জিহাদ-কিতাল:ফাতওয়া  নং  ১১৮

বর্তমানে কি জিহাদ ফরজে আইন?

বর্তমানে কি জিহাদ ফরজে আইন?

বর্তমানে কি জিহাদ ফরজে আইন?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

প্রশ্ন:

বর্তমানে বাংলাদেশে কি জিহাদ ফরজে আইন?

প্রশ্নকারী- উসমান

ঠিকানা- অজ্ঞাত

উত্তর:

বাংলাদেশসহ বর্তমান বিশ্বের সকল সক্ষম মুসলিমের ওপর জিহাদ ফরজে আইন। কারণ বর্তমানে সমগ্র বিশ্বেই মুসলিমরা কোনো না কোনো ভাবে আক্রান্ত। মুসলিমরা যখন আক্রান্ত হয়, তখন তা প্রতিহত করার জন্য প্রথমে আক্রান্তদের ওপর এবং তারা প্রতিহত করতে সক্ষম না হলে কিংবা প্রতিহত না করলে, তাদের পার্শ্ববর্তীদের ওপর, তারপর তাদের পার্শ্ববর্তীদের ওপর; এভাবে ক্রমান্বয়ে সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলিমের ওপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এবিষয়ে ফুকাহায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে। সালাফ থেকে খালাফ; একজন আলেমেরও তাতে দ্বিমত নেই।

ইমাম জাসসাস রহ. (মৃত্যু: ৩৭০ হি.) বলেন,

ومعلوم في اعتقاد جميع المسلمين أنه إذا خاف أهل الثغور من العدو، ولم تكن فيهم مقاومة لهم فخافوا على بلادهم وأنفسهم وذراريهم أن الفرض على كافة الأمة أن ينفر إليهم من يكف عاديتهم عن المسلمين، وهذا لاخلاف فيه بين الأمة إذ ليس من قول أحد من المسلمين إباحة القعود عنهم حتى يستبيحوا دماء المسلمين و سبي ذراريهم. اهـ  -احكام القرآن: 4/312

“সকল মুসলমানের প্রসিদ্ধ আকীদা, যখন সীমান্তবর্তী মুসলমানেরা শত্রুর আশঙ্কা করে; আর তাদের মাঝে শত্রু প্রতিরোধের ক্ষমতা বিদ্যমান না থাকে; ফলে তারা নিজ পরিবার-পরিজন, দেশ ও জানের ব্যাপারে শঙ্কাগ্রস্ত হয়, তখন পুরো উম্মাহর ওপর ফরজ হয়ে যায়, শত্রুর ক্ষতি থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে পারে পরিমাণ লোক তাদের সাহায্যে জিহাদে বের হওয়া। এবিষয়ে উম্মাহর মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। এমন কথা কোনো মুসলমানই বলেনি যে, শত্রুরা মুসলমানদের রক্ত প্রবাহিত করবে, তাদের পরিবার-পরিজনকে বন্দী করবে, আর মুসলমানদের জন্য তাদেরকে সাহায্য না করে বসে থাকা বৈধ হবে।”-আহকামুল কুরআন: ৪/৩১২

শামসুল আইম্মা সারাখসী রহ. (মৃত্যু: ৪৯০ হি.) বলেন,

فأما إذا جاء النفير عاما فقيل لأهل مدينة: قد جاء العدو يريدون أنفسكم أو ذراريكم أو أموالكم، فلا بأس بأن يخرج بغير إذن والديه؛ لأن الخروج في مثل هذه الحالة فرض عين على كل واحد، قال الله تعالى {انفروا خفافا وثقالا} [التوبة: ৪১] . وما يفوته بترك هذه الفريضة لا يمكنه استدراكه، وما يفوته بالخروج بغير إذن الوالدين يمكنه استدراكه بعد هذا؛ فيشتغل بما هو الأهم، ولأن الضرر في تركه الخروج أعم، فإن ذلك يتعدى إليه وإلى والديه وإلى غيرهم من المسلمين، ولأنه لا يحل لوالديه أن ينهياه عن هذا الخروج، فيكون له أن يخرج ليسقط به الإثم عنهما، ولا طاعة لهما عليه فيما كانا عاصيين فيه. اهـ -شرح السير الكبير: 1/199

“আর যখন নফিরে আমের অবস্থা সৃষ্টি হয়, যেমন কোনো শহরবাসীকে বলা হল, ‘শত্রু এসে পড়েছে; তোমাদের জান, মাল ও পরিবার পরিজনের উপর আগ্রাসন চালাতে চাচ্ছে, তখন সন্তান তার পিতা মাতার অনুমতি ছাড়া জিহাদে বের হতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা এ অবস্থায় জিহাদে বের হওয়া প্রত্যেকের ওপর ফরজে আইন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘তোমরা হালকা-ভারী উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বের হও।’ (সূরা তাওবা ৯ : ৪১)। তাছাড়া এই ফরজ ছেড়ে দেয়ার দ্বারা যে ক্ষতি হবে, তা আর পূরণ করা সম্ভব হবে না; কিন্তু পিতা মাতার অনুমতি ছাড়া বের হওয়ার দ্বারা যা ছুটবে, পরে তার ক্ষতিপূরণ সম্ভব। তাই যেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেটাই করবে। তাছাড়া জিহাদ ছেড়ে দেয়ার ক্ষতি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ ক্ষতি তার ব্যক্তি থেকে পিতা মাতা এবং অন্যান্য সকল মুসলমান পর্যন্ত গড়াবে। তাছাড়া এ সময় জিহাদে বের হতে নিষেধ করাও তার পিতা মাতার জন্য জায়েয নয়। তাই তার বের হওয়ার দ্বারা যেন পিতা মাতা (ফরজ আদায়ে বাধা দানের) গুনাহ থেকে রক্ষা পায়, এজন্যও বের হতে হবে। আর যেখানে তারা (আল্লাহ তাআলার) নাফরমানি করবে, সেখানে তাদের আনুগত্য করা তার দায়িত্ব নয়।” -শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ১/১৯৯

ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.) বলেন-

وقد تكون حالة يجب فيها نفير الكل، وهي: الرابعة- وذلك إذا تعين الجهاد بغلبة العدو على قطر من الأقطار، أو بحلوله بالعقر، فإذا كان ذلك وجب على جميع أهل تلك الدار أن ينفروا ويخرجوا إليه خفافا وثقالا، شبابا وشيوخا، كل على قدر طاقته، من كان له أب بغير إذنه ومن لا أب له، ولا يتخلف أحد يقدر على الخروج، من مقاتل أو مكثر. فإن عجز أهل تلك البلدة عن القيام بعدو هم كان على من قاربهم وجاور هم أن يخرجوا على حسب ما لزم أهل تلك البلدة، حتى يعلموا أن فيهم طاقة على القيام بهم ومدافعتهم. وكذلك كل من علم بضعفهم عن عدو هم وعلم أنه يدركهم ويمكنه غياثهم لزمه أيضا الخروج إليهم، فالمسلمون كلهم يد على من سواهم، حتى إذا قام بدفع العدو أهل الناحية التي نزل العدو عليها واحتل بها سقط الفرض عن الآخرين. ولو قارب العدو دار الإسلام ولم يدخلوها لزمهم أيضا الخروج إليه، حتى يظهر دين الله وتحمى البيضة وتحفظ الحوزة ويخزى العدو. ولا خلاف في هذا. اهـ -تفسير القرطبي: 8/151-152

“কোনো কোনো অবস্থায় সকলের ওপরই জিহাদে বের হওয়া ফরজ হয়ে যায়। … উক্ত অবস্থা হল- যখন কোনো (মুসলিম) ভূখণ্ডে শত্রু দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলার কারণে বা কোনো ভূখণ্ডে শত্রু ঢুকে পড়ার কারণে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় উক্ত ভূখণ্ডের হালকা-ভারি (সরঞ্জামের অধিকারী), যুবক-বৃদ্ধ সকল অধিবাসীর ওপর ফরজ- শত্রুর মোকাবেলায় জিহাদে বেরিয়ে পড়া। প্রত্যেকে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী শত্রু প্রতিহত করবে। যার পিতা নেই সে তো যাবেই, যার পিতা আছে সেও পিতার অনুমতি ছাড়াই বেরিয়ে পড়বে। যুদ্ধ করতে সক্ষম কিংবা (অন্তত মুজাহিদদের) সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম, এমন কেউ বসে থাকবে না। ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম হয়, তাহলে উক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মতো তাদের নিকটবর্তী এবং প্রতিবেশীদের ওপরও আবশ্যক- জিহাদে বের হয়ে পড়া; যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারবে যে, এখন তাদের শত্রু প্রতিহত করার এবং তাদেরকে বিতাড়িত করার সামর্থ্য অর্জিত হয়েছে। তেমনি যে ব্যক্তিই জানতে পারবে যে, তারা শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম এবং সে বুঝতে পারবে- আমি তাদের কাছে পৌঁছতে এবং তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম হব; তার ওপরই আবশ্যক সাহায্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। কারণ, সকল মুসলমান তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে এক হস্তের ন্যায়। তবে যে এলাকায় শত্রু আগ্রাসন চালিয়েছে, তারা নিজেরাই যদি শত্রু প্রতিহত করতে পারে, তাহলে অন্যদের ওপর থেকে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। যদি এমন হয় যে, শত্রুরা দারুল ইসলামের নিকটবর্তী হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও দারুল ইসলামে আগ্রাসন চালায়নি, তাহলেও তাদের ওপর ফরজ শত্রু প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। যাতে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী থাকে, ইসলামী ভূখণ্ড সংরক্ষিত থাকে এবং শত্রু অপদস্থ ও পরাস্ত হয়। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।” -তাফসীরে কুরতুবী: ৮/১৫১-১৫২

তিনি আরও বলেন,

قال ابن عطية: والذي استمر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين. اهـ -تفسير القرطبي: 3/38

“ইবনে আতিয়্যাহ্ রহ. বলেন, একথার ওপর ইজমা চলে আসছে যে, উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি ব্যক্তির ওপর জিহাদ ফরজে কেফায়া। যদি মুসলমানদের একাংশ তা আদায় করে, অন্যদের থেকে এর দায়িত্ব-ভার সরে যাবে। তবে শত্রু যদি কোনো ইসলামী ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালায়, তখন তা ফরজে আইন হয়ে যায়।” -তাফসীরে কুরতুবী: ৩/৩৮

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃত্যু: ৭২৮ হি.) বলেন,

وأما قتال الدفع فهو أشد أنواع دفع الصائل عن الحرمة والدين واجب إجماعا، فالعدو الصائل الذي يفسد الدين والدنيا لا شيء أوجب بعد الإيمان من دفعه، فلا يشترط له شرط  بل يدفع بحسب الإمكان، وقد نص على ذلك العلماء أصحابنا وغيرهم.اهـ -الفتاوى الكبرى: 4/608

“প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ মুসলমানদের দ্বীন ও সম্মানের ওপর আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করার সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ স্তর, যা সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। যে আগ্রাসী শক্তি মুসলমানদের দ্বীন-দুনিয়া ধ্বংস করে, ঈমানের পর তাকে প্রতিরোধের চেয়ে গুরুতর ফরজ দ্বিতীয় আরেকটি নেই। এই ক্ষেত্রে কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়, বরং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের ও অন্যান্য (মাযহাবের) ফুকাহায়ে কেরাম সকলেই তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।” -আলফাতাওয়াল কুবরা: ৪/৬০৮

সংক্ষিপ্তকরণের জন্য আমরা এখানে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করলাম। অন্যথায় এই মাসআলায় সালাফ থেকে খালাফ, কোনো একজন ফকিহেরও দ্বিমত নেই। এটি মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত মাসআলা। সকল মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহের কিতাবেই মাসআলাটি আছে।

তবে জিহাদ মানেই, না জেনে না বুঝে এলোপাতাড়ি কিছু আক্রমণ করে দেয়া নয়। এজন্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট মাসআলা মাসায়েল আছে, শরীয়াহ’র সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। জিহাদের জন্য প্রথমে জিহাদের প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করতে হবে। তারপর শরীয়াহ ও সমর বিশেষজ্ঞ কারো নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে শরীয়াহ’র নীতিমালা অনুসারে জিহাদের কাজ আঞ্জাম দিতে হবে। আরো বিস্তারিত জানার জন্য ‘জিহাদ কখন ফরজে আইন হয়ে?’ শিরোনামে ১১৩ নং ফতোয়াটি দেখতে পারেন ইনশাআল্লাহ।

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

৪ ই যুলকা’দাহ, ১৪৪১ হি.

২৬ শে জুন, ২০২০ ইং

Related Articles

Back to top button