ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়াঃ পরিচয় ও পার্থক্য
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
প্রশ্ন:
ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়া কাকে বলে? দুটির পার্থক্য কী? কিছু উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার অনুরোধ রইল। বিশেষত ফরজে কিফায়া জিহাদ কি কিছু লোকে আদায় করতে থাকলেই সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে?
প্রশ্নকারী-আবু ফারিস
ঢাকা
উত্তর:
ফরজে আইন হচ্ছে এমন ফরজ, যা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর ফরজ হয়। যাদের ওপর ফরজ হয়, তাদের প্রত্যেককেই তা আদায় করতে হয়। কিছু সংখ্যক ব্যক্তির আদায় করার দ্বারা বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয় না। যেমন নামায, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি। এগুলো আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন, বান্দার অন্তরাত্মার উন্নয়ন ও পরিশুদ্ধি এবং জান মালের শুকরিয়া আদায়সহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রত্যেক বান্দার ওপর ফরজ করা হয়েছে। যাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককেই তা আদায় করতে হবে। কিছু সংখ্যক মুসলিমের নামায পড়া ও রোযা রাখার দ্বারা বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হবে না। তেমনিভাবে কিছু সংখ্যক সামর্থ্যবান মুসলিমের যাকাত দেয়া বা হজ করার দ্বারা বাকি সামর্থ্যবানরা মুক্তি পাবে না। সকলকেই নামায পড়তে হবে এবং রোযা রাখতে হবে। সামর্থ্যবান সকলকেই যাকাত দিতে হবে এবং হজ করতে হবে।
পক্ষান্তরে ফরজে কিফায়া হচ্ছে এমন ফরজ, যা প্রথমত ফরজে আইনের মতো সকলের ওপরই ফরজ হয়, তবে কিছু সংখ্যক লোকের আদায় করার দ্বারা ফরজটি যথাযথ আদায় হয়ে গেলে সকলেই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়। আর আদায় না হলে সকলে গুনাহগার হয়। যেমন, মুসলিম মাইয়েতের জানাযা ও কাফন-দাফন সম্পন্ন করা একটি ফরজে কিফায়া। কিছু সংখ্যক মুসলিম মিলে তা করে নিলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। বাকিরা শরিক না হলেও তারা গুনাহগার হবে না। কিন্তু কেউই যদি আদায় না করে, তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে।
ফরজে আইনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি উদ্দেশ্য, যার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে কাজটি সম্পাদিত হওয়া জরুরি। পক্ষান্তরে ফরজে কিফায়ার মধ্যে কাজটি অর্জিত হওয়া উদ্দেশ্য, যার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে কাজটি করতে হয় না; ব্যক্তি-সমষ্টি থেকে কাজটি সম্পাদিত হওয়াই যথেষ্ট। -রদ্দুল মুহতার: ১/৪২, ৫৩৮; ৪/১২৩
ফরজে কিফায়া সম্পর্কে দুটি ভুল ধারণা
এক.
অনেকে মনে করেন, ফরজে কিফায়ার অর্থ হচ্ছে, উম্মাহর কিছু লোকের ওপর ফরজ, বাকিদের ওপর ফরজ নয়। এ ধারণা সঠিক নয়। বরং ফরজে কিফায়াও ফরজে আইনের মতো সকলের ওপরই ফরজ। তবে কিছু লোকের মাধ্যমে কাজটি পূর্ণ হয়ে গেলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু কাজটি যদি পরিপূর্ণ আদায় না হয়, তাহলে সকলেই ফরজ ত্যাগের দায়ে গুনাহগার হয়। শুধু তাই নয়; বরং একটি ফরজে কিফায়া ত্যাগ করার ভয়াবহতা ফরজে আইন ত্যাগ করার চেয়েও গুরুতর। একারণে যেখানে ফরজে কিফায়া ও ফরজে আইন এমনভাবে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায় যে, একটি করলে অপরটি করা যায় না, সেখানে শরীয়ত ফরজে কিফায়াকে অগ্রাধিকার দেয়। বিশেষত দিফায়ী জিহাদের ক্ষেত্রে। এজন্যই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধে কয়েক ওয়াক্ত নামায কাযা করে জিহাদের কাজ চালিয়ে গেছেন এবং সেই নামাযগুলো পরে কাযা করেছেন। ফরজে কিফায়া যে সকল মুসলিমের ওপরই ফরজ এবং তা আদায় না হলে যে সকলেই গুনাহগার হয়, তা ফুকাহায়ে কেরামের অনেকেই সুস্পষ্ট করে বলেছেন।
ইবনে কুদামা রহ. (৬২০ হি.) বলেন,
معنى فرض الكفاية، الذي إن لم يقم به من يكفي، أثم الناس كلهم، وإن قام به من يكفي، سقط عن سائر الناس. فالخطاب في ابتدائه يتناول الجميع، كفرض الأعيان، ثم يختلفان في أن فرض الكفاية يسقط بفعل بعض الناس له، وفرض الأعيان لا يسقط عن أحد بفعل غيره. اهـ
“ফরজে কিফায়ার অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজন পরিমাণ লোকে তা আদায় না করলে সকলে গুনাহগার হবে, আর প্রয়োজন পরিমাণ লোকে আদায় করলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। অতএব, শুরুতে ফরজে কিফায়ার দায়িত্ব ফরজে আইনের মতো সকলের উপরই বর্তায়। তবে ব্যবধান হলো, কিছু সংখ্যক লোকের আদায়ের দ্বারা ফরজে কিফায়ার দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়, পক্ষান্তরে ফরজে আইন একজনের আদায়ের দ্বারা আরেকজনের দায়িত্ব আদায় হয় না।” -আলমুগনি: ৯/১৯৬
আরও দেখুন বাদায়িউস সানায়ি: ১৫/২৭০, হিদায়া: ২/৩৭৮
দুই.
অনেকে মনে করেন, কিছু সংখ্যক লোক করতে থাকলেই বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। যেমন কিছু সংখ্যক লোক জিহাদ করতে থাকলে বাকিরা না করলেও সমস্যা নেই।
আসলে ঢালাওভাবে কথাটা সঠিক নয়। কিছু সংখ্যক লোক করতে থাকলেই যে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে, বিষয়টি এমন নয়। বরং প্রয়োজন পরিমাণ লোক ফরজটি আদায় করলে এবং কাজটি যথাযথ সম্পাদিত হলেই কেবল বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হবে। পক্ষান্তরে কাজটি কিছু লোক করতে থাকল ঠিকই, কিন্তু কাঙ্খিত স্তরে কাজটি সম্পাদিত হল না, তাহলে যারা চেষ্টা করল না, তারা সকলেই গুনাহগার হবে।
যেমন ধরুন, মুসলিম মাইয়েতের জানাযা ও কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা, একটি ফরজে কিফায়া। এখন কোনো এলাকায় যদি মহামারিতে অসংখ্য লোক মারা যায়, তাহলে তাদের কাফন দাফনের দায়িত্ব সকলের। এ অবস্থায় কিছু লোক যদি সকলের কাফন দাফন সেরে ফেলে, তাহলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হবে। পক্ষান্তরে কিছু লোক কাজটি করতে থাকল, কিন্তু মৃতের সংখ্যা অধিক হওয়ায় তাদের পক্ষে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হল না। ফলে কিছু লাশ পচে গলে দুর্গন্ধ ছাড়াতে থাকল। এক্ষেত্রে অবশ্যই যারা কাজটি সম্পাদন করার চেষ্টা করল না, তারা সকলেই ফরজ ত্যাগের দায়ে গুনাহগার হবে।
তদ্রূপ স্বাভাবিক অবস্থায় জিহাদ ফরজে কিফায়া হওয়ার অর্থ এই নয় যে, কিছু মুসলিম জিহাদ করতে থাকলেই গোটা উম্মাহ দায়মুক্ত হয়ে যাবে। বরং উম্মাহ তখনই দায়মুক্ত হবে, যখন জিহাদের ফরজ দায়িত্বটি যথাযথ আদায় হবে। জিহাদের উদ্দেশ্য অর্জিত হবে এবং সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের দ্বীন, সম্পদ ও ইজ্জত আব্রু শত্রু থেকে নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত হবে এবং শত্রুরা মুসলিমদের শক্তি ও প্রতাপের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকবে। যতক্ষণ উক্ত উদ্দেশ্য অর্জিত না হবে, ততক্ষণ যারাই এর জন্য চেষ্টারত থাকবে না, তারা সকলেই ফরজ ত্যাগের দায়ে গুনাহগার হবে। আরও দেখুন -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪, মুগনিল মুহতাজ: ৬/১৬, আলওয়াজিয ফি উসূলিল ফিকহ: ৩৬
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
১৮-০৩-১৪৪২ হি.
০৫-১১-২০২০ ঈ.
আরো পড়ূন
বর্তমানে কি জিহাদ ফরজে আইন?