তাযকিয়াফাতওয়া  নং  ২৮৮

বারবার তাওবা ভঙ্গ করলে কি তাওবার রাস্তা একদম বন্ধ হয়ে যায়?

বারবার তাওবা ভঙ্গ করলে কি তাওবার রাস্তা একদম বন্ধ হয়ে যায়?

বারবার তাওবা ভঙ্গ করলে কি তাওবার রাস্তা একদম বন্ধ হয়ে যায়?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্নঃ 

এক সময় আমি অনেক অশ্লীল কাজে লিপ্ত ছিলাম। বারবার তাওবা করতাম, কিন্তু আবার একই কাজ করতাম। একদিন বললাম, আল্লাহ! আমি যদি আরেকবার এ কাজে লিপ্ত হই তাহলে তুমি আমাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বানিয়ে দিয়ো। আমাকে চিরস্থায়ী পথভ্রষ্ট বানিয়ে দিয়ো। কিন্তু তারপরও আমি তাওবা ভঙ্গ করে সেই কাজে আবার লিপ্ত হই। এখন আমার জানার বিষয় হলো, আমি কি আসলেই চিরস্থায়ী পথভ্রষ্ট হয়ে গেছি? আমার কি ফিরে আসার কোনো পথ নেই?

প্রশ্নকারী- আব্দুল্লাহ আল-কাফি

উত্তরঃ

بسم الله الرحمن الرحيم

সকল প্রকারের গুনাহ ও অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকা একজন মুসলমানের জন্য জরুরী। কিন্তু শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কেউ যদি কোনো গুনাহ বা অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে তার জন্য আবশ্যক হলো, সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হয়ে তাওবা করা এবং ভবিষ্যতে এমন গুনাহ ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করা। এরপরও যদি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে বারবার এমন গুনাহ হতে থাকে, তাহলেও প্রত্যেকবার সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে উক্ত গুনাহ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কখনো নিরাশ হওয়া যাবে না। আল্লাহ বান্দাকে তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَيْأَسُوا مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ. –يوسف 87

“তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। জেনে রেখো আল্লাহর রহমত থেকে কেবল কাফির সম্প্রদায়ই নিরাশ হয়।” -সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৭

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ. –الزمر 53

“আপনি বলে দিন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজের উপর সীমালঙ্ঘন করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” -সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ، وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لاَ تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً. هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ. -سنن الترمذي ت بشار (5/ 440)، الرقم: 3540

“আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে আদম সন্তান! যতক্ষণ তুমি আমার কাছে দোয়া করতে থাকবে, আমার কাছে আশা করতে থাকবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করতে থাকবো; তোমার গুনাহ যতোই হোক। কারো পরোয়া করবো না। হে আদম সন্তান! যদি তোমার গুনাহ আসমান সমানও হয়, তারপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিবো। কারো পরোয়া করবো না। হে আদম সন্তান! যদি তুমি যমিন ভরা গুনাহ নিয়ে তাওবা কর, তারপর আমার সঙ্গে কোনো কিছু শরীক না করে আমার সামনে উপস্থিত হও; আমি যমিন ভরা ক্ষমা নিয়ে তোমার সামনে হাজির হবো।” -জামে তিরমিযী: ৩৫৪০

অন্য একটি হাদীসে এসেছে,

عن أبي سعيد رضي الله عنه : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( كان في بني إسرائيل رجل قتل تسعة وتسعين إنسانا ثم خرج يسأل فأتى راهبا فسأله فقال له هل من توبة ؟ قال لا . فقتله فجعل يسأل فقال له رجل ائت قرية كذا وكذا فأدركه الموت فناء بصدره نحوها فاختصمت فيه ملائكة الرحمة وملائكة العذاب فأوحى الله إلى هذه أن تقربي وأوحى الله إلى هذه أن تباعدي وقال قيسوا ما بينهما فوجد إلى هذه أقرب بشبر فغفر له ). صحيح البخاري (دار ابن كثير) (3/ 1280)، الرقم: 3283

“আবু সাঈদ (রাযি)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি ছিলো, যে নিরানব্বইটা খুন করেছিলো। তারপর (একদিন সে অনুতপ্ত হয়ে তাওবার জন্য বড় আলেমের খোঁজে) বের হলো। একজন পাদ্রির (সন্ধান পেয়ে তার) কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, (আমার) তাওবার কোনো সুযোগ আছে কি? পাদ্রি উত্তর দিলো, না (তোমার তাওবার কোনো সুযোগ নেই)। লোকটি তখন তাকেও খুন করে ফেললো (এবং একশ হত্যা পূর্ণ করলো)। তারপর আবারও (বড় আলেমের) সন্ধানে বের হলো।

এক আলেমের সন্ধান পেলো এবং ওই আলেম তাকে বললো, (কে তোমার তাওবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?) তুমি ওমুক গ্রামে চলে যাও (সেখানে কিছু নেককার লোক আছে, যারা আল্লাহর ইবাদত করে। তুমিও তাদের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকো। তোমার আগের এলাকায় আর ফিরে যেয়ো না। সেটি মন্দ এলাকা। এ কথা শুনে লোকটি ওই এলাকার দিকে রওনা হলো)। কিন্তু (পথিমধ্যে) তার মৃত্যু উপস্থিত হয়ে গেলো। (মুমূর্ষু অবস্থায়) লোকটি বুকে ভর দিয়ে (কোনোমতে) ওই গ্রামটির দিকে সামান্য অগ্রসর হলো (এবং ওই অবস্থায়ই মারা গেলো)।

(মৃত্যুর পর) তাকে নিয়ে রহমতের ফেরেশতা ও আযাবের ফেরেশতাদের মাঝে বিবাদ শুরু হলো। তখন আল্লাহ তায়ালা এই (নেক) অঞ্চলের ভূমিকে আদেশ দিলেন, ‘তুমি নিকটবর্তী হয়ে যাও’; আর এই অঞ্চলের ভূমিকে আদেশ দিলেন, ‘তুমি দূরে সরে যাও’। তারপর (ফেরেশতাদের উভয় দলকে) বললেন, এবার তোমরা দুই দিকের ভূমি মেপে দেখো। দেখা গেলো লোকটি ওই (নেক) এলাকাটির দিকে এক বিঘত বেশি এগিয়ে। ফলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো।” –সহীহ বুখারী: ৩২৮৩

সুতরাং বান্দা যতক্ষণ শিরক মুক্ত থাকবে, ততক্ষণ তার তাওবার পথ বন্ধ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

“আমাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বানিয়ে দিয়ো, আমাকে চিরস্থায়ী পথভ্রষ্ট বানিয়ে দিয়ো” এমন কথা বলা আপনার জন্য একদমই ঠিক হয়নি। নিজের বিরুদ্ধে এমন বদদোয়া করা অনেক বড় গুনাহ। অনতিবিলম্বে এ থেকেও তওবা করা জরুরী।

তবে এ কথার দ্বারা এবং পরবর্তীতে তাওবা ভঙ্গের দ্বারা আপনি চিরস্থায়ী পথভ্রষ্ট বা জাহান্নামী হয়ে যাননি। আপনার উচিত আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে বরং পুনরায় তাওবা করা। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাওয়া। ভবিষ্যতে সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা এবং তার উপর অবিচল থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। কখনও আবার গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করা। নিজের বিরুদ্ধে কোনো বদদোয়া না করা।

পাশাপাশি সকল ফরয আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে দোয়া, কিছু নফল আমল ও কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। অধিক পরিমাণে মুত্তাকী পরহেযগার আলেম-ওলামা ও নেককার ব্যক্তিদের সান্নিধ্য গ্রহণ করা এবং নিজের এজাতীয় সমস্যাগুলো উপস্থাপন করে কোনো বিজ্ঞ পরহেযগার আলেমের পরামর্শ নিয়ে জীবন যাপন করা। আশা করি তাতে আল্লাহ তাআলা আপনাকে গুনাহমুক্ত থাকার তাওফীক দিবেন এবং সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।

فقط، والله تعالى أعلم بالصواب

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

২৭-০২-১৪৪৪ হি.

২৪-০৯-২০২২ ঈ.

আরো পড়ুনঃ তাসাওউফের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু এবং আসল ও নকল কিভাবে পার্থক্য করব?

Back to top button