হালাল-হারাম:ফাতওয়া  নং  ১২৬

নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে আত্মহত্যা করা কি বৈধ হবে?

নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে আত্মহত্যা করা কি বৈধ হবে?

নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে আত্মহত্যা করা কি বৈধ হবে?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

প্রশ্ন:

কাফেরদের নির্যাতনের আশংকায় নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে বা তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কোনো মুসলিম বোনের জন্য আত্মহত্যা করা কি বৈধ হবে?

নিবেদক

আব্দুল্লাহ, নোয়াখালী

بسم الله الرحمن الرحيم

حامدا ومصليا ومسلما

উত্তর:

আত্মহত্যা কবীরা গুনাহ। নির্যাতনের ভয়ে বা নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্যও আত্মহত্যা করা জায়েয নয়।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا

“তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।” সূরা নিসা (০৪) : ২৯

এ আয়াতের নিষেধাজ্ঞায় অন্য মুসলিমকে হত্যা করা এবং নিজেকে হত্যা করা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। তদ্রূপ রাগ, মান-অভিমান, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, শাস্তি বা মানহানি ইত্যাদির ভয়ে আত্মহত্যা করাও অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এসবের কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যা জায়েয হবে না।

উক্ত আয়াতের তাফসীরে শায়খ সা’দী রহ. বলেন,

{ولا تقتلوا أنفسكم} أي: لا يقتل بعضكم بعضا، ولا يقتل الإنسان نفسه. اهـ -تفسير السعدي: 175

“তোমাদের পরস্পর যেন একে অপরকে হত্যা না করে এবং কোনো ব্যক্তি যেন নিজেকে নিজে হত্যা না করে।” (তাফসীরে সা’দী: ১৭৫)

ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন,

وأجمع أهل التأويل علي أن المراد بهذه الاية النهي أن يقتل بعض الناس بعضا. ثم لفظها يتناول أن يقتل الرجل نفسه… ويحتمل أن يقال: {ولا تقتلوا أنفسكم} في حال ضجر أو غضب فهذا كله يتناوله النهي. اهـ

“মুফাসসিরীনে কেরাম একমত যে, এ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য, মানুষের একে অপরকে হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। আয়াতের শব্দ আত্মহত্যার নিষেধাজ্ঞাকেও শামিল করে।… এও শামিল করে যে, অসন্তোষ বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তোমরা আত্মহত্যা করো না। এ সবই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।” (তাফসীরে কুরতুবী; খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ১৩৫)

শায়খ আবু উসামা আশশামী বলেন,

لا يجوز للمرأة المسلمة أن تقتل نفسها حتى لو تعرضت لتدنيس عرضها على يد أعداء الدين مهما بلغت مرارة الألم الذي تشعر به وهي لا شك عظيمة ولكنها لا تبيح لها قتل نفسها لأن الله سبحانه قال ” ولا تقتلوا أنفسكم إن الله كان بكم رحيما ” فهذا النص القطعي الثبوت القطعي الدلالة بحاجة إلى مخصص له لإباحة قتل النفس في مثل هذه الحالة أو غيرها؛ وذلك لا يكون إلا بمصلحة قطعية كلية ضرورية كما في العمليات الاستشهادية بضوابطها الشرعية المعروفة، وقتل المرأة نفسها لأجل أنها تعرضت لما تعرضت له ليس فيه أي مصلحة حتى يقال بجوازه. ومعلوم أن أمثال هذه المرأة مكره والمكره معذور مرفوع عنه الحرج والمؤاخذة، فما الداعي إذن لأن تقتل هذه المرأة نفسها. اهـ -أسئلة منتدى المنبر، رقم: 588

“কষ্ট যতই হোক না কেন, দ্বীনের দুশমনদের হাতে কোন মুসলিম নারী সম্ভ্রমহানির শিকার হলে তার জন্য আত্মহত্যা জায়েয নয়। যদিও তা অনেক বড় বেদনাদায়ক যন্ত্রণা, তথাপি তা আত্মহত্যার বৈধতা দেবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্  তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু’। এ নস কাত্বঈয়্যুস সুবূত (অকাট্যভাবে প্রমাণিত) ও কাত্বঈয়্যুদ দালালাহ (অকাট্য অর্থবহ)। এ ধরনের বা অন্য কোনো পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার বৈধতা দিতে হলে এ নসের কোনো মুখাসসিস (مخصص) তথা বিশেষ পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার বৈধতার স্বপক্ষে বিশেষ দলীল আবশ্যক। আর তা একান্ত অপারগ অবস্থায় ব্যাপক ও অবশ্যম্ভাবী মাসলাহাত ছাড়া হবে না। যেমনটা শরয়ী নিয়মনীতির অধীনে (যেগুলো সকলেরই জানা) সম্পন্ন ইস্তিশহাদি হামলার ক্ষেত্রে হয়। মসিবতের শিকার হয়ে কোনো নারী নিজেকে হত্যা করে দেয়ার মাঝে এমন কোনো মাসলাহাত নেই, যার ভিত্তিতে তা জায়েয বলা যেতে পারে। সকলের জানা যে, এ ধরনের নারী ‘মুকরাহ’ তথা বাধ্য। এমন ব্যক্তি (শরীয়তের দৃষ্টিতে) মা’জূর। তার কোনো গুনাহ নেই। একারণে তাকে পাকড়াও করা হবে না। সুতরাং তার আত্মহত্যার বৈধতার কোনো কারণ নেই!” (আসইলাতু মুনতাদাল মিম্বার, প্রশ্ন নং ৫৮৮)

এক হাদীসে এসেছে,

       عن أنس بن مالك عن النبي صلى الله عليه وسلم قال أكبر الكبائر الإشراك بالله وقتل النفس وعقوق الوالدين وقول الزور أو قال وشهادة الزور (صحيح البخاري 6871)

“হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, মানুষ হত্যা করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।” (সহীহ বুখারী: ৬৮৭১)

উল্লেখ্য, আত্মহত্যাও মানুষ হত্যার শামিল।

অন্য হাদীসে এসেছে,

            عن أبي هريرة رضي الله عنه: عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( من تردى من جبل فقتل نفسه فهو في نار جهنم يتردى فيه خالدا مخلدا فيها أبدا ومن تحسى سما فقتل نفسه فسمه في يده يتحساه في نار جهنم خالدا مخلدا فيها أبدا ومن قتل نفسه بحديدة فحديدته في يده يجأ بها في بطنه في نار جهنم خالدا مخلدا فيها أبدا ) (صحيح البخاري 5442، صحيح مسلم 313)

“হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে সর্বদা পাহাড় থেকে পড়তে থাকবে। এভাবেই সে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কাল শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যে বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে দেওয়া হবে। সে জাহান্নামের আগুনে সর্বদা তা পান করতে থাকবে। এভাবেই সে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কাল শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যে ধারালো কোন অস্ত্রের আঘাতে আত্মহত্যা করবে, তার হাতে সেই অস্ত্র ধরিয়ে দেয়া হবে। সে তা দ্বারা জাহান্নামের আগুনে সর্বদা নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে। এভাবেই সে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কাল শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।” সহীহ বুখারী: ৫৪৪২, সহীহ মুসলিম: ৩১৩)

খায়বার যুদ্ধে এক ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে জাহান্নামী’। পরে দেখা গেল সে কাফেরদের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের পেটে নিজে ছুরি ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করে। সহীহ বুখারী: ৬৬০৬, সহীহ মুসলিম: ৩১৯

সুতরাং আল্লাহ না করুন, কোনো মুসলিম নারী যদি নির্যাতন বা ইজ্জত-আব্রুর ওপর হামলার শিকার হন, তাহলে তিনি আক্রমণকারীকে তার সম্ভ্রমহানির সুযোগ দেবেন না; বরং যথাসাধ্য মোকাবালা করে যাবেন। প্রয়োজনে অস্ত্র প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করবেন। কোনো অবস্থায়ই নিজে আত্মহত্যা করবেন না। যদি তিনি আক্রমণকারীকে হত্যা করতে সক্ষম হন, তবে তিনি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাবেন। আক্রমণকারী থেকে নিজের ইজ্জত আব্রু রক্ষা করা ফরজ। যদি আক্রমণকারী তাকে হত্যা করে ফেলে, তাহলে তিনি ইনশাআল্লাহ শহীদদের কাতারে শামিল হবেন। আর যদি সর্বাত্মক চেষ্টার পরও তিনি নিজের ইজ্জত রক্ষায় অক্ষম হন, তবে আল্লাহ তাআলার ফয়সালা মনে করে সবর করবেন। এজন্য তার কোনো গুনাহ হবে না; বরং আল্লাহ তাআলার কাছে অবশ্যই তিনি এই কষ্টের মহা প্রতিদান পাবেন।

মুফতি রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবি রহ. বলেন,

بچّوں اور عورتوں كو خود قتل كرنا جائز نهيں ،عورتوں پر خودكشي بھي حرام هے ،منجانب الله پيش  آنے والے  هرقسم كے حالات  پر صبر كرنا  اور  دين  پر  قائم  رهنا  ان  كے ليۓ  بهت بڑا  جهاد هے –

“(সম্ভ্রমহানির ভয়ে) মুজাহিদদের জন্য যেমন তাদের স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করা হারাম, তেমনি এ অবস্থায় নারীদের নিজেদের জন্যও আত্মহত্যা করা হারাম। আল্লাহর পক্ষ হতে আসা সকল পরিস্থিতির ওপর ধৈর্য ধারণ করা এবং দ্বীনের ওপর অটল থাকা তাদের জন্য অনেক বড় জিহাদ।” (আহসানুল ফাতওয়া; খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ২২)

শায়খ আবুল মুনযির আশশানকিতি রহ. বলেন,

الخوف على العرض لا يبيح قتل النفس بل الواجب على الأخت المجاهدة حفظها الله من كل سوء أن تدفع عن عرضها بكل ما يسر الله من وسائل مشروعة فإن وقع شيء مما تخافه فينبغي الصبر والاحتساب والرضى بما كتب الله من البلاء. ففي الصبر على ذالك الأجر والمثوبة إن شاء الله والدنيا زائلة والأجر باق بإذن الله. اهـ

“সম্ভ্রমহানির ভয় আত্মহত্যার বৈধতা দেয় না। বরং একজন মুজাহিদ বোনের কর্তব্য হল -আল্লাহ তাকে সব রকমের মন্দ থেকে হেফাজত করুন- সামর্থ্যানুযায়ী শরীয়তসম্মত সকল পন্থায় নিজের সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা করা। তবে যে ভয় সে করছিল, তার কোন কিছু যদি ঘটেই যায়, তাহলে তার করণীয় হবে- সওয়াবের আশায় ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহ তাআলা তাকদিরে যে মসিবত লিখে রেখেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। ইনশাআল্লাহ এই সবরের বিনিময়ে সওয়াব ও প্রতিদান মিলবে। বিইযনিল্লাহ দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু সওয়াব রয়ে যাবে।” (আস-ইলাতু মুনতাদাল মিম্বার, প্রশ্ন নং ৩৮৬৯)

فقط، والله تعالى أعلم بالصواب

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদী

১৪-০৪-১৪৪২ হি.

৩০-১১-২০২০ ইং

আরো পড়ূন
নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে আত্মহত্যাকারিনী কী গুনাহগার হবেন?

ইসলামে আত্মহত্যা করার কোনো উপায় আছে?

আত্মহত্যাকারীর কাফন-দাফনের হুকুম কী?

Related Articles

Back to top button