুন। এমন কোনো কাজ করে এসে তৎক্ষণাৎ নামাযে দাঁড়াবেন না, যেটা নামাযেও আমাদেরকে সেদিকে টানতে থাকে। অথবা এমন কোনো ব্যস্ততা সামনে নিয়ে নামাযে দাঁড়াব না, যা আমাদের নামাযকে প্রভাবিত করতে থাকে।

অনেকে এত ব্যস্ততা নিয়ে নামাযে দাঁড়ায় যে, তার ব্যস্ততার প্রভাব পেছনে থাকা মাসবুক ব্যক্তির নামাযকেও প্রভাবিত করে। সে সালাম ফিরিয়েই জুতা হাতে নিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে। পেছনে নামাযরত ব্যক্তিকে পুরোটা সময় মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে রাখে। পেছনের ব্যক্তি আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া তো দূরের কথা, তার সারাক্ষণই মনে হতে থাকে কত তাড়াতাড়ি নামাযটা শেষ করবো। আল্লাহ আমাদের ইসলাহ করুন।

আমরা নিজের এবং অন্য ভাইদের নামাযের হেফাযতের ফিকির করব। মোটকথা সকলের নামায যেন সংরক্ষিত হয়, আমরা সেই ফিকিরে নিবেদিত হব।

অনেক সময় কোনো কোনো মুসল্লী মসজিদে গিয়ে নিজের জুতা কিংবা সামানপত্র এমন জায়গায় রাখে যেখান থেকে খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এভাবে জুতা কিংবা সামান রেখে নামাযে দাঁড়ানো অনুচিত। যত্নসহকারে তা নিজের কাছাকাছি হেফাযত করব। এই হেফাযত মূলত আমাদের নামায এবং আল্লাহর সাথে একাগ্রতাকে অব্যাহত রাখার জন্য।

অনেক সময় আমরা সামান কাছাকাছি রাখলেও, সামনে কাতার ফাঁকা থাকায় সামনে চলে যাই, আমাদের সামান কিংবা জুতা পিছনে রয়ে যায়। এমন দশায়ও দিলকে আল্লাহর জন্য ফারেগ করব। মনে মনে সেই সামানের ব্যাপারে তাওয়াক্কুল করে, তা আল্লাহর হাওয়ালা করে দিলকে ফারেগ করে দিব। এই সামান্য সামান খোয়া যাক অথবা যাই হোক- এটি যেন আমাদের মনিবের সাথে একাগ্রতায় কোনোক্রমেই অন্তরায় না হয়, এই চিন্তা অন্তরে জাগ্রত করব।

আমরা মসজিদে উপস্থিত হব জামাত শুরু হওয়ার পূর্বেই, যেন নামাযের জন্য অপেক্ষারত থাকার সুযোগ লাভ করতে পারি। যেন আমাদের অপেক্ষার সময়গুলোও নামাযরূপে গণ্য হয়। আর এর ফলে মূল নামাযে আমরা একাগ্রতা অনুভব করব। পূর্ববর্তী কোনো ব্যস্ততা থেকে থাকলে, সেই ব্যস্ততার রেশও এতে কেটে যাবে। এভাবে নামাযের জন্য ইনতেজার করার দ্বারা আমরা বিপুল ফায়দা অর্জন করতে পারব ইনশাআল্লাহ।

নামাযে অহেতুক নড়াচড়া পরিহার করার হিম্মত করব।

মনে রাখবেন, নামাযে আমরা যত বেশি স্থির থাকব ও নিষ্ঠা প্রদর্শন করতে পারব, জিহাদেও তত বেশি দৃঢ়তা অব্যাহত রাখতে পারব ইনশাআল্লাহ।

যারা নামাযে দাঁড়িয়ে শরীর চুলকানোতে অভ্যস্ত, মশা বা মাছি বসলে অস্থির হয়ে যায়… এমন লোকজন নামাযে দাঁড়িয়ে এক অস্থিরতার মধ্যে থাকে। ‘কী যেন পায়ে কামড় দিল’, ‘কী যেন গায়ে বসলো’ এমন অনুভূতিতে সবসময়ই এরা আক্রান্ত থাকে।

কিন্তু আমরা যখন মনকে স্থির করে নিব যে, ‘আমরা আল্লাহর সামনে অনেক বেশি স্থিরতা প্রদর্শন করতে চাই’ তখন মশা-মাছি কোনো কিছুই আমাদের মনোযোগ অন্যত্র সরাতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। বরং এভাবে মনোযোগ বজায় রাখাকে আমরা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করব, আল্লাহর সামনে দৃঢ় থাকার চ্যালেঞ্জ। এর দ্বারা ‘নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার’ বড় ফায়দা যেমন অর্জিত হবে, পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। এরূপ উচ্চ মনোবল ও আত্মবিশ্বাস প্রতিটি মুজাহিদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

নামাযের জন্য অপেক্ষাকালীন সময়কে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে এই মুরাকাবার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার দ্বারা আমাদের নামাযে খুশু পয়দা হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন,

وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ ، الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ. –البقرة: 45، 46

ভাবার্থ: “একমাত্র খুশুওয়ালা ছাড়া বাকি সকলের কাছেই নামায ভারি। আর খুশুর অধিকারী ওই সমস্ত লোক, যারা বিশ্বাস করে যে, তাদেরকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে এবং আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে।” -সূরা বাকারা ০২: ৪৫-৪৬

আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ফিকির বান্দার মধ্যে খুশু তৈরি করে। তাই নামাযের জন্য অপেক্ষা থাকাকালীন সময়কে ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে’ অন্তরাত্মায় এই অনুভূতি সঞ্চার করে মুরাকাবা করব।

‘আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে’ এবং ‘হিসাব দিতে হবে’ এ ধরনের কিছু আয়াত নিচে উল্লেখ করা হলো। নামাযের পূর্বে এ আয়াতগুলো মাথায় আনার চেষ্টা করব। নামাযে খুশু স্থায়ী হওয়ার জন্য বিইযনিল্লাহ এটি অত্যন্ত উপকারী একটি কৌশল।

 

يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ (42) خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ وَهُمْ سَالِمُونَ (43)  -القلم: 42، 43

অর্থ: “স্মরণ কর, সেদিনের কথা যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচিত করা হবে, সেদিন তাদেরকে আহ্বান করা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না; তাদের দৃষ্টি অবনত, হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিল তখন তো তাদেরকে আহ্বান করা হয়েছিল সিজদা করতে।” (সূরা কালাম ৬৮:৪২-৪৩)

 

فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ (13) وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً (14) فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ (15) وَانْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَاهِيَةٌ (16) وَالْمَلَكُ عَلَى أَرْجَائِهَا وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ (17) يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ (18)   -الحاقة: 13-18

অর্থ: “যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে- একটি মাত্র ফুৎকার, পর্বতমালাসহ পৃথিবী উৎক্ষিপ্ত হবে, মাত্র এক ধাক্কায় তারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। সেদিন সংঘটিত হবে মহাপ্রলয় এবং আসমান বিদীর্ণ হয়ে যাবে আর সে দিন তা দুর্বল হয়ে যাবে। ফেরেশতাগণ আসমানের প্রান্তদেশে থাকবে এবং সে দিন আটজন ফেরেশতা তোমার রবের আরশকে ধারণ করবে তাদের ঊর্ধ্বে। সেই দিন উপস্থিত করা হবে তোমাদেরকে এবং তোমাদের কিছুই গোপন থাকবে না।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯:১৩-১৮)

 

يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا (38) ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآبًا (39) إِنَّا أَنْذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيبًا يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُولُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا (40) –النبأ: 38-40

অর্থ: “সেই দিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে; দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত অন্যরা কথা বলবে না এবং সে যথার্থ বলবে। এই দিন সুনিশ্চিত; অতএব যার ইচ্ছা সে তার রবের শরণাপন্ন হোক। আমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম; সেই দিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে এবং কাফের বলবে, ‘হায় আমি যদি মাটি হতাম’। (সূরা নাবা, ৭৮ : ৩৮-৪০)

 

كَلَّا إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكًّا دَكًّا (21) وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا (22) وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى (23) يَقُولُ يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي (24) فَيَوْمَئِذٍ لَا يُعَذِّبُ عَذَابَهُ أَحَدٌ (25) وَلَا يُوثِقُ وَثَاقَهُ أَحَدٌ (26) يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ (27) ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً (28) فَادْخُلِي فِي عِبَادِي (29) وَادْخُلِي جَنَّتِي (30) –الفجر: 21-30

অর্থ: “এটি সঙ্গত নয়। পৃথিবীকে যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে, এবং যখন তোমার রব উপস্থিত হবেন ও সারিবদ্ধভাবে ফেরেশতাগণও, সেই দিন জাহান্নামকে আনা হবে এবং সেই দিন মানুষ উপলব্ধি করবে, তখন এই উপলব্ধি তার কী কাজে আসবে? সে বলবে, ‘হায়! আমার এ জীবনের জন্য আমি যদি কিছু অগ্রিম পাঠাতাম?’ সেই দিন তাঁর শাস্তির মতো শাস্তি কেউ দিতে পারবে না, এবং তাঁর বন্ধনের মতো বন্ধন কেউ করতে পারবে না। হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার রবের নিকট ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে, আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও, আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।” (সূরা ফজর ৮৯:২১-৩০)

 

وَعُرِضُوا عَلَى رَبِّكَ صَفًّا لَقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّنْ نَجْعَلَ لَكُمْ مَوْعِدًا (48) وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا (49) –الكهف: 48، 49

অর্থ: “আর তাদেরকে তোমার রবের নিকট উপস্থিত করা হবে সারিবদ্ধভাবে এবং বলা হবে, ‘তোমাদেরকে প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করেছিলাম সেইভাবেই তোমরা আমার নিকট উপস্থিত হয়েছ, অথচ তোমরা মনে করতে যে, তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত ক্ষণ আমি কখনও উপস্থিত করব না।’ আর উপস্থিত করা হবে আমলনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত এবং তারা বলবে, ‘হায়, দুর্ভোগ আমাদের! এটি কেমন কিতাব! এটি তো ছোট বড় কিছুই বাদ দেয় না; বরং এতে সমস্ত হিসাব সংরক্ষিত রয়েছে।’ তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে, তোমার রব কারও প্রতি জুলুম করেন না।” (সূরা কাহাফ ১৮: ৪৮-৪৯)

وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُوا عَلَى رَبِّهِمْ قَالَ أَلَيْسَ هَذَا بِالْحَقِّ قَالُوا بَلَى وَرَبِّنَا قَالَ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ (30) قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِلِقَاءِ اللَّهِ حَتَّى إِذَا جَاءَتْهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً قَالُوا يَا حَسْرَتَنَا عَلَى مَا فَرَّطْنَا فِيهَا وَهُمْ يَحْمِلُونَ أَوْزَارَهُمْ عَلَى ظُهُورِهِمْ أَلَا سَاءَ مَا يَزِرُونَ (31) وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَلَلدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (32) –الأنعام: 30-32

অর্থ: “তুমি যদি দেখতে তাদেরকে যখন তাদের রবের সামনে দাঁড় করান হবে এবং তিনি বলবেন, ‘এটি কি প্রকৃত সত্য নয়?’ তারা বলবে, ‘আমাদের রবের শপথ! নিশ্চয়ই সত্য’। তিনি বলবেন, ‘তবে তোমরা যে কুফরী করতে তার জন্য তোমরা এখন শাস্তি ভোগ কর’।

যারা আল্লাহর সম্মুখীন হওয়াকে মিথ্যা বলেছে  তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমনকি হঠাৎ তাদের নিকট কিয়ামত উপস্থিত হবে তখন তারা বলবে, ‘হায়! এটিকে আমরা যে অবহেলা করেছি তার জন্য আক্ষেপ।’ তারা তাদের পিঠে নিজেদের পাপ বহন করবে; দেখ, তারা যা বহন করবে তা অতি নিকৃষ্ট। দুনিয়ার জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয় এবং যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখিরাতের আবাসই উত্তম; তোমরা কি অনুধাবন কর না?” (সূরা আনআম ০৬:৩০-৩২)

 

যারা ওজরের কারণে মসজিদে যেতে পারেন না

যারা নিরাপত্তার কারণে কিংবা গ্রহণযোগ্য অন্য কোনো ওজরের কারণে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করতে পারেন না তাদের বিষয়ে বলব;

আল্লাহ তাআলার একটি উসূল আছে। বান্দা যখন সক্ষম হালাতে কোনো আমল জারি রাখে, কখনো সে অক্ষম হয়ে গেলেও তাকে সেই আমলের সাওয়াব তিনি দিতে থাকেন। সহীহ বুখারীতে এসেছে-

«إِذَا مَرِضَ العَبْدُ، أَوْ سَافَرَ، كُتِبَ لَهُ مِثْلُ مَا كَانَ يَعْمَلُ مُقِيمًا صَحِيحًا»- صحيح البخاري: 2996

(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন বান্দা অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা সফরে থাকে; তখন সুস্থ অবস্থায় কিংবা মুকীম অবস্থায় যে আমল করতো, সমপরিমাণ সাওয়াব তার জন্য লিখে দেয়া হয়।”) [দেখুন, সহীহ বুখারী: ২৯৯৬]

সুতরাং, আমরা যারা ওযর পেশ করি তারা যখন নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করি, তখন আমাদের অবস্থা কী হয়? তখন যদি মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামায আদায়ের প্রতি তৎপর থাকি, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা অক্ষম অবস্থায় আমাদেরকে সেই সাওয়াব দান করবেন ইনশাআল্লাহ।

 

আসবাব মাকসাদ বিষয়ে কিছু কথা

যখন আমরা মসজিদে গমন করব, তখন এ কথা মাথায় রাখব যে, আমরা জীবনের মূল মাকসাদ বা উদ্দেশ্যের দিকে যাচ্ছি। তার আগ পর্যন্ত যা কিছু করছি সবই হলো মূল মাকসাদে পৌঁছার আসবাব বা মাধ্যম। কিন্তু এখন আমরা মাকসাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আর এর জন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদের সৃষ্টি করেছেন।

বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করলে আশা করি বুঝতে সহজ হবে….

দুনিয়া হচ্ছে দারুল আসবাব। মানুষ দুনিয়াতে প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো কাজ করে থাকে। প্রতিটি কাজ এক একটি সবব। সবব মানে মাধ্যম। এভাবে প্রতিদিন মানুষ শত শত আসবাব গ্রহণ করে। প্রতিটি কাজের কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। আবার প্রতিটি ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যের পিছনে আরও বড় উদ্দেশ্যও নিহিত থাকে। যেমন ধরুন, কেউ বাজারের দিকে রওয়ানা দিয়েছে; এখানে তার মাকসাদ থাকে বাজারে পৌঁছে বাজার করা। কিন্তু, বাজার করাটাই কি আমাদের চূড়ান্ত মাকসাদ? না। বরং এটাও আরেকটা মাকসাদে পৌঁছার জন্য মাধ্যম। তা হলো, ঘরের লোকদের খাবারের ব্যবস্থা করা। আবার, খাবার খাওয়াই কি আমাদের চূড়ান্ত মাকসাদ-উদ্দেশ্য? নিশ্চয় নয়। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নানা আসবাবের চক্রে ঘুরতে থাকি।

আমাদের অনেকে দুনিয়ার এ আসবাবগুলোকে তার জীবনের মূল মাকসাদ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে, আবার অনেকে তা পারে না। দুনিয়াতে অনেকে খাবার-দাবার আর টয়লেট করাকেই চূড়ান্ত মাকসাদ বানিয়ে ফেলে। খাবার খাওয়াটা তাদের কোনো মাকসাদে পৌঁছার জন্য সবব হয় না। তাই তাদের জীবন আর পশুর জীবনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না।

পক্ষান্তরে যারা খাবার খায় আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, তারা মূলত আগের সবগুলো সবব বা মাধ্যম গ্রহণ করে তার মানযিলে মাকসাদে (মূল গন্তব্যে) পৌঁছতে পারে। সুতরাং বুঝা গেল, আমাদের প্রতিটি কাজে মূল মাকসাদ হবে, আল্লাহর ইবাদত। কেউ যখন আল্লাহর ইবাদত পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তখন সে সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে।

বান্দা যখন ঘর থেকে বের হয় তখন সে তাওয়াক্কুলের দোয়া পড়ে বের হয়।

بسم الله توكلتُ على اللهِ، لا حولَ ولاَ قوّةَ إلا باللهِ

অর্থ: “আল্লাহর নাম নিয়ে তাঁরই উপর ভরসা করে বের হলাম। আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া (অসৎ কাজ থেকে বাঁচার এবং সৎ কাজ করার) কোনো শক্তি-সামর্থ্য নেই ।”

আবার যখন ঘরে প্রবেশ করে তখনও সে তাওয়াক্কুলের দোয়া পড়ে।

بِسمِ اللهِ وَلَجْنَا وبسم الله خرجنا، وعلى اللهِ ربِّنا تَوَكَّلْنَا

অর্থ: “আল্লাহর নামেই প্রবেশ করলাম, আল্লাহর নামেই বের হলাম এবং তাঁর উপরই ভরসা করলাম।”

মনে রাখবেন, যেখানে আসবাব থাকবে সেখানে তাওয়াক্কুলের বিষয় থাকবে। কারণ প্রকৃত বান্দা আসবাবের উপর ভরসা করতে পারে না। তাই আসবাব গ্রহণ করতে গিয়েই সে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে। তাওয়াক্কুল হলো, আসবাব থেকে আস্থা হটিয়ে শুধু আল্লাহর উপর আস্থা রাখার নাম।

মানুষের জীবনের হালাত তো দুটিই। হয় সে ঘরের বাইরে থাকবে, না হয় ঘরের ভেতরে। উভয় অবস্থায়ই সে প্রতিদিন শত শত, হাজার হাজার আসবাব গ্রহণ করে। ফলে সে তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে আসবাবগুলো থেকে ইয়াকীন হটিয়ে আল্লাহর উপর ইয়াকীন স্থাপন করে। আর দোয়ার মাধ্যমে সে ঘোষণা দেয় যে, আয় আল্লাহ! আসবাবের দুনিয়াতে আমি ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে যত আসবাব-মাধ্যম গ্রহণ করবো, এই আসবাব-মাধ্যমগুলো আমাকে কাছের কিংবা দূরের মাকসাদে পৌঁছাতে পারবে না, যদি না আপনি পৌঁছে দেন।

আমরা ঘর থেকে দোয়া পড়ে, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে বের হই। আর সিঁড়ি ধরে আমরা বহুতল ভবন থেকে নামা শুরু করে থাকি। আমাদের মাকসাদ হলো, সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় পৌঁছা। এখানে তাওয়াক্কুলের অর্থ হলো, আয় আল্লাহ, এই সিঁড়ি আমাকে নিচতলায় পৌঁছাতে পারবে না, যদি না আপনি আমাদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দেন।

লক্ষ করুন, সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় পৌঁছা হলো আমাদের আপাত একটি মাকসাদ; চূড়ান্ত মাকসাদ না।

মূলত আসবাব এমন জিনিস যার উপরে কোনোভাবেই আস্থা রাখা যায় না। উত্তম মজবুত সিঁড়ি মুহূর্তে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে পারে।

অনুরূপভাবে ঘরের লোকদের খাবার যোগাড় করার জন্য যখন আমরা ঘর থেকে বের হই, তখন দোয়া পড়ি এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করি, এর অর্থ হলো, আমরা নিজেদেরকে রবের নিকট সঁপে দিলাম। যেন আমরা বলছি, আয় আল্লাহ! আমাদের মূল মাকসাদ তো হলো, আপনার ইবাদত করা। কিন্তু ইবাদতের জন্য বাজারে গিয়ে বিভিন্ন সওদা করতে হবে। বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করে বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে এবং তা রান্না করতে হবে। আর এই রান্না করা খাবার খেয়ে ইবাদতের জন্য শক্তি অর্জন করব। অতএব মূল মাকসাদের আগের এত আসবাব, এগুলো আমাদেরকে মূল মাকসাদে পৌঁছাতে পারবে না, যদি না আপনি আমাদেরকে পৌঁছে দেন।

 

মনে রাখব, যেখানেই আসবাবের বিষয় থাকবে সেখানেই তাওয়াক্কুল থাকবে। কারণ, আসবাব এতই দুর্বল যে, তার উপর এক মুহূর্তের জন্যও ভরসা নেই। এটা আমাদেরকে খুব ভালো করে বুঝতে হবে।

একটা উদারহণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি হবে….

আসবাব এতটাই দুর্বল যে, অনেক সময় যেসব বিষয়কে আমরা হেদায়াতের আসবাব মনে করে থাকি, এগুলোই হয়তো আমাদের গোমরাহীর আসবাব হয়ে যেতে পারে। যেমন ধরুন, (আল্লাহ না করুন) প্রসিদ্ধ কোনো আলেম বা প্রসিদ্ধ কোনো দাঈর পদস্খলন হলো। দেখা যাবে, তার পক্ষে অনেকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ তার অবস্থান স্পষ্ট ভুলের উপর।

এক্ষেত্রে তার পক্ষে যেসব মানুষ দাঁড়াল এর কারণ কী? কারণ হয়তো ওই আলেম কিংবা দাঈর সাথে থাকা সুসম্পর্ক অথবা তার বিষয়ে সুধারণা।

একটু লক্ষ করুন…

একসময় হয়তো এই অনুসারীরা ওই আলেম কিংবা দাঈর সাথে সুসম্পর্ক অথবা সুধারণাকে হেদায়াতের সবব তথা মাধ্যম মনে করতো। কিন্তু এখন এটিই তাদের জন্য গোমরাহীর কারণ হয়ে গেল।

এ কারণে আসবাবের উপর কোনো ভরসা করা যায় না। আমাদের ভরসা একমাত্র আল্লাহ তাআলার উপর করতে হবে।

 

আমরা নবীগণের মোযেজার কথা শুনি, আউলিয়ায়ে কেরামের কারামতের কথা শুনি।

এগুলোর মাধ্যমে মূলত আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে শিক্ষা দিতে চান তা হলো, আসবাবের এ দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলার হুকুম ছাড়া কোনো জিনিসের ন্যূনতম ক্ষমতা নেই। আসবাবের দুনিয়াতে আমরা দেখি যে, আগুন পুড়িয়ে দেয়। ছুরি কেটে দেয়। সমুদ্র ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, এগুলো আসবাব। এগুলোর সাথে সরাসরি পুড়িয়ে দেয়ার কিংবা কেটে ফেলার অথবা ডুবিয়ে দেয়ার সম্পর্ক নেই। বরং সবকিছুতেই সরাসরি সম্পর্ক হলো আল্লাহ তাআলার হুকুমের।

একটি আয়াত দেখেন,

وَقَالَ يَا بَنِيَّ لَا تَدْخُلُوا مِنْ بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوا مِنْ أَبْوَابٍ مُتَفَرِّقَةٍ وَمَا أُغْنِي عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُون. –يوسف: 67

অর্থ: “আর ইয়াকুব বলল, হে আমার পুত্রগণ! তোমরা (নগরে) এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না। বরং ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। (বস্তুত) আমি তোমাদেরকে আল্লাহর বিধান থেকে রক্ষা করতে পারবো না। একমাত্র আল্লাহর হুকুমই কার্যকর হয়। (সুতরাং) আমি তাঁরই উপর ভরসা করলাম। আর যারা ভরসা করতে চায়, তাদের উচিত তাঁরই উপর ভরসা করা।” [সূরা ইউসুফ ১২: ৬৭]

মুফাসসিরীনে কেরাম লিখেছেন, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ১১ পুত্রকে লক্ষ করে তিনি এই উপদেশ দিয়েছেন। যেহেতু তাঁরা সুস্থ সবল সুঠাম দেহের অধিকারী ছিল, তাই একসাথে এক ফটক দিয়ে ১১ ভাই প্রবেশ করলে, মানুষের বদনজর তাদের উপর পড়তে পারে। তাই বদনজর থেকে বাঁচার জন্য তাদেরকে নগরের বিভিন্ন ফটক দিয়ে পৃথকভাবে প্রবেশ করতে বললেন। কিন্তু সেই সাথে তিনি ‘আল্লাহর হুকুমই হচ্ছে মূল’ এই বিষয়টিও উল্লেখ করে দিলেন। আল্লাহর হুকুম থাকলে পৃথকভাবে প্রবেশ করলেও ক্ষতি হয়ে যাবে, পক্ষান্তরে হুকুম না থাকলে একত্রে প্রবেশ করলেও ক্ষতি হবে না। সুতরাং আমি যা তোমাদেরকে নসীহত করলাম, তা শুধু বদনজর থেকে বাঁচার একটা সবব বা উপায় মাত্র। কিন্তু এই সববের উপর ভরসা করা যায় না।

 

আবার পূর্বের কথায় যাই…

আমাদের জীবনের মূল মাকসাদ কী? বাজার করা, খাবার খাওয়া, ঘুমানো, ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি? নাকি এগুলো হলো আসবাব, আর মূল মাকসাদ হলো, ইবাদত?

যে যত কম আসবাব গ্রহণ করে মূল মাকসাদে পৌঁছতে পারে, সেই মূলত দুনিয়ার সবচেয়ে বড় যাহেদ

আসবাবগুলো যেহেতু আমাদের মাকসাদ না, তাই আমরা এগুলো গ্রহণ করার সময় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে থাকি এবং তাঁর নিকট দোয়া করি যে, আয় আল্লাহ! আসবাব গ্রহণ করেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত হিসেবে। কিন্তু এ আসবাবের মধ্যে মূল ক্ষমতা নেই। এ আসবাবগুলো যেন আমাদেরকে আটকে দিতে না পারে। আমরা যেন মূল মাকসাদে পৌঁছে যেতে পারি, আমাদেরকে সে তাওফীক দান করুন।

তো আমরা যখন মসজিদে যাই, তখন এ কথা মাথায় রাখব যে, আমরা আমাদের জীবনের মূল মাকসাদের দিকে যাচ্ছি। এর আগে যা কিছু করেছি, সবই ছিল মূল মাকসাদে পৌঁছার আসবাব (মাধ্যম)। কিন্তু এখন আমরা মাকসাদের দিকে যাচ্ছি। আর এর জন্যই আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।

একটি প্রশ্ন করি….

আমরা মসজিদে প্রবেশ করার সময় কি কেউ তাওয়াক্কুলের দোয়া করি?

যেহেতু মসজিদে বান্দা যতক্ষণ থাকে পুরাটাই ‍মূল মাকসাদের কাজ; তাই মসজিদে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকাও ইবাদত। আমরা নামাযের অপেক্ষায় বসে আছি, এটাও ইবাদত হিসেবে গণ্য হচ্ছে। কারো অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকাটাও ইবাদত। মূল মাকসাদে শামিল হওয়ার পর এখন আর তাওয়াক্কুলের কথা বলা হয় না। তাই তো মসজিদে প্রবেশের সময় এই বলে দোয়া করা হয়,

اللهم افتح لي أبواب رحمتك

“হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য রহমতের সব দরজা খুলে দিন।” এখন আমরা এমন জায়গায় চলে এসেছি, যেখানে শুধুই রহমত আর রহমত। এখান থেকে আমরা যত বেশি রহমত নিতে পারব, ততই আমরা সৌভাগ্যবান হব। এ কারণে কারো দিল যদি সবসময় মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে তার এত বেশি রহমত অর্জিত হবে যে, হাশরের কঠিন ময়দানে তার জন্য আরশের ছায়া নসীব হয়ে যাবে। [দেখুন, সহীহ বুখারী: ৬৬০; সহীহ মুসলিম: ১০৩১]

আরেকটি কথা বলি, আমাদের মধ্যে যে যত বেশি আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত হবে, সে দুনিয়ার জন্য তত বেশি উপকারী বলে সাব্যস্ত হবে। রহমত কেবল আল্লাহর তরফ থেকেই অর্জিত হয়। আর রহমত ব্যাপকতাকে চায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ  (“আর আমার রহমত সকল জিনিসকে বেষ্টন করে আছে।” -সূরা আরাফ ০৭: ১৫৬)

আল্লাহর রহমত এমনই যে, তা ছড়িয়ে পড়তে চায়। তাই যে যত বেশি আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারবে, তার দ্বারা দুনিয়াবাসী তত বেশি উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত সবচেয়ে ব্যাপক। এর কারণ হলো, আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ  (“আমি আপনাকে পুরো বিশ্বজগতের জন্য রহমত বানিয়ে প্রেরণ করেছি।” -সূরা আম্বিয়া ২১: ১০৭)

বলছিলাম, বান্দা যখন মসজিদে প্রবেশ করে তখন সে তাওয়াক্কুলের দোয়া করে না। বরং সে রহমতের সব দরজা খুলে দেয়ার দোয়া করে। কেননা মসজিদে যখন সে প্রবেশ করলো তখন সে মূল মাকসাদে প্রবেশ করে ফেলেছে। তাই এখন তাওয়াক্কুলের দোয়া না; তাওয়াক্কুলের বিষয়টা আসবাবের ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, যখন কেউ মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবে, তখন আবার তাওয়াক্কুলের দোয়া পড়ে নিতে পারে। এ সংক্রান্ত একটি বর্ণনা মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় এসেছে-

عن مجاهد قال: كان يقال: إذا خرج الرجل من المسجد فليقل: بسم الله توكلت على الله اللهم أني أعوذ بك من شر ما خرجت إليه. –المصنف لابن أبي شيبة: 30441

 

অর্থ: (বিখ্যাত তাবেঈ) হযরত মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, তাদের সময়ে এই শিক্ষা দেয়া হতো যে, যখন কেউ মসজিদ থেকে বের হবে সে যেন পড়ে নেয়, (بسم الله توكلت على الله اللهم أني أعوذ بك من شر ما خرجت إليه) অর্থাৎ “আমি আল্লাহর নাম নিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে বের হলাম হে আল্লাহ! আমি যেদিকে যাচ্ছি সেখানকার মন্দ থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই।”

 

কয়েকটি শিক্ষা

উপরের এ আলোচনা থেকে আমরা কয়েকটি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

০১. ঘর থেকে বের হওয়া এবং প্রবেশ করতে এখন থেকে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবো।

০২. যখন মসজিদের দিকে রওয়ানা হবো তখন দিলে হাজির করবো যে, আমি আমার জীবনের মূল মাকসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

০৩. যেহেতু মসজিদে রহমতের সব দরজা খুলে দেয়া হয়, তাই আমাদের অন্তরকে মসজিদের সাথে জুড়তে হবে।

তাওয়াক্কুল অনেক বড় আমল। আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিবে এই তাওয়াক্কুল ইনশাআল্লাহ।

আমরা কীভাবে আমাদের নামাযকে সুন্দর করতে পারি, এর উপর ধারাবাহিক আলোচনা করছিলাম। শেষ দিকের পয়েন্টটি ছিল, মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করা। এবার সর্বশেষ পয়েন্ট নিয়ে কিছু কথা বলে আলোচনা শেষ করছি।

 

লাগাতার চল্লিশ দিন তাকবীরে উলার সাথে নামায আদায়ের অনুশীলন করুন

তিরমিযীর এক হাদীসে এসেছে-

«مَنْ صَلَّى للهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا فِي جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيرَةَ الْأُولَى كُتِبَتْ لَهُ بَرَاءَتَانِ بَرَاءَةٌ مِنْ النَّارِ وَبَرَاءَةٌ مِنْ النِّفَاقِ». (رواه الترمذي: 241)

 

“যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন জামাতের সাথে তাকবীরে উলা সহকারে নামায আদায় করবে, তার জন্য দুটি মুক্তির পরোয়ানা লেখা হবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং নিফাক থেকে মুক্তি।” -জামে তিরমিযী: ২৪১

 

এখন তো শাবান চলছে যদি আমরা এখন থেকে এ আমলটি শুরু করি, তাহলে রমযানসহ চল্লিশ দিন সহজেই হয়ে যাবে। এ আমলের হিম্মত আমাদের সকলের করা উচিত।

আমার কেমন যেন মনে হয়, নিজের ভেতরে নিফাক আছে কি নেই, তা যাচাই এর জন্য এটি একটি উত্তম প্রক্রিয়া হতে পারে। আমরা এর মাধ্যমে (কাউকে বলা ছাড়া) নিজেরাই নিজেদের পরীক্ষা করে দেখতে পারি। তাকবীরে উলার সঙ্গে টানা চল্লিশ দিন নামায পড়ার কাজটি খুব সহজ নয়। কেউ চাইলেই করতে পারবে বিষয়টি এমন না। মূলত নিফাক মুমিনের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর ব্যাধির একটি। সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত সবসময় নিজেদের মধ্যে নিফাক ঢুকে গেল কিনা, এ শঙ্কায় থাকতেন।

বিশেষ করে যারা জিহাদের পথে অবিচল থাকতে চায়, তাদের জন্য এই আমলের গুরুত্ব অনেক। কারণ এটা স্বীকৃত যে, নিফাক জিহাদের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।

কমপক্ষে এই হিম্মত করা যে, এখন থেকে রমযানের শেষ পর্যন্ত কোনো নামাযে আমরা মাসবুক হবো না। সব সময় ‘সাবেক’ থাকবো। ‘মাসবুক’ অর্থ যে পিছনে পড়ে গেছে। আর ‘সাবেক’ অর্থ অগ্রগামী। যারা নামাযে ‘সাবেক’ (অগ্রগামী) থাকতে পারবে, আশা করা যায়, দ্বীনের অন্য সকল কাজে তারাই ‘সাবেক’ থাকতে পারবে ইনশাআল্লাহ (والسَّابِقْوْنَ السَّابِقُوْنَ) পক্ষান্তরে যারা নামাযে পিছিয়ে থাকবে, তারা জান্নাতে প্রবেশসহ সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। হাদীসে এসেছে,

لَا يَزَالُ قَوْمٌ يَتَأَخَّرُونَ حَتَّى يُؤَخِّرَهُمُ اللهُ. -صحيح مسلم (438)

“কিছু লোক সবসময় সামনের কাতার থেকে পেছনে থাকবে। আল্লাহ তাআলাও তাদেরকে পেছনে ফেলে রাখবেন।” -সহীহ মুসলিম: ৪৩৮

মূলত নামায এমনই একটি ইবাদত, এখানে যার হালাত যত বেশি ভালো হবে, বুঝতে হবে তার বাকি হালাতগুলো তত বেশি ভালো, তত বেশি উন্নত।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। রমযানের আগেই আমাদের নামাযকে সুন্দর করে দিন। আমীন।

 

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.

 

আরো পড়ুন-

কীভাবে মাহে রমযানের প্রস্তুতি নেব? || ১ম মজলিস

কীভাবে মাহে রমযানের প্রস্তুতি নেব? || ২য় মজলিস

Related Articles

Back to top button