হালাল-হারাম:ফাতওয়া  নং  ১৯০

হালাল-হারাম মিশ্রিত ব্যবসার লভ্যাংশের হুকুম কী?

হালাল-হারাম মিশ্রিত ব্যবসার লভ্যাংশের হুকুম কী?

হালাল-হারাম মিশ্রিত ব্যবসার লভ্যাংশের হুকুম কী?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্ন: 

বেশ কিছু দিন আগে আমি নিজের ব্যক্তিগত হালাল সম্পদের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু কিছুদিন পর সেই ব্যবসায় লোকসানের শিকার হই। তাই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে যে টাকা অবশিষ্ট ছিল তা সুদি কারবারে বিনিয়োগ করি। এক পর্যায়ে মূলধন ও সুদ মিলিয়ে আমার মোটা অংকের একটা এমাউন্ট (ক্যাশ) প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর সুদি কারবার ছেড়ে দিয়ে কিছু মেশিনারিজ সামগ্রী ক্রয় করে নতুন করে ব্যবসা শুরু করি। উক্ত ব্যবসার উপর ভিত্তি করেই এখন আমি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। এখনো এই ব্যবসা চলমান।

সারকথা হল, ব্যবসা শুরু করার সময় আমার পুঁজিতে হালাল-হারাম দু’ধরনের সম্পদই ছিল। আল্লাহর অনুগ্রহে বর্তমানে আমি নিজের অতীতের ভুল বুঝতে পেরেছি এবং এখন আমার সম্পদকে হারাম মুক্ত করতে চাচ্ছি। সুতরাং সম্মানিত মুফতি সাহেবের নিকট আমার বিনীত নিবেদন, এর উপায় কী হতে পারে, তা স্ববিস্তারে জানিয়ে বাধিত করবেন।

নিবেদক-

আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ

উত্তরঃ

এ অবস্থায় আপনার সম্পদকে হারামমুক্ত করতে হলে আপনার চলমান ব্যবসার শুরুতে যে পরিমাণ সুদের অর্থ ছিল, তা যাদের থেকে আপনি সুদ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কারণ এই সম্পদের প্রকৃত মালিক তারাই। তারা জীবিত না থাকলে, তাদের ওয়ারিশদের ফিরিয়ে দিতে হবে।

ইরশাদ হচ্ছে,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا. –النساء: 58

“আল্লাহ তাআলা তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন, তোমরা যেন আমানতসমূহ তার হকদারের হাতে পৌঁছে দাও।” –সূরা নিসা (০৪): ৫৮

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( من كانت له مظلمة لأحد من عرضه أو شيء فليتحلله منه اليوم قبل أن لا يكون دينار ولا درهم إن كان له عمل صالح أخذ منه بقدر مظلمته وإن لم تكن له حسنات أخذ من سيئات صاحبه فحمل عليه ) -صحيح البخاري، رقم: 2317؛ ط. دار ابن كثير، اليمامة – بيروت؛ تحقيق: د. مصطفى ديب البغا

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেউ যদি কারো সম্মান ক্ষুণ্ন করে বা অন্য কোনো বিষয়ে তার ওপর জুলুম করে, সে যেন সেই দিন আসার আগে আজই তার থেকে দায় মুক্ত হয়ে নেয়, যেদিন একটি দিনার বা একটি দিরহামও থাকবে না। যদি জালিমের কোনো নেক আমল থাকে, তাহলে জুলুম সমপরিমাণ নেক আমল নিয়ে নেয়া হবে। নেক আমল না থাকলে; মাজলুমের সমপরিমাণ গুনাহ জালিমের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে।” -সহীহ বুখারী, হাদীস নং২৩১৭

তা না করে উক্ত সম্পদ দান করার সুযোগ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

من جمع مالا حراما، ثم تصدق به، لم يكن له فيه أجر، وكان إصره عليه”. أخرجه ابن حبان، وقال الشيخ شعيب: إسناده حسن … وأخرجه الحاكم … وصححه، ووافقه الذهبي.

“যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ সঞ্চয় করল, তারপর তা সাদাকা করল, তাতে তার কোনো সওয়াব হবে না; বরং এর গুনাহ তার উপরই বর্তাবে।” -সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩২১৬

হ্যাঁ, যদি মালিক বা তাদের ওয়ারিশ কাউকেই পাওয়া না যায়, তাহলে হারাম থেকে দায় মুক্তির উদ্দেশ্যে মালিকের পক্ষ থেকে তা গরিব মিসকিনকে সদকা করে দিতে হবে।

তাবেয়ী আবু ওয়ায়েল রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,.

اشترى عبد الله جارية بسبع مئة درهم، فغاب صاحبها ، فأنشده حولا، أو قال: سنة، ثم خرج إلى المسجد فجعل يتصدق ويقول : اللهم فله فإنْ أبى فعليَّ  ثم قال : هكذا افعلوا باللقطة ، أو بالضالة. -مصنف ابن أبي شيبة (22050)، وذكره البخاري في ترجمة الباب في كتاب الطلاق،  باب حكم المفقود في أهله وماله؛ ط. دار طوق النجاة؛ قال الحافظ ابن حجر رحمه الله تعالى: وقد وصله سفيان بن عيينة في جامعه رواية سعيد بن عبد الرحمن عنه، وأخرجه أيضا سعيد بن منصور عنه بسند له جيد أن بن مسعود اشترى جارية الخ قوله “وقال بن عباس نحوه” وصله سعيد بن منصور من طريق عبد العزيز بن رفيع عن أبيه. اهـ فتح الباري 9\430-431

“আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. সাতশ’ দিরহাম দিয়ে একটি দাসী খরিদ করেন। (কিন্তু মূল্য পরিশোধের পূর্বেই) দাসীর মালিক চলে যায়। ইবনে মাসউদ রাযি. এক বছর পর্যন্ত তাকে খোঁজ করেন। এরপর তিনি মসজিদে এসে দাসীর মূল্য সাদাকা করতে শুরু করেন এবং বলতে থাকেন হে আল্লাহ, এই সাদাকা দাসীর মালিকের পক্ষ থেকে। অবশ্য যদি সে (পরবর্তীতে আসে এবং এ সাদাকায় সম্মত না হয় তবে আমি তার) জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবো। এরপর তিনি বলেন, তোমরা মালিক না জানা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর ক্ষেত্রেও এই নীতি অবলম্বন করো।” -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ২২০৫০

অবশ্য শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেছেন,

ومن أراد التخلص من الحرام والتوبة ولا يمكن رده إلى أصحابه فلينفقه في سبيل الله عن أصحابه فإن ذلك طريق حسنة إلى خلاصه مع ما يحصل له من أجر الجهاد”. اهـ مجموع الفتاوى 28/422

‘যে ব্যক্তি হারাম থেকে দায়মুক্ত হয়ে চায় এবং তওবা করতে চায়; অথচ তা মালিকের নিকট পৌঁছানো সম্ভব নয়, তাহলে সে যেন তা মালিকের পক্ষ থেকে জিহাদের পথে খরচ করে। এটা দায়মুক্তির উত্তম পথ এবং এতে সে জিহাদে অংশ গ্রহণেরও সওয়াব পাবে।’ -মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৪২২

সুদের মূল অর্থ মালিক বা তার ওয়ারিশকে ফিরিয়ে দেয়া কিংবা সদকা করার পর, বিগত দিন তা থেকে যে মুনাফা অর্জিত হয়েছে, তা হালাল হবে কি না, এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, সুদের মূল অর্থ পরিশোধের পর ইতিপূর্বে অর্জিত মুনাফা হালাল গণ্য হবে। কেউ বলেছেন মুনাফা হালাল হবে না; বরং তাও সাদকা করে দিতে হবে। বলা বাহুল্য, মুমিনের জীবনে হারামের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। সুতরাং সতর্কতার দাবি হল, দুনিয়ার এই তুচ্ছ সম্পদের মোহ ত্যাগ করে; সুদ থেকে প্রাপ্ত মুনাফাসহ সদকা করে দেয়া এবং এটাই একজন সচেতন ও খাঁটি মুমিনের বৈশিষ্ট্য। এতে কারো দ্বিমত নেই।

عن النعمان بن بشير يقول سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول الحلال بين والحرام بين وبينهما مشبهات لا يعلمها كثير من الناس فمن اتقى المشبهات استبرأ لدينه وعرضه ومن وقع في الشبهات كراع يرعى حول الحمى يوشك أن يواقعه -صحيح البخاري، رقم: 52؛ ط. دار طوق النجاة

“নু’মান ইবনে বাশির রা. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট। এদুটির মাঝে আছে কিছু সংশয়পূর্ণ বিষয়, যা অনেক মানুষ জানে না। যে ব্যক্তি এই সংশয়পূর্ণ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকল, সে তার দ্বীন ও সম্মান নিয়ে নিরাপদ থাকল। আর যে ব্যক্তি সংশয়পূর্ণ বিষয়গুলোতে নিপতিত হল, তার উদাহরণ এমন ব্যক্তি, যে বাদশাহর সংরক্ষিত ও নিষিদ্ধ চারণভূমির পাশেই পশু চরায়। সমূহ সম্ভাবনা আছে যে, এই আচরণ তাকে অচিরেই নিষিদ্ধ অংশে নিপতিত করে ছাড়বে।” -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫২

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অনেক কিতাবে বর্ণিত; ‘হাদীসুল গার’ বা গুহার হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ হাদীসটিতে যে তিন ব্যক্তির নিজ নিজ নেক আমলের উসিলায় দোয়া করে গুহা থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা এসেছে, তাদের শেষ ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

وقال الثالث اللهم إني استأجرت أجراء فأعطيتهم أجرهم غير رجل واحد ترك الذي له وذهب فثمرت أجره حتى كثرت منه الأموال فجاءني بعد حين فقال يا عبد الله أد إلي أجري فقلت له كل ما ترى من أجرك من الإبل والبقر والغنم والرقيق فقال يا عبد الله لا تستهزئ بي فقلت إني لا أستهزئ بك فأخذه كله فاستاقه فلم يترك منه شيئا اللهم فإن كنت فعلت ذلك ابتغاء وجهك فافرج عنا ما نحن فيه فانفرجت الصخرة فخرجوا يمشون. – صحيح البخاري برقم: 2227، 2333 (3/ 91)

“এবং তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমি কিছু শ্রমিক নিয়েছিলাম। একজন ব্যতীত তাদের সকলের পারিশ্রমিক দিয়ে দিয়েছিলাম। একজন তার পারিশ্রমিক রেখে চলে গিয়েছিল। পরে আমি তার পারিশ্রমিক (বিনিয়োগ করে) বৃদ্ধি করলাম। তা প্রচুর সম্পদে পরিণত হল। কিছু কাল পর লোকটি এসে বলল, ওহে আল্লাহর বান্দা! আমার পারিশ্রমিক দাও! আমি বললাম, সামনে যত উট, গরু, ছাগল ও গোলাম দেখছ, সব তোমার পারিশ্রমিক। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমার সঙ্গে ঠাট্টা করো না। আমি বললাম, আমি ঠাট্টা করছি না। পরে সে সব হাঁকিয়ে নিয়ে চলে গেল। কিছুই রেখে গেল না। হে আল্লাহ! আমি যদি তা আপনার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে বিপদে আছি তা থেকে আমাদের উদ্ধার করুন। অতঃপর পাথরটি সরে গেল এবং তারা হেঁটে বের হয়ে গেল।” -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২২২৭, ২৩৩৩

فقط، والله تعالى أعلم بالصواب

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (আফাল্লাহু আনহু)

১৬-০১-১৪৪৩ হি.

২৬-০৮-২০২১ ইং

(পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ: ০৪-০৪-১৪৪৩ হি. মোতাবেক ১০-১১-২০২১ ইং)

আরও পড়ুন

হারাম সম্পদ দিয়ে ক্রয়কৃত বস্তু ব্যবহারের বিধান

Related Articles

Back to top button