প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমাকৃত অর্থের যাকাত কীভাবে দেবো?
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
প্রশ্ন:
আমি বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মচারী। আমি ২০১৮ সালে চাকরিতে যোগ দেই। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, একজন সরকারি কর্মচারী তার “বেসিক পে বা মূল বেতনের” ০৫% থেকে ২৫% পর্যন্ত পরিমাণ অর্থ জিপিএফে প্রতিমাসে রাখতে পারেন। সরকারি কর্মচারী এভাবে তার বেতনের কিছু অংশ বাঁচিয়ে টাকা জমিয়ে রাখেন। একজন সরকারি কর্মচারী তার চাকরির প্রথম দুই বছর পর্যন্ত শিক্ষানবিস হিসেবে থাকেন। এ সময়ে জিপিএফে টাকা রাখা বা না রাখা তার ইচ্ছাধীন। কিন্তু দুই বছর পার হলে, সরকার তার কাছ থেকে “Compulsory Subscriber” হিসেবে কমপক্ষে ০৫% মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা কেটে রাখবেন। এই বিষয়টা তার ইচ্ছাধীন নয়। এটা বাধ্যতামূলক। তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারী ০৫% এর থেকে শুরু করে ২৫% পর্যন্ত কত রাখবেন, সেটা তার ইচ্ছাধীন। কোন সরকারি কর্মচারীর ৫২ বছর হয়ে যাওয়ার পর, এই তহবিলে টাকা রাখাটা তার জন্য ঐচ্ছিক হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ: একজন কর্মচারীর মূল বেতন যদি ২৪,২৬০ টাকা হয়, জিপিএফে কেটে রাখা হবে কমপক্ষে ২৪,২৬০*৫%=১২১৩ টাকা, যা বাধ্যতামূলক। তবে তিনি এখানে সর্বোচ্চ ২৪,২৬০*২৫%=৬০৬৫ টাকাও কাটাতে পারবেন। ১২১৪ টাকা থেকে শুরু করে ৬০৬৫ টাকা পর্যন্ত ব্যক্তির ইচ্ছাধীন।
এই তহবিলে টাকা একবার ঢুকলে তা কর্মচারীর ৫২ বছর বা অবসরের আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভাবে আর বের করা যায় না। তবে আমার দরকারে যে কোনো পরিমাণে টাকা ধার হিসেবে নিতে পারবো, কিন্তু পরে তা আবার কিস্তি আকারে তহবিলে ফেরত দিতে হবে। তবে ৫২ বছরের পর সব টাকাই তোলা যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রতি বছর পরিপত্রের মাধ্যমে এই তহবিলের সংশ্লিষ্ট বছরের সুদ জানিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত মোটামুটি ১২.৫% বা ১৩% করে সুদ ঘোষিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর বলতে বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থ বছর, যা সাধারণত জুলাই ০১ থেকে জুন ৩০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমি দুই বছর পার হওয়ার আগেই গত ১০ মাসে ষাট হাজার টাকা জমিয়ে ফেলি। যার সুদ সমেত (প্রায় চার হাজার টাকা) ৬৪০০০ টাকার মতো হয়েছে। আমার চাঁদা প্রায় ২৫% ছিল। আসলে নতুন চাকরিতে ব্যাচমেটদের সাথে সব করতে যেয়ে বা পরে ঝামেলা হয় কিনা, এইজন্য দুই বছরের আগেই করেছিলাম। এখন মুহতারাম মুফতি সাহেবের কাছে আমার প্রশ্নগুলো হল-
০১. এই টাকার যাকাত আসবে কিনা? আসলে কত টাকার ওপর আসবে? অর্থাৎ আসল এবং লাভ উভয়টার ওপর আসবে, না শুধু মূল টাকার ওপর আসবে? বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।
০২. আবেদন করে, এই তহবিলে সুদ ছাড়াও টাকা রাখা যায়। অর্থাৎ সুদের অপশনটা নাকেস করা যায়। তাহলে কি সুদ বাদ দিব? প্রসঙ্গত, সকল কর্মচারীর জন্য সরকারের জিপিএফ ফান্ড কিন্তু একটাই। সবার টাকার হিসাব সেখানে থাকবে একসাথে।
০৩. জুন মাসেই পরবর্তী বছরের মাসিক চাঁদা জানাতে হবে (৩০ জুনের মধ্যে)। তাহলে দ্রুত আমার জানা দরকার যে, আমার মাসিক চাঁদা কত হলে তা হারাম হবে না? এই সম্পর্কিত বিস্তারিত শরিয়তের নির্দেশনা জানালে খুবই উপকৃত হব। আল্লাহ তা’আলা আপনাকে নেক হায়াত দান করুন, আমীন।
প্রশ্নকারী-হাসান
উত্তর:
প্রিয় ভাই! আপনার প্রশ্নের উত্তরটি যথাসময় দিতে না পারার জন্য দু:খিত। আসলে আমরা সাইটটি খুলেছি মাত্র। আপনাদের জানা থাকার কথা, আমাদেরকে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়। যদিও ৩০শে জুনের মধ্যেই আপনার উত্তরটি পাওয়া প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সম্ভবত আপনার প্রশ্নটি আমার হস্তগতই হয়েছে ৩০শে জুনের অনেক পরে। আমরা সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি ইনশাআল্লাহ। দোয়া চাই, আল্লাহ যেন যথাসময়ে যথাযথভাবে আপনাদের খেদমত করার সুযোগ দান করেন।
০১. প্রভিডেন্ট ফান্ডে স্বেচ্ছায় জমা করা অর্থের ওপর যে সুদ আসে, সেটা প্রকৃতই সুদ হিসেবে গণ্য। সুতরাং তার ওপর যাকাত আসবে না। বরং তা উসুল করার পর গরিবকে সদকা করে দিতে হবে। আর বাধ্যতামূলক জমা করা অর্থের ওপর যে লাভ দেয়া হয়, তাকে সুদ বলা হলেও শরীয়তের দৃষ্টিতে তা সুদ নয়। এটা চাকুরের প্রাপ্ত বৈধ অর্থ।
বাধ্যতামূলক জমা করা অংশের সুদ ও আসল এবং স্বেচ্ছায় জমা করা অংশের আসল- এ তিন ধরনের অর্থ হস্তগত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। কারণ, সেই অর্থ হস্তগত হওয়ার পূর্বে ব্যক্তির মালিকানায়ই আসেনি। পক্ষান্তরে ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ রহ.-এর মতে এই তিন ধরনের অর্থের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। তবে তা এখনই আদায় করা জরুরি নয়। অর্থ হাতে আসার পর বিগত বছরগুলোর যাকাত আদায় করে দিলেই চলবে।
এক্ষেত্রে ফতোয়া ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতের ওপর। সুতরাং যদি কেউ আবু হানিফা রহ. এর মতানুযায়ী প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমাকৃত অর্থের যাকাত না দেয়, কোন সমস্যা নেই। তবে ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ রহ.-এর মতানুযায়ী যাকাত দিয়ে দেয়াই উত্তম ও তাকওয়ার দাবী। -ইমদাদুল আহকাম, ৩/৪৯৬-৪৯৯ মাকতাবাতু দারুল উলূম করাচি, ১৪৩০ হি. জাওয়াহিরুল ফিকহ, ৩/২৮৫-২৮৭
০২. কোনো মুসলিমের জন্য সুদি চুক্তি করা বা একাউন্ট খোলা এবং সুদি লেনদেন করা জায়েয নয়। সুতরাং প্রভিডেন্ট ফান্ডে স্বেচ্ছায় জমাকৃত অংশে সুদের অপশন বন্ধ করা জরুরি। আর ইতিমধ্যে স্বেচ্ছায় জমাকৃত অংশে যে সুদ জমা হয়েছে, সুদের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তা গরিবকে সদকা করে দেয়া জরুরি। একই সঙ্গে এজন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করাও জরুরি। -ইমদাদুল আহকাম: ৩/৪৯৯
০৩. ব্যাংক যেহেতু সুদি প্রতিষ্ঠান, এজন্য একান্ত বাধ্য না হলে তাতে টাকা জমা রাখাও শরীয়তে জায়েয নয়। কারণ, এতে সুদি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা হয়। সুতরাং আপনি স্বেচ্ছায় যে টাকাটা ব্যাংকে রাখতে চাচ্ছেন, ব্যাংকে না রেখে নিরাপদ কোনো ব্যবস্থা থাকলে ব্যাংকে রাখতে পারবেন না। অপারগ অবস্থায় ব্যাংকে রাখলেও, তাতে সুদের অপশন বন্ধ করে রাখতে হবে। -সূরা মায়িদা: ২, মিম্বারুত তাওহিদ, ফতোয়া নং ৪৭৩, ৮০৫
উল্লেখ্য এখানে আমরা শুধু প্রভিডেন্ট ফান্ডের এবং তার যাকাতের আলোচনা করেছি। বর্তমান সরকার যেহেতু তাগুত, এজন্য এই সরকারের অধীনে চাকরি করার বিষয়টি ভিন্ন। তা কখনো কুফর-শিরক, কখনো হারাম এবং কখনো মাকরূহ। সে বিধান এখানে আলোচনা করা হয়নি। আশা করি আপনার সেগুলো জানা থাকার কথা। এ বিষয়ে fatwaa.org তে প্রকাশিত ১২ নং ফাতওয়াটি ‘সরকারী বেতন হালাল কি?’ ( ক্লিক করুন )
এবং প্রবন্ধ ‘সরকারি চাকরি করা কি বৈধ?’ ( ক্লিক করুন ) দেখতে পারেন ইনশাআল্লাহ।
-মিম্বারুত তাওহিদ, ফতোয়া নং ৯২
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদী
৩০-১১-১৪৪১ হি.
২২-০৭-২০২০ ইং
আরো পড়ূন
যে ভেকু দিয়ে অর্থ উপার্জন করা হয় তার মূল্যের ওপর কি যাকাত আসবে?