মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে কি জিহাদ বলা যাবে?
পিডিএফ ডাউলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
প্রশ্নঃ মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে কি জিহাদ বলা যাবে?
প্রশ্নকারী- সবুজ
উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم
তাগুত ও মুরতাদ শাসককে অপসারণের জন্য তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র কিতাল এবং কিতালের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত অন্যান্য কার্যক্রম জিহাদ হিসেবে গণ্য।
বলা বাহুল্য, মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদের উদ্দেশ্যই ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করা এবং জমিনে আল্লাহর শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত করা। সুতরাং এউদ্দেশ্যে জিহাদরত ব্যক্তি উক্ত শাসক বা তার সহযোগীর হাতে নিহত হলে তারাও শহীদ গণ্য হবে এবং তাদের ওপর শহীদের বিধান কার্যকর হবে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি রহ. (১১৭৬ হি.) বলেন,
فَإِذا كفر الْخَلِيفَة بانكار ضرورى من ضروريات الدّين حل قِتَاله بل وَجب وَإِلَّا لَا، وَذَلِكَ لِأَنَّهُ حِينَئِذٍ فَاتَت مصلحَة نَصبه، يل يخَاف مفسدته على الْقَوْم، فَصَارَ قِتَاله من الْجِهَاد فِي سَبِيل الله. -حجة الله البالغة (2/ 232)، الناشر: دار الجيل، بيروت – لبنان
“জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো কিছু অস্বীকার করার কারণে খলিফা কাফের হয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে কিতাল বৈধ, বরং ওয়াজিব। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে কিতাল বৈধ নয়। কারণ, যে মাসলাহাতের উদ্দেশ্যে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, কাফের হয়ে গেলে তা ব্যাহত হয়; বরং তখন তার কারণে মুসলিমদের উল্টো ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়। এঅবস্থায় তার বিরুদ্ধে কিতাল; জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর অন্তর্ভুক্ত।” -হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগা: ২/২৩২
ইমাম নববি রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,
ولا يغسل الشهيد ولا يصلى عليه وهو من مات في قتال الكفار بسببه. منهاج الطالبين وعمدة المفتين في الفقه (ص: 60)
“শহীদকে গোসল দেয়া হবে না, এবং (শাফিয়ি মাযহাব মতে) জানাযাও পড়া হবে না। শহীদ হচ্ছে কাফেরদের বিরুদ্ধে কিতালে; কিতাল সংক্রান্ত কোনো কারণে যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করে।” -মিনহাজুত তালিবিন, পৃষ্ঠা: ৬০
এর ব্যাখ্যায় খতিব শারবিনি রহ. (৯৭৭ হি.) বলেন,
(وهو) أي الشهيد الذي يحرم عليه غسله والصلاة عليه، ضابطه أنه كل (من مات) ولو امرأة أو رقيقا أو صغيرا أو مجنونا (في قتال الكفار) أو الكافر الواحد، سواء أكانوا حربيين أم مرتدين أم أهل ذمة، قصدوا قطع الطريق علينا أو نحو ذلك (بسببه) أي القتال سواء قتله كافر، أم أصابه سلاح مسلم خطأ، أم عاد إليه سلاحه، أم تردى في بئر أو وهدة، أم رفسته دابته فمات، أم قتله مسلم باغ استعان به أهل الحرب. -مغني المحتاج إلى معرفة معاني ألفاظ المنهاج (2/33- 34)، الخطيب الشربيني الشافعي (المتوفى: 977هـ)، ط. دار الكتب العلمية
“যে শহীদকে গোসল দেয়া ও জানাযা পড়া নিষেধ, তার সংজ্ঞায় মূলনীতি হলো, শহীদ প্রত্যেক এমন মুসলিম –চাই সে মহিলা, গোলাম, নাবালেগ বা পাগল যেই হোক না কেন- যে এক বা একাধিক কাফেরের বিরুদ্ধে কিতালে; কিতাল সংক্রান্ত কোনো কারণে মৃত্যু বরণ করবে। হতে পারে সে কাফের হারবি, মুরতাদ বা যিম্মি। হতে পারে তারা আমাদের বিরুদ্ধে রাহজানি করতে এসেছিল (ফলে মারামারি বেঁধে গেছে) বা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। উক্ত মুসলিমকে কোনো কাফের হত্যা করে থাকলেও শহীদ; কোনো মুসলিমের অস্ত্র ভুলক্রমে তার গায়ে লেগে মারা গেলেও শহীদ। (সজোরে চালনার ফলে) নিজের অস্ত্র নিজের গায়ে ফিরে এসে মারা গেলেও শহীদ। কোনো কূপে বা গর্তে পড়ে মারা গেলেও শহীদ। আপন বাহনের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা গেলেও শহীদ। কিংবা হারবি কাফেরদের দলভুক্ত সীমালংঘনকারী কোনো মুসলিম তাকে হত্যা করলেও শহীদ।” -মুগনিল মুহতাজ: ২/৩৩-৩৪
শায়খ খায়র হাইকাল বলেন,
ثالثا: هل هذا القتال هو من الجهاد في سبيل الله؟
الجواب هو:
إن كان الحاكم قد كفر فعلا، وساندته قوى أيدته على باطله، فالقتال في سبيل إزاحته وقتله هو جهاد في سبيل الله؛ لأنه ينطبق عليه أنه قتال كافر لإعلاء كلمة الله عز وجل ….
والمقتول من الثائرين في وجه الحاكم الكافر يكون شهيدا فى الدنيا والآخرة، حتى ولو قتله مسلم يؤيد ذلك الحاكم الكافر …..
وعلى هذا، فالحاكم المرتد صار من أهل الحرب، والمسلمون الذين يقاتلون في صفه صاروا بغاة يستعين بهم من هو من أهل الحرب، فمن يقتل على أيديهم إنما يقتل في حرب ضد الكافر، فيكون شهيدا في حكم الدنيا والآخرة، وتكون هذه الحرب جهادا في سبيل الله……
-الجهاد والقتال في السياسة الشرعية: ص: 139-140، ط. دار ابن حزم
“তৃতীয় আলোচনা: মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে কিতাল; জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ গণ্য হবে কি?
উত্তর: শাসক যদি বাস্তবেই কাফের হয়ে যায় এবং শক্তির অধিকারী বিভিন্ন দল এ অন্যায় কাজে তার সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে তাকে অপসারণ ও হত্যার জন্য কিতাল করা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র অন্তুর্ভুক্ত। কারণ এ কিতালের ব্যাপারে এ কথা প্রযোজ্য যে, এটি ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহর জন্য কাফেরের বিরুদ্ধে কিতাল।…
মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের যারা নিহত হবে, তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় বিচারে শহীদ গণ্য হবে। এমনকি উক্ত মুরতাদ শাসকের পক্ষাবলম্বী কোনো মুসলিম তাকে হত্যা করলেও সে শহীদ। ….
অতএব বলা যায়, মুরতাদ শাসক হারবি কাফেরে পরিণত হয়। যেসব মুসলিম তার পক্ষ হয়ে কিতাল করে, তারা সীমালংঘনকারীতে পরিণত হয়, যাদেরকে হারবিরা ব্যবহার করে। কাজেই তাদের হাতে যারা নিহত হবে, তারা কাফেরের বিরুদ্ধে কিতালে নিহত এবং দুনিয়া আখেরাত উভয় বিচারেই তারা শহীদ গণ্য হবে। আর এ যুদ্ধ হবে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।…” -আলজিহাদ ওয়াল কিতাল ফিসসিয়াসাতিশ শরঈয়্যাহ: ১৩৯-১৪০
উল্লেখ্য, মুরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ, আসল কাফেরদের বিরুদ্ধে ইকদামি জিহাদ অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম দাবিদার বাতেনি কাফেরদের ব্যাপারে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,
ولا ريب أن جهاد هؤلاء وإقامة الحدود عليهم من أعظم الطاعات وأكبر الواجبات وهو أفضل من جهاد من لا يقاتل المسلمين من المشركين وأهل الكتاب؛ فإن جهاد هؤلاء من جنس جهاد المرتدين والصديق وسائر الصحابة بدءوا بجهاد المرتدين قبل جهاد الكفار من أهل الكتاب؛ فإن جهاد هؤلاء حفظ لما فتح من بلاد المسلمين وأن يدخل فيه من أراد الخروج عنه. وجهاد من لم يقاتلنا من المشركين وأهل الكتاب من زيادة إظهار الدين. وحفظ رأس المال مقدم على الربح. مجموع الفتاوى (35/ 158-159)
“কোনো সন্দেহ নেই যে, এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা এবং এদের ওপর হদ কায়েম করা আল্লাহ তাআলার মহা আনুগত্যের কাজ এবং সর্বাপেক্ষা বড় ফরযগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এ কাজ যেসব মুশরিক ও আহলে কিতাব মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত নয়, তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করার চেয়েও বড় ফজিলতের কাজ। কারণ এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার শ্রেণিভুক্ত। সিদ্দিকে আকবার (আবু বকর) রাদি.সহ অন্য সকল সাহাবায়ে কেরাম আহলে কিতাব কাফেরদের রেখে আগে মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। কারণ, এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার উদ্দেশ্য বিজিত মুসলিম ভূমিগুলো সুরক্ষিত রাখা এবং যারা দ্বীন থেকে বের হয়ে গেছে, তাদেরকে পুনরায় তাতে ফিরিয়ে আনা। পক্ষান্তরে যেসকল মুশরিক ও আহলে কিতাব আমাদের বিরুদ্ধে কিতালে আসেনি, তাদের বিরুদ্ধে কিতালের উদ্দেশ্য (আরও ভূমি ও ব্যক্তির ওপর) দ্বীনের আধিপত্য বিস্তার করা। একথা স্পষ্ট যে, লাভের তুলনায় মূলধন ঠিক রাখা অগ্রগণ্য।” -মাজমুউল ফাতাওয়া:৩৫/১৫৮-১৫৯
মুরতাদ শাসক সম্পর্কে একটি হাদিসে হযরত উবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
دعانا النبي صلى الله عليه وسلم فَبَايَعْنَاهُ. فكان فيما أخذ علينا أَنْ بَايَعَنَا على السمع والطاعة في مَنشَطِنا ومَكْرَهِنا، وعُسرنا ويُسرنا، وَأَثَرَة علينا، وَأَنْ لا نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَه. قَالَ: إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ. (متفق عليه وهذا لفظ مسلم.)
“আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডাকলেন এবং আমরা তাঁর হাতে বাইআত হলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের থেকে যে বিষয়ে বাইআত নিলেন তার একটি ছিল, আমরা আমাদের পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় বিষয়ে, সুখে-দুঃখে এবং আমাদের ওপর যদি অন্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়, তথাপিও (আমীরের কথা) শুনবো ও আনুগত্য করবো এবং আমরা দায়িত্বশীলের সাথে দায়িত্ব নিয়ে বিবাদে জড়াবো না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন তবে হ্যাঁ, যদি (দায়িত্বশীলের থেকে) তোমরা কোনো স্পষ্ট কুফর দেখতে পাও, যার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে- তাহলে ভিন্ন কথা।” -সহীহ বুখারী: ৬৬৪৭, সহীহ মুসলিম: ৪৮৭৭
হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
ملخصه أنه يَنعَزِلُ بالكفر إجماعا فيجبُ على كل مسلمٍ القيامُ في ذلك، فمن قَوِيَ على ذلك فله الثوابُ، ومن داهن فعليه الإثمُ، ومن عَجَزَ وجبتْ عليه الهجرةُ من تلكَ الأرضِ. اهـ
“সারকথা, কুফরির কারণে শাসক সর্বসম্মতিক্রমে অপসারিত হয়ে যাবে। তখন প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ হলো, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যে তাতে সক্ষম হবে, তার জন্য রয়েছে প্রতিদান। যে শিথিলতা করবে, সে গুনাহগার হবে। আর যে অক্ষম, তার জন্য আবশ্যক হলো ওই ভূমি থেকে হিজরত করা।” – ফাতহুল বারি: ১৩/১৫৩
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
২৬-০৮-১৪৪২ হি.
১০-০৪-২০২১ ইং
আরও পড়ুন