কেউ নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে আত্মহত্যা করে ফেললে তার হুকুম কী?
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
প্রশ্ন:
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় দেশেই মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিনিয়তই আমাদের মা বোনেরা কাফের ও মুরতাদদের হাতে নিজেদের মূল্যবান ইজ্জত আব্রু হারাচ্ছেন৷ এমতাবস্থায় আমরা দেখি, আমাদের কোনো কোনো বোন এ থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যা করে ফেলেন৷ আমার জানার বিষয় হল, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর হুকুম কী? কেউ করে ফেললে তিনি কি জাহান্নামী হবেন?
ইরাকের আবু গারীব কারাগার থেকে পাঠানো আমাদের এক বোন ফাতেমা তাঁর চিঠিতে বলেছিলেন, সেখানে এক বোন নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। মেহেরবানি করে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।
প্রশ্নকারী- আমাতুল্লাহ
উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم
আত্মহত্যা হারাম ও কবীরা গুনাহ। সম্ভ্রম রক্ষার জন্যও আত্মহত্যা করা জায়েয নয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
“তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।” (সূরা নিসা (০৪) : ২৯
হাদীসে এসেছে,
عن أنس بن مالك عن النبي صلى الله عليه وسلم قال أكبر الكبائر الإشراك بالله وقتل النفس وعقوق الوالدين وقول الزور أو قال وشهادة الزور (صحيح البخاري 6871)
“হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, মানুষ হত্যা করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।” (সহীহ বুখারী: ৬৮৭১)
অন্য হাদীসে এসেছে,
عن أبي هريرة رضي الله عنه : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( من تردى من جبل فقتل نفسه فهو في نار جهنم يتردى فيه خالدا مخلدا فيها أبدا ومن تحسى سما فقتل نفسه فسمه في يده يتحساه في نار جهنم خالدا مخلدا فيها أبدا ومن قتل نفسه بحديدة فحديدته في يده يجأ بها في بطنه في نار جهنم خالدا مخلدا فيها أبدا ) (صحيح البخاري 5442، صحيح مسلم 313)
“হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পাহাড় হতে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে সর্বদা পাহাড় হতে পড়তে থাকবে। এভাবেই সে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কাল শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যে বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে দেওয়া হবে। সে জাহান্নামের আগুনে সর্বদা তা পান করতে থাকবে। এভাবেই সে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কাল শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যে ধারালো কোন অস্ত্রের আঘাতে আত্মহত্যা করবে, তার হাতে সেই অস্ত্র ধরিয়ে দেয়া হবে। সে তা দ্বারা জাহান্নামের আগুনে সর্বদা নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে। এভাবেই সে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কাল শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।” (সহীহ বুখারী: ৫৪৪২, সহীহ মুসলিম: ৩১৩)
সুতরাং আল্লাহ না করুন, কোনো মুসলিম বোন যদি নির্যাতন বা ইজ্জত-আব্রুর ওপর হামলার শিকার হন, তাহলে তিনি আক্রমণকারীকে তাঁর সম্ভ্রমহানির সুযোগ দেবেন না; বরং যথাসাধ্য মোকাবেলা করে যাবেন। প্রয়োজনে অস্ত্র প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করবেন। কোনো অবস্থায়ই নিজে আত্মহত্যা করবেন না। যদি তিনি আক্রমণকারীকে হত্যা করতে সক্ষম হন, তবে তিনি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাবেন। যদি আক্রমণকারী তাঁকে হত্যা করে, তাহলে তিনি ইনশাআল্লাহ শহীদদের কাতারে শামিল হবেন। আর যদি সর্বাত্মক চেষ্টার পরও তিনি নিজের ইজ্জত রক্ষায় অক্ষম হন, তবে আল্লাহ তাআলার ফায়সালা মনে করে সবর করবেন। এজন্য তাঁর কোনো গোনাহ হবে না; বরং আল্লাহর কাছে অবশ্যই তিনি এর মহা প্রতিদান পাবেন।
তবে কোনো বোন যদি শরীয়তের বিধান না জানার কারণে ইজ্জত রক্ষার জন্য আত্মহত্যা করেই ফেলেন, তাহলে তিনি একটা গোনাহের কাজ করলেন। তবে কেউ কোনো গুনাহের কাজ করলেই তিনি নিশ্চিত জাহান্নামি হবেন, এমনটি বলা যায় না। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে মুমিনদের যে কোনো গুনাহই ক্ষমা করে দিতে পারেন। বিশেষত যখন তিনি না জানার কারণে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কাজ মনে করে করেছেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে আমরা আশা রাখতে পারি, আল্লাহ তাআলা হয়তো তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। যেমন সহীহ বুখারিতে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: ” كَانَ رَجُلٌ يُسْرِفُ عَلَى نَفْسِهِ فَلَمَّا حَضَرَهُ المَوْتُ قَالَ لِبَنِيهِ: إِذَا أَنَا مُتُّ فَأَحْرِقُونِي، ثُمَّ اطْحَنُونِي، ثُمَّ ذَرُّونِي فِي الرِّيحِ، فَوَاللَّهِ لَئِنْ قَدَرَ عَلَيَّ رَبِّي لَيُعَذِّبَنِّي عَذَابًا مَا عَذَّبَهُ أَحَدًا، فَلَمَّا مَاتَ فُعِلَ بِهِ ذَلِكَ، فَأَمَرَ اللَّهُ الأَرْضَ فَقَالَ: اجْمَعِي مَا فِيكِ مِنْهُ، فَفَعَلَتْ، فَإِذَا هُوَ قَائِمٌ، فَقَالَ: مَا حَمَلَكَ عَلَى مَا صَنَعْتَ؟ قَالَ: يَا رَبِّ خَشْيَتُكَ، فَغَفَرَ لَهُ ” وَقَالَ غَيْرُهُ: «مَخَافَتُكَ يَا رَبِّ» -صحيح البخاري (4/ 176)، رقم الحديث: 3481
“আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (পূর্ব যামানার) এক ব্যক্তি নিজের ওপর অনেক জুলুম করতো। তার মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন নিজ সন্তানদের নির্দেশ দিল, আমি মারা গেলে আমাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে পিষে পাউডার করে ফেলবে। এরপর বাতাসে উড়িয়ে দেবে। আল্লাহর কসম! আমার রব যদি আমাকে ধরতে পারেন, আমাকে এমন শাস্তি দেবেন যা আর কাউকেও দেননি।
মারা যাওয়ার পর তার লাশের সাথে তার নির্দেশ মতো কাজ করা হলো। তখন আল্লাহ তায়ালা জমিনকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, এই লোকের (দেহের) যা কিছু তোমার মাঝে আছে সব একত্রিত করো। জমিন তাই করল। অমনি লোকটি (জীবিত) দাঁড়িয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসে তোমাকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? সে উত্তর দিল, হে আমার রব! আপনার ভয়ে (এমনটা করেছি)। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।” -সহীহ বুখারী: ৩৪৮১
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি. বলেন,
فَغَفَرَ لَهُ لِخَوْفِهِ -مسند أبي يعلى الموصلي (8/ 470)، رقم الحديث: 5056، قال المحقق حسين سليم أسد : إسناده صحيح. اهـ
‘আল্লাহকে ভয় করার বদৌলতে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ -মুসনাদে আবু ইয়ালা: ৫০৫৬
সহীহ মুসলিমে এক সাহাবির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে,
عن جابر أن الطفيل بن عمرو الدوسي أتى النبي صلى الله عليه وسلم، فقال: يا رسول الله، هل لك في حصن حصين ومنعة؟ – قال: حصن كان لدوس في الجاهلية – فأبى ذلك النبي صلى الله عليه وسلم للذي ذخر الله للأنصار، فلما هاجر النبي صلى الله عليه وسلم إلى المدينة، هاجر إليه الطفيل بن عمرو وهاجر معه رجل من قومه، فاجتووا المدينة، فمرض، فجزع، فأخذ مشاقص له، فقطع بها براجمه، فشخبت يداه حتى مات، فرآه الطفيل بن عمرو في منامه، فرآه وهيئته حسنة، ورآه مغطيا يديه، فقال له: ما صنع بك ربك؟ فقال: غفر لي بهجرتي إلى نبيه صلى الله عليه وسلم، فقال: ما لي أراك مغطيا يديك؟ قال: قيل لي: لن نصلح منك ما أفسدت، فقصها الطفيل على رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «اللهم وليديه فاغفر» -صحيح مسلم (1/ 108)، رقم الحديث: 326
“জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তুফাইল ইবনে আমর দাউসী রাদি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি একটি মজবুত দূর্গ এবং হেফাজতকারী একদল লোকের মাঝে অবস্থান করতে চান? –বর্ণনাকারী বলেন, জাহিলিয়্যাতের সময় দাউস গোত্রের একটি দূর্গ ছিল। [তুফাইল রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।] [রাসূলের আশ্রয়দাতা হওয়ার সৌভাগ্য] আল্লাহ তায়ালা আনসারদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুফাইল রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করলেন তখন তুফাইল রাদিয়াল্লাহু এবং তাঁর গোত্রের আরও এক ব্যক্তিও মদীনায় হিজরত করেন। কিন্তু মদীনার আবহাওয়া তাদের জন্য অনুকূল হলো না। ফলে সে লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং অসহ্য হয়ে নিজ তীর দিয়ে হাতের আঙুলের গ্রন্থিগুলো কেটে ফেলল। তখন উভয় হাতে অনবরত রক্ত ঝরতে ঝরতে লোকটি মারা গেল। তুফাইল রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে স্বপ্নে দেখলেন। তিনি দেখলেন, তার অবস্থা ভালো, তবে সে নিজের হাত দুটি আবৃত করে রেখেছে। তুফাইল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তোমার রব তোমার সাথে কেমন আচরণ করেছেন? লোকটি বলল, আল্লাহ তায়ালা হিজরত করে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসার কারণে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তুফাইল রাদি. বললেন, তুমি তোমার হাত দুটি আবৃত করে রেখেছ কেন? সে বলল, আমাকে বলা হয়েছে, ‘তুমি যা নষ্ট করেছ আমি সেটা কিছুতেই ঠিক করে দেব না’। তুফাইল রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি সে লোকটির জন্য দোয়া করে বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তার উভয় হাতকেও ক্ষমা করে দিন।” -সহীহ মুসলিম ১১৬
এ সাহাবি অসহ্য হয়ে হাতের গ্রন্থি কেটে ফেলেছিলেন, যা তার মৃত্যুর কারণ হয়। এতদসত্ত্বেও হিজরত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোয়ার বদৌলতে তিনি মাফ পেয়ে গেছেন। তাহলে কোনো বোন যদি নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে আত্মহত্যা করে থাকেন, আমরা আশা করতেই পারি যে, তাঁর অন্যান্য নেক আমল, আল্লাহর রাস্তায় স্বীকার করা কষ্ট এবং মুসলিমদের নেক দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা তাঁকে মাফ করেও দিতে পারেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। আমরা দোয়া করি, আল্লাহ যেন ওই বোনকে ক্ষমা করে দেন। আমীন।
আত্মহত্যার ব্যাপারে আপনি সাইটে প্রকাশিত নিম্নোক্ত ফতোয়া দু’টি দেখতে পারেন:
ফাতওয়া-১৫: ইসলামে আত্মহত্যা করার কোনো উপায় আছে কি?
ফাতওয়া-১২৬: নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে আত্মহত্যা করা কি বৈধ হবে?
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদী
১৪-০৪-১৪৪২ হি.
৩০-১১-২০২০ ইং