বিবিধফাতওয়া  নং  ৩০১

শরয়ী সফরের দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার? না, ৮৭ কিলোমিটার?

শরয়ী সফরের দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার? না, ৮৭ কিলোমিটার?

শরয়ী সফরের দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার? না, ৮৭ কিলোমিটার?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

প্রশ্নঃ

সফরে কসরের জন্য শরয়ী ৪৮ মাইল পরিমাণ দূরে সফরের নিয়ত করা জরুরী৷ এখন শরয়ী ৪৮ মাইল সমান কত কিলোমিটার? এই প্রশ্নে অধিকাংশের মত ৭৮ কিলোমিটার৷ অর্থাৎ শরয়ী সফরের দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার৷ কিন্তু আমার মনে হয় এখানে ভুল হিসাব করা হচ্ছে। এখানে দেশীয় মাইল আর শরয়ী মাইলের মধ্যে পার্থক্য করা হচ্ছে না৷ অর্থাৎ দেশীয় ১ মাইল = ১.৬০৯৩৪৪ কিলোমিটার।

সুতরাং দেশীয় ৪৮ মাইল সমান (১.৬০৯৩৪৪×৪৮) = ৭৭.২৪৮৫১২ কিলোমিটার। আর এটাকেই ৭৮ কিলোমিটার হিসেবে বলা হচ্ছে এবং এটাই আমাদের দেশে দূরত্ব হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে শরয়ী ১ মাইল = ১.৮২৮৮ কিলোমিটার। সুতরাং শরয়ী ৪৮ মাইল (১.৮২৮৮×৪৮) = ৮৭.৭৮২৪ কিলোমিটার। কিন্তু ৪৮ এর সাথে গুণ দেয়ার ক্ষেত্রে অর্থাৎ শরয়ী ৪৮ মাইলকে কিলোমিটার এ কনভার্ট করার সময়,

দেশীয় মাইলের পরিমাপ দ্বারা কনভার্ট করা হয়৷ ফলে প্রচলিত ৭৮ কিলোমিটার বের হয়ে এসেছে৷ ‘কাশফুল মাক্বাদীর’ কিতাবের একক পরিমাপের সূত্র থেকে যে হিসাব বের হয় তা-ই এখানে পেশ করলাম৷ এখন জানার বিষয় হলো, ব্যাপকভাবে প্রচলিত ৭৮ কিলোমিটার ঠিক, নাকি ৮৮ কিলোমিটার ঠিক? এ ব্যাপারে বিস্তারিত হিসেবসহ আপনাদের তাহকীক জানতে চাচ্ছি।

প্রশ্নকারী- আহমদ মাইমুন

উত্তরঃ

হানাফী মাযহাবের ‘মুফতা বিহি কওল’[1] অনুযায়ী সফরের দূরত্বের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হলো, তিন দিনের সফরের দূরত্ব। মানবিক ও শরয়ী সকল প্রয়োজন পূরণ করে তিন দিনে স্বাভাবিক গতিতে পায়ে হেঁটে সফর করে যতটুকু যাওয়া যায়, সেটাই সফরের দূরত্ব। এছাড়া এর নির্দিষ্ট ভিন্ন কোনো পরিমাপ নেই। স্বভাবতই পথের ব্যবধানের কারণে এই দূরত্বের পরিমাণেও ব্যবধান হবে এবং পাহাড়ি পথ ও সমতল পথে সফরের দূরত্ব দুই রকম হবে। আপনি যেমনটি ধারণা করেছেন, সফরের দূরত্ব শরয়ী ৪৮ মাইল, বস্তুত বিষয়টি এমন নয়।

তবে সমগ্র ভারত উপমহাদেশের পথ যেহেতু প্রায় একই রকম, এখানে তেমন দুর্গম পথ নেই, তাই উপমহাদেশের আলেমগণ এ অঞ্চলে তিন দিন সফর করে কতটুকু যাওয়া যায়, তা যাচাই করে সহজে বুঝার সুবিধার্থে সুনির্দিষ্ট করে দেশীয় ৪৮ মাইলের ফতোয়া দিয়ে থাকেন। কারণ বর্তমান যুগের মানুষ স্বাভাবিকভাবে তিন দিনে দেশীয় ৪৮ মাইলের মতোই অতিক্রম করতে পারে।

হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ) (১৩৬২ হি.) বলেন,

تين منزل يه هے كه اكثر پيدل چلنے والے وهاں تين  روز ميں پهنچا كرتے هيں- تخمينه اس كا همارے ملك ميں كه دريا اور پهاڑ ميں سفر نهيں كرنا پڑتا 48 انگريزي میل هے.-بهشتي زيور، ص: 106

“তিন মনযিল হলো ততোটুকু দূরত্ব, যা অধিকাংশ পদব্রজে চলা ব্যক্তিরা তিনদিনে অতিক্রম করতে পারে। আমাদের দেশে যেহেতু সমুদ্র ও পাহাড়িপথে সফর করতে হয় না, তাই সেই দূরত্বের পরিমাণ ইংরেজি (দেশীয়) ৪৮ মাইল হয়।” -বেহেশতী যেওর, পৃ: ১০৬

শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ) (১৩৭৭ হি.) বলেন,

کتبِ فقہ میں حکم میلوں پر نہیں ہے؛ بلکہ تین دن رات کی مسافت اوسط ایام سال میں متوسط انسانی رفتار یا اونٹ کی رفتار سے جملہ حوائج انسانیہ اکل وشرب پیشاب پاخانہ وغیرہ اور حوائج شرعیہ نماز وغیرہ انجام دیتے ہوئے اکثر حصہ یوم ولیلہ جو قطع ہوسکے وہ مسافت سفر ہے، اس قاعدہ سے بمشکل ۱۶؍میل چل سکتا ہے؛ بلکہ ۱۵؍میل چلنا بھی دشوار ہوگا؛ اس لئے بعض حضرات ۱۲؍میل روزانہ اور بعض حضرات ۱۵؍میل قرار دیتے ہیں۔ ہمارے اکابر نے ۱۶؍میل روزانہ احتیاط کے طور پر قرار دیا ہے، اس سے زائد قرار دینا غیر معقول ہے‘‘۔ (فتاویٰ شیخ الاسلام ۴۹)

“ফিকহের কিতাবাদিতে মাইলের উপর হুকুমের ভিত্তি রাখা হয়নি। বরং সফরের দূরত্ব হলো ততটুকু, যতটুকু সকল মানবিক প্রয়োজন, যথা পানাহার, পেশাব-পায়খানা ইত্যাদি এবং শরয়ী প্রয়োজন অর্থাৎ নামায ইত্যাদি পূরণ করার পর বছরের মধ্যম দিনের অধিকাংশ সময় মধ্যম গতিতে পায়ে হেঁটে বা উটে করে তিনদিন তিনরাতে অতিক্রম করা যায়। এই মূলনীতি অনুযায়ী দিনে ১৬ মাইল পথ চলাই কষ্টকর। বরং ১৫ মাইল চলাও দুষ্কর। এজন্য কোনো কোনো আলেম প্রত্যেকদিন ১২ মাইল, আর কেউ কেউ প্রত্যেকদিন ১৫ মাইল চলা সম্ভবপর মনে করেন। আমাদের আকাবির সতর্কতাবশত প্রত্যেকদিন ১৬ মাইল চলা সম্ভবপর ধরে নিয়েছেন। এরচেয়ে বেশি ধরা অযৌক্তিক।” -ফাতাওয়া শাইখুল ইসলাম, পৃ: ৪৯

মুফতী শফী (রহ) (১৩৯৬ হি.) বলেন,

اور شيخ محقق ابن همام نے شرح هدايه ميں ميلوں كي تعيين معتبر نه هونے كي وجه يه بيان فرمائي هے كه تين دن تين رات كي مسافت جو أصل مذهب هے، وه راستوں كے اختلاف سے مختلف هو سكتي هے، كيونكه صاف راسته ميں اگر انسان ايك دن ميں سوله ميل چل سكتا هے، تو دشوار گزار راسته ميں باره ميل بمشكل طے هوتے هيں، اور پهاڑي راستوں ميں تو  آٹھ دس ميل بھي طے كرنا مشكل هوتا هے، اس لے ميلوں كي تعيين مناسب نهيں، بلكه جيسا راسته هو اس كے انداز سے جس قدر ميل بآساني تين دن ميں پياده طے هو سكيں، وهي مسافت قصر هے- (فتح القدير، ص: 394، جلد: 1)

ليكن هندوستان كے عام بلاد ميں چونكه راستے تقريبا مساوي هيں، پهاڑي يا دشوارگزار نهيں هيں، اس لے علماء هندوستان نے ميلوں كے ساتھ تعيين كر دي هيں.

پھر جن حضرات فقهاء نے ميلوں يا فراسخ كے ساتھ مسافت قصر كي تعيين فرمائي ہے، ان ميں مختلف أقوال ہيں، جو اوپر مذكور ہوۓ، اس لے محققين علماء هندوستان نے 48 میل انگريزي كو مسافت قصر قرار دے ديا ، جو  اقوال فقهاء مذكورين كے قريب قريب ہے، اور اصل مدار اس كا اسي پر ہےكه اتني هي مسافت تين دن تين رات ميں پياده مسافر بآساني طےكر سكتا  ہے. -جواهر الفقه: 3/426-427

“মুহাক্কিক ইবনে হুমাম (রহ) হেদায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থে মাইলের হিসাবে সফরের দূরত্ব নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণ এই বলেছেন যে, তিনদিন তিনরাতের দূরত্ব অতিক্রম করা, যেটা মূল মাযহাব, তা পথের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কেননা সহজ পথে যদি মানুষ একদিনে ষোল মাইল চলতে পারে, একই সময়ে দুর্গম পথে বারো মাইল চলাও কষ্টকর। আর পাহাড়ি পথে তো আট-দশ মাইল চলাও কঠিন। এজন্য মাইল নির্ধারণ ঠিক নয়। বরং যে ধরনের পথে সফর করবে, সেই পথের হিসেবে তিনদিনে সহজে যতটুকু পথ পদব্রজে অতিক্রম করা যায়, সেটাই সফরের দূরত্ব হিসেবে বিবেচিত হবে।

কিন্তু যেহেতু হিন্দুস্তানের অধিকাংশ অঞ্চলের পথ অনেকটা একই রকম, পাহাড়ি বা দুর্গম নয়, তাই হিন্দুস্তানি আলেমগণ (বুঝার সহজার্থে) মাইলের হিসেবে সফরের দূরত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

আর যারা মাইল বা ফারসাখ দ্বারা সফরের দূরত্ব নির্ধারণ করেছেন, তাদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য হিন্দুস্তানের বিজ্ঞ আলেমগণ ইংরেজি (দেশীয়) ৪৮ মাইলকে সফরের দূরত্ব হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা পূর্বোল্লিখিত ফুকাহাদের মতের কাছাকাছি এবং তার ভিত্তিও এরই উপর যে, তিন দিন তিন রাতে পায়ে হেঁটে সহজে ইংরেজি (দেশীয়) ৪৮ মাইলই অতিক্রম করা যায়। -জাওয়াহিরুল ফিকহ: ৩/৪২৬-৪২৭

উল্লেখ্য, হানাফী মাযহাবে উপর্যুক্ত ‘মুফতা বিহি কওল’ ব্যতীত আরও কিছু মতেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন:

ক. ২১ ফারসাখ অর্থাৎ শরয়ী ৬৩ মাইল

খ. ১৮ ফারসাখ অর্থাৎ শরয়ী ৫৪ মাইল

গ. ১৫ ফারসাখ অর্থাৎ শরয়ী ৪৫ মাইল

কিন্তু এই মতগুলোর ভিত্তিও পূর্বোক্ত মতের উপরই। এর প্রবক্তাগণ নিজ নিজ অঞ্চলে তিন দিনে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করা যায় বলে মনে করতেন, সেই হিসেবে দূরত্ব নির্ধারণ করেছেন। ইমাম ইবনুল হুমাম (রহ) বলেন,

قيل يقدر بها فقيل بأحد وعشرين فرسخا، وقيل بثمانية عشر، وقيل بخمسة عشر، وكل من قدر بقدر ما اعتقد أنه مسيرة ثلاثة أيام، وإنما كان الصحيح أن لا تقدر بها؛ لأنه لو كان الطريق وعرا بحيث يقطع في ثلاثة أيام أقل من خمسة عشر فرسخا قصر بالنص، وعلى التقدير بأحد هذه التقديرات لا يقصر فيعارض النص فلا يعتبر سوى سير الثلاثة. – فتح القدير للكمال ابن الهمام (2/ 30)

“কেউ কেউ বলেছেন, মাইলের হিসেবে সফরের দূরত্ব নির্ধারণ করা হবে। তাই কেউ একুশ ফারসাখ দ্বারা নির্ধারণ করেছেন, কেউ আঠারো, কেউ পনেরো। যে যেই পরিমাণ দিয়ে নির্ধারণ করেছেন, তিনি মনে করেছেন তিনদিনে ততটুকু দূরত্বই অতিক্রম করা যায়। সঠিক মত হচ্ছে, মাইল দ্বারা দূরত্ব নির্ধারণ না করা। কারণ পথ দুর্গম হওয়ায় যদি তিনদিনে পনেরো ফারসাখের কমও অতিক্রম করা যায়, তবুও নসের ভিত্তিতে মুসাফির বলে গণ্য হবে এবং কসর করবে। অথচ এই মাপকাঠিগুলোর উপর ভিত্তি রাখলে তখন কসর করা যায় না, যা নসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং তিনদিনের সফরের দূরত্ব ব্যতীত অন্য কিছুকে ভিত্তি বানানো যাবে না। -ফাতহুল কাদীর: ২/৩০

একই কথা বলেছেন আল্লামা ইবনে আবেদীন শামি (রহ)ও। দেখুন, রদ্দুল মুহতার: ২/১২৩

আর আপনি যে ৪৮ শরয়ী মাইলের কথা ধারণা করেছেন, তা হানাফী মাযহাবের মত নয়; বরং তা অন্য তিন মাযহাবের মত। তাদের মতে সফরের দূরত্ব ১৬ ফারসাখ অর্থাৎ ৪৮ শরয়ী মাইল। দেখুন, -মুয়াত্তা মালেক: ১/১৪৮[2], শরহুয যুরকানী আলাল মুয়াত্তা: ১/৫১৫[3]; আলমাজমু’, ইমাম নাবাবী: ৪/৩২৫[4]; মাসায়িলুল ইমাম আহমদ, বর্ণনা: ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমদ, পৃষ্ঠা: ১১৯; মাসয়ালা নং: ৩২৪[5]; আল-কাফী, ইবনে কুদামা: ১/৩০৬[6]

তাই শরয়ী ৪৮ মাইল আর দেশীয় ৪৮ মাইলের পার্থক্য না করে দেশীয় মাইলের হিসেবে ৭৮ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে আপনি যা উল্লেখ করেছেন, তা ঠিক নয়; বরং আমাদের জন্য দেশীয় ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটারই সফরের দূরত্ব।

والله سبحانه وتعالى أعلم

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

২৫-০৩-১৪৪৪ হি.

২২-১০-২০২২ ঈ.

 

[1] একাধিক মতের মধ্য থেকে যে মতটির উপর ফতোয়া প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়, তাকে ‘মুফতা বিহি কওল’ বলা হয়।

[2]  15 – وحدثني عن مالك أنه بلغه أن عبد الله بن عباس كان «يقصر الصلاة في مثل ما بين مكة والطائف، وفي مثل ما بين مكة وعسفان، وفي مثل ما بين مكة وجدة» قال مالك: «وذلك أربعة برد، وذلك أحب ما تقصر إلي فيه الصلاة». -موطأ مالك ت عبد الباقي: 1/ 148

[3]  يعني أنه لا يقصر في أقل منها وهي ستة عشر فرسخا ثمانية وأربعون ميلا، وإلى هذا ذهب الشافعي وأحمد. -شرح الزرقاني على الموطأ (1/ 515)

[4]  قد ذكرنا أن مذهبنا أنه يجوز القصر في مرحلتين، وهو ثمانية وأربعون ميلا هاشمية، ولا يجوز في أقل من ذلك، وبه قال ابن عمر وابن عباس والحسن البصري والزهري ومالك والليث بن سعد واحمد واسحق. -المجموع شرح المهذب (4/ 325)

[5]  لا يقصر الصلاة الا في اربعة برد وذلك ثمانية واربعون ميلا.- مسائل الإمام أحمد رواية ابنه عبد الله (ص: 119)

[6]  ويجوز قصر الرباعية فيصليها ركعتين بشروط ستة:

أحدها: أن تكون في سفر طويل قدره أربعة برد، وهي ستة عشر فرسخًا، ثمانية وأربعون ميلًا بالهاشمي….. -الكافي في فقه الإمام أحمد (1/ 306)

আরও পড়ুনঃ টাকা দিয়ে গাড়ির লাইসেন্স নেয়ার হুকুম কী?

Related Articles

Back to top button