হিন্দুত্ববাদ

বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের এক নতুন ও বিপদজনক পর্যায় (২)

বাংলাদেশে

হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের

এক নতুন

বিপদজনক পর্যায়

(২)

 

 

পূর্বকথা

বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান এবং এর পরিধি নিয়ে আস-সাহাব মিডিয়া উপমহাদেশের ‘নাওয়ায়ে গাযওয়ায়ে হিন্দ’ ম্যাগাজিনের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর (২০২০ ইংরেজি) সংখ্যায় দুই পর্বের একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম পর্বের অনুবাদ (https://fatwaa.org/2020/10/01/1700/) ইতিপূর্বে  প্রকাশিত হয়েছিল, এখন দ্বিতীয় পর্বের অনুবাদও প্রকাশিত হল। “বাংলাদেশ মে হিন্দুতওয়া কা খতরনাক মারহালা” (بنگلہ دیش میں ہندوتوا کا خطرناک مرحلہ) শিরোনামে।  উপমহাদেশে তাওহিদবাদী মুসলিমদের সাথে হিন্দুত্ববাদী মুশরিকদের যে অমোঘ সংঘাতের প্রেক্ষাপট ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে তার বাস্তবতা অনুধাবনের জন্য, উপমহাদেশে জিহাদী আন্দোলনের সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য ও বিশ্লেষণ ইনশাআল্লাহ উপকারী হবে। 

 

 

  • ইসকন

গত দশ বছর ধরে প্রশাসনে হিন্দুদের ক্ষমতা ও প্রভাব কতোটা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এর ফলে তারা কতোটা উদ্ধত হয়ে উঠেছে তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ পাওয়া যায় ইসকনের কর্মকান্ডে।

কয়েকটি উদাহরণের দিকে তাকালে ব্যাপারটা স্পষ্ট বোঝা যায়-

২০১৪ সালে রমযান মাসে আয়োজন করে ৭দিন ব্যাপী রথযাত্রার। রাজধানীর স্বামীবাগের ঐতিহ্যবাহী স্বামীবাগ জামে মসজিদের পাশে ইসকনের মূল মন্দির। মসজিদের পাশেই উচ্চস্বরে বাদ্যবাজনা বাজায় তারা। একদিন তারাবীহ নামায চলার সময় ‘রথযাত্রায় অসুবিধা’ হবার অজুহাতে মন্দিরের পক্ষ থেকে রাত ১০টার মধ্যে তারাবীহ নামায শেষ করার জন্য চাপ দেয়া হয় মসজিদ কর্তৃপক্ষকে। দাবি মোতাবেক নামায সংক্ষিপ্ত না করার কারণে মসজিদের মুসল্লিদের ঢিল ছোড়া শুরু করে মন্দিরের উগ্র হিন্দু সন্ত্রাসীরা। হিন্দুদের পক্ষ নিতে ঘটনাস্থলে চলে আসে গেন্ডারিয়া থানার হিন্দু এসআই। এসেই চেষ্টা করে মসজিদের ইমামকে গ্রেপ্তারের। এসময় মসজিদের মুসল্লিগণের হস্তক্ষেপে ইমামকে ছাড়তে বাধ্য হয় হিন্দু এসআই।

হিন্দু এসআই মুসলমানদের হুমকি দেয়, ‘তারাবীর নামায রাত ১০টার মধ্যেই শেষ করতে হবে। নইলে মন্দিরের কার্যক্রমে বাধা দেয়ার কারণে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’  মসজিদে তালা ঝুলানো কথা শুনে মসজিদের মুসল্লিরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। পরে ঘটনা সামাল দেয়ার জন্য উপস্থিত হয় থানার ওসি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই মন্দির থেকে একদল লোক দা, লাঠি নিয়ে বের হয়ে মুসল্লিদের ধাওয়া করে উগ্র দাঙ্গাবাজ হিন্দুরা। পরে স্থানীয় মুরব্বী এবং মসজিদ কমিটির হস্তক্ষেপে উগ্র হিন্দুদের আক্রমণাত্মক সংঘর্ষ থেকে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

এ পুরো ঘটনা থেকে বুঝা যায় কিভাবে প্রশাসনে হিন্দু প্রভাবের কারণে ইসকনের মতো সংগঠনগুলো সরাসরি মুসলিমদের চ্যালেঞ্জ করার সাহস পাচ্ছে, এবং এসব ক্ষেত্রে কিভাবে প্রশাসন তাদের সাহায্য করছে।

একই রকম ঘটনা ঘটে সিলেটে ২০১৬ তে, সিলেটে। সিলেটের কাজল শাহ জামে মসজিদে জুমার নামাযের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে লাউডস্পিকারে বাদ্যবাজনা বাজিয়ে নামাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ইসকনের লোকজন। নামাজের পর মুসল্লিরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মন্দিরে গেলে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে তারা। এক পর্যায়ে মন্দিরের ভেতর থেকে মুসল্লিদের লক্ষ্য করে ছোড়া হয় ইট পাটকেল। মুসল্লিরাও পাল্টা ঢিল ছুড়লে ইসকন ভক্তরা অস্ত্র (দা বটি) নিয়েও মুসল্লিদের উপর হামলা চালায়। এসময় পুলিশ এসে মুসল্লিদের উপর গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুড়তে থাকে। প্রায় ১২ জন মুসল্লি আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন প্রায় ৭ জন। ঘটনার পর অনেক মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু ইসকনের এক জন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।

এ এঘটনার পর ফেসবুকে ইসকনের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে খুন হন সিলেটের ওসমানীনগরের মসজিদের খতিব আব্দুর রহমান। নিজ ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গলায় ফাস লাগানো অবস্থায় পাওয়া যায় তার লাশ। আল্লাহ্‌ তাঁর উপর রহম করুন।

এ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন না, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিমদের উস্কে দেয়ার (provoke) জন্য পরিকল্পিতভাবে এ ধরণের কাজগুলো করে ইসকন। এ বছরও রথযাত্রার সময় সারাদিন, বিশেষভাবে নামাযের সময় তারা উচ্চস্বরে বাদ্যবাজনা চালিয়েছে। রাস্তায় দল বেঁধে মার্চ করেছে হাতে বর্শা নিয়ে।

এ ধরণের উস্কানির আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০১৯ এর জুলাইয়ে। রথযাত্রা কর্মসূচীর অংশ হিসাবে এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামের ৩০ টি স্কুলে পূজার প্রসাদ বিতরণ করে ইসকন। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ছিল সরকারি স্কুল। ক্লাসরুমে ঢুকে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেয় এই হারাম খাওয়া। সেই সাথে তাদের উৎসাহ দিয়ে ‘হরে রাম, হরে কৃষ্ণ’ স্লোগান দেয়ানো হয়। তারপর সেই ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচার করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। সোশ্যাল মিডিয়াতে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। একটি ইসলামী গণতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু বরাবরের মতোই আদালত মামলার আবেদন খারিজ করে দেয়।

মুসলিম শিশুদের হরে রাম, হরে কৃষ্ণ জপ করানোর ভিডিও এবং প্রিয়া সাহার বক্তব্য ভাইরাল হবার পর যখন সারা দেশে হিন্দুবিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হয়ে উঠে, এমন সময় রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দেয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি মসজিদ। এ ঘটনার প্রতিবাদে একজন আলিম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে তাঁকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

গতো বেশ কয়েক বছর ধরে ইসকন এভাবে মুসলিমদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম – এ সব ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এছাড়া প্রশাসনে প্রচুর পরিমাণ হিন্দু ঢুকানোর জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে আসছে ইসকন, যেমনটা প্রতিবেদনের প্রথম দিকে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কাজটা তারা করছে প্রশাসনের ভেতরে থাকা হিন্দুদের কাজে লাগিয়ে এবং টাকার জোরে। তাদের কার্যক্রমের জন্য দেশের বাইরে থেকে আসছে শত শত কোটি টাকা। যেমন সাভারে ইসকন মন্দির তৈরির জন্য যে আরএসএস এর পক্ষ থেকে সাড়ে সাত কোটি টাকা দেয়া হয়েছে সেটা স্বীকার করেছে আরেক উগ্রবাদী দল ‘জাতীয় হিন্দু মহাজোট’ এর নেতা। এই টাকা দিয়ে তারা গড়ে তুলছে মন্দির, এবং দেশজুড়ে বিশাল নেটওয়ার্ক। পাশাপাশি দলে ভিড়াচ্ছে গরীব ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও। দেশের শতাধিক জায়গায় এখন তাদের ঘাঁটি গড়ে উঠেছে।

গত ক’বছরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের (হিন্দু মহাজোট, জাগো হিন্দু, বেদান্ত) অধিকাংশ সদস্যরা ইসকনেরও সদস্য। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার সাথেও যুক্ত ইসকনের সদস্যরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন এক ইসকন সদস্যকে মুসলিম ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ইসলাম অবমাননার জন্য গ্রেপ্তার করা হলে, তাকে বাঁচাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে ভারতীয় হাইকমিশন। পরে ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা মুসলিম ছাত্রদের একজনকে উল্টো গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যেসব স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষন ইসকনের সাথে জড়িতে তারা ছাত্রীদের হিজাব-নিক্বাব পরায় বাঁধা দিচ্ছে।

এর পাশাপাশি সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উচ্চ পদে থাকা হিন্দুর কাছে ইসকন যে প্রস্তাব নিয়ে যায়, তার আলোচনা এরই মধ্যে এসেছে। মূলত ইসকন বাংলাদেশে অনেকটা জায়নিস্ট ইহুদীদের অনুপ্রবেশের আদলে কাজ করছে। সিলেটে ইসকনের ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিল ভারতীয় হাইকমিশনার, যা থেকে বাংলাদেশে ইসকনের পেছনে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মদদের বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যায়। বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রভাব কতোটা বেড়েছে তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ সম্ভবত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহার ঘটনা। ইসকন, প্রশাসনে হিন্দু প্রভাব এবং ভারতীয় হাইকমিশনের জোরেই প্রধান বিচারপতি পদে থাকা অবস্থায় সরাসরি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল সুরেন্দ্র সিনহা। ভারতের এক এজেন্ট সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিল আরেক এজেন্টকে। তবে আওয়ামী লীগ সক্ষম হয় তাকে বলপ্রয়োগে দেশত্যাগ করাতে। সিনহা ছাড়াও সম্প্রীতি বাংলাদেশের পীযূষ ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যজোটের রানা দাসগুপ্তও ইসকনের সাথে সম্পর্কিত।

ইসকনের কাজ থেকে এটা মনে হয় যে তারা নেটওয়ার্ক তৈরি এবং প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে মুসলিম উস্কে দেয়ার এবং সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা করছে। এক সাংবাদিকের অনুসন্ধানী রিপোর্টে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘বিশেষ বাহিনীর এক সাবেক সদস্য’ -এর বক্তব্যের নামে কিছু কথা উঠে এসেছে যা থেকে ইসকনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। এই বক্তব্যটি তাহক্বিক করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তবে প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় এটি আমরা এখানে উল্লেখ করছি –

“বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ইসকন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ও ভবিষ্যতেও করবে। হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা উস্কে দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার মাধ্যমে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য ইসকন কাজ করছে। ইসকনসহ অন্যান্য হিন্দুদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও অত্যাচারের কারণে যখন মুসলিমরা কোন পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করবে বা প্রতিবাদ করবে, তখন দাঙ্গা হবে। এ দাঙ্গার আড়ালে ভারতীয় এজেন্টদের মাধ্যমেই হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘরে আক্রমন হবে, আগুন দেয়া হবে। ভারত বিশ্বকে বুঝাবে বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবং এই অজুহাত দেখিয়ে তারা বাহিনী পাঠিয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে।”

যেসব বিষয় ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, তার আলোকে এ বক্তব্য বানোয়াট হবার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। এ বিষয়টি স্পষ্ট যে নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি, মন্দির নির্মান, প্রশাসনে অনুপ্রবেশ, দেশ জুড়ে ঘাঁটি তৈরি, ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিমদের খেপিয়ে তুলার চেষ্টা করা, এগুলো ইসকনের চূড়ান্ত লক্ষ নয়। বরং তাদের লক্ষ অর্জনের খাতিরে তারা এ কাজগুলো করছে। তাদের এসব কার্যক্রম এবং প্রস্তুতির ধরন বলে দেয় যে তারা চরম পর্যায়ের কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে।

 

  • হিন্দু মহাজোট/গোবিন্দ প্রামানিক

বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব হিন্দু দল-গোষ্ঠী প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে তার মধ্যে সবচেয়ে উগ্র দল সম্ভবত বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট। এ দলের মহাসচিব গোবিন্দ প্রামাণিক প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে ভারতের অংশ করার স্বপ্নের কথা বলে। আরএসএস এর স্বপ্ন অখন্ড ভারতের পক্ষে প্রচারণা চালায়। এ দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরাসরি বাংলাদেশকে ভারতের অংশ বানানোর কথা বলা হয়। হিন্দু মহাজোটের অনুষ্ঠানে সিদ্ধেশ্বরী কালিমন্দিরের পুরোহিত বাংলাদেশকে অখন্ড ভারত প্রতিষ্টার কথা বলেছে। শুধু তাই না, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির প্রধান ও বিধায়ক দিলিপ ঘোষও হিন্দু মহাজোটের অনুষ্ঠানে এসে বলেছে বাংলাদেশকে ভারতের অংশ বানিয়ে অখন্ড ভারত তৈরির কথা। গোবিন্দ প্রামাণিক নিয়মিত অনলাইনে নিজের বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করে এসব ভিডিওতে সে খোলাখুলি সরকার, এবং মন্ত্রীদের তুচ্ছাতাচ্ছিল্য করে। এছাড়া সে হিন্দুদের আহবান জানায় মুসলিমদের মোকবেলার জন্য নিজ ঘরবাড়িতে বর্শা, ত্রিশুল ইত্যাদি মজুদ করার, রথযাত্রাসহ হিন্দুদের অন্যান্য অনুষ্ঠানের সময় হাতে অস্ত্র রাখার। গোবিন্দ প্রামাণিক বাংলাদেশে আরএসএস এর একজন সক্রিয় সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে। সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তৃণমূল পর্যায়ে হিন্দুদের উদ্বুদ্ধ করছে এবং হিন্দু তরুণদের সংঘবদ্ধ করছে আরএসএস এর আদর্শ ও অখন্ড ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে।

প্রামাণিকের বক্তব্য থেকে জানা গেছে আরএসএস বাংলাদেশের বিভিন্ন মঠ-মন্দির এবং হিন্দু দলগুলোর পেছনে বিনিয়োগ করছে শত শত কোটি টাকা। আরএসএস এর টাকা যাদের কাছে যাচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাভারে ইসকন মন্দির, রমনা কালীমন্দির, উত্তরবঙ্গ ও নীলফামারীর বিভিন্ন মন্দির। এর পাশাপাশি হিন্দু মহাজোটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ দলের সদস্য এবং এদের অতিথিরা (দিলিপ ঘোষসহ) কখনো ইঙ্গিতে, কখনো সরাসরি দিচ্ছে হিন্দুদের সশস্ত্র হবার, লড়াই করার বার্তা।

এসব সংগঠনের কার্যক্রম, প্রশাসনিক ক্ষমতা, ইত্যাদির প্রভাব পড়ছে হিন্দুদের আচরণেও। এর একটি উদাহরণ হল বছর খানেক আগে চটগ্রাম শহরের একটি এলাকায় তারা কুরবানির ঈদের সময় সরাসরি মুসলিমদের গরু জবাই করত বাঁধা দেয়। এসময় এলাকার হিন্দুরা হুমকি দেয়, গরু জবাই করা হলে মুসলিমদের জবাই করে দেয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম থামতে বাধ্য হয়। এ ব্যাপারে থানায় মামলা করা হলেও তেমন কোন ফলাফল আসেনি।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে অপেক্ষাকৃত ‘মডারেট’ ও আওয়ামীঘেঁষা সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মতো সংগঠনগুলোকে ছাপিয়ে ইসকন ও হিন্দু মহাজোটের মতো দলগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যদিও এরা সবাই মোটামুটি একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে, কিন্তু এ পরিবর্তন থেকে হিন্দুদের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বৃদ্ধি এবং হিন্দুদের যুদ্ধংদেহী ও আক্রমণাত্মক মনোভাব তৈরি হবার বিষয়টি বুঝা যাচ্ছে। এতোদিন ধরে আওয়ামীয় লীগকে তোয়াজ করে চললেও এখন আওয়ামী লীগের তোয়াক্কা না করেই সরাসরি ভারতের নাম নিয়ে তারা তর্জনগর্জন শুরু করেছে। এতোদিন শক্তি সঞ্চয় ও প্রস্তুতির পর এখন তারা শক্তি প্রদর্শন ও সরাসরি মুসলিমদের বিরুদ্ধে মোকাবেলায় যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করছে।

 

উপসংহার

বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী প্রজেক্ট প্রবেশ করেছে এক নতুন, আরো আত্মবিশ্বাসী, আরো শক্তিশালী পর্যায়ে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রজেক্টের প্রতি খোলাখুলি সমর্থন, প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে ভারতের অংশ করার মতো দাবি তুলা, ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিমদের উসকানোর চেষ্টা, হিন্দুদের সশস্ত্র হবার ও অস্ত্র হাতে নেয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিতে ও কখনো কখনো স্পষ্ট কথা বলা, আওয়ামী লীগের সরাসরি সমালোচনা, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বয়ান প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করা, তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হওয়া, এগুলো নতুন এ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। পাশাপাশি প্রশাসনে এ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে অনুপ্রবেশের নীতি অব্যাহত থাকছে এ পর্যায়ে, এবং আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে এর গতি ও ব্যাপ্তি।

ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে আগাচ্ছে তাতে ভবিষ্যত পরিস্থিতিতে ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা কী হতে পারে তা নিয়ে কিছু অনুমান করা যায় –

  • বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস কর্মী এবং বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদীদের অস্ত্র সরবরাহ করে অতীতের ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন’ এর আলোকে বৃহত্তর খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল ও পটুয়াখালীকে পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করবে।
  • এই সময় অথবা তার পূর্বেই, প্রবর্ধমান শক্তির মাধ্যমে দেশে দাঙ্গা শুরু করা হবে, যাতে করে বেশ কিছু হিন্দু মারা যায়, হয় ভারতীয় এজেন্টদের হাতে অথবা স্বাভাবিকভাবে মুসলিমদের হাতে। এরপর বাংলাদেশের হিন্দুরা যখন আতঙ্কিত হয়ে সীমান্ত পাড় হয়ে ভারতে ঢুকতে শুরু করবে তখন সীমান্ত অঞ্চলে অস্ত্র দিয়ে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন’ এর আলোকে বৃহত্তর খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল ও পটুয়াখালীকে পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করবে।
  • নেতা হিসেবে হাসিনার সক্ষমতা আছে দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হার্ডকোর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উজ্জীবিত করার। এই সক্ষমতার কারণে আওয়ামীলীগ ইতিপূর্বে সুরেন্দ্র সিনহাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে সীমিত পরিসরে হলেও ভারতের কথার বাইরে গেছে। এছাড়াও গত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও ভারতের দিক থেকে সরে চীনের দিকে ঝুকেছে। তাই প্রয়োজন হলে হাসিনাকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় আরো আজ্ঞাবহ কাউকে আনা হতে পারে। এনে তার মাধ্যমে বাংলাদেশকে আরো পুরোপুরিভাবে ভারতের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে যাওয়া হবে, তবে সরাসরি ভারত বাহিনী পাঠাবে না। যারা বিরোধিতার চেষ্টা করবে তাদের ভারতীয় দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সেনাবাহিনী, পুলিশ ইত্যাদি দিয়ে নিউট্রালাইজ করা হবে।
  • এনআরসির মাধ্যমে আসামের ৩০/৪০ লক্ষ মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করার পর ঠিক কী করা হবে তা পরিষ্কার না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এভাবে নাগরিকত্ব বাতিল করে কাউকে অনুপ্রবেশকারী সাব্যস্ত করার পর তাকে নিজের আদি দেশে ফেরত পাঠানো যায় না। এমন অবস্থায় বিজেপি কি এই বিপুল সংখ্যক মুসলিমদের চীনের আদলে কনসেন্ট্রেনশন ক্যাম্পে পাঠাতে চায়, নাকি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় দাঙ্গা লাগিয়ে গণহত্যা লাগিয়ে সীমান্তের দিকে ঠেলে দিতে চায়, তা বুঝা যাচ্ছে না। হয়তো তাদের বাংলাদেশে পুশ করার চেষ্টা করা হবে। অথবা এটাও সম্ভাবনা আছে যে, বিজেপি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় বিশৃঙ্খলা শুরু করে দিবে। যার ফলাফল স্বরূপ মুসলিমদের গণহত্যা শুরু করবে। এবং এই গণহত্যার মাধ্যমে মুসলিমদেরকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। এর ফলাফল স্বরূপ হতে পারে বাংলাদেশে দাঙ্গা বেধে যাবে। এবং এর ফায়েদা নিয়ে আরএসএস ও বিজেপি বাংলাদেশের হিন্দুদের সশস্ত্র করা শুরু করবে। এবং স্বাধীন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বঙ্গভূমি বানানোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে।

 

এই বিষয়গুলো ছাড়াও (জরুরী বিষয় হল) ভবিষ্যতে ভারত কী কী পদক্ষেপ নিবে? পরিস্থিতি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তা খাসভাবে বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য এবং আমভাবে পুরো হিন্দের মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব রাখে। মুসলিমরা এই বিপদকে দূরবর্তী মনে করে তা থেকে মনোযোগ সরিয়ে না রেখে উম্মত হিসেবে চিন্তা ভাবনা শুরু করা জরুরী। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বার্মা ও আফগানিস্তানকে তাদের নিজ নিজ জনগণের সমস্যা মনে করার পরিবর্তে একটি বৃহত্তর ইসলামী ভূখণ্ডের অংশ হিসাবে দেখাও জরুরী

স্মরণ রাখতে হবে যে, মুসলিমদের এক মুঠো জমিনও যদি কাফেরদের দখলে চলে যায়, তখন পর্যায়ক্রমে সব মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। আমাদের রব আমাদের জানিয়েছেন, মুসলিমদের সাথে দুশমনির ক্ষেত্রে সবচে’ কঠোর হচ্ছে ইহুদী ও মুশরিকরা। সুতরাং এদের মোকাবেলার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে থাকুন। তাদের চক্রান্তকে বুঝুন ও তা প্রতিহত করার চেষ্টা করুন, সে সময় আসার পূর্বেই যে, নদীর পানি অনেক দূর প্রবাহিত হয়ে গেছে।

Related Articles

Back to top button