পাকিস্তান রাষ্ট্রের শরয়ী অবস্থান এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠার কর্মপদ্ধতি
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
ریاستِ پاکستان کی حیثیت اور نفاذِ شریعت کا طریقِ کار
পাকিস্তান রাষ্ট্রের শরয়ী অবস্থান
এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠার কর্মপদ্ধতি
শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা.বা.
ও মুফতী নুর ওয়ালী মেহসুদ দা.বা.-এর বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে
কিছু পর্যবেক্ষণ ও আবেদন
মাওলানা মুহাম্মাদ মুসান্না হাসসান দা.বা.
অনুবাদ: উযায়ের আহমদ
নাম
পাকিস্তান রাষ্ট্রের শরয়ী অবস্থান ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠার কর্মপদ্ধতি
মূল বই
ریاستِ پاکستان کی حیثیت اور نفاذِ شریعت کا طریقِ کار
লেখক
মাওলানা মুহাম্মদ মুসান্না হাসসান দা.বা.
অনুবাদক
উযায়ের আহমদ
মূল বই প্রকাশকাল
শাবান ১৪৪৪/মার্চ ২০২৩
অনুবাদ প্রকাশকাল
রমযান ১৪৪৫/মার্চ ২০২৪
সূচিপত্র
সেক্যুলার জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যকার দ্বন্দ্বই পাকিস্তানের আসল দ্বন্দ্ব 3
পাকিস্তানের দ্বীনদার শ্রেণির আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি.. 5
দ্বীনী মতাদর্শের দুরকম ব্যাখ্যা… 6
দ্বীনদার শ্রেণির প্রথম ধারা.. 7
দ্বীনদার শ্রেণির দ্বিতীয় ধারা.. 11
দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মপদ্ধতি.. 20
ইসলাম প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি.. 21
গণতান্ত্রিক রাজনীতি সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের মতামত. 22
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় দাওয়াতী ও তাবলীগী মেহনত. 27
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র সংগ্রাম. 29
প্রথম চিন্তাধারা অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রাম. 29
দ্বিতীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রাম. 32
সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপারে জরুরি জ্ঞাতব্য.. 36
‘পয়গামে পাকিস্তান’-এর বাস্তবতা.. 38
পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা এবং বিশ্বমোড়লদের এজেন্ডা.. 39
পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদারদের নিকট যুগের চাহিদা কী?. 41
শুরুর কথা
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম
সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবাগণ এবং তাঁদের অনুসারীদের ওপর।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে মুজাহিদদের আক্রমণ তীব্র রূপ ধারণ করার পর সরকারের পক্ষ থেকে দেশের শ্রদ্ধাভাজন উলামায়ে কেরামের একটি সভা আয়োজন করা হয়। সভায় শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে একটি বক্তব্য দেন। এতে আফগানিস্তানে তেহরিকে তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতৃবৃন্দের সাথে অনুষ্ঠিত আলোচনার বিষয়েও আলোকপাত করেন। ভাষণে তিনি এটাও বলেন, পাকিস্তান একটি ইসলামী ও মুসলমান রাষ্ট্র। সংবিধানে ‘কারারদাদে মাকাসেদ’[1] যুক্ত হওয়ার পর এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অতএব, এই ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা হারাম ও বিদ্রোহ বলে গণ্য হবে। কয়েকদিন পর এ বক্তব্যের জবাবে টিটিপি-র আমীর মুফতী নুর ওয়ালী মেহসুদ দা.বা. একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন এবং নিজেদের কর্মপদ্ধতির স্বপক্ষে শরয়ী দলীলাদি পেশ করেন।
এসবের মধ্য দিয়ে ‘পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের শরয়ী অবস্থান’ এবং এখানে ‘শরীয়ত প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র সংগ্রামের হুকুম’ নিয়ে আবারও আলোচনা উঠেছে। পাকিস্তানের সরকারি সংস্থাগুলো দেশের শ্রদ্ধাভাজন আলেমগণকে শরীয়ত প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত মুজাহিদদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। নিজেদের কর্মপদ্ধতি সংশোধনের বদলে তারা চেষ্টা করছে দ্বীনদার শ্রেণির মধ্যে বিভাজন ও শত্রুতা ছড়িয়ে দেওয়ার।
প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তান গত আট দশক ধরে ধারাবাহিক অবনতির শিকার। পাকিস্তান আজ একদিকে ইসলাম ও শরীয়তের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে দুনিয়াবি দিক থেকেও অধঃপতিত। সরকারি সংস্থাগুলোর এসব পদক্ষেপ পাকিস্তানকে আরও বেশি দুর্বলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং পরাশক্তির গোলাম ও খেলনায় পরিণত করেছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রিয় মাতৃভূমির দ্বীনদার শ্রেণির সাথে সম্পৃক্ত বিশিষ্ট ও সাধারণ, সকলের সামনে এ ভূমিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সম্পর্কে কিছু কথা বলা এবং বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে কিছু পর্যালোচনা ও আবেদন পেশ করা জরুরি মনে হচ্ছে।
শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, মাতৃভূমির অতীত ও বর্তমানের দুঃখজনক বাস্তবতা এবং এ ভূমিতে ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্বে ইসলামের করুণ পরিণতিতে তীব্রভাবে ব্যথিত হয়েছি। তাছাড়া ভবিষ্যত নিয়েও অত্যন্ত শঙ্কায় আছি। মাতৃভূমির প্রতি এই দরদ, ব্যথা ও শঙ্কা থেকেই এ বিষয়ে কলম ধরেছি। নির্দিষ্ট কোনো দলের মুখপাত্র হিসেবে নয়; বরং প্রিয় মাতৃভূমির একজন নাগরিক এবং এই ভূমির দ্বীনদার শ্রেণির একজন সদস্য হিসেবে এ কথাগুলো লেখা হয়েছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া জরুরি তা হলো, ‘পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র কি না’ এবং ‘এ দেশে ইসলাম কায়েমের পদ্ধতি কী?’—এ দুটি বিষয়ে জ্ঞানগত ও তাত্ত্বিক আলোচনা পেশ করা হয়েছে এ লেখায়। পাকিস্তানি প্রশাসনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিসহ দল-মত-নির্বিশেষে পাকিস্তানের প্রতি আন্তরিক সকল মানুষ এ বইয়ের উদ্দিষ্ট পাঠক। কর্মপন্থা বাস্তবায়ন বা প্রায়োগিক কোনো আলোচনা এ বইতে করা হয়নি। অবশ্য চিন্তা-চেতনা ও তত্ত্ব (থিওরি) তখনই উপকারী হয়, যখন তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করা হয়—এ কথা সকলেরই জানা।
সেক্যুলার জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যকার দ্বন্দ্বই পাকিস্তানের আসল দ্বন্দ্ব
পাকিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার রূপরেখা কী হবে—তা নির্ধারণের আগে এই রাষ্ট্রের অবস্থান নির্ণয় করা জরুরি। একটি বিচিত্র ব্যাপার হলো, পশ্চিমা আদর্শের অন্ধ-অনুসারী—যারা একদিকে এ দেশকে অনৈসলামিক ও লিবারেল-সেক্যুলার কাঠামোতে দাঁড় করাতে চায়, যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করেছিলেন—তারাই আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার অগণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোর (তা যতই শান্তিপূর্ণ হোক না কেন) বিরোধিতার সময় পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রমাণের চেষ্টা করে। আলেমদের ফতওয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ রাষ্ট্র ইসলামী নাকি অনৈসলামী—এর সাথে তাদের কী সম্পর্ক! তাদের কার্যকলাপ থেকে তো এটা স্পষ্ট, তারা দেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বানাতে চায়।
আসলে সোজাসাপটা কথা বলে এই লক্ষ্য যে পূরণ করতে পারবে না, তারা তা ভালোভাবেই জানে; তাই কপটতার আশ্রয় নেয়। মুখে ইসলামের কথা বললেও কাজ করে ইসলামবিরোধী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই ইংরেজদের সময়কার সরকারি আমলা, জেনারেল এবং ইংরেজদের তল্পিবাহক জমিদারেরা এই কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে। মুসলিম লীগের যে-সকল নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান আন্দোলনে সরব ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের হটিয়ে এই দালালশ্রেণিই ক্ষমতা আত্মসাৎ করেছে। মুখে ইসলামের নাম নিলেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই শাসক ও জেনারেলরা পরাশক্তিগুলোর হাতের পুতুল হয়ে থেকেছে, দেশকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দিকে।
এ কথাগুলো বলার কারণ হলো, পাকিস্তানে ‘রাষ্ট্র’ সম্পর্কে মূলত দুটি বয়ান পাওয়া যায়। একটি হলো, রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্ম রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডকে নিজের অনুগত হতে বাধ্য করে না। এটা ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ান। এই বয়ানের ধারক পাকিস্তানের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সাহায্যে তারাই পাকিস্তানের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। আফসোস আরও বেড়ে যায়, যখন দেখি এই গোষ্ঠীর লোকেরা দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত একটি শ্রেণিকেও চিন্তা ও দর্শনে নিজেদের সহযোগী বানিয়ে ফেলেছে। এই দ্বীনদার শ্রেণির নেতৃত্বে আছে জাভেদ আহমদ গামেদী, যিনি উল্লিখিত ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনকে ‘ইসলামী’ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। অন্যান্য আসমানী ধর্মের অনুসারীরা যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে দ্বীন হিসেবে মেনে নিয়েছে, ধর্মকে কেবল ব্যক্তিজীবনের বিষয় বানিয়ে ফেলেছে; ইসলামের প্রশ্নে গামেদীর দৃষ্টিভঙ্গি তেমনই।
তবে এই আদর্শ শুধু পাকিস্তানের সেক্যুলারগোষ্ঠীর কাছেই গ্রহণযোগ্য। দ্বীনদার শ্রেণির মধ্যে সাধারণভাবে এই আদর্শ গ্রহণযোগ্য নয়। তবে গতানুগতিক দ্বীনদার শ্রেণির অল্প কিছু সদস্য গামেদী সাহেবের অনুকরণে এই আদর্শ গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে মাওলানা সরফরায খান সফদর রহ.-এর বংশধর আম্মার খান নাসের, জামিয়া ইমদাদিয়া ফয়সালাবাদের যাহেদ সাহেব এবং করাচির রেয়ায়াতুল্লাহ ফারুকী সাহেব উল্লেখযোগ্য। তবে সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য। যেহেতু তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যায় সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম ও সালাফে সালিহিনের অনুসরণ এবং ফকীহগণের ইজতিহাদ[2] থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ পাকিস্তানের দ্বীনদার শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে বেশিকিছু লেখার প্রয়োজন নেই। শায়খুল ইসলাম মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. নিজেই গামেদী সাহেবের এই আদর্শিক বয়ানের ভ্রান্তি খণ্ডন করেছেন। আমরা এখানে শুধু এতটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করছি, প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তানের ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী সেক্যুলার মতাদর্শ বা ‘ইসলামী সেক্যুলারিজম’-এ বিশ্বাসী।
সেক্যুলার এবং প্রকৃত ইসলামী মতাদর্শের মধ্যকার দ্বন্দ্ব পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো দ্বন্দ্ব। অথচ সেক্যুলার মতাদর্শ পাকিস্তানের ভিত্তির সাথেই সাংঘর্ষিক। পাকিস্তানের দ্বীনদার শ্রেণি এবং অধিকাংশ জনগণ একে গ্রহণ করতে পারে না। তবে বলতে দ্বিধা নেই, আদর্শিকভাবে এই মতবাদকে গ্রহণ করা না হলেও বাস্তব জীবনে এটিই চলছে। এ মতবাদে বিশ্বাসীরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও এই গোষ্ঠীটি কীভাবে কর্তৃত্ব লাভ করল—তা নিয়ে সামনে আলোচনা আসছে।
পাকিস্তানের দ্বীনদার শ্রেণির আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি
ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে পাকিস্তানে অন্য যে দৃষ্টিভঙ্গিটি আছে, সেটিই দ্বীনদার শ্রেণির অবস্থান। তাদের মতে ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্ক অনস্বীকার্য। অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম কেবল ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং ইসলামে সমাজব্যবস্থা-সংক্রান্ত নির্দেশনাও রয়েছে। এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলা ঐচ্ছিক (Optional) নয়; বরং আবশ্যক (Compulsory)। রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করা ইসলামের সত্তাগত একটি দাবি। কোনো মুসলমানই এই দাবিকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। দ্বীনের অর্ধেক ছেড়ে দিয়ে কেবল বাকি অর্ধেকের ওপর আমল করার সুযোগ মুসলমানদের নেই। তেমনইভাবে ব্যক্তিজীবনে দ্বীনের ওপর আমল করে সামাজিক জীবনে ইসলামের নির্দেশনা থেকে ‘স্বাধীন’ হওয়ারও অবকাশ নেই। উপমহাদেশে ব্রিটিশ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পর এই আদর্শের ভিত্তিতেই মুসলমানরা স্বাধীনতা-আন্দোলন শুরু করেছিল। এই আদর্শই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে। এর ভিত্তিতেই উপমহাদেশের দ্বীনদার শ্রেণির সমর্থন লাভ করেছিল কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, ‘পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (পাকিস্তানের উদ্দেশ্য কী? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এই স্লোগান না থাকলে উপমহাদেশের চেহারাই আজ অন্যরকম হতো। এ স্লোগানের অর্থই ছিল, এমন একটি রাষ্ট্র প্রয়োজন, যেখানে ইসলাম দ্বীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যেখানে মুসলিমরা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠই হবে না; বরং বাস্তবেও ইসলামের রাজত্ব থাকবে। এলাহাবাদে আল্লামা ইকবাল রহ. এই কথাই বলেছিলেন। এর ভিত্তিতেই আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ. পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলেন। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উলামায়ে কেরামের কাছে এই বিষয়েরই ওয়াদা করেছিলেন। এ মতাদর্শই পাকিস্তানের জনগণের মতাদর্শ, যা ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের শুধু বিপরীত না; বরং তার সাথে সাংঘর্ষিক।
দ্বীনী মতাদর্শের দুরকম ব্যাখ্যা
এ পর্যন্ত বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। সুস্পষ্ট ছিল হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকগোষ্ঠী ও উলামায়ে কেরামের মধ্যে এই দ্বন্দ্বই চলমান ছিল। এখানে এর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। মৃত্যু পর্যন্ত আল্লামা উসমানী রহ.-এর প্রচেষ্টা, ‘কারারদাদে মাকাসেদ’ (সংবিধানের লক্ষ্য প্রস্তাব) পাশ হওয়া, অতঃপর ১৯৫৩ সালে উলামায়ে কেরামের প্রস্তাবনা, ইসলামী আন্দোলনসমূহের প্রতিষ্ঠা, এ সবই সেই দ্বন্দ্বের বিভিন্ন রূপ। পাকিস্তানকে প্রকৃত অর্থে দারুল ইসলাম বানাতে হবে, এখানে ইসলামী আইন ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করতে হবে—এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম একমত ছিলেন। তখন ‘ইসলামী গণতন্ত্র’-এর পরিভাষাও ছিল অজ্ঞাত।
তখনও পর্যন্ত পাকিস্তানের বড় বড় আলেমগণ পূর্বসূরী ফুকাহায়ে কেরামের বর্ণিত হুকুমত ও সালতানাতের ধারণার মধ্যে থেকেই দ্বীনের বিজয়ের চিন্তা করছিলেন। রাষ্ট্র ও সংবিধানের আইনকানুন কেমন হতে হবে—তা নিয়ে আলাদাভাবে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আনেননি। তাদের ধারণা ছিল, দেশ বিজয় হয়েছে, এখন শাসকগণ তো ইসলাম-ই কায়েম করবেন। মুসলমান শাসকগোষ্ঠী শরয়ী আইন জারি না করলে আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকারের মূলনীতি অনুযায়ী মুসলমানরা হাত, মুখ ও অন্তর দ্বারা সংগ্রাম করবে। মোটাদাগে সর্বস্তরের উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার শ্রেণির কাছে এই অবস্থানই গ্রহণযোগ্য ছিল। তারপর ধীরে ধীরে দ্বীনদার শ্রেণির আদর্শ ও অবস্থানের মধ্যে দুটি ধারা তৈরি হলো।
দ্বীনদার শ্রেণির প্রথম ধারা
‘রাষ্ট্র’ ও ‘সরকার’-এর আধুনিক ধারণা এবং এর অন্তর্গত যাবতীয় বিষয় মেনে নিয়ে তাদের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির মধ্যে ইসলামী বিধিবিধান চালু করা। [অর্থাৎ সিস্টেমের ভেতরে থেকে সিস্টেম বদলানো।]
উলামায়ে কেরামের এক অংশ এই আদর্শ গ্রহণ করলেন। মৌলিকভাবে তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি এবং ফুকাহায়ে কেরামের ইজতিহাদেরই অনুগামী ছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন বর্তমান যুগের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো (Social and political order) ইসলামের চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে ফুকাহায়ে কেরামের করা ইজতিহাদের সাথে মেলে না—বাহ্যিকভাবে মেলানো সম্ভবও না এবং তাঁদের কারও কারও মতে আবশ্যকও না—তখন তারা আধুনিক যুগের সমাজব্যবস্থাকে ‘অনিবার্য বাস্তবতা’ হিসেবে মেনে নিলেন এবং শাখাগত মাসআলায় ফুকাহায়ে কেরামের করা বিভিন্ন ইজতিহাদের আলোকে তা প্রমাণের চেষ্টা করলেন। এভাবে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এর বৈধতা দিয়ে দিলেন। এমনটা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চৌদ্দশ বছরের ইসলামী আদর্শ, সমাজ-সংস্কৃতি এবং ফুকাহায়ে কেরামের ইজতিহাদের বিপরীত কাজ করতে হলো। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য ইসলামের ওপর আমল করার পথ খুঁজে বের করাই ছিল এই শ্রেণির উলামায়ে কেরামের লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে তারা শতভাগ মুখলিস ছিলেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতিরাষ্ট্রের (Nation state) যে ধারণা পশ্চিমারা আবিষ্কার করেছে, এই ধারণার অধীনে এর যে মূলনীতিগুলো তারা প্রণয়ন করেছে এবং যার আলোকে সব জাতিকে একই সমাজব্যবস্থা (Social Order) মেনে নিতে বাধ্য করেছে—এমন কোনো কিছু মুসলমানদের চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অথচ মুসলমানরা চৌদ্দশ বছর পৃথিবীর বড় একটি অংশ শাসন করেছে এবং সেখানে ইসলামকে বিজয়ী রেখেছে।
একইভাবে পশ্চিমা দার্শনিকদের প্রচার করা গণতন্ত্রের (Democracy) দর্শন, যা মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লবের পর পশ্চিমে চালু হয়েছে এবং অস্ত্রের জোরে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা মুসলমানদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। এসবের বদলে মুসলমানদের পরিচয় ছিল খিলাফত, ইমারত, ইমামত, দারুল ইসলাম, দারুল হরব, শাসক ও জনগণের অধিকার, জিহাদ-কিতালের মতো ধারণাগুলোর সাথে। এ ধারণাগুলো উম্মতের চিন্তা-চেতনায় বিদ্যমান ছিল এবং পশ্চিমাদের আগ্রাসনের আগে প্রায়োগিকভাবেও কার্যকর ছিল। ফিকহের কিতাবাদিতে এ সম্পর্কিত বিধিবিধান ছিল; পশ্চিমা চিন্তা, দর্শন আর কর্মপদ্ধতি ছিল না।
মুসলমানরা পরাজিত হওয়ার কারণে এবং মুসলমানদের মাঝে কাফেরদের দর্শন ও শাসনতন্ত্রের প্রচলন ঘটার ফলে দ্বীনদারদের মধ্যে দুটি দল তৈরি হয়ে গেল। একদল পশ্চিমাদের চালু করা সমাজব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করলেন, সংকল্প করলেন পূর্ববর্তী ফকীহগণের ইজতিহাদ অনুযায়ী ইসলামী হুকুমত কায়েমের। অন্যদল বিদ্যমান কাঠামোকে ‘ফিকহুল ওয়াকে’ বা অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়ে একে পরিবর্তন করার বদলে এর মধ্যেই ইসলামী বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন।
এটা স্পষ্ট যে, বিশ্বব্যাপী পশ্চিমাদের আধিপত্যের ফলে তৈরি হওয়া নতুন এই প্রেক্ষাপটে ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়নের চেষ্টা করা সম্পূর্ণ ‘নতুন ইজতিহাদি বিষয়’ ছিল। এক্ষেত্রে একদল উলামায়ে কেরাম বিদ্যমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে জাতিরাষ্ট্রের ব্যাপারে নতুনভাবে ইজতিহাদ করলেন। ইসলামী মূলনীতির আলোকে ও ফুকাহায়ে কেরামের ‘কিছু’ শাখাগত মাসআলার সহায়তায় এ ধরনের রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যাপারে বিধিবিধান প্রণয়ন করলেন। কিন্তু তাদের এই নতুন ইজতিহাদের ফলে যে সমাজকাঠামো (Social formation) তৈরি হলো, তা দীর্ঘ চৌদ্দশ বছর ধরে চলে আসা ফুকাহায়ে কেরামের ইজতিহাদে বর্ণিত সমাজকাঠামোর সম্পূর্ণ বিপরীত।
তাদের এই ইজতিহাদ সঠিক না ভুল, সে আলোচনায় আমরা যাচ্ছি না। শুধু এতটুকু স্পষ্ট করতে চাই, এটি উলামায়ে কেরামের একটি অংশের ইজতিহাদ ছিল। উম্মতের সকল আলেমের ঐকমত্যের ইজতিহাদ ছিল না; এমনকি অধিকাংশের মতও ছিল না। আর এখান থেকেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দ্বীনদার শ্রেণি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
একদিকে আলেমদের সেই দল, যারা প্রথমে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে তার আধুনিক দর্শন অনুযায়ী গ্রহণ করেছেন, কোনো-না-কোনোভাবে এর শরয়ী বৈধতাও বের করেছেন, তারপর সংবিধান ও রাষ্ট্রগঠনের গণতান্ত্রিক দর্শনকে পরখ করে ফিকহী মূলনীতি সামনে রেখে সে অনুযায়ী হুকুম বর্ণনা করেছেন।
এভাবেই পশ্চিমা দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য মেনে নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রকে ‘রূপক ব্যক্তি’ ধরা হয়েছে এবং সংবিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ইসলামী না অনৈসলামী তা ঠিক করা হয়েছে। সরকার গঠনের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ইসলামী পদ্ধতি বলা হয়েছে। শরীয়তবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে কেবল আইনি লড়াইকেই সঠিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতাকে নাজায়েয বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এই নতুন ইজতিহাদ শুধু পাকিস্তানেই না; বরং উসমানী খিলাফতের পতনের পর অস্তিত্বে আসা সব মুসলিম দেশেই এমন করা হয়েছে। এই মতের পক্ষে শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী সাহেব যেমন আছেন, তেমনই আরও অনেক বড় বড় উলামায়ে কেরাম আছেন। তাদের মধ্যে শায়খ মুস্তফা যারকা রহ.[3] ও ড. ওয়াহবা আয-যুহাইলী রহ.-এর[4] নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের কিতাবাদি থেকে রাষ্ট্র ও সরকার-সংক্রান্ত আলোচনাগুলো দেখা যেতে পারে।
পাকিস্তানে এই নতুন ইজতিহাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন মাওলানা আবুল আলা মওদুদী রহ. ও মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী রহ.।[5] পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কাশ্মীরযুদ্ধের সূচনা হলে উক্ত মূলনীতির আলোকেই এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও সাধারণ জনগণের অংশ নেওয়াকে নিষিদ্ধ আখ্যা দিয়েছিলেন মাওলানা মওদুদী।[6] এর জবাবে আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ. চিঠিপত্র লিখেছিলেন। সেগুলো আজও সংরক্ষিত আছে।[7] মাওলানা মওদুদীর এই কথাও তার ঘরানার লোকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ যে, ‘কারারদাদে মাকাসেদ’ মঞ্জুর হওয়ার অর্থ পাকিস্তান রাষ্ট্র যেন কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গিয়েছে, এ রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী ইসলামী বাহিনী হয়ে গিয়েছে। তাই এখন ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা হবে এর মাধ্যমেই।
এটা ছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দ্বীনদার শ্রেণির চিন্তার প্রথম ধারা। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, পাকিস্তানে এই ধারার ধারকদের মধ্য আছেন শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী সাহেবের মতো বড় আলেম এবং তাঁদের অনুসরণে জামিয়াতুর রশীদসহ কিছু দ্বীনী মাদ্রাসাও আছে। কিন্তু এ বাস্তবতাও অনস্বীকার্য যে, এ অবস্থান উম্মতের সকল আলেমের নিকট স্বীকৃত নয়; বরং অধিকাংশ আলেমই এই বক্তব্যের সাথে একমত নন।
দ্বীনদার শ্রেণির দ্বিতীয় ধারা
ইসলামকে সে রূপেই প্রতিষ্ঠা করা হবে, যেভাবে তা উত্থান ও উন্নতির তেরোশো বছর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম বিশ্বব্যাপী নতুন দর্শন ও শাসনতন্ত্রের সয়লাবকে অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিলেও আদর্শিকভাবে এগুলোকে গ্রহণ করা বৈধ মনে করেননি। এগুলোর ইসলামী ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর তো প্রশ্নই আসে না। বরং ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সেই ধারাকেই পছন্দ করেছেন, যা সর্বদা মুসলমানদের কাছে ছিল। তা হলো, মুসলমানদের জন্য শাসক নিয়োগ করা ওয়াজিব। আর শাসকের জন্য ফরয হলো, নিজের আওতাধীন অঞ্চলে শরয়ী বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যান্য ভূমিতে ইসলামের বিজয়ের জন্য জিহাদ করা। যেখানেই শরয়ী বিধিবিধান জারি হবে, তা দারুল ইসলাম বলে গণ্য হবে। যে শাসক শরীয়ত অমান্য করবে বা শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করতে অস্বীকার করবে, তার ওপর অবস্থাভেদে কুফর বা ফিসকের হুকুম আসবে। সে হুকুম অনুযায়ী তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের শরয়ী অবস্থান নির্ধারণ হবে। কোথাও কুফরী আইন জারি থাকলে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার জন্য জবান ও হাতের (দাওয়াত ও জিহাদের) মধ্য থেকে যে পদ্ধতিটি অধিক উপযুক্ত, তা গ্রহণ করা হবে। দারুল ইসলামের কোনো শাসক যদি ইসলামী আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে অস্বীকার করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে শর্তসাপেক্ষে ‘খুরুজ’-এর বিধান অনুযায়ী আমল করা হবে।
ইসলামের এ বিধানগুলো চৌদ্দশ বছরের ফিকহের ভাণ্ডারে সংকলিত আছে। পূর্বোল্লেখিত প্রথম ধারায় যে পদ্ধতি ও মূলনীতির আলোকে রাষ্ট্র ও সরকারের হুকুম নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই ইসলামের চৌদ্দশ বছরের সমৃদ্ধ ফিকহের সাথে মেলে না। বরং ফিকহের দাবি হলো, বর্তমান রাষ্ট্রগুলো দারুল ইসলাম না দারুল হারব প্রথমে তা নির্ধারণ করা হবে এবং তা নির্ধারণ করতে হবে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত আইনের ভিত্তিতে। তারপর শাসকদের হুকুম নির্ধারণ করতে হবে; শাসকদের আকীদা-বিশ্বাস ও কাজের ভিত্তিতে তারা মুমিন, ফাসেক না কাফের—তা ঠিক করা হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এখানে জবানের দ্বারা দাওয়াতী কাজ করা হবে নাকি শক্তি প্রয়োগ করা হবে। শক্তি প্রয়োগ করা হলে, তা কোন স্তরের? জায়েজ, নাজায়েয, ওয়াজিব নাকি হারাম?
উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমগণ আজও এই বিশ্লেষণ ও অবস্থানকেই সঠিক মনে করেন। তাদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের শরয়ী হুকুম নির্ধারণে সংবিধান ও আইনের লিখিত কোনো ধারার বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। একইভাবে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমা মাপকাঠি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও কোনো ভূমিকা রাখে না। তবে এর অর্থ এটা নয় যে, বিদ্যমান কাঠামোর ভেতরে থেকে শরীয়তসম্মত আইন প্রণয়নের জন্য মুসলমানরা কোনো চেষ্টাই করতে পারবে না। এই বিষয়টি (দ্বিতীয় ধারার) সমর্থক ও বিরোধিতাকারী—সবার কাছে স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন। এ কথা বলার কারণ হলো, অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই দ্বিতীয় মতটিই যদি অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত হয়ে থাকে, তাহলে আলেমগণ ইসলামী আইন প্রণয়ন, ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা ও মুসলমানদের অধিকার রক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চেষ্টা করেছেন কেন?
এর জবাব হলো, হ্যা তাঁরা করেছেন। কিন্তু তাঁদের এসব চেষ্টা এ কথার দলীল না যে, তাঁরা এই পদ্ধতি ছাড়া অন্য সব পদ্ধতিকে ভুল মনে করতেন অথবা ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিকে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ মনে করতেন।
এজন্যই আমরা দেখি, পাকিস্তানে যে-সকল উলামায়ে কেরাম ইসলামী আইন ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছেন, সংবিধানে ‘কারারদাদে মাকাসেদ’ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছেন, বাইশ দফা তৈরি করেছেন; তারা কখনোই শুধু এতটুকুর ভিত্তিতে এ রাষ্ট্রকে মুসলমান বা ইসলামী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দেননি। ২২ দফা প্রস্তুতকারীদের অন্যতম একজন হলেন আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহ.। তিনি যখন দেখলেন, শাসকগোষ্ঠী ইসলামকে পছন্দ করে না, শরয়ী আইন বাস্তবায়ন করতে অস্বীকার করে এবং সংবিধানের ইসলামী ধারাগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মহীনতা ও শরীয়তবিরোধী আইন পাশ করে, তখন তিনি প্রকাশ্যেই লিখেছিলেন,
“কারারদাদে মাকাসেদ’-সহ ইসলামী আইন প্রণয়নের যত প্রতিষ্ঠান ও কমিটি আছে, সবগুলো ধোঁকা আর প্রতারণা ছাড়া কিছুই না।’[8]
তিনি এ কথাও বলেছেন,
“ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে দেশে ইসলামী আইন জারি করা হয় না, তাকে দারুল ইসলাম বলা যায় না।[9] তা মুসলমানদের রাষ্ট্র বটে, কিন্তু তাকে ইসলামী রাষ্ট্র বা দারুল ইসলাম বলা যায় না।”
হযরতের শাগরেদগণও এই অবস্থানই গ্রহণ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামিয়া ইসলামিয়া বানুরী টাউনের অধিকাংশ বড় বড় আলেম এই অবস্থানেরই অনুসারী। হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী রহ. বারবার বলেছেন,
“পাকিস্তান অবশ্যই মুসলমানদের রাষ্ট্র। কিন্তু তাকে ইসলামী রাষ্ট্র বা দারুল ইসলাম বলা যায় না। কেননা এখানে ইসলামী আইন-কানুন প্রতিষ্ঠিত নেই এবং সরকার ইসলামী আইন পালন করাকে জরুরি মনে করে না।”[10]
পারভেজ মুশাররফের শাসনামলে জামিয়া রব্বানিয়া করাচির মুহতামিম শায়খ নুরুল হুদা রহ. মুজাহিদদের সমর্থক ছিলেন। বিষয়টি সকলেই জানেন। উস্তাদ আহমদ ফারুক রহ. আমাকে বলেছেন, শায়খ নুরুল হুদা রহ. এক মজলিসে তাঁকে একটি ঘটনা বলেছিলেন, একবার শায়খ নুরুল হুদা রহ. জামিয়া বানুরী টাউনে যান। তার অনুরোধে বানুরী টাউনের দারুল ইফতার তৎকালীন প্রধান মুফতী আব্দুল মাজীদ দীনপুরী রহ. ও অন্যান্য উস্তাদ একত্র হন। শায়খ নুরুল হুদা রহ. তাঁদের সামনে বসিয়ে চল্লিশ মিনিট ধরে আলোচনা করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘সংবিধান বা আইন—কোনোটির ভিত্তিতেই পাকিস্তানকে দারুল ইসলাম বলা যায় না; একে সত্যিকার অর্থে দারুল ইসলাম বানাতে দাওয়াত ও জিহাদের আমল করতে হবে।’ শায়খ নুরুল হুদা রহ. বলেন,
“আমার চল্লিশ মিনিটের আলোচনায় কেউ কোনো আপত্তি করেননি। যখন দেখলাম, আমি একাই কথা বলছি, কেউ আপত্তি করছে না; তখন তাদের বললাম, ভাইয়েরা, আমি ভুল বলে থাকলে কেউ তো (বিপরীত) দলীল দিন।”
তখন মুফতী আব্দুল মাজীদ দীনপুরী রহ. বললেন,
“আমরা কখন বললাম, আপনি ভুল বলছেন। কিন্তু বিষয়টা হলো, সবাই আপনার মতো মরার জন্য প্রস্তুত না। আপনি শতভাগ সঠিক বলছেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এসব কথার অর্থ মৃত্যু ছাড়া আর কিছু না।”
শায়খ নুরুল হুদা রহ. যখন উস্তাদ আহমাদ ফারুককে এ ঘটনা বলেছেন, ততদিনে মুফতী আব্দুল মাজীদ দীনপুরী রহ.-কে করাচিতে টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে শহীদ করে ফেলা হয়েছিল। শায়খ নুরুল হুদা রহ. ঘটনা বলার সময় উস্তাদ আহমদ ফারুককে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘দেখো, মুফতী সাহেব তো শহীদ হয়ে গেলেন, অথচ আমি এখনও জীবিত।’
আমি এ ঘটনা এটা বোঝাতে উল্লেখ করলাম যে, আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহ. এবং তার শাগরেদদের বড় অংশ রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে এই দ্বিতীয় মতের ওপরেই ছিলেন এবং আছেন।
মুফতী নেজামুদ্দীন শামযায়ী রহ.-এর নাম ও অবস্থান তো সবার জানা। তাঁর প্রকাশিত বয়ানসমূহে এ কথা আছে, ‘কারারদাদে মাকাসেদ’ ও ৭৩-এর সংবিধানের শব্দগুলো বড়ই মধুর, কিন্তু প্রায়োগিক জীবনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কার্যকর বিধান নির্ধারণে আদৌ কোনো ভূমিকা নেই এগুলোর। জিহাদের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান নিয়ে সামনে আলোচনা আসছে ইনশাআল্লাহ।
শায়খ সলীমুল্লাহ খান রহ.-এর নাম কে না জানে। তিনি খোদ মুফতী মুহাম্মদ তাকী উসমানী দা.বা.-এরও উস্তাদ। তিনিও এই চিন্তাধারাই লালন করতেন। পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বলার জন্য এর সংবিধানকে যথেষ্ট মনে করতেন না। গণতান্ত্রিক পন্থাকেও তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি মনে করতেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুজাহিদদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তাঁর দোয়া ও নসীহত দ্বারা মুজাহিদগণ সবসময়ই উপকৃত হয়েছেন। নাওয়ায়ে আফগান জিহাদ পত্রিকার সম্পাদক শহীদ হাফেয তায়্যেব নাওয়ায রহ. শায়খ সলীমুল্লাহ খান সাহেবের সাথে নিয়মিত দেখা করতেন। তাঁকে প্রতি মাসের নাওয়ায়ে আফগান জিহাদ পড়ে শোনাতেন, আফগানিস্তানসহ পুরো পৃথিবীর দ্বীন কায়েমের আন্দোলনগুলোর মুখপত্র ছিল পত্রিকাটি। শায়খের জীবনের শেষদিকে যারা তাঁর সঙ্গ পেয়েছেন, তারা সবাই জানেন, শায়খ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে জিহাদের সমর্থক ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে লিখিত তাঁর খতমে বুখারীর তাকরীর যারা পড়েছেন, তারা শায়েখের মাসলাক বুঝতে পারবেন। এই মাসলাক গ্রহণের কারণেই তাঁর কয়েকজন আত্মীয়কে গোয়েন্দাসংস্থা গুম করেছিল। শায়খের ছেলে মাওলানা ড. আদিল খান রহ.-কে শহীদ করা হয়েছে এ কারণেই।
হাফেয তায়্যেব নাওয়ায রহ. আমাকে একবারের ঘটনা শুনিয়েছিলেন। একদিন হযরত শায়খ সলীমুল্লাহ খান রহ. মুজাহিদদের প্রতি অনেক মুহাব্বত প্রকাশ করলেন এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মুজাহিদদের অবিচলতার জন্য দোয়া করলেন। মজলিসে বেফাকুল মাদারিসের কিছু বিষয় নিয়েও তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হলো। তখন হাফেয সাহেব অভিযোগ করে বললেন, মাওলানা হানিফ জালান্ধরী (পাকিস্তান বেফাকের সেক্রেটারি জেনারেল) সরকারের সুস্পষ্ট ইসলামবিরোধী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও সমঝোতার পথে চলেন, এতে আমরা ব্যথিত হই। এ কথা শুনে শায়খ সলীমুল্লাহ খান সাহেব হাফেয সাহেবকে বলেন, আপনি ঠিকই বলছেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, কিন্তু ভাই, মাওলানা হানিফ সাহেবের যে যোগ্যতা আছে, অন্য কোনো আলেমের মাঝে তো সেই যোগ্যতা দেখতে পাচ্ছি না। অর্থাৎ মাওলানা হানিফ সাহেব যেভাবে বিচক্ষণতার সাথে মাদ্রাসার হেফাযত ও মাদ্রাসাওয়ালাদের অধিকার আদায়ের মেহনত করছেন, অন্য কারও সেই যোগ্যতা নেই।
আধুনিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘ইসলামী’ ব্যাংকিংয়ের মাসআলায় শায়খ সলীমুল্লাহ খান সাহেব রহ. ও তাঁর অনুসারীদের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য এসেছে, সেটাও এই চিন্তাধারার ভিন্নতারই ফসল। শায়খ তাঁর এই মতের ওপর দেশের অধিকাংশ আলেম ও মুফতীগণকে একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[11]
হযরত আতাউল্লাহ শাহ বুখারী রহ.-এর খান্দানও একই চিন্তাধারা লালন করে। তাঁর পুত্রগণ, বিশেষ করে মাওলানা আতাউল মুমিন শাহ বুখারী রহ.-এর বয়ান ও সংগ্রাম সম্পর্কে সকলেই জানেন। তিনি পাকিস্তানের নাগরিকদের সংবিধান ও গণতন্ত্রের ঝামেলা থেকে সরে এসে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান করতেন। জমিয়তের সাথে যুক্ত প্রসিদ্ধ বংশের এক আলেম—যিনি মুজাহিদদের সাথে কাজ করতেন—আমাকে জানিয়েছেন, একবার মাওলানা আতাউল মুমিন সাহেবকে ওয়াজের জন্যে এক জায়গায় দাওয়াত দেওয়া হয়। এই আলেমও সেখানে যান। তার পরিচিত ব্যক্তিরা মাওলানা আতাউল মুমিন সাহেবের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, তিনি মুজাহিদদের সমর্থক। এটা শুনে মাওলানা আতাউল মুমিন সাহেব অত্যন্ত মুহাব্বতের সাথে দেখা করলেন এবং বললেন, পাকিস্তানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার দুটি পন্থাই রয়েছে। একটি হলো যা আমরা করছি, অর্থাৎ জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা, জনগণকে ইসলামী শাসন, ইমারত ও খেলাফতের অর্থ বোঝানো। আর দ্বিতীয়টি হলো আপনাদের পন্থা, অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগ করে এই বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা।
জামিয়া হক্কানিয়া আকুড়াখটকের উলামায়ে কেরামও একই চিন্তা লালন করেন। তারা কখনোই শুধু ‘কারারদাদে মাকাসেদের’ ভিত্তিতে পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেখেননি এবং এ দেশে ‘কেবল’ গণতান্ত্রিক আন্দোলন জায়েয, অন্য কোনোভাবে ইসলাম কায়েমের আন্দোলন করা নাজায়েয—এমন ফতওয়াও দেননি। বরং তারা সবসময়ই পাকিস্তানের সকল দ্বীনী আন্দোলন এবং ইসলাম কায়েমের সংগ্রামের সঙ্গ দিয়েছেন, সেই সংগ্রাম জবান দ্বারা হোক বা শক্তি প্রয়োগের দ্বারা। মাওলানা সামিউল হক শহীদ রহ., মাওলানা ডক্টর শের আলী শাহ রহ. প্রমুখের অবস্থান সম্পর্কে আম-খাস সকলেই জানেন।
সমকালীন আলেমগণের মধ্যে বিশিষ্ট একজন হলেন মুফতী ডক্টর আব্দুল ওয়াহেদ রহ.। তাঁর ইলমী মাকাম সর্বস্তরের উলামায়ে কেরামের কাছে স্বীকৃত। তিনিও শুধু সংবিধানের কারণে পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বলতেন না। মুফতী সাহেবের শাগরেদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী রহ.-এর একজন বংশধর আমাকে বলেছিলেন, তিনি মুফতী আব্দুল ওয়াহেদ সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীগুলোকে কি ইসলামী বাহিনী বলা যায়? মুফতী সাহেব জবাব দিয়েছিলেন,
“এই রাষ্ট্রকেই যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায় না, সেখানে এর বাহিনীগুলো ইসলামী হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।”
পাখতুনখোয়া প্রদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীনী জামাত, যারা কয়েক বছর যাবত পাকিস্তানে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও করেছিল, তাঁরাও এই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ কাবুলগেরামী রহ.-এর বয়ান ও রচনাবলি, বিশেষত তাঁর কিতাব ‘ইলামুল আলাম বি মাফহুমিদ দ্বীন ওয়াল ইসলাম’ এ দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ। তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট পুরো জামাত এ পথে যে কুরবানী করেছে, তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না।
ইসলামী ইতিহাসবেত্তা মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া রহ.-এর সাহেবজাদা মাওলানা হামেদ মিয়া রহ. এবং তাঁর ভক্ত-মুরীদানও এই চিন্তাধারার ছিলেন। তাঁরা এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার অগণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ইসলামাবাদের শহীদ মাওলানা আব্দুল্লাহ গাযী রহ. ও তাঁর বংশধরও এই আদর্শ লালন করেন। লাল মসজিদের পুরো আন্দোলন এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। লাহোরের জামিয়া হামীদিয়ার মুহতামিম মুফতী হামীদুল্লাহ জান সাহেব রহ.—যিনি জামিয়া আশরাফিয়া লাহোরে কয়েক বছর দারুল ইফতার প্রধান ছিলেন—২০০৮ বা ২০০৯ সালে জামিয়া আশরাফিয়ায় আয়োজিত ‘সন্ত্রাস ও আত্মঘাতী হামলা’-র প্রেক্ষাপটে আয়োজিত এক সম্মেলনে প্রকাশ্যে সরকারের অবস্থানের নিন্দা করেছিলেন। “সন্ত্রাস ও আত্মঘাতী হামলা”-র ব্যাপারে সরকারি বক্তব্য খণ্ডন করেছিলেন। যার ফলে সে সম্মেলন কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ করতে হয়েছিল। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি গণতান্ত্রিক শাসনের বিপরীতে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এতে অটল ছিলেন।
উলামায়ে কেরামের দীর্ঘ তালিকা থেকে কেবল প্রয়াত কয়েকজনের নাম আমরা এখানে উল্লেখ করলাম। জীবিত উলামায়ে কেরামের বড় একটি অংশ এখনও এই চিন্তাধারা ও অবস্থানে বিশ্বাসী। তবে তাদের কারও নাম প্রকাশ করা সংগত নয়। দ্বীনের দুশমন পাকিস্তানের সরকারি বাহিনীগুলো কুকুরের মতো ওই মানুষদের গন্ধ খুঁজে বেড়ায়, যারা এই পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে চান। তারা জানে, এ আদর্শ বাস্তবায়িত হলে তাদের পশ্চিমা প্রভুদের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে এবং মুসলিমরা একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে জেগে উঠবে।
তরীকতের মাশায়েখগণের মধ্যেও অনেকেই এই চিন্তাধারার পক্ষে। তাঁদের মধ্যে কুন্দিয়ানের খাজা খান মুহাম্মদ রহ., শাহ আব্দুল কাদের রায়পুরী রহ.-এর খলীফা সায়্যিদ শাহ নাফীস আল-হুসাইনী রহ., শাইখুল হাদীস রহ.-এর খলীফা আযীযুর রহমান হাযারবী রহ., শাহ আবরারুল হক রহ.-এর খলীফা হাকীম আখতার সাহেব রহ.-এর নাম উল্লেখযোগ্য। এই তালিকায় আমার ও অসংখ্য আলেম এবং মুজাহিদের শায়খ মাওলানা আব্দুল মালেক সিদ্দীকীর খলীফা হযরত কারী নুর মুহাম্মদ রহ.-এর নামও উল্লেখ করতে চাই। পরাশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ এবং পাকিস্তানে ইসলাম কায়েমের সকল মেহনতকে তিনি সবসময় পূর্ণ সমর্থন করেছেন, নিজের মাকবুল দোয়ায় মুজাহিদদের সবসময় স্মরণ রেখেছেন। এ কারণেই এই ফেরেশতা-স্বভাবের মানুষটিকেও পাকিস্তানের গোয়েন্দাসংস্থা এক সপ্তাহের জন্য গুম করে নির্যাতন করেছিল। হযরত ইসলাহের বাইআত নেওয়ার সময় জিহাদেরও বাইআত নিতেন। বলতেন, ‘বাইআত করো, যখন জিহাদ ফরযে আইন হবে তখন জিহাদ করব।’ আর বাইআত নেওয়ার পর বলতেন, ‘বর্তমানে যদি জিহাদ ফরযে আইন না হয়, তবে আর কবে হবে?’
আল্লাহ তায়ালা উক্ত উলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখদের আপন দরবারে উচ্চ মর্যাদা দান করুন এবং আমাদেরকে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দান করুন, আমীন।
উলামায়ে কেরামের এই জামাত রাষ্ট্র, সরকার ও ইসলাম কায়েমের ব্যাপারে প্রথমোক্ত অবস্থানের সাথে একমত ছিলেন না; বরং তারা সেই চিন্তাধারাই পোষণ করতেন, যা চৌদ্দশ বছর ধরে মুসলমানদের মধ্যে চর্চিত হয়েছে। একইভাবে তাঁরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার মেহনতকে রাষ্ট্র ও সরকারের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করতেন না।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের উলামায়ে কেরামের অবস্থানও এটিই। এই চিন্তাধারাকে পুনর্জীবিত করতেই আমীরুল মুমিনীন মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রহ.-এর নেতৃত্বে আলেম ও মুজাহিদগণ সংগ্রাম করেছিলেন এবং আমীরুল মুমিনীন শায়খ হেবাতুল্লাহ আখুন্দযাদাহর নেতৃত্বে বাস্তবেই আজ তা প্রয়োগ করে দেখাচ্ছেন।
তাদেরকেও বলা হয়েছিল, বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের দর্শন মেনে নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করুন। কিন্তু তারা শক্তির জোরে কুফর ও তার দোসরদের পরাজিত করেছেন। সেই ইসলামী শাসনই প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা উম্মতের ইতিহাসে জীবিত ছিল। এ ব্যাপারে তাদের আলেমগণের কিতাবাদিও রয়েছে, যার মধ্যে ইমারতে ইসলামিয়ার আইনমন্ত্রী শায়খ আব্দুল হাকীম হক্কানীর কিতাব ‘আল-ইমারতুল ইসলামিয়্যাহ ও নিযামুহা’ পড়া যেতে পারে।
ওপরের আলোচনায় আমরা শুধু এতটুকু দেখাতে চেয়েছি যে, দ্বীনদার শ্রেণির মধ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দুটি চিন্তাধারা ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যা তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের মূলনীতির আলোকেই গ্রহণ করেছেন। তাই যেসব আলেম প্রথম ব্যাখ্যাকে সঠিক মনে করেন, তাঁরা যদি দ্বিতীয় ব্যাখ্যার ধারক ও সে অনুযায়ী সংগ্রামরত ব্যক্তিদের ভুল, বিদ্রোহী বা হারামে লিপ্ত বলেন, তবে এটা কোনোভাবেই উচিত হবে না। একইভাবে দ্বিতীয় ব্যাখ্যার ধারকদের জন্যও প্রথম শ্রেণির ব্যাপারে খারাপ ধারণা করা এবং তাদের প্রতিপক্ষ মনে করা ঠিক হবে না।
এবার আমরা আলোচনা করব, এই দুই চিন্তাধারা অনুযায়ী ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কীভাবে হতে পারে? গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, দাওয়াত ও তাবলীগ বা বিদ্রোহ ও জিহাদের ব্যাপারে দ্বীনদারদের কাছে গ্রহণযোগ্য মতামত কী?
দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মপদ্ধতি
এতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের আলোচনার মূল বক্তব্য ছিল, বর্তমান যুগ ও বাস্তবতার আলোকে রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যাপারে দ্বীনদারদের মধ্যে দুটি চিন্তাধারা ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাই এক চিন্তাধারাকে আঁকড়ে ধরে অন্যটিকে একেবারে অস্বীকার করা কোনো ইলমী তরীকা হতে পারে না। সুতরাং যে-সকল উলামায়ে কেরাম বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ইসলামীকরণের (ইসলামাইজেশন) ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী, তাদের এটাও মানতে হবে, দ্বীনদারদের একটি বড় অংশ; বরং অধিকাংশই এই ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী নন। তাই অন্যদের বিদ্রোহী বা বাগী বলার আগে এটা যাচাই করে নেওয়া জরুরি, রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যাপারে তারা শরীয়তের আলোকে কোন অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং তাদের এই অবস্থান ফুকাহায়ে কেরামের মাযহাবের সাথে মেলে কি না। মুসলমানদের দেশে যারা যুদ্ধ-বিগ্রহের পরিবেশ তৈরি করে; কিন্তু আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি ও ফুকাহায়ে কেরামের মাযহাবের সাথে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তাদের ওপর তো বিদ্রোহ ও জুলুমের হুকুম দেওয়া যায়। যেমন: আইএস ও অন্যান্য খারেজীগোষ্ঠী। কিন্তু দ্বীনদারদের যে শ্রেণি শরীয়তের মূলনীতি ও ফুকাহায়ে কেরামের মাযহাব অনুযায়ী বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কাঠামোকে অনৈসলামী মনে করে, তাদের বাগী ও বিদ্রোহী বলা শুধু বে-ইনসাফি না; বরং শরীয়তের হুকুম থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার শামিল।
এখন আমরা আলোচনা করব, দ্বীনদার শ্রেণির মধ্যে বিদ্যমান দুটি অবস্থানের আলোকে বর্তমান রাষ্ট্রগুলোতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি কী হতে পারে এবং কী হওয়া উচিত?
ইসলাম প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি
ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি হিসেবে প্রথম যে আলোচনাটি সামনে আসে তা হলো, বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে থেকে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। প্রথমোক্ত অবস্থানের ধারক আলেমগণের মতে বর্তমান রাষ্ট্রগুলোতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুধু এই পদ্ধতিতেই করা যাবে। পাকিস্তানের ব্যাপারে বলা হয়, সংবিধানের কল্যাণে পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের সংবিধানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করা হয়েছে। এখন শুধু তা বাস্তবায়ন করার কাজটা বাকি, আর এটা সরকারের দায়িত্ব। এ কারণে এমন সরকার ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করতে হবে, যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার ওয়াদাকে বাস্তবায়ন করবে। সরকার গঠন করা হবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে। সরকার শরীয়তবিরোধী আইন প্রণয়ন করলে সেটাকে বাতিল করার জন্য আগে ‘ইসলামী নযরিয়াতি কাউন্সিল (Council of Islamic Ideology)’ ছিল, এখন ‘ফেডারেল শরীয়ত কোর্ট (Federal Shariat Court)’ আছে। সেখানে আবেদন করা হবে, কোনো আইনকে তারা শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করলে সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট পাঠাবে, যার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট চাইলে রায় দিয়ে সেই আইন বাতিল করে দেবে। এ পদ্ধতিতে ইসলামী আইনও বাস্তবায়ন হবে, আবার ইসলামবিরোধী আইন প্রণয়নের পথও বন্ধ করা যাবে। এই পদ্ধতিটি পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী বৈধ। ‘কারারদাদে মাকাসেদ’-কে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বানানোর মাধ্যমে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকেও এই পদ্ধতির বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শরয়ী মূলনীতি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে ‘ইসলামী গণতন্ত্র’-এর ধারণা পেশ করা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতি সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের মতামত
গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির বৈধতার ব্যাপারে প্রথমোক্ত অবস্থানের উলামায়ে কেরামের ইজতিহাদের সারমর্ম আমরা এরইমধ্যে পেশ করেছি। এই পদ্ধতিতেই আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক দ্বীনী দলগুলো দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে আসছে। উল্লিখিত উলামায়ে কেরাম তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। দেশের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঠিক কতটুকু ইসলাম কায়েম হয়েছে—এ নিয়ে চিন্তা করলে দেশের সচেতন নাগরিকমাত্রই এ পদ্ধতির কার্যকারিতা বুঝতে পারবেন। এ নিয়ে এখানে আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য না। আমরা যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব তা হলো, দেশের দ্বীনদার শ্রেণির কাছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবস্থান কী? এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কী কী মতামত আছে?
এই প্রশ্নের উত্তরে মৌলিকভাবে গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির ব্যাপারে দ্বীনদার শ্রেণির তিনটি মত পাওয়া যায়:
এক. বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে থেকে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করা-ই ইসলাম কায়েমের একমাত্র পথ। এটা ইসলাম কায়েমের ব্যাপারে প্রথমোক্ত অবস্থানের অবধারিত ফল। এ অবস্থানের ধারকবাহকগণ ‘ইসলামী রাষ্ট্র’-কে ‘দারুল ইসলাম’-এর বিকল্প এবং ‘ইসলামী গণতন্ত্র’-কে ‘ইসলামী খিলাফত ও ইমারত’-এর বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এটাই বিশ্বাস করেন। এই চিন্তার অনিবার্য একটি দিক হলো, সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত ব্যক্তিও যদি শাসক হয়, তবু তার বিপক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম করা নাজায়েয। কেননা রাষ্ট্র ইসলামী, সংবিধানও ইসলামী। শাসক যদিও সংবিধানের বিরোধিতা করে ক্ষমতা লাভ করেছে, তবু সশস্ত্র সংগ্রাম করা জায়েয হবে না। কারণ সশস্ত্র সংগ্রাম সংবিধান-বিরোধী। এমন শাসককে অপসারণের চেষ্টা করতে হবে গণতান্ত্রিক পন্থায়। অথচ উম্মতের ইজমায়ী মাসআলা (সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত) হলো, শাসক কাফের হয়ে গেলে মুসলমানদের ওপর সামর্থ্যসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করা ওয়াজিব।
দুই. গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করা জায়েয; কিন্তু জরুরি বা ওয়াজিব না। যদি গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম কায়েম করা যায়, তাহলে তো ভাল। অন্যথায় মাসলাহাত ও লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় শরীয়তের দেখানো অন্যান্য পদ্ধতি অনুযায়ী আমল করা জায়েয বা ওয়াজিব হবে।
তিন. গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ জায়েয নেই। এটা শরীয়ত পরিপন্থি পদ্ধতি, যা ইসলামী আদর্শের বিপরীত। ইসলামী শরীয়তে এর কোনো নজির পাওয়া যায় না। তাই এর থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব। এর পরিবর্তে মাসলাহাতের ভিত্তিতে ও সামর্থ্য অনুপাতে দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে।
শেষোক্ত মতদুটি সাধারণত রাষ্ট্র ও শাসনের ব্যাপারে দ্বিতীয় ধারার আলেমগণের নিকট পাওয়া যায়। এ দুটি মত-ই বর্তমান সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের সাথে সাংঘর্ষিক। আমাদের সমাজের অধিকাংশ আলেমই গণতন্ত্রের ব্যাপারে শেষোক্ত মতদুটি পোষণ করে থাকেন। সে হিসেবে এই দুই মতে বিশ্বাসী আলেমগণকেও কি ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘অবৈধ দল’ বলা হবে? অথচ তারা শরীয়তের সর্বস্বীকৃত মূলনীতির ওপর দাঁড়িয়ে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এই সম্মানিত আলেমগণ ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ নামের কোনো বাস্তবতাকে স্বীকার করেন না। তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এই পরিভাষা আকর্ষণীয় মনে হলেও বাস্তব দুনিয়ায় এর কোনো অস্তিত্ব নেই। বাস্তবে কেবল সেই গণতন্ত্রই আছে, যা পশ্চিমারা কায়েম করেছে। এজন্যই শুধু সংবিধানের ভিত্তিতে যে দেশগুলোকে ইসলামী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সে দেশগুলোতে আজ পর্যন্ত ইসলামী গণতন্ত্রের কোনোকিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ইসলামী গণতন্ত্রে আইনপ্রণেতা নির্বাচনের যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়, সেগুলো যেমন কার্যকর হয়নি। একইভাবে আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোর ওপর এমন কোনো শর্তও আরোপ করা হয়নি যে, তারা শুধু গায়রে মানসূস (যে বিষয়গুলোতে শরীয়তে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই) বিষয়েই আইন প্রণয়ন করতে পারবে। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর আইন প্রণয়নকারী সংস্থায় দিনদিন ফাসেকদের সংখ্যা বাড়ছে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে ইসলামবিরোধী আইন পাশ করার কাজ। খোদ পাকিস্তানে নারী সুরক্ষা আইন (Women’s Protection Bill)-এর পর ট্রান্সজেন্ডার আইন, ধর্মান্তর আইন ইত্যাদি পাশ হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রত্যেক দ্বীনদারের ভাবা উচিত।
আমরা আগেই বলেছি, নিকট অতীতে উলামায়ে কেরামের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এটা প্রমাণ করে না যে, তারা কেবল এ পদ্ধতিকেই হক মনে করতেন এবং অন্যান্য সব পদ্ধতিকে বাতিল মনে করতেন। বরং আকাবিরগণ তো এমন সময় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন, যখন তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রও ছিল না; ছিল ব্রিটিশ অধিকৃত হিন্দুস্তান। আকাবিরগণ প্রথমে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে বয়কট করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের পর কংগ্রেস যখন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করল, তখনও আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী এর বিরোধিতা করেছিলেন।[12] পরে যখন আল্লামা উসমানী মুসলিম লীগের সমর্থনে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তখনও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তিনি আসলে এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে। নিতান্ত বাধ্য হয়ে এতে শামিল হয়েছেন।
‘মুকালামাতুস সদরাইন’-এও একই কথা বলেছেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতিনিধিদলকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যুদ্ধের জন্য এখন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত? সাংবিধানিক পদ্ধতি নাকি বিপ্লবী পদ্ধতি? উত্তরে জমিয়তের প্রতিনিধি বলেছিলেন, এখন যেহেতু যুদ্ধের শক্তি ও অস্ত্র নেই, তাই বাধ্য হয়ে আমরা সাংবিধানিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছি।[13] এই একই কারণে আইনসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন তিনি দেখলেন, আইন প্রণয়নকারী কমিটির মাধ্যমে ইসলামী আইন প্রণয়ন সম্ভব না, তখন গণবিপ্লব তৈরির জন্য ঢাকা গিয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন, সরকার যেন ইসলামী আইন জারি করে, নতুবা আমরা বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত আছি।[14]
তিনি কোথাও এ কথা বলেননি, রাস্তা কেবল একটাই—ভোট বাড়াতে হবে এবং নির্বাচনে অংশ নিয়ে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে ইসলামী আইন জারি করতে হবে। এর পেছনে যদি শতশত বছর অতিবাহিত হয় এবং গণতান্ত্রিক শাসনের সমর্থনের নামে বহু মন্দ কাজ ও সুস্পষ্ট ইসলামবিরোধী আইনের সমর্থনও করতে হয়, তবু এই পদ্ধতি ছাড়া যাবে না, এটাই একমাত্র পদ্ধতি—এমন কথা তিনি কখনোই বলেননি।
অন্যান্য আলেমগণের অবস্থানও এমনই ছিল। ‘তাযকিরাতুয যফর’ বইয়ে মাওলানা আব্দুশ শাকুর তিরমিযী রহ. লিখেছেন, সত্তরের নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়ার পর মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রহ. মারকাযী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে দূরে থাকার এবং মুসলমানদের মধ্যে তাবলীগের মেহনত করার সিদ্ধান্ত দেন।[15] এটাই সেই পয়গাম, যা আল্লামা বানুরী রহ. বাইয়িনাত পত্রিকার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিলেন।
সত্তরের নির্বাচনের সময় পত্রপত্রিকাগুলো যখন মুফতী মাহমুদ রহ. এবং মাওলানা গোলাম গাউস হাযারবী রহ.-এর মধ্যকার দ্বন্দ্বকে ফলাও করে প্রচার করছিল, উলামায়ে কেরাম তখন অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি দিনশেষে দ্বীনদারদের পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আল্লামা বানুরী রহ. ‘বাসায়ের ও ইবার’-এ এই আক্ষেপ প্রকাশও করেছেন।[16] এ সকল উলামায়ে কেরাম ইসলামী গণতন্ত্রকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এমন কোনো মতবাদকে ইসলামী বলার সুযোগ নেই। মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রহ.-এর খলীফা মাওলানা আব্দুশ শাকুর তিরমিযী রহ., শাহ আব্দুল গনী ফুলপুরী রহ.-এর খলীফা মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানবী রহ.,[17] শাইখুল হাদীস রহ.-এর খলীফা মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী রহ.,[18] শায়খ সলীমুল্লাহ খান সাহেব রহ.,[19] আহলে হাদীস ঘরানার মাওলানা আব্দুল্লাহ ভাওয়ালপুরী রহ. ও মাওলানা আব্দুর রহমান কীলানী রহ.-এর মতো বড় বড় আলেমগণের সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে যে, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে বিদ্যমান নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাজনীতিরই একটি রূপ। একে ইসলামী বলা যায় না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গণতান্ত্রিক নির্বাচনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে একেবারেই নিষেধ করেছেন। যারা অনুমতি দিয়েছেন, তারাও শুধু জায়েয বলেছেন।
এই সম্মানিত আলেমগণ, যারা বর্তমান গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিকে শরয়ী মূলনীতির ভিত্তিতে নাজায়েয বলেছেন; কিংবা শুধু একেই পাকিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার একমাত্র পদ্ধতি মনে করেননি—তাদেরও কি রাষ্ট্র, সংবিধান ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ‘ইসলামী’ মনে না করার কারণে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হবে?
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় দাওয়াতী ও তাবলীগী মেহনত
পাকিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচলিত একটি পদ্ধতি হলো জবান ও কলম দ্বারা ইসলাম কায়েমের জন্য মুসলমানদের তৈরি করা। এরও দুটি দিক আছে। রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যাপারে প্রথমোক্ত চিন্তাধারার আলেমগণের মতে এখানে জবান ও কলম দ্বারা মূলত ভোট বাড়ানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ পাকিস্তানের জনগণকে উৎসাহ দেওয়া হবে, যাতে তারা গণতান্ত্রিক ধর্মীয় দলগুলোর সদস্য হয়, নির্বাচনে তাদের ভোট দেয় এবং (ইসলামী আইন বাস্তবায়নের জন্য) ফেডারেল শরয়ী আদালতের মতো আইনি সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়। দাওয়াতী ও তাবলীগী মেহনত বলতে আমরা এই কাজকে বোঝাচ্ছি না। কারণ এগুলো আসলে গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, আলাদা কিছু না। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দাওয়াতী ও তাবলীগী মেহনতসমূহ।
উলামায়ে কেরামের একটি বড় অংশ, যারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, তারা পাকিস্তানের বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তে প্রকৃত ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষকে প্রস্তুত করছেন, যাতে তারা গণতান্ত্রিক শাসন পরিবর্তনের জন্য নিজেদের ও অন্যদের প্রস্তুত করে। এই দাওয়াত প্রশাসনের সদস্যদের কাছেও পৌঁছানো হচ্ছে, যেন এসব ক্ষমতাধর লোকেরা শক্তির মাধ্যমে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার বদলে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহ. ও মুফতী মুহাম্মদ শফী উসমানী রহ.-এর পক্ষ থেকে ‘মজলিসে দাওয়াত ও ইসলাহ’ প্রতিষ্ঠা, মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রহ.-এর মারকাযী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে তাবলীগের নির্দেশনা প্রদান, মাওলানা ওলীউল্লাহ কাবুলগেরামী রহ.-এর নির্দেশনায় ‘তাহরীকে নাফাযে শরীয়তে মুহাম্মদী’ ও মাওলানা আতাউল মুমিন শাহ বুখারী রহ.-এর নেতৃত্বে ‘মজলিসে আহরার’-এর আন্দোলন, মাওলানা শের আলী শাহ রহ. ও মুফতী হামীদুল্লাহ জান রহ.-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘তাহরীকে তলাবা ওয়া তালিবাত’, লাল মসজিদ আন্দোলন—এ সবই উলামায়ে কেরামের অগণতান্ত্রিক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। এসব আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সমাজ, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোতে অনুপ্রবেশকারী নাস্তিক-বেদ্বীনদের নির্মূল করা, নেককারদের সংখ্যা বাড়ানো এবং ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনে জিতে ইসলামী আইন প্রণয়নের চেষ্টা করা এসব আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল না।
বাহ্যিকভাবে মনে হয়, বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এ ধরনের আন্দোলনের সুযোগ আছে। কিন্তু আমেরিকা ‘ওয়ার অন টেরর’-এর নামে যে তাণ্ডব শুরু করেছে, এ ধরনের অগণতান্ত্রিক আন্দোলনও তার থেকে রেহাই পায়নি। এসব আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাও সরকারি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। মাওলানা ড. আদিল খান রহ.-এর শাহাদাত এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
যে-সকল সম্মানিত আলেম দাওয়াত ও বয়ানের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় আইন ও সংবিধানকে অনৈসলামিক বলে প্রচার করেন এবং এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনসমর্থন লাভের পথ সুগম করেন, তাদেরও কি দেশদ্রোহী ও গাদ্দার বলা হবে?
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র সংগ্রাম
সবচেয়ে বেশি মতভেদ হয় বর্তমান রাষ্ট্রগুলোতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের বৈধতা নিয়ে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, মানবরচিত সংবিধান দ্বারা পরিচালিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে কি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এমন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে, যারা শক্তির জোরে ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়ন এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করবে?
দ্বীনদারদের মধ্যে এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে এই মতপার্থক্যের কারণ হলো চিন্তাধারার সেই পার্থক্য, যা নিয়ে আমরা শুরুতেই আলোচনা করেছি।
প্রথম চিন্তাধারা অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রাম
প্রথম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী আলেমদের মতে পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোতে ‘সার্বভৌমত্ব বা Sovereignty’ আল্লাহ তাআলাকে অর্পণ করার মাধ্যমে সংবিধান ও রাষ্ট্র উভয়টিই ইসলামী হয়ে গিয়েছে। এমন রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের অনুমতি তারা দেন না। কেননা রাষ্ট্রের ‘ইসলামী সংবিধানে’ এর অনুমতি নেই। ফুকাহায়ে কেরাম খুরুজ বা বিদ্রোহের যে আলোচনাগুলো করেছেন, সেগুলো এই চিন্তাধারার উলামায়ে কেরামের কাছে অর্থহীন। কেননা গণতান্ত্রিক আইনে সরকার পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের অনুমতি নেই। এটা তো গণতন্ত্রের অস্তিত্বের সাথেই সাংঘর্ষিক। তাই গণতান্ত্রিক আইন মেনে নেওয়ার পর সশস্ত্র সংগ্রামের বৈধতা দেওয়া অসম্ভব। এ কারণেই এই চিন্তাধারার উলামায়ে কেরাম মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে কোনো অবস্থাতেই সশস্ত্র সংগ্রামের কোনো ধরনকেই জায়েয মনে করেন না।
প্রথমোক্ত চিন্তাধারা গ্রহণ করে নিলেও বর্তমান শাসনের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। এখানে তেমনই কয়েকটি প্রশ্ন উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি।
এক. ‘কারারদাদে মাকাসেদের’ মতো ধারাগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে যদি ধরে নেওয়া হয়, রাষ্ট্র নামক এই ‘রূপক ব্যক্তি’ ইসলাম গ্রহণ করেছে বা ইসলামী হয়ে গিয়েছে; তাহলে সুদের মতো একাধিক সুস্পষ্ট হারামের বৈধতা-সংক্রান্ত ধারা সংবিধানে থাকার কারণে কি এই রাষ্ট্র ইরতিদাদ ও যানদাকায় লিপ্ত হয় না? অনৈসলামী হয়ে যায় না? কেননা সংবিধান তো কোনো আমল নয়; বরং আকীদা বা বিশ্বাসের নাম। এ কারণেই তো আল্লাহ তায়ালার জন্য সার্বভৌমত্ব স্বীকার করাকে কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করার মতো ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে হারামকে হালাল মনে করা তো সুস্পষ্ট কুফর। জীবনভর ইবাদত করা কোনো মুসলিম যদি একটি কুফরী বিশ্বাসও লালন করে, তাহলে সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে— এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত। কাজেই হারাম জিনিসকে বৈধতা দেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র যদি অনৈসলামী হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রাম জায়েয হবে কি না?
একইভাবে রাষ্ট্রকে ‘রূপক ব্যক্তি’ ধরে নেওয়ার পর আমরা যদি দেখি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র নামের এই ‘রূপক ব্যক্তি’ জমিনে বিশৃঙ্খলা করছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, তাহলে কি তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম জায়েয হবে? কারণ উলামায়ে কেরামের ইজমা হলো, জমিনে বিশৃঙ্খলা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ব্যক্তি ‘মুসলিম’ হলেও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বৈধ। প্রথম চিন্তাধারা অনুযায়ী এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরি। আমরা মনে করি, প্রথম চিন্তাধারার মূলনীতি অনুযায়ীও [যেহেতু তাঁরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অনুসারী] এক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামকে বৈধ বলতে হবে। আল্লাহু আ’লাম।
দুই. খুরুজ বা বিদ্রোহের সম্পর্ক শাসকের সাথে, রাষ্ট্রের সাথে না। তাই ফুকাহায়ে কেরামের আলোচিত শর্তাবলি অনুযায়ী দারুল ইসলামেও শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হতে পারে। প্রথম ধারার অবস্থান অনুযায়ী এই মাসআলার প্রয়োগ কীভাবে হবে? কারণ বর্তমানে এসব রাষ্ট্রের ‘ইসলামী সংবিধান’ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনকে ‘সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ মনে করে না; বরং ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ মনে করে। এটি এমন এক ধাঁধা, যার উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কেউ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলামী হুকুমত কায়েমের চেষ্টা করলেই সেটাকে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ মনে করা হয়। অথচ যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন না; বরং সরকার ও সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, যাতে রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থে দারুল ইসলাম বানানো যায়। তাহলে তাদের দেশদ্রোহী বলা শরীয়তের দৃষ্টিতে কীভাবে বৈধ হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরও প্রথম ধারা অনুযায়ী দেওয়া জরুরি। আমরা ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলাম। উত্তর প্রথম অবস্থানের আলোকে দেওয়া জরুরি।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, পাকিস্তানের অর্ধেক ইতিহাস হলো জেনারেলদের সামরিক বিদ্রোহের ইতিহাস। জেনারেলরা প্রকাশ্যে সংবিধানকে ছুড়ে ফেলেছে, রাষ্ট্রীয় আইনকে পদদলিত করেছে, মসনদে বসে ক্ষমতার মজা উপভোগ করেছে বছরের পর বছর। কিন্তু কখনও তো তাদের দেশদ্রোহী বলা হয়নি। দেশদ্রোহী কেবল সেই নিষ্ঠাবান মুসলিমদেরই বলা হয়েছে, যারা পাকিস্তানকে তার মূলভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছে, যে ভিত্তির ওপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই একটিমাত্র অপরাধে কত মুখলিস যুবককে সামরিক আদালতের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, কতজনকে নির্বিচারে মেরে ফেলা হয়েছে, বানোয়াট বন্দুকযুদ্ধের কথা বলে শহীদ করা হয়েছে আর কত যুবক আজও পর্যন্ত গুম হয়ে আছে।
উলামায়ে কেরামের জন্য অত্যন্ত ভয়ের বিষয়, তাদের ফতওয়াকে পুঁজি করে সরকারি বাহিনীগুলো এ ধরনের নোংরা অপরাধ করছে। আল্লাহ না করুন, কিয়ামতের দিন এ কারণে যদি আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হয়! পশ্চিমাদের গোলাম লিবারেল-সেক্যুলারগোষ্ঠী যা করার তা তো করবেই। তাদের কাছে ফতওয়ার কোনো মূল্য নেই। এরা উলামায়ে কেরামকে নিজেদের মন্দ কাজের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এরা উলামায়ে কেরামকে বাহন বানিয়ে জাহান্নামে যেতে চায়।
উলামায়ে কেরামের ফতওয়া দেখিয়ে মুসলিম পরিবারগুলোকেও ধ্বংস করতে চায় এই ধর্মবিদ্বেষী গোষ্ঠী। গোয়েন্দাসংস্থার লোকেরা আমার স্ত্রীকেও ফতওয়া দেখিয়ে আমার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। তাদের কাছে তো আমি রাষ্ট্রদ্রোহী। তারা সব ঘরানার উলামায়ে কেরামের ফতওয়া সংগ্রহ করে রেখেছে। আর যেসব উলামায়ে কেরাম এ ফতওয়াগুলো দিয়েছেন, তাদের কারও মতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত ব্যক্তি থেকে স্ত্রীর আলাদা হয়ে যাওয়া ওয়াজিব, আর কারও মতে জায়েয। কিন্তু উলামায়ে কেরামের ব্যাপারে আমার ধারণা হলো, তাঁরা যদি বৈশ্বিক কুফরিশক্তির দোসর এই সরকারি বাহিনীগুলোর বাস্তবতা জানতে পারেন, তাহলে কখনও তাদের হাতে এমন কোনো ফতওয়া তুলে দেবেন না, যা মুসলমানদের দুর্বল করে দেবে। তবে কারও থেকে জোর করে ফতওয়া নেওয়া হলে ভিন্ন বিষয়। এর হুকুম সকলেই জানেন এবং এই ওযরও গ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রাম
এতক্ষণ আমরা প্রথম চিন্তাধারা অনুযায়ী বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের বৈধতা নিয়ে আলোচনা করলাম। এখন দ্বিতীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে, যা অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের অবস্থান। তারা যেহেতু ফকীহদের পূর্বের ইজতিহাদকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্তমান যুগেও প্রযোজ্য মনে করেন, তাই বর্তমান যুগে সশস্ত্র সংগ্রামের বিধান তাঁরা সেই ইজতিহাদের আলোকেই নির্ধারণ করেন। এই ইজতিহাদ অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রামকে নিঃশর্তভাবে জায়েযও বলা যায় না, আবার সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধও বলা যায় না। বরং ফুকাহায়ে কেরাম খুরুজ বা বিদ্রোহের যে শর্তগুলো উল্লেখ করেছেন, সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। সে অনুসারে খুরুজের তিনটি অবস্থা হতে পারে—ওয়াজিব, জায়েয এবং হারাম।
ওয়াজিব খুরুজ: শাসক যদি সুস্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হয় বা শরীয়তের কোনো বিধান পরিবর্তন করে, তাহলে প্রয়োজনে বিদ্রোহ করে হলেও তাকে অপসারণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। অবশ্য বিদ্রোহের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম সামর্থ্য থাকার শর্ত দিয়েছেন। তবে সামর্থ্য ছাড়াও যদি কেউ যুদ্ধ (শুরু) করে, তাহলে তাদের সাহায্য করা ওয়াজিব না হলেও তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে শাসকদের সমর্থন করা জায়েয নেই। সামর্থ্য না থাকলে বিদ্রোহ করা যদিও ওয়াজিব না, কিন্তু বিদ্রোহের জন্য ইদাদ ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা মুসলিমদের ওপর কাফেরদের শাসন ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েয নয়।[20] তাই এ অবস্থায় বিদ্রোহের প্রস্তুতি গ্রহণ করা ওয়াজিব হয়ে যায় এবং প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে বিদ্রোহ করাও আবশ্যক হয়ে যায়। কাফের সরকারকে অপসারণ করার জন্য সম্ভাব্য সকল মাধ্যমে চেষ্টা করা, যুদ্ধ ব্যতীত অপসারণ করা সম্ভব না হলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। এই যোদ্ধাদের কখনোই ‘বাগী বা বিদ্রোহী’ বলা যাবে না; বরং তারা আল্লাহর পথের মুজাহিদ। আর মুসলমানদের ওপর চেপে বসা এসব শাসক অপসারণযোগ্য।
জায়েয খুরুজ: শাসক জুলুম-অত্যাচার করলে মজলুমের জন্য শাসকের জুলুম-অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষা ও নিজেদের অধিকার আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করা জায়েয। তারাও ‘বাগী’-র হুকুমের আওতায় পড়বে না। তেমনই অন্যান্য মুসলমানদের জন্যও এই মজলুম মুসলমানদের বিপক্ষে শাসকদের সাহায্য করা জায়েয নয়। এমনকি যোদ্ধাদের নিন্দা করাও নাজায়েয।
হারাম খুরুজ: শাসক ব্যক্তিজীবনে ফিস্ক-ফুজুর ও গুনাহে লিপ্ত হলে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ জায়েয নেই। অধিকাংশ মুতাআখখিরীন উলামায়ে কেরামের মতে তা হারাম। যদিও সালাফ থেকে এর বৈধতার পক্ষেও কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়। তেমনই এই যোদ্ধাদের ওপর বাগী বা বিদ্রোহীর হুকুম আরোপ করার ক্ষেত্রেও উলামায়ে কেরামের মতভেদ রয়েছে; কারও মতে তাদের বাগী বা বিদ্রোহী বলা যাবে, কারও মতে বলা যাবে না।
শাসক যদি ন্যায়পরায়ণ হন এবং শরীয়ত অনুযায়ী শাসন করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সশস্ত্র সংগ্রাম করা বাগাওয়াত ও বিদ্রোহের শামিল। এমন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শাসকদের সঙ্গ দেওয়া মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।
এ বিধানগুলো ফুকাহায়ে কেরামের কিতাবাদিতেই আছে। আমরা এখানে কেবল সারমর্ম তুলে ধরলাম। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.-এর পুস্তিকা ‘জাযলুল কালাম ফি আযলিল ইমাম’ যথেষ্ট, যার সারমর্ম হযরত মুফতী তাকী উসমানী সাহেব দা.বা. তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিমে উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং যে-সকল উলামায়ে কেরাম আধুনিক রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যাপারে দ্বিতীয় চিন্তাধারা পোষণ করেন, তারা বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলোর সরকারের ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রয়োগ করেন। শাসক যদি সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হয়, এর দিকে আহ্বানকারী হয়, শরীয়ত পরিবর্তনের অপরাধে লিপ্ত হয় এবং শরয়ী আইনের স্থলে পশ্চিমা আইন জারি করে—তবে তার বিরুদ্ধে উলামায়ে কেরাম খুরুজ ও বিদ্রোহের ফতওয়া দেন। যদিও সে এমন রাষ্ট্রের শাসক হয়, যার সংবিধানে ‘কারারদাদে মাকাসেদ’ আছে। এই বিদ্রোহীরা আল্লাহর পথের মুজাহিদ, হক পথের পথিক। তাদের বিপক্ষে শাসকদের সাহায্য করা হারাম। হ্যাঁ, বিদ্রোহের শক্তি থাকা-না-থাকার ব্যাপারে উপরিউক্ত আলোচনার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
এই দলীলের ভিত্তিতেই মাওলানা ওলীউল্লাহ কাবুলগেরামী রহ. এবং তার ঘরানার উলামায়ে কেরামের একটি বড় অংশ ‘তাহরীকে নাফাযে শরীয়তে মুহাম্মদী’ শুরু করেন। তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা ছিলেন। এই অপরাধেই তাঁকে এবং তার সহকর্মী উলামায়ে কেরামের একটি বড় অংশকে সেনাবাহিনী শহীদ করেছিল। এই দলীলের ভিত্তিতেই মুফতী নেজামুদ্দীন শামযায়ী রহ. পারভেজ মুশাররফ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফতওয়া দিয়েছিলেন, যা সে সময় ব্যাপক প্রচার হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই শায়খ নুরুল হুদা রহ.-ও পাকিস্তানে সশস্ত্র সংগ্রামের ফতওয়া দিয়েছিলেন, যা মুজাহিদদের রিসালাসমূহে প্রকাশিত হয়েছে। জামিয়া হক্কানিয়া আকুড়াখটকের উস্তাযুল হাদীস শায়খ নসীব খান রহ.-ও এই ফতওয়া দিয়েছিলেন।
জামিয়া ফরীদিয়া ইসলামাবাদের এক আলেম আমাকে বলেছেন, তিনি তেহরিকে নাফাযে শরীয়তে মুহাম্মদীর এক দায়িত্বশীল খালেদ আমীর-এর সাথে একই জেলখানায় বন্দি ছিলেন। খালেদ আমীর সাহেব তাকে বলেছেন, ইমারতে ইসলামিয়ার সূচনালগ্নে তিনি মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানবী রহ.-এর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, মুফতী সাহেব যেন আমীরুল মুমিনীন মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রহ.-কে আফগানিস্তানে নাফাযে শরীয়তের প্রশিক্ষণক্যাম্প খোলার অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি সুপারিশপত্র লিখে দেন। যাতে তারা পাকিস্তানে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে পারেন। মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ. পুরো কথা শোনার পর আমীরুল মুমিনীন রহ. বরাবর একটি সুপারিশপত্র লিখে দেন এবং তাঁর সুপারিশের ভিত্তিতেই আমীর খালেদ সাহেব আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণক্যাম্প খোলার অনুমতি পান।
উল্লিখিত উলামায়ে কেরাম ছাড়াও আরও অনেক আলেমের মত আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। এ সকল উলামায়ে কেরামের দ্বীনী মজবুতি এবং ফিকহ ও ফিকর সর্বজনস্বীকৃত। তাঁদের থেকে সুস্পষ্টভাবে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করার সমর্থন পাওয়া যায়। তাছাড়া আমরা জানি, সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরাম সশস্ত্র সংগ্রামের গোপন সমর্থন পূর্বেও করেছেন, এখনও করছেন।
যেসব শাসক মুসলমানদের কোনো গোত্র বা অঞ্চলের ওপর সুস্পষ্ট জুলুম-অত্যাচার করে, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করা-ও উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে জায়েয। তাঁদের মতে এমন পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সংগ্রামকারী মুসলমানদের বিপক্ষে গিয়ে শাসকদের সমর্থন করা নাজায়েয। যেমন: পশ্চিমাদের ইশারায় পাকিস্তানের কাবায়েলি অঞ্চলে পাকবাহিনী জুলুম-নির্যাতনের এক কালো অধ্যায় রচনা করেছে। পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে আমেরিকার অগ্রগামী বাহিনী হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন কাবায়েলি অঞ্চলে আক্রমণ শুরু করে, তখন পুর্বোল্লেখিত দলীলের ভিত্তিতেই লাল মসজিদে উলামায়ে কেরামের সভায় ‘ওয়ানা অপারেশনের’ বিপক্ষে ফতওয়া দেওয়া হয়, সরকার ও সেনাবাহিনীর সমর্থনকে হারাম বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ফতওয়ায় পাঁচশোর অধিক উলামায়ে কেরাম সন্তুষ্টচিত্তে স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের কাউকে বাধ্য করা হয়নি।
প্রশ্ন হলো, এখন কি পাকিস্তানের অবস্থা পালটে গিয়েছে? পাকিস্তানের শাসকবর্গ ও জেনারেলরা কি আজ ইসলামের দুয়ারে মাথা নত করে শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে? নাকি আজও পারভেজ মোশাররফের সেই পন্থাই বহাল আছে? তারা কি পরাশক্তির ইশারায় শরীয়তবিরোধী লিবারেল আইন প্রণয়ন করছে না? শরীয়তের নাম উচ্চারণকারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে আমেরিকার ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই’ অব্যাহত রাখছে না? এটা তো স্পষ্ট একটি বিষয়, এর দলীলও দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট।
সাথে সাথে আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের নিকট এটিও স্বীকৃত যে, আলেম ও মুজতাহিদের মৃত্যুতে তাঁর ইজতিহাদ শেষ হয়ে যায় না, তার অনুসরণ নাজায়েযও হয়ে যায় না। তাহলে উপরিউক্ত আলেমগণের ফতওয়া কি আজও গ্রহণযোগ্য নয়?
এই পুরো আলোচনার দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানে যদিও আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয় আর গণতান্ত্রিক মূলনীতিগুলোতে স্রেফ শাব্দিক কিছু পরিবর্তন করা হয়; কিন্তু যেহেতু এসব দেশে ইসলামী শরীয়ত বাস্তবিক অর্থে অকার্যকর, এখানে সরকার ক্ষমতায় আসে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে, তাই এমন রাষ্ট্রে ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করা ফুকাহায়ে কেরামের বর্ণিত বিধান অনুযায়ী নাজায়েয-ও নয়, বাগাওয়াত-ও নয়; বরং অবস্থার প্রেক্ষিতে কখনও জায়েয, কখনও ওয়াজিব। এটাই পাকিস্তানের অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত, যাদের আমরা দ্বিতীয় চিন্তাধারা ও অবস্থানের ধারক বলে উল্লেখ করেছি।
সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপারে জরুরি জ্ঞাতব্য
সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপারে আমরা যা-কিছু আলোচনা করেছি, তা সব মৌলিক বিধান। এ পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে, বর্তমান রাষ্ট্রগুলোর সরকার শরীয়তবিরোধী কুফরী আইন প্রণয়ন করলে এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনী এমন সরকার ও কুফরী আইনের প্রতিরক্ষা করলে, শরীয়ত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দলকে ‘বাগী বা বিদ্রোহী’ বলা যাবে না। বরং এই যুদ্ধে শরীয়তবিরোধী সরকার ও বাহিনীগুলোকে সমর্থন করা হারাম। এটিই অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত।
যে-সকল উলামায়ে কেরাম প্রথম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী, তাদেরও এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার, গণতান্ত্রিক আইনকে ভিত্তি বানিয়ে কীভাবে তাঁরা এমন সরকার ও বাহিনীকে সমর্থন করছেন, যারা সুস্পষ্টভাবে শরীয়ত পরিপন্থি কাজে লিপ্ত এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠায় ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা প্রদান করছে? এটা তো ফুকাহায়ে কেরামের বর্ণিত বিধানের সুস্পষ্ট বিরোধিতা।
সাথে সাথে এটাও বোঝা দরকার, মূল ওয়াজিব হলো কুফরী আইন বাস্তবায়নকারী সরকারকে হটিয়ে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা। এই ওয়াজিব যদি অস্ত্র ধরা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আদায় হয়ে যায়, তাহলে অস্ত্র ধরার প্রয়োজন নেই। [কারণ লক্ষ্য অর্জন হয়ে গিয়েছে।] এমনইভাবে অস্ত্রধারণ করে বিদ্রোহ করা হলো ঠিকই, কিন্তু বিদ্রোহের পরও যদি শরীয়ত প্রতিষ্ঠা না করা হয়, তাহলে [বিদ্রোহ সফল হলেও] কার্যক্ষেত্রে এই চেষ্টাকে ব্যর্থই ধরা হবে। [কারণ লক্ষ্য অর্জন হয়নি।]
যদি সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে নানাবিধ অকল্যাণ তৈরির আশংকা থাকে, তখন হতে পারে কিছু আলেম (ক্ষতির দিকে লক্ষ্য করে) এ থেকে নিষেধ করবেন।[21] বিশেষ করে, শরীয়ত প্রতিষ্ঠার নামে সশস্ত্র সংগ্রামকারীরা যদি সাধারণ মুসলমানদের রক্ত ঝরায়, নিরপরাধ লোকদের হত্যা করা শুরু করে এবং মুসলমানদের সহায়-সম্পত্তির ক্ষতি করে, তাহলে শরীয়ত পরিপন্থি এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা তো ইসলামের মৌলিক বিধানেরই অন্তর্ভুক্ত। যারা ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য করে না এবং যুদ্ধের যে নিয়মাবলি শরীয়ত দিয়েছে, তার কোনো পরোয়া করে না; এমন সশস্ত্র কর্মকান্ডকে নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমে দ্বীন-ই সমর্থন করতে পারেন না।
বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করলে আমরা দেখব, আজ পর্যন্ত পাকিস্তানে যত সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে, সে ব্যাপারে অনেকের অভিযোগ আছে, এগুলোতে শরয়ী সীমারেখা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এটা ঠিক যে, নারীদের সম্ভ্রমহানি আর জনগণকে হয়রানি করা সরকারি বাহিনীর নিয়মে পরিণত হয়েছে, আমরাও এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অপরদিকে মুজাহিদদের থেকে দুয়েকটি ভুল হয়েছে, [যা না হওয়া দরকার ছিল।] কারণ, সাদা পোশাকে ছোট্ট একটি কালো দাগও বাজে দেখায়, কিন্তু কালো পোশাকে হাজার কালো দাগ থাকলেও তা নজরে পড়ে না।
‘পয়গামে পাকিস্তান’-এর বাস্তবতা
কেউ আপত্তি তুলতে পারেন, আপনি বলছেন অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম দ্বিতীয় চিন্তাধারার অনুসারী এবং তাদের মতে বর্তমান রাষ্ট্রগুলোতে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা জায়েয। অথচ পাকিস্তানের সকল ঘরানার ১৮শ-এর বেশি উলামায়ে কেরাম ‘পয়গামে পাকিস্তান’-এ স্বাক্ষর করেছেন। এটা কি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না?
এর উত্তরে বলব, পয়গামে পাকিস্তান বাহ্যিকভাবে যেমন দেখা যায় বাস্তবেও যদি তেমন হতো, তাহলে সত্যই তা সংখ্যাগরিষ্ঠতার দলীল হতো। কিন্তু আমরা ‘পয়গামে পাকিস্তান’-এ স্বাক্ষরকারী উলামায়ে কেরামের কাছে জিজ্ঞাসা করে দুটি বিষয় জানতে পেরেছি। একজন বড় আলেম বলেছেন, যে বিষয়ে আমাদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে আর ‘পয়গামে পাকিস্তান’-এর নামে যা ছাপা হয়েছে, দুটোতে কোনো মিল নেই। এ কথা তিনি একজনের সামনে বলেননি; বরং হাদীসের দরসে সকল ছাত্রের সামনে বলেছেন। আরেকজন বড় মুফতী সাহেব বলেছেন, গোয়েন্দাসংস্থার প্রচণ্ড চাপের মুখে আমরা স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছি।[22]
এই দুই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বাকি স্বাক্ষরগুলোর অবস্থা বুঝে নিন এবং জেনে নিন, পয়গামে পাকিস্তানে যা লেখা আছে, স্বাক্ষরকারী আলেমগণ তার সাথে একমত নন। এটাই পয়গামে পাকিস্তানের বাস্তবতা।
পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা এবং বিশ্বমোড়লদের এজেন্ডা
প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তান আজ বর্ণনাতীত সঙ্গিন অবস্থা পার করছে, জীবনমান ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেভাবে দেউলিয়াত্বের দিকে ছুটে চলছে, তাতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পতনের (Collapse) প্রবল আশংকা রয়েছে। আমাদের ভয় ছিল, পাকিস্তানে ব্যাপক গৃহযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানও সিরিয়ার মতো বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যুদ্ধ ছাড়াই সেই অবস্থা হতে চলেছে। আল্লাহ না করুন! এখন যদি কোনো বিপর্যয় ঘটে, তাহলে আমাদের দেশও সিরিয়ার মতোই বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
আল্লাহর শরীয়তের বিরোধিতা এবং আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মূল দায়ভার ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর ওপরেই বর্তাবে, চাই তারা শাসক হোক বা জেনারেল। কিন্তু নাহী আনিল মুনকার ত্যাগ করা এবং এই জালেমদের কৃতকর্মের প্রতিবাদ না করার কারণে আল্লাহ তাআলার রীতি অনুযায়ী সকলকেই শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.
“সেই বিপর্যয়কে ভয় করো, যা তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে, শুধু তাদেরই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখ, আল্লাহর আজাব সুকঠিন।” [সূরা আনফাল ৮:২৫]
দেশের জ্ঞানীগুণী সকলে একত্র হয়ে চিন্তা-ফিকির করলে তাদের এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বেগ পেতে হবে না যে, এই পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাধর গোষ্ঠীই দায়ী। তারা ইসলামের প্রতিও আন্তরিক না, দেশ ও জাতির প্রতিও আন্তরিক না। এরা সেই গোষ্ঠী, যাদেরকে পশ্চিমা শক্তি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বেছে নিয়েছে। এরা নিজেদের দুনিয়া সাজানোর জন্য দেশ ও জাতির সাথে গাদ্দারি করে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বই পাকিস্তানকে আজ এই অবস্থায় এনেছে। পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস সাক্ষী, এরা সবসময় ইসলামের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে, ইসলামী আইন প্রণয়নে বাধা দিয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় দেশের নিরাপত্তাকে নিলামে তুলেছে, স্বনির্ভর করার বদলে দেশকে বানিয়েছে পশ্চিমা শক্তির গোলাম। কী করুণ অবস্থা দেখুন, একদিকে পূর্বের প্রতিবেশী রাষ্ট্র (ভারত) পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে আর এই জালেমরা পশ্চিমের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (আফগানিস্তান) দ্বীনদারিকে আমেরিকা ও পশ্চিমাদের কাছে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে দেখিয়ে নিজেদের জন্য করুণা ভিক্ষা করছে।
প্রবল আশংকা আছে, এই ক্ষমতাধর গোষ্ঠী গদি রক্ষার জন্য পশ্চিমাদের শর্ত অনুযায়ী ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে অথবা দেশের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো তাদের হাতে ছেড়ে দেবে। যার অর্থ হবে ভৌগলিক ও আদর্শিক, উভয় ক্ষেত্রে দেশকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করা।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীই দায়ী—এই বিশ্লেষণ যদি সঠিক হয়, তাহলে পুরো জাতি, বিশেষ করে উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হলো, এদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যেন নিজেদের শুধরে নেয়। আর যদি নিজেদের সংশোধন না করে, তবে যেন ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। যখন দেখি, এরা নিজেদের কর্মপদ্ধতি তো পরিবর্তন করছেই না, উলটো শরীয়ত প্রতিষ্ঠার আওয়াজ উত্তোলনকারীদেরকে দেশের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছে এবং কিছু উলামায়ে কেরামকেও নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিচ্ছে, তখন অবাক না হয়ে পারি না।
এই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী যদি দেশকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে আন্তরিক হতো, তাহলে অবশ্যই সমাধানের পথে অগ্রসর হতো। একদিকে দেশে শরীয়তের ইনসাফপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠা করত, অন্যদিকে বহিরাগত শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম বানাত। এটাই পাকিস্তানের সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন ক্ষমতার বাগডোর দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব থেকে ছিনিয়ে নেককার ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করা হবে।
দেশের প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোতে যদি এমন নেককার নেতৃত্ব থেকে থাকে, তবে তাদের উচিত গণতান্ত্রিক তামাশার অপেক্ষা না করে এ কাজ করে ফেলা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দ্বীন-ধর্ম এবং দেশ-জাতির প্রতি আন্তরিক যারা আছেন, তাদের উচিত নষ্ট-ভ্রষ্ট জেনারেলদের থেকে বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতার বাগডোর নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়া এবং দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করা। সেনাবাহিনীতে যদি এমন নেক নেতৃত্বের যোগ্য কেউ না থাকে, তবে দেশ ও জাতির উচিত বাহির থেকে যোগ্য নেতৃত্ব আসার পথ সুগম করা এবং মুজাহিদদের ওপর ভরসা রাখা।
পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদারদের নিকট যুগের চাহিদা কী?
পাকিস্তানের দ্বীনদার শ্রেণি, বিশেষ করে উলামায়ে কেরামের বোঝা দরকার, আমাদের দেশের মূল লড়াই পশ্চিমা আদর্শে বিশ্বাসী শাসকগোষ্ঠী এবং দেশ ও জাতির প্রতি আন্তরিক দ্বীনদার শ্রেণির মধ্যে। শাসকগোষ্ঠী না ইসলামের প্রতি আন্তরিক, না দেশ ও জাতির প্রতি। তারা এই দেশকে কুফরী শক্তিগুলোর হাতে পুরোপুরি বিক্রি করে ছাড়বে। এই গোষ্ঠীর নোংরা অভিলাষ পূরণে যদি বাস্তবেই কেউ অন্তরায় থেকে থাকেন, তবে তারা হলেন শরীয়ত প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত আল্লাহর পথের মুজাহিদগণ, যারা পাকিস্তানের দ্বীনদার শ্রেণিরই শক্তি। এই শক্তিকেই শাসকগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তাই তারা নিজেদের স্বার্থরক্ষায় মুজাহিদদেরকে দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর প্রমাণের চেষ্টা করে। এরা নিজেরা পশ্চিমাদের হাতের পুতুল হওয়া সত্ত্বেও মুজাহিদদের ‘সিআইএ’ ও ‘র’-এর এজেন্ট বলে দাবি করে। নিজেদের এই যুদ্ধে উলামায়ে কেরামকে ব্যবহার করে, তাদের থেকে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ফতওয়া নিয়ে আসে। অথচ তারাই সমাজে উলামায়ে কেরামের মর্যাদাহানি করে, দ্বীনী শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের কর্তৃত্ব খর্ব করার চেষ্টা করে। মাদরাসাগুলোকে তারা নিজেদের আয়ত্তে নিতে চায়, উলামায়ে কেরামকে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মহীন পলিসির অনুগত বানাতে চায়। এমনকি এই জালেমগোষ্ঠী উলামায়ে কেরামকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। এর প্রমাণ হিসেবে মাওলানা সামীউল হক শহীদ রহ. এবং মাওলানা ড. আদিল খান শহীদ রহ.-এর শাহাদাতই যথেষ্ট। স্বয়ং শায়খুল ইসলাম হযরত মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের ওপর গুলিবর্ষণকারীরাই বা কোথা থেকে এলো আর কোথায় মিলিয়ে গেল?
এই যুদ্ধে দ্বীনদার শ্রেণির সফলতার একমাত্র উপায় হলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সর্বতোভাবে শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন পরিহার করা। উলামায়ে কেরাম, মুজাহিদীন, মাদ্রাসার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ অথবা দ্বীনী দলসমূহ; যে যে-ঘরানারই হোক না কেন—একমাত্র এই দ্বীনদার শ্রেণিই পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আন্তরিক। ইজতিহাদ ও চিন্তাধারার ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও দ্বীনের মূলনীতির ক্ষেত্রে তারা সকলে একমত এবং মাতৃভূমি পাকিস্তানের ব্যাপারে তাদের মতাদর্শ এক।
রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্ষেত্রে মতপার্থক্যকে আপন জায়গায় রাখা চাই। এর ভিত্তিতে একে অপরকে বাগী, দেশদ্রোহী, বাতিল বলে ফতওয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। দ্বীনদার শ্রেণির এই বিক্ষিপ্ততার দ্বারা দ্বীনবিদ্বেষী শক্তিগুলোই লাভবান হয়। পশ্চিমাদের স্পষ্ট পলিসি হলো দ্বীনী শক্তিগুলোর মধ্য থেকে নিজেদের সমর্থক খুঁজে বের করে তাদেরকে অন্যদের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। এ ব্যাপারে র্যান্ড কর্পোরেশনের মতো আমেরিকান থিংক ট্যাংকগুলোর বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হলো সর্বস্বীকৃত মুনকার (মন্দ) কাজগুলোর বিরুদ্ধে সকলে মিলে প্রতিবাদ করা, সে মুনকার যে-ই করুক না কেন। সব মুনকার কাজ এক স্তরের নয়। বড় মুনকারের বিরোধিতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় মুনকার হলো ইসলামী হুকুমত ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠা না হওয়া এবং পরাশক্তির দাসত্ব। তাই এই মুনকারে লিপ্ত শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। জনগণের মধ্যে অনুভূতি সৃষ্টি করা দরকার, যেন তারা শাসকগোষ্ঠীকে পশ্চিমাদের দালালির এই অভ্যাস থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে দেশ ও জাতির প্রতি আন্তরিক লোকদের সমর্থন করে।
আমাদের বোঝা দরকার, প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তানের অবস্থা সংশোধন করতে চাইলে পুরো দ্বীনদার শ্রেণিকে একসাথে কাজ করতে হবে। এ কাজ কিছু লোকের হাতিয়ার ওঠানোর দ্বারা হবে না। একটি যুদ্ধের মাধ্যমেও এর নিষ্পত্তি হবে না। বরং এটি বিস্তৃত এক কর্মযজ্ঞ, যার রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্র। জনসাধারণের মধ্যে ইসলামী বিধিবিধানের তাবলীগ করা, সরকারি সংস্থাগুলোর সদস্যদের দ্বীন শেখানো, প্রশাসনে বেদ্বীনদের পরিবর্তে নেককার লোকদের শক্তি অর্জনের চেষ্টা করা এবং এমন এক জিহাদী শক্তি তৈরি করা, যারা পাকিস্তানে ইসলামী শাসন ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে, যাদের মাধ্যমে এমন নেককার ও যোগ্য নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে, যে নেতৃত্ব ইসলামের প্রতি আন্তরিক হবে, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রহরী হবে এবং সত্যিকার অর্থেই দেশ ও জাতির সেবায় নিবেদিতপ্রাণ হবে। এ কাজ মাদ্রাসাওয়ালাদের, সরকারি সংস্থাগুলোর সদস্যদের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উলামায়ে কেরামের এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত মুজাহিদদের। তবে নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে মুজাহিদদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি এবং তাদের শক্তির ওপরই পাকিস্তানের কল্যাণ নির্ভরশীল।
মুজাহিদদের দায়িত্ব
জাতির সামনে মুজাহিদদের প্রমাণ করতে হবে—তারা শুধু শরীয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যই মেহনত করছেন না; বরং পাকিস্তানকে পরাশক্তির তাবেদারি থেকে বের করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বানাতে চান, দেশ ও জাতিকে পৃথিবীর বুকে সম্মানিত করতে চান; আরও প্রমাণ করতে হবে, পাকিস্তান আজ যে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত বিপর্যয়ের শিকার—সে সম্পর্কে মুজাহিদগণ সম্পূর্ণ সচেতন এবং তারা জাতিকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে চান। এটা তখনই সম্ভব, যখন মুজাহিদগণ নিজেদের শরয়ী ও রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে স্পষ্টবাদী হবেন, তাদের রাজনীতি ধর্মহীন লালসার রাজনীতির প্রতারণা ও মুনাফেকি থেকে মুক্ত হবে, আদর্শের সাথে কাজের মিল থাকবে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে আত্মসমালোচনাও থাকতে হবে, যেন ভুল সংশোধন হয় এবং প্রতিটি কাজ আগের চেয়ে উত্তম হয়। মুজাহিদদের প্রমাণ করতে হবে, তারা দেশ ও জাতির ওপর চেপে বসতে চান না; বরং দেশ ও জাতিকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করতে চান।
পাকিস্তানের জনগণ দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক সমস্যায় ভুগছে। তা সমাধানের জন্য যারাই চেষ্টা করছেন, আমরাও যেন তাদের সাথে শরীক হতে পারি এবং এর জন্য যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, তাতে আমরাও যেন অংশগ্রহণ করতে পারি—এই নিয়তেই সংক্ষিপ্ত এ কথাগুলো তুলে ধরলাম। আমাদের প্রত্যেকের জন্য জরুরি হলো নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে এই সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা এবং সকল দ্বীনী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করা। যাতে বাতিল শক্তির মোকাবিলা করা যায়, পাকিস্তানসহ পুরো মুসলিম উম্মতের সম্মান ও সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে আনা যায় এবং পৃথিবীতে শরীয়তের ইনসাফপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
وما أريد إلا الإصلاح ما استطعت، وما توفيقي إلا بالله عليه توكلت وإليه أنيب.
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين، وصلى الله على نبينا محمد وعلى آله وصحبه وأمته وعلينا أجمعين.
নোট
[1]. কারারদাদে মাকাসেদ (قرارداد مَقاصِد): শাসনতন্ত্রের আদর্শ। পাকিস্তান সংবিধানের Preamble বা ‘লক্ষ্য প্রস্তাব’। দেখুন: https://bn.wikipedia.org/wiki/লক্ষ্য_প্রস্তাব
আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ.-সহ বিভিন্ন উলামায়ে কেরামের প্রাণান্ত চেষ্টায় ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ‘শাসনতন্ত্রের আদর্শ প্রস্তাব’ (কারারদাদে মাকাসেদ) পাশ হয়৷
[2]. এরা ফুকাহাদের ইজতেহাদকে ‘ক্লাসিকাল ফিকহ’ বলে থাকে এবং একে প্রাচীন যুগের প্রয়োজন আখ্যা দিয়ে বর্তমানে অকার্যকর বলে দাবি করে।
[3]. দেখুন, আল-মাদখালুল ফিকহী আল-আম (أهم المبادئ الأساسية، المطلب الثاني، قسم الحقوق العامة، في الحقوق الداخلية)
[4]. দেখুন, আল-ফিকহুল ইসলামী ও আদিল্লাতুহু (القسم الخامس، الباب السادس: نظام الحكم في الإسلام، الفصل الرابع: الدولة الإسلامية، المبحث الأول: أركان الدولة الإسلامية، الفرع الثالث: شخصية الدولة الإسلامية)
[5]. এ ব্যাপারে ‘اسلامي رياست’ শিরোনামে তাদের কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে।
[6]. মাওলানা মওদুদি রহ.-এর দৃষ্টিতে পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র ছিল। তিনি মনে করতেন, পাকিস্তান যেহেতু মুসলিম রাষ্ট্র, তাই ভারতের সাথে পাক সরকার যে-সকল চুক্তি করেছে, তা সাধারণ মুসলিমদের জন্য মানা আবশ্যক। ভারত যখন কাশ্মীরে আক্রমণ করে, তখনও যেহেতু পাকিস্তানের সাথে ভারতের চুক্তি বহাল ছিল, তাই তাঁর বক্তব্য ছিল, মুসলিম রাষ্ট্র কোনো চুক্তি করলে তা তার সকল জনগণের জন্য মানা যেহেতু আবশ্যক, তাই পাকিস্তানের মুসলিমদের জন্য কাশ্মীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা জায়েয নেই। দেখুন: খুতুবাত ওয়া মাকতুবাতে উসমানী, পৃ. ২৪৫-২৬০, সংকলক: আবু হামযা কাসিমী। [সম্পাদক]
[7]. মাওলানা ইদরীস কান্ধলভীর ছেলে মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া সিদ্দীকী রহ. আল্লামা উসমানী রহ. এর রাজনৈতিক চিঠিপত্র স্বতন্ত্ররূপে বিন্যাস করে প্রকাশ করেছেন। আল্লামা উসমানী ও মাওলানা মওদুদীর মধ্যকার চিঠিপত্র সেখান থেকে দেখা যেতে পারে। এখন আমার সামনে সেই কিতাবটি নেই। আমি নিজের স্মরণশক্তির উপর ভিত্তি করে এই কথা লিখছি।
[8]. বাসায়ের ও ইবার: ২/১১৮ (মাকতাবা বাইয়িনাত, করাচি)
[9]. প্রাগুক্ত: ২/২৬
[10]. আপ কে মাসায়েল আওর উন কা হল: ৮/৬৩৩ (মাকতাবায়ে লুধিয়ানভী, করাচি) আরও দেখুন, ‘আরবাবে ইকতেদার সে খারি খারি বাতেঁ’ (কিতাবটি বর্তমানে আমাদের হাতে না থাকায় খণ্ড ও পৃষ্ঠা নাম্বার দেওয়া যাচ্ছে না।)
[11]. ইসলামী ব্যাংকিং: ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তর, পৃ: ২২১ (ইলমহাউস প্রকাশন)। এ পয়েন্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, বিদ্যমান কাঠামো বহাল রেখে তাতে ইসলামী বিধান অনুযায়ী আমলের সুযোগ বের করা বা সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেম বদলানোর পদ্ধতি পাকিস্তানের কিছু উলামায়ে কেরামের কর্মপন্থা হলেও অধিকাংশ আলেম এতে সম্মত নন। এ কথা যেমনভাবে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনই বিদ্যমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিপক্ষে সম্মিলিত ফতওয়া দেওয়া যতটা সহজ, বিদ্যমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিপক্ষে সশস্ত্র জিহাদের সম্মিলিত ফতওয়া দেওয়া ততটাই কঠিন। [অনুবাদক]
[12]. আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদবী ‘ইয়াদে রফতেগাঁ’ গ্রন্থে আল্লামা উসমানীর আলোচনায় সেই সভার বিবরণ দিয়েছেন। দেখুন, ইয়াদে রফতেগাঁ, পৃ: ৩৯০, ৩৯১ (মজলিসে নশরিয়্যাতে ইসলাম, করাচি)
[13]. মুকালামাতুস সদরইন, পৃ: ১৩ মাওলানা তাহের কাসেমীর সংকলন।
[14]. তা’মীরে পাকিস্তান আওর উলামায়ে রব্বানী, পৃ: ১৫৪, ১৫৫ (এদারায়ে ইসলামিয়্যাত, লাহোর)
[15]. তাযকিরাতুয যফর, পৃ: ৪৩০, ৪৩১ (মাতবুআতে ইলমী কামালিয়্যাহ, ফয়সালাবাদ)
[16]. বাসায়ের ও ইবার, ২/১১২, ১১৩, ১১৬, ১৫২-১৫৫, ৩৭১, ৩৭২ (মাকতাবায়ে বাইয়িনাত, করাচি)
[17]. আহসানুল ফাতাওয়া, ষষ্ঠ খণ্ড (رفع النقاب عن وجه الانتخاب، اسلام ميں سياست كا مقام)
[18]. আপ কে মাসায়েল আওর উন কা হল, (كيا جمهوريت كو مشرف باسلام كيا جا سكتا؟) ৮/১৮৯-১৯৬ (পুরাতন প্রকাশনা, মাকতাবায়ে লুধিয়ানভী, করাচি)
[19]. মাজাল্লায়ে সানাবিল, ( خصوصي شماره ، جمهوريت نمبرগণতন্ত্র নিয়ে বিশেষ সংখ্যা)
[20]. উলামায়ে কেরামের উচিত এই মাসআলাটি স্পষ্টভাবে আলোচনা করা। সাধারণত মনে করা হয়, শাসক কাফের হয়ে গেলে সামর্থ্য থাকলে বিদ্রোহ ওয়াজিব আর সামর্থ্য না থাকলে বিদ্রোহের হুকুম রহিত হয়। কিন্তু সামর্থ্য না থাকলে বিদ্রোহের হুকুম কি স্থায়ীভাবে রহিত হয়ে যায়? কাফের শাসকের অধীনে মুসলিমদের জীবনযাপন করা জায়েয হয়ে যায়? নাকি এর অর্থ হলো শাসককে অপসারণ সর্বাবস্থায় ওয়াজিব, কেননা কোনো কাফের মুসলমানদের শাসক হতে পারে না, তাই যুদ্ধের শক্তি না হওয়া পর্যন্ত শক্তি অর্জন করা ওয়াজিব হবে এবং শক্তি অর্জন হয়ে গেলে যুদ্ধ করে শাসককে অপসারণ করতে হবে? এই দ্বিতীয় অর্থটি বর্তমানে প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছেন। এখন এটাই মনে করা হয়, সামর্থ্য যেহেতু নেই তাই এখন এমন শাসকরাই মুসলিমদের উলুল আমর (অভিভাবক ও শরয়ী শাসক)। এখানে এই মাসআলা বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। উলামায়ে কেরামের নিকট আবেদন, তারা এই শরয়ী মাসআলাকে অবশ্যই আলোচনায় আনবেন।
[21]. প্রকাশ থাকে যে, বিশেষ অবস্থায় শরীয়ত প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামকে নিষেধ করা আর মুজাহিদদের বিপক্ষে গিয়ে শরীয়তবিরোধী সরকার ও সেনাবাহিনীর সমর্থন করা—দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একটি আরেকটির জন্য জরুরি না। আমরা এখানে প্রথম বিষয়টির আলোচনা করছি। দ্বিতীয় বিষয়টির ব্যাপারে শুরু থেকেই আমরা বিরোধিতা করে আসছি।
[22]. দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আমরা এখানে সে-সকল উলামায়ে কেরামের নাম উল্লেখ করতে পারছি না। হতে পারে এ কারণে অনেকেই আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমাদের কী করার আছে? উলামায়ে কেরামের হেফাযত তো আমাদের কাছে আমাদের জানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে যে জালেমরা তাদের স্বাক্ষর নিয়েছে, তাদের কাছে উলামাদের রক্তের কোনো মূল্যই নেই। আল্লাহ তায়ালা জালেমদের ক্ষতি থেকে সকল মুসলমানদের, বিশেষ করে উলামায়ে কেরামকে হেফাযত করুন, আমীন।