আমি কীভাবে দুনিয়া ও দ্বীনের মাঝে সমন্বয় করে চলতে পারি?
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
প্রশ্নঃ
আমি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। পাশাপাশি যথাযম্ভব দ্বীন মানার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময়ই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমার জানার বিষয় হল, আমি কীভাবে দুনিয়া ও দ্বীনের মাঝে সমন্বয় করে চলতে পারি? এ ব্যাপারে কিছু পরামর্শ কামনা করছি।
প্রশ্নকারী- আব্দুর রহমান
উত্তরঃ
প্রিয় ভাই! দ্বীন দুনিয়ার সমন্বয় করে চলার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষ করুন;
ক. আল্লাহ ও বান্দার হকের ক্ষেত্রে ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদাগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে শরীয়াহ সম্মত পদ্ধতিতে আদায় করুন। কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি না করে, সামর্থ্য অনুযায়ী সুন্নতে যায়েদাহ ও মুস্তাহাবগুলো আদায়ে সচেষ্ট থাকুন।
খ. উপার্জন ও দুনিয়াবি অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শরিয়তের সীমারেখায় থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে আঞ্জাম দিন। একজন মুমিন দুনিয়াবি কাজগুলো যখন শরিয়তের সীমায় থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে করে, সেগুলোও আল্লাহ তার নেক আমল হিসেবে গণ্য করেন এবং বান্দাকে তার বিনিময় দান করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
…وفى بضع أحدكم صدقة. قالوا يا رسول الله أيأتى أحدنا شهوته ويكون له فيها أجر قال « أرأيتم لو وضعها فى حرام أكان عليه فيها وزر فكذلك إذا وضعها فى الحلال كان له أجر.- صحيح مسلم للنيسابوري: 3/ 82
“…এবং তোমাদের স্ত্রী-সঙ্গমেও সাদাকার সওয়াব রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, একজন তার মনের চাহিদা পূরণ করবে, তাতেও তাকে সওয়াব দেয়া হবে?! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেন দেয়া হবে না? সে যদি তা হারাম ক্ষেত্রে ব্যবহার করত, তাতে কি তার গুনাহ হত না? সুতরাং সে যখন তা হালাল ক্ষেত্রে ব্যবহার করবে, তাতেও তার সওয়াব হবে।” -সহীহ মুসলিম: ৩/৮২
অন্য এক হাদীসে এসেছে,
“ولست تنفق نفقة تبتغي بها وجه الله، إلا أجرت بها، حتى اللقمة تجعلها في في امرأتك. –صحيح البخاري: 1295 صحيح مسلم: 1628
“আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তুমি যা-ই খরচ করবে, তারই তুমি প্রতিদান পাবে। এমনকি নিজ স্ত্রীর মুখে খাবারের যে লোকমা তুলে দাও, সেটারও। -সহীহ বুখারী: ১২৯৫, সহীহ মুসলিম: ১৬২৮
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে এসেছে, মুয়ায ও আবু মূসা আশআরী রাযি. তাহাজ্জুদের ব্যাপারে আলোচনা করেন, তখন মুয়াজ রাযি. বলেন,
أنام أول الليل، فأقوم وقد قضيت جزئي من النوم، فأقرأ ما كتب الله لي، فأحتسب نومتي كما أحتسب قومتي. -صحيح البخاري: 4341 صحيح مسلم: 1733
“আমি রাতের প্রথম ভাগে ঘুমিয়ে পড়ি এবং কিছু সময় ঘুমিয়ে উঠে পড়ি। এরপর আল্লাহ্ আমাকে যতটুকু তাওফীক দান করেন তিলাওয়াত করি। এতে আমি আমার নিদ্রার অংশকেও সাওয়াবের বিষয় মনে করি, যেভাবে আমি আমার তিলাওয়াতকে সাওয়াবের বিষয় মনে করি।” -সহীহ বুখারী: ৪৩৪১; সহীহ মুসলিম: ১৭৩৩
ইমাম নাবাবী রহ. বলেন,
إن المباح إذا قصد به وجه الله تعالى صار طاعة ويثاب عليه وقد نبه صلى الله عليه وسلم على هذا بقوله صلى الله عليه وسلم حتى اللقمة تجعلها في في امرأتك ….. وهذا معنى قوله صلى الله عليه وسلم وفي بضع أحدكم صدقة والله أعلم -شرح النووي على مسلم: 11/77
“শরিয়ত অনুমোদিত (মুবাহ বা সাধারণ) বিষয় যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করা হয়, তখন তা আল্লাহর আনুগত্যে পরিণত হয় এবং তার ওপর বান্দাকে বিনিময় প্রদান করা হয়। স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেয়ার হাদীসটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন….। এবং এ অর্থেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের স্ত্রী-সঙ্গমেও তোমাদের জন্য সাদাকার সওয়াব রয়েছে।” শরহে মুসলিম নাবাবী রহ.: ১১/৭৭
গ. কখনও দ্বীনি ও দুনিয়াবি বিষয়ে সংঘর্ষ দেখা দিলে, দ্বীনকে প্রাধান্য দিন; চাই তা আপনার কাছে যত কঠিনই মনে হোক না কেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَأَمَّا مَنْ طَغَى (37) وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (38) فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى (39) وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى (40) فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى (41) [النازعات: 37 – 41]
“আর যে সীমা লঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয়, জানান্নামই হবে তার ঠিকানা। পক্ষান্তরে যে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার ঠিকানা।” সূরা নাযিয়াত: ৩৭-৪১
অন্যত্র বলেন,
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى -الأعلى: 16، 17
“কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ আখেরাত হচ্ছে উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।” -সূরা আ’লা: ১৬-১৭
অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ [التوبة: 24]
“আপনি বলুন, তোমাদের কাছে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের খান্দান, তোমাদের সেই সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, তোমাদের সেই ব্যবসা, যাতে মন্দা পড়ার আশঙ্কা কর এবং বসবাসের সেই ঘর, যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর, যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ ফায়সালা প্রকাশ করেন। আর আল্লাহ অবাধ্যদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছান না।” -সূরা তাওবা: ২৪
উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম রাযী রহ. বলেন,
وهذه الآية تدل على أنه إذا وقع التعارض بين مصلحة واحدة من مصالح الدين وبين جميع مهمات الدنيا، وجب على المسلم ترجيح الدين على الدنيا. -تفسير الرازي: 16/17
“এ আয়াত প্রমাণ করে, যদি কখনো দুনিয়াবি সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বীনের একটিমাত্র কল্যাণের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়, তবে মুসলিমের জন্য দুনিয়ার ওপর দ্বীনকে প্রাধান্য দেয়াই আবশ্যক হবে।” -তাফসীরে রাযী: ১৬/১৭
কখনো দুনিয়ার সুবিধার মোকাবেলায় দ্বীনকে পাধান্য দেয়া বাহ্যত অনেক কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা করে যখন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এটি করবেন, তখন আল্লাহ আপনার জন্য সহজ পথ বের করে দিবেন ইনশাআল্লাহ। কোরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে,
{وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا (3)} [الطلاق: 2، 3]
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পথ খুলে দেন এবং তাকে এমনভাবে রিযিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করে না। যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হন। আল্লাহ তাঁর বিষয় পূর্ণ করেই ছাড়েন। সবকিছুর জন্যই তিনি একটি সীমা নির্ধারিত করেছেন।” -সূরা তালাক: ২-৩
ইমাম বায়হাকি রহ. বর্ণনা করেন,
832- أَخْبَرَنَا أَبُو طَاهِرٍ الْفَقِيهُ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حَمْشَاذٍ، حَدَّثَنَا الْحَارِثُ بْنُ أَبِي أُسَامَةَ، حَدَّثَنَا أَبُو النَّضْرِ، حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ الْمُغِيرَةِ، عَنْ حُمَيْدٍ، حَدَّثَنَا أَبُو قَتَادَةَ، وَأَبُو الدَّهْمَاءِ، قَالا : أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ ، فَقَالَ الْبَدَوِيُّ : أَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِيَدِي، فَجَعَلَ يُعَلِّمُنِي مِمَّا عَلَّمَهُ اللَّهُ، وَكَانَ يَقُولُ : إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءً لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ أَعْطَاكَ اللَّهُ خَيْرًا مِنْهُ. الآداب للبيهقي: 2/ 8، بترقيم الشاملة آليا
“… আবু কাতাদা ও আবুদ দাহমা রাহিমাহুমাল্লাহ বলেন, আমরা এক বেদুঈন (সাহাবি)র নিকট গেলাম। তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরলেন এবং আল্লাহ তাঁকে যা শিখিয়েছেন, তা থেকে আমাকে শেখাতে লাগলেন। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ভয়ে যে কোনো বিষয় পরিহার করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন।” -আলআদাব, বায়হাকি: ২/৮
ঘ. তাছাড়া দ্বীনের ওপর চলার জন্য নিয়মিত কুরআন-সুন্নাহ অধ্যয়ন করুন, হক্কানী আলেমদের সাহচর্য ও নেককার লোকদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করুন। আল্লাহ দ্বীনের ওপর চলা সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।
ঙ. সর্বোপরি দ্বীন ও ঈমানের ওপর থাকার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকুন এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করুন। কারণ আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ না হলে কারো পক্ষেই দ্বীনের ওপর চলা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে তাওফিক দান করুন।
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب.
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
২৩-০৪-১৪৪৩ হি.
২৯-১১-২০২১ ঈ.
আরও পড়ুনঃ কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর ব্যাপারে করণীয় কী?