জিযিয়া:ফাতওয়া  নং  ৫০০

জিযিয়ার পরিচয় ও তার হুকুম

জিযিয়ার পরিচয় ও তার হুকুম

 

প্রশ্ন: জিযিয়া অর্থ কী? জিযিয়া কাদের থেকে উসুল করা হয়? শুনেছি, মুসলিম ও কাফের একসাথে বসবাস করতে পারে না। তারা হয় ইসলাম গ্রহণ করবে, না হয় জিযিয়া দিতে সম্মত হবে, না হয় তরবারির মাধ্যমে ফায়সালা হবে। কথাটি সহীহ কী না? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিস্তারিত জানানোর অনুরোধ করছি।

-আবু উবাইদা

উত্তর: জিযিয়া অর্থ বিনিময়, বদলা। অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপদে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ প্রদানের বিনিময়ে, ইমামুল মুসলিমীন তাদের থেকে যে অর্থ গ্রহণ করেন, তাকে জিযিয়া বলা হয়। -আল-মুফরদাত, রাগেব ইস্পাহানী, পৃ: ১৯৫; তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, ইমাম নববী: ৩/৫১ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ); লিসানুল আরব: ১৪/১৪৭ (দারু সাদির); ফাতহুল কাদীর: ৬/৪৪ (দারুল ফিকর); রদ্দুল মুহতার: ৪/১৯৬ (দারুল ফিকর) আল-মুগনী: ৯/৩২৮ (মাকতাবাতুল কাহেরাহ); আকরাবুল মাসালিক, ইমাম দারদীর মালেকী: ২/৩০৮-৩০৯

মুরতাদ ও জাযীরাতুল আরবের মুশরিক ছাড়া অন্য সকল কাফেরের সাথে জিযিয়া চুক্তি করা যায়। এক্ষেত্রে কাফেরদের মধ্য হতে যুদ্ধ করতে সক্ষম এমন সুস্থ মস্তিষ্ক, বালেগ, স্বাধীন পুরুষদের থেকে ধনী-গরীব ভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণে জিযিয়া গ্রহণ করা হবে। নারী, শিশু ও যুদ্ধ করতে সক্ষম নয় এমন পুরুষদের থেকে জিযিয়া নেয়া যাবে না। -আলহিদায়াহ: ২/৪০১ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস); আল-বাহরুর রায়েক: ৫/১১৯ (দারুল কিতাবিল ইসলামী); রদ্দুল মুহতার: ৪/১৯৯ (দারুল ফিকর)

মুসলিমরা শক্তিশালী থাকাবস্থায় হারবী কাফেরদের তিনটি বিষয়ে ইখতিয়ার দিবে। হয় তারা ইসলাম গ্রহণ করবে, নতুবা জিযিয়া প্রদানের শর্তে ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে থাকবে। অন্যথায় তরবারির মাধ্যমে তাদের সাথে ফায়সালা হবে।

শক্তি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ না করে কাফেরদের এমনি ছেড়ে রাখা এবং মুসলিম-কাফের পরস্পরের তথাকথিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা জায়েয নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ. -التوبة: 29

“কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন, তা হারাম হিসেবে মানে না এবং সত্য দীনকে দীন হিসেবে গ্রহণ করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ অবস্থায় নিজ হাতে জিযিয়া প্রদান করে।” -সূরা তাওবা ০৯:২৯

বুরাইদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا أمر أميرا على جيش، أو سرية، أوصاه في خاصته بتقوى الله، ومن معه من المسلمين خيرا، ثم قال: «اغزوا باسم الله في سبيل الله، قاتلوا من كفر بالله، اغزوا ولا تغلوا، ولا تغدروا، ولا تمثلوا، ولا تقتلوا وليدا. وإذا لقيت عدوك من المشركين، فادعهم إلى ثلاث خصال – أو خلال – فأيتهن ما أجابوك فاقبل منهم، وكف عنهم، ثم ادعهم إلى الإسلام، فإن أجابوك، فاقبل منهم، وكف عنهم، … فإن هم أبوا فسلهم الجزية، فإن هم أجابوك فاقبل منهم، وكف عنهم، فإن هم أبوا فاستعن بالله وقاتلهم. –صحيح مسلم (3/1357 رقم: 1731 ط. دار إحياء التراث)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো বড় সেনাদল কিংবা ছোট সেনাদলের আমীর নিযুক্ত করতেন, তখন বিশেষ করে তাঁকে আল্লাহর ভয় অবলম্বন এবং তাঁর সঙ্গী মুসলমানদের প্রতি সদাচারের উপদেশ দিতেন। অতঃপর বলতেন, যুদ্ধ করো আল্লাহর নামে, আল্লাহর রাস্তায়। কিতাল করো তাদের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করেছে। যুদ্ধ করো, তবে (গনীমতের মালের) খিয়ানত করো না, চুক্তি ভঙ্গ করো না, শক্র পক্ষের অঙ্গ বিকৃতি করো না। শিশুদেরকে হত্যা করো না।

যখন তুমি মুশরিক শক্রর সম্মুখীন হবে, তখন তাকে তিনটি বিষয়ের প্রতি আহ্বান জানাবে। তারা এগুলোর মধ্য থেকে যেটাই গ্রহণ করবে, তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। প্রথমে তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিবে। যদি তারা তোমার এই আহ্বানে সাড়া দেয়, তবে তুমি তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকবে।… আর যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তবে তাদেরকে জিযিয়া প্রদানের আহ্বান করবে। যদি তারা তাতে সাড়া দেয়, তবে তুমি তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকবে। আর যদি তারা এ দাবি না মানে, তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং তাদের বিরুদ্ধে কিতাল (শুরু) করো…।” –সহীহ মুসলিম: ৩/১৩৫৭ হাদীস: ১৭৩১ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস)

নাহাওয়ান্দ যুদ্ধের দিন মুগীরা বিন শোবা রাযিয়াল্লাহু আনহু পারস্যের বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

أمرنا نبينا رسول ربنا صلى الله عليه وسلم أن نقاتلكم حتى تعبدوا الله وحده، أو تؤدوا الجزية. وأخبرنا نبينا صلى الله عليه وسلم عن رسالة ربنا، أنه من قتل منا صار إلى الجنة في نعيم لم ير مثلها قط، ومن بقي منا ملك رقابكم. -صحيح البخاري (4/ 97  رقم: 3159   ط. دار طوق النجاة)

“আমাদের নবী, আমাদের রবের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন, তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করবে কিংবা জিযিয়া প্রদান করবে এবং আমাদের নবী তাঁর রবের পক্ষ হতে আমাদের জানিয়েছেন, আমাদের যারা (তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে) শহীদ হবে, তারা জান্নাতে এমন নেয়ামত ভোগ করবে, যা কেউ কখনো দেখেনি। আর যারা জীবিত থাকবে, তারা তোমাদের গর্দানের মালিক হয়ে যাবে।” –সহীহ বুখারী: ৪/৯৭ হাদীস: ৩১৫৯ (দারু তাওকিন নাজাহ)

আবু ওয়ায়েল রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন,

عن أبي وائل قال: كتب خالد بن الوليد إلى أهل فارس يدعوهم إلى الإسلام: «بسم الله الرحمن الرحيم من خالد بن الوليد إلى رستم ومهران، وملأ فارس سلام على من اتبع الهدى، أما بعد فإنا ندعوكم إلى الإسلام، فإن أبيتم فأعطوا الجزية عن يد وأنتم صاغرون، فإن أبيتم، فإن معي قوما يحبون القتل في سبيل الله كما تحب فارس الخمر. والسلام على من اتبع الهدى» -مصنف ابن أبي شيبة (18/259 رقم:34422 ط. دار القبلة) مسند ابن الجعد (ص: 335 رقم: 2304 ط. مؤسسة نادر – بيروت) المعجم الكبير للطبراني (4/ 105 رقم:  3806 ط. مكتبة ابن تيمية – القاهرة)

قال الهيثمي في “مجمع الزوائد” (5/ 310 ط. مكتبة القدسي) : وإسناده حسن أو صحيح.

“খালেদ বিন ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে পারস্যবাসীর নিকট চিঠি লিখেন। (চিঠির ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ)

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম

খালেদ বিন ওয়ালীদের পক্ষ থেকে রুস্তম, মেহরান ও পারস্যের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতি! শান্তি বর্ষিত হোক হেদায়াতের অনুসারীদের উপর। হামদ ও সালাতের পর আমরা তোমাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। যদি তোমরা এতে সম্মত না হও তবে লাঞ্ছিত হয়ে জিযিয়া প্রদান করো। যদি এতেও সম্মত না হও তবে (জেনে রেখো) আমার সাথে এমন জাতি আছে, যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হতে তেমনই পছন্দ করে, যেমন পারস্যবাসী মদ পছন্দ করে। শান্তি বর্ষিত হোক হেদায়াতের অনুসারীদের উপর।” -সহীহ ইবনুল জাদ, পৃ: ৩৩৫ বর্ণনা নং: ২৩০৪ (মুআসসাতু নাদের); মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাহ: ১৮/২৫৯ বর্ণনা নং: ৩৪৪২২ (দারুল কিবলাহ); আল-মুজামুল কাবীর: ৪/১০৫ বর্ণনা নং: ৩৮০৬ (মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়াহ)

হাফেয নুরুদ্দীন হাইসামী (৮০৭ হি.) বলেন, ‘এর সনদ হাসান বা সহীহ।’ –মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ৫/৩১০ (মাকতাবাতুল কুদসী)

কাদেসিয়ার যুদ্ধের পূর্বে পারস্যের সেনাপতি রুস্তমের দরবারে দূত হিসেবে রিবয়ী বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠানো হয়। ইবনে জারীর তাবারী (৩১০ হি.) এর বর্ণনায় তাদের কথোপকথনের চিত্র দেখুন,

فقال: ما جاء بكم؟ قال: الله ابتعثنا، والله جاء بنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام، فأرسلنا بدينه إلى خلقه لندعوهم إليه، فمن قبل منا ذلك قبلنا ذلك منه ورجعنا عنه، وتركناه وأرضه يليها دوننا، ومن أبى قاتلناه أبدا، حتى نفضي إلى موعود الله. قال: وما موعود الله؟ قال: الجنة لمن مات على قتال من أبى، والظفر لمن بقي فقال رستم: قد سمعت مقالتكم، فهل لكم أن تؤخروا هذا الأمر حتى ننظر فيه وتنظروا! قال: نعم، كم أحب إليكم؟ أيوما أو يومين؟ قال: لا بل حتى نكاتب أهل رأينا ورؤساء قومنا وأراد مقاربته ومدافعته، فقال: إن مما سن لنا رسول الله ص وعمل به أئمتنا، ألا نمكن الأعداء من آذاننا، ولا نؤجلهم عند اللقاء أكثر من ثلاث، فنحن مترددون عنكم ثلاثا، فانظر في أمرك وأمرهم، واختر واحدة من ثلاث بعد الأجل، اختر الإسلام وندعك وأرضك، أو الجزاء، فنقبل ونكف عنك، وإن كنت عن نصرنا غنيا تركناك منه، وإن كنت إليه محتاجا منعناك أو المنابذة في اليوم الرابع تاريخ الطبري (3/ 520 ط. دار التراث)

“রুস্তম জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা কেন এসেছো? রিবয়ী বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উত্থিত করেছেন, যেন আল্লাহ তাআলার যাদেরকে চান তাদেরকে সৃষ্টির গোলামি থেকে মুক্ত করে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের দিকে, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে এবং সকল ধর্মের অবিচার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের ইনসাফের দিকে নিয়ে যান। যারা আমাদের এই আহ্বান (অর্থাৎ ইসলাম) গ্রহণ করবে, আমরাও তাদের থেকে তা গ্রহণ করে ফিরে যাবো, তাদের ভূমি তাদেরকেই শাসন করতে দিবো। আর যে তা গ্রহণ করবে না, আমরা তার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো; যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি লাভ করবো। রুস্তম জিজ্ঞাসা করলো, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কী? রিবয়ী বললেন, শহীদদের জন্য জান্নাত আর অবশিষ্টদের জন্য বিজয়। রুস্তম বললো, তোমার কথা শুনলাম। তোমরা কি যুদ্ধ স্থগিত রাখবে যেন আমরা ও তোমরা এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারি? রিবয়ী বললেন হ্যাঁ, কতদিন চাও? একদিন? না, দুদিন? রুস্তম বললো, না; বরং আমাদের অভিজ্ঞ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে চিঠি প্রেরণ করা পর্যন্ত। রুস্তমের উদ্দেশ্য ছিলো এভাবে রিবয়ীকে কাছে টানা এবং যুদ্ধ থেকে বিরত রাখা। কিন্তু রিবয়ী বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য যে রীতি প্রবর্তন করেছেন এবং আমাদের শাসকগণ সে অনুযায়ী চলেছেন তা হলো, আমরা শত্রুদের আমার মাথার উপর থাকাবস্থায় কোনো সুযোগ দিবো না এবং যুদ্ধের সময় তিনদিনের বেশি অবকাশ দিবো না। আমরা তিনদিন পর্যন্ত তোমাদের কাছে যাতায়াত করবো। এর মাঝে তুমি নিজের ব্যাপারে ও বাহিনীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নাও এবং তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তিনটি বিষয়ের কোনো একটি গ্রহণ করো। হয় ইসলাম গ্রহণ করো, তাহলে আমরা তোমার হাতেই তোমার ভূমি ছেড়ে যাবো। না হয় জিযিয়া প্রদানে সম্মত হয়ে যাও, তাহলে আমরা তোমার থেকে জিযিয়া গ্রহণ করে তোমার (সাথে যুদ্ধ করা) থেকে বিরত থাকবো। যদি তোমার আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে আমরা তা করতে যাবো না। আর সাহায্যের প্রয়োজন থাকলে আমরা তোমাদের প্রতিরক্ষা করবো। এর কোনোটিই গ্রহণ না করলে চতুর্থ দিনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও!” -তারীখে তাবারী: ৩/৫২০ (দারুত তুরাস)

ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

لا تصلح قبلتان في أرض واحدة. -رواه الترمذي (2/ 20 رقم: 633 ط. دار الغرب الإسلامي) وابن أبي شيبة (6/560 رقم: 10680 ط. دار القبلة) وابن الجارود في “المنتقى” (ص: 279 رقم: 1107) من طريق جرير بن عبد الحميد عن قابوس عن أبيه، ووقع في رواية ابن الطباع عند ابن الجارود: “لا تصلح ملتان”. وقال الشيخ عوامة في تعليقه على “المصنف: : “وقابوس مختلف فيه، فحديثه حسن.”

“এক ভূমিতে দুই ধর্ম থাকতে পারে না।” –জামে তিরমিযী: ২/২০ হাদীস: ৬৩৩ (দারুল গরবিল ইসলামী); মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ: ৬/৫৬০ হাদীস: ১০৬৮০ (দারুল কিবলাহ); সহীহ ইবনুল জারুদ, পৃ: ২৭৯ হাদীস: ১১০৭ (মুআসসাতুল কিতাবিস সাকাফিয়্যাহ)

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম তূরপুশতি রহিমাহুল্লাহ (৬৬১ হি.) বলেন,

أي: لا يستقيم دينان بأرض على سبيل المظاهرة والمعادلة، أما المسلم فليس له أن يختار الإقامة بين ظهراني قوم كفار، وأما الذي يخالف دينه دين الإسلام، فلا يمكن عن الإقامة في بلاد الإسلام إلا ببذل الجزية، ثم لا يؤذن له في الإشادة بدينه، والإشاعة بشعائره. -الميسر في شرح مصابيح السنة (3/926)

“অর্থাৎ একই ভূখণ্ডে দুটি ধর্ম বিজয়ী বেশে এবং সমভাবে চলতে পারে না। কেননা মুসলিমের অধিকার নেই (কাফের রাষ্ট্রে) কাফেরদের মাঝে বসবাস করার। আর কাফেরদের মুসলিম রাষ্ট্রে জিযিয়া ব্যতীত বসবাসের সুযোগ দেয়া হবে না এবং নিজ ধর্ম প্রচার ও প্রকাশ্যে ধর্মীয় শিয়ার পালনের সুযোগ দেয়া হবে না।” -আল-মুয়াসসার: ৩/৯২৬ (মাকতাবাতু মুস্তফা আল-বায)

এজন্যই আলেমদের সর্বসম্মত ও ইজমায়ী সিদ্ধান্ত হলো, মুসলিমদের কোনো স্বার্থ বা কল্যাণ ব্যতীত এমনিতেই কাফেরদের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বা সন্ধিচুক্তি করা জায়েয নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ وَاللَّهُ مَعَكُمْ وَلَنْ يَتِرَكُمْ أَعْمَالَكُمْ. -محمد: 35

“(হে মুসলিমগণ!) তোমরা মনোবল হারিয়ে সন্ধির প্রস্তাব দিও না। তোমরাই উপরে থাকবে। আল্লাহ তোমাদের সাথে। তিনি কখনই তোমাদের কর্মফল খর্ব করবেন না।” –সূরা মুহাম্মদ ৪৭: ৩৫

ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ (২০৪ হি.) বলেন,

وقتال الصنفين من المشركين فرض إذا قوي عليهم وتركه واسع إذا كان بالمسلمين عنهم أو عن بعضهم ضعف، أو في تركهم للمسلمين نظر للمهادنة وغير المهادنة. -الأم للشافعي (4/ 199 ط. الرسالة)

“সামর্থ্য থাকলে মুশরিকদের উভয় দল (অর্থাৎ মূর্তিপূজারি ও আহলে কিতাবদের) সাথে যুদ্ধ করা ফরয। কিন্তু তাদের সাথে বা তাদের কোনো দলের সাথে যুদ্ধ করার সামর্থ্য না থাকলে কিংবা যুদ্ধ না করার মাঝে মুসলমানদের কোনো কল্যাণ নিহিত থাকলে, সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে বা সন্ধি চুক্তি ব্যতীতই যুদ্ধ বন্ধ রাখা জায়েয।” –আলউম্ম: ৪/১৯৯ (আর-রিসালাহ)

ইমাম সারাখসী রহিমাহুল্লাহ (৪৮৩ হি.) বলেন,

«فريضة القتال لمقصود إعزاز الدين وقهر المشركين، فإذا حصل المقصود بالبعض سقط عن الباقين، …. وفي مثل هذا يجب على الإمام النظر للمسلمين، لأنه منصوب لذلك نائب عن جماعتهم، فعليه أن لا يعطل الثغور، ولا يدع الدعاء إلى الدين وحث المسلمين على الجهاد. وإذا ندب الناس إلى ذلك فعليهم أن لا يعصوه بالامتناع من الخروج. ولا ينبغي أن يدع المشركين بغير دعوة إلى الإسلام، أو إعطاء جزية إذا تمكن من ذلك». )شرح السير الكبير،  1 : 189 ط: الشركة الشرقية)

“যুদ্ধ ফরয করার লক্ষ্য হলো, দীনকে বিজয়ী করা ও কাফেরদের পর্যুদস্ত করা। যদি এ উদ্দেশ্য কিছু মানুষের দ্বারা অর্জিত হয়, তাহলে অন্যরা জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে ইমামের দায়িত্ব হলো, মুসলমানদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা। কেননা মুসলিম জামাতের পক্ষ হতে তাকে এই দায়িত্বই প্রদান করা হয়েছে। তাই তার দায়িত্ব হলো, কখনোই সীমান্ত থেকে বাহিনী প্রত্যাহার না করা, (জিহাদের মাধ্যমে কাফেরদের) ইসলামের প্রতি আহ্বান করতে থাকা এবং মুসলিমদের জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে থাকা। ইমাম যখন মানুষকে যুদ্ধের প্রতি আহ্বান জানাবে, তখন তাদের কর্তব্য হলো, তার ডাকে সাড়া দেয়া, তার অবাধ্যতা না করা। জিহাদের সুযোগ ও শক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কাফের-মুশরিকদের ইসলাম বা জিযিয়া প্রদানের আহ্বান ব্যতীত ছেড়ে রাখার সুযোগ নেই।” –শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ১/১৮৯ (আশ-শারিকাতুশ শারকিয়্যাহ)

শাফেয়ী মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী রহিমাহুল্লাহ (৪৭৮ হি.) বলেন,

«والمختار عندي في هذا مسالكُ الأصوليين، وهم لم يَرْوا التخصيص بالسَّنة، ولكن رأَوْا أن الجهاد دعوة قهرية، فيجب إدامته على حسب الإمكان والإطاقة، حتى لا يبقى إلا مسلمٌ أو مسالم ولا يختص بمرة في السنة، ولا يعطل إذا أمكنت الزيادة». راجع: «نهاية المطلب» (17 : 397 ط. دار المنهاج : 1428هـ) و«روضة الطالبين» (10/209 ط. المكتب الإسلامي:1412هـ)

“বছরে কতবার জিহাদ ওয়াজিব, এব্যাপারে আমার নিকট উসূল শাস্ত্রবিদদের মতটিই গ্রহণযোগ্য। তারা এ বিষয়টিকে কোনো সংখ্যার সাথে নির্দিষ্ট করেননি। বরং তাদের মতে জিহাদ হলো জোরপূর্বক দাওয়াত। তাই যখনই জিহাদ করা সম্ভব হবে, জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্য অর্জিত হবে, তখনই জিহাদ করা ওয়াজিব হবে। যতক্ষণ না পৃথিবীতে মুসলিম বা ‘মুসালিম’ (জিযিয়া বা সন্ধি চুক্তিবদ্ধ) ব্যতীত অন্য কেউ বাকী না থাকে।” -নেহায়াতুল মাতলাব, ইমামুল হারামাইন: ১৭/৩৯৭; রওযাতুত তালিবিন: ইমাম নববী: ১০/২০৯

মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ আলেম ইমাম কারাফী রহিমাহুল্লাহ (৬৮৪ হি.) বলেন,

وفي التلقين هو من فروض الكفايات لا يجوز تركه إلا لعذر ولا يكف عنهم إلا أن يدخلوا في ديننا أو يؤدوا الجزية في بلدنا -الذخيرة (3/ 385 ط. دار الغرب الإسلامي- بيروت)

“তালকীন গ্রন্থে বলা হয়েছে জিহাদ ফরযে কেফায়া। কোনো ওজর ব্যতীত জিহাদ পরিত্যাগ করা জায়েয নেই। কাফেররা যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দীনে প্রবেশ না করবে কিংবা আমাদের দেশে জিযিয়া প্রদান করে না থাকবে, ততক্ষণ তাদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করা হবে না।” -আয-যখিরাহ: ৩/৩৮৫ (দারুল গরবিল ইসলামী)

ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ দুটি গ্রন্থ; আল-মুহীতুল বুরহানী ও ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে এসেছে,

«قال أبو الحسن الكرخي رحمه الله في مختصره: ولا ينبغي أن يخلى ثغر من ثغور المسلمين ممن يقاوم العدو في قتالهم، وإن ضعف أهل ثغر من الثغور عن المقاومة مع العدو وخيف عليهم، فعلى من وراءهم من المسلمين أن ينفروا إليهم الأقرب فالأقرب، وأن يمدوهم بالكراع والسلاح ليكون الجهاد أبدا قائما، والدعاء إلى الله تعالى وإلى دينه متصلا». )المحيط البرهاني: (91 : 7 ط. إدارة القرآن: 1424 هـ). والفتاوى الهندية: (2 : 188 ط. دار الفكر)

“ইমাম আবুল হাসান কারখী রহিমাহুল্লাহ বলেন, মুসলমানদের কোনো সীমান্ত এমন বাহিনী-শূন্য রাখার সুযোগ নেই, যারা শত্রুর মোকাবিলায় সক্ষম। যদি কোনো সীমান্তের লোকেরা শত্রুর মোকাবিলা করতে অক্ষম হয়ে যায় এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশংকা তৈরি হয়, তবে তাদের নিকটবর্তী মুসলিমদের উপর পর্যায়ক্রমে জান-মাল দ্বারা তাদের সাহায্য করা আবশ্যক হয়ে যায়। যেন জিহাদ সর্বদা চলতে থাকে এবং (জিহাদের মাধ্যমে) আল্লাহর দীনের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন দাওয়াত জারি থাকে।” –আল-মুহিতুল বুরহানী: ৭/৯১ (ইদারাতুল কুরআন); আল-হিন্দিয়া: ২/১৮৮ (দারুল ফিকর)

এ জন্যই আলেমদের ইজমায়ী সিদ্ধান্ত হলো মুসলিমদের কোনো স্বার্থ বা কল্যাণ না থাকলে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ বিরতির সন্ধি করা জায়েয নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ وَاللَّهُ مَعَكُمْ. -محمد: 35

“(হে মুসলিমগণ!) তোমরা মনোবল হারিয়ে সন্ধির প্রস্তাব দিও না। তোমরাই উপরে থাকবে, আল্লাহ তোমাদের সাথে।” -সূরা মুহাম্মদ ৪৭: ৩৫

আয়াতের তাফসীরে ইমাম আবু বকর জাসসাস রহিমাহুল্লাহ (৩৭০ হি.) বলেন,

فنهى عن المسالمة عند القوة على قهر العدو وقتلهم; وكذلك قال أصحابنا: إذا قدر بعض أهل الثغور على قتال العدو ومقاومتهم لم تجز لهم مسالمتهم ولا يجوز لهم إقرارهم على الكفر إلا بالجزية، وإن ضعفوا عن قتالهم جاز لهم مسالمتهم كما سالم النبي صلى الله عليه وسلم كثيرا من أصناف الكفار وهادنهم على وضع الحرب بينهم من غير جزية أخذها منهم. أحكام القرآن للجصاص ط العلمية (3/90)

“শত্রুদের পর্যুদস্ত করা ও হত্যা করার ক্ষমতা থাকলে, আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে সন্ধি করতে নিষেধ করেছেন। আমাদের মাযহাবের ইমামগণও এমনটাই বলেছেন। যদি কোনো সীমান্তের অধিবাসীরা শত্রুদের মোকাবেলা ও যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়, তবে তাদের জন্য সন্ধি করা এবং জিযিয়া ব্যতীত কাফেরদের কুফরীতে বহাল রাখা জায়েয হবে না। আর যদি তাদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা না থাকে, তাহলে সন্ধি করা জায়েয হবে। যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন; কাফেরদের বিভিন্ন গোত্রের সাথে জিযিয়া গ্রহণ ব্যতীতই যুদ্ধ বিরতির চুক্তি করেছেন।” -আহকামুল কুরআন: ৩/৯০ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)

ইমাম ইবনুল কাত্তান আল-ফাসী রহিমাহুল্লাহ (৬২৮ হি.) বলেন,

واتفق الجميع أن الصلح لا يجوز إلا في صالح المسلمين. -الإقناع في مسائل الإجماع (1/ 360  الفاروق الحديثة للطباعة والنشر)

আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, মুসলিমদের কল্যাণ না থাকলে সন্ধি করা জায়েয হবে না। -আল-ইকনা: ১/৩৬০ (আল-ফারুকুল হাদীসাহ)

গত শতাব্দীর বরেণ্য আলেমগণের তত্ত্বাবধানে রচিত ফিকহি বিশ্বকোষ ‘মাওসূআহ ফিকহিয়্যাহ কুয়েতিয়্যায় বলা হয়েছে,

وقد أجمع الفقهاء على جواز المهادنة متى كانت في ذلك مصلحة للمسلمين لقوله تعالى : { فلا تهنوا وتدعوا إلى السلم وأنتم الأعلون } فأما إذا لم يكن في الموادعة مصلحة فلا يجوز بالإجماع. –الموسوعة الفقهية الكويتية (25/ 232 ط. وزارة الأوقاف)

“মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর হলে যুদ্ধবিরতি চুক্তি জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ফুকাহাগণ একমত। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা মনোবল হারিয়ে সন্ধির প্রস্তাব দিও না। তোমরাই উপরে থাকবে। আল্লাহ তোমাদের সাথে।” তবে যুদ্ধ বিরতির চুক্তিতে মুসলিমদের কোনো কল্যাণ না থাকলে, আলেমদের ঐকমত্যে তা জায়েয নয়।” -মাওসূআহ ফিকহিয়্যাহ: ২৫/২৩২ (ওযারাতুল আওকাফ, কুয়েত)

আরও দেখুন, তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৭/৩২৩ (দারু তাইবাহ); আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী: ২/৪২৭ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ); মাবসূতে সারাখসী: ১০/৮৬ (দারুল মারেফাহ); বাদায়েউস সানায়ে: ৭/১০৮ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ); ফাতহুল কাদীর: ৫/৪৫৬ (দারুল ফিকর); আল-মুগনী: ৯/২৯৭ (মাকতাবাতুল কাহেরা); আস-সফাদিয়্যাহ, ইবনে তাইমিয়াহ: ২/৩২১ (মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়াহ); রদ্দুল মুহতার: ৪/১৩৩ (দারুল ফিকর)

জিযিয়ার বিধান সম্পর্কে আরও জানতে দেখুন,

ফাতওয়া: ১৪৮ মুসলিম দেশে অবস্থানরত অমুসলিমরা কতটুকু সুযোগ সুবিধা পাবে?

والله تعالى أعلم

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

২৭-০২-১৪৪৬ হি.

০২-০৯-২০২৪ ঈ.

Back to top button