প্রবন্ধ-নিবন্ধরমজানশায়খ ফজলুর রহমান কাসিমি

লাইলাতুল কদরঃ কী ও কবে?

লাইলাতুল কদরঃ কী ও কবে?

শায়খ ফজলুর রহমান কাসিমি হাফিযাহুল্লাহ

লাইলাতুল কদরের পরিচয়
লাইলাতুল কদর মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে এক অনন্য উপহার। এ রাতটিকে তিনি এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
কদরের রাতটি এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সূরা কদর (৯৭) : ৩

আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সর্বশেষ হেদায়েতবার্তা কুরআনুল কারীম এ রাতেই অবতীর্ণ হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
আমি কদরের রাতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি। সূরা কদর (৯৭) : ১

এ রাতে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য ফেরেশতাগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তির বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। ফেরেশতাদের নুরানী পদচারণায় মুখোরিত হয়ে উঠে গোটা পৃথিবী। আর মুমিনগণ আল্লাহর রহমত ও প্রশান্তির অবিরাম বর্ষণে সিক্ত হতে থাকে পুরো রাত। এ ধারা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ، سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْر
সেই রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের পালনকর্তার অনুমতিক্রমে প্রতিটি নির্দেশ নিয়ে নেমে আসে। (মুমিন বান্দাদের জন্য সারারাত জুড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাজ করে) শান্তি, ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। সূরা কদর (৯৭) : ৪

লাইলাতুল কদরের ফজিলত
লাইলাতুল কদরের সব চেয়ে বড় ফজিলত ওটাই যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে কারীমে ঘোষণা দিয়েছেন যে, এ রাতটি এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। তিনি এ রাতের পরিচয় ও ফজিলত সম্বলিত স্বতন্ত্র একটি সূরা নাযিল করেছেন।
এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একাধিক হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশা নিয়ে কদরের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করে তার পিছনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। সহীহ বুখারী : ১৯০১; সহীহ মুসলিম : ৭৫৯

রমযানের শেষ দশকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল সম্পর্কে হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ أَحْيَا اللَّيْلَ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ وَجَدَّ وَشَدَّ الْمِئْزَر

যখন রমযানের শেষ দশক শুরু হতো তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতভর জেগে থাকতেন, পরিবারের লোকদেরকেও জাগাতেন, (ইবাদতে বন্দেগিতে) খুব কষ্ট করতেন এবং (এর জন্য) তিনি লুঙ্গি শক্তভাবে বেঁধে নিতেন। (অর্থাৎ অনেক বেশি ইবাদত করতেন বা এ সময় তিনি স্ত্রীদের কাছ থেকে একদম দূরে থাকতেন) সহীহ বুখারী : ২০২৪

সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহ আনহা বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم يَجْتَهِدُ فِي العَشْرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ في غَيْرِهِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশকে (ইবাদতের জন্য) এত বেশি পরিশ্রম করতেন রমযানের অন্য দিনগুলোতে তত করতেন না। সহীহ মুসলিম : ১১৭৪

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে রমযানের শেষ দশকের ইবাদতের ফজিলত বুঝা যাচ্ছে আর এ সময়ের ইবাদতের ফজিলত মূলত লাইলাতুল কদরের কারণেই। যা অন্যান্য হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

কোন রাতটি লাইলাতুল কদর?
বছরের একটি মাত্র রাতের নাম লাইলাতুল কদর। যা আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিশেষ উপহার হিসেবে দান করেছেন। এখন জানার বিষয় হচ্ছে, সেটি কোন রাত? এ বিষয়ে আমরা একটু বিস্তারিত বলার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

লাইলাতুল কদর রমযান মাসে
প্রথম কথা হল লাইলাতুল কদর রমযান মাসের একটি রাত। কুরআন কারীমের তিনটি আয়াতকে সামনে রাখলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ মহামূল্যবান রাতটি রমযান মাসেই রয়েছে। তিনটি আয়াতের প্রথমটি হচ্ছে সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা এবং হেদায়েতের সুষ্পষ্ট নিদর্শনাবলী এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

দ্বিতীয়টি হচ্ছে সূরা কদরের প্রথম আয়াত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
আমি কদরের রাতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি। সূরা কদর (৯৭) : ১

তৃতীয়টি হচ্ছে সূরা দুখানের তিন নম্বর আয়াত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ
আমি এক বরকতময় রাতে এ কুরআন নাযিল করেছি। সূরা দুখান (৪৪) : ৩

প্রথম আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে, কুরআন নাযিল হয়েছে রমযান মাসে। দ্বিতীয় আয়াতে যে রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে সেই রাতটিকে লাইলাতুল কদর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তৃতীয় আয়াতে সেই রাতটিকে লাইলাতুম মুবাকারাহ বা বরকতময় রাত বলা হয়েছে। তিনটি আয়াত থেকে যে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, তা হল, লাইলাতুল কদর বা লাইলাতুম মুবাকারাহ নামের যে রাতটিতে কুরআন নাযিল হয়েছে সেই রাতটি রমযান মাসের একটি রাত। ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ আয়াতগুলোর তাফসীর এভাবেই করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন হাদীস থেকেও এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাবে বুঝা যায় যে, লাইলাতুল কদর রমযান মাসেরই একটি রাত। বিশেষত ইতিকাফ বিষয়ক যে হাদীসগুলো বর্ণিত হয়েছে, ওগুলোতে একথা বার বার এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে ইতিকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য নিজে চেষ্টা করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে এ উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করতে বলেছেন। একবার তিনি এ উদ্দেশ্যে রমযানের পুরো ত্রিশ দিন ইতিকাফ করেন। এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, লাইলাতুল কদর রমযান মাসেই রয়েছে।

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلُّ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ، لِلَّهِ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ
তোমাদের নিকট রমযান উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের উপরে আল্লাহ তা’আলা এ মাসের রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। অবাধ্য শয়তানদের গলায় বেড়ী পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি ওই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল সে প্রকৃত পক্ষেই বঞ্চিত হল। সুনানে নাসায়ী : ২১০৬ (হাদীসটি সহীহ)

কুরআনে কারীমের আয়াত ও ইতেকাফ বিষয়ক একাধিক সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, লাইলাতুল কদর রমযান মাসেরই একটি রাত, ওই হাদীসগুলো থেকে কিছু হাদীস সামনে উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।

লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকে
লাইলাতুল কদর রমযানের ঠিক কোন অংশে? এ বিষয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও সহীহ মত হচ্ছে, রমযানের শেষ অংশে। রমযানের শেষ দশকের রাতগুলোই হল লাইলাতুল কদরের সম্ভাব্য রাত।

ইমাম ইবনে কাসীর রহ. ইমাম আবু হানীফা রহ.র উদ্ধৃতি দিয়ে একটি অভিমত উল্লেখ করেছেন যে, রমযান মাসের পুরোটাতেই লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তিনি সুনানে আবু দাউদের উদ্ধৃতিতে একটি হাদীসও উল্লেখ করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেছেন, তা পুরো রমযানে রয়েছে। হাদীসটির বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। তবে তিনি এও বলেন, ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, শো’বা ও সুফিয়ান রাহিমাহুমাল্লাহ হাদীসটি মওকূফ হাদীস হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সুনানে আবু দাউদের বর্ণনাসহ ইবনে কাসীর রহ. এর বিবরণ নিম্নরূপ-

وقد ترجم أبو داود في سننه على هذا فقال: “باب بيان أن ليلة القدر في كل رمضان”: حدثنا حميد بن زنجويه النسائي أخبرنا سعيد بن أبي مريم، حدثنا محمد بن جعفر بن أبي كثير، حدثني موسى بن عقبة، عن أبي إسحاق، عن سعيد بن جبير، عن عبد الله بن عمر قال: سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم وأنا أسمع عن ليلة القدر، فقال: “هي في كل رمضان” وهذا إسناد رجاله ثقات إلا أن أبا داود قال: رواه شعبة وسفيان عن أبي إسحاق فأوقفاه. وقد حكي عن أبي حنيفة، رحمه الله، رواية أنها ترجى في جميع شهر رمضان. وهو وجه حكاه الغزالي، واستغربه الرافعي جدا.

এটি একটি অভিমত মাত্র। নয়তো একাধিক সহীহ হাদীস থেকে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকের কোন একটি রাত।
নিম্নে সেই হাদীসগুলো থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা হল।

১ম হাদীস-

عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ “.
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। সহীহ বুখারী ২০১৭

২য় হাদীস-

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ، وَيَقُولُ ” تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ “.
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। সহীহ বুখারী ২০২০

৩য় হাদীস-

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকে তালাশ কর। … সহীহ বুখারী ২০২১

৪র্থ হাদীস-

আবু সাঈদ খুদরি রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

اعْتَكَفْنَا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم الْعَشْرَ الأَوْسَطَ مِنْ رَمَضَانَ، فَخَرَجَ صَبِيحَةَ عِشْرِينَ، فَخَطَبَنَا وَقَالَ ” إِنِّي أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ، ثُمَّ أُنْسِيتُهَا أَوْ نُسِّيتُهَا، فَالْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فِي الْوَتْرِ، وَإِنِّي رَأَيْتُ أَنِّي أَسْجُدُ فِي مَاءٍ وَطِينٍ، فَمَنْ كَانَ اعْتَكَفَ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَلْيَرْجِعْ “. فَرَجَعْنَا وَمَا نَرَى فِي السَّمَاءِ قَزَعَةً، فَجَاءَتْ سَحَابَةٌ فَمَطَرَتْ حَتَّى سَالَ سَقْفُ الْمَسْجِدِ وَكَانَ مِنْ جَرِيدِ النَّخْلِ، وَأُقِيمَتِ الصَّلاَةُ، فَرَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَسْجُدُ فِي الْمَاءِ وَالطِّينِ، حَتَّى رَأَيْتُ أَثَرَ الطِّينِ فِي جَبْهَتِهِ.

আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে রমযানের মধ্যম দশকে ই’তিকাফ করি। তিনি বিশ তারিখের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, আমাকে লাইলাতুল কদর (-এর সঠিক তারিখ) দেখানো হয়েছিল কিন্তু পরে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তা তালাশ কর। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ওই রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – এর সঙ্গে ই’তিকাফ করেছে সে যেন ফিরে আসে। আমরা সকলে ফিরে আসলাম। (আমরা যারা তখনও মসজিদে ছিলাম তাঁরা মসজিদেই রয়ে গেলাম) আমরা তখন আকাশে হালকা মেঘও দেখতে পাইনি। পরে মেঘ দেখা দিল এবং এমন জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের ডাল দিয়ে তৈরি মসজিদের ছাদ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। নামায শুরু হলে আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে কাদার চিহ্ন দেখতে পাই। সহীহ বুখারী ২০১৬

৫ম হাদীস-
সহীহ মুসলিমে হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাযি. থেকে একটি হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন,

إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوَّلَ مِنْ رَمَضَانَ ثُمَّ اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ فِي قُبَّةٍ تُرْكِيَّةٍ عَلَى سُدَّتِهَا حَصِيرٌ – قَالَ – فَأَخَذَ الْحَصِيرَ بِيَدِهِ فَنَحَّاهَا فِي نَاحِيَةِ الْقُبَّةِ ثُمَّ أَطْلَعَ رَأْسَهُ فَكَلَّمَ النَّاسَ فَدَنَوْا مِنْهُ فَقَالَ ” إِنِّي اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِي إِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ ” . فَاعْتَكَفَ النَّاسُ مَعَهُ قَالَ ” وَإِنِّي أُرِيتُهَا لَيْلَةَ وِتْرٍ وَأَنِّي أَسْجُدُ صَبِيحَتَهَا فِي طِينٍ وَمَاءٍ

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম দশ দিন ই’তিকাফ করেন। এরপর মাঝের দশ দিনও ই’তিকাফ করেন। তিনি একটি তুর্কি তাবুতে ইতিকাফ করছিলেন, যার সামনে চাটাইয়ের আড়াল ছিল। (বিশ দিন পার হওয়ার পর) তিনি চাটাইটি ধরে তাবুর এক পাশে সরিয়ে রাখেন। এরপর মাথা বের করে লোকদের সঙ্গে কথা বলেন। সবাই তাঁর কাছাকাছি গেলে বললেন, কদরের রাতটি তালাশ করার জন্যই আমি প্রথম দশ দিন ই’তিকাফ করেছি, এরপর মাঝের দশ দিনও ই’তিকাফ করেছি। এরপর আমাকে জানানো হয়েছে যে, তা শেষ দশকে রয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে কেউ ই’তিকাফ করতে চাইলে সে যেন (এখন) ই’তিকাফ করে। তখন সাহাবিরা তাঁর সাথে ই’তিকাফ করলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে দেখানো হয়েছে, তা বেজোড় রাতে, যে রাতের পরের সকালে (বৃষ্টি হওয়ার কারণে) আমি কাদা-পানিতে সেজদা করছি …..। (সহীহ মুসলিম : ২৬৪৫)

লাইলাতুল কদর চেনার কিছু আলামত
রমযানের শেষ দশকের ঠিক কোন রাতটি লাইলাতুল কদর? এ বিষয়টি বলার আগে কয়েকটি কথা আরজ করছি। এক. বাস্তবতা হচ্ছে, রমযানের শেষ দশকের ঠিক কোন রাতটি লাইলাতুল কদর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুনির্দিষ্টভাবে তা আমাদেরকে জানাননি।

দুই. লাইলাতুল কদর চেনার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্ভাব্য কিছু সংখ্যা ও আলামত বলে দিয়েছেন। যার মাধ্যমে ধারণা লাভ করা যেতে পারে যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর হচ্ছে।

তিন. সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ শেষ দশকের বিশেষ একটি রাতকে সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলেছেন। তবে তা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বলা কিছু আলামতের ভিত্তিতে একটি ধারনা মাত্র। নয়তো এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কথা বলেননি।
চার. লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভ করার জন্য সাম্ভাব্য সবগুলো রাতেই ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো শরীয়তে কাম্য।
এবার মূল কথায় ফিরে আসি। লাইলাতুল কদর চিনার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সম্ভাব্য যে সব সংখ্যা ও নিদর্শন বলে দিয়েছেন এখন সংক্ষেপে ওগুলো নিয়ে কিছু আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ

(ক) উপরোল্লিখিত ১ম হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে, কদরের রাতটি শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর কোন একটি হবে। অর্থাৎ একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাইশ ও উনত্রিশতম রাত।
(খ) সহীহ মুসলিমে হযরত উবাই বিন কাআব রাযি. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদরের একটি আলামত বলেছেন,

أنها تطلع (الشمس) يومئذ لا شعاع لها

লাইলাতুল কদরের পর দিন) ভোরে সূর্যের আলোতে তাপ থাকবে না। সহীহ মুসলিম ৭৬২

(গ) সহীহ ইবনে খুযাইমাতে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ليلة طلقة لا حارة ولا باردة، تصبح الشمس يومها ضعيفة حمراء
কদরের রাতটি হবে উজ্জ্বল-পরিষ্কার, গরমও হবে না, ঠাণ্ডা হবে না, সেদিন (অর্থাৎ লাইলাতুল কদরের পরের দিন ভোরে) সূর্যের আলোতে তাপ থাকবে না। । সহীহ ইবনে খুযাইমা ২১৯০ (শাইখ আলবানি রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন)

লাইলাতুল কদরে করণীয়
লাইলাতুল কদরে কী করণীয়, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টিভাবে কোন আমলের কথা কোন হাদীসে আসেনি।
হ্যাঁ, হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে একটি দোয়ার কথার এসেছে।

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ عَلِمْتُ أَىُّ لَيْلَةٍ لَيْلَةُ الْقَدْرِ مَا أَقُولُ فِيهَا قَالَ ” قُولِي اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي ” . قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ .
হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি তাহলে সে রাতে কী পড়ব? তিনি বললেন, তুমি বলো,

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাকারী, উদার। ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। জামে তিরমিযী ৩৫১৩; কোন কোন বর্ণনায় দোয়াটি এভাবে এসেছে,

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাকারী। ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।

মূলত এ রাতে আমাদের উচিত, আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তি এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের ইবাদতের মধ্যে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করা। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতসহ পুরো শেষ দশকে ইবাদতে এত বেশি পরিশ্রম করতেন যা অন্য কোন সময় করতেন না। তিনি নিজে সারা রাত জেগে থাকতেন, পরিবারের লোকদেরকেও জাগিয়ে দিতেন। এ সময় ইবাদতের উদ্দেশ্যে অন্য সকল ব্যস্ততা থেকে অবসর থাকার জন্য মসজিদে ইতিকাফে বসে যেতেন। অথচ তাঁর পূর্বাপর সব কিছুই ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এ থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি, এ রাতে আমাদের মতো গুনাহগারদের কী কী করণীয়? আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহামূল্যবান এ রাতটির যথাযথ কদর করার তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া আরহামার রাহিমীন।

Related Articles

Back to top button