বিদআত পরিচয়, ভয়াবহতা ও পরিত্রাণের উপায়
বিদআত পরিচয়, ভয়াবহতা ও পরিত্রাণের উপায়
মুফতি আবু আসেম নাবিল হাফিযাহুল্লাহ
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
সূচী
বিদআত পরিচয়, ভয়াবহতা ও পরিত্রাণের উপায়. 6
বিদআতে হাসানাহ ও বিদআতে সায়্যিআহ : একটি পর্যালোচনা.. 10
বিদআতের ভয়াবহতা এবং বিদআত প্রবণতা সৃষ্টির কারণ. 12
হাদীসের আলোকে বিদআতের ভয়াবহ পরিণতি.. 12
ক) দ্বীনের নামে সকল নব আবিষ্কৃত বিষয়ই বিদআত ও গোমরাহি.. 12
খ) সর্বপ্রকার বিদআত পরিত্যাজ্য.. 13
গ) আল্লাহ বিদআতীর আমল কবুল করেন না.. 13
ঘ) বিদআতের শেষ পরিণাম জাহান্নাম. 13
ঙ) হাদীসে বিদআতকে কুকুরের বিষের সাথে তুলনা করা হয়েছে.. 14
সাহাবীগণের বক্তব্যে বিদআতের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী.. 14
সালাফে সালেহীনের বক্তব্যের আলোকে বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তির ভয়াবহ পরিণতির কিছু দিক. 15
বিদআতী আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়, তার ইবাদত কাজে আসে না.. 15
বিদআতীর চেহারায় গোমরাহির অন্ধকার থাকে… 15
বিদআতীর প্রতি সালাফগণের ঘৃণা প্রকাশ. 15
বিদআত মানুষের মাঝে যে সকল মন্দ প্রবণতা সৃষ্টি করে.. 16
ক)সুন্নাহর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে.. 16
খ)সুন্নাতের চেয়ে বিদআতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা তৈরি করে.. 17
গ)বিদআত মানুষকে সুন্নাহ থেকে বঞ্চিত রাখে.. 17
ঘ)বিদআত মানুষকে তাওবাহ থেকে বঞ্চিত রাখে.. 17
বিদআতীর সাথে উঠা-বসা করার কিছু ক্ষতিকর দিক. 18
ক) অন্তর থেকে ইসলামের নূর বের করে দেয়. 18
খ) হক্ব দেখা থেকে অন্ধ করে দেয়. 18
গ) অন্তরে ব্যাধি সৃষ্টি করে.. 18
ঘ) আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনী-সুরক্ষা উঠিয়ে নেয়া হয়. 18
ঙ) হক্বের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে.. 19
চ) দ্বীনী ও দুনিয়াবি বিষয়ে শারীরিক-মানুষিক কষ্ট দিবে.. 19
ছ) দ্বীনের বিষয়ে সন্দেহে নিপতিত করে.. 19
জ) বেদআতীর সাথে উঠাবসা করা নিফাকের আলামত. 19
বেদআতীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা.. 20
কীভাবে মানুষের মাঝে বিদআত প্রবণতা সৃষ্টি হয়?. 20
ক) কুরআন-সুন্নাহ’র বিশুদ্ধ ইলম থেকে বঞ্চিত থাকলে… 21
গ) নিজের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার প্রবণতা থাকলে… 22
বিদআত প্রতিরোধ না করার পরিণতি.. 22
সাহাবা ও তাবেঈন বিদআতকে একদম প্রশ্রয় দিতেন না.. 23
বিদআতী ও গোমরাহ ব্যক্তিদের প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা.. 24
শয়তানী কৌশল এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায়. 24
বিদআত চিহ্নিতকরণের মূলনীতি.. 25
প্রথম মূলনীতি : যে সকল কাজের মাধ্যমে ইবাদতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবড়ি করা হয়. 26
ক) যে কোনো ইবাদতের জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে অনুমোদন পূর্বশর্ত. 26
খ) বিদআত সৃষ্টির পিছনে শয়তান কিভাবে ভূমিকা রাখে?. 28
গ) কী প্রক্রিয়ায় বিদআত মানুষের মাঝে জায়গা করে নেয়?. 28
ঘ) জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন বিদ‘আত নয়. 29
ঙ) দ্বীনী কাজে আধুনিক উপকরণের ব্যবহার : একটি পর্যালোচনা.. 29
চ) মৃত্যু পরবর্তী বিভিন্ন রসম-রেওয়াজের বিধান. 31
ছ) নব আবিষ্কৃত বিষয় কখন বিদআত হিসেবে সাব্যস্ত হবে আর কখন হবে না?. 31
জ) বিদআত দুই প্রকার : আকীদাগত ও আমলগত. 31
দ্বিতীয় মূলনীতি : শরীয়ত অনুমোদিত কোনো ইবাদতের সাথে নিজের পক্ষ থেকে সংযোজন করা.. 32
বিদআতের বিষয়ে বাড়াবাড়ি হয় দুটি স্থানে.. 33
তৃতীয় মূলনীতি : বিদআত কখনো কোনো কাজ করার মাধ্যমে হয় আবার কখনো কোনো কাজ ছাড়ার মাধ্যমে হয়. 36
ষষ্ঠ মূলনীতি : শরীয়ত যে কাজকে শর্তহীন রেখেছে, সেখানে নিজের পক্ষ থেকে শর্ত যুক্ত করা.. 43
সপ্তম মূলনীতি : শরীয়ত যে ইবাদত যে বিশেষ অবস্থার সাথে অনুমোদন করেছে তার মধ্যে পরিবর্তন করা.. 43
অষ্টম মূলনীতি : যে কাজ শরীয়ত একাকী আদায় করা অনুমোদন করেছে তা সম্মিলিতভাবে আদায় করা.. 44
নবম মূলনীতি : মাওযু বা জাল হাদীসের ওপর ভিত্তি করে কোনো আমল করা.. 44
বিদআত থেকে পরিত্রাণের উপায়. 44
ক) কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা.. 44
খ) সাহাবায়ে কিরামের পথ-পদ্ধতি ও আদর্শের অনুসরণ করা.. 45
গ) বিশেষত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ ও পথ আঁকড়ে ধরা.. 45
‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ শব্দের বিশ্লেষণ. 47
‘জামাআহ’র দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ‘ইজমা’ 48
‘জামাআহ’র তৃতীয় উদ্দেশ্য মুসলমানদের ‘জামাআহ’ 51
বিদআতঃ পরিচয়, ভয়াবহতা ও পরিত্রাণের উপায়
মুফতি আবু আসেম নাবিল হাফিযাহুল্লাহ
প্রারম্ভিক কথা
কুরআন-সুন্নাহর নানা জায়গায় বিদআতের কঠোর নিন্দা এসেছে। পুর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম তাঁদের বিভিন্ন রচনায় বিদআতের পরিচয় এবং কোন কাজগুলো বিদআত আর কোনগুলো বিদআত নয়, তা সুস্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছেন। পাশাপাশি বিদআত চিহ্নিত করার জন্য তাঁরা কিছু মূলনীতিও বলেছেন।
কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফে সালিহীনের বক্তব্যের আলোকে বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে বিদআতের পরিচয়, বিদআতের ভয়াবহতা, বিদআত চিহ্নিতকরণের মূলনীতি ও বিদআত থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়বস্তু সহজে বুঝার জন্যে আলোচনাকে চারটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায় : বিদআতের আভিধানিক অর্থ। এখানে শাখা শিরোনাম হিসেবে এসেছে, বিদআতে হাসানাহ ও বিদআতে সায়্যিআহ : একটি পর্যালোচনা।
দ্বিতীয় অধ্যায় : বিদআতের ভয়াবহতা ও বিদআত প্রবণতা সৃষ্টির কারণ।
তৃতীয় অধ্যায় : বিদআত চিহ্নিতকরণের মূলনীতি।
তৃতীয় অধ্যায়ে নয়টি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম মূলনীতির অধীনে বেশ কিছু শাখা শিরোনাম যুক্ত হয়েছে। শিরোনামগুলো হল,
ক) যে কোনো ইবাদতের জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে অনুমোদন পূর্বশর্ত।
খ) বিদআত সৃষ্টির পিছনে শয়তান কিভাবে ভূমিকা রাখে?
গ) কী প্রক্রিয়ায় বিদআত মানুষের মাঝে জায়গা করে নেয়?
ঘ) জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনা বিদআত নয়।
ঙ) বিদআত ও দ্বীনী কাজে আধুনিক উপকরণের ব্যবহার : একটি পর্যালোচনা।
চ) মৃত্যু পরবর্তী বিভিন্ন রসম-রেওয়াজের বিধান।
ছ) নবআবিষ্কৃত বিষয় কখন বিদআত হিসেবে গণ্য হবে আর কখন হবে না?
জ) বিদআত দু’ভাগে বিভক্ত : আকীদাগত ও আমলগত।
চতুর্থ অধ্যায় : বিদআত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়। এখানে শাখা শিরোনাম হিসেবে এসেছে ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ শব্দের বিশ্লেষণ এবং ‘সুন্নাহ’ ও ‘জামাআহ’ বলে কী উদ্দেশ্য?
ওপরে সংক্ষিপ্তাকারে পুরো প্রবন্ধের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হলো, যেন মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে প্রবন্ধটির সংক্ষিপ্ত একটি রূপরেখা পাঠকের সামনে এসে যায়। এতে পাঠকের জন্য পুরো আলোচনাটি বুঝা খুবই সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রথম অধ্যায়
বিদআতের আভিধানিক অর্থ
আভিধানিক অর্থে বিদআত হলো, কোনো পূর্ব নমুনা ব্যতীত নতুন কিছু উদ্ভাবন করা। তাই কোনো কাজ প্রথমবার সংঘটিত হওয়া, নতুন কোনো আবিষ্কার, নতুন মত প্রবর্তন বা নতুন কিছুর সৃষ্টি বা সূচনাকে শাব্দিক অর্থে বিদআত বলা হয়। কুরআন কারীমের নিচের দুটি আয়াত বিদআত শব্দের উক্ত অর্থকেই সাব্যস্ত করে। -আল্লাহ তাআলা বলেন,
১. ﴿بديع السماوات والأرض﴾ (তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক।) -সূরা বাকারা (২) : ১১৭
২. ﴿ قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعاً مِنَ الرُّسُلِ﴾(হে নবী আপনি বলুন, আমি তো কোনো নতুন রাসূল নই।) -সূরা আহক্বাফ (৪৬) : ৯
নিম্নে বিদআত শব্দের শাব্দিক অর্থ সম্পর্কে কয়েকজন ইমামের মতামত তুলে ধরা হলো-
১. ইমাম মুহাম্মাদ বিন আবু বকর রাযী রহ. (৬৬৫ হি.) বলেন:
وبدع أبدع الشيء اخترعه لا على مثال، ومنه قوله تعالى: ﴿بديع السماوات والأرض﴾
‘বিদআত হলো, কোনো নমুনা ছাড়াই নতুন কিছু উদ্ভাবন করা।’ এই অর্থে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক।’ -সূরা বাকারা (২) : ১১৭; মুখতারুস সিহাহ্ ১/৭৩
২. ইমাম নববী রহ.(মৃ. ৬৭৬ হি.) বলেন,
البدعة هي كل شيء عمل على غير مثال سابق.
কোনো পূর্ব নমুনার অনুসরণ ব্যতীত কৃত যে কোনো আমলকেই বিদআত বলা হয়। -শরহু সহীহ মুসলিম ১/২৮৫, হাদীস ৮৬৭
৩. প্রখ্যাত আরবি অভিধান প্রণেতা আল্লামা ইবনে মানযুর (৭১১ হি.) বলেন:
(البدعة في اللغة) بدَع الشيءَ يَبْدَعُه بَدْعاً وابْتَدَعَه: أَنشأَه وبدأَه. والبِدْعُ: الشَّيْءُ الَّذِي يَكُونُ أَوّلًا.ومنه قوله تعالى:﴿ : قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعاً مِنَ الرُّسُلِ﴾.
‘আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বিদআত’ শব্দটি কোনো কিছুর নব-উদ্ভাবন বুঝিয়ে থাকে। যেমন, নতুন কিছু সৃষ্টি করল, নতুন কিছু সূচনা করল। البدعশব্দের অর্থ হলো, কোনো কিছু প্রথমবার হওয়া বা নতুন হওয়া।’ এ অর্থে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমি তো কোনো নতুন রাসূল নই।’ -সূরা আহক্বাফ (৪৬) : ৯; লিসানুল আরব ৮/৬
৪. ইমাম শাতিবী রহ. (মৃ. ৭৯০ হি.) বলেন,
وأصل مادة بَدَعَ لِلِاخْتِرَاعِ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ
অর্থ্যাৎ – بدعধাতুটির মূল ব্যবহার কোনো পূর্ব নমুনা ছাড়া অভিনব আবিষ্কারের অর্থে হয়ে থাকে। -ইতিসাম ১/৪৯
৫. ফায়রুযাবাদী রহ. (মৃ. ৮১৭ হি.) বলেন:
والبِدْعُ بالكسر : الأَمْرُ الذي يكونُ أوَّلاً
‘বিদআত হলো, যা প্রথমবার সংঘটিত হয়।’ -আল-কামুসুল মুহীত ১/৯০৬ (শামেলা)
উক্ত আলোচনার আলোকে এটা স্পষ্ট যে, আভিধানিকভাবে বিদআতের মূল বিষয়টি নব আবিষ্কার ও প্রথম উদ্ভাবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বিদআতের শরঈ অর্থ
ইসলামের অনুসরণীয় ইমামগণ শরঈ বা পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদআতকে চিহ্নিত করে বিদআতের সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা একেকজন একেক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কেউ বিদআতকে তার মূল বিষয়ের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন। কেউ বিদআতের ফলাফল বা শাখাগত একটি বিষয়ের মাধ্যমে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আবার কেউ বিষয়টির মূল বা হাকীকতের দিকে না গিয়ে সাধারণ মানুষের বুঝ-বুদ্ধি উপযোগী করে বিদআতের পরিচয় দিয়েছেন। আমরা প্রথমে সংক্ষেপে বিদআতের হাকীকত ও বিদআতের শরঈ অর্থ উল্লেখ করব। এরপর এ বিষয়ে ইমামগণের মতামত তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
বিদআতের সংজ্ঞার সারাংশ আমরা এভাবে বলতে পারি, বিদআত হলো, ‘এমন কোনো বিষয়ের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের উদ্দেশ্যে করেছেন বা ছেড়েছেন মর্মে কোনো ভিত্তি নেই। অথবা এমন কোনো বিষয়ের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা, যার মূল ভিত্তি শরীয়তে রয়েছে কিন্তু মূলের সাথে যে অতিরিক্ত বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে সেটার কোনো দলিল বা ভিত্তি শরীয়তে নেই। অথচ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় এর প্রয়োজনীয়তা ও উপলক্ষ বিদ্যমান ছিল। সে সময় এই বিধান দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। আর এ সবকিছু করা হয়, নিজ প্রবৃত্তিপ্রসূত চিন্তার ভিত্তিতে, অতিরিক্ত ইবাদত করার আশায়।’
উল্লেখ্য, বিদআতের হাকীকত সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করা হবে তৃতীয় অংশের ‘বিদআত চিহ্নিতকরণের মূলনীতি’র আলোচনা প্রসঙ্গে ইনশাআল্লাহ।
বিদআতের সংজ্ঞায় ইমামগণের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হল-
১. প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ আলজাওহারী (মৃ. ৩৯৩ হি.) বলেন,
والبِدْعَةُ: الحَدَثُ في الدين بعد الإكْمال.
“বিদ‘আত হলো, পূর্ণতার পরে দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন।”-আস-সিহাহ, জাওহারী, ৩/১১৮৪
২. রাগিব আসফাহানী (মৃ. ৫০২ হি.) বলেন,
البِدْعةُ في المذهب: إيراد قول لم يستنّ قائلها وفاعلها فيه بصاحب الشريعة وأماثلها المتقدمة وأصولها المتقنة
দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদআত হলো, নতুনভাবে কোনো মতের প্রবর্তন করা। প্রবর্তনকারী (প্রবক্তা ও আমলকারী) এ ক্ষেত্রে সাহেবে শরীয়ত (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), সালাফে সালিহীন (সৎ পূর্বসূরীগণ) ও শরীয়তের সুদৃঢ় উৎসসমূহের কোনোটিরই অনুসরণ করেনি। -আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন পৃ. ১১১
৩. আল্লামা আলী ইবনে মুহাম্মাদ আলজুরজানী রহ.(মৃ. ৬০৪ হি.) বলেন,
“البدعة هي الفِعلة المخالفة للسنة، سميت البدعة لأن قائلها ابتدعها من غير مقال إمام وهي الأمر المحدث الذي لم يكن عليه الصحابة والتابعون ولم يكن مما اقتضاه الدليل الشرعي”
বিদআত হলো, সুন্নাতের বিপরীত কাজ। এটাকে বিদআত নামকরণ করা হয়, কেননা তা প্রবর্তনকারী অনুসরণীয় কোনো ইমামের উক্তি ছাড়াই তা নব-উদ্ভাবন করেছে। আর তা নবপ্রবর্তিত বিষয়, যার ওপর সাহাবী এবং তাবেঈগণের আমল পাওয়া যায় না এবং শরীয়তের কোনো দলিলের আলোকেও তা হয়নি। -আত তা’রিফাত ১/৭৩
৪. প্রখ্যাত আরবি অভিধান প্রণেতা আল্লামা ইবনে মানযুর (৭১১ হি.) বলেন,
والبِدْعةُ: الحَدَث وَمَا ابْتُدِعَ مِنَ الدِّينِ بَعْدَ الإِكمال.
বিদআত হলো, দ্বীন পূর্ণতা প্রাপ্তির পরে দ্বীনের নামে নবআবিষ্কৃত বিষয়। -লিসানুল আরব ৮/৬
৫. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃ. ৭২৮ হি.) বলেন,
“البدعة في الدين هي ما لم يشرعه الله ورسوله صلى الله عليه وسلم، وهو ما لم يأمر به أمر إيجاب ولا استحباب.”
‘দ্বীনের মধ্যে বিদআত হলো, যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তন করেননি। আর তা এমন যে, এ বিষয়ে (শরীয়তের) নির্দেশমূলক কিংবা মুস্তাহাবমূলক কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।’ -মাজমুউল ফাতাওয়া ৪/১০৭
৬. আল্লামা ইবনে নুজাইম (মৃ.৭৯০ হি.) বলেন,
الْبِدْعَةِ وَهِيَ كَمَا فِي الْمُغْرِبِ اسْمٌ مِنْ ابْتَدَعَ الْأَمْرَ إذَا ابْتَدَأَهُ وَأَحْدَثَهُ… ثُمَّ غَلَبَتْ عَلَى مَا هُوَ زِيَادَةٌ فِي الدِّينِ أَوْ نُقْصَانٌ مِنْهُ. وَعَرَّفَهَا الشُّمُنِّيُّ بِأَنَّهَا مَا أُحْدِثَ عَلَى خِلافِ الْحَقِّ الْمُتَلَقَّى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ عِلْمٍ أَوْ عَمَلٍ أَوْ حَالٍ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ وَاسْتِحْسَانٍ وَجُعِلَ دِينًا قَوِيمًا وَصِرَاطًا مُسْتَقِيمًا.
“আল মুগরিব” গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘বিদ‘আত শব্দটি ‘ইবতাদাআ’ ফে’ল থেকে গৃহীত ইসম। ফেলটির অর্থ শুরু করা বা উদ্ভাবন করা। অতঃপর দ্বীনের মধ্যে সংযোজন বা বিয়োজন অর্থে বিদআত শব্দটির ব্যবহার প্রাধান্য লাভ করে।’ শুমুন্নী (আল্লামা আহমাদ আশ শুমুন্নী – ৮০১-৮৭২ হি.) বিদআতের সংজ্ঞায় বলেন,‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গৃহীত সত্যের ব্যতিক্রম যে জ্ঞান, আমল (কর্ম) অথবা অবস্থা, যা কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য ভুল বুঝার কারণে ভাল মনে করে উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং যাকে সঠিক দ্বীন ও সিরাতে মুস্তাকীম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই বিদআত’।” –আল বাহরুর রায়িক শারহু কানযুদ-দাকাইক, ইবনে নুজাইম ১/৩৭০;-রাদ্দুল মুহতার আলাদ দুররিল মুখতার (বাবুল ইমামাহ) ১/৫৬০
৭. আল্লামা আবু ইসহাক শাতিবী (মৃত ৭৯০ হি.) বিদআতের দুটি সংজ্ঞাউল্লেখ করেছেন-
فالبدعة إذا عبارة عن طريقة في الدين مُخْتَرَعَةٍ تُضَاهِي الشَّرْعِيَّةَ، يقصد بالسلوك عليها المبالغة في التعبد لله سبحانه.
ক.) বিদআত বলতে বুঝায় দীনের মধ্যে কোনো নব উদ্ভাবিত পদ্ধতি, যা বাহ্যত শরীয়তের মতই, যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয় মহান আল্লাহর অতিরিক্ত ইবাদত করার আশায় ।” -আল-ই’তিসাম, শাতিবী ১/৫০
البدعة: طريقة في الدين مخترعة تضاهي الشرعية يقصد بالسلوك عليها ما يقصد بالطريقة الشرعية.
খ.) বিদআত হলো, শরঈ বিধানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ যে কোনো নতুন উদ্ভাবিত ধর্মীয় রীতি, যা অনুসরণের পেছনে তা-ই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, যা শরঈ বিধান পালনের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। -আলইতিসাম, শাতিবী ১/৫১
৮. ইবনে রজব হাম্বলী রহ. (মৃ. ৭৯৫ হি.) বলেন,
والمراد بالبدعة ما أحدث مما لا أصل له في الشريعة يدل عليه وأما ما كان له أصل من الشرع يدل عليه فليس ببدعة شرعا وإن كان بدعة لغة.
শরীয়তে ভিত্তি নেই এমন যে কোনো বিষয় আবিষ্কার করাকেই বিদআত বলে। কিন্তু শরীয়তে ভিত্তি আছে এমন কোনো বিষয় (ইসলামের পরিভাষায়) বিদআত নয়। যদিও তা আভিধানিক অর্থে বিদআত বিবেচিত হয়। -জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম পৃ. ৩২৪-৩২৫
৯. আল্লামা মাজদুদ্দীন ফাইরুযাবাদী (মৃ. ৮১৭ হি.) বলেন,
والبِدْعَةُ بالكسر: الحَدَثُ في الدين بعدَ الإِكْمَالِ، أو ما اسْتُحْدِثَ بعد النبيِّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من الأَهْواءِ والأَعْمالِ.
বিদআত হলো, দ্বীন পূর্ণতা লাভের পরে দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পরে প্রবৃত্তি প্রসূত যে মতবাদ বা কর্ম উদ্ভাবিত হয়েছে।-আলকামূসুল মুহীত ১/৯০৬
১০. আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী (মৃ. ১০৮৮ হি.) তাঁর আদ-দুররুল মুখতার গ্রন্থে বিদআতের পরিচয়ে বলেন:
وَهِيَ اعْتِقَادُ خِلافِ الْمَعْرُوفِ عَنْ الرَّسُولِ لا بِمُعَانَدَةٍ بَلْ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ
“বিদআত হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সুপরিজ্ঞাত বিষয়ের ব্যতিক্রম কোনো বিশ্বাস, যে ব্যতিক্রমের কারণ ইচ্ছাকৃত বিরোধিতা নয়, বরং কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ বুঝতে অস্পষ্টতা বা ভুল বুঝা।” -রাদ্দুল মুহতার, ইবনে আবেদীন ১/৫৬০
১১. আল্লামা মুরতাযা যাবিদী রহ. (মৃ. ১২০৫ হি.) বলেন,
البدعة ما خَالَفَ أُصُولَ الشَّرِيعَةِ ولَمْ يُوَافِق السَّنَةَ.
বিদআত হলো, যা শরীয়তের নীতিমালা বিরোধী ও সুন্নাহ পরিপন্থী। -তাজুল আরুস ২০/৩১০
১২. শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. (মৃ. ১৩৬৯ হি.) বলেন,
إن البدعة الشرعية هي إحداث أمر ليس له ثبوت بواحد من الأصول الأربعة الدينية زاعما أنه من الدين، ومظنة للإثابة من الله والتحسين.
শরঈ বিদআত হলো, ধর্মীয় বিষয় মনে করে আল্লাহর নিকট থেকে ছাওয়াব ও কল্যাণ লাভের প্রত্যাশায় এমন কিছু নতুনভাবে উদ্ভাবন করা, যে ব্যাপারে দ্বীনের চার-মূল দলিলের কোনো একটিতেও কোনো প্রমাণ নেই। -ফাতহুল মুলহিম শরহু সহীহ মুসলিম ৫/৩৩২, হাদীস ২০০২
বিদআতে হাসানাহ ও বিদআতে সায়্যিআহ : একটি পর্যালোচনা
বিদআত কি ভালো-মন্দ দু’প্রকার কিংবা বিদআতে হাসানা বা বিদআতে সায়্যিআহ বলতে কি কিছু আছে? এ বিষয়টি বিস্তারিত পর্যালোচনার দাবি রাখে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দ্বীনের যে সব বিষয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের সুন্নাহতে নেই কিংবা শরঈ নীতিমালার আলোকে যা সাব্যস্ত করা হয়নি সেটিই বিদআত। কোনো কিছু নতুন হলেই বিদআত হবে, বিষয়টি এমন না। অতএব, নববী যুগের পরে যেটা শরঈ উসূলের আলোকে হয়নি সেটা বিদআত। সেখানে বিদআতে সায়্যিআহ ও বিদআতে হাসানার কোনো ভাগ নেই। শরঈ উসূলের আলোকে হয়নি, এমন সব প্রকারই বিদআতে সায়্যিআহ হবে, যা হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। সুতরাং একজন মুমিন হিসেবে আমাদের ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, বিদআতের মধ্যে ভালো-মন্দ বলে কোনো ভাগ নেই। ঈমান ও কুফুর, নামাজ ও যাকাত শব্দের যেমন একটি শরঈ পরিভাষা রয়েছে, অনুরূপ বিদআত শব্দেরও একটি দ্বীনী ও শরঈ পরিভাষা রয়েছে। আর তা হল, কোনো কাজকে দ্বীনী রং দিয়ে দ্বীনের মাঝে শামিল করা এবং সে কাজ করার মাধ্যমে ইবাদতের মতো ছাওয়াবের আশা করা। অথচ সেই কাজটি শরঈ কোনো নীতিমালার আলোকে সাব্যস্ত হয়নি।
তবে কখনো কখনো এমন নতুন বিষয় যা শরঈ উসূলের আলোকেই সাব্যস্ত হয়েছে; তাকেও সালাফদের কেউ কেউ বিদআত শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা তা করেছেন মূলত বিদআতের শাব্দিক অর্থে, শরঈ অর্থে নয়। এবিষয়ে ইমামদের কিছু মতামত নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১. হাফেয ইবনে হাজার রহ. (মৃ. ৮৫২ হি.) বলেন,
” قَالَ الشَّافِعِيُّ: الْبِدْعَةُ بِدْعَتَانِ مَحْمُودَةٌ وَمَذْمُومَةٌ فَمَا وَافَقَ السُّنَّةَ فَهُوَ مَحْمُودٌ وَمَا خَالَفَهَا فَهُوَ مَذْمُومٌ “
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন, বিদআত বা নব আবিস্কৃত আমল দুই প্রকার। (মাহমূদাহ) প্রশংসিত ও (মাযমূমাহ) নিন্দিত। যা সুন্নাহ অনুযায়ী হবে তা ‘মাহমূদাহ’-প্রসংশিত আর যা সুন্নাহ পরিপন্থী হবে সেটা ‘মাযমূমাহ’-নিন্দিত।’ -ফাতহুল বারি, ইবনে হাজার ১৩/২৮৯, হাদীস ৭২৭৭
২. বিষয়টিকে আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন ইমাম ইবনে রজব হাম্বালী রহ. (মৃ. ৭৯৫ হি.)। তিনি বলেন,
“وَأَمَّا مَا وَقَعَ فِي كَلَامِ السَّلَفِ مِنَ اسْتِحْسَانِ بَعْضِ الْبِدَعِ، فَإِنَّمَا ذَلِكَ فِي الْبِدَعِ اللُّغَوِيَّةِ، لَا الشَّرْعِيَّةِ، فَمِنْ ذَلِكَ قَوْلُ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ لَمَّا جَمَعَ النَّاسَ فِي قِيَامِ رَمَضَانَ عَلَى إِمَامٍ وَاحِدٍ فِي الْمَسْجِدِ، وَخَرَجَ وَرَآهُمْ يُصَلُّونَ كَذَلِكَ فَقَالَ: نِعْمَتُ الْبِدْعَةُ هَذِهِ.
‘সালাফগণের কারো কারো বক্তব্যে কোনো কোনো বিদআতকে উত্তম গণ্য করার যে কথা পাওয়া যায়, তা মূলত বিদআতের শাব্দিক অর্থে প্রযোজ্য হবে, বিদআতের শরঈ অর্থে প্রয়োগ হবে না। যেমন ওমর (রাযি.) এর বক্তব্য; রমযান মাসে তিনি মানুষদেরকে মাসজিদে এক ইমামের পেছনে (তারাবীহের) নামাজ আদায় করতে একত্রিত করলেন এবং (দ্বিতীয় দিন) যখন ওমর (রাযি.) বের হয়ে তাদেরকে অনুরূপভাবে নামাজ আদায় করতে দেখলেন, তখন তিনি বললেন: ‘এটা কতইনা উত্তম বিদআত।’ -জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম পৃ. ৩২৪-৩২৫
৩. হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (মৃ. ৮৫২ হি.) বলেন,
والمحدثات بفتح الدال جمع محدثة والمراد بها ما أحدث وليس له أصل في الشرع ويسمى في عرف الشرع بدعة وما كان له أصل يدل عليه الشرع فليس ببدعة فالبدعة في عرف الشرع مذمومة بخلاف اللغة فان كل شيء أحدث على غير مثال يسمى بدعة سواء كان محمودا أو مذموما.
শরঈ পরিভাষায় বিদআত হলো, এমন নব আবিষ্কৃত বিষয় শরীয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু শরীয়তে যার ভিত্তি আছে এমন কোনো বিষয় বিদআত নয়। সুতরাং শরঈ বিদআত নিন্দনীয়, তবে আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থের বিদআত নিন্দনীয় নয়। কেননা, কোনো পূর্বনমুনা ব্যতীত যেকোনো নবআবিষ্কৃত বিষয়কেই বিদআত বলা হয়। চাই সেটা (শরঈ নীতিমালার আলোকে হওয়ার কারণে) প্রশংসনীয় হোক বা (শরঈ নীতিমালার আলোকে না হওয়ার কারণে) নিন্দনীয় হোক। -ফাতহুল বারি ১৩/২৮৮, হাদীস ৭২৭৭
৪. হাফিয বাদরুদ্দিন আইনী (৭৬২-৮৫৫ হি.) বলেন,
والبدعة في الأصل أحداث أمر لم يكن في زمن رسول الله، صلى الله عليه وسلم، ثم البدعة على نوعين: إن كانت مما يندرج تحت مستحسن في الشرع فهي بدعة حسنة، وإن كانت مما يندرج تحت مستقبح في الشرع فهي بدعة مستقبحة.
বিদআত হলো, মূলত এমন নতুন কিছু সৃষ্টি করা, যা আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুগে ছিল না। বিদআত দু’প্রকার; যদি সে নতুন সৃষ্ট বিষয় শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নীতিমালার আলোকে করা হয় তাহলে তা ‘বিদআতে হাসানাহ’। আর যদি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন কিছুর ভিত্তিতে করা হয় তাহলে তা নিন্দনীয় বিদআত। -উমদাতুল কারী ১১/১২৬ (মুজাল্লাদ ৬)
সুতরাং সালাফগণের কারো কারো কথায় বিদআতের যে প্রশংসা-বাক্য পাওয়া যায়, তা ছিল মূলত, বিদআত শব্দের শাব্দিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কিন্তু যেটা শরঈ অর্থে বিদআত (যার পরিচয় ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে), এমন বিদআতের প্রশংসা তাঁদের কারো থেকে পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় অধ্যায়
বিদআতের ভয়াবহতা এবং বিদআত প্রবণতা সৃষ্টির কারণ
হাদীসের আলোকে বিদআতের ভয়াবহ পরিণতি
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে বিদআতের ভয়াবহতা ও মন্দ পরিণাম তুলে ধরে উম্মাহকে সতর্ক করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল-
ক) দ্বীনের নামে সকল নব আবিষ্কৃত বিষয়ই বিদআত ও গোমরাহি
১. ইরবায ইবনে সারিয়া (রাযি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
সাবধান! (দীনের ব্যাপারে কিতাব ও সুন্নাহর বাহিরে) নতুন নতুন তরিকা ও পদ্ধতি থেকে দূরে থাকবে। কারণ (দ্বীনের মধ্যে) সকল নবউদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত। আর সকল বিদআতই গুমরাহী। ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। -মুসনাদে আহমাদ ২৮/৩৭৫, হাদীস ১৭১৪৫,তাহকীক- শায়খ শুআইব আলআরনাউত; জামে তিরমিযী ২/ ৯৬; সুনানে আবু দাউদ ২/৬৩৫; সুনানে ইবনে মাজাহ ১/৫
২. জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أما بعد! فانَّ خير الحديث كتاب الله، وخير الهدي هدي محمد، وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة.
সর্বোত্তম কথা হলো, আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত কথা। সর্বোত্তম পথনির্দেশনা হলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত পথনির্দেশনা। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস হলো, দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট নতুন জিনিস। সকল বিদআতই হলো গোমরাহি। -সহীহ মুসলিম ১/২৮৪-২৮৫, হাদীস ৮৬৭
৩. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّمَا هُمَا اثْنَتَانِ: الْكَلامُ وَالْهَدْيُ فَأَحْسَنُ الْكَلامِ كَلامُ اللَّهِ وَأَحْسَنُ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ أَلا وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدِثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ شَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ
বিষয় শুধুমাত্র দুটি : বাণী ও পথনির্দেশনা। সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর বাণী এবং সর্বোত্তম পথনির্দেশনা হলো মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পথনির্দেশনা। সাবধান! তোমরা নব উদ্ভাবিত বিষয়াবলী থেকে সাবধান থাকবে; কারণ সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো নবউদ্ভাবিত বিষয়। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত এবং সকল বিদআতই পথভ্রষ্টতা।” হাদীসটির সনদ হাসান। -সুনানে ইবনে মাজাহ, তাহকীক- শায়খ শুআইব আরনাউত ১/০৬, হাদীস ৪৬
খ) সর্বপ্রকার বিদআত পরিত্যাজ্য
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযি) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
কেউ আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে দ্বীনের অংশ নয় এমন কিছুর উদ্ভব ঘটালে তা পরিত্যাজ্য হবে।
আয়েশা (রাযি.) থেকে সহীহ মুসলিমের দ্বিতীয় বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ عَمِلَ عَمَلا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
যে (দ্বীন ও শরীয়তের নামে) নতুন কোনো কাজ করে, যে বিষয়ে শরঈ কোনো দলিল নেই, তাহলে তার নতুন উদ্ভাবিত কাজটি পরিত্যাজ্য (আল্লাহর নিকট তা কবুল হবে না)।” -সহীহ বুখারী ১/৩৭১, হাদীস ২৬১৯; সহীহ মুসলিম ২/৭৭, হাদীস ১৭১৮
উক্ত হাদীস সমূহের আলোকে বুঝা যায়, দ্বীনের নামে এমন যা কিছু প্রচার করা হবে যেগুলো দ্বীন হওয়ার কোনো দলিল নেই, তা পরিত্যাজ্য।
গ) আল্লাহ বিদআতীর আমল কবুল করেন না
হাসান বসরী রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
من أحدث حدثا أو آوى محدثا فعليه لعنة الله والملائكة والناس أجمعين ، لا يقبل منه صرف ولا عدل
، قالوا : وما الحدث يا رسول الله ؟ قال : بدعة بغير سنة ، مثلة بغير حد ، نهبة بغير حق
যে ব্যক্তি (দ্বীনের মধ্যে) কোনো নতুন কোন বিষয়ের উদ্ভাব ঘটাবে কিংবা নতুন বিষয় উদ্ভাবনকারী তথা বিদআতীকে প্রশ্রয় দিবে, তার ওপর আল্লাহর লানত এবং সমস্ত ফেরেশতা ও মানুষের লানত। তার ফরজ, নফল কোনো ইবাদতই কবুল হবে না। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! নব উদ্ভাবিত বিষয় বলে কী উদ্দেশ্য? তিনি বললেন, এমন নব উদ্ভাবিত বিষয় যা সুন্নাহ’র (ভিত্তিতে) হয়নি। হদ ব্যতীত কারো অঙ্গহানি করা। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া।-মারাসীলে আবু দাউদ, তাহকীক- শায়খ শুআাইব আলআরনাউত পৃ. ২৬৩, হাদীস ৫৩৫ (এর সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য) সহীহ বুখারী ১/২৫১, হাদীস ১৮৩২, ১৮২৯ (ফাযায়িলুল মাদীনাহ) ; মুসলিম ১/৪৪১
ঘ) বিদআতের শেষ পরিণাম জাহান্নাম
জাবির (রাযি) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ وَكُلُّ ضَلالَةٍ فِي النَّارِ.
সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম পথনির্দেশনা হলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত পথনির্দেশনা। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট নতুন বিষয়। প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত আর প্রতিটি বিদ‘আত-ই পথভ্রষ্টতা এবং সকল পথভ্রষ্টতা জাহান্নামে (নিয়ে যাবে)” -সুনানে নাসাঈ ১/১৭৯, হাদীস ১৫৭৭। মূল হাদীসটি সহীহ মুসলিমে রয়েছে; ১/২৮৪-২৮৫
ঙ) হাদীসে বিদআতকে কুকুরের বিষের সাথে তুলনা করা হয়েছে
মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইরশাদ করেন,
“….. وإنّه سيخرج في أمتي أقوام تَجَارَى بهم تلك الأهواءُ كما يَتَجَارَى الكَلَبُ لِصاحبه -وقال عمرو: “الكَلَب بصاحبه- لا يبقى منه عِرْقٌ ولا مَفصِلٌ إلا دخلَه”
…..শীঘ্রই আমার উম্মতের মধ্যে এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে, যাদের শরীরের গিরায় গিরায় বিদআত প্রবণতা ছড়িয়ে পড়বে, ঠিক যেভাবে কাউকে কুকুর কামড়ালে এর বিষ তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের কোনো শিরা বা জোড়া অবশিষ্ট থাকে না, যেখানে এ বিষ না ঢুকে। হাদীসটির সনদ হাসান।-মুসনাদে আহমদ ২৮/১৩৪-১৩৫, হাদীস ১৬৯৩৭, তাহকীক- শায়খ শুআাইব আলআরনাউত; সুনানে আবু দাউদ ৭/০৬, হাদীস ৪৫৯৭, তাহকীক- শায়খ শুআাইব আলআরনাউত।
সাহাবীগণের বক্তব্যে বিদআতের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী
১. ইবনে মাসঊদ (রাযি) বলেন ,
اتَّـبِـعُوا وَلا تَـبْـتَـدِعُوا فَقَـدْ كُـفِـيتُـمْ، كل بدعة ضلالة
তোমরা (কুরআন-সুন্নাহর) অনুসরণ কর, বিদআত উদ্ভাবন করো না। কারণ, দ্বীনের মধ্যে যা আছে তা-ই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহি।” হাইসামী রহ. বলেন, হাদীসটির সকল বর্ণনাকারী ছিক্বাহ। -সুনানেদারিমী ১/৭৪, হাদীস ২০৯; তবরানী কাবীর ৯/১৫৪, হাদীস ৮৭৭০; মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৮১, হাদীস ৮৫৩
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. (মৃ. ৬৮ হি.) বলেন,
إن أبغض الأمور إلى الله البدع ، وإن من البدع الاعتكاف فى المساجد التى فى الدور.
আল্লাহর কাছে যেসব কাজ নিকৃষ্ট বিবেচিত তন্মধ্যে অন্যতম হলো বিদআত। আর মহল্লার মসজিদে (যেখানে জুমআ হয় না, শুধু পাঁচ ওয়াক্তের নামায হয় সেখানে) এতেকাফ করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। বর্ণনাটি হাসান। -সুনানে কুবরা, বাইহাকী (মৃ. ৪৫৮ হি.) ৪/৩১৬, ৮৮৩৬
৩. উসমান বিন হাদির বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রাযি. (মৃ. ৬৮ হি.) -এর নিকট গমন করি এবং বলি, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন,
نَعَمْ، عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالاسْتِقَامَةِ، اتَّبِعْ وَلا تَبْتَدِعْ
হ্যাঁ, (দিচ্ছি) তুমি আল্লাহকে ভয় করবে, ইসলামের সকল বিধিবিধান সুদৃঢ়ভাবে পালন করবে। (সুন্নাহ’র) অনুসরণ করবে, বিদআত উদ্ভাবন করবে না।” হাদীসটির সনদ হাসান লি-গাইরিহি।-সুনানে দারিমী, আবু মুহাম্মাদ দারিমি (মৃ.২৫৫ হি.) ১/৫৭, হাদীস ১৩৯
সালাফে সালেহীনের বক্তব্যের আলোকে বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তির ভয়াবহ পরিণতির কিছু দিক
সালাফে সালেহীন তথা খায়রুল কুরুনের ইমাম ও মুজতাহিদগণ বিদআতের বিভিন্ন ক্ষতি ও ভয়াবহতার কথা আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে নিম্নে কিছু তুলে ধরা হলো,
বিদআতী আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়, তার ইবাদত কাজে আসে না
১. বিশিষ্ট তাবেঈ হাসান বসরী রহি.(মৃ. ১১০ হি.) বলেন,
صَاحِبُ الْبِدْعَةِ لَا يَزْدَادُ اجْتِهَادًا, صِيَامًا وَ صَلَاةً , إِلَّا ازْدَادَ مِنَ اللَّهِبُعْدًا
বিদআতী তার নামায, রোযার ক্ষেত্রে যত বেশী পরিশ্রম করবে, তত বেশি সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাবে। বর্ণনাটির সনদ সহীহ।-আলবিদাউ ওয়ান নাহয়ু আনহা, ইবনে ওয়াদ্দাহ আলকুরতুবী (ابن وضّاح القُرْطُبيّ) -মৃ. ২৮৭ হি.- ১/৬২ (৬৬)
১. তাবিঈ আইয়ুব আস সাখতিয়ানী রহ. (মৃ. ১৩১ হি.) বলেন,
” مَا ازْدَادَ صَاحِبُ بِدْعَةٍ اجْتِهَادًا إِلَّا ازْدَادَ مِنَ اللَّهِ بُعْدًا”
বিদআতী (তার নামায, রোযার ক্ষেত্রে) যত বেশী পরিশ্রম করবে, তত বেশি সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাবে। -আলবিদাউ ওয়ান নাহয়ু আনহা, ইবনে ওয়াদ্দাহ আলকুরতুবী (ابن وضّاح القُرْطُبيّ) -মৃ. ২৮৭ হি.- ১/৬২ (৬৭)
বিদআতীর চেহারায় গোমরাহির অন্ধকার থাকে
বিদআতের শিকার লোকদের চেহারায় গোমরাহির অন্ধকার থাকে। যাঁদের জীবন কুরআন-সুন্নায় উদ্ভাসিত, তারা তা বুঝতে পারেন। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. (মৃ. ১৮১ হি.) বলেন,
“صَاحِبُ الْبِدْعَةِ عَلَى وَجْهِهِ الظُّلْمَةُ وَإِنِ ادَّهَنَ كُلَّ يَوْمٍ ثَلَاثِينَ مَرَّةً “
‘বিদআতীর চেহারায় অন্ধকারের ছাপ থাকে। যদিও সে (তার চেহারাকে উজ্জ্বল করার জন্য) প্রতিদিন ত্রিশবার তেল ব্যবহার করে।’ -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ১/৫৯ (২৮৪)
বিদআতীর প্রতি সালাফগণের ঘৃণা প্রকাশ
ক) কুরআন-সুন্নাহ’য় যে সব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সমাধান নেই, সে সব ক্ষেত্রে ফকীহগণ শরঈ উসূলের আলোকে সমাধান দিয়ে থাকেন কিন্তু যারা বিদআতের শিকার, তারা সেটা না করে আপন খেয়াল খুশি মতো নিজের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় অতঃপর সেটাকে শরঈ রূপ দিয়ে মানুষের সামনে প্রকাশ করে। এমন বিদআতির নিন্দা করে ওমর রাযি. (মৃ. ২৩ হি.) বলেন,
إِيَّاكُمْ وَأَصْحَابَ الرَّأْيِ فَإِنَّهُمْ أَعْدَاءَ السُّنَنِ أَعْيَتْهُمُ الْأَحَادِيثُ أَنْ يَحْفَظُوهَا فَقَالُوا بِالرَّأْيِ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا.
‘তোমরা আসহাবে রায় (অর্থাৎ যারা দ্বীনী বিষয়ে নিজের খেয়াল খুশি মতো সিদ্ধান্ত দেয় তাদের) থেকে সাবধান থেকো, তারা সুন্নাহ’র শত্রু, তারা হাদীস মুখস্ত করে সীনায় ধারণ করতে অক্ষম। তাই (হাদীস না জানার কারণে) নিজস্ব মতামত অনুযায়ী (দ্বীনী বিষয়ে) কথা বলে। ফলে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করে। ইবনে কাইয়্যিম আলজাওযী (মৃ. ৭৫১ হি.) বলেন, সনদটি সহীহ।-আস-সুনান,ইমাম দারাকুতনী (মৃ. ৩৮৫ হি.) ৪/১৪৬, হাদীস ৪২৮০; ই’লামুল মুওয়াক কী’ইন আন রব্বিল আলামীন ১/৫৫
খ) বিদআতীকে মজলিস থেকে বের করে দেওয়া।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. (মৃ. ৮৫২ হি.) বলেন,
” وأخرج البيهقي بسندٍ جيدٍ عن عبد الله بن وهب قال: كنا عند مالك، فدخل رجلٌ فقال: يا أبا عبد الله الرحمن،”على العرش استوى”، كيف استوى؟ فأطرق مالك، فأخذته الرحضاء، ثم رفع رأسه فقال:” الرحمن على العرش استوى” كما وصف به نفسه، ولا يقال كيف، وكيف عنه مرفوع، وما أراك الا صاحب بدعة، أخرِجوه”
ইমাম বাইহাকী রহ. সহীহ সনদে আব্দুল্লাহ ইবনে ওহাব থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমরা ইমাম মালেক রহ. এর কাছে ছিলাম, এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি তাঁর নিকট প্রবেশ করে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ! (কুরআনে এসেছে) আল্লাহ আরশের ওপর ‘ইসতাওয়া’ করেছেন। তিনি কীভাবে ‘ইসতাওয়া’ করেছেন? তখন ইমাম মালেক রহ. প্রশ্নের ভয়াবহতায় মাথা নিচু করে ফেললেন। আর তাঁর শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। অতঃপর তিনি মাথা উঠিয়ে বললেন, আল্লাহ আরশের ওপর ‘ইসতাওয়া’ করেছেন যেমন তিনি নিজের ব্যাপারে বলেছেন। (এর ধরণ আমাদের জানা নেই) এখন এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর ‘ইসতিওয়া’ কীভাবে হয়েছে? বা আল্লাহর (এমন কোনো ছিফাতের ব্যাপারে, যা সম্পর্কে শরীয়ত আমাদেরকে কিছু জানায়নি তার) ব্যাপারে এমন প্রশ্ন করা যাবে না যে, কীভাবে তার থেকে কাজটি সম্পন্ন হয়েছে? আর আমার মনে হচ্ছে, তুমি বিদআতী! (এরপর তিনি উপস্থিত লোকদেরকে বললেন) তোমরা তাকে (এখান থেকে) বের করে দাও।’ -ফাতহুল বারি ১৩/৪৬১ (৭৪১৭-৭৪১৮)
গ) বিদআতীর কোনো অনুগ্রহ গ্রহণ না করা। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. (মৃ. ১৮১ হি.) বলতেন,
“اللَّهُمَّ لَا تَجْعَلْ لِصَاحِبِ بِدْعَةٍ عِنْدِي يَدًا فَيُحِبَّهُ قَلْبِي”
হে আল্লাহ! আমার প্রতি যেন কোনো বিদআতীর অনুগ্রহ না থাকে, যার ফলে আমার অন্তরে তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে।’ -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ১/৫৮ (২৭৫)
ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. (মৃ ১৮৭ হি.) বলেন,
” أدركت خيار الناس كلهم أصحاب سنة وينهون عن أصحاب البدع “
‘আমি মানুষদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিদেরকে পেয়েছি, তাঁরা সবাই সুন্নাহ’র অনুসারী ছিলেন। তাঁরা বিদআতীদের (সাথে উঠা-বসা) থেকে নিষেধ করতেন।’ -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ১/১৫৬, হাদীস ২৬৭
বিদআত মানুষের মাঝে যে সকল মন্দ প্রবণতা সৃষ্টি করে
ক) সুন্নাহর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে
একজন বিদআতী যখন তার বিদআতের বিপক্ষে কোনো সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীস শোনে, তখন সে ওই হাদীসের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে। বাকিয়্যাহ রহ. বলেন,
” قَالَ لِيَ الْأَوْزَاعِيُّ: يَا أَبَا مُحَمَّدٍ مَا تَقُولُ فِي قَوْمٍ يُبْغِضُونَ حَدِيثَ نَبِيِّهِمْ؟ قَالَ: قُلْتُ: قَوْمُ سُوءٍ , قَالَ: لَيْسَ مِنْ صَاحِبِ بِدْعَةٍ تُحَدِّثُهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِخِلَافِ بِدْعَتِهِ إِلَّا أَبْغَضَ الْحَدِيثَ”
আমাকে ইমাম আওযায়ী রহ. (মৃ. ১৫৭ হি.) বলেছেন, ‘হে আবু মুহাম্মাদ! ওই লোকদের ব্যাপারে তোমার কি অভিমত, যারা তাদের নবীর হাদীসের প্রতি বিদ্বেষ রাখে? আমি বললাম, তারা খুব খারাপ লোক। তিনি বললেন, তুমি কোনো বিদআতীর কাছে তার বিদআতের খেলাফ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কোনো হাদীস বর্ণনা করলে নিশ্চিত সে ওই হাদীসের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।’ -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ৩/৪৭৭ (৭৩২)
খ) সুন্নাতের চেয়ে বিদআতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা তৈরি করে
একজন বিদআতীর অবস্থা এমন হয় যে, যদি তার কোন সুন্নাহ ছুটে যায় তাহলে সে ততটা পেরেশান হয় না। কিন্তু কোনো বিদআত ছুটে গেলে সে অস্থির হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) তাঁর সামনে উপস্থিত লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا لَبِسَتْكُمْ فِتْنَةٌ يَهْرَمُ فِيهَا الْكَبِيرُ، وَيَرْبُو فِيهَا الصَّغِيرُ، وَيَتَّخِذُهَا النَّاسُ سُنَّةً، فَإِذَا غُيِّرَتْ قَالُوا: غُيِّرَتِ السُّنَّةُ “. قَالُوا: وَمَتَى ذَلِكَ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ؟ قَالَ: إِذَا كَثُرَتْ قُرَّاؤُكُمْ، وَقَلَّتْ فُقَهَاؤُكُمْ، وَكَثُرَتْ أُمَرَاؤُكُمْ، وَقَلَّتْ أُمَنَاؤُكُمْ، وَالْتُمِسَتِ الدُّنْيَا بِعَمَلِ الْآخِرَةِ
ওই সময় তোমাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে যখন এমন দীর্ঘস্থায়ী ফেতনা বা বিপর্যয় তোমাদের গ্রাস করবে যে, বয়স্ক লোক এ বিপর্যয়ের মধ্যে বয়োবৃদ্ধে পরিণত হবে, ছোটরা বয়স্কে পরিণত হবে। মানুষ (বিদআতকে) সুন্নাহ হিসেবে গ্রহণ করবে। যখন কোনো বিদআতে পরিবর্তন করা হবে বা বিদআত ছুটে যাবে তখন সে বলবে, সুন্নাহ’র মধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে বা সুন্নাহ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.)এর শাগরিদরা বললেন, এমন ফেতনা কখন আসবে? তিনি বললেন, যখন তোমাদের মাঝে ক্বারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে অথচ প্রাজ্ঞ ফকীহের সংখ্যা হ্রাস পাবে। আমির ও নেতার সংখ্যা বেড়ে যাবে, অথচ আমানতদার লোকের সংখ্যা কমে যাবে। যখন আখিরাতের আমল দিয়ে দুনিয়া তালাশ করা হবে।-হাকিম রহ. বলেন, এই হাদীসের সকল বর্ণনাকারী ছেক্বাহ। হাফেয যাহাবিও অনুরূপ বলেছেন। -আলমুসতাদরাক ৪/৫৬০, হাদীস ৮৫৭০; সুনানে দারেমী ১/৬৮, হাদীস ১৮৯
গ) বিদআত মানুষকে সুন্নাহ থেকে বঞ্চিত রাখে
১. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি) বলেন,
مَا أَتَى عَلَى النَّاسِ عَامٌ إِلاَّ أَحْدَثُوْا فِيْهِ بِدْعَةً وَأَمَاتُوا فِيْهِ سُنَّةً، حَتَّى تَحْيَا الْبِدَعُ وَتَمُوْتَ السُّنَنُ
প্রতি বৎসরই মানুষ কিছু বিদআত উদ্ভাবন করতে থাকবে এবং সুন্নাহ মিটিয়ে ফেলতে থাকবে, এক পর্যায়ে শুধু বিদআতই থাকবে, সুন্নাহ একদম বিলীন হয়ে যাবে।” হাইসামী রহ. বলেন, হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য।-আলমুজামুল কাবীর, তবরানী ১০/২৬২, হাদীস ১০৬১০; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাইসামী ১/১৮৮; আলবিদাউ, ইবনু ওয়াদ্দাহ ১/২৩
২. তাবিঈ হাসসান বিন আতিয়্যা রহ. (মৃ. ১২০ হি.) বলেন,
مَا ابْتَدَعَ قَوْمٌ بِدْعَةً فِي دِينِهِمْ إِلَّا نَزَعَ اللَّهُ مِنْ سُنَّتِهِمْ مِثْلَهَا ثُمَّ لَا يُعِيدُهَا إِلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
যখনই কোনো সম্প্রদায় দ্বীনের মধ্যে কোনো বিদআত সৃষ্টি করেছে, তখনই আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্য হতে সে পরিমাণ সুন্নাহ উঠিয়ে নিয়েছেন। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত তা আর তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। বর্ণনাটি সহীহ। -সুনানে দারেমী, দারেমী (মৃ. ২৫৫ হি.) ১/৪৯, হাদীস ৯৮
ঘ) বিদআত মানুষকে তাওবাহ থেকে বঞ্চিত রাখে
বিশিষ্ট তাবে তাবিঈ সুফিয়ান সাওরী রহ. (মৃ. ১৬১ হি.) বলেন,
البدعة أحب إلى إبليس من المعصية، المعصية يتاب منها، والبدعة لا يتاب منها
ইবলিসের কাছে গুনাহের চেয়ে বিদআত বেশি প্রিয়। কারণ, গুনাহ থেকে তাওবা করার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বিদআত থেকে তাওবা করার সম্ভাবনা থাকে না। বর্ণনাটির সনদ নির্ভরযোগ্য বা কমপক্ষে হাসান পর্যায়ের। মুসনাদে ইবনুল জাদ, ইবনুল জাদ (ابن الجعد) মৃ. ২৩০ হি. ১/২৭২, হাদীস ১৮০৯
বিদআতীর সাথে উঠা-বসা করার কিছু ক্ষতিকর দিক
ক) অন্তর থেকে ইসলামের নূর বের করে দেয়
ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. (মৃ ১৮৭ হি.) বলেন,
” لَا تَجْلِسْ مَعَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ أَحْبَطَ اللَّهُ عَمَلَهُ، وَأَخْرَجَ نُورَ الْإِسْلَامِ مِنْ قَلْبِه”
‘তুমি কোনো বিদআতীর সাথে বসবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা তার আমলকে নিষ্ফল করে দিয়েছেন এবং তার অন্তর থেকে ইসলামের নূর বের করে দিয়েছেন।’-শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ১/১৫৫ (২৬৩)
খ) হক্ব দেখা থেকে অন্ধ করে দেয়
ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. (মৃ. ১৮৭ হি.) বলেন,
“صَاحِبُ الْبِدْعَةِ لَا تَأْمَنْهُ عَلَى دِينِكَ، وَلَا تُشَاوِرْهُ فِي أَمْرِكَ، وَلَا تَجْلِسْ إِلَيْهِ، فَمَنْ جَلَسَ إِلَى صَاحِبِ بِدْعَةٍ وَرَّثَهُ اللَّهُ الْعَمَى “
কোনো বিদআতীকে তোমার দ্বীনের ক্ষেত্রে নিরাপদ মনে করো না, তোমার কোনো বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করো না এবং তার সাথে ওঠা-বসা করবে না। যে ব্যক্তি কোনো বিদআতীর কাছে বসল, আল্লাহ তাকে (দ্বীনের ক্ষেত্রে) অন্ধ করে দিবেন।’ -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (৪১৮হি.) ১/৫৬ (২৬৪)
গ) অন্তরে ব্যাধি সৃষ্টি করে
বিশিষ্ট তাবেঈ হাসান বসরী রহি.(মৃ. ১১০ হি.) বলেন,
لَا تُجَالِسْ صَاحِبَ بِدْعَةٍ؛ فَإِنَّهُ يُمْرِضُ قَلْبَكَ
তুমি কোনো বিদআতির সাথে ওঠা-বসা করবে না। অন্যথায় সে তোমার অন্তরে ব্যাধি সৃষ্টি করবে।’ -আলবিদাউ ওয়ান নাহয়ু আনহা, ইবনে ওয়াদ্দাহ আলকুরতুবী (ابن وضّاح القُرْطُبيّ) -মৃ. ২৮৭ হি.- ২/৯৫ (১১৫)
ঘ) আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনী-সুরক্ষা উঠিয়ে নেয়া হয়
মুহাম্মাদ ইবনে নদর আল হারিসী (মৃ. ১৭১-১৮০ হি.) বলেন,
مَنْ أَصْغَى سَمْعَهُ إِلَى صَاحِبِ بِدْعَةٍ، وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ صَاحِبُ بِدْعَةٍ، نُزِعَتْ مِنْهُ الْعِصْمَةُ، وَوُكِلَ إِلَى نَفْسِهِ
‘যে ব্যক্তি কোনো বিদআতীর কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করল। অথচ সে জানে যে, উক্ত ব্যক্তি বিদআতী তাহলে তার থেকে দ্বীনী-সুরক্ষা উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তাকে তার নিজের দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হয়।’ -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতিওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ১/৫৩ (২৫২)
ঙ) হক্বের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে
ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. (মৃ. ১৮৭ হি.) বলেন,
مَنْ أَتَاهُ رَجُلٌ فَشَاوَرَهُ فَدَلَّهُ عَلَى مُبْتَدَعٍ فَقَدْ غَشَّ الْإِسْلَامَ، وَاحْذَرُوا الدُّخُولَ عَلَى صَاحِبِ الْبِدَعِ؛ فَإِنَّهُمْ يَصُدُّونَ عَنِ الْحَقِّ
কারো কাছে কেউ পরামর্শ চাইতে এল আর সে তাকে কোনো বিদআতির কাছে যেতে বলল তাহলে সে ইসলামের সাথে প্রতারণা করল। কাজেই তোমরা কোনো বিদআতীর কাছে যাওয়ার ব্যাপারে সাবধান থেকো। কারণ তারা (মানুষকে) সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।’-শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ১/১৫৫ (২৬১)
চ) দ্বীনী ও দুনিয়াবি বিষয়ে শারীরিক-মানুষিক কষ্ট দিবে
তাবেঈ মুসআব ইবনে সাদ (মৃ. ১০৩ হি.) বলেন,
” لَا تُجَالِسْ مَفْتُونًا فَإِنَّهُ لَنْ يُخْطِئَكَ مِنْهُ إِحْدَى خَصْلَتَيْنِ: إِمَّا أَنْ يَفْتِنَكَ فَتُتَابِعَهُ، أَوْ يُؤْذِيَكَ قَبْلَ أَنْ تُفَارِقَهُ “
‘তুমি বিভ্রান্তি বা ফেতনার শিকার কোনো ব্যক্তির সাথে ওঠাবসা করবে না। কারণ, এতে তুমি অবশ্যই দুটি দোষের যে কোনো একটি দোষের শিকার হবে। হয়ত সে তোমাকে (বিদআত ও গোমরাহির) ফেতনায় ফেলবে ফলে তুমি তার অনুসরণ করে বসবে অথবা তার থেকে (পরিপূর্ণভাবে) বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই সে তোমার ক্ষতি করে ফেলবে।’ -শুআবুল ঈমান ৭/৬১ (৯৪৬৫) (শামেলা)
ছ) দ্বীনের বিষয়ে সন্দেহে নিপতিত করে
তাবিঈ আবু কিলাবা (রাযি.) (মৃ. ১০৪ হি.) বলেন,
“لَا تُجَالِسُوا أَهْلَ الْأَهْوَاءِ وَلَا تُجَادِلُوهُمْ فَإِنِّي لَا آمَنُ أَنْ يَغْمِسُوكُمْ فِي ضَلَالَتِهِمْ أَوْ يَلْبِسُوا عَلَيْكُمْ بَعْضَ مَا تَعْرِفُونَ”
তোমরা প্রবৃত্তি-পুজারীদের সাথে উঠাবসা করবে না এবং তাদের সাথে বিতর্কে জড়াবে না। কেননা, আমি আশঙ্কামুক্ত নই যে, তারা তাদের গোমরাহির মধ্যে তোমাদেরকে নিমজ্জিত করবে অথবা (দ্বীনের সঠিক) যে বিষয়গুলো তোমরা জানো, তার কিছু বিষয়ে তোমাদেরকে সন্দেহযুক্ত করে দেবে। -বর্ণনাটি সহীহ। সুনানে দারেমি ১/১১৪ (৩৯৭)
জ) বেদআতীর সাথে উঠাবসা করা নিফাকের আলামত
ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. (মৃ ১৮৭ হি.) বলেন,
” إِنَّ لِلَّهِ مَلَائِكَةً يَطْلُبُونَ حِلَقَ الذِّكْرِ، فَانْظُرْ مَعَ مَنْ يَكُونُ مَجْلِسُكَ، لَا يَكُونُ مَعَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ، فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ،وَعَلَامَةُ النِّفَاقِ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ وَيَقْعُدَ مَعَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ “
আল্লাহ তাআলার একদল ফিরিশতা আছে, যারা যিকিরের মজলিস তালাশ করে। সুতরাং তুমি লক্ষ রাখ; কারা তোমার মজলিসে বসে। (তোমার মজলিস যেন) কোনো বেদআতীর সাথে না হয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা তাদের দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকান না। আর (মনে রেখো) বেদআতীর সাথে উঠা-বসা করা নিফাকের আলামত।’ -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ১/১৫৬ (২৬৫)
বেদআতীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা
বেদআতী থেকে দূরে থাকার বিষয়ে কুরআনের কঠোর নির্দেশ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا فَرِيقًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা যদি কিতাবীদের একটি দলের (অর্থাৎ ইহুদিদের) কথা মেনে নাও, তবে তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর পুনরায় কাফির বানিয়ে ছাড়বে।’ -সূরা আলে-ইমরান (৩) : ১০০
সম্ভবত এই সকল শ্রেণির মানুষদের সাথে বসার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মূল হলো আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ ﴾
তিনি কিতাবে তোমাদের প্রতি এই নির্দেশ নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে যে, আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করা হচ্ছে ও এর প্রতি বিদ্রূপ করা হচ্ছে, তখন তাদের সাথে বসবে না, যে পর্যন্ত না তারা অন্য কোনো প্রসঙ্গে লিপ্ত হবে। অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হয়ে যাবে।’ -সূরা নিসা (৪) : ১৪০
ইমাম ইবনে জারীর তবারী রহ. (মৃ. ৩১০ হি.) বলেন,
“وفي هذه الآية الدلالة الواضحة على النهي عن مجالسة أهل الباطل من كل نوع من المبتدعة والفسقة عند خوضهم في باطلهم”
সকল প্রকার বিদআতী ও ফাসিক শ্রেণির লোকদের সাথে ওঠা-বসা করা নিষেধ, যখন তারা বাতিল বিষয়ে প্রবৃত্ত হবে। উক্ত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এই আয়াত স্পষ্ট দলিল।’ -তাফসীরে তবারী ৪/২২১
যারা মুমিন ও সত্যপন্থীদের পথ বাদ দিয়ে গোমরাহ লোকদের পথ অবলম্বন করবে, তাদেরকে কঠিনভাবে সতর্ক করে আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا ﴾
আর যে ব্যক্তি তার সামনে হেদায়েত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করবে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ অনুসরণ করবে, আমি তাকে সেই পথেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা অতি মন্দ ঠিকানা।’ -সূরা নিসা (৪) : ১১৫
কীভাবে মানুষের মাঝে বিদআত প্রবণতা সৃষ্টি হয়?
যখন কোনো ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহ’র বিশুদ্ধ ইলম থেকে বঞ্চিত থাকে অথবা কুরআন-সুন্নাহর কিছু জ্ঞান থাকে কিন্তু অন্তরে বক্রতা থাকে, তখনই তার মাঝে বিদআত-প্রবণতা দেখা দেয়। আরও একটি বিষয় কোন ব্যক্তিকে বেদআতের প্রতি আকৃষ্ট করে। তা হল, মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জযবা। নিম্নে এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা হল-
ক) কুরআন-সুন্নাহ’র বিশুদ্ধ ইলম থেকে বঞ্চিত থাকলে
যখন কোন ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহ’র বিশুদ্ধ ইলম থেকে বঞ্চিত থাকবে, তখনই সে বিদআতের সহজ শিকার হবে।
১. ইবনে মাসঊদ রাযি (মৃ. ৩২ হি.) বলেন,
” عَلَيْكُمْ بِالْعِلْمِ قَبْلَ أَنْ يُقْبَضَ، وَقَبْضُهُ أَنْ يَذْهَبَ بِأَصْحَابِهِ، عَلَيْكُمْ بِالْعِلْمِ فَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَا يَدْرِي مَتَى يَفْتَقِرُ أَوْ يُفْتَقَرُ إِلَى مَا عِنْدَهُ، وَإِنَّكُمْ سَتَجِدُونَ أَقْوَامًا يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ يَدْعُونَكُمْ إِلَى كِتَابِ اللَّهِ، وَقَدْ نَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ فَعَلَيْكُمْ بِالْعِلْمِ وَإِيَّاكُمْ وَالتَّبَدُّعَ وَإِيَّاكُمْ وَالتَّنَطُّعَ وَإِيَّاكُمْ وَالتَّعَمُّقَ وَعَلَيْكُمْ بِالْعَتِيقِ “
ইলম উঠিয়ে নেওয়ার পূর্বেই তা শিক্ষা করে নাও। ইলম উঠিয়ে নেওয়ার অর্থ হলো, ইলমের ধারক-বাহকগণ দুনিয়া থেকে চলে যাওয়া। তোমরা ইলম শিক্ষা করে নাও। কারণ, কেউ জানে না, কখন তার নিজের সে ইলমের দরকার পড়বে অথবা অন্য কারো দরকার পড়বে (তখন সে তাকে সহযোগিতা করতে পারবে)। নিশ্চয় তোমরা সত্বর এমন লোকদেরকে পাবে, যারা তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাবের দিকে ডাকার দাবি করবে, অথচ তারা আল্লাহর কিতাব পিছনে ছুড়ে মেরেছে (আল্লাহর কিতাবের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই)। সুতরাং (গোমরাহি থেকে বাঁচার জন্য সঠিকভাবে) ইলম শিক্ষা কর। আর খবরদার! কখনো বেদআতে লিপ্ত হবে না। খবরদার! বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হবে না। খবরদার! (শরীয়তের সীমানা লঙ্ঘন করে) গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করবে না। বরং (আল্লাহর যাত ও সিফাতের ক্ষেত্রে) পুরোনো পথ (অর্থাৎ সাহাবাগণের পথ ও পন্থাকে) আঁকড়ে ধরে থাকবে।” বর্ণনাটি ইবনে মাসঊদ (রাযি) থেকে রেওয়ায়াত করেন বিশিষ্ট তাবিঈ আবু কিলাবাহ রহ. (মৃ. ১০৪ হি.)। আবু কিলাবাহ রহ. পর্যন্ত সনদ সহীহ। তিনি ইবনে মাসঊদ (রাযি) থেকে মুরসাল বর্ণনা করেন।-আস সুন্নাহ, মুহাম্মাদ বিন নসর আলমারওয়াযি (মৃ. ২৯৪ হি.) ১/২৯, হাদীস ৮৫
২. সাঈদ ইবনে মানসুর (মৃ. ২২৭ হি.) বলেন,
عن إبراهيم التيمي قال:خَلَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، ذَاتَ يَومٍ يُحَدِّثُ نَفْسَهُ، فأَرْسَلَ إِلَى ابْنِ عَبَّاسٍ، فَقَالَ: كَيْفَ تَخْتَلِفُ هَذِهِ الْأُمَّةُ وَنبِيُّهَا وَاحِدٌ، وَكِتَابُهَا وَاحِدٌ وَقِبْلَتُهَا؟ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ، ” إِنَّا أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْقُرْآنُ، فَقَرَأْنَاهُ وَعَلِمْنَا فِيمَ أُنْزِلَ، وَإِنَّهُ سَيَكُونُ بَعْدَنَا أَقْوَامٌ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ، وَلَا يَعْرِفُونَ فِيمَ نُزِّلَ، فَيَكُونُ لِكُلِّ قَوْمٍ فِيهِ رَأْيٌ، فَإِذَا كَانَ لِكُلِّ قَوْمٍ فِيهِ رَأْيٌ اخْتَلَفُوا، فَإِذَا اخْتَلَفُوا اقْتَتَلُوا، فَزَبَرَهُ عُمَرُ وَانْتَهَرهُ، فَانْصَرَفَ ابْنُ عَبَّاسٍ، ثُمَّ دَعَاهُ بَعْدُ فَعَرَفَ الَّذِي قَالَ، ثُمَّ قَالَ: إِيهِ أَعِدْ عَلَيَّ
ইবরাহীম আত তাইমি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর ইবনে খাত্তাব (রাযি.) একদিন মনে মনে কোনো একটি বিষয় নিয়ে ভাবছিলেন। তখন তিনি ইবনে আব্বাস (রাযি.)-কে ডেকে পাঠান। (তিনি এলে তাঁকে) বললেন, এ উম্মত কীভাবে মতবিরোধে লিপ্ত হবে! অথচ তাদের নবী এক, কিতাব এক, কিবলা এক? ইবনে আব্বাস (রাযি.) বললেন: ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আমাদের ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, আমরা তার তিলাওয়াত করেছি এবং তা কোন প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে তা জেনেছি। অচিরেই আমাদের পরে এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা কুরআন তিলাওয়াত করবে কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে তা জানবে না। আর এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সম্প্রদায়েরই নিজস্ব অভিমত থাকবে। যখন প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব অভিমত থাকবে তখন তারা মতবিরোধে লিপ্ত হবে। আর যখন মতোবিরোধ দেখা যাবে তখন পরস্পর হানাহানি শুরু হবে।’ তার কথা শুনে ওমর (রাযি.) তাকে (একটু) ধমক দেন এবং তিরষ্কার করেন। অতঃপর ইবনে আব্বাস (রাযি.) সেখান থেকে চলে যায়। পরে ওমর (রাযি.) ইবনে আব্বাস (রাযি.)-কে আবার ডাকেন। এরই মধ্যে তিনি ইবনে আব্বাস (রাযি.)-র কথাটি বুঝতে পারেন। (তিনি এলে) বললেন, তোমার কথাটা আবার বলো তো। -সুনানে সাঈদ ইবনে মানসূর ১/১৭৬, হাদীস ৪২, (হাদীসটি সহীহ লি গায়রিহি) তাহকীক- ড. সাআদ বিন আব্দুল্লাহ আলে হুমায়দ। উক্ত তাহকীককৃত নুসখার টীকায় হাদীসটির হুকুম সম্পর্কে সুন্দরভাবে সবিস্তারে আলোচনা রয়েছে।
উক্ত বর্ণনায় ইবনে আব্বাস রাযি (অল্প বয়সের একজন বালক হয়ে) এত বড় একটা কথা বলেছেন, তাই ওমর (রাযি.) তাঁকে ধমক দিয়েছেন। এখানে ইবনে আব্বাস (রাযি.) এর কথাকে অস্বীকৃতি জানানো হয়নি। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইবনে আব্বাস যা বলেছিলেন তাই বাস্তব। ইবনে আব্বাস (রাযি.) যে আশংকার কথা বলেছিলেন, সেটাই তো এখন আমরা স্বচক্ষে দেখছি।
খ) অন্তরে বক্রতা থাকলে
কেউ কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে কিছু জানে কিন্তু কুরআন-সুন্নাহ’র নূর থেকে বঞ্চিত। অন্তরে বক্রতা রয়েছে। তাহলে এই বক্র-অন্তর তাকে বিদআত সৃষ্টির প্রতি উসকে দেয়। আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে বলেন,
﴿ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ﴾
যাদের অন্তরে বক্রতা আছে, তারা সেই মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের পেছনে পড়ে থাকে, উদ্দেশ্য ফিতনা সৃষ্টি করা এবং সেসব আয়াতের তাবীল-ব্যাখ্যা খোঁজা।’ -সূরা আলে-ইমরান (৩) : ৭
উক্ত আয়াতে الزيغ শব্দটি হলো (দ্বীনী বিষয়ে বিভিন্ন) সন্দেহের রোগ, যা প্রবৃত্তি-পূজারী লোকদের অন্তরে শয়তান ঢেলে দেয়।
গ) নিজের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার প্রবণতা থাকলে
এ বিষয়টিও মানুষকে বিদআতের প্রতি আকর্ষণ করে। মুয়ায ইবনে জাবাল (রাযি.) বলেছেন,
إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ فِتَنًا يَكْثُرُ فِيهَا الْمَالُ وَيُفْتَحُ فِيهَا الْقُرْآنُ حَتَّى يَأْخُذَهُ الْمُؤْمِنُ وَالْمُنَافِقُ وَالرَّجُلُ وَالْمَرْأَةُ وَالصَّغِيرُ وَالْكَبِيرُ وَالْعَبْدُ وَالْحُرُّ، فَيُوشِكُ قَائِلٌ أَنْ يَقُولَ: مَا لِلنَّاسِ لا يَتَّبِعُونِي وَقَدْ قَرَأْتُ الْقُرْآنَ، مَا هُمْ بِمُتَّبِعِيَّ حَتَّى أَبْتَدِعَ لَهُمْ غَيْرَهُ، فَإِيَّاكُمْ وَمَا ابْتُدِعَ! فَإِنَّ مَا ابْتُدِعَ ضَلالَةٌ.
তোমাদের সামনে অনেক ফিতনা আসছে, যখন মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এবং কুরআন শিক্ষার পথ খুলে যাবে। মুমিন-মুনাফিক, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, মনিব-চাকর সবাই কুরআন শিখবে। তখন হয়ত কোনো ব্যক্তি বলবে, মানুষের কী হলো, আমি কুরআন শিক্ষা করলাম (কুরআন নিয়ে গবেষণা করলাম!) অথচ তারা আমার অনুসরণ করছে না? কুরআন ছাড়া কোনো নতুন মত বা কাজ উদ্ভাবন না করলে মানুষেরা আমার অনুসরণ করবে না। (অর্থাৎ আমি এত শিক্ষা অর্জন করলাম কিন্তু আমার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। আমার অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে না। কাজেই, মানুষের মধ্যে আমার সঠিক মূল্যায়নের উপায় হলো, নতুন কোনো মতামত বা পদ্ধতি উদ্ভাবন করা) খবরদার! তোমরা বিদআতের কাছেও যাবে না। নিঃসন্দেহে যা কিছু বিদআত তা-ই পথভ্রষ্টতা ।” হাকেম রহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। -সুনানে আবু দাউদ ২/৬৩২-৬৩৩, হাদীস ৪৬১১; মুসতাদরাকে হাকেম ৪/৫১৩, হাদীস ৮৪৪০
বিদআত প্রতিরোধ না করার পরিণতি
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿واتقوا فتنةً لا تصيبن الذين ظلموا منكم خاصة واعلموا أن الله شديد العقاب ﴾
এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় করো, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখো, আল্লাহর আযাব সুকঠিন।’ -সূরা আনফাল (৮) : ২৫
আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন,
” أمر الله المؤمنين أن لا يُقروا المنكر بين ظهرانيهم فيعمهم الله بالعذاب “
আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে আদেশ করেছেন, তারা যেন তাদের সামনে ঘটা কোনো খারাপ কাজের স্বীকৃতি না দেয়। তাহলে আল্লাহ তাআলা অপরাধীদের সাথে তাদেরকেও আযাব দ্বারা ঘিরে ফেলবেন।
ইবনে কাসীর রহ. (মৃ. ৭৭৪ হি.) বলেন,
وهذا تفسيرٌ حسنٌ جداً”
এটি (আয়াতের) বেশ চমৎকার একটি তাফসীর।’ -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৪০
সাহাবা ও তাবেঈন বিদআতকে একদম প্রশ্রয় দিতেন না
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন; সবাই যে সব নীতির ব্যাপারে এক ছিলেন তার একটি হলো, বিদআতকে প্রশ্রয় না দেওয়া। তাঁরা সুন্নতের ওপর আমল করতেন, সুন্নাহ’র দাওয়াত দিতেন। পাশাপাশি বিদআত থেকে বেঁচে থাকতেন। বিদআতের খারাবী বর্ণনা করতেন। তাঁদের উপরিউক্ত সচেতনতার কারণে তাদের যুগ ছিল খাইরুল কুরূন। পরবর্তী সময়ে উম্মতের এ ব্যাপারে সচেতনতা হ্রাস পাওয়ার কারণে শিরক ও বিদআত ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সাহচর্যের ফলে শিরক ও বিদআত সম্পর্কে সাহাবীগণ অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তাওয়াফের সময় হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করতে হয়। এটি শরীয়তের হুকুম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে চুম্বন করেছেন। কিন্তু এর মধ্যে তো ভালো-মন্দের কোনো ক্ষমতা নেই। শরীয়তের বিধান হিসেবেই চুম্বন করা হয়। কেউ যেন এখান থেকে কোনো ভুল ধারণায় পড়ে না যায়, এজন্য হযরত ওমর (রাযি.) সতর্ক করেছেন। আবেস ইবনে রাবীআ রাহ. ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.) সম্পর্কে বলেন,
“أنه جاء إلى الحجر الأسود فقبله فقال إني أعلم أنك حجر لا تضر ولا تنفع ولولا أني رأيت النبي صلى الله عليه و سلم يقبلك ما قبلتك”
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) হজরে আসওয়াদের নিকট এসে তা চুম্বন করলেন। এরপর তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি নিশ্চিত ভাবে জানি, তুমি একটি পাথর মাত্র। তোমার মধ্যে না কোনো উপকার করার ক্ষমতা আছে, আর না কোনো অপকার করার। আমি যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে কষ্মিনকালেও তোমাকে চুম্বন করতাম না। -বুখারী১/২১৭, হাদীস ১৫৭৩; মুসলিম১/৪১২,হাদীস ১২৭০
এখানে তিনি স্পষ্ট করে দিলেন, ইট, পাথর, সেটি যদি হজরে আসওয়াদও হয় তবুও তার মধ্যে নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। হ্যাঁ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই পাথরটি চুম্বন করেছেন বিধায় সেটিকে চুম্বন করা সুন্নত। এ জন্য আমাদেরকেও তাই করতে হয়।
বিদআত মুলোৎপাটনের বিষয়ে ওমর (রাযি.) এর আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাবিঈ নাফে রাহ. বলেন,
كان الناس يأتون الشجرة التي يقال لها شجرة الرضوان فيصلون عندها قال فبلغ ذلك عمر بن الخطاب فأوعدهم فيها وأمر بها فقطع
লোকেজন একটি গাছটির কাছে আসা যাওয়া করত, গাছটিকে ‘শাজারাতুর রিদওয়ান’ বলা হতো। সেখানে তারা (বরকত লাভের উদ্দেশ্যে) নামাজ আদায় করতো। বিষয়টি ওমর (রাযি.) এর নিকট পৌঁছলে তিনি এর জন্য লোকজনকে ধমকি দেন এবং গাছটি কেটে ফেলার নির্দেশ দেন।-আত তবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাআদ ১/৪১৬; ফাতহুল বারি ৭/৫১৪ (৪১৬৫ নং হাদীসের অন্তর্গত। হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ।)
কোথাও বিদআত হতে থাকলে সাহাবায়ে কেরাম সেখানে উপস্থিত থাকতেন না। যেন তাদের উপস্থিতিকে অন্যরা দলিল হিসাবে পেশ করার সুযোগ না পায়। তাবিঈ মুজাহিদ রাহ. বলেন,
كنتُ مع ابن عمرَ فثوّبَ رجل في الظهرِ أو العَصرِ، قال: اخرُجْ بنا فإنّ هذه بِدْعَة
আমি ইবনে ওমর (রাযি.)-এর সঙ্গে এক মসজিদে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি যোহর, কিংবা আছর নামাযের জন্য (আযানের পর আবার) ডাকাডাকি করছিল। তখন তিনি (আমাদেরকে) বললেন, আমাদেরকে (এই মসজিদ থেকে অন্য কোথাও) নিয়ে চল। এখানে বিদআত হচ্ছে। -সুনানে আবু দাউদ হাদীস ১/৭৯, হাদীস ৫৩৮, তাহকীক- শায়খ শুআাইব আলআরনাউত। (হাদীসটি হাসান)
বিদআতী ও গোমরাহ ব্যক্তিদের প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
বিদআতী ও গোমরাহদের প্রতিরোধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাযি.) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا مِنْ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللَّهُ فِي أُمَّةٍ قَبْلِي إِلا كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لا يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لا يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنْ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ
আমার পূর্বে যে উম্মতের মধ্যেই আল্লাহ কোনো নবী পাঠিয়েছেন ওই উম্মাতের মধ্যে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও সাহাবী অবশ্যই থাকত। তাঁরা তাঁর সুন্নাহ আঁকড়ে ধরত, তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করত। তাদের পরে এমন একদল উত্তরসূরির আবির্ভাব ঘটে, যারা যা বলে তা করে না এবং যা তাদের করতে নির্দেশ দেওয়া হয়নি, তা তারা করে। (এমন লোক আমার উম্মতের মধ্যেও আসবে) কাজেই যে ব্যক্তি তাদের সাথে হাত দিয়ে জিহাদ করবে সে মুমিন। যে মুখ দিয়ে জিহাদ করবে সেও মুমিন। যে অন্তর দিয়ে জিহাদ করবে (অর্থাৎ অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে পাশাপাশি মুখ ও হাত দিয়ে কীভাবে জিহাদ করতে পারে সেই পরিকল্পনাও করতে থাকবে) সেও মুমিন। এর পরে সরিষা পরিমাণ ঈমানও অবশিষ্ট থাকে না।” -সহীহ মুসলিম ১/৫২, হাদীস ৫০,৮০
আলী এবং ইবনে মাসঊদ (রাযি.) থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يَأْتِي فِي آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ حُدَثَاءُ (أَحْدَاثُ) الأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الأَحْلامِ يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ (يَتَكَلَّمُوْنَ بِالْحَقِّ) (يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ) يَمْرُقُونَ مِنْ الإِسْلامِ (مِنَ الْحَقِّ) كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ لا يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ فَأَيْنَمَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ فَإِنَّ قَتْلَهُمْ أَجْرٌ لِمَنْ قَتَلَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
শেষ যুগে এমন একটি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যারা বয়সে হবে তরুণ, জ্ঞান-বুদ্ধিতে হবে অপরিপক্ক। তারা সর্বোত্তম কথা বলবে। সত্য ও ন্যয়ের কথা বলবে। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা ইসলাম থেকে (সত্য ও ন্যায় থেকে) ঠিক সেভাবে ছিটকে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে তীর শিকারের দেহ ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করবে; কারণ তাদেরকে যারা হত্যা করবে তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পুরস্কার রয়েছে। -সহীহ বুখারী ১/৫১০,হাদীস ৩৪৮৪; সহীহ মুসলিম ১/৩৪২, হাদীস ১০৬৬; সুনানে তিরমিযী ২/৪২, হাদীস ২১৮৮; আস-সুনানুল কুবরা, নাসাঈ ৫/১৬১-১৬২
শয়তানী কৌশল এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায়
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.)বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطَبَ النَّاسَ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ، فَقَالَ: قَدْ يَئِسَ الشَّيْطَانُ بِأَنْ يُعْبَدَ بِأَرْضِكُمْ وَلَكِنَّهُ رَضِيَ أَنْ يُطَاعَ فِيمَا سِوَى ذَلِكَ مِمَّا تُحَاقِرُونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ، فَاحْذَرُوا يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي قَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوا أَبَدًا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন, শয়তান তোমাদের ভূখণ্ডে মূর্তিপূজা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হয়ে গিয়েছে। তবে সে আশাবাদী যে, তোমরা মূর্তিপূজা ছাড়া অন্যান্য এমন এমন কাজে তার আনুগত্য করবে যেগুলিকে তোমরা সামান্য বিষয় বলে জ্ঞান করবে। হে লোক সকল! কাজেই সাবধান! (সামান্য দেখিয়ে সে যেন তোমাদেরকে বিদআতের অনুসরণ করাতে না পারে) আমি তোমাদের জন্য এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা সে জিনিস দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ তাহলে কখনো গোমরাহ হবে না। তা হলো, আল্লাহ তাআলার কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত। -আলমুসতাদরাক ১/১৭১, হাদীস ৩১৮; আততারগীব ওয়াত তারহীব, মুনযিরী, হাদীস ৩৬ (হাকিম রহ. বলেন, এই হাদীসের সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। হাফেয যাহাবিও অনুরূপ বলেছেন।)
তৃতীয় অধ্যায়
বিদআত চিহ্নিতকরণের মূলনীতি
বিদআত চিহ্নিতকরণের মূলনীতি জানা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যা একজন মুমিনকে বিদআত কেন্দ্রিক বিভিন্ন জটিলতা ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে। আলোচনা কিছুটা দীর্ঘ হওয়ায় পঠকের সুবিধার্থে এখানে প্রথমে শিরোনামগুলো উল্লেখ করা হবে। এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি শিরোনাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ। প্রত্যেকটি শিরোনামের অধীনে শাখা শিরোনামও থাকবে।
আলোচনার শিরোনাম
প্রথম মূলনীতি: যে সকল কাজের মাধ্যমে ইবাদতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবড়ি করা হয়।
দ্বিতীয় মূলনীতি: শরীয়ত অনুমোদিত কোনো ইবাদতের সাথে নিজের পক্ষ থেকে সংযোজন করা।
তৃতীয় মূলনীতি: বিদআত কখনো কোনো কাজ করার মাধ্যমে হয়, আবার কখনো কোনো কাজ ছাড়ার মাধ্যমে হয়।
চতুর্থ মূলনীতি: নববী যুগে প্রয়োজনীয় উপলক্ষ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ে কোনো বিধান না দেওয়া।
পঞ্চম মূলনীতি: শরীয়ত একটি বিষয়কে একটি বিশেষ স্থানের জন্য নির্ধারণ করেছে। সেটিকে ভিন্নস্থানে ব্যবহার করা।
ষষ্ঠ মূলনীতি: শরীয়ত কোন কাজকে শর্তহীন রেখেছে, সেখানে নিজের পক্ষ থেকে শর্ত যুক্ত করা।
সপ্তম মূলনীতি: যে ইবাদত যে বিশেষ অবস্থার সাথে শরীয়ত অনুমোদন করেছে, তার মধ্যে পরিবর্তন করা।
অষ্টম মূলনীতি: যে কাজ শরীয়ত একাকী আদায় করা অনুমোদন করেছে, সেটা সম্মিলিতভাবে আদায় করা।
নবম মূলনীতি: মাওযু বা জাল হাদীসের ভিত্তিতে কোনো আমল করা।
নিম্নে প্রতিটি শিরোনামের অধীনে ধারাবাহিক আলোচনা পেশ করা হল-
প্রথম মূলনীতি : যে সকল কাজের মাধ্যমে ইবাদতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবড়ি করা হয়
প্রথম শিরোনামের অধীনে অনিবার্য কারণে আলোচনা কিছুটা দীর্ঘ হয়েছে। তাই পাঠক যেন মূল বিষয় থেকে হারিয়ে না যান, এ জন্য প্রথমে শাখা শিরোনাম উল্লেখ করে এরপর বিস্তারিত আলোচনা পেশ করছি। আল্লাহই তাওফীক দাতা।
ক) যে কোনো ইবাদতের জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে অনুমোদন পূর্বশর্ত।
খ) বিদআত সৃষ্টির পিছনে শয়তান কিভাবে ভূমিকা পালন করে।
গ) কী প্রক্রিয়ায় বিদআত মানুষের মাঝে জায়গা করে নেয়।
ঘ) জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনা বিদআত নয়।
ঙ) বিদআত ও দ্বীনী কাজে আধুনিক উপকরণ ব্যবহারঃ একটি পর্যালোচনা।
চ) মৃত্যু পরবর্তী বিভিন্ন রসম-রেওয়াজের বিধান।
ছ) নবআবিষ্কৃত বিষয় : কখন বিদআত হিসেবে সাব্যস্ত হবে আর কখন হবে না।
জ) বিদআত দু’ভাগে বিভক্ত : আকীদাগত ও আমলগত।
নিম্নে মূল শিরোনামের অধীনে উক্ত শাখা শিরোনাম সমূহের বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হল-
ক) যে কোনো ইবাদতের জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে অনুমোদন পূর্বশর্ত
যে কোনো ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য হয়, তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হবে। এক্ষেত্রে মানুষের পক্ষ থেকে দুটি জায়গায় বাড়াবাড়ি হয়।
এক. নিজের পক্ষ থেকে বানানো এমন কোনো ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য হয়। এই কাজটাই স্বয়ং বাড়াবাড়ি। কারণ, ইবাদত হিসেবে আল্লাহ যা অনুমোদন করেননি সেটাকে সে নিজের পক্ষ থেকে সাব্যস্ত করেছে।
দুই. আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে অনুমোদিত কোনো ইবাদতে কমানো বা বাড়ানো। এবিষয়ে ‘দ্বিতীয় মূলনীতি’র অধীনে পৃথক আলোচনা আসছে।
এই উভয় প্রকারই বিদআত হিসেবে গণ্য হবে এবং সেটা ইবাদতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবড়ি হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা খৃস্টানদের ব্যাপারে বলেন,
﴿وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا﴾
কিন্তু সন্ন্যাসবাদ- এতো তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য উদ্ভাবন করেছিল, আমি তাদেরকে এর বিধান দেইনি, অথচ তাও তারা যথাযথভাবে পালন করেনি।” -সূরা হাদীদ (৫৭) : ২৭
কুরআনের উক্ত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝে আসে, বিদআত হচ্ছে এরূপ কাজ যা করতে আল্লাহ নির্দেশ দেননি, তবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষ তা উদ্ভাবন করে। আর বিদআতের প্রকৃতি হল, মানুষ যদিও ইবাদতের আগ্রহ নিয়েই তা উদ্ভাবন করে, কিন্তু তা সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। কারণ, মানুষ কোন কাজ কতটুকু সহজে পালন করতে পারবে, তা আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভালো জানেন। তিনি সেভাবেই বিধান দেন। মানুষ ধর্মের সাধারণ নির্দেশনার আলোকে আরো বেশি ভাল কাজ করার আগ্রহে কিছু নতুন কর্ম বা রীতি বানিয়ে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পালন করতে পারে না।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর রহ. (মৃ. ৭৭৪ হি.) বলেন,
“وقوله تعالى ( إلا ابتغاء رضوان الله) فيه قولان؛ أحدهما أنهم قصدوا بذلك رضوان الله، قاله سعيد بن جبير وقتادة، والآخر ما كتبنا عليهم ذلك إنما كتبنا عليهم ابتغاء رضوان الله”.
আল্লাহ তাআলার বাণী ( إلا ابتغاء رضوان الله) এর দুইটি ব্যাখ্যা রয়েছে। একটি হল, ‘তারা এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে।’ যেমনটি বলেছেন সাঈদ ইবনে যুবায়ের ও কাতাদা রহ.। আর অপরটি হল, ‘তা আমি তাদের উপরে এই জন্যই ফরয করেছি, যেন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে।’ -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/৫৭৯
উক্ত আয়াতের স্বাভাবিক অর্থ হিসেবে সাঈদ ইবনে যুবায়ের রহ.ও কাতাদা রহ. এর ব্যাখ্যাই এখানে প্রযোজ্য।
অতএব, যে কোনো ধরণের ইবাদত যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য হয়, তা অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে অনুমোদিত হতে হবে। অন্যথায় তা বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং নিজের পক্ষ থেকে নতুন কোনো ইবাদতমূলক কাজ সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ আল্লাহ তাআলা রাখেননি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ ﴾
তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে সে ধর্ম সিদ্ধ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?-সূরা শুরা (৪২) : ২১
ইবনে জারীর তবারী রহ. (মৃ. ৩১০ হি.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
“أم لهؤلاء المشركين بالله شركاء في شركهم وضلالتهم شرعوا لهم من الدين ما لم يأذن به الله، يقول ابتدعوا لهم من الدين ما لم يبح الله لهم ابتداعه”
এই সকল মুশরিকদের শিরক ও গোমরাহির ক্ষেত্রে তাদের এমন শরীক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে সে ধর্ম সিদ্ধ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। তিনি বলেন, সে সকল শরীক দেবতারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন নতুন বিষয় সৃষ্টি করেছে, যা সৃষ্টি করার বৈধতা আল্লাহ দেননি। -তাফসীরে তবারি ৯/৮৫১
আয়েশা (রাযি) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
যে আমাদের এই দীনে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটায়, তার নতুন উদ্ভাবিত কাজটি পরিত্যাজ্য।
আয়েশা (রাযি.) থেকে আরো বণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
যে (দ্বীন ও শরীয়তে নামে) নতুন কোনো কাজ করে, যে বিষয় শরঈ কোনো দলিল নেই, তাহলে তার নতুন উদ্ভাবিত কাজটি পরিত্যাজ্য (আল্লাহর নিকট কবুল হবে না)।” -সহীহ বুখারী ১/৩৭১, হাদীস ২৬১৯; সহীহ মুসলিম ২/৭৭, হাদীস ১৭১৮
উক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, দ্বীনের নামে যা কিছু প্রচার করা হবে, অথচ তা দ্বীন হওয়ার কোনো দলিল নেই, তা পরিত্যাজ্য এবং দ্বীনের নামে বাড়াবাড়ির অন্তর্ভুক্ত হবে।
খ) বিদআত সৃষ্টির পিছনে শয়তান কিভাবে ভূমিকা রাখে?
শয়তান কিভাবে বিদআত সৃষ্টির পিছনে ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. (মৃ. ৭৫১ হি.) বলেন,
“قال بعض السلف: ما أمر الله تعالى بأمر إلا وللشيطان فيه نزغتان: إما إلى تفريط وتقصير، وإما إلى مجاوزة وغلو، ولا يبالي بأيهما ظفر”
পূর্ববর্তী কোনো কোনো অনুসরণীয় আলেম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যে বিষয়েই আদেশ করেন না কেন, তাতে শয়তান দু’ভাবে কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা দেয়। হয়ত তার মধ্যে অবহেলা ও শৈথিল্য প্রদর্শনের কুমন্ত্রণা দেয়। অথবা তাতে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির প্ররোচনা দেয়। এর যে কোনো একটাকেই শয়তান সফলতা গণ্য করে।’ -ইগাসাতুল লাহফান ১/১১৬
গ) কী প্রক্রিয়ায় বিদআত মানুষের মাঝে জায়গা করে নেয়?
বিদআতের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে যে বিষয়টি ফুটে ওঠে তা হল, একজন বিদআতী ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করে শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশি ও প্রবৃত্তিপূজার মাধ্যমে। সে ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়তকে যথেষ্ট, পর্যাপ্ত ও সন্তোষজনক মনে করে না। তাই সে সন্তুষ্ট চিত্তে নিজের নফস ও প্রবৃত্তিকে ইলাহ ও প্রভু বানিয়ে।
মানুষের মাঝে দ্বীনের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির সূচনা এবং কী প্রক্রিয়ায় বিদআত মানুষের মাঝে জায়গা করে নেয়, সে সম্পর্কে আল্লামা শাতিবী রহ. (মৃ. ৭৯০ হি.) চমৎকার আলোচনা করেছেন। তিনি বিদআতের শরঈ পরিচিতির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন,
قوله”يقصد بالسلوك عليها المبالغة في التعبد لله تعالى” هو تمام معنى البدعة إذ هو المقصود بتشريعها،وذلك أن أصل الدخول فيها يحث على الانقطاع إلى العبادة والترغيب في ذلك ، لأن الله تعالى يقول : “وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ”، فكأن المبتدع رأى أن المقصود هذا المعنى، ولم يتبين له أن ما وضعه الشارع فيه من القوانين والحدود كاف، فرأى من نفسه أنه لا بد لما أطلق الأمر فيه من قوانين منضبطة، وأحوال مرتبطة، مع ما يداخل النفوس من حب الظهور أو عدم مظنته، فدخلت في هذا الضبط شائبة البدعة .
বিদআতের উদ্দেশ্যই হলো, আল্লাহর ইবাদতে আধিক্য অর্জন করা। সেটাই বিদআতের পূর্ণাঙ্গ অর্থ। কারণ, এটাই বিদআত প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ বিদআতে প্রবেশের সূচনা এভাবে হয় যে, (নফস তাকে) নিরবচ্ছিন্নভাবে ইবাদত করার প্রতি প্রলুব্ধ করে এবং (বিভিন্নভাবে) প্ররোচিত করে। (তাকে বিষয়টি এভাবে বুঝায় যে,) আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে।’ -সূরা যারিআত (৫১) : ৫৬
তখন বিদআতী মনে করে, এটাই (যে কোনোভাবে আল্লাহর ইবাদতই) মূল উদ্দেশ্য। (যদিও সেটা সুন্নাহ অনুযায়ী না হয়)। তার কাছে এটা স্পষ্ট হয় না যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের জন্য যে নিয়ম-পদ্ধতি দিয়েছেন সেটাই যথেষ্ট। যার ফলে সে শরীয়তের সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকা জরুরী মনে করেন না। (তাই নিজের পক্ষ থেকে ইবাদত হিসেবে তাতে সংযোজন-বিয়োজন করে)। আর নিজেকে প্রকাশ করা বা নতুন চমক দেখানোর মানবীয় প্রবৃত্তি সেই সাথে কাজ করে। আর এই প্রক্রিয়ায় সেখানে বিদআতের দুর্গন্ধ ঢুকে পড়ে।
মানুষ কেন বিদআতের প্রতি আগ্রহী হয়, সে প্রসঙ্গে শাতিবী রহ. বলেন,
وأيضاً فإن النفوس قد تمل وتسأم من الدوام على العبادات المرتبة، فإذا جدد لها أمر لا تعهده، حصل بها نشاط آخر لا يكون لها مع البقاء على الأمر الأول، ولذلك قالوا : ( لكل جديد لذة ) بحكم هذا المعنى، كمن قال: كما تحدث للناس أقضية بقدر ما أحدثوا من الفجور ، فكذلك تحدث لهم مرغبات في الخير بقدر ما حدث لهم من الفتور !وفي حديث معاذ بن جبل رضي الله عنه”فَيُوشِكُ قَائِلٌ أَنْ يَقُولَ: مَا لِلنَّاسِ لا يَتَّبِعُونِي وَقَدْ قَرَأْتُ الْقُرْآنَ، مَا هُمْ بِمُتَّبِعِيَّ حَتَّى أَبْتَدِعَ لَهُمْ غَيْرَهُ، فَإِيَّاكُمْ وَمَا ابْتُدِعَ! فَإِنَّ مَا ابْتُدِعَ ضَلالَةٌ.”
এছাড়া মানবীয় প্রকৃতি নিয়মিত ও পুরাতন ইবাদতে ক্লান্ত ও নিঃস্পৃহ হয়ে পড়ে। নতুন নিয়ম পদ্ধতির মধ্যে অতিরিক্ত উদ্দীপনা ও কর্মপ্রেরণা লাভ করে, যা পুরাতনের মধ্যে পায় না। আর এ অর্থেই বলা হয়, ‘প্রত্যেক নতুনের মধ্যেই মজা’। বিদআতীদের তত্ত্ব এই যে, মানুষের মধ্যে অপরাধ বেড়ে গেলে যেমন অপরাধ ধরা ও বিচার করার জন্য পদ্ধতিও বেড়ে যায়, অনুরূপভাবে মানুষের মধ্যে ইবাদতে অবহেলা প্রসার লাভ করলে তাদের অবহেলা কাটাতে নতুন নতুন (ইবাদতের প্রতি প্রলুব্ধকারী) নিয়ম পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। মু‘আয রাযি. এর হাদীসে এসেছে- “তখন হয়ত কোনো ব্যক্তি বলবে, মানুষের কী হলো, আমি কুরআন শিক্ষা করলাম (কুরআন নিয়ে গবেষণা করলাম!) অথচ তারা আমার অনুসরণ করছে না? কুরআন ছাড়া কোনো নতুন মত বা কাজ উদ্ভাবন না করলে লোকেরা আমার অনুসরণ করবে না।’মু‘আয রাযি. বলেন, খবরদার! তোমরা বিদআতের কাছেও যাবে না। নিঃসন্দেহে যা কিছু বিদআত তাই পথভ্রষ্ঠতা।” -আল-ই’তিসাম, শাতিবী ১/৫৪-৫৬
ঘ) জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন বিদ‘আত নয়
এরপর শাতিবী (রহ.) বিদআতের সীমারেখা এবং কোনটা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে, কোনটা অন্তর্ভুক্ত হবে না, সে সম্পর্কে বলেন,
وقد تبين بهذا القيد أن البدع لا تدخل في العادات. فكل ما اخترع من الطرق في الدين مما يضاهي المشروع ولم يقصد به التعبد فقد خرج عن هذه التسمية
এদ্বারা বুঝা যায় যে, ইবাদতের বাইরে জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনা শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত বলে গণ্য নয়। বিদআত বলতে বুঝায়, দ্বীনের মধ্যে নব-আবিষ্কৃত তরীকা বা পদ্ধতি, যা বাহ্যত শরীয়তের মতই। যে পদ্ধতির দ্বারা ইবাদত উদ্দেশ্য নয়, সেটা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে না।”-আল-ই’তিসাম, শাতিবী ১/৫৬
ঙ) দ্বীনী কাজে আধুনিক উপকরণের ব্যবহার : একটি পর্যালোচনা
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়; একটি হল, কোনো কাজ শরীয়তের মূল মাকসাদ বা উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া। আরেকটি হল, কাজটি মূল উদ্দেশ্য নয় বরং শরঈ কোনো বিষয় অর্জন করার মাধ্যম। যেমন; ওযু করা শরীয়তের একটি হুকুম। যখন ওযুর পানি তালাশ করা বা কূপ থেকে তা উত্তোলন করা জরুরী হয়ে পড়ে, তখন তা করা শরঈ দৃষ্টিতে ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়ে যায়। কারণ, শরীয়তের স্বীকৃত মূলনীতি হল, কোনো ফরয বা ওয়াজিব কাজ আদায় করার জন্য যে সকল কাজ বা মাধ্যম ব্যবহার করা জরুরী ও অনিবার্য, সেগুলোও ওয়াজিব। অর্থাৎ উপকরণ ও মাধ্যম শরঈ মাকসাদ ও উদ্দেশ্যের হুকুম রাখে। সুতরাং যে কাজ বা মাধ্যম ছাড়া কোনো জরুরী ও ওয়াজিব কাজ সম্পাদন করা সম্ভব হয় না, সেটিও ওয়াজিব বা জরুরী হয়ে যায়। তবে যদি স্বয়ং সে মাধ্যমকে ইবাদতের বস্তু গণ্য করে, তাহলে সেটা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।
উক্ত মূলনীতির আলোকে দ্বীনের বিভিন্ন বিধান পালন করার জন্য আধুনিক বৈধ বস্তু ও উপকরণসমূহ ব্যবহার করা যে বিদআত নয়, তা প্রতিভাত হয়ে উঠে। যেমন;
১. কুরআন কারীম ও হাদীসে নববীতে জিহাদের অনেক ফযিলত এসেছে। সুতরাং বর্তমানে যে সকল উপকরণের মাধ্যমে জিহাদ করা হয় বা যে সকল অস্ত্রশস্ত্র জিহাদে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে শুধু এ কারণে বিদআত বলা বৈধ নয় যে, এসকল অস্ত্রশস্ত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কিংবা সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না। কেননা, স্বয়ং এসকল যুদ্ধাস্ত্র দ্বীনের মূল উদ্দেশ্য বা মাকসাদ নয় এবং ‘এগুলোর ব্যবহার’কে দ্বীনী কাজ মনে করে করা হয় না। বরং জিহাদের শরঈ উদ্দেশ্য অর্জন করার মাধ্যম মনে করে এগুলো ব্যবহার করা হয়।
২. হজ্জ্বের সফর অনেক বড় ইবাদত। হজ্জ্বের সফরে যাতায়াতের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা বিদআত হবে না। কেননা, বিমানে বসা বা সামুদ্রিক জাহাজে বসাকে কেউ ইবাদত মনে করে না। বরং এগুলোকে ‘হজ্জ্ব নামক শরঈ ইবাদত’ আদায় করার মাধ্যম মনে করা হয়।
৩. অনুরূপভাবে গাড়িতে করে মসজিদে যাওয়া। এখানে ‘গাড়িতে আরোহণ করা’কে ইবাদত মনে করা হয় না। বরং ‘আস সা’য়ু ইলাল মাসজিদ’ বা নামাযের জন্য মসজিদের দিকে যাওয়াকে ইবাদত মনে করা হয়। শরঈ এই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন ও নিশ্চিতকরণের জন্য গাড়িতে আরোহণ করাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
৪. নামাযে কাতার ঠিক করা। সেটা বাস্তবায়ন ও নিশ্চিতকরণের জন্য কোনো বৈধ মাধ্যম বা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কোনো বাধা নেই। যদি এই বৈধ মাধ্যমটিকেই ইবাদতের বিষয়ে পরিণত না করা হয়। অথচ সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় ছিল না। এর উদাহরণ হলো, মসজিদের মেঝেতে কাতার সোজা করার জন্য দাগ দেওয়া বা রেখা টানা। এটি যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ছিল না। কিন্তু তবুও তা বিদআত বলে গণ্য হবে না। কারণ, আমরা এই ‘রেখা টানা’কে ইবাদতের বিষয় মনে করি না। বরং ‘কাতার সোজা করা’কে ইবাদতের বিষয় মনে করি আর ‘কাতার সোজা করা’র কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য ‘রেখা টানা’কে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছি।
৫. কুরআন-হাদীসে ইলমে দ্বীন পড়া, পড়ানো, শিখা, শিখানোর অনেক ফযিলত এসেছে। এ ব্যাপারে খুব গুরুত্বও দেওয়া হয়েছে। এখন ইলমে দ্বীন অর্জন করার যে সকল বৈধ মাধ্যম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরামের জামানায় ছিল না, বরং তাদের পরে অস্তিত্বে এসেছে, সেগুলো অবলম্বন করা বিদআত হবে না। কারণ, এসকল মাধ্যম মূল উদ্দেশ্য নয় বরং একটি শরঈ বিষয় সম্পন্ন করার মাধ্যম মাত্র।
৬. অনুরূপভাবে ইলমে নাহু, ইরাব, কুরআন কারীমে নুকতা ও হরকত দেওয়, কুরআন তিলাওয়াতের সময় কোথায় থামতে হবে, কোথায় মিলিয়ে পড়তে হবে, কোথায় ওয়াকফ করতে হবে, এ সবের চিহ্ন দেওয়া। যেন সাধারণ মুসলমানরা সহীহশুদ্ধ ভাবে তিলাওয়াত করতে পারে। একইভাবে হাদীস সংকলন ও তার ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রণয়ণ, ফিকহের সংকলণ, বিভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের ওপর দ্বীনী রচনা ও পুস্তক লেখা, সেগুলো ছাপিয়ে প্রচার-প্রসার করা, আধুনিক ব্যবস্থাপনা সম্বলিত বিভিন্ন দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করা, কুতুবখানা বা পুস্তক-বিক্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এসব বিষয় বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা, এসব কিছু যদিও নববী যুগে ছিলো না। কিন্তু যখন গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী মাকসাদ ও উদ্দেশ্য হাসিল করা, দ্বীনী বিধি-বিধান পালন ও সম্পাদন করার জন্য এগুলো জরুরী ও অপরিহার্য সাব্যস্ত হলো, তখন সেটাও শরীয়তে কাঙ্খিত ও শরীয়তের পক্ষ থেকে আদিষ্ট বিষয়ে পরিণত হলো। সুতরাং উপরিউক্ত কাজগুলো বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং সেগুলো শরঈ লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে শামিল হয়ে যাবে। এগুলো মূলত কুরআন হিফয বা সংরক্ষণ করা, কুরআন-সুন্নাহ অন্যকে শিক্ষা দেওয়া বা অন্যের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার বিভিন্ন মাধ্যম। আমরা স্বয়ং সে মাধ্যমগুলোকে ইবাদত মনে করি না। বরং ইবাদত মনে করি, কুরআন তেলাওয়াত করা ও তা হিফজ করাকে। ইবাদত মনে করি, সেগুলো অন্যকে শিক্ষানো বা অন্যের কাছে পৌঁছানোকে, যা শরীয়তের মূল মাকসাদ। এই কাজগুলোকে সত্ত্বাগতভাবে কেউই ইবাদত বলে মনে করে না। হ্যাঁ, কেউ যদি এ গুলোকেই ইবাদত বলে মনে করে, তবে তার ক্ষেত্রে এগুলো বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে।
৭. একই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে; ক) সফরের জন্য আধুনিক যাতায়াত মাধ্যম, যেমন; রেল গাড়ি, মটর গাড়ি, বিমান ইত্যাদি বিভিন্ন নতুন আবিষ্কার। খ) আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন; টেলিফোন-মোবাইল ইন্টারনেট ইত্যাদি। গ) মানুষের দৈনন্দিন জীবনের শান্তি ও আরামদায়ক উপকরণ, নিত্যনতুন খাবার, আধুনিক বিভিন্ন পোশাক, নতুন ডিজাইনের বিভিন্ন ঘর-বাড়ি। উপরিউক্ত আধুনিক উপকরণসমূহের বৈধ ব্যবহার বিদআত হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ, এগুলোকে কেউ ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে করে না বা এগুলোকে দ্বীনী বিষয়ও মনে করে না।
৮. অনুরূপভাবে বিবাহ ইত্যাদি উৎসবে পালিত বিভিন্ন রসম-রেওয়জ (এর অনেকগুলো যদিও পাপের বিষয়), সেগুলোও শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত নয়। কারণ, মানুষ এগুলো প্রথা হিসেবে অথবা লোক দেখানো বা সুনামের জন্য করে থাকে। এগুলো কেউ ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে করে না এবং এগুলোকে দ্বীনী বিষয়ও মনে করে না। এখান থেকে বিদআত ও রসম-বেওয়াজের পার্থক্যও ফুটে ওঠে।
চ) মৃত্যু পরবর্তী বিভিন্ন রসম-রেওয়াজের বিধান
তবে যে সকল রসমকে দ্বীনের বিষয় মনে করা হয় এবং সেগুলোর দ্বারা আখেরাতের ছাওয়াবের আশা করা হয়, সেগুলো অবশ্যই বিদআতের মধ্যে শামিল হবে। যেমন; মৃত্যু পরবর্তী বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ। তিনদিনা, চল্লিশা মৃত্যু-বার্ষিকী ইত্যাদি পালন, বুজর্গদের কবরে গিলাফ চড়ানো, ফুল দেওয়া, ওরস করা ইত্যাদি। এসব কাজকে দ্বীনী কাজ মনে করা হয় এবং ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে করা হয়। তাই অবশ্যই বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে।
ছ) নব আবিষ্কৃত বিষয় কখন বিদআত হিসেবে সাব্যস্ত হবে আর কখন হবে না?
মোটকথা, একটি মূলনীতি আমাদেরকে খুব গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে। তা হল, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের জামানার পরে সৃষ্ট, এমন কোনো বিষয় বিদআত হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য শর্ত হলো, শরঈ কোনো দলিল ছাড়া সেটাকে দ্বীনের কাজ বা ইবাদতের বিষয় মনে করা। যদি দ্বীনের কাজ বা ইবাদতের বিষয় না মনে করা হয়, তাহলে তা বিদআত হবে না। অনরূপভাবে সে সকল মাধ্যমও বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে না, যদি স্বয়ং সে বস্তু বা মাধ্যম দ্বারা আল্লাহর ইবাদত করা উদ্দেশ্য না হয়। বরং শরঈ নীতিমালার আলোকে শরীয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সেগুলো গ্রহণ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যে কোনো জিনিসকে ‘শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ইবাদত’ আদায়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে, সে জিনিসের ব্যবহার জায়েয হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু যদি মাধ্যমকে দ্বীনী ও ছাওয়াবের কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়, তা হলে তা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।
উক্ত মূলনীতি কেউ ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে তার কাছ স্পষ্ট হয়ে যাবে, নবআবিষ্কৃত বিষয় কখন বিদআত হবে আর কখন বিদআত হবে না? উক্ত মূলনীতি যারা বুঝে না, তাদের কেউ কেউ বিদআতের বিরুদ্ধে হক্বপন্থী আলেমদের কথা শুনলেই আধুনিক বিভিন্ন আবিষ্কারের প্রসঙ্গ টেনে বলতে শুরু করে, আধুনিক জিনিসগুলো তো আপনারাও গ্রহণ করছেন, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সালাফগণের জামানায় ছিলো না, তা সত্ত্বেও সেগুলো গ্রহণ করা যদি বিদআত না হয়, তাহলে আমাদের এসকল (বিদআতি) কাজ কেন বিদআত হবে? উক্ত আলোচনা থেকে তাদের এসকল আপত্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। যাহোক, বিদআত সম্পর্কে উক্ত মূলনীতি না বুঝার কারণে বা বুঝার চেষ্টা না করার কারণে সে লোকগুলো এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সব বিষয়ে সঠিক বুঝ নসীব করুন।
জ) বিদআত দুই প্রকার : আকীদাগত ও আমলগত
এ সকল বিদআত দুই প্রকার :
এক. আকীদা বা বিশ্বাসগত বিদ‘আত (البدعة العقدية)
দুই. আমলী বিদআত (البدعة العملية)
আকীদাগত বিদআত আমলী বিদআতের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। আকীদাগত বিদআত হল, কোনো ব্যক্তি বা দল এমন আকীদা বা বিশ্বাস পোষণ করে, যা কুরআন-সুন্নাহর খেলাফ। আকীদাগত বিদআতের বিভিন্ন স্তর ও প্রকার রয়েছে। এর মধ্যে কিছু আকীদা আছে স্পষ্ট কুফরি।
যেমন,
এক. কাদিয়ানীদের একটি আকীদা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরও নবুওয়াতের দরজা খোলা রয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)।
দুই. এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, ঈসা আলাইহিস সালাম মৃত্যুবরণ করেছেন।
তিন. এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহর ওলীগণ গায়েবের বিষয় জানেন, তাঁরা ‘হাযের-নাজের’ (সব জায়গা উপস্থিত থাকেন এবং সব কিছু দেখেন) এবং এ ধারণা রাখা যে, কেউ তাঁদেরকে বহু দূর দেশ থেকে ডাকলেও তাঁরা সে ডাক শুনতে পান, তাকে সাহায্য করেন এবং তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন। এ সকল আকীদা-বিশ্বাস বিদআত হওয়ার পাশাপাশি শিরকও বটে। তবে সকল আকীদাগত বিদআত কুফুর নয়, বরং অনেকগুলো গোমরাহির অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় মূলনীতি : শরীয়ত অনুমোদিত কোনো ইবাদতের সাথে নিজের পক্ষ থেকে সংযোজন করা
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীর মাধ্যমে দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এমন কোনো বিষয় পাওয়া যাবে না, যার বিধান সবিস্তারে কিংবা উসূলীভাবে শরীয়তে নেই। দ্বীনের পূর্ণতার বিষয়ে আল্লাহ তআলা বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে (চির দিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম। -সূরা মাইদাহ (৫) : ৩
দ্বীনের পূর্ণতার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
” ما بقي شيء يُقرِّب من الجنة ويباعد من النار إلا وقد بُيِّن لكم”
তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দেয় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়; এমন সব কিছুই তোমাদের কাছে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে।’ হাইসামী রহ. (মৃ ৮০৭ হি.) বলেন, হাদীসটি সকল বর্ণনাকারী ছিক্বাহ। -আল মুজামুল কাবীর, ইমাম তবরানী রহ. ২/১৫৫, হাদীস ১৬৪৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২৬৩-২৬৪, হাদীস ১৩৯৭১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
“ليس من عمل يقرب من الجنة إلا قد أمرتكم به ولا عمل يقرب من النار إلا وقد نهيتكم عنه”
এমন কোনো আমল বাকী নেই যা (মানুষকে) জান্নাতের নিকটবর্তী করে; অথচ আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে আদেশ করিনি। আর এমন কোনো আমলও বাকী নেই যা (মানুষকে) জাহান্নামের নিকটবর্তী করে; অথচ আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করিনি।’ -মুসতাদরাকে হকেম ২/৫ হাদীস ২১৩৬; সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব, মুনযিরী রহ. (মৃ. ৬৫৬ হি.) ২/১৪৪, হাদীস ১৭০০ (শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ লি গায়রিহি)
উক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, দ্বীন তার যাবতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ। সুতরাং যে ব্যক্তি দ্বীনের নামে এমন কোনো কাজ সমাজে চালু করল, যার কোনো শরঈ ভিত্তি নেই, সে মূলত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে রিনামাযের বিষয় খিয়ানাতের অভিযোগ করল। এ সম্পর্কে ইবনে মাজিশুন রহ. বলেন, আমি ইমাম মালেক রহ. (মৃ. ১৭৯ হি.)-কে বলতে শুনেছি:
من ابتدع في الإسلام بدعةً يراها حسنة فقد زعم أن محمداً صلى الله عليه وسلم خان الرسالة، لأن الله يقول:”اليوم أكملت لكم دينكم” فما لم يكن يومئذِ ديناً فلا يكون اليوم ديناً. اهـ.
যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোনো বিদআত চালু করল এবং সেটিকে উত্তম হিসাবে দেখল। সে যেন ধারণা করল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিনামাযের ক্ষেত্রে খিয়ানত করেছেন। অথচ, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম।’ সুতরাং সেই সময় কোনো বিষয় যদি দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত না থাকে, তাহলে আজও তা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হবে না। -আলইতিসাম, শাতিবী ১/৬৪
দ্বীনের পূর্ণতা এবং দ্বীনের বাহিরে কোনো কিছু তালাশ করা গোমরাহি, এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘(হে নবী! তাদেরকে) আরো বল, এটা আমার সরল-সঠিক পথ। সুতরাং এর অনুসরণ কর, অন্য কোনো পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’ -সূরা আনআম (৬) : ১৫৩
ইমাম শাতিবী রহ. (মৃ. ৭৯০ হি.) ‘সিরাতুল মুসতাক্বীম’ এর ব্যাখ্যায় বলেন:
فالصراط المستقيم هو سبيل الله الذي دعا إليه وهو السنة، والسُبُل هي سبل أهل الاختلاف الحائدين عن الصراط المستقيم وهم أهل البدع.
‘সিরাতুল মুসতাক্বীম’ হলো আল্লাহ তাআলার রাস্তা, যেদিকে তিনি আহ্বান করেছেন। তা হলো (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) সুন্নাহ। আর ‘সুবুল’ হলো সিরাতুল মুসতাক্বীম থেকে যারা সরে গিয়েছে এমন মতানৈক্য সৃষ্টিকারীদের রাস্তা; আর তারাই হলো আহলে বিদআত। -আলইতিসাম ১/৭৬
ইমাম ইবনে জারীর তবারী রহ. (মৃ. ৩১০ হি.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
قوله تعالى ﴿فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ﴾يَقُولُ: فَيُشَتِّتُ بِكُمْ إِنِ اتَّبَعْتُمُ السُّبُلَ الْمُحْدَثَةَ الَّتِي لَيْسَتْ لِلَّهِ بِسُبُلٍ وَلَا طُرُقٍ وَلَا أَدْيَانٍ،
কুরআনের আয়াত ﴿فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِه ﴾ অর্থাৎ যদি তোমরা আল্লাহ তাআলার পথ ও দ্বীন বহির্ভূত নব-উদ্ভাবিত পন্থা-পদ্ধতির অনুসরণ কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন।’ -তাফসীরে তাবারী ৫/২২২ (১৪১৬১)
বিদআতের বিষয়ে বাড়াবাড়ি হয় দুটি স্থানে
১ম স্থান
বিদআত কখনো এমন বিষয়ের মাধ্যমে হয়, যার কোনো ভিত্তি শরীয়তে নেই। যেমন খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদের আকীদা-বিশ্বাস, যার কোনো ভিত্তি তাদের শরীয়তে নেই। আল্লাহ তাআলা সে সম্পর্কে বলেন,
﴿ يَاأَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ انْتَهُوا خَيْرًا لَكُمْ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا ﴾
হে কিতাবীগণ! নিজেদের দ্বীনে সীমালঙ্ঘন করো না এবং আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ছাড়া অন্য কথা বলো না। মারইয়ামের পুত্র ঈসা মাসীহ তো আল্লহর রাসূল মাত্র এবং আল্লাহর এক কালিমা, যা তিনি মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর ছিলেন এক রূহ, যা তাঁরই পক্ষ হতে (সৃষ্টি হয়ে) ছিল। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন এবং বলো না (আল্লাহ) ‘তিন’। এর থেকে নিবৃত্ত হও। এরই মধ্যে তোমাদের কল্যাণ। আল্লাহ তো একই মাবুদ। তাঁর কোনো পুত্র থাকবে- এর থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা-কিছু আছে, তা তাঁরই। (সকলের) তত্ত্বাবধানের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ -সূরা নিসা (৪) : ১৭১
ইমাম ইবনে আবি হাতেম রহ. (মৃ. ৩২৭ হি.) নিজস্ব সনদে তাবেঈ কাতাদা (মৃ. ১১৩ হি.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,
” لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ قَالَ: لَا تَبْتَدِعُوا.” وذكر وجهاً ثانياً بسنده عن عبد الرحمن بن زيد بن أسلم يقول:” فِي قَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى:لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ قَالَ: الْغُلُوُّ: فِرَاقُ الْحَقِّ وَكَانَ مِمَّا غَلَوْا فِيهِ أَنْ دَعَوْا لِلَّهِ صَاحِبَةً وَوَلَدًا سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى.
আল্লাহ তাআলার বাণী لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ আয়াতে কাতাদা রহ. বলেন, ‘তোমরা বিদআত সৃষ্টি করো না।’ এছাড়া আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম এর সূত্রে ইবনে আবি হাতেম রহ. (দ্বিতীয় অর্থ) বর্ণনা করে বলেন, আল্লাহ তাআলার বাণী لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ আয়াতের দ্বিতীয় দিক হলো, الغلو তথা হক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।’ -তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম ৪/১১২২ (৬৩০৩, ৬৩০৪)
২য় স্থান
অনুমোদিত কোনো ইবাদতে কমানো বা বাড়ানো, ইবাদতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবড়ি
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে অনুমোদিত কোনো ইবাদতে যদি কমানো বা বাড়ানো হয়, তাহলে তা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে এবং সেটা ইবাদতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবড়ি হিসেবে বিবেচিত হবে। নিচের হাদীসগুলো থেকে বিষয়টি স্পষ্ট বুঝে আসে। ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন,
“قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةَ الْعَقَبَةِ وَهُوَ عَلَى نَاقَتِهِ: الْقُطْ لِي حَصًى فَلَقَطْتُ لَهُ سَبْعَ حَصَيَاتٍ، هُنَّ حَصَى الْخَذْفِ، فَجَعَلَ يَنْفُضُهُنَّ فِي كَفِّهِ وَيَقُولُ أَمْثَالَ هَؤُلَاءِ، فَارْمُوا ثُمَّ قَالَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّينِ، فَإِنَّهُ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِي الدِّينِ”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘জামরাতুল আকাবা’র ভোরে তাঁর উষ্ট্রীর পিঠে আরোহিত অবস্থায় বলেন, আমার জন্য কংকর সংগ্রহ করে নাও। আমি তার জন্য সাতটি কংকর সংগ্রহ করলাম। তা ছিল এমন ছোট ছোট কংকর, যা আংগুলের মাথায় নিক্ষেপ করা যায়। তিনি তা নিজের হাতের তালুতে ঝাড়তে ঝাড়তে বলেন, তোমরা আকারে ক্ষুদ্র এই ধরণের কংকর নিক্ষেপ করবে। অতঃপর বলেন, হে লোকসকল! তোমরা দ্বীনের বিষয় বাড়াবাড়ি করা থেকে সাবধান থাকো! কেননা, তোমাদের পূর্বেকার লোকদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের বাড়াবাড়ি ধ্বংস করেছে।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩০২৯; সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ ৩/৪৯, হাদীস ২৪৭৩ (শায়খ আলবানী রহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ।)
হজ্জ্বের সময় মিনার জামারাতে পাথর মারার বিষয় শরীয়তে সাব্যস্ত। সেখানে পাথরের আকার-আকৃতির বিষয় শরীয়াহ-পদ্ধতি বাদ দিয়ে নিজের পক্ষ থেকে পাথরের আকৃতি নির্ধারণ করা বিদআত ও বাড়াবাড়ি হবে।
অনুমোদিত কোনো ইবাদতে নিজের পক্ষ থেকে বাড়ানো প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস রাযি. (মৃ. ৬৮ হি.) বলেন,
بينا النبي صلى الله عليه وسلم يخطب إذا هو برجلٍ قائم، فسأل عنه، فقالوا أبو إسرائيل؛ نذر أن يقوم ولا يقعد ولا يستظل ولا يتكلم ويصوم. فقال النبي صلى الله عليه وسلم:” مُره فليتكلم وليستظل وليقعد وليتم صومه”
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে খুতবা দিচ্ছিলেন, সে সময় এক ব্যক্তি দাঁড়ানো ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। সাহাবাগণ বললেন, ‘সে আবু ইসরাঈল। সে মানত করেছে; দাঁড়িয়ে থাকবে, বসবে না, ছায়াও গ্রহণ করবে না (রোদে দাঁড়িয়ে থাকবে), কথাও বলবে না আর রোযা রাখবে।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাকে বলো, সে যেন কথা বলে, ছায়া গ্রহণ করে এবং বসে যায় আর রোযাটা যেন পূর্ণ করে।’ -সহীহ বুখারী ২/৯৯১, হাদীস ৬৪৪৮
এখানে উক্ত মূল ইবাদত শরীয়তে সাব্যস্ত আছে। সেখানে সে ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বিষয় সংযোজন করে নেয়। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সংযোজিত বিষয়গুলোকে বাদ দিতে বললেন।
উক্ত বিষয়ের আরও একটি উদাহরণ হল, আরবের মুশরিকদের উলঙ্গ অবস্থায় বায়তুল্লাহ’র তাওয়াফ করা। তারা বলত, ‘আমরা ওই পোশাকে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করব না, যে পোশাক পরে আল্লাহর নাফরমানি করেছি।’
এখানেও মূল তাওয়াফ ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ধর্মে ছিল কিন্তু তারা এর সাথে নিজেদের পক্ষ থেকে নতুন কিছু জিনিস যোগ করে নেয়।
অতএব, মূল বিষয়টি সাব্যস্ত হলেই তার সাথে (শরঈ কোনো ভিত্তি ছাড়া) নিজের মত করে কোন কিছু সংযুক্ত করা যাবে না। এখানে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি। তা হল, যে জিনিসের কোনো ভিত্তিই শরীয়তে নেই, তা বিদআত হওয়ার বিষয়টি সবারই স্পষ্ট বুঝে আসে। তবে যেকাজের মূল বিষয়টি শরীয়তে রয়েছে কিন্তু সেখানে নতুন কিছু সংযুক্ত করা হয়েছে, সেটাও যে বিদআত, এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট থাকে না। অনেকের কাছে বিষয়টি জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। তাই তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। মোটকথা, মূল বিষয় শরীয়তে সাব্যস্ত আছে কিন্তু সেখানে নিজের পক্ষ থেকে নতুন কিছু যুক্ত করাও যে বিদআত, এটি ভালোভাবে বুঝে নেওয়া খুব জরুরি।
শরীয়ত যাকে উম্মুক্ত রেখেছে, তাকে সংকীর্ণ বা সীমিত করে ফেলা, এটিও উক্ত মূলনীতির অধীনে আসবে। যেমন, রোজা দাঁড়িয়ে বসে শুয়ে যে কোনো অবস্থায় পালন করা যায়। সেখানে শুধু দাঁড়িয়ে রোযা পালন করার মান্নত করা বিদআত। উক্ত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন।
অনুরূপ, যে কোনো হালাল খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করা যাবে। সেখানে নির্দিষ্ট কোনো প্রকার খাদ্য গ্রহণের ওপর সীমাবদ্ধ থাকা। অথবা নির্দিষ্ট প্রকারের পোশাক ব্যবহার করা নিজের জন্য আবশ্যক করে নেওয়া ইত্যাদি। এ সকল কাজের মূল বিষয় শরীয়তে সাব্যস্ত আছে। কিন্তু এর সাথে সংযুক্ত বিষয় সাব্যস্ত হওয়ার পক্ষে কোনো দলিল নেই। অনেক বিষয় বিদআত হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি। এই মূলনীতি স্মরণে না থাকার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বিষয় অস্পষ্ট থেকে যায়। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বার্ষিকী পালনের বিষয় যখন অস্বীকৃতি জানানো হয় তখন অনেকের কাছে বিষয়টা জটিল মনে হয়। কারণ, তারা সেটা নবীর মহব্বতেই করে থাকে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত দ্বীন ও ঈমানের অংশ। কিন্তু এই ভালোবাসার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের যে রূপ বা প্রকৃতি (অর্থাৎ যে রূপ বা প্রকৃতির মাধ্যমে এই ইবাদত করা হচ্ছে) সেটা অবশ্যই শরীআহ মোতাবেক হতে হবে। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের ওপর আপত্তি নয়, বরং আপত্তি হল, নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এমন পন্থা ও পদ্ধতি ওপর, যে পন্থা ও পদ্ধতির (মাধ্যমে নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের) অনুমতি শরীয়ত দেয়নি বা যার পক্ষে কোনো শরঈ দলিল নেই।
এ বিষয়টি হুযাইফা রাযি. (মৃ. ৩৬ হি.) এর কথা থেকে আরও স্পষ্ট হবে। ইব্রাহীম নাখাঈ রহ.(মৃ. ৯৬ হি.) বলেন, হুযাইফা (রাযি.) মসজিদে ক্বারীগণের একটি হালকার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখন তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,
اتَّقُوا اللَّهَ يَا مَعْشَرَ الْقُرَّاءِ، خُذُوا طَرِيقَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، وَاللَّهِ لَئِنِ اسْتَقَمْتُمْ لَقَدْ سُبِقْتُمْ سَبْقًا بَعِيدًا، وَلَئِنْ تَرَكْتُمُوهُ يَمِينًا وَشِمَالًا لَقَدْ ضَلَلْتُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا
হে ক্বারীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের (সাহাবাগণের) পথ অবলম্বন কর। আল্লাহর শপথ! যদি তোমরা (তাদের পথে) অবিচল থাকো তাহলে অনেক পথ এগিয়ে যাবে। আর যদি তা ছেড়ে ডানে এবং বামে ছুটতে শুরু কর, তাহলে স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত হবে। (বর্ণনাটি ইব্রাহীম নাখাঈ রহ. পর্যন্ত সহীহ। তিনি তা হুযাইফা (রাযি) থেকে মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে ইব্রাহীম নাখাঈ রহ.এর মুরসাল গ্রহনযোগ্য।) -আলবিদাউ ওয়ান নাহয়ু আনহা, ইবনে ওয়াদ্দাহ আলকুরতুবী (ابن وضّاح القُرْطُبيّ) -মৃ. ২৮৭ হি.- ১/৩৬, হাদীস ১০; তাহযীবুল কামাল ১/১৪৫
এখানে হুযাইফা (রাযি.) ক্বারীগণের কুরআন তিলাওয়াতের ওপর আপত্তি করছেন না। কারণ, শরঈ দলিলের আলোকে সেটা সাব্যস্ত। বরং তাঁর আপত্তি হল, কুরআন তিলাওয়াতের এমন কোনো অবস্থা বা পদ্ধতির (সংযুক্তির) ওপর, যা সাহাবায়ে কেরামের মানহায ও পদ্ধতির বিপরীত।
তৃতীয় মূলনীতি : বিদআত কখনো কোনো কাজ করার মাধ্যমে হয় আবার কখনো কোনো কাজ ছাড়ার মাধ্যমে হয়
অর্থাৎ বিদআত কখনো হয়, নতুন কোনো কাজকে ইবাদতের রূপ দানের মাধ্যমে আবার কখনো শরীআহ অনুমোদিত কোনো হালাল বস্তু ছেড়ে দেওয়াকে ইবাদত মনে করার কারণে সেটাও বিদআত হিসেবে বিবেচিত হয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতিবী রহ. (মৃ. ৭৯০ হি.) বলেন:
“فَقَدْ يَقَعُ الِابْتِدَاعُ بِنَفْسِ التَّرْكِ تَحْرِيمًا لِلْمَتْرُوكِ أَوْ غَيْرَ تحريم”
কখনো কখনো বিদআত সৃষ্টি করা হয় বৈধ কোন বস্তুকে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে। সে ছেড়ে দেওয়াটা কখনো হয়, সেই বস্তুটিকে হারাম সাব্যস্ত করে, আবার কখনো হয় হারাম সাব্যস্ত না করে।-ইতিসাম ১/৫৭
শরীয়তে বৈধ এমন যেকোনো কিছু ছেড়ে দিলেই সেটা বিদআত বলে গণ্য হবে না। দেখতে হবে, কেন ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যদি কেউ গ্রহণযোগ্য কোন শরঈ ওজরের কারণে ছেড়ে দেয়, যেমন, স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে ছেড়ে দেয়, তাহলে কোন অসুবিধা নেই। অথবা সন্দেহযুক্ত জিনিসের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে পারে এ জন্য ছেড়ে দেয়, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যদি ছেড়ে দেওয়াটা গ্রহণযোগ্য কোনো শরঈ কারণে না হয়, তাহলে সেটা হয়ত এমনিতেই হবে বা ছেড়ে দেয়াটাকে ইবাদত মনে করে ছেড়ে দেয়া হবে। দ্বিতীয়টি হলে তা হবে বিদআত। কারণ, আল্লাহ যা বৈধ করেছেন তা সে ছেড়ে দিচ্ছে ইবাদত মনে করে। যেমন, কেউ সুতি কাপড় পরিধান করা ছেড়ে দিল, এ ছেড়ে দেয়াটাকে ইবাদত মনে করে কিংবা সুস্বাদু ফল-মূল, রুটি-গোশত ইত্যাদি ছেড়ে দিল অথবা লাগাতার চুপ থাকাকে ইবাদত মনে করে কথা বলা থেকে বিরত থাকল, তাহলে এ কাজগুলো বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحَرِّمُوا طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ﴾
হে মুমিনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে সকল উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করেছেন, তাকে হারাম সাব্যস্ত করো না এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালবাসেন না।’ -সূরা মায়েদা (৫) : ৮৭
ইমামুল মুফাসসিরীন ইবনে জারীর রহ. (মৃ. ৩১০ হি.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
“﴿ لَا تُحَرِّمُوا طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكُمْ ﴾، يعني بالطيبات اللذيذات التي تشتهيها النفوس وتميل إليها القلوب، فتمنعوها إياها كالذي فعله القسيسون والرهبان، فحرموا على أنفسهم النساء والمطاعم الطيبة والمشارب اللذيذة وحبس في الصوامع بعضهم أنفسهم وساح في الأرض بعضهم، يقول تعالى ذكره فلا تفعلوا أيها المؤمنون كما فعل أولئك ولا تعتدوا حد الله الذي حد لكم فيما أحل لكم وفيما حرم عليكم”.
উক্ত আয়াতে طَيِّبَاتِ অর্থ হলো, এমন সুস্বাদু খাবার যা মানুষ পছন্দ করে থাকে এবং তাদের অন্তর যে সকল খাবারের প্রতি আকৃষ্ট থাকে। তারা নিজেদেরকে সেসকল খাবার থেকে বিরত রাখে। যেমন (খ্রীষ্টান) পাদরী ও সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসীরা করেছিল। তারা নিজেদের ওপর নারী, উত্তম খাদ্য ও সুস্বাদু পানীয়কে হারাম করেছিল! তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে গির্জার মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছিল আর কেউ (বৈরাগীদেরর মত) পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত। আল্লাহ তাআলা (একথা স্মরণ করিয়ে) বলছেন, হে মুমিনগণ! তোমরা এরূপ করো না, যেমন তারা করেছে। আর তিনি তোমাদের জন্য যা হালাল করেছেন এবং যা হারাম করেছেন, তোমরা সে সব ব্যাপারে আল্লাহর দেয়া সীমারেখা লঙ্ঘন করো না।’ -তাফসীরে তবারী ৪/৬৩৮ (১২৩৪৮)
আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের নিকৃষ্ট কার্যকলাপ প্রকাশ করে বলেন,
﴿ وَقَالُوا هَذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لَا يَطْعَمُهَا إِلَّا مَنْ نَشَاءُ بِزَعْمِهِمْ وَأَنْعَامٌ حُرِّمَتْ ظُهُورُهَا وَأَنْعَامٌ لَا يَذْكُرُونَ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا افْتِرَاءً عَلَيْهِ سَيَجْزِيهِمْ بِمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ ﴾
‘তারা বলে, এসব গবাদি পশু ও শস্যতে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত আছে। আমরা যাদেরকে ইচ্ছা করব তারা ছাড়া অন্য কেউ এসব খেতে পারবে না এবং কতক গবাদি পশু এমন, যাদের পিঠকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কিছু পশু এমন, (যাদের সম্পর্কে) আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তার যবাইকালে আল্লাহর নাম নেয় না। তারা যে মিথ্যাচার করছে, আল্লাহ শীঘ্রই তার প্রতিফল তাদের দেবেন।’ -সূরা আনআম (৬): ১৩৮
ইবনে কাসীর রহ. (মৃ. ৭৭৪ হি.) ﴿ افْتِرَاءً عَلَيْهِ﴾আয়াতের ব্যাখ্যা করে বলেন,
قوله تعالى﴿ افْتِرَاءً عَلَيْهِ ﴾ أي على الله وكذباً منهم في إسنادهم ذلك إلى دين الله وشرعه فإنه لم يأذن لهم في ذلك ولا رضيه منهم
﴿ افْتِرَاءً عَلَيْهِ ﴾ অর্থ হলো, আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করা। অর্থাৎ মুশরিকদের থেকে যেসকল মিথ্যা (মনগড়া) কার্যকলাপ প্রকাশ পায়, তারা সেগুলোকে আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তের দিকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে (আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করত।) অথচ আল্লাহ তাদেরকে এমন কাজের অনুমতি দেননি এবং (ধর্মের নামে) তাদের এসকল কাজের প্রতি সন্তুষ্টও ছিলেন না।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৩৮৭
সুতরাং আল্লাহ যা হালাল করছেন সেটা হালাল, আর আল্লাহ যা হারাম করবেন সেটা হারাম। কেউ যদি শরঈ দলিল ছাড়া আল্লাহর ইবাদত মনে করে বৈধ কোন জিনিস ছেড়ে দেয়, তাহলে সে আল্লাহর নামে মিথ্যা অপবাদ দিল। বিষয়টি নিম্ন বর্ণিত হাদীস থেকে আরো স্পষ্ট হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.(মৃ. ৩২ হি.) বলেন,
كنا نغزو مع رسول الله صلى الله عليه وسلم وليس لنا شيء، فقلنا ألا نستخصي؟ فنهانا عن ذلك، ثم رخص لنا أن ننكح المرأة بالثوب، ثم قرأ علينا:﴿ يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحَرِّمُوا طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ﴾
আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে অংশ নিতাম; কিন্তু আমাদের সাথে (পরিবার-পরিজন) কিছু ছিল না। তাই আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, (হে আল্লাহর রাসূল!) আমরা কি খাসি হয়ে যাব? তিনি আমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করলেন। অতঃপর (মোহর হিসেবে মাত্র) একটি কাপড় দিয়ে হলেও কোন মেয়েকে বিবাহ করে নেয়ার অনুমতি দেন। তিনি আমাদেরকে এই আয়াত পাঠ করে শুনান: ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে সকল উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করেছেন, তাকে হারাম সাব্যস্ত করো না এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ -সূরা মাইদা (৫) : ৮৭; সহীহ বুখারী (কিতাবুন নিকাহ) ২/৭৫৯, হাদীস ৪৮৮৪
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে ইবাদত যেটুকু প্রমাণিত, সেটাকে কম মনে করা এবং এর চেয়ে বেশি ইবাদতকে অধিক তাকওয়ার বিষয় মনে করা সুন্নাহ পরিপন্থী, সে সম্পর্কে আনাস ইবনে মালেক রাযি. (মৃ. ৯২ হি.) বলেন,
جاء ثلاثة رهط إلى بيوت أزواج النبي صلى الله عليه وسلم يسألون عن عبادة النبي صلى الله عليه وسلم، فلما أُخبروا كأنهم تقالوها، فقالوا : وأين نحن من النبي صلى الله عليه وسلم، قد غفر الله له ما تقدم من ذنبه وما تأخر؟ قال أحدهم: أما أنا فإني أصلي الليل أبداً، وقال آخر:أنا أصوم الدهر ولا أفطر، وقال آخر: أنا أعتزل النساء فلا أتزوج أبداً، فجاء رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال:” أنتم الذين قلتم كذا وكذا، أما والله إني لأخشاكم لله وأتقاكم له، لكني أصوم وأفطر وأصلي وأرقد وأتزوج النساء، فمن رغب عن سنتي فليس مني”
তিন জনের একটি দল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য তাঁর স্ত্রীগণের গৃহে আসলেন। যখন তাদেরকে এ সম্পর্কে জানানো হলো, তখন তারা ইবাদতের পরিমাণ কম মনে করলেন এবং বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমাদের তুলনা হতে পারে না। কারণ, তাঁর আগের ও পরের সব কিছু ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তখন তাদের একজন বললেন, আমি সারা জীবন রাতভর নামাজ আদায় করতে থাকব। আরেকজন বললেন, আমি সব সময় রোযা রাখব, কখনো বাদ দিব না। তৃতীয় জন বললেন, আমি নারীদের থেকে আলাদা থাকব, কখনো বিয়ে করব না। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট এসে (তাদের এসব কথাবার্তা সম্পর্কে জানতে পেরে) বললেন, ‘তোমরাই কি ওই সব লোক যারা এমন এমন কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশি অনুগত; অথচ আমি রোযা রাখি, আবার কখনও তা থেকে বিরতও থাকি। আমি রাতে কিছু সময় নামাজ আদায় করি, কিছু সময় ঘুমাই, আমি নারীদেরকে বিয়েও করেছি। অতএব, যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ -সহীহ বুখারী (কিতাবুন নিকাহ্) ২/৭৫৭, হাদীস ৪৮৭২; সহীহ মুসলিম ১/৪৪৯, হাদীস ১৪০১
তারা এই বৈধ কাজগুলো ছাড়াকে তাকওয়া এবং অধিক ইবাদতের বিষয় ভেবেছিলেন এবং সুন্নাহ সম্মত পরিমাণকে কম মনে করেছিলেন। অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলকে কম মনে করেছিলেন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এই মনোভাবের নিন্দা করে কঠোরভাবে সতর্ক করলেন। সুন্নাহ সম্মত আমলের গুরুত্বের বিষয়টিকে ইবনে মাসঊদ (রাযি) সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। ইবনে মাসঊদ (রাযি) বলেন,
اَلاِقْتِصَادُ فِيْ السُّنَّةِ أَحْسَنُ مِنَ الاِجْتِهَادِ فِيْ الْبِدْعَةِ
“বিদআতি পদ্ধতিতে অনেক আমল করার চেয়ে সুন্নাতের ওপর অল্প আমল করা অধিক উত্তম।” -হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। মুসতাদরাকে হাকেম ১/১৮৪, হাদীস ৩৫২
বিদআতমুক্ত এবং সুন্নাহসম্মত অল্প আমলে অনেক বরকত। এ প্রসঙ্গে তাবিঈ হাসান বসরী রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عَمَلٌ قَلِيْلٌ فِيْ سُنَّةٍ خَيْرٌ مِنْ عَمَلٍ كَثِيْرٍ فِيْ بِدْعَةٍ وَمَنِ اسْتَنَّ بِيْ فَهُوَ مِنِّيْ وَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ
সুন্নাতের মধ্যে অল্প আমল করা বিদআতের মধ্যে অনেক আমল করার চেয়ে উত্তম। যে আমার পদ্ধতির অনুসরণ করবে সে আমার উম্মত, আমার সাথে সম্পর্কিত। আর যে আমার পদ্ধতি (সুন্নাহ) অপছন্দ করবে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।তাবেয়ীহাসান বসরী পর্যন্ত হাদীসটির সনদ মুরসালরূপে গ্রহণযোগ্য।-মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ১১/২৯১, হাদীস ২০৫৬৮
মোটকথা, বিদআত শুধু নতুন কোনো কাজ সৃষ্টির মাধ্যমে হয় না বরং ইবাদতের উদ্দেশ্যে বৈধ কোনো কাজ ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমেও বিদআত হয়। অনেকে বিষয়টি খেয়াল করেন না।
চতুর্থ মূলনীতি : নববী জামানায় প্রয়োজনীয় উপলক্ষ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সেই বিষয়ে কোনো বিধান না দেওয়া
উক্ত মূলনীতি সম্পর্কে আল্লামা শাতিবী রহ. চমৎকার আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন,
أن سكوت الشارع عن الحكم على ضربين: أحدهما:أن يسكت عنه لأنه لا داعية له تقتضيه، ولا موجب يقدر لأجله؛ كالنوازل التي حدثت بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم؛ فإنها لم تكن موجودة ثم سكت عنها مع وجودها، وإنما حدثت بعد ذلك؛ فاحتاج أهل الشريعة إلى النظر فيها وإجرائها على ما تقرر في كلياتها، وما أحدثه السلف الصالح راجع إلى هذا القسم؛ كجمع المصحف، وتدوين العلم، وتضمين الصناع، وما أشبه ذلك مما لم يجر له ذكر في زمن رسول الله صلى الله عليه وسلم، ولم تكن من نوازل زمانه، ولا عرض للعمل بها موجب يقتضيها؛ فهذا القسم جارية فروعه على أصوله المقررة شرعًا بلا إشكال؛ فالقصد الشرعي فيها معروف من الجهات المذكورة قبل.والثاني: الشارع؛ إذا فهم من قصده الوقوف عند ما حدّ هنالك، لا الزيادة عليه ولا النقصان منه…..وقد احتوت علىأن يسكت عنه وموجبه المقتضي له قائم، فلم يقرر فيه حكم عند نزول النازلة زائد على ما كان في ذلك الزمان؛ فهذا الضرب: السكوت فيه كالنص على أن قصد الشارع أن لا يزاد فيه ولا ينقص؛ لأنه لما كان هذا المعنى الموجب لشرع الحكم العملي موجودًا ثم لم يشرع الحكم دلالة عليه؛ كان ذلك صريحًا في أن الزائد على ما كان هنالك بدعة زائدة، ومخالفة لما قصده.
অনুবাদের সারাংশ হলো, শরীয়ত প্রণেতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল বিষয়ের হুকুম বর্ণনা থেকে বিরত থেকেছেন, তা দু’প্রকার। প্রথম প্রকার হল, নববী যুগে সে বিধানের কোনো প্রয়োজনীয়তা ও উপলক্ষ সৃষ্টি হয়নি বিধায় শরীয়ত সে সম্পর্কে কোনো বিধান দেয়া থেকে বিরত থাকে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর এমন কিছু উপলক্ষ সৃষ্টি হয়, যা ওই হুকুমের প্রয়োজনীয়তাকে অনিবার্য করে তুলে। এই প্রকারের যাবতীয় শাখাপ্রশাখা শরীয়তের সুনির্ধারিত মূলনীতির ওপর প্রয়োগ করতে হবে। তখন চিন্তা ভাবনা ও কিয়াস ইত্যাদির মাধ্যমে সে সকল মূলনীতির আলোকে নতুন উদ্ভূত বিষয়ের হুকুম জানা যাবে। দ্বিতীয় প্রকার হল, ইসলামী শরীআহ নির্দিষ্ট কোনো বিধান দেওয়া থেকে বিরত ছিল। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সে বিধান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও উপলক্ষ বিদ্যমান ছিল। তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর তাঁর যুগের বিধানটি যেভাবে ছিল তার সাথে অতিরিক্ত কোনো কিছু যুক্ত করা যাবে না। শরীয়ত প্রণেতার চুপ থাকার এই প্রকারটি যেন (শরীয়তের পক্ষ থেকে) স্পষ্ট বার্তা যে, শরীয়ত প্রণেতার ইচ্ছা হলো, এই বিধানে কোনো কমবেশি করা যাবে না। কেননা, নতুন কর্মবিষয়ক বিধান দেওয়ার মত কার্যকারণ থাকা সত্ত্বেও শরীয়ত এমন কোনো নির্দেশনা দিল না, যা এই কাজটাকে প্রমাণিত করে। তাই এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নববী যুগে শরিআতের বিধান যেভাবে ছিল তার চেয়ে বেশি করা বিদআত এবং শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য পরিপন্থী। -মুওয়াফাকাত (الموافقات), শাতিবী ৩/১৫৬–১৫৮
উক্ত বিষয়টিকে বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে আরো ফুটিয়ে তুলেছেন ইবনে রজব হাম্বলী রহ.। তিনি বলেন,
وَرُوِيَ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ: إِنْ كَانَتْ هَذِهِ بِدْعَةٌ، فَنِعْمَتُ الْبِدْعَةُ. وَرُوِيَ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ، قَالَ لَهُ: إِنَّ هَذَا لَمْ يَكُنْ، فَقَالَ عُمَرُ: قَدْ عَلِمْتُ، وَلَكِنَّهُ حَسَنٌ، وَمُرَادُهُ أَنَّ هَذَا الْفِعْلَ لَمْ يَكُنْ عَلَى هَذَا الْوَجْهِ قَبْلَ هَذَا الْوَقْتِ، وَلَكِنَّ لَهُ أُصُولٌ مِنَ الشَّرِيعَةِ يُرْجَعُ إِلَيْهَا، فَمِنْهَا أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَحُثُّ عَلَى قِيَامِ رَمَضَانَ، وَيُرَغِّبُ فِيهِ، وَكَانَ النَّاسُ فِي زَمَنِهِ يَقُومُونَ فِي الْمَسْجِدِ جَمَاعَاتٍ مُتَفَرِّقَةً وَوُحْدَانًا، وَهُوَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى بِأَصْحَابِهِ فِي رَمَضَانَ غَيْرَ لَيْلَةٍ، ثُمَّ امْتَنَعَ مِنْ ذَلِكَ مُعَلِّلًا بِأَنَّهُ خَشِيَ أَنْ يُكْتَبَ عَلَيْهِمْ، فَيَعْجِزُوا عَنِ الْقِيَامِ بِهِ، وَهَذَا قَدْ أُمِنَ بَعْدَهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،…. وَمِنْهَا أَنَّهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ بِاتِّبَاعِ سُنَّةَ خُلَفَائِهِ الرَّاشِدِينَ، وَهَذَا قَدْ صَارَ مِنْ سُنَّةِ خُلَفَائِهِ الرَّاشِدِينَ، فَإِنَّ النَّاسَ اجْتَمَعُوا عَلَيْهِ فِي زَمَنِ عُمَرَ وَعُثْمَانَ وَعَلِيٍّ.
‘ওমর রাযি. থেকে (মসজিদে জামাতবদ্ধভাবে তারাবীহ’র নামাজ আদায় করার বিষয়ে) বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, এটি যদি বিদআত হয়, তাহলে তা কতই না উত্তম বিদআত! উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি তখন ওমর (রাযি.)-কে বললেন, এটি তো আগে ছিল না। তখন ওমর (রাযি.) বললেন, তা আমি জানি। তবে এটি উত্তম হবে। ওমর (রাযি.) এর উদ্দেশ্য হলো, এই কাজটি যদিও ইতঃপূর্বে এইভাবে ছিল না। কিন্তু শরীয়তের বেশ কিছু উসূলের আলোকেই বর্তমানে এইরূপে করা হচ্ছে। সেগুলো নিম্নরূপ-
ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামে রমাযান বা তারাবীহ’র নামাযের প্রতি লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর সময় লোকজন মসজিদে বিভিন্ন ছোট ছোট জামাতে তারাবীহ’র নামাজ আদায় করতেন। আর কেউ কেউ একাকী আদায় করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে একাধিক রাতে তারাবীহ’র নামাজ জামাতে আদায় করেছেন। পরবর্তীতে তিনি তারাবীহ’র নামাজ জামাতে আদায় করা থেকে এই আশংকায় এই আশংকায় বিরত থাকেন যে, লোকজনের ওপর তা ফরয হয়ে যেতে পারে। তখন তারা তা (নিয়মিত) আদায় করতে পারবে না। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর (ফরজ হওয়ার) সে শঙ্কা আর থাকেনি, …।
খ) আরো একটি মূলনীতি হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ’র অনুসরণ করার আদেশ করেছেন। আর তারাবীহ’র নামাজ খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ হিসেবে পরিণত হয়েছে। কারণ, সে সময়ের মুসলিমগণ তথা সকল সাহাবি ও তাবেঈ ওমর, ওসমান ও আলী (রযিআল্লাহু আনহুম) এর জামানায় এভাবে তারাবীহ’র নামাজ আদায় করার ওপর একমত হয়েছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় ছিল না কিন্তু পরবর্তী সময় শরঈ উসূলের আলোকে সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন, জুমআর প্রথম আজান, কুরআন কারিমকে এক মলাটের মধ্যে একত্রিত করা। সে প্রসঙ্গে ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন,
وَمِنْ ذَلِكَ: أَذَانُ الْجُمُعَةِ الْأَوَّلُ، زَادَهُ عُثْمَانُ لِحَاجَةِ النَّاسِ إِلَيْهِ، وَأَقَرَّهُ عَلِيٌّ، وَاسْتَمَرَّ عَمَلُ الْمُسْلِمِينَ عَلَيْهِ، وَرُوِيَ عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ قَالَ: هُوَ بِدْعَةٌ، وَلَعَلَّهُ أَرَادَ مَا أَرَادَ أَبُوهُ فِي قِيَامِ رَمَضَانَ.
وَمِنْ ذَلِكَ جَمْعُ الْمُصْحَفِ فِي كِتَابٍ وَاحِدٍ، تَوَقَّفَ فِيهِ زَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ وَقَالَ لِأَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ: كَيْفَ تَفْعَلَانِ مَا لَمْ يَفْعَلْهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ ثُمَّ عَلِمَ أَنَّهُ مَصْلَحَةٌ، فَوَافَقَ عَلَى جَمْعِهِ، وَقَدْ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْمُرُ بِكِتَابَةِ الْوَحْيِ، وَلَا فَرْقَ بَيْنَ أَنْ يُكْتَبَ مُفَرَّقًا أَوْ مَجْمُوعًا، بَلْ جَمْعُهُ صَارَ أَصْلَحَ.
وَكَذَلِكَ جَمْعُ عُثْمَانَ الْأُمَّةَ عَلَى مُصْحَفٍ وَاحِدٍ وَإِعْدَامُهُ لِمَا خَالَفَهُ خَشْيَةَ تَفَرُّقِ الْأُمَّةِ، وَقَدِ اسْتَحْسَنَهُ عَلِيٌّ وَأَكْثَرُ الصَّحَابَةِ، وَكَانَ ذَلِكَ عَيْنَ الْمَصْلَحَةِ.
(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের জামানায় ছিল না কিন্তু পরবর্তী সময় শরঈ উসূলের আলোকে সাব্যস্ত হয়েছে, তার দ্বিতীয় উদাহরণ হলো) জুমআর প্রথম আজান। উসমান (রাযি.) লোকজনের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে তা চালু করেছেন। আর আলী (রাযি.) এটিকে অনুমোদন করেছেন। যুগ পরম্পরায় মুসলিমদের আমল এর ওপর চলে এসেছে। যদিও ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি এটাকে বিদআত বলেছেন। সম্ভবত, তাঁর পিতা ওমর (রাযি.) রমযানের তারাবীহ’র বিষয় বিদআত শব্দ ব্যবহার করে যা উদ্দেশ্য নিয়েছেন (অর্থাৎ বিদআতের শাব্দিক অর্থ) তিনিও তাই উদ্দেশ্য নিয়েছেন।
(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের জামানায় ছিল না কিন্তু পরবর্তী সময় শরঈ উসূলের আলোকে সাব্যস্ত হয়েছে তার তৃতীয় উদাহরণ হলো) কুরআন কারিমকে এক কিতাবে তথা এক মলাটের মধ্যে একত্রিত করা। প্রথম পর্যায়ে যায়েদ ইবনে সাবিত (রযি.) ইতস্তত করছিলেন এবং আবু বকর ও ওমর (রাযিআল্লাহু আনহুমা)-কে বললেন, আপনারা এমন কাজ কিভাবে করছেন, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম করেননি? অতঃপর (তাঁদের উভয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর) তাঁর বুঝে এসেছে যে, এতেই কল্যাণ ররেছে। তাই তিনি এক মলাটের অধীনে কুরআন একত্রিত করার বিষয়ে তাঁদের সাথে একমত হলেন। আর (এ ক্ষেত্রে মূলনীতি ছিল) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো নিয়মিত ওহী লেখার আদেশ করতেন। আর বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন বস্তুতে লিখে রাখা আর একত্রে (এক মলাটের অধীনে) লিখে রাখার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং একসাথে এক কিতাবে জমা করাটা সংরক্ষণের জন্য অধিকতর উপযোগী।
(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের জামানায় ছিল না, কিন্তু পরবর্তী সময় শরঈ উসূলের আলোকে সাব্যস্ত হয়েছে তার চতুর্থ উদাহরণ হলো, কুরআন নিয়ে) উম্মাহর মাঝে বিভেদ সৃষ্টির আশঙ্কায় ওসমান (রাযি.) কর্তৃক কুরআন কারিমের একটি মাত্র মুসহাফ রেখে, অন্য সকল মুসহাফ বিলুপ্ত করে দেওয়া; আলী (রাযি.) সহ অধিকাংশ সাহাবি এটিকে উত্তম কাজ বলে গণ্য করলেন। আর এটাই ছিল উম্মাহর যথাযথ কল্যাণ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় ছিল না কিন্তু পরবর্তী সময় শরঈ উসূলের আলোকে সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন, যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং মানুষকে নিয়মিতভাবে সপ্তাহ বা দিনের নির্দিষ্ট সময় ওয়াজ নসীহত করা। সে প্রসঙ্গে ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন,
وَكَذَلِكَ قِتَالُ مَنْ مَنَعَ الزَّكَاةَ تَوَقَّفَ فِيهِ عُمَرُ وَغَيْرُهُ حَتَّى بَيَّنَ لَهُ أَبُو بَكْرٍ أَصْلَهُ الَّذِي يَرْجِعُ إِلَيْهِ مِنَ الشَّرِيعَةِ، فَوَافَقَهُ النَّاسُ عَلَى ذَلِكَ. وَمِنْ ذَلِكَ الْقَصَصِ، وَقَدْ سَبَقَ قَوْلُ غُضَيْفِ بْنِ الْحَارِثِ: إِنَّهُ بِدْعَةٌ، وَقَالَ الْحَسَنُ: الْقَصَصُ بِدْعَةٌ، وَنِعْمَتِ الْبِدْعَةُ، كَمْ مِنْ دَعْوَةٍ مُسْتَجَابَةٍ، وَحَاجَةٍ مَقْضِيَّةٍ، وَأَخٍ مُسْتَفَادٍ. وَإِنَّمَا عَنَى هَؤُلَاءِ بِأَنَّهُ بِدْعَةٌ الْهَيْئَةَ الِاجْتِمَاعِيَّةَ عَلَيْهِ فِي وَقْتٍ مُعَيَّنٍ، فَإِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ لَهُ وَقْتٌ مُعَيَّنٌ يَقُصُّ عَلَى أَصْحَابِهِ فِيهِ غَيْرَ خُطْبَتِهِ الرَّاتِبَةِ فِي الْجُمَعِ وَالْأَعْيَادِ، وَإِنَّمَا كَانَ يُذَكِّرُهُمْ أَحْيَانًا، أَوْ عِنْدَ حُدُوثِ أَمْرٍ يَحْتَاجُ إِلَى التَّذْكِيرِ عِنْدَهُ، ثُمَّ إِنَّ الصَّحَابَةَ اجْتَمَعُوا عَلَى تَعْيِينِ وَقْتٍ لَهُ كَمَا سَبَقَ عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ أَنَّهُ كَانَ يُذَكِّرُ أَصْحَابَهُ كُلَّ يَوْمِ خَمِيسٍ. “
(পঞ্চম উদাহরণ হলো,) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। প্রথম পর্যায়ে ওমর (রাযি.)সহ কোনো কোনো সাহাবি ইতস্তত করলেন। একপর্যায় আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) তাঁদেরকে এক্ষেত্রে শরঈ মূলনীতি বুঝিয়ে দিলেন তখন তারা তাঁর সাথে সে বিষয় একমত হলেন।
ষষ্ঠ উদাহরণ হলো, মানুষকে (সপ্তাহ বা দিনের নির্দিষ্ট সময়) ওযাজ নসীহত করা। গুদাইফ বিন হারেস (রাযি.) এর কথা গিয়েছে যে, ‘তিনি এটাকে বিদআত বলেছেন।’ আর হাসান বাসরি রহ. বলেন, ‘(মানুষকে সপ্তাহ বা দিনের নির্দিষ্ট সময়) ওযাজ নসীহত করা বিদআত। তবে তা কতই না উত্তম বিদআত, কারণ কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক আলোচনার দ্বারা কত মানুষ হেদায়াতের দিশা পায়, তাদের কত (দ্বীনী বিষয়) জানার প্রয়োজন মিটে এবং কত ভাই থেকে (দ্বীনী বিষয়ে) উপকৃত হওয়া যায়।’
যারা এটাকে বিদআত বলেছেন তারা বিদআত দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন, (নিয়মিতভাবে সপ্তাহ বা দিনের নির্দিষ্ট সময়) লোকজনকে নসীহত করার জন্য একত্রিত করা। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম জুমআ ও ঈদের নামাযের নিয়মিত খুতবা ছাড়া নির্দিষ্ট সময় তাঁর সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বয়ান করতেন না। তবে তিনি কখনো কখনো তাদেরকে উপদেশ দিতেন বা দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতেন। অথবা নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে, যে প্রসঙ্গে লোকজনকে সতর্ক করা জরুরী হলে সতর্ক করতেন। অতঃপর সাহাবিগণ সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময় ওয়াজ করার বৈধতার ওপর একমত হলেন। যেমন ইবনে মাসউদ (রাযি.) প্রতি বৃহস্পতিবার বয়ান করতেন। (এরপর ইবনে রজব হাম্বলি এটার পক্ষে অন্যান্য সাহাবির ঘটনা বা আমল উল্লেখ করেন।)’ -জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম পৃ. ৩২৫- ৩২৬, হাদীস ২৮
পঞ্চম মূলনীতি: শরীয়ত কোন একটি বিষয়কে একটি স্থানের জন্য নির্ধারিত করেছে। সেটিকে ভিন্ন স্থানে ব্যবহার করা।
শরীয়ত কোন একটি বিষয়কে একটি স্থানের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছে। কেউ যদি নিজ প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ে সেটিকে ভিন্নস্থানে ব্যবহার করে, তাহলে তা হবে বিদআত।
যেমন, একটি উদাহরণ হল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমআর নামাজ ছাড়া অন্যান্য নামাযের জন্য আযান দেওয়া। সবাই জানে যে, শরীয়ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমআর নামাজ ছাড়া অন্য কোনো নামাযের জন্য (যেমন; দু’ঈদের নামাজ, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্য গ্রহণের নামাজ, বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ ও জানাযা ও তারাবীহ’র নামাজ ইত্যাদির জন্য) আযান ও ইকামাতের অনুমতি দেয়নি। এখন কেউ যদি ইজতেহাদ করে যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ঘোষণা দেয়ার জন্য যেমন আযানের দরকার, তেমনি এসকল নামাজেও আযানের দরকার। সুতরাং এসকল নামাজেও আযান দেওয়া উচিত। তাহলে তার এই ইজতেহাদ সুস্পষ্ট ভুল সাব্যস্ত হবে। কারণ, শরীয়ত ফরয নামাজ ছাড়া অন্য কোনো নামাযের জন্য আযানের অনুমতি দেয়নি। তাছাড়া এসকল নামাযে আযান দেওয়ার যে হেকমত ও কল্যাণ এই ব্যক্তি ঠিক করেছে, তা যদি গ্রহণযোগ্য হত, তাহলে শরীয়ত আমাদেরকে সেসকল স্থানেও আযানের অনুমতি দিত।
অথবা কেউ ইজতেহাদ করলো, হাদীসে এসেছে- আযান শুনলেই শয়তান পালায়। আর যেহেতু মৃত ব্যক্তি থেকে শয়তানকে তাড়ানো জরুরী, তাই দাফনের পর কবরেও আজান দেওয়া। তাহলে এই ইজতেহাদও সম্পূর্ণ ভুল সাব্যস্ত হবে। কারণ, প্রথমত শয়তানের প্ররোচনা তো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত থাকে। কেউ মারা গেলে তার সাথে শয়তানের কি কাজ? দ্বিতীয়ত, যদি এই হেকমত ও কল্যাণ-চিন্তা সঠিক হত, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরামেরও বুঝে আসতো। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে কবরে আজান দেওয়া প্রমাণিত নেই। একারণে, ফোকাহাগণ এটকে বিদআত বলেছেন। এভাবে আরো আনেক উদাহরণ হতে পারে।
মোটকথা, শরীয়ত যে কাজের জন্য যে স্থান নির্ধারণ করেছে, সে স্থান বাদ দিয়ে অন্য স্থানে সে কাজ করা বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে।
ষষ্ঠ মূলনীতি : শরীয়ত যে কাজকে শর্তহীন রেখেছে, সেখানে নিজের পক্ষ থেকে শর্ত যুক্ত করা
ক) যেমন, শরীয়ত কবর যিয়ারতের জন্য কোনো সময় নির্ধারণ করে দেয়নি। কিন্তু কেউ যদি কোনো বুজর্গের কবর যিয়ারতের জন্য একটা সময় নির্ধারণ করে নেয় এবং এটাকে জরুরী মনে করে, তাহলে তা বিদআত হবে। কারণ, মূল যিয়ারত তো জায়েয কিন্তু সেখানে সময় নির্ধারণ সালাফগণ থেকে পাওয়া যায় না। বিদআত এভাবে হল যে, মূল কাজটা তো জায়েয কিন্তু এটার জন্য সময় নির্ধারিত করাটা হল বিদআত।
খ) তাহাজ্জুদ নামায, এটা সপ্তাহের যে কোনো রাতে, যে কোনো স্থানে পড়া যায়। এখন কেউ যদি (শরঈ কোনো দলিল ছাড়া) এটাকে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন বা কোনো নির্দিষ্ট স্থানের সাথে আবদ্ধ করে ফেলে। যেমন, প্রতি মঙ্গলবার অমুক মসজিদ বা খানকাহে তাহাজ্জুদ পড়লে বেশি ছাওয়াব। সুতরাং সপ্তাহের সে রাত বা নির্দিষ্ট স্থানে তাহাজ্জুদ পড়াকে ফযীলতের বিষয় মনে করার কারণে তা বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে। এখানেও বিদআত এভাবে হল যে, মূল কাজটা তো জায়েয কিন্তু এর জন্য সময় বা স্থান নির্ধারিত করাটা হল বিদআত। উক্ত মূলনীতি দ্বিতীয় মূলনীতির অধীনেও আসতে পারে।
সপ্তম মূলনীতি : শরীয়ত যে ইবাদত যে বিশেষ অবস্থার সাথে অনুমোদন করেছে তার মধ্যে পরিবর্তন করা
শরীয়ত যে ইবাদত যে বিশেষ অবস্থার সাথে অনুমোদন করেছে সেটাকে সেভাবে পালন করা জরুরী। তার অবস্থার মধ্যে কোনো ধরণের পরিবর্তন হারাম ও বিদআত।
ক) যেমন, দিনের বেলা জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে শরীয়ত আস্তে কিরাত পড়া অনুমোদন করেছে। আর জুমআ ও দু’ঈদের নামাজসহ রাতের নামাযে জোরে কিরাত পড়াকে অনুমোদন করেছে। এখন কেউ যদি জোহর-আসরে জোরে ক্বেরাত পড়ে, তাহলে তার এ কাজ নাজায়েয ও বিদআত হবে।
খ) যে নামাজগুলোতে ক্বেরাত জোরে পড়া হয় সেখানেও ছানা, আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ আস্তে পড়তে হয়। এখন কেউ যদি এগুলোও জোরে পড়া শুরু করে, তাহলে তা নাজায়েয বা বিদআত হবে। আনাস (রাযি.) বলেন-
صَلَّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَأَبِى بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ فَلَمْ أَسْمَعْ أَحَدًا مِنْهُمْ يَقْرَأُ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ.
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর (রাযি.), ওমর (রাযি.) ও উসমান (রাযি.)-এর পিছনে নামাজ পড়েছি; কিন্তু তাদের কাউকে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তে শুনিনি ।” -সহীহ মুসলিম ১/১৭২ (৩৯৯)
আনাস (রাযি.) থেকে আরো বর্ণিত-
أَنَّ النِّبيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ وَأَبَاْ بَكَرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهْمَاْ كَاْنُوْا يَفْتَتِحُوْنَ الصَّلَاْةَ بِالْحَمْدِ لِلّهِ رَبِّ الْعَاْلَمِيْنَ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর (রাযি.) ও ওমর (রাযি.) الحمد لله رب العالمين দ্বারা নামায (ক্বেরাত) শুরু করতেন ।” -সহীহ বুখারী ১/১০৩ (৭৩৪)
ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন-
وَالْعَمَلُ عَلَيْهِ عِنْدَ أَكْثَرِ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَصْحَاْبِ النِّبيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مِنْهُمْ أَبُوْ بَكْرٍ وَ عَمَرُ وَعَلِيٌّ وَ غَيْرُهُمْ وَ مَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ التَّاْبِعِيِّ. وَبِه يَقُوْلُ الثَّوْرِيُّ وَ ابْنُ الْمُبَاْرَكِ وَأحْمَدُ وَ إِسْحَاْقُ، لَاْيَرَوْنَ أَنْ يَجْهَرَ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ، قَاْلُوْا : وَيَقُوْلُهَاْ فِيْ نَفْسِهِ.
“নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সাহাবীর আমল এরূপ ছিল। যাদের মধ্যে রয়েছেন আবু বকর (রাযি.), ওমর (রাযি.) ও উসমান (রাযি.), আলী (রাযি.) এবং অন্যান্য সাহাবী। তাদের পর তাবেঈগণও এই নিয়ম অনুসরণ করেছেন। সুফিয়ান ছাওরী (রহ.), ইবনুল মুবারক (রহ.), ইমাম আহমাদ (রহ.), ইসহাক (রহ.) কেউই উচ্চস্বরে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ার কথা বলেননি। তারা সবাই বলেছেন, ‘বিসমিল্লাহ’ অনুচ্চস্বরে পড়া হবে । -জামে তিরমিযী, ১/৫৭
অষ্টম মূলনীতি : যে কাজ শরীয়ত একাকী আদায় করা অনুমোদন করেছে তা সম্মিলিতভাবে আদায় করা
যেমন, ফরয নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা হয় এবং এটি কাম্য। কিন্তু নফল নামাজ আলাদা আলাদা ভাবে আদায় করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তাই নফল নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা মাকরুহ ও বিদআত। এ কারণে (রমযানের কিয়ামুল লাইল বা তারাবীহের নামাজ ছাড়া) তাহাজ্জুদের নামাজ, শবে বরাত, শবে মেরাজ, শবে কদরের নামাজের জন্য মসজিদে একত্রিত হওয়া এবং সম্মিলিতভাবে সে নামাজগুলো আদায় করা বিদআত।
নবম মূলনীতি : মাওযু বা জাল হাদীসের ওপর ভিত্তি করে কোনো আমল করা
মাওযু বা জাল হাদীসের ভিত্তিতে কোনো আমল করা বিদআত। কারণ, যে কোনো ইবাদত, ইবাদত হওয়ার জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে অনুমোদন লাগবে। আর জাল হাদীস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ না। সুতরাং সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত না হওয়ায় বিদআত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। আমাদের সমাজে ইবাদত হিসেবে এমন বহুকাজ মানুষ করে থাকে, যেগুলোর ভিত্তি জাল হাদীস ছাড়া আর কিছুই নয়। এজন্য যে কোনো আমল করার পূর্বে আমাদের জেনে নেওয়া কর্তব্য, আমাদের সেই আমলটি কি নির্ভরযোগ্য হাদীস ও সুন্নাহ নির্ভর, না জাল হাদীস নির্ভর?
এখানে বিদআত চিহ্নিতকরণের নয়টি মূলনীতি উল্লেখ করা হল। এর বাহিরেও আরও মূলনীতি রয়েছে। তবে উপরিউক্ত মূলনীতিগুলো কেউ যদি ভালোভাবে বুঝে নিতে পারে, তাহলে বাকিগুলো বুঝে নেয়া তার জন্য সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে, যে কোনো কাজ ইবাদত হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য শরঈ অনুমোদন লাগবে। এরপর সে ইবাদতটি কবুল হওয়া দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক. ইবাদতটি ইখলাসের সাথে অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করতে হবে। দুই. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক করতে হবে। এর যে কোনো একটিতে ত্রুটি দেখা দিলে, সে কাজটি ত্রুটিযুক্ত হয়ে পরিত্যাজ্য হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
চতুর্থ অধ্যায়
বিদআত থেকে পরিত্রাণের উপায়
যে সব উপায় অবলম্বন করলে আমাদের জন্য বিদআত থেকে বাঁচা থাকা সম্ভব হবে তা নিম্নরূপ,
ক) কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা
খ) সাহাবায়ে কিরামের পথ-পদ্ধতি ও আদর্শের অনুসরণ করা
গ) বিশেষত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ ও পথ আঁকড়ে ধরা
নিম্নে এ বিষয়গুলো স্ববিস্তারে পেশ করা হচ্ছে-
ক) কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা
১. আল্লাহ তাআলা বলেন,
” يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا “
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা ‘উলূল আমর’ তাদেরও। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তোমরা তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট পেশ করো। যদি তোমরা পরকালে বিশ্বাসী হও। এটাই উৎকৃষ্টতর এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ।’ -সূরা নিসা (৪) : ৫৯
২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
يا ايها الناس! إني قد تركت فيكم ما إن اعتصمتم به فلن تضلوا أبدا : كتاب الله وسنة نبيه.
হে লোকসকল! আমি তোমাদের কাছে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি সে দুটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ, তাহলে কখনো বিপথগামী হবে না। তা হল, আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। -আলমুসতাদরাক ১/১৭১, হাদীস ৩১৮ (হাকিম রহ. বলেন, এই হাদীসের সকল বর্ণনাকারী ছেক্বাহ। হাফেয যাহাবিও অনুরূপ বলেছেন।)
খ) সাহাবায়ে কিরামের পথ-পদ্ধতি ও আদর্শের অনুসরণ করা
১. তাবিঈ মায়মূন বিন মিহরান রহ.(মৃ. ১১৭ হি.) বলেন, আমাকে ইবনে আব্বাস (মৃ.৬৮ হি.) বলেন,
“احْفَظْ عَنِّي ثَلَاثًا: إِيَّاكَ وَالنَّظَرَ فِي النُّجُومِ فَإِنَّهُ يَدْعُو إِلَى الْكهَانَةِ، وَإِيَّاكَ وَالْقَدَرَ فَإِنَّهُ يَدْعُو إِلَى الزَّنْدَقَةِ، وَإِيَّاكَ وَشَتَمَ أَحَدٍ مِنْ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيُكِبَّكَ اللَّهُ فِي النَّارِ عَلَى وَجْهِكَ “
তিনটা বিষয় আমার থেকে মুখস্থ করে নাও। তারাকারাজি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা থেকে দূরে থাকো, কেননা তা তোমাকে ভাগ্য গণনা বা ভবিষ্যদ্বাণীর দিকে নিয়ে যাবে। তাকদীর নিয়ে বেশি চিন্তা ফিকির থেকে দূরে থাকো। কেননা, তা তোমাকে ‘যানদাকা’ (ঈমানের ছদ্মাবরণে কুফরি পোষণ) বা নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাবে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কোনো সাহাবীকে গালমন্দ করা থেকে বেঁচে থেকো। অন্যথায় আল্লাহ তোমাকে অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। -শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.) ৪/৭০০ (১১৩৪) (বর্ণনাটি সহীহ।)
২. ইমাম আহমাদ রহ. (মৃ. ২৪১ হি.) বলেন,
” أصُول السّنة عندنَا التَّمَسُّك بِمَا كَانَ عَلَيْهِ أَصْحَاب رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم والاقتداء بهم “
আমাদের নিকট সুন্নাহ’র মূলনীতি হলো, সাহাবায়ে কেরাম যে পথ ও পদ্ধতির ওপর ছিলেন তা আঁকড়ে ধরা এবং তাঁদের অনুসরণ করা। -উসূলুস সুন্নাহ, ইমাম আহমাদ ১/১৪
গ) বিশেষত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ ও পথ আঁকড়ে ধরা
ইরবায ইবনে সারিয়া (রাযি.) বলেন,
صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصُّبْحَ ذَاتَ يَوْمٍ، ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا، فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ، وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ، فَقَالَ قَائِلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ، فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا؟ فَقَالَ: أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا، وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
একদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। এরপর আমাদের দিকে ফিরে এক মর্মস্পর্শী নসীহত করলেন। এতে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হল এবং অন্তর প্রকম্পিত হল। একজন আরজ করলেন, আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায় দানকারীর উপদেশ। (যদি বিষয়টি এমন হয়) তাহলে আপনি আমাদের (জরুরী বিষয়ের) কিছু উপদেশ প্রদান করুন! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদেরকে অসীয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার এবং (খলীফা বা আমীর) হাবশী গোলাম হলেও তার আনুগত্য করার। কারণ, আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা শীঘ্রই উম্মতের মধ্যে নানা রকমের মতভিন্নতা দেখতে পাবে। (বিভিন্ন রকমের বিদআত, শ্রেণী বিভক্তি উম্মতকে খণ্ড-বিখণ্ড করে রাখছে) তখন তোমাদের করণীয় হবে, আমার সুন্নাহ ও হেদায়তপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধারণ করবে। (দীনের ব্যাপারে কিতাব ও সুন্নাহর বাহিরে) নতুন নতুন তরীকা ও পদ্ধতি থেকে দূরে থাকবে। কারণ, (দ্বীনের মধ্যে) সকল নবউদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত। আর সকল বিদআতই গুমরাহী। -ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। -মুসনাদে আহমাদ ২৮/৩৭৫, হাদীস ১৭১৪৫,তাহকীক- শায়খ শুআাইব আলআরনাউত; জামে তিরমিযী ২/ ৯৬; সুনানে আবু দাউদ ২/৬৩৫; সুনানে ইবনে মাজাহ ১/৫;আল-মুসতাখরাজ আলাস সহীহাইন ১/৩৬-৩৭
হাফেয আবু নুয়াইম আসফাহানী রাহ.(মৃত্যু. ৪৩০ হি.) এ হাদীসের নির্দেশনা সম্পর্কে বলেন-
فتلقت الهداة العقلاء وصية نبيهم صلى الله عليه وسلم بالقبول ولزموا التوطن على سنته وسنة الهداة المرشدة من الخلفاء، فلم يرغبوا عنه بل علموا أن الثبوت عليه غير ممكن إلا بتتبع ما سنه عليه السلام وسنه بعده أئمة الهدى الذين هم خلفائه في أمته فتركوا الاشتغال بهواجس النفوس وخواطر القلوب، وما يتولد من الشبهات التي تولد آراء النفوس وقضايا العقول خوفا من أن يزيغوا عن المحجة التي فارقهم عليها رسول الله صلى الله عليه وسلم الذي شبه ليلها بنهارها مع ما جاءهم عن الله تعالى من الوعيد البليغ المصرح بنفي الإيمان عما خالفه عليه السلام أوطعن على أحكامه ولم تطب نفسه بالتسليم له. انتهى
হেদায়েতের দিশারী প্রাজ্ঞজনরা তাঁদের নবীর এই অসীয়তকে শিরোধার্য করেছেন এবং তাঁর সুন্নাহ ও খলীফাগণের সুন্নাহর ওপর নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখেছেন, যারা ছিলেন হেদায়েতপ্রাপ্ত ও হেদায়েতের দিশারী। তা থেকে বিমুখ হননি। বরং তারা নিশ্চিত জেনেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সুন্নাহ জারি করেছেন এবং তাঁর পর হেদায়েতের ইমামগণ যে সুন্নাহ জারি করেছেন, যাঁরা ছিলেন উম্মতের মাঝে তাঁরই উত্তরসূরী, তা অন্বেষণ করা ছাড়া দ্বীনের ওপর অবিচল থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং তারা মনের খেয়াল, মস্তিষ্কের কল্পনা এবং বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির মত ও মতবাদ থেকে জন্ম নেওয়া সংশয় ও বিভ্রান্তিতে আত্মনিয়োগ করেননি। ওই উজ্জ্বল রাজপথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ভয়ে, যার ওপর দাঁড় করিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসেছে ঈমান হারা হওয়ার কঠিন হুঁশিয়ারি তাদের জন্য, যারা আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা করে, তাঁর বিধি বিধানের নিন্দা করে কিংবা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পিত হতে বিরত থাকে। -কিতাবুয যুআফা, আবু নুয়াইম আলআসফাহানী ১/৪৬
উপরিউক্ত হাদীসে ইখতিলাফটা ব্যাপক। যে কোনো ধরনের ইখতিলাফ হতে পারে। ইখতিলাফ যখন হবে তখন করণীয় কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ইখতিলাফ হলে আমার সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখবে।’ সুতরাং একজন মুমিনের উচিত, বিদআত ও সকল গোমরাহি থেকে বাঁচার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে (যা সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহও বটে) সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখবে। যারা এমন করবে তারাই হলো, নাজাতপ্রাপ্তদল তথা ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’।
‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ শব্দের বিশ্লেষণ
‘সুন্নাহ’ বলে উদ্দেশ্য, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। আর ‘জামাআহ’ বলে উদ্দেশ্য সাহাবায়ে কেরামের জামাত।
তাবিঈ আবু আমের আবদুল্লাহ রহ. বলেন,
حججنا مع معاوية بن أبي سفيان، فلما قدمنا مكة قام حين صلى صلاة الظهر، فقال : إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن أهل الكتابين افترقوا في دينهم على ثنتين وسبعين ملة، وإن هذه الأمة ستفترق على ثلاث وسبعين ملة، يعني الأهوءا، كلها في النار إلا الواحدة، وهي الجماعة … انتهى.
আমরা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাযি.)-এর সাথে হজ্ব করলাম। যখন মদীনায় এলাম যোহরের নামাযের পর তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পূর্বের দুই কিতাবধারী সম্প্রদায় তাদের ধর্মে বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এই উম্মত বিভক্ত হবে তেহাত্তর দলে। অর্থাৎ তারা খেয়াল-খুশির অনুসারী বহু দলে পরিণত হবে। সবগুলো দল জাহান্নামী হবে, একটি ছাড়া। আর সেটি হচ্ছে ‘আলজামাআহ’। (এ হাদীসটির মান সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। এটি সুনান ও মাসানীদের কিতাবের মশহূর হাদীস। আবু দাউদ, তিারমিযী, নাসায়ী ও অন্যান্যদের সুনানে তা আছে।) -মুসনাদে আহমদ ২৮/১৩৪, তাহকীক- শায়খ শুআইব আলআরনাউত, হাদীস : ১৬৯৩৭; সুনানে আবু দাউদ ২/৬৩১, হাদীস ৪৫৯৭;মাজমুউল ফাতাওয়া ৩/৩৪৫
অন্য হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
تفترق أمتي على ثلاث وسبعين ملة، كلهم في النار إلا ملة واحدة، قالوا : من هي يا رسول الله؟ قال : ما أنا عليه وأصحابي.
আমার উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। একটি ছাড়া বাকি সবগুলোই জাহান্নামে যাবে। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! সেই এক দলে কারা থাকবেন? বললেন, ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী।’ অর্থাৎ যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের ওপর থাকবে। -জামে তিরমিযী ২/৯২-৯৩, হাদীস ২৬৪১ (ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেছেন, এটি হাসান, গরীব ও মুফাসসার হাদীস; হাদীসটি এভাবে শুধু এই সূত্রেই আমরা পাই।)
ما أنا عليه وأصحابي অর্থাৎ নাজাতপ্রাপ্ত তারা, যারা ওই পথে থাকবে, যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা রয়েছি। এখানে ‘মা’ দ্বারা সুন্নাহকে নির্দেশ করা হয়েছে। তাহলে এই হাদীসে ‘মা-আনা আলাইহি’ শব্দে তাই বলা হয়েছে, যা ইতঃপূর্বে উল্লিখিত হাদীসে ‘আলাইকুম বিসুন্নাতী’ শব্দে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ আমার সুন্নাহকে ধারণ কর। আর এভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের জামাআতের অনুসারীদের নামকরণ করা হয় ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’।
আর ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ নামটি সাহাবায়ে কেরামের জামানা থেকে চলে আসছে। কখনো পুরো নাম উল্লেখ করা হত, কখনো সংক্ষেপে শুধু ‘আহলুস সুন্নাহ’ বলা হত। সূরা আল ইমরানের ১০৬ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে পুরা নাম বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটি হল-
﴿يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ﴾
সেই দিন, যে দিন কতক চেহারা (ঈমান ও আনুগত্যের আলোয়) উজ্জ্বল হবে এবং কতক মুখ (কুফর ও পাপের কালিমায়) কালো হয়ে যাবে। -সূরা আল ইমরান (৩) : ১০৬
ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন-
تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ، وَتَسْوَدُّ وُجُوهُ أَهْلِ الْبِدْعَةِ وَالْفُرْقَةِ.
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের চেহারা উজ্জ্বল হবে আর আহলে বিদআত বা বিদআতীর চেহারা কালো হবে।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/১০০
এ নামটি সংক্ষিপ্তভাবেও বিভিন্ন স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। যেমন সহীহ মুসলিমের ‘মুকাদ্দিমা’য় ইবনে সীরীন রহ.(মৃ. ১১০.হি.) -এর বক্তব্যে এসেছে। তিনি বলেন-
“لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنِ الْإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ، قَالُوا: سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ، وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ فَلَا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ.”
সাহাবায়ে কেরাম সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন না। কিন্তু যখন ফিতনা দেখা দিল তখন থেকে কেউ কোনো হাদীস বর্ণনা করলে তার থেকে হাদীসের বর্ণনাকারীর নাম (অর্থাৎ যার থেকে সে শুনেছে তার নাম) জানতে চাইতেন। (নাম শুনার পর) যদি দেখতেন, বর্ণনাকারী আহলে সুন্নাহ’র অনুসারী, তাহলে তার হাদীস গ্রহণ করতেন। আর যদি দেখতেন, সে বিদআতী তাহলে তার হাদীস গ্রহণ করতেন না। -মুকাদ্দিমাহ সহীহ মুসলিম ১/ ১১
উপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সুন্নাহ ও জামাআহ- একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
‘জামাআহ’র দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ‘ইজমা’
জামাআর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, ইজমা তথা ইসলামী বিধি-বিধানের বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামসহ যুগে যুগে ইসলামের অনুসরণীয় উলামায়ে উম্মাতের ইজমা তথা মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত কর্মপন্থা। যা মূলত সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহ’র সম্প্রসারিত রূপ। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
ومن العجب أن الرافضة تثبت أصولها على ما تدعيه من النص والإجماع، وهم أبعد الأمة عن معرفة النصوص والإجماعات والاستدلال بها بخلاف السنة والجماعة (وفي نسخة “بخلاف أهل السنة والجماعة”) فإن السنة تتضمن النص والجماعة تتضمن الإجماع، فأهل السنة والجماعة هم المتبعون للنص والإجماع.
আশ্চর্যের বিষয় হল, রাফেজীরা তাদের দাবি অনুসারে তাদের নীতি ও উসূল প্রমাণ করে থাকে নস ও ইজমা থেকে! অথচ এরা হচ্ছে নস ও ইজমাকে জানা এবং তা দ্বারা দাবি প্রমাণের ক্ষেত্রে উম্মাহ’র সুদূরতম দল। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ হচ্ছে নস ও ইজমার অনুসারী। ‘সুন্নাহ’ নসকে ধারণ করে আর ‘জামাআ’ ধারণ করে ইজমাকে। -মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ ৬/৩৩২
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, ‘আলজামাআ’র এক অর্থ ইজমা। নিম্নে ইজমার গুরুত্ব এবং ইজমা-বিরোধিতার ভয়াবহতা সংক্রান্ত কিছু দলিল পেশ করা হল-
১. কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
” وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا”
‘আর যে ব্যক্তি তার সামনে হিদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে ও মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ অনুসরণ করবে, আমি তাকে সেই পথেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা অতি মন্দ ঠিকানা।’ -সূরা নিসা (৫) : ১১৫
এখানে ‘ছাবীলুল মুমিনীন’ মানে উম্মতের সর্বসম্মত পথ, বিধানের বিষয়ে উলামায়ে উম্মতের ইজমা ও উম্মতের রাষ্ট্রপ্রধান তথা খলীফাতুল মুসলিমীন, সবকিছুই ‘ছাবীলুল মুমিনীন’ এর অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের ওপর অনেক অনুগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুগ্রহ হলো, (হক্ব) জামাআত ও দ্বীনের মজবুত রশি আঁকড়ে ধরার আদেশ করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا﴾
আর তোমরা আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দ্বীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ এবং পরস্পরে বিভেদ করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখ। একটা সময় ছিল, যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে জুড়ে দিলেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। -সূরা আলে-ইমরান (৩) : ১০৩
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.)উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
قوله (وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا) قال:”الجماعة”
(وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا) তোমরা আল্লাহর রশিকে অর্থাৎ ‘জামাআহ’কে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো -তাফসীরে তবারী, ইবনে জারীর তবারী রহ. (মৃ. ৩১০ হি.) ৩/৩৫৬ (৭৫৫৭
এই উম্মতের ওপর আল্লাহ তাআলার আরেকটি অনুগ্রহ হলো, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সবসময় হক্ব জামাতের সঙ্গে থাকার জন্য তাঁর কাছে দোয়াও করতে বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴾ (7) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ (6) ﴿ اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
আমাদের সরল পথে পরিচালিত কর। সেই সকল লোকের পথে, যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ। ওই সকল লোকের পথে নয়, যাদের প্রতি গযব নাযিল হয়েছে এবং তাদের পথেও নয়, যারা পথহারা।’ -সূরা ফাতিহা (১) ৬-৭
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) মুসলিমদের আদেশ করেছেন, তারা যেন প্রবৃত্তির পূজা থেকে বিরত থাকে এবং পারস্পরিক বিভেদ থেকে দূরে থাকে। সর্বাবস্থায় সুন্নাহ ও জামাআহকে আঁকড়ে ধরে থাকে, কোনো অবস্থাতেই যেন জামাআহ’র বিপরীত অবস্থান না করে। এ বিষয়ে আল্লাহর কঠোর আদেশ নিচের আয়াতগুলো থেকে প্রতিভাত হয়-
১. আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ﴾
তোমরা ওসকল লোকের (অর্থাৎ ইহুদি ও খ্রস্টানদের) মতো হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ও পরস্পর মতভেদ সৃষ্টি করেছিল।-সূরা আলে-ইমরান (৩) : ১০৫
ইমাম সুয়ূতী রহ. (মৃ. ৯১১ হি.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
” أمر الله المؤمنين بالجماعة ونهاهم عن الإختلاف والفرقة وأخبرهم أنما هلك من كان قبلكم بالمراء والخصومات في دين الله”
আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে জামাতবদ্ধ থাকার আদেশ করেছেন এবং পরস্পর মতানৈক্য ও বিভেদ থেকে নিষেধ করেছেন। এছাড়া মুমিনদেরকে এ বিষয়ে জানিয়েছেন যে, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।-আদ-দুররুল মানসূর ২/২৮৯
২. আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿ إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ ﴾
(হে নবী!) নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।-সূরা আনআম (৬) : ১৫৯
হাফেয ইবনে কাসীর রহ. (মৃ. ৭৭৪ হি.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
قوله تعالى ﴿ وَكَانُوا شِيَعًا ﴾ :أي فرقا كأهل الملل والنحل -وهي الأهواء والضلالات -فالله قد برأ رسوله مما هم فيه.
আল্লাহ তাআলার বাণী ﴿ وكانوا شيعاً ﴾ অর্থাৎবিভিন্ন দল-উপদল, প্রবৃত্তিপূজারী ও গোমরাহ ব্যক্তিদের ন্যায় তারা শতধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তারা যেই অবস্থার ওপর ছিল আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা থেকে মুক্ত রেখেছেন।’-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৪২০
৩. আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ﴾ (32) وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ( 31) ﴿
আর তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত।-সূরা রূম (৩০) : ৩১-৩২
ইমাম তবারী রহ. (মৃ. ৩১০ হি.) বলেন:
وقوله ﴿ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ﴾ يقول كل طائفة وفرقة من هؤلاء الذين فارقوا دينهم الحق فأحدثوا البدع التي أحدثوا (بما لديهم فرحون) يقول بما هم به متمسكون من المذهب فرحون مسرورون يحسبون أن الصواب معهم دون غيرهم.
আল্লাহ তাআলার কথা ﴿كل حزب بما لديهم فرحون﴾ অর্থাৎ, যারা সত্য দ্বীন ছেড়ে দিয়ে ধর্মের বাহিরে বিভিন্ন বিদআত সৃষ্টি করেছে, তাদের প্রত্যেক দল-উপদল- (بما لديهم فرحون) (এর অর্থ) সেই মনগড়া মতবাদ আঁকড়ে ধরে তাতেই তারা আনন্দিত ও উল্লসিত। তারা ধারণা করে যে, তারাই কেবল সঠিক পথে অবিচল আছে, অন্যরা নেই।’ -তাফসীরে তবারী ৯/৯০ (২৮০৩২)
প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে পারস্পরিক বিভেদ দুনিয়াতেই বড় বিপর্যয় নিয়ে আসবে। সে বিষয় আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ بَعْضٍ ﴾
অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে পরস্পরের মুখোমুখি করে দেবেন এবং এক দলকে অপর দলের শক্তির স্বাদ গ্রহণ করাবেন। -সূরা আনআম (৬) : ৬৫
আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইমাম তবারী রহ. ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন,
(أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا) : الأهواء المفترقة”
‘আয়াতটিতে (أو يلبسكم شيعاً) দ্বারা প্রবৃত্তির অনুসারী বিভিন্ন দল উদ্দেশ্য।’ -তাফসীরে তবারী ৪/৮৯৭
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, জামাআর দুটি দিক রয়েছে, এক. নিছক দ্বীনী বিষয়ে জামাআহ। এটি হচ্ছে ইজমা। ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর উপরিউক্ত বক্তব্যে ‘আলজামাআ’র ব্যাখ্যায় ইজমার কথা এসেছে। দুই. সাহাবায়ে কেরামের জামাআহ বা তাঁদের সুন্নাহ। উভয় বিষয় সম্পর্কেই উপরে সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে। জামাআর তৃতীয় আরেকটি দিক হচ্ছে মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান, খলীফা বা ইমাম, যিনি শরীআ মুতাবেক মুসলিমদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করেন। অনেক হাদীসে জামাআহ দ্বারা এ বিষয়টির কথা বলা হয়েছে। যার আলোচনা সামনে আসছে।
‘জামাআহ’র তৃতীয় উদ্দেশ্য মুসলমানদের ‘জামাআহ’
বিভিন্ন হাদীসে জামাআ দ্বারা এমন মুসলিম শাসককে বুঝানো হয়েছে, যিনি শরীআ অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করেন, যাকে খলীফাতুল মুসলিমীন বা আমিরুল মুমিনীন বলা হয়। এমন শাসকের সাথে বা তাঁর অধীনে থাকার ব্যাপারে কঠোরভাবে আদেশ করা হয়েছে। সাধারণত যিনি প্রকৃত অর্থে খলীফা হন, তাঁর অধীনেই অধিকাংশ মুসলিম থাকে। (ব্যতিক্রম কিছু সময় বাদে ইসলামের ইতিহাস এমনই ছিল।) একজন মুমিনের উচিত, সর্বাবস্থায় ইসলামী খেলাফতের ছায়াতলে থাকা। যদি ইসলামী খেলাফত না থাকে, তাহলে যারা সঠিক পদ্ধতিতে খিলাফত পূনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় রত তাঁদের কাতারে শামিল থাকা। আর তারাই হলো নাজাতপ্রাপ্ত দল। তারা কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হতে পারে। আবার কখনো মুসলিমদের একটা কফেলাও হতে পারে। কেউ যদি উক্ত দল বা কাফেলার সাথে যুক্ত না হতে পারে, তাহলে তার দায়িত্ব হলো, সকল দল থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে সাধ্য আনুযায়ী আল্লাহর বিধান পালন করে যাওয়া। নিম্নে উক্ত বিষয় সংক্রান্ত দলিল পেশ করা হচ্ছে-
১. হুযাইফাহ্ ইবনুল ইয়ামান রাযি. (মৃ. ৩৬ হি.) বলেন,
كانَ النّاسُ يَسْأَلُونَ رَسولَ اللهِ ﷺ عَنِ الخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي، فَقُلتُ: يا رَسولَ اللهِ، إنّا كُنّا في جاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ، فَجاءَنا اللَّهُ بهذا الخَيْرِ، فَهلْ بَعْدَ هذا الخَيْرِ شَرٌّ؟ قالَ: نَعَمْ، فَقُلتُ: هلْ بَعْدَ ذلكَ الشَّرِّ مِن خَيْرٍ؟ قالَ: نَعَمْ، وَفِيهِ دَخَنٌ، قُلتُ: وَما دَخَنُهُ؟ قالَ: قَوْمٌ يَسْتَنُّونَ بغيرِ سُنَّتِي، وَيَهْدُونَ بغيرِ هَدْيِي، تَعْرِفُ منهمْ وَتُنْكِرُ، فَقُلتُ: هلْ بَعْدَ ذلكَ الخَيْرِ مِن شَرٍّ؟ قالَ: نَعَمْ، دُعاةٌ على أَبْوابِ جَهَنَّمَ مَن أَجابَهُمْ إلَيْها قَذَفُوهُ فِيها، فَقُلتُ: يا رَسولَ اللهِ، صِفْهُمْ لَنا، قالَ: نَعَمْ، قَوْمٌ مِن جِلْدَتِنا، وَيَتَكَلَّمُونَ بأَلْسِنَتِنا، قُلتُ: يا رَسولَ اللهِ، فَما تَرى إنْ أَدْرَكَنِي ذلكَ؟ قالَ: تَلْزَمُ جَماعَةَ المُسْلِمِينَ وإمامَهُمْ، فَقُلتُ: فإنْ لَمْ تَكُنْ لهمْ جَماعَةٌ وَلا إمامٌ؟ قالَ: فاعْتَزِلْ تِلكَ الفِرَقَ كُلَّها، ولو أَنْ تَعَضَّ على أَصْلِ شَجَرَةٍ حتّى يُدْرِكَكَ المَوْتُ وَأَنْتَ على ذلكَ.
লোকজন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কল্যাণের বিষয়ে প্রশ্ন করতো আর আমি প্রশ্ন করতাম অকল্যাণ সম্পর্কে; এ ভয়ে, যেন আমি তাতে জড়িয়ে না পড়ি। তাই আমি (কোনো এক সময়) প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা জাহিলি যুগে ছিলাম, অমঙ্গলের মধ্যে ছিলাম। তারপর আল্লাহ আমাদের জন্য এ কল্যাণ (ইসলামের নিআমত) দান করলেন। এ কল্যাণের পরেও কি কোনো অকল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারপর আমি বললাম, ওই অকল্যাণের পর কি আবার কল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তবে তাতে ধুম্রতা আছে। আমি বললাম কী সে ধোঁয়া? তিনি বললেন, তখন এমন একদল লোকের উদ্ভব হবে, যারা আমার সুন্নাহ বাদ দিয়ে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করবে এবং আমার প্রদর্শিত হিদায়াতের পথ ছেড়ে অন্য পদ্ধতির দিকে পরিচালিত করবে। তুমি তাদের মধ্যে কিছু ভাল ও কিছু মন্দ দেখতে পাবে। তখন আমি আরয করলাম, এ কল্যাণের পর কি কোনো অকল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, কিছু লোক মানুষকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করবে। যারা তাদের ডাকে সাড়া দেবে তারা তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় বলুন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাদের গায়ের রঙ হবে আমাদেরই মতো, তারা আমাদেরই ভাষায় কথা বলবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যদি সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই তাহলে আপনি আমাদেরকে কি করতে বলেন? তিনি বললেন, তোমরা মুসলিমদের জামাআত ও তাদের ইমামের সাথে আঁকড়ে থাকবে। আমি বললাম, যদি তাদের কোনো জামাআত বা ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তা হলে সকল দল থেকে আলাদা থাকবে- যদিও তোমাকে কোন বৃক্ষমূল দাঁত দিয়ে আঁকড়ে থাকতে হয় এবং এ অবস্থায়ই তোমার মৃত্যু চলে আসে।’ -সহীহ মুসলিম ২/১২৭ হাদীস ১৮৪৭
২. সাওবান (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ، حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ
আমার উম্মতের একটি দল হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যারা তাদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে তারা কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর নির্দেশ (অর্থাৎ কিয়ামত) আসা পর্যন্ত এ দলটি এভাবেই হকের ওপর থাকবে -সহীহ মুসলিম ২/১৪৩, হাদীস ১৯২০
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সব ধরনের বিদআত ও গোমরাহি থেকে হেফাজত করেন এবং হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেই দলের অন্তর্ভুক্ত করেন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!
১৯ রমযান, ১৪৪১ হিজরী
১৩ মে, ২০২০ ঈসায়ী।
গ্রন্থপঞ্জি
১. আল কুরআনুল কারীম।
২. মুআত্তা মালেক, ইমাম মালেক ইবনে আনাস রহ. (মৃ. ১৭৯ হি:), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার,ঢাকা।
৩. মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, ইমাম আব্দুর রায্যাক সানআনী (মৃ. ২১১ হি:), আল মাকতাবাতুল ইসলামী, বয়রুত।
৪. সুনানে সাঈদ ইবনে মানসুর, ইমাম সাঈদ ইবনে মানসুর (মৃ. ২২৭ হি.) দারুস্ সামিয়ী, রিয়াদ। তাহকীক- ড. সাআদ বিন আব্দুল্লাহ আলে হুমায়দ, চতুর্থ সংস্করণ ২০১২ খ্রি.।
৫. আত তবাকাতুল কুবরা, মুহাম্মাদ ইবনে সাআদ (মৃ. ২৩০ হি:), দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বয়রুত।
৬. মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (মৃ. ২৪১হি.), তাহকীক: শায়খ শুআইব আল-আরনাউত (১৪৩৮হি.), মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ২০১৫ খ্রি.।
৭. উসূলুস সুন্নাহ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (মৃ. ২৪১ হি.), দারুল মানার আস-সউদিয়্যাহ, (শামেলা)।
৮. সুনানে দারেমী, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান দারেমী (মৃ. ২৫৫ হি.), দারুল কলম, দিমাশক। প্রথম সংস্করণ ১৯৯১ খ্রি.।
৯. সহীহ বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল আল-বুখারী (মৃ. ২৫৬হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।
১০. সহীহ মুসলিম, ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (মৃ. ২৬১হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার,ঢাকা।
১১. সুনানে আবু দাউদ, ইমাম আবু দাউদ আস-সিজিসতানী (মৃ. ২৭৫হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।
১২. সুনানে আবু দাউদ, ইমাম আবু দাউদ আস-সিজিসতানী (মৃ. ২৭৫ হি.), তাহকীক- শুআইব আলআরনাউত, দারুর রিসালাহ আল-ইলমিয়্যাহ।
১৩. মারাসীলে আবু দাউদ, ইমাম আবু দাউদ আস-সিজিসতানী (মৃ. ২৭৫ হি.), তাহকীক- শায়খ শুআাইব আলআরনাউত।
১৪. সুনানে ইবনে মাজাহ, ইমাম মুহামম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে মাজাহ (মৃ.২৭৫হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার,ঢাকা ।
১৫. সুনানে ইবনে মাজাহ, ইমাম মুহামম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে মাজাহ (মৃ.২৭৫হি.), তাহকীক- শায়খ শুআাইব আলআরনাউত, দারুর রিসালা আল-ইলমিয়্যাহ, (শামেলা)।
১৬. সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ(মৃ.২৭৫হি.), তাহক্বীক: শায়খ আলবানী রহ. (মৃ. ১৪২০ হি:), মাকতাবাতুল মাআরিফ, রিয়াদ।
১৭. সুনানে তিরমিযী, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিযী (মৃ. ২৭৯ হি.), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা।
১৮. আলবিদাউ ওয়ান নাহয়ু আনহা, ইবনে ওয়াদ্দাহ আলকুরতুবী (ابنوضّاحالقُرْطُبيّ)(মৃ. ২৮৭ হি.), (শামেলা)।
১৯. আস সুন্নাহ, মুহাম্মাদ বিন নসর আলমারওয়াযি (মৃ. ২৯৪ হি.), মুআস্সাসাতুল কিতাব আস-সাকাফিয়্যাহ, (শামেলা)।
২০. আস-সুনানুল কুবরা, ইমাম আহমাদ ইবনে শুআইব আন-নাসাঈ (মৃ. ৩০৩হি.), দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন।
২১. তাফসীরে তবারী, মুহাম্মদ ইবনে জারির আত-তবারী (মৃ. ৩১০হি.), দারুল হাদিস, কায়রো, মিসর।
২২. তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম, আব্দুর রহমান ইবনে আবি হাতেম (মৃ. ৩২৭ হি:), দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, বয়রুত।
২৩. আল ম’জামুল কাবীর, তবারানী (মৃ. ৩৬০ হি.), ওযারাতুল আওক্বাফ, ইরাক, ১৪০৫হিজরী, (শামেলা)।
২৪. আস-সুনান, ইমাম দারা কুতনী (মৃ. ৩৮৫ হি.), তাহকীক: আব্দুল্লাহ হাশেম ইয়ামানী, দারুল মাআরিফ, রয়রুত।
২৫. আস-সিহাহ ফিল লুগাত, ইসমাইল ইবনে হাম্মাদ আল জাওহারী (মৃ. ৩৯৩ হি:), (শামেলা)।
২৬. মুসতাদরাকে হাকেম, আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকেম (মৃ. ৪০৫হি.), দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, ১৯৯০ খ্রি.।
২৭. শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী (মৃ.৪১৮হি.), (শামেলা)।
২৮. কিতাবুয যুআফা, আবু নুয়াইম আলআসফাহানী (মৃ. ৪৩০ হি:), দারুস সাক্বাফা (শামেলা)।
২৯. আল-মুসতাখরাজ আলা সহীহ মুসলিম, আবু নুয়াইম আল-আসফাহানী (মৃ. ৪৩০ হি), দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ বৈরুত, (শামেলা)।
৩০. সুনানে কুবরা, আবু বকর বাইহাকী রহ. (মৃ. ৪৫৮ হি:), দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, বয়রুত।
৩১. শুআবুল ঈমান, ইমাম বায়হাকী (মৃ. ৪৫৮হি.), দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, ১৯৯০ খ্রি.।
৩২. আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, আবুল কাসেম হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদ (মৃ.৫০২ হি:), তাহকীক: মুহাম্মাদ সাঈদ কিলানী, দারুল মা’রেফা, লেবনান (শামেলা)।
৩৩. তা’রিফাত, মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জুরজানী (মৃ. ৬০৪ হি.), দারুল কিতাব আল-আরাবী বয়রুত, তাহক্বীক: ইবরাহীম আল-আবয়ারী, (শামেলা)।
৩৪. আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, মুনযিরী রহ. (মৃ. ৬৫৬ হি.), দারুল হাদীস,কায়রো, মিশর।
৩৫. সহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, মুনযিরী রহ. (মৃ. ৬৫৬ হি.), শায়খ আলবানী রহ. (মৃ. ১৪২০ হি:), মাকতাবাতুল মাআরিফ, রিয়াদ।
৩৬. মুখতারুস সিহাহ্, মুহাম্মাদ ইবনে আবী বকর আর রাযী (মৃ. ৬৬৫ হি.), মাকতাবাতু লেবনান, (শামেলা)।
৩৭. শরহু সহীহ মুসলিম (সহীহ মুসলিমের টীকা), ইমাম নববী রহ. (মৃ. ৬৭৬ হি:), আল মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বাংলাবাজার,ঢাকা।
৩৮. লিসানুল আরব, মুহাম্মাদ ইবনে মুর্কারাম (ইবনে মানযুর) (মৃ. ৭১১ হি.), দারুস সাদের বৈরুত, (শামেলা)।
৩৯. মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃ. ৭২৮ হি.), মুআসসাসাতু করাতিয়্যাহ, (শামেলা)।
৪০. মাজমূউল ফাতাওয়া, আহমাদ ইবনে তাইমিয়া (মৃ. ৭২৮হি.),দারু আলামিল কুতুব, রিয়াদ, সৌদিআরব, ১৯৯১খ্রি., (শামেলা)।
৪১. তাহযীবুল কামাল, আবুল হাজ্জাজ ইউসুফ আলমিযযী (মৃ. ৭৪২ হি.), মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, বয়রুত।
৪২. ইগাসাতুল লাহফান, ইবনুল কায়্যিম আল জাওযী (মৃ. ৭৫১ হি.), দারু আলাম আল-ফাওয়াইদ, মক্কামুকাররমা, প্রথম সংস্করণ: ১৪৩২হি., (শামেলা)।
৪৩. ই’লামুল মুওয়াককী’ইন আন রব্বিল আলামীন, ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (মৃ. ৭৫১ হি.), দারু ইবনুল জাওযী মামলাকাতুল আরাবিয়্যাহ, (শামেলা)।
৪৪. তাফসিরে ইবনে কাছির, ইসমাঈল ইবনে কাছির (মৃ. ৭৭৪ হি:), মাকতাবাতু দারুল হাদিস, কায়রো, মিশর।
৪৫. আল-ই’তিসাম, ইবরাহীম ইবনে মুসা আশ-শাতিবী (মৃ. ৭৯০ হি.), দারু ইবনে আফ্্ফান, চতুর্থ সংস্করণ: ১৪১৬ হি:।
৪৬. মুওয়াফাকাত (الموافقات), ইবরাহীম ইবনে মুসা আশ শাতিবী (মৃ. ৭৯০ হি.), আল মাকতাবাতুর রক্বমিয়্যাহ, (শামেলা)।
৪৭. আল বাহরুর রায়েক, ইবনু নুজাইম (মৃ. ৭৯০ হি.), দারুল মা’আরেফা, (শামেলা)।
৪৮. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, ইবনে রজব হাম্বলী (মৃ. ৭৯৫ হি.), দারু ইবনু হযম, প্রথম সংস্করণ: ১৪১৮ হি:।
৪৯. মাজমাউয যাওয়ায়েদ, নুরুদ্দীন হাইসামী (মৃ. ৮০৭ হি.), দারুল কিতাব আল আরাবী, বৈরুত, লেবানন।
৫০. আলকামূসুল মুহীত, মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব আল-ফায়রুযআবাদী (মৃ. ৮১৭ হি.), (শামেলা)।
৫১. ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার আল-আসকালানী (মৃ. ৮৫২হি.), মাকতাবাতুস সাফা, কায়রো, মিসর, ২০০৩ খ্রি.।
৫২. উমদাতুল কারী শরহে সহীহ বুখারী, বদরুদ্দীন আল-আইনী (মৃ. ৮৫৫ হি:), দারুল ফিক্র, বয়রুত।
৫৩. আদ-দুররুল মানসূর, জালাল উদ্দীন আস-সুয়ূতী রহ. (মৃ. ৯১১ হি.), দারুল ফিক্র, বৈরুত (শামেলা)।
৫৪. তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরিল ক্বামুস, মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রায্যাক আয-যাবিদী (মৃ. ১২০৫ হি:)(শামেলা)।
৫৫. রদ্দুল মুহতার, ইবনে আবেদীন শামী (মৃ. ১২৫২হি.), দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন, ১৯৬৬ খ্রি.।
৫৬. ফাতহুল মুলহিম (সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থ), আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. (মৃ. ১৩৬৯ হি.), আল মাকতাবাতুল আশরাফিয়্যাহ, দেওবন্দ, ভারত।
৫৭. মাআরিফুল হাদীস, মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রহ. (মৃ. ১৯৯৭ ঈসায়ী), দারুল ইশাআত, করাচি, পাকিস্তান।
৫৮. ইখতেলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুসতাকীম, মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধয়ানবী রহ. (মৃ. ১৮ মে, ২০০০ ঈসায়ী) মাকতাবাহ হিজাজ, দেওবন্দ, সাহারানপুর।
৫৯. আলবিদাউ ওয়া আসারুহুস সায়্যিউ ফিল উম্মাহ, ড. ওয়াসীম মাহমূদ ফাতহুল্লাহ(আল্লাহ তাঁকে কবুল করুন। আমিন), মিম্বারুত তাওহীদ ওয়াল জিহাদ।