ভারত উপমহাদেশের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা কেন ওয়াজিব? ৪র্থ পর্ব (শেষ পর্ব)
ভারত উপমহাদেশের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা কেন ওয়াজিব?
৪র্থ পর্ব (শেষ পর্ব)
শায়খ ফজলুর রহমান কাসিমি হাফিযাহুল্লাহ
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ভারত উপমহাদেশ যখন মুসলমানদের হাত থেকে বের হয়ে অমুসলিমদের হাতে চলে গেছে এবং মুসলমানরা একটি দারুল হারবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়ে পড়েছে, তখন সময়ের চাহিদা ও দায়িত্বকে সামনে রেখে উলামায়ে কেরাম তাঁদের নিজ নিজ যিম্মাদারী আদায়ের জন্য দুটি কাজ করেছেন।
এক. মাসআলার শরয়ী অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, হিন্দুস্তান বর্তমান অবস্থায় দারুল হারব। এরপর একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, দারুল হারবে অবস্থানকারী মুসলমানদের দায়িত্ব কী?
দুই. দ্বিতীয়ত তাঁরা যে কাজটি করেছেন তা হচ্ছে, দারুল হারবকে পুনরায় দারুল ইসলামে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আমলীভাবে জিহাদ শুরু করেছেন এবং সে জন্য যা যা প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল সে প্রস্তুতি গ্রহণে লেগে পড়েছেন।
এ পর্যায়ে আমি ভূমিকা স্বরূপ কিছু কথা তুলে ধরতে চাই, যে কথাগুলো সম্পর্কে আমি আশাবাদী যে, সে কথাগুলোতে কেউ কোনো দ্বিমত করবেন না। আর আমি এটাও আশা করছি যে, এ কথাগুলো সামনে রাখলে আমরা আমাদের দায়িত্বগুলো বুঝে নেয়া সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কথাগুলো হচ্ছে এই-
০১. যিম্মাদারী আদায় করতে দেরি হলে কিংবা আদায় করতে অলসতা করলে সে কারণে যিম্মাদারীতে কোনো প্রকার শিথিলতা আসে না এবং যিম্মাদারী হালকা হয়ে যায় না।
০২. কোনো এক প্রজন্ম যদি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব আদায় না করতে পারে, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের উপর থেকে সে দায়িত্ব চলে যায় না। দায়িত্ব বহাল থাকে।
০৩. এ দেশগুলোতে কুফরী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখার পেছনে মূল শক্তি হচ্ছে এ দেশগুলোর শাসকবর্গ। অন্য বিভাগগুলো তাদের সহযোগী।
০৪. দীন ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠা, খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং ইমারাতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করা মুসলমানদের উপর অর্পিত একটি ফরয দায়িত্ব। আর এ ফরয আদায় করতে গিয়ে বাধাদানকারী যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো দূর করাও ফরয।
০৫. হালাত ও পরিস্থিতির কারণে ফরয আদায়ের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে, কিন্তু মূল বিধান মুলতবি হতে পারে না।
০৬. ফরয জিহাদের দায়িত্ব জিহাদের প্রস্তুতি এবং আমলীভাবে জিহাদের দ্বারাই আদায় হতে পারে, অন্যান্য ফরয দায়িত্ব আদায় করা এর বদলা হতে পারে না। যেমন নামায, রোযা, হজ ইত্যাদি আদায় করার দ্বারা জিহাদের দায়িত্ব আদায় হতে পারে না।
০৭. সেসব কাজকেই জিহাদের প্রস্তুতি বলা হবে যেসকল কাজকে কুরআন ও হাদীসে জিহাদের প্রস্তুতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ কয়েকটি কথা উল্লেখ করার পর আমরা দেখার চেষ্টা করব যে, চলমান সময়ে ভারত উপমহাদেশ তথা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর এ ক্ষেত্রে কী কী দায়িত্ব বর্তায়।
উল্লেখিত শিরোনামগুলোর উপর আলোচনা শুরু করার আগে আমরা সবাই এ কথার উপর একমত হয়ে যাই যে, আমরা প্রত্যেকটি কথাকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার চেষ্টা করব এবং সে জন্য আল্লাহর কাছে তাওফীক চাইবো।
ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করব। দিক নির্দেশনা নেব। পথ অনুসন্ধানের পদ্ধতি শিখবো। শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয় হওয়ার সূত্রগুলো শিখে নেব। মুনাফিক, মুলহিদ ও যিন্দিকদের ষড়যন্ত্র ও ধোঁকা থেকে নিজে বাঁচার এবং নিজের জাতিকে বাঁচানোর কৌশল শিখবো। কিন্তু সিদ্ধান্ত আমরা কুরআন ও হাদীস থেকেই নেব। অর্থাৎ শরীয়তের দলীল এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীন থেকেই নেব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আমাদের দায়িত্ব কী?
আমাদের আজকের প্রথম দায়িত্ব সেটিই যা ঐ যামানায় শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রহিমাহুল্লাহ এবং সে যামানার অন্য রাহবারগণ আদায় করেছেন। অর্থৎ এই দেশগুলোর শরয়ী অবস্থান দলীলের আলোকে সবার সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরা। এমনিভাবে সাইয়েদ আহমাদ বেরেলভী রহিমাহুল্লাহ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ রহিমাহুল্লাহ যে দায়িত্ব আদায় করেছিলেন, সে দায়িত্বই আজ মুসলমানদের উপর অর্পিত। অর্থাৎ যতটুকু সামর্থ্য আছে শত্রুর মোকাবেলায় ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ততটুকুকে সাজিয়ে নেয়া। কার্যকরভাবে জিহাদের জন্য নগদেই ফিকির শুরু করা এবং একটি সফল জিহাদের জন্য যে যে প্রস্তুতি নেয়া জরুরি সেসব প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এখন আমরা এগুলোর কিঞ্চিৎ বিবরণ তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।
প্রথম দায়িত্ব:
দখলদার শত্রু ও তাদের দালালদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া দারুল ইসলাম পুনরুদ্ধার করা
ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পাঠ থেকে আমাদের সামনে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ভারত উপমহাদেশ একবার দারুল হারব হয়ে যাওয়ার পর তা আর দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হতে পারেনি। যেসকল পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে এ ভূখণ্ডকে দারুল হারব সাব্যস্ত করা হয়েছিল, হুবহু সে অবস্থা ও প্রেক্ষাপটই এখনও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বিরাজ করছে। সে কারণে দারুল ইসলাম পুনরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মুসলমানদের উপর ফরয। আর তা করতে গিয়ে যে যে বাধা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে সেগুলো দূর করার জন্য জিহাদ করাও মুসলমানদের উপর ফরয। আর এ জিহাদ যেহেতু নিজেদের ভূমিকে পুনরুদ্ধারের জিহাদ, সেহেতু এটি একটি দিফায়ী ফরযে আইন জিহাদ।
এই বিষয়ের দলীলগুলো দেখার আগে ভূমিকা হিসাবে কিছু কথা তুলে ধরা হয়েছিল, সেগুলোর উপর আরেকবার নযর বুলিয়ে নিন এবং সে কথাগুলো নিয়ে আরেকটু ফিকির করুন।
মাজমাউল আনহুর শরহু মুলতাকাল আবহুর -এর ইবারত দেখুন-
)فإن هجم) أي: غلب (العدو) أي: على بلد من بلاد الإسلام، أو ناحية من نواحيها.
وفي المغرب الهجوم الإتيان بغتة، والدخول من غير استئذان (ففرض عين فتخرج المرأة، والعبد بلا إذن الزوج، والمولى)؛ لأن المقصود لا يحصل إلا بإقامة الكل فيفرض على الكل وحق الزوج، والمولى لا يظهر في حق فروض الأعيان، وكذا يخرج الولد بغير إذن والديه، والغريم بغير إذن دائنه وإن الزوج، والمولى إذا منعا أثما.
وفي البحر امرأة مسلمة سبيت بالمشرق وجب على أهل المغرب تخليصها ما لم تدخل حصونهم وحرزهم قال في الذخيرة إذا جاء النفير إنما يصير فرض عين على من يقرب من العدو وهم يقدرون على الجهاد فأما من وراءهم يبعد من العدو، فإن كان الذين هم بقرب العدو عاجزين عن مقاومة العدو القادرين إلا أنهم لا يجاهدون لكسل بهم، أو تهاون افترض على من يليهم فرض عين، ثم من يليهم كذلك حتى يفترض على هذا التدريج على المسلمين كلهم شرقا وغربا انتهى. (مجمع الأنهر في شرح ملتقى الأبحر، أحكام الجهاد)
অনুবাদ: “(যদি আক্রমণ করে) অর্থাৎ জয় লাভ করে (শত্রু) অর্থাৎ দারুল ইসলামের কোনো শহরের উপর, অথবা দারুল ইসলামের কোনো অংশের উপর।
‘মুগরিব’ কিতাবে আছে, الهجوم এর অর্থ হচ্ছে, হঠাৎ চড়াও হওয়া এবং অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা। (তখন ফরয আইন। সুতরাং মহিলা ও গোলাম নিজেদের স্বামী ও মনিবের অনুমতি ছাড়া বের হয়ে যাবে।) কেননা সবার অংশগ্রহণ ছাড়া উদ্দেশ্য আদায় হবে না। তাই সবার উপর ফরয হয়ে যাবে এবং স্বামী ও মনিবের অধিকার ফরযে আইন বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার প্রভাব ফেলবে না। এমনিভাবে ছেলে তার বাবার অনুমতি ছাড়া, ঋণী ব্যক্তি ঋণদাতার অনুমতি ব্যতীত বের হয়ে যাবে। স্বামী ও মনিব যদি বাধা দেয় তা হলে তারা গুনাহগার হবে।
‘বাহর’ কিতাবে আছে, যদি কোনো মুসলিম নারী পূর্ব প্রান্তে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে যায়, তা হলে তাকে ছাড়িয়ে আনা পশ্চিম প্রান্তের মুসলিমদের উপর ওয়াজিব। যতক্ষণ না ঐ মহিলা তাদের কেল্লায় কিংবা তাদের সংরক্ষিত সীমানায় প্রবেশ করে। ‘যখীরাহ’ কিতাবে আছে, যখন ‘নফীরে আম’ হবে তখন যারা শত্রুর কাছে থাকবে তাদের উপর ফরযে আইন হয়ে যাবে, যদি তাদের জিহাদ করার মতো শক্তি থাকে। আর শত্রু থেকে দূরে অবস্থানকারী মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে, শত্রুর নিকটবর্তী মুসলিমরা যদি শত্রু প্রতিরোধে অক্ষম হয়ে যায়, অথবা প্রতিরোধ করতে সক্ষম, কিন্তু অলসতা ও গাফলতের কারণে জিহাদ না করে, তখন তাদের পরবর্তী নিকটবর্তীদের উপর জিহাদ করা ফরয হয়ে যাবে। অতঃপর তৎপরবর্তী যারা নিকটে তাদের উপর। এরকমভাবে পূর্ব পশ্চিমে বসবাসকারী সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরয হয়ে যাবে।”
ইনায়াহ শরহে হিদায়াহ -এর বক্তব্য দেখুন-
ثم الجهاد يصير فرض عين عند النفير العام على من يقرب من العدو وهو يقدر عليه، وأما من وراءهم فلا يكون فرضا عليهم إلا إذا احتيج إليهم، إما لعجز القريب عن المقاومة مع العدو، وإما للتكاسل فحينئذ يفرض على من يليهم ثم وثم إلى أن يفترض على جميع أهل الإسلام شرقا وغربا على هذا التدريج. (العناية شرح الهداية، كتاب السير)
অনুবাদ: “এরপর যখন নফীরে আম হবে তখন যে মুসলমানরা দুশমনের কাছাকাছি হবে এবং তারা দুশমনকে প্রতিহত করতে সক্ষম, তাদের উপর জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যাবে। এছাড়া যারা তাদের থেকে দূরে রয়েছে তাদের উপর ফরয হবে না, যতক্ষণ না তাদের প্রয়োজন পড়ে। যদি কাছের মুসলমানরা তাদের দুর্বলতার কারণে অথবা তাদের অলসতার কারণে দুশমনকে প্রতিহত করতে অক্ষম হয়ে যায়, তাহলে তাদের কাছাকাছি যারা রয়েছে তাদের উপর হয়ে যাবে। এরপর যারা তাদের কাছে রয়েছে তাদের উপর। এরপর তাদের কাছে যারা রয়েছে তাদের উপর। এভাবে পরম্পরায় পূর্ব পশ্চিমের সকল মুসলমানের উপর ফরয হয়ে যাবে।”
‘আল-মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়াইতিয়্যাহ’র ইবারত দেখুন-
إذا استولى الكفار على بقعة من دار الإسلام صار الجهاد فرض عين على جميع أفراد الناحية التي استولى عليها الكفار، رجالا ونساء، صغارا وكبارا، أصحاء ومرضى، فإذا لم يستطع أهل الناحية دفع العدو عن دار الإسلام، صار الجهاد فرض عين على من يليهم من أهل النواحي الأخرى من دار الإسلام، وهكذا حتى يكون الجهاد فرض عين على جميع المسلمين، ولا يجوز تمكين غير المسلمين من دار الإسلام. ويأثم جميع المسلمين إذا تركوا غيرهم يستولي على شيء من دار الإسلام.
……….
ولا يجوز لغير المسلمين دخول دار الإسلام إلا بإذن من الإمام أو أمان في مسلم. ولا يجوز لهم إحداث دور عبادة لغير المسلمين: كالكنائس، والصوامع، وبيت النار …. . (الموسوعة الفقهية الكويتية، في كلمة دار)
অনুবাদ: “যখন কাফেররা দারুল ইসলামের কোনো অংশের উপর চড়াও হবে, তখন যে এলাকার উপর কাফেররা হামলা করেছে সে এলাকার প্রত্যেক মুসলমানের উপর জিহাদ করা ফরযে আইন হয়ে যায়। পুরুষ-নারী, ছোট-বড়, সুস্থ-অসুস্থ সবার উপর। যদি সে এলাকার মুসলমানরা দারুল ইসলাম থেকে শত্রুকে প্রতিহত করতে সক্ষম না হয়, তাহলে তাদের এলাকার সাথে যুক্ত নিকটবর্তী এলাকার মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরয হয়ে যাবে। এভাবে সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরয হয়ে যাবে। আর কাফেরদেরকে দারুল ইসলামে জায়গা করে নেয়ার সুযোগ দেয়া জায়েয নেই। যদি কাফেরদেরকে দারুল ইসলামের কোনো অংশে দখল দেয়ার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে সকল মুসলমান গুনাহগার হবে।
………….
আর অমুসলিমরা ইমামুল মুসলিমীনের অনুমতি ব্যতীত অথবা কোনো মুসলিমের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদান ব্যতীত দারুল ইসলামে প্রবেশ করা জায়েয নেই। এমনিভাবে অমুসলিমরা ইবাদতখানা বানানোও জায়েয নেই। যেমন গির্জা, মন্দির, অগ্নিকুণ্ড ইত্যাদি বানানো …।”
উল্লেখিত উদ্ধৃতিগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী, শত্রু যদি দারুল ইসলামের উপর চড়াও হয়, তাহলে দারুল ইসলামের অধিবাসীদের উপর ওয়াজিব দায়িত্ব হল, শত্রুর মোকাবেলা করে দারুল ইসলামকে পুনরুদ্ধার করা। আর এটি একটি ফরযে আইন দায়িত্ব। এমনিভাবে এ কথাও স্পষ্ট যে, যদি দারুল ইসলামকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে তা শত্রুর হাতে তুলে দেয়া হয়, তা হলে প্রত্যেক মুসলমান গুনাহগার হবে। এ বিষয়ে ফিকহের ইবারত এভাবে এসেছে-
ويأثم جميع المسلمين إذا تركوا غيرهم يستولي على شيء من دار الإسلام
অতএব ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রথম যিম্মাদারী হচ্ছে, ফরযে আইন জিহাদ আদায় করার জন্য ময়দানে নেমে পড়বে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।
এ দেশগুলোর শাসকবর্গ যেহেতু এ দেশগুলোকে দারুল ইসলাম বানাতে প্রস্তুত নয়, সে কারণে এসব দেশের শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করা মুসলমানদের দায়িত্ব। চলমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ব্যতীত আর কোনো পথ খোলা নেই। এ কারণে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরযে আইন।
দ্বিতীয় যিম্মাদারী:
কাফের ও মুরতাদ শাসকদেরকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য জিহাদ করা
উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যদি কোনো কাফের শাসন ক্ষমতার মসনদে বসে যায়, অথবা মুসলিম শাসক কুফরে লিপ্ত হয়, তা হলে সে শাসককে সরিয়ে কোনো মুসলিম শাসককে ক্ষমতার মসনদে বসানো ফরয দায়িত্ব। কাজী ইয়াজ রহিমাহুল্লাহ এর একটি ইবারত দেখুন-
لا خلاف بين المسلمين أنه لا تنعقد الإمامة للكافر، ولا تستديم له إذا طرأ عليه، وكذلك إذا ترك إقامة الصلوات والدعاء إليها، وكذلك عقد جمهورهم البدعة.
وذهب بعض البصريين إلى أنها تنعقد لها وتستديم على التأويل، فإذا طرأ مثل هذا على وال من كفر اْو تغير شرع أو تأويل بدعة، خرج عن حكم الولاية وسقطت طاعته، ووجب على الناس القيام عليه وخلعه، ونصب إمام عدل أو والي مكانه إن اْمكنهم ذلك. (إكمال المعلم شرح صحيح مسلم للقاضي عياض، باب وجوب طاعة الأمراء في غير معصية)
অনুবাদ: “মুসলমানদের মাঝে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, কাফেরের জন্য ইমামত তথা শাসন ক্ষমতা সাব্যস্ত হয় না। আর কোনো মুসলিম শাসক শাসক হিসাবে বহাল থাকে না, যখন তার মাঝে কোনো কুফর প্রকাশ পায়। এমনিভাবে যখন নামায প্রতিষ্ঠা করা এবং নামাযের দিকে আহ্বান করা ছেড়ে দেয়, তখন তার জন্য ইমামত তথা শাসন ক্ষমতা সাব্যস্ত হয় না। এরকমভাবে বিদআতের ক্ষেত্রেও অধিকাংশের মত এটাই।
কোনো কোনো বসরী উলামায়ে কেরামের মতে তাবীল তথা ব্যাখ্যা সাপেক্ষে বিদআতীর জন্য ইমামত তথা শাসন ক্ষমতা সাব্যস্ত হবে এবং তা বহাল থাকবে। অতএব এরকম কুফর কিংবা শরীয়তের বিধান পরিবর্তন করে দেয়া, অথবা বিদআতের ব্যাখ্যা করার প্রবণতা কোনো মুসলিম শাসকের মাঝে পাওয়া গেলে, সে শাসক ক্ষমতা থেকে বের হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্য বহাল থাকবে না। মুসলমানরা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং তার জায়গায় একজন ইনসাফগার শাসককে বসানো ওয়াজিব হয়ে যাবে, যদি তা তাদের দ্বারা সম্ভব হয়।”
কাজী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ এখানে সর্বসম্মত মত উল্লেখ করেছেন যে, যদি কাফের শাসক মুসলমানদের উপর ক্ষমতা দখল করে বসে, অথবা মুসলিম শাসক কুফর করে বসে, তা হলে তাকে সরিয়ে কোনো মুসলিম শাসককে শাসন ক্ষমতায় বসানো মুসলমানদের উপর ফরয। আর এ কথা স্পষ্ট যে, কোনো কাফের অথবা মুরতাদ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা সশস্ত্র কার্যক্রম ছাড়া সম্ভব নয়। সে কারণে ফলাফল দাঁড়ায়, এ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরয। ভারত উপমহাদেশের শাসকরা কাফের কিংবা মুরতাদ হওয়ার বিষয়ে এ নিবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আলোচ্য বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার কারণে সে বিষয়টির প্রতি সংক্ষেপে ইঙ্গিত করে যাচ্ছি-
ভারতের শাসক মূল থেকেই কাফের। প্রকাশ্য মুশরিক। তার কুফরের বিষয়ে সন্দেহ করা কুফর। কাফেরকে কাফের মনে করা ফরয। আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শাসকরা জন্মগতভাবে মুসলমান থেকে থাকলেও তারা মুরতাদ হয়ে গেছে। যদিও তারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে প্রকাশ করে এবং ইসলামের কিছু বিধানের উপর আমলও করে। তারা মুরতাদ কারণ, তাদের মাঝে স্পষ্ট কুফর রয়েছে। সলফ ও খলফ তথা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যদি কোনো শাসক দেশ পরিচালনা করার জন্য ইসলামী শরীয়ত তথা কুরআন সুন্নাহকে অর্থাৎ আল্লাহর বিধানকে সংবিধান হিসাবে গ্রহণ না করে এবং তৎপরিবর্তে গায়রুল্লাহর বিধানকে গ্রহণ করে, তাহলে সে কাফের। এ বিষয়ে আপনি সলফ ও খলফের কিছু বক্তব্য দেখুন-
হাকীমুল উম্মত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভী রহিমাহুল্লাহ লিখেন-
أمر مخل بالإمامت
০১. اختياري يعني خلع بلا سبب.
০২. غير اختياري، مثل مرض مانع عن العمل وأسر ممتد، وعجز عن العمل.
০৩. كفر.
০৪. غير متعدي إلى الغير، مثل شرب خمر وغيره.
০৫. متعدي، يعني ظلم بأخذ الأموال اجتهادي.
০৬. متعدي، يعني ظلم بأخذ الأموال غير اجتهادي.
০৭. بالإكراه على المعصية.
قسم ثالث: نعوذ بالله كافر هو جاوئے خواه بكفر تكذيب وجحود وخواه بكفر عناد ومخالفت وخواه بكفر استخفاف واستقباح امور دين۔ ّ (امداد الفتاوى، جلد ৫، ص ১২৯)
قسم ثالث كا حكم: حكمران معزول هو جاوے گا، اگر جدا نه هو تو (مسلمانوں پر) بشرط قدرت جدا كر دينا على الاطلاق واجب هے۔ لقوله في العبارة الثالثة كالردة۔ مگر اس ميں شرط يه هے كه وه كفر متفق عليه هو، بدليل الحديث الأول كفرا بواحا عندكم من الله فيه برهان مع انضمام الإجماع المذكور سابقا۔ اور جس طرح اس كا كفر هونا قطعي هو اسي طرح اس كا صدور بھي يقيني هو، مثل رؤت عين كے، نه كه محض روايات ظنيه كے درجه ميں، كما دل عليه قوله عليه السلام : إلا أن تروا، المراد رؤية العين، بدليل تعديته إلى مفعول واحد۔ (إمداد الفتاوى، جلد ৫، ص ১৩৩)
অনুবাদ: “শাসন ক্ষমতায় বাধাদানকারী বিষয়সমূহ:
০১. ইখতিয়ারি। অর্থাৎ কোনো কারণ ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত করা।
০২. গায়রে ইখতিয়ারি। যেমন, এমন অসুস্থতা যা কাজ করতে বাধাগ্রস্থ করে। দীর্ঘ বন্দী জীবন এবং কাজ করতে অক্ষম হওয়া।
০৩. কুফর।
০৪. অপরকে আক্রান্ত করে না এমন। যেমন মদপান ইত্যাদি।
০৫. অপরকে আক্রান্ত করে এমন। যেমন কারো সম্পদ নিয়ে নেয়ার মাধ্যমে জুলুম। ইজতেহাদী।
০৬. অপরকে আক্রান্ত করে এমন। যেমন কারো সম্পদ নিয়ে নেয়ার মাধ্যমে জুলুম। গায়রে ইজতেহাদী।
০৭. গুনাহ করতে বাধ্য করার কারণে।
তৃতীয় প্রকার: নাউযুবিল্লাহ! কাফের হয়ে যাবে। চাই মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কুফর হোক, অস্বীকার করার কুফর হোক, চাই অবাধ্যতা ও বিরোধিতার কুফর হোক, চাই দীনী বিষয়াবলিকে হেয় ও নিন্দা করার কুফর হোক …..” (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/১২৯)
তৃতীয় প্রকারের হুকুম: শাসক ক্ষতাচ্যুত হয়ে যাবে। যদি সে নিজে নিজে ক্ষমতা ছেড়ে না দেয়, তা হলে মুসলমানদের শক্তি থাকলে সর্বাবস্থায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেয়া ওয়াজিব। لقوله في العبارة الثالثة كالردة এ ইবারতের আলোকে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, কুফরটি সর্বজন স্বীকৃত কুফর হতে হবে। এর দলীল হচ্ছে, প্রথম হাদীস: স্পষ্ট কুফর যা সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে প্রমাণ আছে। এরই সাথে পূর্বে যে ইজমা উল্লেখ করা হয়েছে তা সহ। আর যেমনিভাবে তার ঐ কুফর কুফর হওয়াটা অকাট্য হতে হবে, তেমনিভাবে তা প্রকাশ পাওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত হতে হবে। চোখে দেখার মতো। ধারণা নির্ভর বর্ণনার ভিত্তিতে নয়। এর দলীল হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: ‘তবে যদি তোমরা দেখ…’ উদ্দেশ্য হচ্ছে, চোখের দেখা। এর দলীল হচ্ছে, শব্দটিকে একটি মাফউলের দিকে মুতাআদ্দী করা হয়েছে।” (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/১৩৩)
মুফতী তকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ সাহেব লেখেন-
“اس كے علاوه حضرت حكيم الامت رح فرماتے هيں كه، ايك اور صورت ايسي هے جس ميں امير كا فسق دوسروں تك متعدي هو رها هو، يعني أمير لوگوں كا دين خراب كر رها هو، مثلا لوگوں كو معصيت پر مجبور كر رها هوتو اگر يه عمل كسي ايك يا دو افراد كے ساتھ هوتو اس كا حكم اكراه كا هوگا، اور اكراه كے احكام جاري هوں گے۔ ليكن اگر امير نے اس كو ايك مستقل پاليسي بنا ليا كه وه مستقل طور سے لوگوں كو معصيتوں پر مجبور كرنے لگا هےاور اس ميں غير اسلامي قوانين كو شريعت كے مقابلے ميں زياده بهتر سمجھتا هے تو يه كفر صريح هے اور اگر فوقيت نهيں ديتا ليكن تاويلا (شريعت كي غلط تشريح كر كے) يا تكاسلا (سستي كي بناء پر) اس كو چھوڑا هوا هے تو بھي اگر چه يه كفر صريح نه هو، ليكن كفر كے حكم سے ملحق هو سكتا هے، كيوں كه اس سے شريعت كا استخفاف لازم آتا هے، لهذا اس صورت ميں بھي خروج جائز هے۔” (اسلام اور سياسي نظريات، ص: ৩৬৭)
অনুবাদ: “এছাড়া হযরত হাকীমুল উম্মত রহিমাহুল্লাহ বলেন, আরেকটি সুরত এমন আছে যে ক্ষেত্রে আমীরের অপরাধ ও গুনাহ অন্যদের পর্যন্ত গড়ায়। অর্থাৎ আমীর মানুষের দীন নষ্ট করছে। উদাহরণস্বরূপ, মানুষদেরকে গুনাহ করতে বাধ্য করছে। এক্ষেত্রে এ আচরণটি যদি এক/দুইজনের সাথে হয় তা হলে তা ‘ইকরাহ’ তথা বাধ্য করার হুকুমে হবে এবং ইকরাহের বিধি-বিধান প্রয়োগ হবে। আর যদি আমীর তার এ আচরণকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নীতি হিসাবে গ্রহণ করে, এবং সে নীতির অধীনে মানুষকে গুনাহ করতে বাধ্য করতে শুরু করে। সে ক্ষেত্রে সে অনৈসলামিক আইন কানুনকে শরীয়তের বিপরীতে বেশি উত্তম মনে করে, তা হলে এটা স্পষ্ট কুফর। আর যদি প্রাধান্য না দেয়, কিন্তু তাবীল করে (শরীয়তের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে) অথবা অলসতাবশত (অলসতা করে) তাকে ত্যাগ করে থাকে, সেক্ষেত্রে এটা যদিও স্পষ্ট কুফর নয়, কিন্তু তা কুফরের বিধানের সাথে যুক্ত হতে পারে। কেননা এর দ্বারা শরীয়তকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। তাই এ ক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয।…” (ইসলাম আওর সিয়াসী নযরিয়াত পৃ: ৩৬৭)
মুফতী কেফায়াতুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ এর ফাতওয়া দেখুন-
خلاف شرع حكم كرنے والے حكمران طاغوت هيں، ان كو “اولي الامر” ميں داخل كرنے والے كي امامت نا جائز هے۔
سوال: جو شخص آيت شريفه (وأولي الأمر منكم) كو حكام آئين پر محمول كرتا هو اور حكام آئين موجوده كے حكم كو اس آيت شريفه سے استدلال كركے واجب العمل كهتا هو تو ايسے شخص كا شريعت ميں كيا حكم هے؟ اور اس شخص كے پيچھےنماز پڑھنا جائز هے يا نهيں؟ (المستفتي نمبر ১৪৬২، مولوي محمد شفيع صاحب، مدرس اول مدرسه اسلاميه شهر ملتان، ২৩ ربيع الاول ১৩৫৬ھ، بمطابق ৩ جون ১৯৩৭ع)
جواب: (واولي الأمر منكم) سے علماء يا حكام مسلمين مراد هيں۔ يعني ايسے حكام جو مسلمان هو اور خدا اور رسول صلى الله عليه وسلم كے حكم كے موافق احكام جاري كريں۔ ايسے مسلمان حاكم جو خدا اور رسول كے احكام كے خلاف حكم جاري كريں ( ومن لم يحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون) ميں داخل هيں اور خدا اور رسول كے خلاف حكم جاري كرنے والوں كو قرآن پاك ميں طاغوت فرمايا گيا هے، اور طاغوت كي اطاعت حرام هے۔پس جو شخص ايسے حكام كو جو الهي شريعت اور آسماني قانون كے خلاف حكم كرتے هيں (وأولي الأمر منكم) ميں داخل قرار دے وه قرآن پاك كي نصوص صريحه كي مخالفت كرتا هے۔ انگريزي قانون كے ما تحت خلاف شرع حكم كرنے والے خواه غير مسلم هو خواه نام كے مسلمان؛ طاغوت هيں اور اولي الامر ميں كسي طرح داخل نهيں هو سكتے۔ ان كو اولي الامر ميں داخل كرنے والا يا مجنون هے يا جاهل هے يا فاسق، اور ايسي حالت ميں اس كو مقتدا بنانا اور امام مقرر كرنا نا جائز هے۔ فقط محمد كفايت الله كان الله له۔ (كفاية المفتي، جلد১، ص১৩৯)
অনুবাদ: “শরীয়তের খেলাফ শাসনকারী শাসক তাগুত। তাকে যারা ‘উলুল আমর’ এর অন্তর্ভুক্ত মনে করবে তাদের ইমামতি করা নাজায়েয।
প্রশ্ন: যারা পবিত্র আয়াতে কারীমা وأولي الأمر منكم কে চলমান আইনের শাসকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এবং এ আয়াতের আলোকে দলীল দিয়ে চলমান মানবরচিত আইনের শাসকদের হুকুমকে মান্য করা ওয়াজিব বলে, এমন ব্যক্তির শরয়ী হুকুম কী এবং এমন ব্যক্তির পেছনে নামায পড়া জায়েয আছে? নাকি নেই? (মুস্তাফতী নম্বর ১৪৬২, মৌলভী মুহাম্মদ শফী সাহেব, মুদাররিসে আউয়াল, মাদরাসায়ে ইসলামিয়া, মুলতান শহর, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৩৫২হি: মোতাবেক ৩জুন ১৯৩৭খ্রি.)
উত্তর:
(وأولي الأمر منكم) দ্বারা উলামা অথবা মুসলিম শাসক উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন শাসক যারা মুসলমান হবে এবং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করবে। আর এমন শাসক যে আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের বিপরীত হুকুম জারি করে, তা হলে সে (ومن لم يحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون) এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের বিপরীত বিধান যারা জারি করে কুরআন পাকে তাদেরকে তাগুত বলা হয়েছে, আর তাগুতের আনুগত্য হারাম।
অতএব ইলাহী শরীয়ত ও আসমানী বিধানের বিপরীত শাসনকারী শাসককে যারা (وأولي الأمر منكم) এর অন্তর্ভুক্ত বলে সাব্যস্ত করে, তারা কুরআন পাকের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধিতা করে। ইংরেজদের আইনের অধীনে শরীয়তের খেলাফ শাসনকারী ব্যক্তি, চাই গায়রে মুসলিম হোক কিংবা নামের মুসলিম হোক, সর্বাবস্থায় সে তাগুত, সে কোনো অবস্থায় (وأولي الأمر منكم) এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাদেরকে যারা (وأولي الأمر منكم) এর অন্তর্ভুক্ত মনে করে তারা হয়ত পাগল, নয়ত মূর্খ, নয়ত ফাসেক। এমতাবস্থায় তাকে মুকতাদা ও অনুসরণীয় বানানো এবং তাকে ইমাম বানানো জায়েয নেই। -মুহাম্মদ কেফায়াতুল্লাহ, আল্লাহ তাঁর পক্ষে। (কেফায়াতুল মুফতী ১/১৩৯)
মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহিমাহুল্লাহ এর ফাতওয়া
سوال: حكومت برما اپنے مسلم باشندوں پر ظلم كر رهي هے حتى كه ان كے مذهبي احكام پر پابندي لگا رهي هے، فرائض شرعيه كي ادائيگي ميں مانع هو رهي هے، دريں حالات مسلم باشندوں پر ايسي حكومت سے جهاد كرنا فرض هے يا نهيں؟ نيز اموال زكوة كے ذريعےايسے مجاهدين كي مدد كي جا سكتي هے يا نهيں؟ بينوا تؤجروا۔
الجواب باسم ملهم الصواب: ان حالات ميں ايسي حكومت كافره سے جهاد كرنافرض هے، اس مقصد كے ليے ايسي نتظيم ضروري هے جو علمائے ماهرين، متقنين و أهل بصيرت كي نگراني ميں حدود شريعت كے اندر كام كرے، دوسرے ممالك كے مسلمانوں پر بھي بالترتيب الاقرب فالأقرب تعاون كرنا فرض هے، اور جهاد كي استطاعت نه هو تو وهاں سے هجرت كرنا فرض هے۔ (أحسن الفتاوى، ج৬، ص ২৮)
অনুবাদ: “প্রশ্ন: বার্মা হুকুমত তাদের মুসলিম অধিবাসীদের উপর জুলুম করছে, এমন কি তাদের ধর্মীয় বিধি-বিধানের উপরও পাবন্দি লাগিয়ে দিচ্ছে। শরয়ী ফরয দায়িত্বসমূহ আদায় করার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এমন শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরয কিনা? এমনিভাবে যাকাতের মাল দ্বারা এমন মুজাহিদীনকে সাহায্য করা যাবে কিনা?
উত্তর: এমন পরিস্থিতিতে এমন কাফের হুকুমতের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয। আর এ উদ্দেশ্যে এমন একটি সংগঠন থাকা জরুরি যা অভিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম, বলিষ্ঠ ও দূর দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের তত্ত্বাবধানে শরীয়তের সীমানার মধ্যে থেকে কাজ করবে। অন্যান্য দেশের মুসলমানদের উপর ধারা পরম্পরা নিকটবর্তী হিসাবে সাহায্য করা ফরয। আর যদি জিহাদ করার মতো শক্তি না থাকে, তা হলে হিজরত করা ফরয।” (আহসানুল ফাতাওয়া ৬/২৮)
ইবনে কাসীরের সুস্পষ্ট বক্তব্য:
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট কথা বলেছেন। তিনি أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ এ আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় লিখেন-
وقوله: {أفحكم الجاهلية يبغون ومن أحسن من الله حكما لقوم يوقنون} ينكر تعالى على من خرج عن حكم الله المحكم المشتمل على كل خير، الناهي عن كل شر وعدل إلى ما سواه من الآراء والأهواء والاصطلاحات، التي وضعها الرجال بلا مستند من شريعة الله، كما كان أهل الجاهلية يحكمون به من الضلالات والجهالات، مما يضعونها بآرائهم وأهوائهم، وكما يحكم به التتار من السياسات الملكية المأخوذة عن ملكهم جنكزخان، الذي وضع لهم اليساق وهو عبارة عن كتاب مجموع من أحكام قد اقتبسها عن شرائع شتى، من اليهودية والنصرانية والملة الإسلامية، وفيها كثير من الأحكام أخذها من مجرد نظره وهواه، فصارت في بنيه شرعا متبعا، يقدمونها على الحكم بكتاب الله وسنة رسوله صلى الله عليه وسلم. ومن فعل ذلك منهم فهو كافر يجب قتاله، حتى يرجع إلى حكم الله ورسوله [صلى الله عليه وسلم] فلا يحكم سواه في قليل ولا كثير. (تفسير القرآن العظيم، ابن كثير)
অনুবাদ: “(এ আয়াতে কারীমা) ‘তারা কি জাহিলিয়াতের ফায়সালা চায়? আর আল্লাহর বিধান (ফায়সালা) এর চাইতে উত্তম আর কার বিধান হতে পারে সেসব লোকদের জন্য যারা বিশ্বাস করে’। আল্লাহ তাআলা সেসব লোকের কর্মপন্থার অসারতা বর্ণনা করছেন, যারা আল্লাহর বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যে বিধানে সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং যা সব ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত। এমন পবিত্র বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে রায় কিয়াসের দিকে, মনস্কমনার দিকে এবং সেসব বিধানের প্রতি ঝুঁকেছে যারা কোনো প্রকার শরয়ী দলীলের তোয়াক্কা না করে নিজের পক্ষ থেকে বিধান তৈরি করে নিয়েছে। যেমনিভাবে জাহেলী যুগের মানুষ নিজেদের মূর্খতা ও গোমরাহি, নিজেদের মত ও মর্জি অনুযায়ী বিধি-বিধান জারি করে ফেলত। আর যেমনিভাবে তাতারীরা রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে চেঙ্গিস খানের দেয়া বিধি-বিধানের অনুসরণ করত। যে তাদের জন্য ‘ইয়াসাক’ তৈরি করেছিল। আর তা হচ্ছে কিছু বিধি-বিধানের সমষ্টি যা সে ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্ম থেকে সংগ্রহ করেছে। আর তাতে অনেক বিধান এমন রয়েছে যা সে শুধুই নিজের চিন্তা-ভাবনা ও মনস্কামনা থেকে গ্রহণ করেছে। তখন তা তার বংশধরদের মাঝে অনুসৃত বিধান হিসাবে গৃহীত হয়েছে, যাকে তারা আল্লাহর কিতাবের বিধান এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহের উপর প্রধান্য দিতো। তাদের মধ্য থেকে যেই এ কাজ করবে সেই কাফের, তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা ওয়াজিব, যতক্ষণ না সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানের দিকে ফিরে আসে এবং ছোট বড় সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কোনো বিধানকে গ্রহণ না করে।”
সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ তিনটি দেশ (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) এর শাসকবর্গ হয়ত জন্মগতভাবে কাফের, অথবা তারা মুরতাদ। উভয় অবস্থায় তাদেরকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে কোনো মুসলমানকে শাসক বানানো মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। আর এর জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি তা গ্রহণ করা ফরয। যেহেতু জিহাদ ব্যতীত এ উদ্দেশ্য হাসেল করা সম্ভব নয়, সেহেতু উপমহাদেশের কাফের ও মুরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরয।
যদি কেউ এ মাসাআলায় দ্বিমত করেন এবং মুসলিম দাবিদার শাসকদেরকে কাফের মানতে প্রস্তুত না হন, তা হলে এ জাতীয় দ্বিমতের কারণে এসকল শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয হওয়ার মাসআলায় কোনো প্রকার প্রভাব পড়ে না। ভারতের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি স্পষ্ট, অতএব ভারতের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরয হওয়ার মাসআলায় তাঁদের কোনো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। আর যেসব শাসক নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করে তাদের বেলায়ও জিহাদ ফরয হওয়ার মাসআলা বরাবর। কেননা তারা খেলাফতে ইসলামিয়া ও ইমারতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠার পথে বাধা প্রদানকারী। আর আল্লাহ বিধান বাস্তবায়ন করার পথে যে বাধা হবে, তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয। অতএব এসকল শাসকের বিরুদ্ধেও জিহাদ করা ফরয হওয়ার মাসাআলায় এ সকল দ্বিমতকারী ব্যক্তিবর্গ জিহাদের মাসআলায় দ্বিমত না করা চাই।
সাম্প্রতিককালে আপনারা আশা করি দেখেছেন, আফগানিস্তানে আমেরিকান শয়তানদের থেকে মুক্ত হওয়ার চুক্তির (দোহা চুক্তির) ফলাফলে যুদ্ধবিরতির পরও ইমারাতে ইসলামিয়ার মুজাহিদীন জিহাদ বন্ধ করেননি। অথচ তাদের যুদ্ধ এমন সব লোকের সাথে চলছিল যারা নিজেদেরকে মুসলমান হিসাবে প্রকাশ করে। এ লড়াই সম্পর্কে তালেবান মুজাহিদীনের বক্তব্য এটাই ছিল যে, ইমারাতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত ইমরাতে ইসলামিয়া মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ চলতে থাকবে। আর এ জিহাদ সেসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যারা ইমরাতে ইসলামিয়ার জন্য বাধা।
আশা করি আপনাদের এ কথাও জানা আছে যে, আফগান জাতীয় সেনাদলের বিরুদ্ধে তালেবানের এ লড়াইকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম সমর্থন করেছেন। মুফতী তাকী উসমানী সাহেবসহ অন্যান্য উলামায়ে কেরাম আফগান বাহিনীকে কাফের মনে না করলেও তাদের বিরুদ্ধে তালেবানের লড়াইকে অবশ্যই সমর্থন করেন। অতএব বোঝা যাচ্ছে, ইসলামের দাবিদার শাসকদেরকে তাকফীর করার ক্ষেত্রে যারা দ্বিমত করেন, তাঁরাও এ কথা মানতে হবে যে, এ সকল শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয।
তৃতীয় যিম্মাদারী: খেলাফতে ইসলামিয়া ও ইমারাতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা
মুসলমান যখন সামষ্টিকভাবে একটি ভূখণ্ডে বসবাস করে, তখন তাদের সামষ্টিক একটি রূপও হয়, আর সে সামষ্টিক অবস্থানের উপর শরীয়তের কিছু বিধি-বিধানও আরোপ হয়, যাকে শরীয়াহ বাস্তবায়ন কিংবা ইমারাত প্রতিষ্ঠা বলে প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়টিকে কুরআন, হাদীস ও ফিকহ যেভাবে মূল্যায়ন করে তা খুবই সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
কুরআন কী বলে?
মানবজাতির অস্তিত্ব, আল্লাহর বিধান প্রয়োগের যিম্মাদারী, আল্লাহর বিধানের বিজয়, রাসূল প্রেরণের মৌলিক উদ্দেশ্য অন্যান্য ধর্ম ও বিধানের উপর আল্লাহর বিধানের প্রাধান্য দেয়া, মুশরিক কাফের ও মনস্কামনার বিরুদ্ধে আল্লাহর বিধান প্রয়োগ, প্রতিটি ছোট বড় বিষয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর হাকিমিয়্যাত, রাসূলের খেলাফত ও উম্মতের প্রতিনিধিত্ব এবং আল্লাহর বিধান থেকে বিমুখ হওয়ার ফলাফলের বিবরণ ইত্যাদি। এগুলো এমন কিছু বিষয় যেগুলোর প্রতি কুরআন কারীম বার বার বিভিন্নভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং এ বিষয়গুলোতে কুরআনের নির্দেশনা খুবই স্পষ্ট ও স্বচ্ছ।
নিচের আয়াতগুলো দেখুন-
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ.
অনুবাদ: “স্মরণ কর যখন তোমার রব ফেরেশতাগণকে বলেছেন, আমি জমিনের বুকে প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি। তারা বললেন, আপনি জমিনে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং রক্ত ঝরাবে? অথচ আমরা আপনার তাসবীহ ও হামদ করছি এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। তিনি বলেন, আমি জানি যা তোমরা জান না।” -সূরা বাকারা ০২:৩০
তাফসীরে জালালাইনে এসেছে-
{و} اذكر يا محمد {إذ قال ربك للملائكة إني جاعل في الأرض خليفة} يخلفني في تنفيذ أحكامي فيها
অনুবাদ: “(আর) স্মরণ কর হে মুহাম্মাদ (যখন তোমার রব্ব ফেরেশতাদেরকে বলেছেন, আমি জমিনের বুকে খলীফা বানাতে যাচ্ছি) যারা জমিনের বুকে আমার বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করবে।”
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ.
অনুবাদ: “ঐ আল্লাহ তিনিই তো যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য ধর্ম নিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ দীনকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করেন, চাই মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক।” -সূরা তাওবা ০৯:৩৩
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا.
অনুবাদ: “ঐ আল্লাহ তিনিই তো যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য ধর্ম নিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ দীনকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করেন, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।” -সূরা ফাতহ ৪৮:২৮
وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ.
অনুবাদ: “আপনি তাদের মাঝে ফায়সালা করুন ঐ (শরীয়ত) অনুযায়ী যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন এবং তাদের মনস্কামনার অনুসরণ করবেন না। আর আপনি সতর্ক থাকুন, যেন আল্লাহ আপনার প্রতি যা নাযিল করেছেন তার কোনো কিছু থেকে তারা আপনাকে বিচ্যুত করতে না পারে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তা হলে আপনি জেনে রাখুন, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কোনো গুনাহের শাস্তি দিতে চাচ্ছেন। আর অধিকাংশ মানুষ ফাসেক ও নাফরমান।” -সূরা মায়েদা ০৫:৪৯
فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ.
অনুবাদ: “(তখন তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল) তোমরা মানুষকে ভয় করো না, তোমরা আমাকে ভয় কর। আর তোমরা সামান্য মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াতগুলো বিক্রয় করে দিও না। আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না তারাই তো কাফের।” -সূরা মায়েদা ০৫:৪৪
হাদীসের নির্দেশনা
এমনিভাবে হাদীসে নববীতে খেলাফত ও ইমারাতে ইসলামিয়ার এমন প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে, যা সামনে রাখার পর উম্মতের জন্য কোনো প্রকার সন্দেহ সংশয়ের বিন্দুমাত্র বাকি থাকে না।
আমীর ও খলীফার গুণাগুণ, ইমামের যিম্মাদারী, রাজনীতি তথা পরিচালনার পদ্ধতি, আনুগত্যের ধরন, রাজনীতি তথা পরিচালনা ও আনুগত্যের গুরুত্ব, পরিচালনার দায়িত্ব থেকে দূরে থাকা ও আনুগত্য না করার উপর ধমকি, আমীরের জন্য পরিচালনার সীমারেখা, অধীনস্থদের জন্য আনুগত্যের সীমারেখা, ইজতিমায়ী ও সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব, আমীর ব্যতীত সামষ্টিক জীবনের ধারণা অসম্ভব হওয়া, খেলাফত, বাইয়াত, বাইয়াত রক্ষা করা, বিদ্রোহ করা ওয়াজিব হওয়া, জায়েয হওয়া ও হারাম হওয়া ইত্যাদি রাজনৈতিক তথা উম্মতকে পরিচালনা বিষয়ে হাদীসের কিতাবাদিতে আলাদা আলাদা অধ্যায়সমূহ রয়েছে। মোটকথা, হাদীসে নববীতে সিয়াসত তথা উম্মতকে পরিচালনা করার এমন কোনো দিক অস্পষ্ট অথবা গুরুত্বহীনভাবে রেখে দেয়া হয়নি যা নিয়ে আমরা এখন সন্দেহ কিংবা সংশয়ে পড়তে হবে। ফালিল্লাহিল হামদ। সম্মানিত পাঠকবর্গ নিচে উল্লেখিত হাদীসগুলো দেখতে থাকুন এবং বাস্তব অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে থাকুন-
عن أبي هريرة رضي الله عنه: أنه سمع رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول: من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقد عصى الله ومن يطع الأمير فقد أطاعني ومن يعص الأمير فقد عصاني وإنما الإمام جنة يقاتل من ورائه ويتقى به فإن أمر بتقوى الله وعدل فإن له بذلك أجرا وإن قال بغيره فإن عليه منه. (صحيح البخاري، كتاب الجهاد والسير، باب يقاتل من وراء الإمام ويتقى به)
অনুবাদ: “আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল, আর যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহর সঙ্গে অবাধ্যতা করল। আর যে আমীরের আনুগত্য করল সে আমার আনুগত্য করল, যে আমীরের অবাধ্যতা করল সে আমার অবাধ্যতা করল। ইমাম হচ্ছে ঢাল। তার অধীনে থেকে যুদ্ধ করা হবে এবং তার মাধ্যমেই আত্মরক্ষা করা হবে। অতএব আমীর যদি আল্লাহর ভয় ও ইনসাফের হুকুম করে তা হলে সে এর বিনিময় পাবে। আর যদি এর বিপরীত কিছু বলে তা হলে তার বোঝাও তার উপর চাপানো হবে।”
عن أم الحصين قالت: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إن أمر عليكم عبد مجدع يقودكم بكتاب الله فاسمعوا له وأطيعوا. (صحيح مسلم، كتاب الإمارة، باب وجوب طاعة الأمراء في غير معصية وتحريمها في معصية)
অনুবাদ: “উম্মে হুসাইন থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি তোমাদের উপর কোনো নাক কাটা গোলামকেও আমীর বানিয়ে দেয়া হয়, যে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাবের আলোকে পরিচালনা করে, তা হলে তোমরা তার কথা শোন এবং তার আনুগত্য কর।”
نافع عن عبد الله رضي الله عنه: عن النبي صلى الله عليه و سلم قال (السمع والطاعة على المرء المسلم فيما أحب وكره ما لم يؤمر بمعصية فإذا أمر بمعصية فلا سمع ولا طاعة. (صحيح البخاري، كتاب الجهاد والسير، باب السمع والطاعة للإمام، وصحيح مسلم، كتاب الإمارة، باب وجوب طاعة الأمراء في غير معصية وتحريمها في معصية)
অনুবাদ: “আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পছন্দ অপছন্দ সকল অবস্থায় মুসলিম ব্যক্তির উপর শোনা ও আনুগত্য করা ওয়াজিব, যতক্ষণ না সে গুনাহের আদেশ দেয়। আর যখন গুনাহের আদেশ দেবে তখন তার কথা শোনাও হবে না এবং তার আনুগত্যও করা হবে না।”
وعن عبادة بن الصامت قال: بايعنا رسول الله صلى الله عليه وسلم على السمع والطاعة في العسر واليسر والمنشط والمكره وعلى أثرة علينا، وعلى أن لا ننازع الأمر أهله، وعلى أن نقول بالحق أينما كنا لا نخاف في الله لومة لائم. وفي رواية: وعلى أن لا ننازع الأمر أهله إلا أن تروا كفرا بواحا عندكم من الله فيه برهان. (المصدر السابق)
অনুবাদ: “উবাদাহ ইবনে সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে এ বিষয়গুলোর উপর বাইয়াত হয়েছি: শোনা ও আনুগত্য করা, কঠিন অবস্থায় এবং সহজ অবস্থায়, পছন্দনীয় ক্ষেত্রে, অপছন্দনীয় ক্ষেত্রে এবং আমাদের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রেও। খেলাফত ও ইমারতের বিষয়ে আমরা যেন শাসকদের সাথে লড়াই ঝগড়া না করি। যেখানেই হোক আমরা যেন সত্য কথা বলি, আল্লাহর বিষয়ে আমরা কোনো নিন্দাকারীর নিন্দাকে যেন ভয় না করি।
অপর এক বর্ণনায় আছে, আমরা যেন শাসকদের সাথে শাসন ক্ষমতা নিয়ে লড়াই না করি, তবে যদি তোমরা স্পষ্ট কুফর দেখ, যার পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে প্রমাণ আছে।”
وعن ابن عباس قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من رآى أميره يكرهه فليصبر، فإنه ليس أحد يفارق الجماعة شبرا فيموت إلا مات ميتة جاهلية. (صحيح البخاري، كتاب الأحكام، باب السمع والطاعة للإمام ما لم تكن معصية)
অনুবাদ: “ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে দেখে তার আমীর তাকে তার অপছন্দনীয় কোনো কাজে বাধ্য করছে সে যেন তার উপর সবর করে। কেননা যে জামাত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরত্বে অবস্থান করবে এবং ঐ অবস্থায় সে মারা যায় তাহলে সে জাহেলী মৃত্যুবরণ করল।”
وعن عبد الله بن عمر قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: من خلع يدا من طاعة لقي الله يوم القيامة ولا حجة له، ومن مات وليس في عنقه بيعة مات ميتة جاهلية. (المصدر السابق)
অনুবাদ: “আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আল্লাহর মুখোমুখি হবে যে, তার পক্ষে কোনো দলীল থাকবে না। আর যে ব্যক্তি ইমামুল মুসলিমীনের হাতে বাইয়াত না করা অবস্থায় মারা গেল, সে জাহেলি মৃত্যুবরণ করল।”
وعن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: كانت بنو إسرائيل تسوسهم الأنبياء كلما هلك نبي خلفه نبي وإنه لا نبي بعدي وسيكون خلفاء فيكثرون. قالوا فما تأمرنا؟ قال: فوا ببيعة الأول فالأول أعطوهم حقهم فإن الله سائلهم عما استرعاهم. (صحيح البخاري، كتاب الأنبياء، باب ما ذكر عن بني إسرائيل)
অনুবাদ: “আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের শাসন ক্ষমতা নবীগণ পরিচালনা করতেন। এক নবীর মৃত্যুর পর আরেক নবী আসতেন। আর আমার পর কোনো নবী আসবেন না। আমার পর খলীফাগণ হবে এবং তাঁরা অনেক হবে। সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহ আনহুম জিজ্ঞেস করলেন, সে ক্ষেত্রে আপনি আমাদেরকে কী আদেশ করেন? তিনি বলেছেন, প্রথম জনের বাইয়াতকে রক্ষা কর, এরপর পরবর্তী প্রথম জনের বাইয়াতকে রক্ষা কর। তাঁদেরকে তাঁদের হক আদায় করে দাও, কেননা আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে তাঁদের অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন।”
وعن أبي سعيد قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إذا بويع لخليفتين فاقتلوا الآخر منهما. (صحيح مسلم، كتاب الإمارة، باب إذا بويع لخليفتين)
অনুবাদ: “আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন দুই খলীফার হাতে বাইয়াত হবে, তখন তোমরা তাদের দুইজনের শেষে বাইয়াত গ্রহণকারীকে (দ্বিতীয় জনকে) হত্যা করে দাও।”
وعن عبد الله بن عمرو قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من بايع إماما فأعطاه صفقة يده وثمرة قلبه فليطعه إن استطاع، فإن جاء آخرينازعه فاضربوا عنق الآخر. (صحيح مسلم، كتاب الإمارة، باب الوفاء ببيعة الخلفاء الأول فالأول)
অনুবাদ: “আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহ আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো ইমামের হাতে হাত দিয়ে নিষ্ঠার সাথে বাইয়াত হয়েছে, সে যেন যথাসাধ্য তার আনুগত্য করে। এরপর যদি অপর কেউ তার সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে আসে, তা হলে তার গর্দান উড়িয়ে দাও।”
عن الحارث الأشعري قال: قال النبي صلى الله عليه و سلم وأنا آمركم بخمس الله أمرني بهن السمع والطاعة والجهاد والهجرة والجماعة فإن من فارق الجماعة قيد شبر فقد خلع ربقة الإسلام من عنقه إلا أن يرجع ومن ادعى دعوى الجاهلية فإنه من جثا جهنم فقال رجل يا رسول الله وإن صلى وصام ؟ قال وإن صلى وصام. وفي رواية: وزعم أنه مسلم. (سنن الترمذي، كتاب الأمثال عن رسول الله صلى الله عليه و سلم، باب ما جاء في مثل الصلاة والصيام والصدقة، ومسند أحمد في مسند الحارث الأشعري)
অনুবাদ: “হারেস আশআরী রাযিয়াল্লাহ আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে আদেশ করছি, যে পাঁচটি বিষয়ে আল্লাহ আমাকে আদেশ দিয়েছেন। শোনা, আনুগত্য করা, জিহাদ করা, হিজরত করা ও জামাতবদ্ধ থাকা। কেননা যে জামাত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে যাবে, সে তার গলা থেকে ইসলামের বন্ধনকে খুলে রাখলো, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। আর যে জাহেলিয়াতের দিকে ডাকে, সে জাহান্নামীদের একজন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি নামায রোযা আদায় করে তবুও? তিনি বললেন, হ্যাঁ, নামায রোযা করলেও এবং নিজেকে মুসলিম মনে করলেও।”
أبو سعيد الخدري رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إذا خرج ثلاثة في سفر فليؤمروا أحدهم. (سنن أبي داود، كتاب الجهاد، باب في القوم يسافرون يؤمرون أحدهم)
অনুবাদ: “আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তিন জন সফরে বের হবে তখন তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।”
ফিকহ ও ইজতিহাদের সিদ্ধান্ত
উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস থেকে প্রত্যেক জমানার মুজতাহিদ, মুফাসসীর ও মুহাদ্দিস উলামায়ে কেরাম সেসব মাসআলা বের করেছেন তা বিস্তারিত নিম্নরূপ-
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহিমাহুল্লাহ বলেন-
اعلم أنه يجب أن يكون في جماعة المسلمين خليفة لمصالح لا تتم إلا بوجوده، وهي كثيرة جدا يجمعها صنفان:
أحدهما ما يرجع إلى سياسة المدينة من ذب الجنود التي تغزوهم وتقهرهم، وكف الظالم عن المظلوم، وفصل القضايا، وغير ذلك، وقد شرحنا هذه الحاجات من قبل.
وثانيهما ما يرجع إلى الملة، وذلك أن تنويه دين الإسلام على سائر الأديان لا يتصور إلا بأن يكون في المسلمين خليفة ينكر على من خرج من الملة، وارتكب ما نصت على تحريمه أو ترك ما نصت على افتراضه أشد الانكار، ويذل أهل سائر الأديان ويأخذ منهم الجزية عن يد وهم صاغرون، وإلا كانوا متساوين في المرتبة لا يظهر فيهم رجحان إحدى الفرقتين على الأخرى، ولم يكن كابح يكبحهم عن عدوانهم. (حجة الله البالغة، من أبواب سياسة المدن)
অনুবাদ: “জেনে রাখো, মুসলমানদের জামাতে একজন খলীফা থাকা ওয়াজিব, এমন কিছু প্রয়োজনে যা খলীফাতুল মুসলিমীন ব্যতীত সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়, আর সে প্রয়োজনগুলো সংখ্যায় অনেক। এসব মোট দুই প্রকার:
দুই প্রকারের এক প্রকার হচ্ছে, যা রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত। যার মধ্যে রয়েছে সেসব বাহিনীকে প্রতিহত করা, যারা তাদের সঙ্গে লড়াই করে এবং তাদের উপর বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করে। মাজলুম থেকে জালিমের জুলুম দূর করা। আইন-আদালতের বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করা। ইত্যাদি।
আর দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে যা মুসলিম জাতির সাথে সম্পৃক্ত। আর তা হচ্ছে, সকল ধর্মের উপর ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা, মুসলমানদের একজন খলীফা ব্যতীত কল্পনা করা যায় না। কেউ ইসলাম থেকে বের হয়ে গেলে তাকে প্রতিহত করবেন, শরীয়ত যে কাজগুলোকে হারাম করেছে তা কেউ করলে তাকে বাধা দেবেন, শরীয়ত যে কাজগুলোকে ফরয করেছে সেগুলো কেউ ছেড়ে দিলে, তাকে কঠোরভাবে দমন করবেন। অন্যসব ধর্মের অনুসারীদেরকে অপদস্থ করবেন। তাদেরকে লাঞ্ছিত করে তাদের কাছ থেকে জিযিয়া আদায় করবেন। নচেৎ তারা সম্মানের দিক থেকে বরাবর হয়ে যাবে, এক দলের উপর আরেক দলের প্রাধান্য প্রকাশ পাবে না এবং তাদেরকে তাদের সীমালঙ্ঘন থেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো নিয়ন্ত্রণকারী লাগাম থাকবে না।”
ইমাম নসফী রহিমাহুল্লাহ বলেন-
قال النسفي: والمسلمون لا بد لهم من إمام يقوم بتنفيذ أحكامهم، وإقامة حدودهم، وتجهيز جيوشهم وأخذ صدقاتهم، وقهر المتغلبة والمتلصصة وقطاع الطريق، وإقامة الجمع والأعياد، وقطع المنازعات الواقعة بين العباد، وقبول الشهادات القائمة على الحقوق، وتزويج الصغار والصغيرات الذين لا أولياء لهم، وقسمة الغنائم، أي نحو ذلك من الأمور التي لا يتولاها آحاد الأمة. (شرح العقائد النسفية ص: ৯৬-৯৭)
অনুবাদ: “মুসলমানদের জন্য একজন ইমাম থাকা জরুরি, যে সকল বিধি-বিধান বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেবেন, তাদের দণ্ডবিধান করবেন, বাহিনী তৈরি করবেন, সাদাকা উসূল করবেন, জালিম, চোর ও ডাকাতদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, জুমা ও ঈদের নামাযের দায়িত্ব আদায় করবেন, মানুষের মাঝে সংঘটিত ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা করবেন, বিভিন্ন প্রকারের হক পাওনা দেওনার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন, যেসব শিশু, ছেলে-মেয়ের অভিভাবক নেই, তাদেরকে বিয়ে-শাদী দেয়ার দায়িত্ব নেবেন, গনীমতের মাল বণ্টন করবেন। ইত্যাদি এমন সব কাজ উম্মতের ব্যক্তি বিশেষ যার দায়িত্ব নিতে পারে না।”
‘আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু’র ইবারত দেখুন-
وقال الإيجي في المواقف: إن في نصب الإمام دفع ضرر مظنون، وإن دفع هذا الضرر واجب شرعاً. وبيان ذلك أننا نعلم علماً يقارب الضرورة أن مقصود الشارع، فيما شرع من المعاملات، والمناكحات، والجهاد، والحدود والمقاصات، وإظهار شعائر الشرع في الأعياد والجماعات، إنما هو مصالح عائدة إلى الخلق معاشاً ومعاداً، وذلك المقصود لا يتم إلا بإمام يكون من قبل الشارع يرجعون إليه فيما تعين لهم.
وهناك برهان آخر يستتبع القيام بالوظيفة المقدسة للبشر: وهو أن مرفق القضاء الذي تقوم به الدولة أمر ضروري لفض المنازعات الدائمة بين البشر، لا سيما بعد زوال النظام القبلي الذي يحكم فيه رئيس القبيلة بالعرف والهوى الشخصي، وعدم جدوى اللجوء إلى التحكيم إذا تعذر اتفاق المتخاصمين، فلم يبق إلا القضاء الذي يلجأ إلىه كل إنسان بمفرده.
ومهمة القضاء في الإسلام لا تقتصر على إقامة العدل بالمفهوم الإلهي، وفصل الخصومات، وتطبيق أحكام الشريعة، وإنما يشمل كل ما من شأنه رعاية الحرمات الدينية، واحترام الفضيلة، وإقرار المعروف، ومكافحة المنكرات والفواحش بمختلف ألوانها.
فلولا القضاء لاستأصل البشر بعضهم، وهلكوا جميعاً، فكان وجوده رحمة، وتنظيمه فريضة، وقيام الدولة به ووجودها من أجله أمراً محتماً.
وإذا لا حظنا أن مهمة الدولة في الإسلام حراسة شؤون الدين والدنيا، وتحقيق السعادة للبشر في الحياة الدنيا والآخرة، علمنا مدى الأهمية المنوطة بالدولة المستلزمة للسعي الفوري في إيجادها، ولولا ذلك لعمت الفوضى، وشاع الفساد، وانتشر الظلم بين العباد.
والخلاصة: إن تلازم وجود الدولة مع دعوة الإسلام ودين الإسلام أمر لا يمكن فصله في مفهوم إنسان، منذ أن قامت دولة المدينة باعتبارها أول نواة لوجود الدولة بالمعنى الحديث القائم على أركان ثلاثة: هي الشعب، والإقليم (الوطن) والسلطة السياسية أو السيادة.
অনুবাদ: “আলঈজী ‘মাওয়াকেফ’ এ বলেছেন, সম্ভাব্য সকল সমস্যা প্রতিহত করা ইমামুল মুসলিমীন নির্ধারণ করার উপর মওকূফ। আর সমস্যাগুলো এমন যা প্রতিহত করা শরীয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। এর ব্যাখ্যা ও বিবরণ হচ্ছে, আমরা জানি, সকল লেন-দেন, বিবাহ, জিহাদ, দণ্ডবিধি, কিসাস, ঈদ, জামাআতের মাধ্যমে ইসলামের নিদর্শনাবলীর প্রকাশ, এসব কিছুকে বিধিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিধানদাতার এমন কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে, যা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের বিষয়াদির সাথে সম্পর্কযুক্ত। আর এ উদ্দেশ্যগুলো ইমামুল মুসলিমীন ব্যতীত সম্পন্ন হতে পারে না। যে ইমামুল মুসলিমীন বিধানদাতার পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়াদির ক্ষেত্রে সবাই তার শরণাপন্ন হবে।
এখানে আরেকটি দলীল রয়েছে, যা মানুষের একটি পবিত্র যিম্মাদারী বাস্তবায়ন করাকে এর অধীনে নিয়ে আসে, আর তা হচ্ছে আদালতের ব্যবস্থাপনা, যার দ্বারা একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষদের পরস্পরে যেসকল ঝগড়া-বিবাদ চলতেই থাকে, এসব লড়াই ঝগড়া দূর করার জন্য একটি জরুরি বিভাগ হচ্ছে আদালত। বিশেষ করে গোত্রীয় শাসন, যার মধ্যে গোত্রের প্রধান সাধারণ প্রথা প্রচলন এবং নিজের মনস্কামনা অনুযায়ী বিচার করত, তা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিবাদমান দুটি পক্ষ যদি একজন বিচারকের ব্যাপারে একমত না হতে পারে, তাহলে বিচারকের শরণাপন্ন হওয়াটাই বেকার হয়ে যায়। অতএব একটি বিচারালয় ব্যতীত কোনো কিছুই স্বাভাবিক থাকতে পারে না, যে বিচারালয়ে মানুষ যেতে পারে এবং তার আশ্রয় নিতে পারে।
ইসলামে বিচারের যিম্মাদারী শুধু আদল ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, মামলা মুকাদ্দমার ফায়সালা ও শরয়ী বিধি-বিধান বাস্তবায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর মাঝে প্রত্যেক ঐ বস্তু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যার মাঝে দীনের পবিত্রতা রক্ষা এবং মর্যাদাপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দাবি রয়েছে। যার মাঝে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও মনস্কামনার সব ধরনের মূলোৎপাটন রয়েছে।
সুতরাং যদি বিচার ব্যবস্থা না থাকতো, তাহলে মানুষ মানুষকে মূলোৎপাটন করে ছাড়ত এবং সবাই ধ্বংস হয়ে যেত। তাই এ ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব একটি রহমতস্বরূপ, এর ব্যবস্থা করা ফরয, এর মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং এর জন্যই তার অস্তিত্ব একটি অনিবার্য বিষয়।
আর আমরা যখন দেখব, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দুনিয়ার সকল বিষয়াদির প্রহরা দেয়া এবং দুনিয়া ও আখিরাতে মানব জাতির সৌভাগ্যের বার্তা পৌঁছানো, তখন আমরা বুঝতে পারব যে, ইসলামী রাষ্ট ব্যবস্থার প্রয়োজন কতটুকু এবং এর অস্তিত্বের জন্য যে চেষ্টা প্রচেষ্টা করা চাই তা কতটুকু নগদ জরুরি কাজ। যদি এটা না হত তাহলে বিশৃঙ্খলা ব্যাপক হয়ে যেত, ফাসাদ সৃষ্টি হয়ে যেত এবং মানুষদের মাঝে জুলুম অত্যাচার ব্যাপক হয়ে যেত।
মোটকথা, দাওয়াতে ইসলাম ও দীন ইসলামের সাথে রাষ্ট্র ও শাসনের অত্যাবশ্যকীয়তা এমন একটি বিষয় যাকে আলাদা করা মানুষের বিবেকে সম্ভব নয়।”
আল্লামা কাসানী রহিমাহুল্লাহ বলেন-
[كتاب آداب القاضي] [بيان فرضية نصب القاضي]
الكلام في هذا الكتاب في مواضع، في بيان فرضية نصب القاضي، وفي بيان من يصلح للقضاء، وفي بيان من يفترض عليه قبول تقليد القضاء، وفي بيان شرائط جواز القضاء، وفي بيان آداب القضاء، وفي بيان ما ينفذ من القضايا، وما ينقض منها؛ إذا رفع إلى قاض آخر، وفي بيان ما يحله القاضي وما لا يحله، وفي بيان حكم خطأ القاضي في القضاء، وفي بيان ما يخرج به القاضي عن القضاء.
(أما) الأول فنصب القاضي فرض؛ لأنه ينصب لإقامة أمر مفروض، وهو القضاء قال الله سبحانه وتعالى {يا داود إنا جعلناك خليفة في الأرض فاحكم بين الناس بالحق} [ص: ২৬] وقال تبارك وتعالى لنبينا المكرم عليه أفضل الصلاة والسلام: {فاحكم بينهم بما أنزل الله} [المائدة: ৪৮] والقضاء هو: الحكم بين الناس بالحق، والحكم بما أنزل الله عز وجل، فكان نصب القاضي؛ لإقامة الفرض، فكان فرضا ضرورة؛ ولأن نصب الإمام الأعظم فرض، بلا خلاف بين أهل الحق، ولا عبرة – بخلاف بعض القدرية -؛ لإجماع الصحابة – رضي الله عنهم – على ذلك، ولمساس الحاجة إليه؛ لتقيد الأحكام، وإنصاف المظلوم من الظالم، وقطع المنازعات التي هي مادة الفساد، وغير ذلك من المصالح التي لا تقوم إلا بإمام، لما علم في أصول الكلام. (بدائع الصنائع في ترتيب الشرائع، للكاساني الحنفي ৫৮৭ه، كتاب آداب القاضي، بيان فرضية نصب القاضي)
অনুবাদ: “কিতাবু আদাবিল কাজী -এর কয়েকটি জায়গায় এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। যেমন: কাজী নির্ধারণ করা ফরয হওয়ার বয়ান, কাজী হওয়ার উপযুক্ততার বয়ান, কাজীর আদব ও শর্তাবলীর বয়ান, ফায়সালার ক্ষেত্রে যেসব ফায়সালা বাস্তবায়ন হবে এবং যেসব ফায়সালা অন্য কাজীর কাছে গিয়ে মুলতবী হয়ে যাবে সেসবের বয়ান, কাজী যাকে হালাল বলে এবং যাকে হালাল বলে না এ বিষয়ক বয়ান, ফায়সালা করার ক্ষেত্রে কাজীর ভুলসমূহের বয়ান এবং যেসব কারণে কাজী বিচার করার অধিকার হারিয়ে ফেলে সেসবের বয়ান।
এগুলোর মধ্যে সর্ব প্রথম বিষয় হচ্ছে বিচারপতি নির্ধারণ করা। এ বিষয়টি ফরয। কেননা তাকে নিয়োগ দেয়া হয় একটি ফরয দায়িত্ব পালন করার জন্য। আর তা হচ্ছে বিচার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘হে দাঊদ! আমি তোমাকে জমিনের বুকে খলীফা বানিয়েছি। অতএব তুমি হক দ্বারা মানুষদের মাঝে ফায়সালা কর’। আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন, “আপনি মানুষদের মাঝে তা দ্বারা ফায়সালা করুন, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন।”
আর কাজা হচ্ছে, মানুষের মাঝে হক ফায়সালা করা এবং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে ফায়সালা করা। সুতরাং কাজী নিয়োগ করা হচ্ছে ফরয প্রতিষ্ঠা করার জন্য, তাই অত্যাবশ্যকীয়ভাবে কাজী নিয়োগ করাও ফরয হবে। আর তা এ জন্য যে, রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ফরয এবং এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। আর কাদারিয়া গোষ্ঠীর কিছু লোক যে দ্বিমত করে তার কোনো ধর্তব্য নেই। কারণ এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে। তাছাড়া এর প্রয়োজনও সুস্পষ্ট। বিধানসমূহ বাস্তবায়নের জন্য, জালিম থেকে মজলুমের হক আদায় করার জন্য, পরস্পরের লড়াই ঝগড়াকে দূর করার জন্য যা ফাসাদের মূল ইত্যাদি কার্যক্রম যা ইমাম তথা রাষ্ট্রপ্রধান ব্যতীত সম্ভব নয়, যা ইলমে কালামের মূলনীতি থেকে জানা যায়।”
এসকল ‘নস’ ও বক্তব্য থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মুসলমানদের ইজতিমায়ী জীবন কোনো একজন ইমাম কিংবা শাসক ব্যতীত চলতে পারে না। সে কারণে একজন ইমাম ও শাসক নির্বাচন করা মুসলমানদের উপর ফরয। যখনই কোনো কারণে মুসলমানদের এ ইমাম ও শাসক থাকবে না, তখন ইমাম ও শাসক নির্বাচন করে নেয়া জরুরি। এ ইমাম ও শাসক ব্যতীত মুসলমানদের ইজতিমায়ী জীবনের কোনো ধারণা নেই। আর এ ইমাম ও শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব বাধা আসবে, তা প্রতিহত করাও জরুরি। এ বাধাগুলো দূর করার জন্য যত ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়, তা নেয়া সকল মুসলমানের উপর ফরয।
আর এ কথাও স্পষ্ট যে, ভারত উপমহাদেশের প্রতিটি অংশে ইমাম ও শাসক নিয়োগ করার জন্য এবং শরয়ী আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে, এ ভূখণ্ডগুলোর অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গায়রে শরয়ী ও কুফরী আইনের পতাকাবাহী শাসকদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা ব্যতীত তা সম্ভব নয়। আর এ উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার জন্য জিহাদ করা জরুরি। অতএব ভারত উপমহাদেশের কাফের ও মুরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরয।
সারসংক্ষেপ
এ আলোচনার প্রেক্ষিতে এ ফলাফল বেরিয়ে আসে যে, ভারত উপমহাদেশের শাসকদের বিরুদ্ধে এমন তিনটি কারণে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরয, যে তিনটি কারণের যেকোনো একটির উপস্থিতিই জিহাদ ফরয হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ঐ তিনটি কারণ যেগুলো আমরা বিস্তারিত আলোচনা করে আসছি সেগুলো হচ্ছে এই-
প্রথম কারণ: মুসলমানদের এ ভূখণ্ডকে (যাকে দুই শত বছর আগে দারুল হারব ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এবং যা দ্বিতীয়বার আর দারুল ইসলাম হতে পারেনি) দারুল ইসলাম বানানোর পথে বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব।
দ্বিতীয় কারণ: মুসলমানদের এ ভূখণ্ডের কিছু শাসক, প্রকাশ্য কাফের ও মুশরিক, আর কিছু স্স্পষ্ট কুফরে লিপ্ত হওয়ার কারণে মুরতাদ হয়ে গেছে। এসকল কাফের ও মুরতাদ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করে একজন মুসলিম শাসক নিয়োগ করার জন্য কাফের ও মুরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব।
তৃতীয় কারণ: এ ভূখণ্ডগুলোতে মুসলমানদের ইজতিমায়ী জীবন রয়েছে। এখানে কোটি কোটি মুসলমান বসবাস করে, কিন্তু তাদের কোনো মুসলিম শাসক নেই, যে শাসক তাদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করবেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা গায়রে শরয়ী আইনের অধীনে এবং অমুসলিম শাসকদের শাসনের মধ্যে জীবন যাপন করে চলেছে। তাদের কোনো খেলাফতে ইসলামিয়া নেই, তাদের কোনো ইমারাতে ইসলামিয়া নেই এবং তাদের এমন কোনো মুসলিম শাসক নেই, যার অধীনে তারা শরয়ী আইনের আলোকে জীবন কাটাতে পারে। আর শরীয়তের পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য এ অবস্থায় জীবন যাপন করার অনুমতি নেই। অতএব একটি ইমারাতে ইসলামিয়া ও একটি খেলাফতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য এর বিরুদ্ধে অবস্থানকারী শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব।
একটি দারুল ইসলাম দারুল হারব হয়ে যাওয়ার পর তাকে পুনরায় দারুল ইসলামের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ফরয দায়িত্ব। দারুল ইসলামের শাসক সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত হওয়ার পর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে একজন মুসলিম শাসক নিয়োগ দেয়া একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ফরয দায়িত্ব। এমনিভাবে কোনো ভূখণ্ডে আল্লাহর বিধানের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ না থাকলে, সেখানে আল্লাহর বিধানের প্রয়োগ এবং খেলাফতে ইসলামিয়া ও ইমারাতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ফরয দায়িত্ব।
এ তিনটি বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। অতএব ভারত উপমহাদেশের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। চাই সে শাসক ভারতের হোক, কিংবা পাকিস্তানের হোক, অথবা বাংলাদেশের হোক।
আরেকবার দৃষ্টিপাত করুন
ক. উপমহাদেশের তিনটি দেশ যেহেতু দারুল ইসলাম থেকে দারুল হারবে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এখনো তা দারুল ইসলামের দিকে ফিরে আসেনি, সেহেতু এ দেশগুলোকে দারুল ইসলামে ফিরিয়ে আনা মুসলমানদের উপর একটি ফরয যিম্মাদারী। এ পথে বাধা প্রদানকারীরা নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে প্রকাশ করুক কিংবা কাফের, সর্বাবস্থায় তাদেরকে প্রতিহত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয।
খ. ভারত উপমহাদেশের কোনো কোনো অংশের শাসক প্রকাশ্য কাফের, আর কোনো কোনো অংশের শাসক সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত। সর্বাবস্থায় কাফের শাসকদেরকে সরিয়ে মুসলমানদের শাসক হিসাবে কোনো মুসলিম শাসককে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা মুসলমানদের উপর ফরয। এর জন্য জিহাদের কোনো বিকল্প নেই। অতএব এ ফরয দায়িত্ব আদায় করতে গেলে যেই বাধা দেবে, তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরয।
গ. মুসলমানদের ইজতিমায়ী জীবন শরয়ী আইন তথা কুরআন হাদীসের আইনের অধীনে চলা ফরয। যেখানে এ কুরআনী আইনের কর্তৃত্ব নেই, সেখানে কুরআনী আইনের প্রতিষ্ঠা তথা খেলাফতে ইসলামিয়া ও ইমারাতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করা মুসলমানদের উপর একটি ফরয যিম্মাদারী। এ ফরয যিম্মাদারী আদায় করতে গেলে যেই বাধা দেবে, তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলমানরদের উপর ফরয।
এ মাসআলায় নিজে সন্দেহের মাঝে পতিত হওয়া এবং অপরকে সন্দেহের মধ্যে ফেলা উচিত নয়। বরং শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রহিমাহুল্লাহ এর রূহানী সন্তান এবং সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী শহীদ রহিমাহুল্লাহ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ রহিমাহুল্লাহ এর উত্তরসূরি আকাবির উলামায়ে কেরাম, উম্মতের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের জন্য উচিত হবে এবং তাদের কাছে এটা সময়ের দাবি যে, তাঁরা এ মাসআলাকে উম্মতের সামনে খুব স্পষ্ট করে তুলে ধরবেন। এ কাজটি একটি শরয়ী যিম্মাদারী, ইলমী আমানত এবং সলফের সঠিক অনুসরণ।
মাসআলার তাহকীক করার সময় এবং উম্মতের সামনে এর শরয়ী অবস্থান স্পষ্ট করার সময় মাসআলার উপর আমল করার জটিলতা, পরিবেশ পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি গুরুত্বহীন কিছু বিষয়, সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে এগুলো বাধা না হওয়া চাই। মাসআলার তাহকীকের সময় দলীল ও দলীলের প্রয়োগ সঠিক হওয়া কাম্য, দলীল থেকে ফলাফল বের করা সঠিক হওয়া কাম্য, আমানতদারী রক্ষা করা কাম্য, কোনো প্রকার তাহরীফ-অপব্যাখ্যা না হওয়া কাম্য। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে, এ মূলনীতিগুলোর আলোকে মাসআলার সুরতহাল সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়াই শরয়ী যিম্মাদারী।
এটা হচ্ছে ইলমী যিম্মাদারী, যা আদায় করাকে আমরা জরুরি মনে করেছি। ইলমের এ দস্তরখানায় উলামায়ে কেরাম ও মুফতীয়ানে কেরামকে আমরা স্বাগত জানাই। মাসআলার শরয়ী অবস্থান উম্মতের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেলে তা বাস্তবায়নের পদ্ধতিও বের হয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ। মাসআলার যদি তাহকীক না হয় এবং তা প্রকাশ্যে না আসে, তা হলে তার উপর আমল করার তাকাযাই সৃষ্টি হবে না এবং ফরয দায়িত্ব আদায়ের উদ্দীপনাও হারিয়ে যাবে।
জিহাদ একটি ইজতিমায়ী আমল
স্মরণ রাখা চাই যে, জিহাদ একটি ইজতিমায়ী আমল। এককভাবে এ দায়িত্ব আদায় করা যায় না। অতএব হয়ত আমরা চলমান ইজতিমায়ী কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবো। যদি নির্ভরযোগ্য ইজতিমায়ী কোনো কর্মধারা না পাওয়া যায়, তা হলে নিজের শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী কোনো ইজতিমায়ী কার্যক্রম চালু করার পেছনে নিজের সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করে দেব। একটি অনিবার্য বিষয় ও একটি অকাট্য ফরয যিম্মাদারী আদায়ের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মুকাল্লাফ মুসলিমকে যা যা করতে হয় তার সবই তার করা চাই। ব্যক্তিগতভাবে নিজেই প্রস্তুতি নিতে থাকবে এবং ইজতিমায়ীভাবে জিহাদ করার সম্ভাব্য সব সুরত বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করতে থাকবে। তালাশের স্পৃহা এমন থাকতে হবে যেমন ছিল ঐ তাওবাকারী বান্দার, যে নিরানব্বইটি হত্যা করে তাওবার পথ তালাশ করে ফিরছিল। আর ইজতিমায়ী শক্তি সংগ্রহের চেষ্টা প্রচেষ্টা এমন হওয়া চাই, যা ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আমরা দেখতে পাই। ইসলামী খেলাফত ও ইসলামী ইমারাত দুশমনের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও যেভাবে দ্বিতীয়বার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, আমাদেরও সে পথেই চলতে হবে। এ উদ্দেশ্যে দূর অতীতে তাতারীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সফল জিহাদ এবং নিকট অতীতে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রতিককালে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদীনের সফল জিহাদকে আদর্শ হিসাবে সামনে রাখা যেতে পারে। আর চলমান শাসন ব্যবস্থাগুলো থেকে বিমুখ হওয়া এবং তাদের থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে এমন দূরত্ব বজায় রাখা চাই, যেভাবে আসহাবে কাহফ তাদের সময়ের শাসকদের থেকে দূরত্ব বজায়ে রেখেছিলেন।
আমাদের দুর্বলতা ও ওযর
আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে, উম্মতের অধিকাংশই দীর্ঘকাল থেকে এ যিম্মাদারীর বিষয়ে গাফেল। আর সে গাফলতের কারণে যেসব দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়ার ছিল সেসব দুর্বলতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। একটি দুর্বলতা হচ্ছে, জিহাদ ফরয হওয়ার মাসআলাটি স্পষ্ট না হওয়া। দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে, একটি সফল জিহাদের নকশা ও নমুনা দৃষ্টির সামনে না থাকা। এটি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় যে, যে মাসআলার উপর অনুশীলন হবে না এবং যার কোনো আমলী বাস্তব রূপ সামনে না থাকবে, তার শরয়ী অবস্থান সম্পর্কে উম্মত বেখবর হতে থাকবে, গাফেল হয়ে যাবে। আর তা-ই হয়েছে।
আর এরই সাথে আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে জিহাদের বিরুদ্ধে এত বেশি পরিমাণে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয়েছে যে, খোদ মুসলমানরা তাদের জিহাদের ফরয দায়িত্ব সম্পর্কে সন্দেহের মাঝে পড়ে গিয়েছে। অনুরূপভাবে জিহাদ ও মুজাহিদীনকে এতভাবে বদনাম করা হয়েছে যে, মুসলমানরা তাদের একটি ফরয দায়িত্ব আদায়কে ফিতনা ফাসাদ মনে করতে শুরু করেছে। ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে যে, জিহাদের সম্ভাব্য কোনো সুরত চিন্তা করা, তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে গিয়েছে।
এমন বৈরি পরিস্থিতিতে এ মাসআলার বাস্তব রূপ, এর অনিবার্যতা স্পষ্ট করে দেয়া, মুসলমানদের সামনে জিহাদ ফরয হওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া, এর বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করার জন্য চিন্তা-ফিকির করা এবং এর প্রয়োগের জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, সমকালীন রাহবারগণের সবচাইতে বড় যিম্মাদারী।
তাই এখন আমাদের দুর্বলতাকে এবং আমাদের ওযরকে শরীয়তের কষ্টিপাথরে মেপে নিতে হবে। কাল্পনিক দুর্বলতা, ধারণা নির্ভর ওযর ও ফাসেকের খবর তথা তথ্য সন্ত্রাসের ভিত্তিতে জিহাদের ফরয দায়িত্ব থেকে দূরে থাকা এবং মাসআলার শরয়ী অবস্থান স্পষ্ট করা থেকে বিরত থাকা জায়েয নেই। যে বীর পুরুষ মুজাহিদগণ জিহাদের ময়দানে কুরবানী দিয়ে চলেছে, তাদের সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া চাই, তা জানা থাকা বর্তমান পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি।
মনে রাখা উচিত, একথা সহীহ যে, জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার আগে এবং শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন, সে পরিমাণ শক্তি ও প্রস্তুতির আগে প্রকাশ্যে জিহাদের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়া উচিত নয়। এ কথাটি যেমন সহীহ তেমনিভাবে এ কথাগুলো সহীহ যে, প্রথমত, অসামর্থ্য ও দুর্বলতার ওযর পেশ করে ফরয যিম্মাদারী আদায় থেকে ফিকিরহীন থাকা, দ্বিতীয়ত, কোনো উপযুক্ত জামাত তালাশ না করা, অথবা কোনো একটি জামাত তৈরি করার জন্য কোনো প্রকার চিন্তা-ফিকির না করা, তৃতীয়ত, এককভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু প্রস্তুতি নেয়া যায় ততটুকুর প্রতিও কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করা, সর্বোপরি মুজাহিদীনকে সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বিমুখ থাকাও জায়েয নেই। মোটকথা এ ধরনের কোনো আচরণই গ্রহণ করা জায়েয নেই, যে কারণে মুজাহিদীনের জিহাদী কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তাঁর দীনের জন্য জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহে অংশ গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন।
وصلى الله على خير خلقه محمد وآله وأصحابه أجمعين!
تمت ولله الحمد