নফল ইবাদত ও জামাতবদ্ধ থাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
নফল ইবাদত ও জামাতবদ্ধ থাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
নফল ইবাদত ও জামাতবদ্ধ থাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
প্রশ্ন:
আমার এক ভাই অন্যায়ভাবে তাগুতের কারাগারে বন্দী। তিনি দুটি বিষয় জানতে চেয়েছেন; এক. কারাগারে আমরা পরিচিত কয়েকজন নিজেদের সময়কে কাজে লাগানোর জন্যে একসাথে উঠাবসা করি। একে অপরকে উপদেশ দেই। নেক কাজের ব্যাপারে একে অপরকে উৎসাহ দেই। আমাদের সাথে থাকা এক ভাই প্রায়ই আমার ব্যাপারে একটি অভিযোগ করেন, আমি নাকি নফল ইবাদতের ব্যাপারে বেশি কড়াকড়ি করি। উদাহরণত আমরা নিজেদের তারবিয়াহর উদ্দেশ্যে তাহাজ্জুদের নামাযে কমপক্ষে ৪০ মিনিট কাটানোর সিদ্ধান্ত নিই। ওই ভাই এ বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানান। আমি বলি, তারবিয়াহর উদ্দেশ্যে এমন করা যায়। তিনি মানতে নারাজ। তাঁর কথা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কখনো এমন করেছেন? নফল ইবাদতের ব্যাপারে একটু জোর দিলেই তিনি ওই হাদীসগুলো পেশ করেন যেগুলোতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো কোনো সাহাবীকে শুধু ফরয আমল উপর জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
দুই. এখানকার কিছু ভাই বলেন, কারাগারে জামাতবদ্ধ থাকা এবং কারো আনুগত্য করা জরুরি কিছু নয়।
মুহতারাম মুফতি সাহেবের কাছে আমার আবেদন, নফল ইবাদত ও জামাতবদ্ধ থাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যদি একটু বিস্তারিত আমাদের জানাতেন, আমরা অনেক উপকৃত হতাম।
-আবিদুর রহমান
উত্তর:
মূল উত্তরে যাওয়ার আগে কয়েকটি বিষয় আরজ করতে চাই;
এক. কুরআন-সুন্নাহয় নফল ইবাদতের বিশেষ করে তাহাজ্জুদের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوا سُجَّدًا وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ (15) تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ (16) فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ. -السجدة: 15 – 19
“আমার আয়াতসমূহে ঈমান আনে কেবল তারা, যারা এর দ্বারা যখন উপদেশ প্রাপ্ত হয়, তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং নিজ প্রতিপালকের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে। আর তারা অহংকার করে না। (রাতের বেলা) তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা ভয় ও আশার (মিশ্র অনুভূতি) সাথে নিজ প্রতিপালককে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে। কেউই জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফল স্বরূপ চোখ জুড়ানো কত কি লুকিয়ে রাখা হয়েছে।” –সূরা সাজদা, ৩২: ১৫-১৭
আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
إنه لمكتوب في التوراة : لقد أعد الله للذين تتجافى جنوبهم عن المضاجع ما لم تر عين ، ولم تسمع أذن ، ولم يخطر على قلب بشر ، وما لا يعلمه ملك ، ولا مرسل ، قال : ونحن نقرؤها : [فلا تعلم نفس ما أخفي لهم من قرة أعين] إلى آخر الآية. –أخرجه ابن أبي شيبة في المصنف (35137)، والحاكم في المستدرك (3550)، وقال الحاكم: حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ وَلَمْ يُخْرِجَاهُ اهـ. ووافقه الذهبي.
“নিশ্চয়ই তাওরাতে লিখা আছে, যারা পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা করবে, তাদের জন্য এমন নেয়ামত প্রস্তুত করা হয়েছে, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, কোনো মানুষের অন্তরে কল্পনাও জাগেনি এবং তা না কোনো ফিরিশতা জানে, না কোনো রাসূল। আমরা সেটাই (কুরআনে) তিলাওয়াত করি: فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ অর্থাৎ: কোনো ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফল স্বরূপ চোখ জুড়ানো কত কি লুকিয়ে রাখা হয়েছে।” –মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, হাদীস নং: ৩৫১৩৭, মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস নং: ৩৫৫০, হাদীসটি সহীহ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إن الله قال: من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب، وما تقرب إلي عبدي بشيء أحب إلي مما افترضت عليه، وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته: كنت سمعه الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر به، ويده التي يبطش بها، ورجله التي يمشي بها، وإن سألني لأعطينه، ولئن استعاذني لأعيذنه، وما ترددت عن شيء أنا فاعله ترددي عن نفس المؤمن، يكره الموت وأنا أكره مساءته. –صحيح البخاري (6502)
“আল্লাহ তাআলা বলেন, যে আমার কোনো ওলীর সাথে দুশমনি করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো। আমি বান্দার উপর যা ফরয করেছি, আমার কাছে তার চেয়ে অধিক প্রিয় কোনো আমল নেই, যা দিয়ে বান্দা আমার আরও অধিক নৈকট্য লাভ করতে পারে। নফল আমলসমূহের মাধ্যমে বান্দা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, এক পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, তার কান হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শোনে। তার চোখ হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে। তার হাত হয়ে যাই, যা দ্বারা সে ধরে। তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দান করি। আমি কোনো কাজ করতে গিয়ে অতটা দ্বিধান্বিত হই না, যতটা দ্বিধান্বিত হই মুমিনের মৃত্যুর ব্যাপারে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে। আর আমিও তাকে কষ্ট দিতে অপছন্দ করি।” –সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৬৫০২
অপর হাদীসে এসেছে,
عليكم بقيام الليل فإنه دأب الصالحين قبلكم، وهو قربة إلى ربكم، ومكفرة للسيئات، ومنهاة للإثم. –سنن الترمذي (5/445، الناشر: دار الغرب الإسلامي – بيروت). حسنه العراقي في المغني عن حمل الأسفار في الأسفار (ص: 421، الناشر: دار ابن حزم، بيروت – لبنان).
“তোমরা রাতের সালাতকে আবশ্যক করে নাও। কেননা রাতের সালাত তোমাদের পূর্ববর্তী নেককারদের বৈশিষ্ট্য। তোমাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায়, মন্দ কাজ সমূহের কাফফারা ও পাপসমূহের জন্য প্রতিরোধক।” –জামে তিরমিযী: ৫/৪৪৫ হাফেয ইরাকী রহিমাহুল্লাহ (৮০৬ হি.) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
দুই. বিশেষত মুজাহিদদের জন্য আল্লাহ তাআলার সাহায্য অর্জন এবং দাওয়াত ও জিহাদের কণ্টকাকীর্ণ পথে অটল-অবিচল থাকার জন্য নফল ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ. -الأنفال: 45
“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোনো দলের মুখোমুখি হবে, তখন অবিচল থাকবে এবং আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর।” -সূরা আনফাল ০৮: ৪৫
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“إن عبدي كل عبدي الذي يذكرني وهو ملاقٍ قِرنه.” يعني: عند القتال. –سنن الترمذي (5/462 رقم: 3580 ط. دار الغرب الإسلامي) قال الإمام الترمذي: “هذا حديث غريب، لا نعرفه إلا من هذا الوجه، وليس إسناده بالقوي.” ولكن نقل المناوي في “فيض القدير” (2/309 ط. المكتبة التجارية الكبرى) وابن علان في “الفتوحات الربانية” (5/62 ط. جمعية النشر والتأليف الأزهرية) عن الحافظ ابن حجر أنه قال: “هو حسن غريب، وقول الترمذي ليس إسناده بقوي يريد ضعف عفير، لكن وجدت له شاهدا قويا مع إرساله، أخرجه البغوي، فلذلك حسنته، وقول الترمذي غريب أراد غرابته من جهة تفرد عفير بوصله، وإلا فقد وجد من وجه آخر.” وفي “النهاية” (4/55 ط. المكتبة العلمية) : القرن: “الكفء والنظير في الحرب والشجاعة.”
“আমার প্রকৃত বান্দা সেই, যে (যুদ্ধে) সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে মোকাবেলার সময়ও আমাকে স্মরণ করে।” –জামে তিরমিযী: ৫/৪৬২ হাদীস নং: ৩৫৮০ (দারুল গরবিল ইসলামী), হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২ হি.) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
হাদীসের ব্যাখ্যায় শায়খ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ বলেন,
وهذا الحديث القدسي الشريف من بابة الآية الكريمة: [يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ] فرتب الله عز وجل الفلاح في الجهاد على أمرين: على الثبات أمام العدو، وعلى ذكره جل شأنه ذكرا كثيرا، ولم تقتصر الآية الكريمة على مجرد ذكر الله تعالى، بل أمرت بالذكر الكثير! وفقنا الله لذلك. –من صحاح الأحاديث القدسية (ص: 346 ط. دار المنهاج)
“এই হাদীসে কুদসী আল্লাহ তাআলার বাণী “হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোনো দলের সম্মুখীন হবে, অবিচল থাকবে এবং আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর”-এর ন্যায়। আয়াতে আল্লাহ তাআলা জিহাদের সফলতাকে দুটি বিষয়ের উপর বিন্যস্ত করেছেন, শত্রুর সম্মুখে অবিচল থাকা এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করা। আর আয়াতে শুধু যিকরের কথা বলা হয়নি, বরং অধিক পরিমাণে যিকিরের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর তাওফীক দান করুন।”
-মিন সিহাহিল আহাদীসিল কুদসিয়্যাহ, পৃ: ৩৪৬ (দারুল মিনহাজ)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ (7) وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ. -الانشراح: 7، 8
“তুমি যখন অবসর পাও, তখন (ইবাদতে) নিজেকে পরিশ্রান্ত কর এবং নিজ প্রতিপালকের প্রতিই মনোযোগী হও।” -সূরা ইনশিরাহ ৯৪: ০৭-০৮
আয়াতের তাফসীরে শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,
“বলা বাহুল্য, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল প্রচেষ্টা ও ব্যস্ততা দীনকে কেন্দ্র করেই ছিল। তাবলীগ, তালীম, জিহাদ, প্রশাসন ইত্যাদি সমস্ত কাজ দীনের জন্যই হত এবং এ কারণে তাঁর সকল কাজ ইবাদতেরও মর্যাদা রাখত। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা হচ্ছে, আপনি যখন এসব কাজ শেষে অবসর পাবেন, তখন খালেস ইবাদত, যেমন নফল নামায, মৌখিক যিকির ইত্যাদি এ পরিমাণ করবেন, যাতে দেহ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর দ্বারা বোঝা গেল, যারা দীনের খেদমতে নিয়োজিত আছে, তাদেরও কিছুটা সময় খালেস নফল ইবাদতের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। এর দ্বারাই আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠ হয় এবং এর দ্বারাই অন্যান্য দীনি কাজে বরকত সৃষ্টি হয়।” -তাওযীহুল কুরআন (বাংলা অনুবাদ): ৩/৭২৭
আবুদ দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
أيها الناس، عمل صالح قبل الغزو، فإنما تقاتلون بأعمالكم. -رواه الإمام عبد الله بن المبارك في الجهاد (5) والإمام أحمد في الزهد (724) ورواه الإمام البخاري تعليقا بصيغة الجزم (4/20) ولكن اقتصر على قوله: “إنما تقاتلون بأعمالكم.” وترجم عليه بقوله: “باب: عمل صالح قبل القتال.”
“হে লোক সকল! তোমরা যুদ্ধের পূর্বে নেক আমল করে নাও, কেননা তোমরা তো তোমাদের আমলের মাধ্যমেই যুদ্ধ করো।” –সহীহ বুখারী: ৪/২০; কিতাবুল জিহাদ, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহ: ৫; আয-যুহদ, ইমাম আহমদ রহিমাহুল্লাহ: ৭২৪
এর ব্যাখ্যায় আল্লামা আহমাদ আলকো-রানী রহিমাহুল্লাহ (৮৯৩ হি.) বলেন:
إن العمل الصالح يعين على القتال، ويقوي الجأش. -الكوثر الجاري إلى رياض أحاديث البخاري: 5/ 405، دار إحياء التراث العربي، بيروت – لبنان.
“নেক আমল যুদ্ধে সাহায্য করে, অন্তরকে শক্তিশালী করে।” -আলকাউসারুল জারী: ৫/৪০৫ (দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবী)
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহিমাহুল্লাহ (১৩৫৩ হি.) বলেন,
إن الأعمال الصالحة تورث ثبات القدم عند القتال، فالقتال يكون بسبب بركة الأعمال، فهي دخيلة فيه. –فيض الباري (4/160، الناشر: دار الكتب العلمية بيروت – لبنان)
“নেক আমলসমূহ যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ় রাখে। সুতরাং যুদ্ধ আমলসমূহের বারাকাতেই হয়। আমল যুদ্ধেরই অন্তর্ভুক্ত।” –ফয়যুল বারী: ৪/১৬০ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ (৭৭৪ হি.) বলেন,
وروى أحمد بن مروان المالكي في المجالسة: ثنا أبو إسماعيل الترمذي ثنا أبو معاوية بن عمرو عن أبي إسحاق قال: كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يثبت لهم العدو فواق ناقة عند اللقاء، فقال هرقل وهو على أنطاكية لما قدمت منهزمة الروم: ويلكم أخبروني عن هؤلاء القوم الذين يقاتلونكم أليسوا بشرا مثلكم؟ قالوا: بلى. قال: فأنتم أكثر أم هم؟ قالوا: بل نحن أكثر منهم أضعافا في كل موطن. قال: فما بالكم تنهزمون؟ فقال شيخ من عظمائهم: من أجل أنهم يقومون الليل ويصومون النهار، ويوفون بالعهد، ويأمرون بالمعروف، وينهون عن المنكر، ويتناصفون بينهم، ومن أجل أنا نشرب الخمر، ونزني، ونركب الحرام، وننقض العهد، ونغصب ونظلم ونأمر بالسخط وننهى عما يرضي الله ونفسد في الأرض. فقال: أنت صدقتني. -البداية والنهاية (ط الفكر 7/ 15)
“আহমদ বিন মারওয়ান মালেকী ‘মুজালাসা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, আবু ইসমাঈল তিরমিযী আবু মুআবিয়া বিন আমরের সূত্রে আবু ইসহাক রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় শত্রুরা সাহাবায়ে কেরামের সামনে সামান্য সময়ও টিকতে পারতো না। রোমান বাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসলে আন্তাকিয়া থাকা অবস্থায় হেরাক্লিয়াস তাদেরকে বললো, তোমাদের ধ্বংস হোক! তোমাদের সাথে যুদ্ধরত (মুসলিমদের) বিষয়টা আমাকে বলো তো! তারা কি তোমাদের মতোই মানুষ না? তারা বললো, হাঁ। হেরাক্লিয়াস বললো, তাহলে তোমাদের সংখ্যা বেশি না তাদের? তারা বললো, আমরা তো সব ময়দানে তাদের দ্বিগুণেরও বেশি। হেরাক্লিয়াস বললো, তবে তোমরা কেন পরাজিত হচ্ছ? তখন তাদের নেতৃত্বস্থানীয় এক প্রবীণ ব্যক্তি বললো, এর কারণ হলো, তারা রাতে ইবাদত করে, দিনে সওম পালন করে, অঙ্গীকার পূরণ করে, সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে বারণ করে, নিজেদের মাঝে ইনসাফ কায়েম করে। পক্ষান্তরে আমরা মদ পান করি, যিনা করি, হারামে লিপ্ত হই, অঙ্গীকার ভঙ্গ করি, ডাকাতি ও জুলুম করি, এমন কাজের আদেশ করি, যাতে আল্লাহ তাআলা রাগান্বিত হন এবং এমন কাজ থেকে নিষেধ করি, যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, জমিনে অশান্তি সৃষ্টি করি। তখন হেরাক্লিয়াস বললো, তুমি সত্য বলেছো। -আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ: ৭/১৫ (দারুল ফিকর)
শায়খ আব্দুল কাদির বিন আব্দুল আযীয বলেন,
الإعداد الإيماني أساس لازم لجميع التكاليف الشاقة ومنها الجهاد، ومن ذلك أمر الله تعالى لنبيه صلى الله عليه وسلم بقوله: [يَاأَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمْ اللَّيْلَ إِلاَّ قَلِيلا نِصْفَهُ أَوْ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلا أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلْ الْقُرْآنَ تَرْتِيلا إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلا ثَقِيلا]، فأمره سبحانه بالاجتهاد في العبادة استعدادا لتحمل القول الثقيل وهو أعباء الرسالة. وهذه قاعدة عامة وهامة: وهي أن التكاليف الشرعية الشاقة لا بد لها من إعداد إيماني فإذا تم هذا الإعداد صار المرء مؤهلا لأداء التكليف الشاق كالجهاد ونحوه، وصار مؤهلا للتأييد والتثبيت الإلهي قدرا، …. والإعداد الإيماني يجبر نقص العدد والعدة لدى المسلمين بالنسبة لأعدائهم. -العمدة في إعداد العدة (1/381)
“জিহাদ সহ সকল কঠিন বিধান পালনের জন্য ঈমানী প্রস্তুতি অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি। এজন্যই আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ দিয়েছেন, “হে চাদরাবৃত! রাতের কিছু অংশ ছাড়া বাকী রাত (ইবাদতের জন্য) দাঁড়িয়ে যাও। রাতের অর্ধাংশ বা অর্ধাংশ থেকে কিছু কমাও। কিংবা তা থেকে কিছু বাড়িয়ে নাও এবং ধীরস্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত কর। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করছি এক গুরুভার বাণী।” (সূরা মুযযাম্মিল ৭৩: ০১-০৫)
আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইবাদত-বন্দেগিতে মেহনত-মুজাহাদার আদেশ দিয়েছেন (কুরআনের) ভারী বাণী তথা রিসালাতের গুরু দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতিস্বরূপ। এটি একটি ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি যে, ভারী দায়িত্ব পালনের জন্য ঈমানী প্রস্তুতি আবশ্যক। ঈমানী প্রস্তুতি পূর্ণ হলে মানুষ জিহাদ ও জিহাদের মতো অন্যান্য কঠিন বিধান পালনের যোগ্য হয় এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সাহায্য ও দৃঢ়তা লাভের যোগ্য হয়। ঈমানী প্রস্তুতি শত্রুর তুলনায় মুমিনদের শক্তি ও সংখ্যার ঘাটতি পূরণ করে দেয়।” –আল-উমদাহ: ১/৩৮১
শায়খ আবু মুহাম্মদ মাকদিসি বলেন,
ولن يستطيع العبد مواجهة الشرك وأهله ولن يقوى على التبرؤ منهم وإظهار العداوة لباطلهم إلا بعبادة الله حق عبادته، ولقد أمر الله عز وجل نبيه محمداً صلى الله عليه وسلم بتلاوة القرآن وقيام الليل في مكة وأعلمه بأن ذلك هو الزاد الذي يعينه على تحمل أعباء الدعوة الثقيلة وذلك قبل قوله: [إنا سنلقي عليك قولاً ثقيلاً] {المزمل: 5} فقال: [يا أيها المزمل قم الليل إلا قليلا، نصفه أو انقص منه قليلاً أو زد عليه ورتل القرآن ترتيلاً] {المزمل: 1 – 4} فقام صلوات الله وسلامه عليه وقام معه أصحابه حتى تفطرت أقدامهم .. إلى أن أنزل سبحانه التخفيف في آخر الآيات.
وإن هذا القيام بتلاوة آيات الله عز وجل وتدبر كلامه .. لخير زاد ومعين للداعي، يثبته ويعينه على مشاق الدعوة وعقباتها .. وإن الذين يظنون أنفسهم قادرين على تحمل الدعوة العظيمة بأعبائها الثقيلة بدون إخلاص العبادة لله عز وجل وبدون إطالة ذكره وتسبيحه لمخطئون وواهمون .. وإن ساروا خطوات، فلن يستطيعوا مواصلة الطريق الصحيح المستقيم بغير زاد .. وإن خير الزاد التقوى .
ولقد وصف الله عز وجل أصحاب هذه الدعوة والذين أمر نبيه صلوات الله وسلامه عليه أن يصبر نفسه معهم بأنهم يدعون ربهم بالغداة والعشي يريدون وجهه، وبأنهم قليلاً من الليل ما يهجعون .. وتتجافى جنوبهم عن المضاجع يدعون ربهم خوفاً وطمعاً .. ويخافون من ربهم يوماً عبوساً قمطريراً .. وغير ذلك من الصفات التي لا يصلح لهذه الدعوة وتحمل أعبائها إلا من اتصف بها، جعلنا الله تعالى وإياك منهم، فتنبه!! -ملة إبراهيم (ص: 15)
“আল্লাহর তাআলার যথাযথ ইবাদত ব্যতীত বান্দা কখনোই শিরক ও মুশরিকদের মোকাবেলা করা, তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ এবং তাদের বাতিল মতবাদের প্রতি শত্রুতা প্রকাশে সক্ষম হবে না। এজন্যই আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কায় কুরআন তিলাওয়াত ও রাত্রিজাগরণের আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন, এটাই সেই পাথেয় যা নবীজীর জন্য রিসালাতের গুরু দায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে। “আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করছি এক গুরুভার বাণী”- এই বাণীর আগে আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে চাদরাবৃত! রাতের কিছু অংশ ছাড়া বাকী রাত (ইবাদতের জন্য) দাঁড়িয়ে যাও। রাতের অর্ধাংশ কিংবা অর্ধাংশ থেকে কিছু কমাও। অথবা তা থেকে কিছু বাড়িয়ে নাও এবং ধীরস্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত কর।” -সূরা মুযযাম্মিল ৭৩: ০১-০৫
আল্লাহ তাআলার আদেশ অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম রাত জেগে ইবাদত করেন, এমনকি তাঁদের পা ফুলে ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা এ বিধান হালকা করে দেন।
কুরআন তিলাওয়াত ও তাদাব্বুর সহকারে এই রাত্রিজাগরণই দাঈর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয় ও সাহায্যকারী, যা তাকে দাওয়াতের দুর্গম পথে অবিচল রাখবে। যারা মনে করে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে একনিষ্ঠতা, দীর্ঘ সময় আল্লাহর যিকির ও তাসবীহ ছাড়াই তারা দাওয়াতের গুরু দায়িত্ব পালন করতে পারবে, তারা বিভ্রান্তির শিকার। কিছু পথ পাড়ি দিতে পারলেও পাথেয় ব্যতীত তারা পথচলা অব্যাহত রাখতে পারবে না। আর সর্বোত্তম পাথেয় তো তাকওয়া।
এই দাওয়াত বহনকারী, যাদের সাথে নিজেকে রাখতে আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ দিয়েছেন, আল্লাহ তাঁদের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে— “যারা তাদের রবকে সকাল সন্ধ্যা ডাকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, যারা রাতের খুব সামান্য অংশই ঘুমায়”…, “যাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা থাকে এবং তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকতে থাকে”…, “যারা তাদের রবের পক্ষ থেকে এমন এক দিনের ভয় করে, যেদিন চেহারা ভীষণভাবে বিকৃত হয়ে যাবে”… ইত্যাদি আরও গুণাবলি যাতে গুণান্বিত হওয়া ব্যতীত কেউ এই দাওয়াত ও তার গুরু দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত হয় না। আল্লাহ তাআলা তোমাকে ও আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। সুতরাং (হে পাঠক!) সতর্ক হও।” -মিল্লাতু ইববরাহীম, পৃ: ১৫
তিন. নফল ইবাদতের দ্বারা ফরযের ঘাটতি পূরণ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إن أول ما يحاسب به العبد يوم القيامة من عمله صلاته، فإن صلحت فقد أفلح وأنجح، وإن فسدت فقد خاب وخسر، فإن انتقص من فريضته شيء، قال الرب عز وجل: انظروا هل لعبدي من تطوع فيكمل بها ما انتقص من الفريضة، ثم يكون سائر عمله على ذلك. –سنن الترمذي (413. المحقق: بشار عواد معروف. الناشر: دار الغرب الإسلامي – بيروت). وقال الترمذي: حديث أبي هريرة حديث حسن غريب من هذا الوجه. وقد روي هذا الحديث من غير هذا الوجه، عن أبي هريرة.
“কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম সালাতের হিসাব নেওয়া হবে। যদি তা সঠিক বলে গণ্য হয়, সে কল্যাণপ্রাপ্ত ও সফলকাম হবে। আর যদি তা সঠিক বলে গণ্য না হয়, সে হবে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। ফরযের মধ্যে যদি কোনো ক্রটি দেখা যায়, মহান প্রভু বলবেন, দেখো! আমার বান্দার কোনো নফল আমল আছে কি? তা দিয়ে তার ফরযের যতটুকু ক্রটি আছে তা পূরণ করে দাও। অতঃপর তার অন্যান্য আমল এই নিয়মেই (হিসাব) হবে।” –সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং: ৪১৩, ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ (২৭৯ হি.) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
এজন্যই নফল ব্যতীত শুধু ফরয দ্বারা আখিরাতে কোনো পেরেশানি ব্যতীত নির্বিঘ্নে জান্নাতে যাওয়া কঠিন।
আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يا أيها الناس، أفشوا السلام، وأطعموا الطعام، وصلوا، والناس نيام، تدخلون الجنة بسلام. -سنن الترمذي (4/233 رقم: 2485) قال الترمذي: هذا حديث صحيح.
“হে লোক সকল, তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাদ্য খাওয়াও, মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করো। তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” –জামে তিরমিযী (২৪৯৫) ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
হাদীসের ব্যাখ্যায় শায়খ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ বলেন,
دخول الجنة بسلام – معناه – والله أعلم – دخولها من غير حساب ولا عذاب، وهذا ترغيب عظيم، لا ينبغي للقادر عليه أن يغفل عنه. –من صحاح الأحاديث القدسية (ص: 232 ط. دار المنهاج)
“নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশের অর্থ হলো কোনো হিসাব ও আযাব ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করা। এটা অনেক বড় ফযীলতের বিষয়, যে তা করতে সক্ষম তার জন্য এ থেকে গাফেল থাকা উচিত নয়।” -মিন সিহাহিল আহাদীসিল কুদসিয়্যাহ, পৃ: ২৩২ (দারুল মিনহাজ)
ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
كان الرجل في حياة النبي صلى الله عليه وسلم، إذا رأى رؤيا قصها على رسول الله صلى الله عليه وسلم فتمنيت أن أرى رؤيا، فأقصها على رسول الله صلى الله عليه وسلم، وكنت غلاما شابا، وكنت أنام في المسجد على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم فرأيت في النوم كأن ملكين أخذاني، فذهبا بي إلى النار، فإذا هي مطوية كطي البئر وإذا لها قرنان وإذا فيها أناس قد عرفتهم، فجعلت أقول: أعوذ بالله من النار، قال: فلقينا ملك آخر فقال لي: لم ترع. فقصصتها على حفصة فقصتها حفصة على رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: «نعم الرجل عبد الله، لو كان يصلي من الليل» فكان بعد لا ينام من الليل إلا قليلا. –صحيح البخاري (1121)
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় কোনো ব্যক্তি স্বপ্ন দেখলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে তা বর্ণনা করতেন। আমারও ইচ্ছে হলো, আমি কোনো স্বপ্ন দেখলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বর্ণনা করতে পারতাম। আমি ছিলাম যুবক। মসজিদে ঘুমাতাম। একদিন স্বপ্নে দেখলাম, যেন দুজন ফেরেশতা আমাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তা যেন কুয়ার বাঁধানো পাড়ের ন্যায় বাঁধানো। তাতে দুটি খুঁটি রয়েছে এবং এর মধ্যে রয়েছে এমন কতক লোক, যাদের আমি চিনতে পারলাম। আমি বলতে লাগলাম, আমি জাহান্নাম থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। তিনি বলেন, তখন অন্য একজন ফিরিশতা আমার সঙ্গে মিলিত হলেন। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ভয় নেই।
আমি এ স্বপ্ন (আমার বোন) হাফসা রাযিয়াল্লাহু আনহার কাছে বর্ণনা করলাম। এরপর হাফসা রাযিয়াল্লাহু আনহা তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বর্ণনা করলেন। তখন তিনি বললেন, আবদুল্লাহ কতই না ভালো লোক; যদি সে রাত জেগে সালাত আদায় করত! এরপর থেকে আবদুল্লাহ (ইবনে উমর) রাযিয়াল্লাহু আনহুমা খুব অল্প সময়ই ঘুমাতেন।” –সহীহ বুখারী, হাদীস নং: (১১২১)
হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
قال القرطبي: إنما فسر الشارع من رؤيا عبد الله ما هو ممدوح لأنه عرض على النار ثم عوفي منها، وقيل له لا روع عليك وذلك لصلاحه، غير أنه لم يكن يقوم من الليل فحصل لعبد الله من ذلك تنبيه على أن قيام الليل بما يتقي به النار والدنو منها فلذلك لم يترك قيام الليل بعد ذلك. -فتح الباري (3/ 7 ط. دار الفكر)
“কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ বিন উমরের স্বপ্ন থেকে ভালো অংশের ব্যাখ্যা করেছেন। কেননা তাঁকে জাহান্নামের সম্মুখীন করে অতঃপর জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ভয় পেও না। কারণ তিনি নেককার ছিলেন, কিন্তু রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন না। তাই এর মাধ্যমে তাঁকে সতর্ক করা হয়েছে যে, কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে জাহান্নাম ও এর নিকটবর্তী হওয়া থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। এজন্যই পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা আর রাত্রিজাগরণ ছাড়েননি।” -ফাতহুল বারী: ৩/৭ (দারুল ফিকর)
চার. শুধু জান্নাতে যাওয়াই মুমিনের লক্ষ্য নয়। বরং জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা লাভও মুমিনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আর জান্নাতের উচ্চমর্যাদা লাভ নফলের মাধ্যমেই সম্ভব। শুধু ফারায়েয আদায় করে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব হলেও উচ্চমর্যাদা লাভ করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63) وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا (64) وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ …………. وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا (72) ……… أُولَئِكَ يُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوا وَيُلَقَّوْنَ فِيهَا تَحِيَّةً وَسَلَامًا. -الفرقان: 63- 65، 72، 75
“রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূমিতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ করে (অজ্ঞতা সুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে। যারা রাত অতিবাহিত করে নিজ প্রতিপালকের সামনে (কখনো) সিজদারত অবস্থায়, (কখনো) দণ্ডায়মান অবস্থায়। যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! জাহান্নামের আযাব আমাদের থেকে ফিরিয়ে রাখুন।… যারা অন্যায় কাজে শরীক হয় না এবং যখন কোনো বেহুদা কার্যকলাপের নিকট দিয়ে যায়, তখন আত্মসম্মান বাঁচিয়ে যায়। … এরাই তারা, যাদেরকে তাদের সবরের প্রতিদানে জান্নাতের সুউচ্চ প্রাসাদ দেয়া হবে এবং সেখানে শুভেচ্ছা ও সালামের সাথে তাদের অভ্যর্থনা করা হবে” -সূরা ফুরকান ২৫: ৬৩-৬৫, ৭২, ৭৫
শেষোক্ত আয়াতে ‘ইবাদুর রহমান’ (রহমানের প্রকৃত বান্দাদের) যে ‘জান্নাতের সুউচ্চ প্রাসাদের’ সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, হাদীসে তার বিবরণ এসেছে এভাবে,
إن أهل الجنة ليتراءون الغرف في الجنة، كما تتراءون الكوكب في السماء. –صحيح البخاري (8/114رقم: 6555 ط. دار طوق النجاة) صحيح مسلم (4/ 2177 رقم: 2830 ط. دار إحياء التراث)
“(সাধারণ) জান্নাতবাসীরা জান্নাতের সুউচ্চ প্রাসাদগুলো দেখতে পাবে যেমনিভাবে তোমরা আকাশের তারকারাজি দেখ।” -সহীহ বুখারী: ৮/১১৪ হাদীস নং: ৬৫৫৫; সহীহ মুসলিম: ৪/২১৭৭ হাদীস নং: ২৮৩০
হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,
الغرفة: منزلة من أعلى منازل الجنة، …. والمراد من رؤية الغرفة هنا: أن أهل الجنة تتفاوت منازلهم بحسب درجاتهم في الفضل حتى أن أهل الدرجات العلى يراهم من هو أسفل منهم كالنجوم. –تكملة فتح الملهم (6/141 ط. دار إحياء التراث العربي)
“…হাদীসের উদ্দেশ্য হলো, মর্যাদার স্তরের ভিত্তিতে জান্নাতবাসীদের অবস্থানের তারতম্য হবে। ফলে নিম্নস্তরের জান্নাতিরা উচ্চস্তরের জান্নাতিদের দেখতে পাবে আকাশের তারার মতো।” -তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম: ৬/১৪১ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)
অপর হাদীসে এসেছে,
إن في الجنة غرفا يرى ظاهرها من باطنها، وباطنها من ظاهرها، فقال أبو موسى الأشعري: لمن هي يا رسول الله؟ قال: لمن ألان الكلام، وأطعم الطعام، وبات لله قائما والناس نيام. –مسند أحمد (6615) (مؤسسة الرسالة) والمعجم الكبير للطبراني (103) وحسن المنذري إسناد الطبراني في الترغيب والترهيب (1/424، الناشر: مكتبة مصطفى البابي الحلبي – مصر)
“জান্নাতে এমন সুউচ্চ প্রাসাদ রয়েছে যার ভিতর থেকে বাহির এবং বাহির থেকে ভিতর দেখা যায়। আবু মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সেটা কাদের জন্য? তিনি ইরশাদ করেন, যারা নম্রভাবে কথা বলবে, (মানুষকে) খাবার খাওয়াবে, আল্লাহর জন্য রাত জেগে কিয়ামুল্লাইল করবে; যখন সমস্ত মানুষ ঘুমন্ত থাকে।” –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ৬৬১৫, ইমাম মুনযিরী রহিমাহুল্লাহ (৬৫৬ হি.) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
জিহাদ ফরযে কেফায়া অবস্থায় যদিও জিহাদ ব্যতীত শুধু ফারায়েয আদায় করেই জান্নাতে যাওয়া সম্ভব, তারপরও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাননি মুসলিমরা জিহাদ ছেড়ে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হোক। আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
من آمن بالله وبرسوله، وأقام الصلاة، وصام رمضان كان حقا على الله أن يدخله الجنة، جاهد في سبيل الله أو جلس في أرضه التي ولد فيها»، فقالوا: يا رسول الله، أفلا نبشر الناس؟ قال: «إن في الجنة مائة درجة، أعدها الله للمجاهدين في سبيل الله، ما بين الدرجتين كما بين السماء والأرض، فإذا سألتم الله، فاسألوه الفردوس، فإنه أوسط الجنة وأعلى الجنة، وفوقه عرش الرحمن، ومنه تفجر أنهار الجنة». –صحيح البخاري (4/16 رقم: 2790 ط. دار طوق النجاة)
“যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, সালাত আদায় করল ও রমযানের সিয়াম পালন করল, সে আল্লাহর পথে জিহাদ করুক কিংবা স্বীয় জন্মভূমিতে বসে থাকুক, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায়।
সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা কি লোকদের এ সুসংবাদ পৌঁছে দিব না? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতে একশটি স্তর প্রস্তুত রেখেছেন। প্রতি দুটি স্তরের ব্যবধান আসমান জমিনের সমপরিমাণ। তোমরা আল্লাহর কাছে চাইলে ফেরদাউস চাইবে। কেননা এটাই হলো সবচাইতে উত্তম ও সর্বোচ্চ জান্নাত। এর উপরে রয়েছে রহমানের আরশ। আর সেখান থেকে জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হয়।” –সহীহ বুখারী: ৪/১৪ হাদীস নং: ৬৯৮৭ (দারু তওকিন নাজাহ)
হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখুল হাদীস আল্লামা সাঈদ আহমাদ পালনপুরী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
حديث كا حاصل يہ ہے كہ صرف جنت ميں جانا ہى مطلوب نہيں، بلكہ جنت ميں جو بلند درجات ہیں ان كو حاصل كرنا بھى مقصود ہے، اور وه درجات جہاد فی سبيل الله كے ذريعہ حاصل ہوتے ہیں ، پس خوشخبری سناؤ تو ساتھ ميں يہ بات بھى بتاؤ. –تحفة القارى: 6/200 ط. مكتبہ حجاز، ديوبند
“হাদীসের সারমর্ম হলো, শুধু জান্নাতে যাওয়াই লক্ষ্য নয়। বরং জান্নাতের উচ্চস্তর অর্জনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আর তা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর দ্বারা অর্জিত হয়। তাই (ফারায়েয আদায়ে) জান্নাতের সুসংসাদ শোনালে সাথে এ বিষয়টিও জানিয়ে দাও। -তুহফাতুল কারী: ৬/২০০ (মাকতাবায়ে হেজায, দেওবন্দ)
এমনকি জিহাদে শাহাদাত লাভকারী সকলের মর্যাদাও সমান হবে না। ঈমান-আমলের ভিত্তিতে তাদের মর্যাদার মধ্যেও তারতম্য হবে। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الشهداء أربعة: رجل مؤمن جيد الإيمان، لقي العدو، فصدق الله حتى قتل، فذلك الذي يرفع الناس إليه أعينهم يوم القيامة هكذا ورفع رأسه حتى وقعت قلنسوته، قال: فما أدري أقلنسوة عمر أراد أم قلنسوة النبي صلى الله عليه وسلم؟ قال: ورجل مؤمن جيد الإيمان لقي العدو فكأنما ضرب جلده بشوك طلح من الجبن أتاه سهم غرب فقتله فهو في الدرجة الثانية، ورجل مؤمن خلط عملا صالحا وآخر سيئا لقي العدو فصدق الله حتى قتل فذلك في الدرجة الثالثة، ورجل مؤمن أسرف على نفسه لقي العدو فصدق الله حتى قتل فذلك في الدرجة الرابعة. رواه الترمذي (1644) وقال: هذا حديث حسن. وروى أحمد (17657) من حديث عن عتبة بن عبد السلمي نحوه، وزاد فيه: فمصمصة محت ذنوبه وخطاياه، إن السيف محاء الخطايا، وأدخل من أي أبواب الجنة شاء.
“শহীদরা চার শ্রেণিতে বিভক্ত:
১. মজবুত ঈমানের অধিকারী (মুত্তাকী ও নেককার) ব্যক্তি। সে শত্রুর মুখোমুখি হয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে নিহত হয়। কিয়ামতের দিন মানুষ তার দিকে এভাবে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকবে, (এ কথা বলে) তিনি তাঁর মাথা উত্তোলন করে দেখালেন, এমনকি এতে তাঁর টুপি পড়ে গেল, (বর্ণনাকারী বলেন) আমি জানি না, এখানে কার টুপি উদ্দেশ্য, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের টুপি? না উমরের টুপি?
২. মজবুত ঈমানের অধিকারী (কিন্তু ভীরু)। যখন সে শত্রুর মুখোমুখি হয়, ভীরুতার কারণে তার নিকট মনে হয়, যেন তার চামড়ায় বাবলা গাছের কাঁটা দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। হঠাৎ একটি তীর বিদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলল। সে হলো দ্বিতীয় স্তরের শহীদ।
৩. এমন মুমিন, যে কিছু নেক আমলও করেছে এবং গুনাহের কাজও করেছে। সে শত্রুর মুখোমুখি হয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয়। সে হলো তৃতীয় স্তরের শহীদ।
৪. এমন মুমিন যে অনেক গুনাহ করে নিজের উপর জুলুম করেছে, সে শত্রুর মুখোমুখি হয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করে এবং নিহত হয়। সে হলো চতুর্থ স্তরের।”
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত অপর হাদীসে এসেছে, “এই মৃত্যু তার গুনাহকে মিটিয়ে দিবে। নিশ্চয়ই তরবারি গুনাহকে সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দেয় এবং সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা, প্রবেশ করবে।” -জামে তিরমিযী: ১৬৪৪; মুসনাদে আহমদ: ১৭৬৫৭ ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
অপর এক হাদীসে এসেছে,
عن طلحة بن عبيد الله، أن أعرابيا جاء إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم ثائر الرأس، فقال: يا رسول الله أخبرني ماذا فرض الله علي من الصلاة؟ فقال: «الصلوات الخمس إلا أن تطوع شيئا»، فقال: أخبرني ما فرض الله علي من الصيام؟ فقال: «شهر رمضان إلا أن تطوع شيئا»، فقال: أخبرني بما فرض الله علي من الزكاة؟ فقال: فأخبره رسول الله صلى الله عليه وسلم شرائع الإسلام، قال: والذي أكرمك، لا أتطوع شيئا، ولا أنقص مما فرض الله علي شيئا، وفي رواية -والله لا أزيد على هذا ولا أنقص- فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم «أفلح إن صدق، أو دخل الجنة إن صدق». –صحيح البخاري (1891)
“তালহা বিন উবায়দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এলোমেলো চুল বিশিষ্ট একজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলেন। এসে বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে বলুন, আল্লাহ তাআলা আমার উপর কত (ওয়াক্ত) সালাত ফরয করেছেন? তিনি বললেন: পাঁচ (ওয়াক্ত) সালাত; তবে তুমি যদি কিছু নফল আদায় কর (সেটা আলাদা)। এরপর তিনি বললেন, বলুন, আমার উপর কত সিয়াম আল্লাহ তাআলা ফরয করেছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রমযান মাসের সাওম; তবে তুমি যদি কিছু নফল কর (সেটা আলাদা)। এরপর তিনি বললেন, বলুন, আল্লাহ আমার উপর কী পরিমাণ যাকাত ফরয করেছেন? বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইসলামের বিধান জানিয়ে দিলেন। এরপর তিনি বললেন, ওই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দিয়ে সম্মানিত করেছেন, আমি নফল কিছু করব না এবং আল্লাহ আমার উপর যা ফরয করেছেন তা থেকে কমাবও না। (অপর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর শপথ! আমি এর অতিরিক্ত কোনো কিছু করব না এবং এ থেকে কমাবও না) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে সত্য বলে থাকলে সফল হবে কিংবা বলেছেন, সে সত্য বলে থাকলে জান্নাত লাভ করবে।” –সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৮৯১
হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২ হি.) বলেন,
فإن قيل أما فلاحه بأنه لا ينقص فواضح، وأما بأن لا يزيد فكيف يصح؟ أجاب النووي: بأنه أثبت له الفلاح لأنه أتى بما عليه. وليس فيه أنه إذا أتى بزائد على ذلك لا يكون مفلحا، لأنه إذا أفلح بالواجب ففلاحه بالمندوب مع الواجب أولى …. وهذا جار على الأصل بأنه لا إثم على غير تارك الفرائض، فهو مفلح وإن كان غيره أكثر فلاحا منه. -فتح الباري (1/ 108)
“এখানে প্রশ্ন হয় যে, সে উল্লিখিত বিষয়াদিতে কোনো কমতি না করার কারণে সফলকাম হবে সেটা তো স্পষ্ট কিন্তু উল্লিখিত বিষয়গুলোর অতিরিক্ত কোনো কিছু না করার ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে তাঁকে সফলকাম বললেন? ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ এর উত্তরে বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফারায়েয আদায়ের কারণে তাঁকে সফলকাম বলেছেন। কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করলে সফল হবে না এমনটা বলা হয়নি। কেননা যখন সে ফারায়েয আদায় করেই সফল হচ্ছে তাহলে ফারায়েযের সাথে নফল আদায় করলে যে সফল হবে, তা হওয়া তো বলাই বাহুল্য।” …. উপর্যুক্ত জবাব এই মূলনীতির আলোকে যে, ফারায়েয ব্যতীত অন্য কিছু ছাড়া গুনাহ নয়। তাই ফারায়েয আদায়ের কারণে সে সফল হবে; যদিও অন্যরা (নফল আদায়ের কারণে) তারচেয়ে বেশি সফল হবে।” -ফাতহুল বারী: ১/১০৮ (দারুল ফিকির)
পাঁচ. নিজের অধীনস্থদের নফল ইবাদতের জন্য চাপ প্রয়োগ করা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। বস্তুত ইসলাম যদিও এটাই চায় যে, মানুষ ফরয-নফল সব ইবাদতই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আদায় করবে, কিন্তু বাস্তবে অনেকেই চাপ প্রয়োগ ব্যতীত যথাযথভাবে ইবাদত করতে পারে না। তবে প্রথমদিকে কিছুটা চাপের কারণে করলে পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই হাদীসের আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম অধীনস্থ ও তারবিয়ারতদের ক্ষেত্রে নফল ইবাদতেও চাপ প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«رحم الله رجلا قام من الليل فصلى، ثم أيقظ امرأته فصلت، فإن أبت نضح في وجهها الماء، ورحم الله امرأة قامت من الليل فصلت، ثم أيقظت زوجها فصلى، فإن أبى نضحت في وجهه الماء». –سنن النسائي (1610) (تحقيق: عبد الفتاح أبو غدة، الناشر: مكتب المطبوعات الإسلامية – حلب) وصححه العراقي في تخريج الإحياء (ص: 1781، الناشر: دار ابن حزم، بيروت – لبنان)
“আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে রাতের কিছু অংশ জেগে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে, অতঃপর তার স্ত্রীকেও জাগিয়ে দেয়, সেও তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে। যদি স্ত্রী জাগ্রত হতে না চায় তবে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। ওই মহিলার উপরও আল্লাহ তাআলা রহম করুন, যে রাতের কিছু অংশ জেগে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে। অতঃপর তার স্বামীকেও জাগিয়ে দেয়, সেও তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে। যদি সে জাগ্রত হতে না চায় তবে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়।” –সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং: ১৬১০, হাফেয ইরাকী রহিমাহুল্লাহ (৮০৬ হি.) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
ইমাম ইবনে হিব্বান রহিমাহুল্লাহ (৩৫৪ হি.) এই হাদীসের শিরোনাম দিয়েছেন এভাবে,
ذكر استحباب إيقاظ المرء أهله لصلاة الليل ولو بالنضح. -صحيح ابن حبان: 6/ 306 ط. مؤسسة الرسالة)
“প্রয়োজনে পানি ছিটিয়ে হলেও পরিবারকে তাহাজ্জুদের জন্য জাগানো মুস্তাহাব।” –সহীহ ইবনে হিব্বান: ৬/৩০৬ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ)
আল্লামা ইবনে মালাক রহিমাহুল্লাহ (৮৫৪ হি.) বলেন,
وهذا يدل على أن إكراه أحد على خير يجوزُ، بل يستحب. –شرح مصابيح السنة (2/168، الناشر: إدارة الثقافة الإسلامية، الطبعة: الأولى، 1433 هـ – 2012 م)
“এই হাদীস প্রমাণ করে, কাউকে ভালো কাজে বল প্রয়োগ করা জায়েয; বরং মুস্তাহাব।”
–শরহু মাসাবীহিস সুন্নাহ: ২/১৬৮
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহিমাহুল্লাহ (৮৫৫ হি.) বলেন,
وفيه حث عظيم على قيام الليل، حتى إن من لم يقم اختيارا يقام بالإزعاج. –شرح سنن أبي داود (5/215، الناشر: مكتبة الرشد – الرياض)
“উক্ত হাদীসে কিয়ামুল লাইলের প্রতি অনেক উৎসাহ-অনুপ্রেরণা রয়েছে। এমনকি যে স্বেচ্ছায় করবে না, তাকে কিছু চাপ প্রয়োগের অবকাশ দেওয়া হয়েছে।” –শরহু সুনানি আবি দাউদ: ৫/২১৫
অপর হাদীসে এসেছে,
عن عائشة رضي الله عنها، قالت: «كان النبي صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر شد مئزره، وأحيا ليله، وأيقظ أهله». –صحيح البخاري (2024، الناشر: دار طوق النجاة)
“আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রমযানের শেষ দশক আসত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে বেঁধে নিতেন এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।” –সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ২০২৪
অপর বর্ণনায় হাদীসটি এভাবে এসেছে,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا بقي من الشهر عشرة أيام لم يذر أحدا من أهله يطيق القيام إلا أقامه. -مختصر قيام الليل (ص: 247 حديث أكادمي، فيصل اباد – باكستان) فتح الباري (4/269)
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে তাঁর পরিবারের যারাই রাত জাগতে সক্ষম ছিল তাদের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন, কাউকে বাদ দিতেন না।”
-মুখতাসারু কিয়ামুল লাইল, পৃ: ২৪৭; ফাতহুল বারী: ৪/২৬৯
ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ (১৭৯ হি.) বর্ণনা করেন,
أن عمر بن الخطاب كان يصلي من الليل ما شاء الله، حتى إذا كان من آخر الليل، أيقظ أهله للصلاة. يقول لهم: الصلاة، الصلاة. ثم يتلو هذه الآية: [وأمر أهلك بالصلوة واصطبر عليها لا نسئلك رزقا نحن نرزقك والعاقبة للتقوى]. -موطأ مالك(1/119 ط. دار إحياء التراث)
“উমর বিন খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু রাতে সালাত আদায় করতেন আল্লাহ তাআলা যতটুকু চান। অতঃপর শেষরাতে পরিবারের লোকদের সালাতের জন্য জাগিয়ে দিতেন। তাঁদেরকে বলতেন, সালাত, সালাত। এরপর এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন, “নিজ পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ কর এবং নিজেও তাতে অবিচল থাক। আমি তোমার কাছে রিযিক চাই না। রিযিক তো আমিই দেব। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই।” [সূরা তহা ২০: ১৩২] –মুআত্তা মালেক: ১/১১৯ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)
ইমাম আবুল ওয়ালিদ বাজী রহিমাহুল্লাহ (৪৭৪ হি.) বলেন,
وإيقاظه أهله من آخر الليل يريد بذلك أن يأخذوا من نافلة الليل بحظ وإن قل. -المنتقى شرح الموطإ (1/213 مطبعة السعادة)
“উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু শেষরাতে পরিবারকে জাগিয়ে দিতেন যেন তাঁরা রাতের নফল সালাতের কিছু অংশ পায়, যদিও তা কম হয়।” -আল-মুনতাকা: ১/২১৩ (মাতবাআতুস সাআদাহ)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
“مروا أولادكم بالصلاة وهم أبناء سبع سنين، واضربوهم عليها وهم أبناء عشر، وفرقوا بينهم في المضاجع.” -سنن أبي داود: 495 )ط. دار الرسالة العالمية)
“সাত বছর বয়সে তোমরা সন্তানদের সালাতের আদেশ দাও। আর দশ বছর বয়সে সালাতের জন্য প্রহার কর এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।” -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ৪৯৫
প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আলাউদ্দীন কাসানী রহিমাহুল্লাহ (৫৮৭ হি.) এই হাদীস উল্লেখ করে বলেন,
وذلك بطريق التأديب والتهذيب لا بطريق العقوبة؛ لأنها تستدعي الجناية، وفعل الصبي لا يوصف بكونه جناية. –بدائع الصنائع: 7/64 (ط. دار الكتب العلمية)
“এই প্রহার শিক্ষাদান ও সংশোধনের জন্য, শাস্তি হিসেবে নয়। কেননা শাস্তি দেওয়া হয় অপরাধ করলে। আর শিশুর কোনো কাজকে অপরাধ বলা যায় না।” -বাদায়েউস সানায়ে: ৭/৬৪ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
আল্লামা শামী রহিমাহুল্লাহ (১২৫২ হি.) বলেন,
له إكراه طفله على تعلم قرآن وأدب وعلم. -رد المحتار: (4/ 78 ط. دار الفكر)
“কুরআন, আদব ও ইলম শিখার জন্য বাবা সন্তানকে বাধ্য করতে পারবে।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/৭৮ (দারুল ফিকর)
শায়খ আহমদ সারহিন্দি রহিমাহুল্লাহ (১০৩৪) তাঁর এক মুরিদের নিকট প্রেরিত চিঠিতে লিখেন,
والنّصيحة الاخرى الّتي أنصح بها التزام صلاة التّهجّد … إذا تعسّر عليكم هذا المعنى ولم يتيسّر الانتباه على خلاف المعتاد ينبغي أن يوكّل لهذا الامر جمعا من المتعلّقين ليوقظوكم وقت التّهجّد طوعا أو كرها ولا يتركوكم على نوم الغفلة فإذا فعلتم ذلك أيّاما يرجى أن تتيسّر المداومة على ذلك من غير تكلّف. -المكتوبات للسرهندي (2/ 174)
“অপর যে নসীহতটি আমি আপনাকে করবো তা হলো, নিজের উপর তাহাজ্জুদ আবশ্যক করে নেওয়া। … যদি আপনার জন্য অভ্যাসের বিপরীতে ঘুম থেকে উঠা কষ্টকর হয় তাহলে নিজের সাথে সম্পৃক্ত কিছু মানুষকে দায়িত্ব প্রদান করতে পারেন, যেন তারা তাহাজ্জুদের সময় আপনাদের জাগিয়ে দেয়, আপনার ইচ্ছা থাক কিংবা না থাক এবং গাফলতের ঘুমে বিভোর থাকতে আপনাকে না দেন। কিছুদিন এভাবে করলে আশা করা যায় কোনো কষ্ট ছাড়াই নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া সহজ হয়ে যাবে।” -আল-মাকতুবাত: ২/১৭৪
অবশ্য চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অধীনস্থদের শারীরিক অবস্থা, সুস্থতা-অসুস্থতা, দুর্বলতা-সক্ষমতা ইত্যাদির প্রতিও লক্ষ রাখা জরুরি। যেন চাপ প্রয়োগটা তাদের জন্য অসহনীয় মনে না হয় এবং তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে না যায়।
আবু মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا بعث أحدا من أصحابه في بعض أمره، قال: بشروا ولا تنفروا، ويسروا ولا تعسروا. -صحيح مسلم (3/ 1358 رقم الحديث: 1732 ط.دار إحياء التراث)
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সাহাবীকে কোনো কাজে প্রেরণ করতেন, তখন বলতেন, “তোমরা লোকদেরকে সুসংবাদ দেবে; বিরক্তি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করবে না, সহজ করবে; কঠোরতা পরিহার করবে।” -সহীহ মুসলিম: ৩/১৩৫৮ হাদীস নং: ১৭৩২ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)
অপর হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করেছেন,
«اللهم من ولي من أمر أمتي شيئا فشق عليهم، فاشقق عليه، ومن ولي من أمر أمتي شيئا فرفق بهم، فارفق به». -صحيح مسلم (3/1458 رقم الحديث: 1828 ط. دار إحياء التراث)
“হে আল্লাহ! যে আমার উম্মতের কোনো বিষয়ের দায়িত্ব লাভ করে তাদের প্রতি কঠোরতা করে, তুমিও তার প্রতি কঠোরতা কর। আর যে আমার উম্মতের কোনো বিষয়ের দায়িত্ব লাভ করে তাদের প্রতি নম্রতা করে, তুমিও তার প্রতি নম্রতা কর।” –সহীহ মুসলিম: ৩/১৪৫৮ হাদীস নং: ১৮২৮ (দারু ইহইয়ায়িত তুরাস)
ছয়. মুসলমানদের যেকোনো ইজতেমায়ী অবস্থানে একজনকে আমীর বানিয়ে তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। দীনের যেসব ইজতেমায়ী কাজ এককভাবে সম্ভব নয়, সেসব কাজে তা আরও বেশি জরুরি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,
{إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ فَإِذَا اسْتَأْذَنُوكَ لِبَعْضِ شَأْنِهِمْ فَأْذَنْ لِمَنْ شِئْتَ مِنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمُ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ} [النور: 62]
“মুমিন তো কেবল তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং যখন রাসূলের সঙ্গে সমষ্টিগত কোনো কাজে শরীক হয়, তখন তার অনুমতি ছাড়া কোথাও যায় না। (হে নবী!) যারা আপনার অনুমতি নেয়, তারাই সত্যিকার অর্থে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখে। সুতরাং তারা যখন তাদের কোনো কাজের জন্য আপনার নিকট অনুমতি চায়, তখন যাকে ইচ্ছা অনুমতি দিন। আর তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” –সূরা আননূর ২৪: ৬২
আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا كان ثلاثة في سفر فليؤمروا أحدهم. -سنن أبي داود( 2608، الناشر: دار الرسالة العالمية). ورواه البزار عن ابن عمر، وصححه الحافظ ابن حجر في “مختصر زوائد البزار” (1/690)
“তিন ব্যক্তি সফরে থাকলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।”
–সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ২৬০৮
উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
إذا كان نفر ثلاث فليؤمروا أحدهم، ذاك أمير أمره رسول الله صلى الله عليه وسلم. -صحيح ابن خزيمة (4/141 رقم: 2541 ط. المكتب الإسلامي) مسند البزار: (1/ 462 رقم: 329 ط. مكتبة العلوم والحكم) وقال الحافظ ابن كثير في “مسند الفاروق” (3/ 59 ط. دار الفلاح) : “هذا إسناد جيد.” وقال الهيثمي في مجمع الزوائد (5/255 ط. مكتبة القدسي) : “رجاله رجال الصحيح خلا عمار بن خالد، وهو ثقة.” وقال الحافظ ابن حجر في “مختصر زوائد البزار” (1/689) : “إسناده صحيح.”
“তোমাদের তিনজন একত্রিত হলে যেন একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়। এ আমীর নবীজীর পক্ষ থেকে নিয়োজিত আমীর।” –মুসনাদে বাযযার: ১/৪৬২ হাদীস নং: ৩২৯ (মাকতাবাতুল উলুমি ওয়াল হিকাম) ইমাম ইবনে কাসীর (৭৭৪ হি.), হাফেয হাইসামী (৮০৭ হি.) ও ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ (৮৫২ হি.) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
উপর্যুক্ত হাদীস দুটি উল্লেখ করে ইমাম তাহাভী রহিমাহুল্লাহ (৩২১ হি.) বলেন,
ففي هذين الحديثين أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قد جعل الأمير الذي يؤمره الناس عليهم حيث يبعدون من أمرائهم، كأمرائهم عليهم في وجوب السمع منهم، والطاعة له فيما يأمرهم به أمراؤهم، إذا كانوا بحضرتهم. -شرح مشكل الآثار (12/38 ط. مؤسسة الرسالة)
“উপর্যুক্ত হাদীস দুটি প্রমাণ করে, আমীরদের কাছে থাকার সময় যেমন তাদের আনুগত্য আবশ্যক, তেমনি তাদের থেকে দূরে থাকাবস্থায় মানুষ যাদেরকে আমীর বানিয়ে নেয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আনুগত্যও আবশ্যক করে দিয়েছেন।”
–শরহু মুশকিলিল আসার: ১২/৩৮ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ)
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অপর হাদীসে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لا يحل لثلاثة نفر يكونون بأرض فلاة الا أمروا عليهم أحدهم. –مسند أحمد(6647 مؤسسة الرسالة) وصححه الشيخ أحمد شاكر في تعليقه على مسند أحمد (6/204، الناشر: دار الحديث – القاهرة)
“যেকোনো তিন ব্যক্তির জন্য কোনো মরু ময়দানে অবস্থান করা জায়েয নয়, যতক্ষণ না তারা তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।” –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ৬৬৪৭, হাদীসটি সহীহ
ইমাম খাত্তাবী রহিমাহুল্লাহ (৩৮৮ হি.) বলেন,
إنما أمر بذلك ليكون أمرهم جميعا ولا يتفرق بهم الرأي ولا يقع بينهم خلاف فيعنتوا اهـ. –معالم السنن: (2\260، الناشر: المطبعة العلمية – حلب)
“আমীর নির্ধারণের আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং পরস্পর অনৈক্য ও মতবিরোধে লিপ্ত হয়ে কষ্টে না পড়ে যায়।” –মাআলিমুস সুনান: ২/২৬০
আল্লামা কাজী শাওকানী রহিমাহুল্লাহ (১২৫০ হি.) বলেন,
وفيها دليل على أنه يشرع لكل عدد بلغ ثلاثة فصاعدا أن يؤمروا عليهم أحدهم لأن في ذلك السلامة من الخلاف الذي يؤدي إلى التلف، فمع عدم التأمير يستبد كل واحد برأيه ويفعل ما يطابق هواه فيهلكون، ومع التأمير يقل الاختلاف وتجتمع الكلمة، وإذا شرع هذا لثلاثة يكونون في فلاة من الأرض أو يسافرون فشرعيته لعدد أكثر يسكنون القرى والأمصار ويحتاجون لدفع التظالم وفصل التخاصم أولى وأحرى. –نيل الأوطار (8/294، الناشر: دار الحديث، مصر)
“এ হাদীসগুলো একথার দলীল যে, তিন বা ততোধিক সংখ্যার সকলের জন্যই বিধান হলো, তারা নিজেদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেবে। কেননা এর মাধ্যমেই তারা পারস্পরিক মতবিরোধ থেকে মুক্তি পাবে, যে মতবিরোধ তাদেরকে ধ্বংসে নিপতিত করতে পারে। আমীর নির্ধারণ না করলে সকলেই নিজের বুঝ অনুযায়ী স্বেচ্ছাচারিতা দেখাবে। নিজ খাহেশ মতো কাজ করবে। এভাবে তারা ধ্বংসে নিপতিত হবে। পক্ষান্তরে আমীর বানিয়ে নিলে মতবিরোধ কমে যাবে এবং ঐক্য বজায় থাকবে। মরু ময়দানে কিংবা সফরে থাকা তিন জনের বেলায়ই যখন এই বিধান; তখন গ্রাম ও শহরে বসবাসরত এর চেয়ে বেশি সংখ্যক, যারা পারস্পরিক জুলুম প্রতিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ মেটানোর প্রতি মুখাপেক্ষী, তাদের বেলায় তো এ বিধান আরও আগেই প্রযোজ্য।” -নাইলুল আওতার: ৮/২৯৪
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ (৭২৮ হি.) বলেন,
يجب أن يعرف أن ولاية أمر الناس من أعظم واجبات الدين؛ بل لا قيام للدين ولا للدنيا إلا بها. فإن بني آدم لا تتم مصلحتهم إلا بالاجتماع لحاجة بعضهم إلى بعض ولا بد لهم عند الاجتماع من رأس حتى قال النبي صلى الله عليه وسلم {إذا خرج ثلاثة في سفر فليؤمروا أحدهم}. رواه أبو داود من حديث أبي سعيد وأبي هريرة. وروى الإمام أحمد في المسند عن عبد الله بن عمرو أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: {لا يحل لثلاثة يكونون بفلاة من الأرض إلا أمروا عليهم أحدهم} فأوجب صلى الله عليه وسلم تأمير الواحد في الاجتماع القليل العارض في السفر تنبيها بذلك على سائر أنواع الاجتماع. اهـ. –مجموع الفتاوى (28/390، مجمع الملك فهد)
“একথা জানা জরুরি যে, জনগণের নেতৃত্ব দেওয়া দীনের প্রধানতম ফরয দায়িত্বগুলোর অন্যতম। শুধু তাই নয়, বরং নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ব্যতীত দীন-দুনিয়া কোনোটাই চলতে পারে না। পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধ হওয়া ব্যতীত মানব জাতির মাসলাহাসমূহের পূর্ণতা সম্ভব নয়। কারণ মানুষ একে অপরের মুখাপেক্ষী। আর ঐক্যবদ্ধ হতে হলে একজন নেতা আবশ্যক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এতটুকু পর্যন্ত বলেছেন যে, ‘তিন ব্যক্তি সফরে বের হলে তারাও যেন একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।’ ইমাম আবু দাউদ রহিমাহুল্লাহ হাদীসটি হযরত আবু সাঈদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ মুসনাদে আহমাদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “যেকোনো তিন ব্যক্তির জন্য কোনো মরু ময়দানে অবস্থান করা জায়েয নয়, যতক্ষণ না তারা তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।”
সফরে সৃষ্টি হওয়া ছোট্ট একটি জামাআতের বেলায়ও একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন একথা বুঝানোর জন্য যে, সব ধরনের জামাআতের ক্ষেত্রেই আমীর বানিয়ে নেওয়া আবশ্যক।” –মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০
সাত. বিশেষত জিহাদের জন্য কোনো আমীরের আনুগত্যে জামাতবদ্ধ হওয়া আরও বেশি জরুরি। জামাতবদ্ধ হওয়া ব্যতীত জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি কার্যকর জিহাদী কার্যক্রম আঞ্জাম দেওয়াও সম্ভব নয়।
ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب. –الأشباه والنظائر للسبكي (2/ 88 ط. دار الكتب العلمية) المنثور في القواعد الفقهية للزركشي (1/ 235 وزارة الأوقاف الكويتية) شرح القواعد الفقهية للزرقاء (ص: 486 ط. دار القلم)
“যে বিষয় ব্যতীত ফরয আদায় করা যায় না তা করাও ফরয।” –আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের: ২/৮৮ (দারুল কুতুব); আল-মানসুর ফিল কাওয়ায়েদ: ১/২৩৫; শরহুল কাওয়ায়েদুল ফিকহিয়্যাহ, পৃ: ৪৮৬ (দারুল কলম, দিমাশক)
শায়খ আব্দুল কাদির বিন আব্দুল আযীয বলেন,
فبالجماعة والسمع والطاعة تتكون الشوكة اللازمة للجهاد … والنصوص في تَكَوُّن الشوكة بالموالاة الإيمانية كثيرة، منها قوله تعالى…: [فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضْ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا]، فكف بأس الكافرين لا يتم إلا بالشوكة المتحصلة بتحريض المؤمنين، وقد قال الله تعالى لنبيه صلى الله عليه وسلم : «وقاتل بمن أطاعك من عصاك». {صحيح مسلم (4/2197) رقم: 2865 ط. دار إحياء التراث} -العمدة في إعداد العدة (2/71)
“জামাতবদ্ধ হওয়া এবং শ্রবণ ও আনুগত্য দ্বারাই জিহাদের জন্য আবশ্যকীয় শক্তি অর্জিত হয়। …. ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দ্বারা শক্তি অর্জন হওয়া কুরআন-সুন্নাহর অসংখ্য বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর। তোমার উপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারও দায়ভার নেই। অবশ্য মুমিনদেরকে উৎসাহ দিতে থাক। অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ কাফেরদের যুদ্ধ ক্ষমতা চূর্ণ করে দিবেন। আল্লাহর শক্তি সর্বাপেক্ষা প্রচণ্ড এবং তারঁ শাস্তি অতি কঠোর।” [সূরা নিসা ০৪: ৮৪] সুতরাং মুমিনদের জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার দ্বারা যে শক্তি অর্জন হবে তা দ্বারাই কাফেরদের শক্তি খর্ব করা যাবে। আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, “যারা তোমার আনুগত্য করেছে তাদেরকে নিয়ে তোমার অবাধ্যদের সাথে যুদ্ধ কর।” [সহীহ মুসলিম: ৪/২১৯৭ হাদীস নং: ২৮৭৫]” –আল-উমদাহ: ২/৭১
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো হৃদয়ঙ্গম করার পর এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রশ্নে মূলত দুটি বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে,
এক. নফল ইবাদতে গুরুত্ব প্রদান ও চাপ প্রয়োগের বিধান।
নফল ইবাদতের গুরুত্ব ও তাতে চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। এ আলোচনার পর আশা করি তাতে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
ফারায়েয যথাযথভাবে আদায় করতে পারলে জান্নাতে যাওয়া যাবে ঠিক, কিন্তু আমরা কি ফারায়েয যথাযথভাবে আদায় করতে পারছি? আমরা কি দাবি করতে পারবো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সাহাবীদের শুধু ফরয আদায়ের ভিত্তিতে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন আমরাও তাঁদের মতো যথাযথভাবে ফরয আদায় করতে পারছি? শুধু ফরয নামাযের বিষয়টাই ধরুন। হাদীসে এসেছে,
خمس صلوات افترضهن الله عز وجل، من أحسن وضوءهن وصلاهن لوقتهن وأتم ركوعهن وخشوعهن كان له على الله عهد أن يغفر له، ومن لم يفعل فليس له على الله عهد، إن شاء غفر له، وإن شاء عذبه. -سنن أبي داود ت الأرنؤوط (1/ 316 رقم: 425 ط. دار الرسالة العالمية) وقال النووي في خلاصة الأحكام (1/246) : “صحيح رواه مالك في الموطأ وأبو داود، …، وأحد إسنادي أبي داود على شرط الصحيحين.” وكذا صححه السخاوي في “الأجوبة المرضية” (2/ 819 ط. دار الراية)
“আল্লাহ তাআলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অযু করে নির্ধারিত সময়ে বিনয়ের সাথে সালাত আদায় করবে, তার জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, আল্লাহ তার সমস্ত পাপ মাফ করবেন। পক্ষান্তরে যারা এরূপ করবে না, তাদের জন্য আল্লাহর কোনো অঙ্গীকার নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাদের ক্ষমা করবেন অন্যথায় শাস্তি দেবেন।” –সুনানে আবু দাউদ: ১/৩১৬ হাদীস নং: ৪২৫ (দারুল রিসালাতিল আলামিয়্যা)
লক্ষ করুন, এখানে যেভাবে সালাত আদায় করলে মাগফিরাতের ওয়াদা করা হয়েছে, আমরা কি সেভাবে আদায় করতে পারছি? একটু হিসেব কষে দেখুন তো, জীবনে যত ফরয সালাত আদায করেছি, তার কত ভাগ পূর্ণ খুশু খুজুর সঙ্গে আদায় করেছি, আর কত ভাগ গাফলতের সঙ্গে আদায় করেছি? এই সালাতে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছি? না, আযাবের উপযুক্ত হয়েছি?
তাছাড়া আমরা যে দুই একটি ঘটনার ভিত্তিতে নফলের গুরুত্ব হ্রাস করতে চাচ্ছি, এটা কি ‘ফাহমুস সালাফ’ (সাহাবা-তাবেঈন ও সালাফে সালেহীন যেভাবে দীন বুঝেছেন) -এর সাথে মিলে? এই ঘটনাগুলো থেকে কি কেউ এমন বুঝেছেন যে, নফলের গুরুত্ব না দিলেও সমস্যা নেই, সুতরাং আমি শুধু ফরযগুলো যথাযথভাবে আদায় করব? رهبان بالليل فرسان بالنهار ‘রাতে ইবাদতগুজার, দীনে ঘোড়সওয়ার’ কাদের ব্যাপারে বলা হত? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ বাদ দিয়ে জীবনে কি করে আমরা সফল হতে পারবো?
আসলে উক্ত হাদীসে তো একটি দিক বলা হয়েছে যে, কেউ যদি হক আদায় করে ফরযগুলো আদায় করতে পারে, সে সফল হবে। কিন্তু আমাদের মতো দুর্বলরা যে হক আদায় করে ফরযগুলো আদায় করতে পারি না, তা কি আমাদের উপলব্ধিতে আছে? যদি এই উপলব্ধি না থাকে, তাহলে আমাদের ধ্বংসের জন্য এটাই যথেষ্ট। কারণ নিজের এমন অসম্পূর্ণ ও ভাঙ্গাচোরা ইবাদতকে যে নাজাতের জন্য যথেষ্ট মনে করবে এবং একারণে নফল আমলকে গুরুত্বহীন মনে করবে, সে তো রীতিমতো ‘উজুব’ ও আত্মম্ভরিতা এবং আত্মপ্রবঞ্ছনায় নিমজ্জিত। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের আদর্শ হলো, তাঁরা ফরযগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তো আদায় করতেনই, পাশাপাশি নফল আমলেরও এত অধিক গুরুত্ব দিতেন যে, তাঁদের আমলের মান ও পরিমাণ সবই আমাদের কল্পনাতীত। তথাপিও তাঁরা নিজেদের আমলকে যথেষ্ট মনে করতেন না; বরং আমল কবুল না হওয়ার ভয়, আল্লাহর ভয় ও জাহান্নামের ভয়ে সর্বদা শঙ্কিত থাকতেন। আসলে এটাই মুত্তাকীদের আলামত, যে দুনিয়াতে যত ভয়ে থাকবে, সে পরকালে তত নির্ভয় ও নিরাপদ হবে।
قيل ليحيى بن معاذ رحمه الله: من آمن الخلق غدا؟ فقال: أشدهم خوفا اليوم
“ইয়াহইয়া বিন মুআয রহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হলো, আগামীকাল (আখিরাতে) সবচেয়ে বেশি নির্ভয় কারা হবে? তিনি উত্তর দেন, আজকে (দুনিয়াতে) যারা সবচেয়ে বেশি ভয়ে আছে।” -ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন -৯/২০৮
كان أبو الحسين الضرير رحمه الله يقول : علامة السعادة خوف الشقاوة.
আবুল হাসান দারীর রহিমাহুল্লাহ বলতেন, (আখিরাতে) হতভাগা হওয়ার ভয় ও শঙ্কা (সেখানে) ভাগ্যবান হওয়ার লক্ষণ।” -ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন-৯/২০৮
ইমাম গাযালী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
لا يسلم من أهوال يوم القيامة إلا من أطال فكره في الدنيا فإن الله لا يجمع بين خوفين على عبد فمن خاف هذه الأهوال في الدنيا أمنها في الآخرة.
কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা থেকে কেবল তারাই নিরাপদ থাকবে, দুনিয়াতে যাদের সেদিনের ভয় ও শঙ্কা দীর্ঘায়িত হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর দুটি ভয় একত্র করবেন না। অতএব যে ব্যক্তি দুনিয়ায় থাকাকালে সেদিনের ভয়াবহতাকে ভয় করবে, সে-ই আখিরাতের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ থাকবে।” -রমাযানঃ সাওরাতুত তাগঈর-১৬৯
আরও ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে সুন্নত মুস্তাহাবের গুরুত্বহীনতা পরিণতিতে কুফর শিরক পর্যন্ত নিয়ে যায়।
عن الْحَسَن بْنَ عَرَفَةَ يقول: سَمِعْتُ ابْنَ الْمُبَارَكِ، يقول : مَنْ تَهَاوَنَ بالأَدَبِ عُوقِبَ بِحِرْمانِ السُّنَنِ، وَمَنْ تَهَاوَنَ بِالسُّنَنِ عُوقِبَ بِحِرْمانِ الْفَرَائِضِ، وَمَنْ تَهَاوَنَ بِالْفَرَائِضِ عُوقِبَ بِحِرْمانِ الْمَعْرِفَةِ .
ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি আদব (নফল ও নফলের চেয়ে নিম্নস্তরের করণীয় কাজ)-এর ব্যাপারে অবহেলা করে, তাকে এর শাস্তি স্বরূপ সুন্নত থেকে বঞ্চিত করা হয়। যে ব্যক্তি সুন্নতের ব্যাপারে অবহেলা করে, তাকে শাস্তি স্বরূপ ফরয থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর যে ব্যক্তি ফরযের ব্যাপারে অবহেলা করে, তাকে এর শাস্তি স্বরূপ আল্লাহর মারিফাত তথা ঈমান থেকে বঞ্চিত করা হয়।” -শুআবুল ঈমান, ইমাম বাইহাকী রহিমাহুল্লাহ, হাদীস-৩০১৬
একারণেই সালাফে সালেহীন অনেক বেশি আমল করা সত্ত্বেও সর্বদা শঙ্কিত থাকতেন। সালাফের এমন হাজারো লাখো দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়েছে। আর যা তাঁরা কাউকে জানতে দেননি, একান্তই আল্লাহর জন্য অন্তরে লুকিয়ে রেখেছেন, তার তো কোনো হিসেবই নেই। কয়েকটি দৃষ্টান্ত লক্ষ করুন।
অগ্নিপূজারি ক্রীতদাস আবু লুলু উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ছুরিকাঘাতে আহত করলে মৃত্যুশয্যায় এক আনসারী যুবক এসে বললেন:
أبشر يا أمير المؤمنين ببشرى الله، كان لك من القدم في الإسلام ما قد علمت، ثم استخلفت فعدلت، ثم الشهادة بعد هذا كله، فقال: ليتني يا ابن أخي وذلك كفافا لا علي ولا لي. –صحيح البخاري: 1392
“হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আল্লাহ তাআলার সুসংবাদ গ্রহণ করুন। ইসলাম গ্রহণে আপনার অগ্রগামিতা সম্পর্কে তো আপনিও অবগত। এরপর আপনাকে খলীফা নিযুক্ত করা হয়েছে। আপনি ইনসাফ করেছেন। এসব কিছুর পর এখন শাহাদাতের মর্যাদাও লাভ করছেন। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু যু্বককে বললেন: হে ভাতিজা! (কতই না ভালো হয়!) যদি তা আমার জন্য লাভ ও ক্ষতির কারণ না হয়ে বরাবর হয়ে যায়।” –সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৩৯২
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা এর ইনতিকালের আগে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর নিকট এসে বলেন:
كيف تجدينك؟ قالت: بخير إن اتقيت، قال: فأنت بخير إن شاء الله، زوجة رسول الله صلى الله عليه وسلم، ولم ينكح بكرا غيرك، -زاد في رواية أحمد: كنت أحب نساء رسول الله صلى الله عليه وسلم، إلى رسول الله، ولم يكن رسول الله يحب إلا طيبا- ونزل عذرك من السماء. -زاد في رواية أحمد: جاء به الروح الأمين، فأصبح ليس لله مسجد من مساجد الله يذكر فيه الله، إلا يتلى فيه- ودخل ابن الزبير خلافه، فقالت: دخل ابن عباس فأثنى علي، ووددت أني كنت نسيا منسيا. –صحيح البخاري:4753 مسند أحمد: 4/298 رقم: 2496
“আপনার অবস্থা কেমন? তিনি উত্তরে বললেন, ভালো; যদি আমি মুত্তাকী হই। ইবনে আব্বাস বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি ভালোই থাকবেন। আপনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী। আপনি ছাড়া কোনো কুমারীকে তিনি বিবাহ করেননি। (মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় অতিরিক্ত এসেছে, আপনি ছিলেন নবীজীর নিকট সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী, আর নবীজী পূত-পবিত্র নারীকেই ভালোবাসবেন) আপনার পবিত্রতার ঘোষণা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। (মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় অতিরিক্ত এসেছ, জিবরাঈল আমীন তা নিয়ে অবতরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলার যত মসজিদে তাঁর যিকির হয়, সর্বত্র আপনার পবিত্রতার আয়াতগুলিও তিলাওয়াত করা হয়) ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বের হওয়ার পর আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা প্রবেশ করেন। তখন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা এসে আমার প্রশংসা করে গেলেন। অথচ আমি কামনা করি, যদি আমি সম্পূর্ণ বিস্মৃত-বিলুপ্ত হয়ে যেতাম! (অর্থাৎ আমার যে আমল তাতে আমি জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারব কি না শঙ্কা হচ্ছে, তার চেয়ে বরং ভালো হত যদি আমার কোনো হিসেব নিকেশই না হত এবং আমি নিঃশেষ হয়ে যেতাম!)।” –সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৭৫৩; মুসনাদে আহমদ: ৪/২৯৮ হাদীস: ২৪৯৬
উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর ইবাদতের ব্যপারে তাঁর স্ত্রী –তাঁর শাহাদাতের পূর্বে- বলেন,
إن تقتلوه أو تتركوه فإنه كان يحيي الليل كله في ركعة يجمع فيها القرآن. –أخرجه الطبراني في المعجم الكبير (130) وقال الهيثمي في مجمع الزوائد (9/94): “إسناده حسن”.
“তোমরা তাঁকে হত্যা করো কিংবা ছেড়ে দাও, তিনি কিন্তু পুরো রাত জেগে এক রাকাতে সম্পূর্ণ কুরআন শেষ করতেন।” –আলমুজামুল কাবীর: হাদীস: ১৩০ (মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া) হাইসামী রহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
এতদসত্ত্বেও তাঁর অবস্থা ছিল, কবরের সামনে দাঁড়ালে কাঁদতে কাঁদতে দাড়ি ভিজে যেতো। হানী রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন,
كان عثمان إذا وقف على قبر بكى حتى يبل لحيته، فقيل له: تذكر الجنة والنار فلا تبكي وتبكي من هذا؟ فقال: إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: إن القبر أول منزل من منازل الآخرة، فإن نجا منه فما بعده أيسر منه، وإن لم ينج منه فما بعده أشد منه. قال: وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ما رأيت منظرا قط إلا والقبر أفظع منه. –سنن الترمذي (2308). وقال الترمذي: هذا حديث حسن غريب، لا نعرفه إلا من حديث هشام بن يوسف.
“উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু কোনো কবরের সামনে দাঁড়ালে অনেক কাঁদতেন এমনকি তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা হলে আপনি কাঁদেন না অথচ এক্ষেত্রে এত কাঁদেন? তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আখিরাতের মনযিলসমূহের প্রথম মনযিল হলো কবর। যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পেয়ে যাবে তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলো আরও সহজ হবে। আর যে এখানে মুক্তি পাবে না তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলো আরও কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “আমি কবরের চেয়ে অধিক ভয়ংকর দৃশ্য আর কখনো দেখিনি।” –সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ২৩০৮ ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু একদিন গাছের ডালে বসা একটি পাখিকে লক্ষ করে বলেন,
طوبى لك يا طير والله لوددت أني كنت مثلك ، تقع على الشجرة وتأكل من الثمر، ثم تطير وليس عليك حساب ، ولا عذاب، والله لوددت أني كنت شجرة إلى جانب الطريق مر علي جمل فأخذني فادخلني فاه فلاكني ثم ازدردني ثم أخرجني بعرا ولم أكن بشرا. -مصنف ابن أبي شيبة: 35573
“হে পাখি! সুসংবাদ তোমার জন্য। আল্লাহর কসম! আমি যদি তোমার মতো হতাম, কতইনা ভালো হত। তুমি গাছে বস, ফল ভক্ষণ কর, অতঃপর উড়ে যাও। তোমার কোনো হিসাব নেই, আযাব নেই। আল্লাহর কসম! কতই না ভালো হত, যদি আমি পথের ধারে গাছ হতাম, উটের দল আমার পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে আমাকে মুখে ঢুকিয়ে চিবিয়ে গ্রাস করে নিত, অতঃপর আমাকে গোবর করে বের করত, আমি মানুষ হিসাবে থাকতাম না!” –মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা বর্ণনা নং: ৩৫৫৭৩ (দারুল কিবলা)
জেলখানায় জামাতবদ্ধ থাকা
দুই. জেলখানায় জামাতবদ্ধ থাকা
জেলখানায় জামাতবদ্ধ থাকা এবং আনুগত্য করা জরুরি নয়, এ কথাটির দুটি অর্থ হতে পারে-
ক. জেলখানায় একসাথে কয়েকজন থাকলে তাদেরই একজনকে আমীর বানিয়ে তার ইমারতে জামাতবদ্ধ থাকা এবং তার আনুগত্য করা জরুরি নয়। যদি এমনটি উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা সঠিক নয়। যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের মতো সাময়িক ইজতেমায়ী অবস্থানেও একজনকে আমীর বানিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি জেলজীবনে কেন তা আবশ্যক হবে না? সেখানেও একজনকে আমীর বানিয়ে যতটুকু সম্ভব তার অধীনে জামাতবদ্ধ থাকা জরুরি।
খ. দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, জেলখানায় তানজীম কিংবা ইমারার সাথে কৃত চুক্তি রক্ষা করা এবং তার অধীনে জামাতবদ্ধ থাকা জরুরি নয়।। উদ্দেশ্য যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে তা আরও বড় ভুল। কারণ জেলখানায়ও যথাসম্ভব জিহাদের দাওয়াত ও নুসরত চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক। আর দীন প্রতিষ্ঠা যেহেতু এককভাবে সম্ভব না তাই জামাতবদ্ধ হওয়া ও জামাতবদ্ধ থাকা আবশ্যক। বিশেষত তানজীমের সাথে চুক্তি হয়ে থাকলে তা রক্ষা করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নতুবা জিহাদের ফরয দায়িত্বে অবহেলার পাশাপাশি অঙ্গীকার ভঙ্গেরও গুনাহ হবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا. -الإسراء: 34
“আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” –সূরা বনি ইসরাঈল, ১৭: ৩৪
ইমাম আবু ইসহাক ফাযারী রহিমাহুল্লাহ (১৭১ হি.) বলেন,
قلت للأوزاعي: لو أن إماما أتاه عدو كثير، فخاف على من معه فقال لأصحابه: تعالوا نتبايع على ألا نفر، فبايعوا على ذلك؟ فقال: «ما أحسن هذا» . قلت: فلو أن قوما فعلوا ذلك دون الإمام؟ قال: «لو فعلوا ذلك بينهم شبه العقد في غير بيعة». -السير لأبي إسحاق الفزاري (ص: 199 ط. مؤسسة الرسالة)
“আমি ইমাম আওযায়ী রহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলাম, যদি কোনো শাসকের বিপক্ষে অনেক শত্রু যুদ্ধ করতে আসে, তখন তিনি সাথিদের বলেন, এসো! আমরা পলায়ন না করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই, এরপর তারা এর উপর বাইয়াতবদ্ধ হয়? আওযায়ী বললেন, এটা কতইনা না উত্তম! আমি বললাম, যদি ইমামের উপস্থিতি ব্যতীত কিছু লোক (এমন পরিস্থিতিতে) এরূপ করে? আওযায়ী বললেন, তাহলে এটা অঙ্গীকারের মতো হবে, তবে এই বাইয়াত শাসকের হাতে বাইয়াত হওয়ার মতো হবে না। -আসসিয়ার, পৃ: ১৯৯ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইয়িমা রহিমাহুল্লাহ বলেন,
والذي يوجبه الله على العبد قد يوجبه ابتداء؛ كإيجابه الإيمان والتوحيد على كل أحد. وقد يوجبه؛ لأن العبد التزمه وأوجبه على نفسه ولولا ذلك لم يوجبه؛ كالوفاء بالنذر للمستحبات. وبما التزمه في العقود المباحة: كالبيع والنكاح والطلاق ونحو ذلك إذا لم يكن واجبا. وقد يوجبه للأمرين كمبايعة الرسول على السمع والطاعة له وكذلك مبايعة أئمة المسلمين وكتعاقد الناس على العمل بما أمر الله به ورسوله.- مجموع الفتاوى: 29/345
“আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর যা ওয়াজিব করেন কখনো তিনি নিজেই তা ওয়াজিব করেন, যেমন ঈমান ও তাওহীদকে তিনি প্রত্যেকের উপর ওয়াজিব করেছেন। আর কখনো ওয়াজিব করেন বান্দা তা নিজের উপর আবশ্যক করে নেয়ার কারণে। যদি বান্দা নিজের উপর তা ওয়াজিব না করতো তাহলে আল্লাহও তার উপর তা ওয়াজিব করতেন না। যেমন মুস্তাহাব বিষয়াদির মান্নত পুরা করা এবং মুবাহ চুক্তিসমূহ যথা, ক্রয়-বিক্রয়, বিয়ে-তালাক ইত্যাদি, যা বান্দা নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছে। আর কখনো আল্লাহ তাআলা তা ওয়াজিব করেন উভয় কারণে (অর্থাৎ এমনিতেও তা ওয়াজিব ছিল, আর পরে বান্দাও তা নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছে) যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের হাতে আনুগত্যের বাইয়াত, মুসলিমদের শাসকদের হাতে বাইয়াত এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কোনো নির্দেশ পালনের ব্যাপারে লোকদের পরস্পর অঙ্গীকার।” -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৯/৩৪৫
বলার অপেক্ষা রাখে না, তানজীমের বাইয়াত হচ্ছে তৃতীয় প্রকারের। অর্থাৎ যেটা দুই কারণেই পূরণ করা ওয়াজিব। কারণ এটা আল্লাহর ফরয বিধান শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সংঘটিত মুসলিমদের পরস্পর অঙ্গীকার।
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
২৯-১০-১৪৪৫ হি.
০৯-০৫-২০২৪ ঈ.
আরও পড়ুনঃ কুনূতে নাযিলা পড়ার বিধান ও পদ্ধতি