বিবিধসকল ফাতওয়াফাতওয়া  নং  ৪৯২

স্বামীর সেবা করা কি স্ত্রীর উপর ওয়াজিব?

স্বামীর সেবা করা কি স্ত্রীর উপর ওয়াজিব?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্ন:

বিয়ের পর স্বামীর জন্য রান্না-বান্না করা, বাচ্চাদের লালন-পালন করা কি স্ত্রীর উপর ওয়াজিব? না তার ইহসান ও উত্তম আখলাকের অন্তর্ভুক্ত? যদি সে তা না করে তাহলে কি গুনাহগার হবে?

-আবু দুজানা

উত্তর: আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন স্বভাব-বৈশিষ্ট্য দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। নারীর শরীর-মানস পুরুষ থেকে ভিন্ন। যেহেতু আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষের স্রষ্টা, তাই তিনিই ভালো জানেন, কে কোন দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত। সে হিসেবে আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। পুরুষকে উপার্জনসহ ঘরের বাহিরের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। নারীকে সন্তান লালন-পালন ও ঘর সামলানোর দায়িত্ব প্রদান করেছেন।

নবীজীর কলিজার টুকরো, জান্নাতী নারীদের সর্দার ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা ঘরের সব কাজ করতেন। এমনকি যাঁতা পেষার কারণে তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেতো। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

أن فاطمة، اشتكت ما تلقى من الرحى في يدها، وأتى النبي صلى الله عليه وسلم سبي، فانطلقت، فلم تجده ولقيت عائشة، فأخبرتها فلما جاء النبي صلى الله عليه وسلم، أخبرته عائشة بمجيء فاطمة إليها، فجاء النبي صلى الله عليه وسلم إلينا، وقد أخذنا مضاجعنا، فذهبنا نقوم فقال النبي صلى الله عليه وسلم: على مكانكما فقعد بيننا حتى وجدت برد قدمه على صدري، ثم قال: ألا أعلمكما خيرا مما سألتما، إذا أخذتما مضاجعكما، أن تكبرا الله أربعا وثلاثين، وتسبحاه ثلاثا وثلاثين، وتحمداه ثلاثا وثلاثين، فهو خير لكما من خادم. -صحيح البخاري (4/84 رقم: 3113 ط. دار طوق النجاة) صحيح مسلم (4/2091 رقم: 2727 ط. دار إحياء التراث) ووقع في رواية الترمذي  (5/ 349 رقم: 3408 ط. دار الغرب الإسلامي) من طريق عبيدة السلماني، عن علي، قال: “شكت إلي فاطمة مجل يديها من الطحين فقلت: لو أتيت أباك فسألته خادما” …  ووقع في رواية أبي داود (4/606 رقم: 2988 ط. دار الرسالة العالمية) عن أبي الورد بن ثمامة، قال: قال علي لابن أعبد: “ألا أحدثك عني وعن فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم، وكانت أحبَّ أهلِه إليه، وكانت عندي، فجرت بالرحى حتى أثرت بيدها، واستقت بالقربة حتى أثرت في نحرها، وقمَّت البيت حتى اغبرت ثيابها، وأوقدت القدر حتى دكنت ثيابها، وأصابها من ذلك ضر، فسمعنا أن رقيقا أتي بهم النبي ….”

“ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা তাঁকে আটা পেষার কষ্টের কথা জানালেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কিছু বন্দী আনা হয়। ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। তিনি তাঁকে না পেয়ে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার কাছে বলে চলে গেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা তাঁকে বিষয়টি জানালেন। (আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সংবাদ পেয়ে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এলেন। তখন আমরা শয্যা গ্রহণ করেছি। আমরা উঠতে উদ্যত হলাম। তিনি বললেন, তোমরা নিজ নিজ জায়গায় থাক। তিনি আমাদের মাঝে বসলেন। আমার বুকে তাঁর পায়ের শীতলতা অনুভব করলাম। নবীজী বললেন, “তোমরা যা চেয়েছ, আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়ে উত্তম বস্তুর সন্ধান দিব না? (তিনি বললেন) যখন তোমরা শয্যা গ্রহণ করবে, তখন চৌত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ’ এবং তেত্রিশবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবে। এটা তোমাদের জন্য একজন খাদেম থেকে উত্তম।” -সহীহ বুখারী: ৪/৮৪ হাদীস: ৩১১৩ (দারু তাওকিন নাজাহ); সহীহ মুসলিম: ৪/২০৯১ হাদীস: ২৭২৭ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস); জামে তিরমিযী: ৫/৩৪৯ হাদীস: ৩৪০৮ (দারুল গরবিল ইসলামী); সুনানে আবী দাউদ: ৪/৬০৬ হাদীস: ২৯৮৮ (দারুল রিসালাতিল আলামিয়্যাহ)

ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহার মতো, সিদ্দীক তনয়া—আসমা রাযিয়াল্লাহু আনহাও যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঘরের সব কাজ করতেন। একইভাবে সহীহ হাদীসসমূহে উম্মুল মুমিনীনগণের নবীজীর জন্য খাবার রান্না করা, নবীজীর কাপড় ধুয়ে দেয়া, চুল আঁচড়ে দেয়া এবং বিছানা প্রস্তুত করে দেয়ার বিবরণ এসেছে। -সহীহ বুখারী: ১/৫৫, ৬৭; ৩/১৩৬; ৭/৩৫; হাদীস: ২২৯, ২৯৫, ২৪৮১, ৫২২৪ (দারু তাওকিন নাজাহ) সহীহ মুসলিম: ১/২৩৯; ৪/১৭১৬ হাদীস: ২৮৯; ২১৮২ সুনানে নাসায়ী: ৭/৭০ হাদীস: ৩৯৫৬ (মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়্যাহ); সুনানে আবু দাউদ: ৫/৪২০ হাদীস: ৩৫৬৮ (দারুল রিসালাতিল আলামিয়্যাহ); শামায়েলে তিরমিযী, পৃ: ২৬৯ হাদীস: ৩৩০ (আল-মাকতাবাতুত তিজারিয়্যাহ); মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ: ২০/১৩৮ হাদীস: ৩৭৪৩৪; ফাতহুল বারী: ৫/১২৪-১২৫ (দারুল ফিকর)

এজাতীয় অসংখ্য দলীলের ভিত্তিতে ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, সন্তান লালন-পালন ও দুধ পান করানো এবং ঘরের কাজ যথা, রান্না-বান্না, ঘর পরিষ্কার রাখা, স্বামীর কাপড়-চোপড় ধোয়া ইত্যাদি স্ত্রীর উপর ওয়াজিব। কোনো ওযর ব্যতীত স্ত্রী তা না করলে ওয়াজিব ত্যাগের কারণে গুনাহগার হবে। -মাবসুতে সারাখসী: ১৫/১২৭ (দারুল মারেফাহ); বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২৪ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ); ফাতহুল কাদীর: ৪/৪১২ (দারুল ফিকর); লিসানুল হুক্কাম, পৃ: ৩৩৬ (আল-বাবুল হালাবী); রদ্দুল মুহতার: ২/৩৬৮, ৩/৫৬১, ৫৭৯ (দারুল ফিকর); মাজমুউল ফাতাওয়া: ৩৪/৯০ (মাজমাউল মালিক ফাহাদ); কেফায়াতুল মুফতী: ৫/২২৮ (দারুল ইশাআত)

আল্লামা শুরুম্বুলালী রহিমাহুল্লাহ (১০৬৯ হি.) বলেন,

يجب عليها الطبخ والخبز وكنس البيت وغسل الثياب كإرضاع ولدها كما في الفتح. -حاشية الشرنبلالي على درر الحكام (1/ 413 ط. دار إحياء الكتب العربية)

“রান্না করা, রুটি বানানো, ঘর ঝাড়ু দেয়া, কাপড় ধোয়া স্ত্রীর উপর ওয়াজিব, যেমনিভাবে সন্তানকে দুধ পান করানো ওয়াজিব। যেমনটা (হেদায়ার বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ) ‘ফাতহুল কাদীরে’ বলা হয়েছে।” –হাশিয়াতুত শুরুম্বুলালী আলা দুরারিল হুক্কাম: ১/৪১৩ (দারু ইহয়ায়িল কুতুবিল আরাবিয়্যাহ)

আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহিমাহুল্লাহ (১৩৯৪ হি.) বলেন,

زوجہ كے ذمہ  شوہر كى خدمت واعمال بيت ديانةً واجب ہيں قضاءً نہيں لہذا شوہر اس كو مجبور نہيں كر سكتا  ليكن اگر انكار كريگى گنہگار ہوگى (بشرط قدرتها )  –امداد الاحكام:  2/378   ط. دار الاشاعت، كراى)

“স্ত্রীর জন্য স্বামীর সেবা ও ঘরের কাজ করা দিয়ানাতান (আখিরাতের বিচারে) ওয়াজিব ‘কাযাআন’ (আইনের বিচারে) নয়। অর্থাৎ স্বামী তাকে আইনত বাধ্য করতে পারবে না, কিন্তু (সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও) স্ত্রী এসব কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে গুনাহগার হবে।” -ইমদাদুল আহকাম: ২/৩৭৮ (দারুল ইশাআত, করাচি)

হাফেজ ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ (৭৫১ হি.) এ বিষয়ে বিস্তারিত দালীলিক আলোচনা করেছেন এবং যারা বলে, স্ত্রীর জন্য স্বামীর খেদমত আবশ্যক নয় কিংবা সম্ভ্রান্ত নারীর উপর স্বামীর খেদমত ওয়াজিব নয়, তাদের শক্তভাবে খণ্ডন করেছেন। তাঁর আলোচনার অংশবিশেষ দেখুন,

وقولهم: إن خدمة فاطمة وأسماء كانت تبرعا وإحسانا يرده أن فاطمة كانت تشتكي ما تلقى من الخدمة، فلم يقل لعلي: لا خدمة عليها، وإنما هي عليك وهو صلى الله عليه وسلم لا يحابي في الحكم أحدا، … ولا يصح التفريق بين شريفة ودنيئة وفقيرة وغنية فهذه أشرف نساء العالمين، كانت تخدم زوجها وجاءته صلى الله عليه وسلم تشكو إليه الخدمة، فلم يشكها. –زاد المعاد: 5/171 (ط. دار الرسالة)

“ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা ঘরের কাজ করতে গিয়ে কষ্টের শিকার হলে নবীজী আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বলেননি, ঘরের কাজ ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহার উপর আবশ্যক নয়; এটা তোমার দায়িত্ব। অথচ নবীজী ফায়সালার ক্ষেত্রে কারো পক্ষপাতিত্ব করতেন না। এতে তাদের বক্তব্য খণ্ডন হয়, যারা বলে ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা ও আসমা রাযিয়াল্লাহু আনহা নফল ও ইহসান হিসেবে ঘরের কাজ করতেন। … এক্ষেত্রে ধনী-গরীব ও বংশীয় আভিজাত্যের ব্যবধান করাও ঠিক নয়। ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা পৃথিবীর অভিজাততম নারী হয়েও স্বামীর সেবা করতেন। এতে কষ্টের সম্মুখীন হলে তিনি নবীজীর কাছে তা ব্যক্ত করেন। কিন্তু নবীজী তাঁর কষ্ট দূর করার ব্যবস্থা করেননি। -যাদুল মাআদ: ৫/১৭১ (আর-রিসালাহ)

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আজ অনেক মুসলিম মেয়ে উম্মুল মুমিনীন ও উম্মাহর শ্রেষ্ঠ নারীদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও মাসআলার আংশিক পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদের মনমানস নারীবাদের বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত হওয়ায় ঘরের কাজকে তারা অপমানজনক মনে করছে। অথচ এটা যেমন শরীয়তের হুকুম, তেমনি যৌক্তিকও। একই সঙ্গে তা নারীর শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যেরও বাস্তবসম্মত দাবি। স্ত্রী স্বামীকে যথাসম্ভব ঘরের কাজ থেকে মুক্ত রাখলে, স্বামী দীনি ও দুনিয়াবি কাজের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায় এবং দীনি ও দুনিয়াবি উন্নতি করা তার জন্য সহজ হয়। তাই স্ত্রীর দায়িত্ব হলো যথাসম্ভব নিজেই ঘর সামলানোর চেষ্টা করা। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া স্বামীর নিকট ঘরের কাজে সহায়তা না চাওয়া। স্বামীর জন্য ঘরকে শান্তির নীড় বানিয়ে রাখা, যেন দীনি ব্যস্ততা ও দুনিয়াবি ঝঞ্ঝাট সেরে ঘরে ফিরে স্বামী বিশ্রাম ও স্বস্তি লাভ করে এবং নবউদ্যোম ও কর্মপ্রেরণা নিয়ে পুনরায় কাজে বের হতে পারে।

বরং সম্ভব হলে দীনি ও দুনিয়াবি কাজেও স্বামীকে সহায়তা করা উচিত। খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা নবীজীর শুধু ঘর সামলাননি, নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনেও অনেক সাহায্য করেছেন। কাফেররা যখন অপবাদ-মিথ্যাচার দিয়ে নবীজীর অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করতো, খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা  তাতে সান্ত্বনার শীতল প্রলেপ বুলিয়ে দিতেন। নবীজীর জন্য তিনি নিজের সম্পদ অকাতরে বিলিয়েছেন। নবীজী যখন হেরা পাহাড়ের সুউচ্চ গুহায় ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন, তখন খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা  দুর্গম পাহাড় বেয়ে তাঁর নিকট খাবার পৌঁছে দিতেন। যার ফলে খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুর পর নবুওয়াতের দায়িত্বের পাশাপাশি ঘর সামলানো নবীজীর জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল।

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসে নবীজী খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার প্রশংসা করে বলেন,

لقد آمنت بي إذ كفر بي الناس وأوتني إذ رفضني الناس وصدقتني إذ كذبني الناس. –رواه الحافظ أبو بشر الدولابي في «الذرية الطاهرة» (ص: 31 رقم: 19 ط. الدار السلفية) والطبراني في «المعجم الكبير» (23/13 رقم: 21 ط. مكتبة ابن تيمية) ورواه الطبراني في «المجكم الكبير» (23/13 رقم: 22) من طريق آخر، وفيه: «وواستني بمالها إذ حرمني الناس».

“মানুষ যখন আমার সঙ্গে কুফরী করেছে, তখন সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে। মানুষ যখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তখন সে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তখন সে আমাকে সত্যায়ন করেছে।” অপর বর্ণনায় এসেছে, “মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে, তখন সে তাঁর সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করেছে।” –আয-যুরিয়্যাতুত তাহিরাহ, পৃ: ৩১ হাদীস: ১৯ (আদ-দারুস সালাফিয়্যাহ); আল-মুজামুল কাবীর: ২৩/১৩ হাদীস: ২১, ২২ (মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়াহ)

অপর হাদীসে এসেছে,

عن أبي هريرة رضي الله عنه، قال: أتى جبريل النبي صلى الله عليه وسلم، فقال: يا رسول الله: هذه خديجة قد أتت معها إناء فيه إدام، أو طعام أو شراب، فإذا هي أتتك فاقرأ عليها السلام من ربها ومني وبشرها ببيت في الجنة من قصب لا صخب فيه، ولا نصب. -صحيح البخاري (5/ 39 رقم: 3820 صحيح مسلم (4/ 1887 رقم: 2432) وقال الحافظ ابن حجر في «فتح الباري» (7/ 138 ط. دار الفكر) : “قوله: “أتى جبريل” في رواية سعيد بن كثير عند الطبراني: أن ذلك كان، وهو بحراء…. وقوله: “من قصب” … قال ابن التين: المراد به لؤلؤة مجوفة واسعة كالقصر المنيف.” (وراجع: المعجم الكبير للطبراني (23/ 15 رقم:  25 ط. مكتبة ابن تيمية)

“আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গারে হেরায় থাকাকালীন) জিবরীল আলাইহিস সালাম নবীজীর খেদমতে হাযির হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই যে খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার একটি পাত্র হাতে নিয়ে আসছেন। ঐ পাত্রে তরকারি অথবা খাবার দ্রব্য অথবা পানীয় ছিল। যখন তিনি পৌঁছে যাবেন তখন তাঁকে তাঁর রবের পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ থেকেও সালাম জানাবেন আর তাঁকে জান্নাতের এমন একটি সুরম্য প্রাসাদের সুসংবাদ দিবেন, যা ফাঁকা মণি মুক্তা দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে থাকবে না কোনো প্রকার হট্টগোল, কোনো প্রকার ক্লেশ ও ক্লান্তি।” -সহীহ বুখারী: ৫/৩৯ হাদীস: ৩৮২০ (দারু তাওকিন নাজাহ); সহীহ মুসলিম: ৪/১৮৮৭ হাদীস: ২৪৩২ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস); আল-মুজামুল কাবীর: ২৩/১৫ হাদীস: ২৫ (মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়াহ); ফাতহুল বারী: ৭/১৩৮ (দারুল ফিকর)

আবু সালামা বিন আব্দুর রহমান এবং ইয়াহইয়া বিন আব্দুর রহমান বিন হাতেব রহিমাহুমাল্লাহ বর্ণনা করেন,

جاءت خولة بنت حكيم بن الأوقص السلمية امرأة عثمان بن مظعون إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقالت: يا رسول الله , كأني أراك قد دخلتك خلة لفقد خديجة فقال: «أجل، كانت أم العيال وربة البيت» قالت: أفلا أخطب عليك؟ قال: «بلى، فإنكن معشر النساء أرفق بذلك» فخطبت عليه سودة بنت زمعة من بني عامر بن لؤي وخطبت عليه عائشة بنت أبي بكر فتزوجها. –رواه ابن سعد في الطبقات الكبرى (8/ 57 ط. دار صادر) وقال الحافظ ابن حجر في “الإصابة في تمييز الصحابة” (8/ 102) : “وسنده قوي مع إرساله.”

“উসমান বিন মাযউনের স্ত্রী খাওলাহ বিনতে হাকীম রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মনে হচ্ছে খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুর কারণে আপনার সমস্যা হচ্ছে। নবীজী বললেন হাঁ, সেই তো বাচ্চাদের দেখা-শোনা করতো এবং ঘর সামলাতো। খাওলাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আমি কি তাহলে আপনার জন্য প্রস্তাব নিয়ে যাবো? নবীজী বললেন, হাঁ, তোমরা নারীরাই তো এর অধিক উপযুক্ত। তখন খাওলাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা সাওদা বিনতে যামআ রাযিয়াল্লাহু আনহা  ও আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার (পরিবারের সাথে কথা বলে) নবীজীর সাথে তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন।” -আত-তাবাকাতুল কুবরা: ৮/৫৭ (দারু সাদির); আল-ইসাবাহ: ৮/১০২ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)

তবে স্বামীর জন্যও ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করা সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ও সাহাবীদের জীবনচরিত এমনই ছিল। তাই বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি না করে মধ্যপন্থায় ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করার চেষ্টা করা স্বামীর কর্তব্য। বিশেষত সংসার বড় হওয়ার কারণে কাজ বেশি হলে বা স্ত্রী শারীরিকভাবে দুর্বল কিংবা অসুস্থ হলে তাকে যথাসম্ভব সাহায্য করা স্বামীর মানবিক দায়িত্ব হওয়ার পাশাপাশি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকেও তা স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণের অন্তর্ভুক্ত, যার নির্দেশ কুরআন-সুন্নাহয় বারবার এসেছে। এক্ষেত্রে স্বামীর অবহেলা স্ত্রীর জন্য শারীরিক কষ্টের কারণ হওয়ার পাশাপাশি মানসিক কষ্টেরও কারণ হয়। পক্ষান্তরে স্বামী শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও সময়-সুযোগে ঘরের কাজে হাত লাগালে এটা স্ত্রীর জন্য অনেক বড় মানসিক প্রশান্তির কারণ হয়।

সহীহ বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, আসওয়াদ রহিমাহুল্লাহ বলেন,

سألت عائشة ما كان النبي صلى الله عليه وسلم يصنع في بيته؟ قالت: «كان يكون في مهنة أهله – تعني خدمة أهله – فإذا حضرت الصلاة خرج إلى الصلاة». –صحيح البخاري (1/136 رقم: 676 ط. دار طوق النجاة)

“আমি আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে থাকাকালীন কী করতেন? আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, তিনি পরিবারের সেবা করতেন। যখন সালাতের সময় হয়ে যেতো তখন (কাজ রেখে) সালাতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেতেন।” -সহীহ বুখারী: ১/১৩৬ হাদীস নং: ৬৭৬ (দারু তাওকিন নাজাহ)

হাদীসের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহিমাহুল্লাহ (৮৫৯ হি) বলেন,

وفيه: أن خدمة الدار وأهلها سنة عباد الله الصالحين. -عمدة القاري شرح صحيح البخاري (21/ 21 دار إحياء التراث العربي – بيروت)

“এ হাদীস প্রমাণ করে, ঘরের কাজ ও পরিবারের সেবা করা আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাদের রীতি।” -উমদাতুল কারী: ২১/২১ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস)

অলসতা ঝেড়ে ফেলে কর্মঠ ও ‍উদ্যোমী হলে একজন পুরুষের জন্য দীনি ও দুনিয়াবি কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজেও স্ত্রীকে সাহায্য করা অসম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা পুরুষকে এমন শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। সাঈদ বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু  হিমসের গভর্ণর হওয়া সত্ত্বেও রাতে দীর্ঘ সময় আল্লাহর তাআলার ইবাদত করতেন এবং ভোর হতে বেলা উঠা পর্যন্ত ঘরের কাজ করতেন। হিমসের অধিবাসীরা উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট অভিযোগ করেন, সাঈদ রাতে আমাদের ডাকে সাড়া দেন না এবং বেলা উঠা পর্যন্ত আমাদের নিকট বের হন না। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু সাঈদ রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বেলা করে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,

والله إن كنت لأكره ذكره، ليس لأهلي خادم فأعجن عجيني ثم أجلس حتى يختمر ثم أخبز خبزي، ثم أتوضأ ثم أخرج إليهم، …. قال: ما تقول؟ قال: إن كنت لأكره ذكره أني جعلت النهار لهم وجعلت الليل لله عز وجل. –حلية الأولياء: 1/245 (ط. دار الكتاب العربي)

“আল্লাহর শপথ! আমি এ বিষয়টি প্রকাশ করা অপছন্দ করতাম। আমার পরিবারে কোনো কাজের লোক নেই। তাই আমি নিজেই রুটির খামির তৈরি করি, রুটি বানাই। এরপর অযু করে তাদের নিকট আসি।”

…এরপর উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাতে কারো ডাকে সাড়া না দেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ বিষয়টিও আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। আমি দিনকে নির্দিষ্ট করেছি মানুষের (সেবার) জন্য, আর রাতকে নির্দিষ্ট করেছি আল্লাহর ইবাদতের জন্য।” -হিলয়াতুল আওলিয়া: ১/২৪৫ (দারুল কিতাবিল আরাবী)

এভাবে স্বামী-স্ত্রী আস্থা ও ভালোবাসার ভিত্তিতে নিজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অপরের প্রতি সহযোগিতার মানসিকতা লালন করলেই একে অপরের পরিপূরক হবে এবং দাম্পত্য জীবন সুখময় হবে। উভয়ে পরিপূর্ণভাবে দীন পালন করলে অভাব-অনটন থাকলেও সংসারে স্বর্গীয় সুখ বিরাজ করবে ইনশাআল্লাহ। পক্ষান্তরে একে অপরকে প্রতিপক্ষ মনে করে অধিকার আদায়ের যুদ্ধে লিপ্ত হলে শুধু দাম্পত্য কলহই বাড়বে এবং সুখের সব উপকরণ বিদ্যমান থাকলেও সংসার নরকে পরিণত হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দীনের সঠিক বুঝ দান করুন। প্রত্যেককে নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালনের তাওফীক দান করুন। আমীন।

والله تعالى أعلم

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

২৩-০২-১৪৪৬ হি.

২৯-০৮-২০২৪ ঈ.

Related Articles

Back to top button