জিহাদ-কিতাল:ফাতওয়া  নং  ৪১২

নারীদের জন্য সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণের বিধান

নারীদের জন্য সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণের বিধান

নারীদের জন্য সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণের বিধান

পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্ন-১

নারীদের উপর জিহাদ কখন ফরয হয়?

 -সালমান

প্রশ্ন-২

একজন থেকে শুনলাম, পুরুষের মতো নারীদেরও নাকি আত্মরক্ষামূলক জিহাদে মুখোমুখি লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা ফরয। কথাটি কতটুকু সত্য?

-মোরশেদ

প্রশ্ন-৩

পুরুষদের মতো নারীদেরও কি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ফরয? যদি ফরয হয়, তবে আমরা কীভাবে আমাদের দায়িত্ব পালন করবো? আমরা কীভাবে এই ফরয তরকের গুনাহ থেকে বাঁচবো? অনুগ্রহ করে যদি এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেন, তবে অনেক উপকৃত হবো।

-বিনতে সাফা

প্রশ্ন-৪

নারীদের উপর কি ময়দানে জিহাদ করা ফরয?

-মুহাম্মদ

 

 

উত্তর:

নারীদের উপর শুধু দুই অবস্থায় কিতাল তথা মুখোমুখি যুদ্ধ ফরযে আইন হয়,

এক. আত্মরক্ষার জন্য। অর্থাৎ যদি কেউ কোনো নারীর উপর আক্রমণ করে, তখন নিজেকে রক্ষার জন্য তার উপর আক্রমণকারীকে যথাসাধ্য প্রতিহত করা ফরয হয়ে যায়। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,

أن أم سليم اتخذت يوم حنين خنجرا، فكان معها، فرآها أبو طلحة، فقال: يا رسول الله، هذه أم سليم معها خنجر، فقال لها رسول الله صلى الله عليه وسلم: «ما هذا الخنجر؟» قالت: اتخذته إن دنا مني أحد من المشركين، بقرت به بطنه، فجعل رسول الله صلى الله عليه وسلم يضحك –صحيح مسلم (1809)

“উম্মে সুলাইম রাযিয়াল্লাহু আনহা হুনাইন যুদ্ধের দিন একটি খঞ্জর সঙ্গে রাখলেন। (তাঁর স্বামী) আবু তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু দেখে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, উম্মে সুলাইম তো সাথে খঞ্জর নিয়ে নিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই খঞ্জর দিয়ে কি করবে উম্মে সুলাইম? উম্মে সুলাইম বললেন, আমি এটা এজন্য নিয়েছি, যাতে কোনো মুশরিক আমার কাছে আসলে তার পেট ফুঁড়ে দিতে পারি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা শুনে হাসতে লাগলেন।” -সহীহ মুসলিম: ১৮০৯

আল্লামা আইনী রহিমাহুল্লাহ (৮৫৯ হি.) বলেন,

بل هو واجب عليها الدفع إذا دنى منها العدو كما في حديث أم سليم.

“শত্রু নারীর নিকটবর্তী হলে তার জন্য আত্মরক্ষা করা ফরয, যেমনটা উম্মে সুলাইমের হাদীসে এসেছে।” -উমদাতুল কারী: ১৪/১৬৬ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস); আরও দেখুন: আত-তাওযীহ: ১৭/৫৬৯ (দারুন নাওয়াদির, দিমাশক); সুবুলুসু সালাম: ২/৪৬০ (দারুল হাদীস, কায়রো)

দুই. যখন শত্রুরা কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমণ করে এবং নারীদের অংশগ্রহণ ব্যতীত শুধু পুরুষরা তাদের প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট না হয়, তখন নারীদের উপরও কিতাল ফরযে আইন হয়ে যায়। ইমাম মুহাম্মদ রহিমাহুল্লাহ বলেন,

لا يعجبنا أن تقاتل النساء المسلمات مع الرجال إلا أن يضطر المسلمون إلى ذلك، فإن اضطر المسلمون إلى ذلك بأن جاء النفير، وكان في خروجهن حاجة وضرورة، فلا بأس بخروجهن للقتال، ولهن أن يخرجن في هذه الحالة من غير إذن آبائهن لأن القتال في هذه الحالة فرض عين، وليس لهم حق المنع عما هو فرض عين». –شرح السير الكبير (ص: 201) والمحيط البرهاني: 7/110 ط. إدارة القرآن كراتشي، والفتاوى الهندية: 2/189 ط. دار الفكر، الطبعة: الثانية، 1310 هـ

“মুসলিম নারীদের পুরুষদের সাথে মিলে সরাসরি যুদ্ধ করা আমরা পছন্দ করি না। তবে যদি মুসলিমরা (অনন্যোপায় হয়ে) নারীদের যুদ্ধে নিতে বাধ্য হয় তাহলে কথা ভিন্ন। মুসলিমরা যদি (অনন্যোপায় হয়ে) নারীদের যুদ্ধে নিতে বাধ্য হয়- যেমন নাফিরে আমের হালাত সৃষ্টি হলো এবং (শত্রু প্রতিহত করার জন্য) নারীদের জিহাদে বের হওয়া একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়লো- তখন তারা যুদ্ধে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে তাদের জন্য পিতা ও স্বামীর অনুমতি নেওয়াও জরুরি নয়। কেননা এ অবস্থায় কিতাল ফরযে আইন। অভিভাবকদের জন্য ফরযে আইন হতে নিষেধ করার অধিকার নেই।” -শরহুস সিয়ার: পৃ: ২০১; আলমুহিতুল বুরহানী: ৭/১১০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ২/১৮৯

আর যদি নারীদের ছাড়াই পুরুষরা কাফেরদের প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট হয়, তবে নারীদের উপর সরসারি কিতালে যুক্ত হওয়া ফরয নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে একাধিকবার কাফেররা মুসলিমদের উপর আক্রমণ করতে এসেছে, যার কারণে নফীরে আম তথা ব্যাপকভাবে সকল মুসলিমের উপর জিহাদ ফরযে আইন হয়েছে এবং যারা জিহাদে যাননি, তাদের ভর্ৎসনা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু তথাপিও সেসকল যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের নিয়ে যাননি।

খন্দকের যুদ্ধ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

كنت أنا وعمر بن أبي سلمة، يوم الخندق مع النسوة في أطم حسان. -أخرجه البخاري: (3720) ومسلم: (2416)

“খন্দকের যু্দ্ধের সময় আমি ও উমর বিন আবু সালামাহ নারীদের সাথে হাসসান (বিন সাবেত)-এর দুর্গে ছিলাম।” -সহীহ বুখারী: ৩৭২০; সহীহ মুসলিম: ২৪১৬

তাবুকের যুদ্ধে রোমানরা মুসলমানদের বিপক্ষে বাহিনী জড়ো করার সংবাদ এসেছিলো, তখনও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের যুদ্ধে নিয়ে যাননি; বরং আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে নারী ও শিশুদের দায়িত্ব দিয়ে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন। সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم خرج إلى تبوك، واستخلف عليا، فقال: أتخلفني في الصبيان والنساء؟ قال: «ألا ترضى أن تكون مني بمنزلة هارون، من موسى إلا أنه ليس نبي بعدي». -أخرجه البخاري: (4416) ومسلم (2404)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত বানিয়ে যান, তখন আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আপনি কি আমাকে নারী ও শিশুদের মাঝে রেখে যাচ্ছেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে, যেমন হারুন আলাইহিস সালাম মূসা আলাইহিস সালামের স্থলাভিষিক্ত ছিলেন? তবে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে (হারুন আলাইহিস সালাম নবী ছিলেন, কিন্তু তুমি নবী নও, কারণ) আমার পর আর কোনো নবী নেই।”-সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৪১৬

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্ত নীতির আলোকেই ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, যদি পুরুষরাই কাফেরদের প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট হয়, তবে নারীরা কিতালে যাবে না। প্রয়োজন হলে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু অংশ গ্রহণ করবে। যেমন নারীরা যোদ্ধাদের রান্না-বান্না, আহতদের সেবা-‍শুশ্রূষা ইত্যাদিতে ক্ষান্ত থাকবে। একান্ত প্রয়োজন হলে সরাসরি কিতালেও অংশ গ্রহণ করবে। একইভাবে এই কাজগুলো যুবতি নারীদের পরিবর্তে বয়স্কা নারীদের দিয়ে সারার চেষ্টা করবে। একান্ত প্রয়োজন হলে তুলনামূলক কম বয়স্কা নারীদেরও নিতে পারবে।

ফাতাওয়া তাতারখানিয়াতে বলা হয়েছে,

قال محمد: لايعجبنا أن تقاتل النساء المسلمات مع الرجال، إلا أن يضطر المسلمون إلى ذلك، فإن اضطر المسلمون إلى ذلك بأن جاء النفير العام وكان في خروجهن حاجة وضرورة فلا بأس بخروجهن للقتال، ولهن أن يخرجن في هذه الحالة من غير إذن آبائهن وأزواجهن وليس لهم منعهن عن الخروج ويأثمون بالمنع عن الخروج، وكذا إذا لم يضطر المسلمون إلى خروجهن، ولكن أمكنهن القتال من بعيد من حيث الرمي فلا بأس بذلك. -التاتارخانية 7/36-37

“ইমাম মুহাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, একান্ত নিরুপায় না হলে পুরুষদের পাশাপাশি মুসলিম নারীও লড়াই করুক, এটা আমাদের পছন্দ নয়। তবে যদি মুসলিমরা নিতান্তই নিরুপায় পরিস্থিতির শিকার হয়, যেমন নাফিরে আম হয়ে গেল আর লড়াইয়ে নারীদের বের হওয়ারও জরুরত পড়লো, তাহলে বের হতে সমস্যা নেই। এসময় তারা তাদের পিতা (তথা অভিভাবক) ও স্বামীদের অনুমতি ছাড়াও বের হতে পারবে। তারা বাধা দিতে পারবে না। বাধা দিলে গুনাহগার হবে।

তদ্রূপ নারীদের বের হওয়ার মতো নিরুপায় অবস্থা সৃষ্টি না হলেও যদি দূর থেকে তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে লড়াই করা তাদের জন্য সম্ভব হয়, তাহলেও তাতে সমস্যা নেই।” -তাতারখানিয়া: ৭/৩৬-৩৭

উল্লেখ্য, নারীদের জন্য যদিও নিরুপায় পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে সরাসরি কিতালে অংশ গ্রহণ করা ঠিক নয়, কিন্তু জিহাদ যখন আমভাবে সবার উপর ফরয হয়ে যায়, যেমন বর্তমানে হয়ে আছে, তখন নারীদেরও নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ, দাওয়াত ও ‍মুজাহিদদের নুসরত ইত্যাদির মাধ্যমে জিহাদের অন্যান্য কাজে অংশ গ্রহণ করা জরুরি। -সূরা তাওবা (০৯): ৯১; সুনানে আবু দাউদ: ৪/১৫৯, হাদীস নং: ২৫০৪; (দারুল রিসালাতিল আলামিয়্যাহ) আহকামুল কুরআন: ৩/১৪৮, ১৮৬ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ (৭২৮ হি.) বলেন,

والجهاد منه ما هو باليد ومنه ما هو بالقلب والدعوة والحجة واللسان والرأي والتدبير والصناعة فيجب بغاية ما يمكنه. ويجب على القعدة لعذر أن يخلفوا الغزاة في أهليهم ومالهم. اهـ -الفتاوى الكبرى لابن تيمية (5/ 538)

“জিহাদ হাত দিয়ে হতে পারে, হতে পারে অন্তর দিয়ে অথবা দাওয়াত ও প্রমাণাদি পেশ করার মাধ্যমে কিংবা জবান ও মতামত দিয়ে এবং পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় শিল্পকর্মের মাধ্যমে। একজনের পক্ষে সর্বোচ্চ যতটুকু সম্ভব ততটুকু করা ওয়াজিব। কোনো ওজরের কারণে যারা যেতে পারবে না, তাদের উপর ওয়াজিব হলো, মুজাহিদদের সম্পদ ও পরিবারের দেখাশোনা করা।” আলফাতাওয়াল কুবরা: ৫/৫৩৮

তিনি আরও বলেন,

ومن عجز عن الجهاد ببدنه وقدر على الجهاد بماله وجب الجهاد بماله وهو نص أحمد في رواية أبي الحكم وهو الذي قطع به القاضي في أحكام القرآن في سورة براءة عند قوله : { انفروا خفافا وثقالا }. فيجب على الموسرين النفقة في سبيل الله. وعلى هذا فيجب على النساء الجهاد في أموالهن إن كان فيها فضل وكذلك في أموال الصغار إذا احتيج إليها[1]  كما تجب النفقات والزكاة. وينبغي أن يكون محل الروايتين في واجب الكفاية. فأما إذا هجم العدو فلا يبقى للخلاف وجه. فإن دفع ضررهم عن الدين والنفس والحرمة واجب إجماعا. اهــــ -الفتاوى الكبرى لابن تيمية (5/ 537)، الناشر : دار المعرفة – بيروت

“যে সশরীরে জিহাদ করতে সক্ষম নয়, কিন্তু সম্পদ দিয়ে জিহাদে শরীক হতে সক্ষম, সম্পদ দিয়ে জিহাদ করা তার উপর ওয়াজিব। … অতএব, সম্পদ দিয়ে জিহাদ করা নারীদের উপর ওয়াজিব- যদি তাদের অতিরিক্ত সম্পদ থাকে। প্রয়োজন দেখা দিলে শিশুদের সম্পদের ক্ষেত্রেও একই কথা।” –আলফাতাওয়াল কুবরা: ৫/৫৩৭

এ বিষয়ে আরও জানতে নিম্মোক্ত ফাতওয়াটি দেখুন,

ফাতওয়া: 120- সামর্থ্যবানদের জন্য সম্পদ দিয়ে জিহাদ করা কি ফরয?

فقط، والله تعالى أعلم بالصواب

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

২৯-১২-১৪৪৪ হি.

১৮-০৭-২০২৩ ঈ.

[1]   قال الراقم: فى المطبوع ” وإذا احتيج إليها”- بزيادة الواو. لعل هذا خطأ مطبعي. ونقل المشايخ العبارة كما ذكرت بدون الواو. والله تعالى أعلم.

Related Articles

Back to top button