জিহাদ-কিতাল:ফাতওয়া  নং  ১১৩

জিহাদ কখন ফরজে আইন হয়?

জিহাদ কখন ফরজে আইন হয়?

জিহাদ কখন ফরজে আইন হয়?

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

প্রশ্ন:

জিহাদ কখন ফরজে আইন হয়? বর্তমান বাংলাদেশে মুসলিমদের উপর কি জিহাদ ফরজে আইন? সবিস্তারে জানানোর জন্য অনুরোধ করছি।

আবুল কালাম, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর

প্রশ্ন:

কী কী কারণে জিহাদ ফরজে আইন হয়? দলিলসহ জানালে উপকৃত হতাম।

মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيم

উত্তর: জিহাদ বান্দার জন্য আল্লাহ তায়ালার দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ ইবাদত। তা কখনো ফরজে কেফায়া; কখনো ফরজে আইন।

ফরজে কেফায়া ও ফরজে আইনের অর্থ

ফরজে কেফায়া অর্থ এমন ফরজ, যার দায়িত্ব সমষ্টিগতভাবে সকল মুসলমানের। কিছু মুসলমান আদায় করলে, সকলের দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়। প্রত্যেককে সেই দায়িত্ব আদায় করতে হয় না। কিন্তু কেউই যদি আদায় না করে, তাহলে সবার উপর এর দায় থেকে যায় এবং সবাই গোনাহগার হয়। আর যদি কিছু লোক আদায় করে, কিন্তু কাজটি আদায় হওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ লোক আদায় না করে, তাহলেও বাকিদের উপর তার দায় থেকে যায় এবং তারা গোনাহগার হয়।

পক্ষান্তরে ফরজে আইন অর্থ এমন ফরজ, যা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর ফরজ হয়। যার যার উপর ফরজ হয়, তাদের সবাইকে তা আদায় করতে হয়। অন্যথায় তারা গোনাহগার হয়।

সাধারণ অবস্থায় জিহাদ ফরজে কেফায়া

সাধারণ অবস্থায় জিহাদ ফরজে কেফায়া। অর্থাৎ মুসলামনদের দ্বীন ঈমান, ইজ্জত আব্রু, ভূখণ্ড ও ধন সম্পদের প্রতিরক্ষার জন্য এবং কাফেরদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত রাখার জন্য যেই পরিমাণ লোকের প্রয়োজন, পুরো উম্মত থেকে সেই পরিমাণ লোক জিহাদি কার্যক্রমে যুক্ত থাকা ফরজে কেফায়া। এই পরিমাণ লোক উক্ত ফরজ আদায় করলে উম্মতের সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে এই পরিমাণ লোক যদি তা আদায় না করে এবং ফরজটি অনাদায়ী থেকে যায়, তাহলে যারা যারা তা আদায়ের চেষ্টা করবে না, তারা সবাই গোনাহগার হবে।

হেদায়া গ্রন্থকার আল্লামা মারগিনানি রহ. (৫৯৩ হি.) বলেন,

قَالَ (الْجِهَادُ فَرْضٌ عَلَى الْكِفَايَةِ، إذَا قَامَ بِهِ فَرِيقٌ مِنْ النَّاسِ سَقَطَ عَنْ الْبَاقِينَ) …

فَإِذَا حَصَلَ الْمَقْصُودُ بِالْبَعْضِ سَقَطَ عَنْ الْبَاقِينَ كَصَلَاةِ الْجِنَازَةِ وَرَدِّ السَّلَامِ (فَإِنْ لَمْ يَقُمْ بِهِ أَحَدٌ أَثِمَ جَمِيعُ النَّاسِ بِتَرْكِهِ) لِأَنَّ الْوُجُوبَ عَلَى الْكُلِّ، وَلِأَنَّ فِي اشْتِغَالِ الْكُلِّ بِهِ قَطْعَ مَادَّةِ الْجِهَادِ مِنْ الْكُرَاعِ وَالسِّلَاحِ فَيَجِبُ عَلَى الْكِفَايَةِ (إلَّا أَنْ) (يَكُونُ النَّفِيرُ عَامًّا) فَحِينَئِذٍ يَصِيرُ مِنْ فُرُوضِ الْأَعْيَانِ….

وَقَالَ فِي الْجَامِعِ الصَّغِيرِ: الْجِهَادُ وَاجِبٌ إلَّا أَنَّ الْمُسْلِمِينَ فِي سَعَةٍ حَتَّى يُحْتَاجَ إلَيْهِمْ، فَأَوَّلُ هَذَا الْكَلَامِ إشَارَةٌ إلَى الْوُجُوبِ عَلَى الْكِفَايَةِ، وَآخِرُهُ إلَى النَّفِيرِ الْعَامِّ، وَهَذَا لِأَنَّ الْمَقْصُودَ عِنْدَ ذَلِكَ لَا يَتَحَصَّلُ إلَّا بِإِقَامَةِ الْكُلِّ فَيُفْتَرَضُ عَلَى الْكُلِّ. – الهداية مع فتح القدير: 5/436-441

“ইমাম কুদুরি রহ. বলেছেন, (জিহাদ ফরজে কেফায়া। যখন একদল লোক তা আদায় করবে, বাকিদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে)।….

অর্থাৎ কিছু সংখ্যক লোক দিয়ে যখন উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে, বাকিদের থেকে তার দায় সরে যাবে। যেমন জানাযার সালাত এবং সালামের উত্তর। (যদি কেউই তা আদায় না করে, সকল মানুষই তা ত্যাগ করার কারণে গোনাহগার হবে)। কারণ ফরজ সকলের উপরই। আর সবাই জিহাদে বেরিয়ে পড়লে যেহেতু ঘোড়া অস্ত্র ইত্যাদির মতো জিহাদের উপায় উপকরণ প্রস্তুতের পথও বন্ধ হয়ে যাবে, এজন্য ফরজে কেফায়া। (তবে যদি ‘নাফিরে আম’ হয়) তখন ফরজে আইনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।…

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. জামিউস সাগীরে বলেছেন, ‘জিহাদ ফরজ। তবে তা না করার সুযোগ থাকবে, যতক্ষণ না তাতে সকলের প্রয়োজন পড়ে’। তাঁর এই বক্তব্যের প্রথমাংশ ফরজে কেফায়ার ইঙ্গিত বহন করে এবং শেষাংশ নাফিরে আমের ইঙ্গিত বহন করে। কারণ, তখন সকলের অংশগ্রহণ ব্যতীত উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। সুতরাং তখন সকলের উপর ফরজ হয়ে যাবে।” -হেদায়া; ফাতহুল কাদিরসহ: ৫/৪৩৬-৪৪১

কাজি ইবনে আতিয়্যা আন্দালুসি রহ. (মৃত্যু: ৫৪১ হি.)  বলেন,

والذي استمر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين. اهـ -تفسير ابن عطية: 1/289

“যে বিষয়টির উপর ইজমা চলে আসছে তা হল, উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরজে কেফায়া। যদি মুসলমানদের একাংশ তা আদায় করে, তাহলে অন্যদের থেকে এর দায়-ভার সরে যাবে। তবে যদি শত্রু কোনো ইসলামী ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়, তখন তা ফরজে আইন হয়ে যায়। -তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ: ১/২৮৯

তিন অবস্থায় জিহাদ ফরজে আইন হয়

এছাড়া বিশেষ তিনটি অবস্থায় জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়।

ইমাম ইবনে কুদামা মাকদিসি রহ. (৬২০ হি.) বলেন-

يتعين الجهاد في ثلاثة مواضع؛ أحدها، إذا التقى الزحفان، وتقابل الصفان؛ حرم على من حضر الانصراف، وتعين عليه المقام …  الثاني، إذا نزل الكفار ببلد، تعين على أهله قتالهم ودفعهم. الثالث، إذا استنفر الإمام قوما لزمهم النفير معه. اهـ -المغني: 12/423

“তিন অবস্থায় জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। ১. যখন (মু’মিন-কাফের) উভয় বাহিনী লড়াইয়ের জন্য কাতারবন্দি হয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন উপস্থিত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পলায়ন করা হারাম এবং অটল থেকে জিহাদ করা ফরজে আইন। ২. কাফেররা কোনো এলাকায় আক্রমণ চালালে উক্ত এলাকার অধিবাসীদের উপর তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা এবং তাদের প্রতিরোধ করা ফরজে আইন। ৩. ইমাম যদি কোনো সম্প্রদায়কে জিহাদে বের হতে আহ্বান করেন, তাহলে তাদের সকলের জন্য জিহাদে বের হওয়া ফরজে আইন।” -আলমুগনী: ১২/৪২৩

এবিষয়ে ইবনে কুদামা রহ.র বক্তব্যটি গুছানো বিধায় তাঁর বক্তব্যটি উদ্ধৃত করলাম। অন্যথায় বিষয়টি হানাফি মাযহাবসহ সকল মাযহাবেই স্বীকৃত। দেখুন, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯১ ও ৭/৯৮, আলবিনায়া: ৭/৯৬, রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৭

ফরজে আইনের উপরোক্ত তিনটি অবস্থার প্রত্যেকটি সম্পর্কে আমরা কুরআন, ‍সুন্নাহ’র দলিল ও ফিকহের কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি ইনশাআল্লাহ। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ!

এক. রাণাঙ্গনে শত্রুর মুখোমুখি হলে

ফরজে আইনের প্রথম ক্ষেত্র ছিল, যখন কিতালের জন্য মুসলিম ও কাফের বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন উপস্থিত সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন। এমতাবস্থায় ময়দান ছেড়ে পালানো হারাম ও কবীরা গুনাহ।

ক. আলকুরআনুল কারীম

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ (15) وَمَنْ يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلَّا مُتَحَرِّفًا لِقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَى فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ. (16) -الأنفال

“হে ঈমানদারগণ, যখন কাফেরদের চড়াও হয়ে আসা অবস্থায় তোমরা তাদের মুখোমুখি হও, তখন তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করো না। সেদিন যুদ্ধকৌশল অবলম্বন অথবা দলে স্থান লওয়া ব্যতীত কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে, সে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্রোধ নিয়ে ফিরবে এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর তা অতি মন্দ ঠিকানা।”আনফাল: ১৫-১৬

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম ত্ববারী রহ. (৩১০ হি.) বলেন-

وأولى التأويلين في هذه الآية بالصواب عندي قولُ من قال: حكمها محكم، وأنها نزلت في أهل بدر، وحكمها ثابت في جميع المؤمنين، وأن الله حرّم على المؤمنين إذا لقوا العدو، أن يولوهم الدبر منهزمين إلا لتحرفٍ القتال، أو لتحيز إلى فئة من المؤمنين حيث كانت من أرض الإسلام، وأن من ولاهم الدبر بعد الزحف لقتالٍ منهزمًا بغير نية إحدى الخلتين اللتين أباح الله التولية بهما، فقد استوجب من الله وعيده، إلا أن يتفضل عليه بعفوه. اهـ -جامع البيان في تأويل القرآن 13-440 مؤسسة الرسالة

“আমার মতে এই আয়াতের দু’টি ব্যাখ্যার মাঝে তুলনামূলক সঠিক ব্যাখ্যাটি হল- আয়াতের বিধান এখনও বহাল রয়েছে। আয়াতটি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হলেও; তার বিধান সব মুসলিমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য শত্রুর মুখোমুখি হলে পরাজিত হয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করা হারাম করেছেন। অবশ্য যুদ্ধ-কৌশল হিসেবে কিংবা দারুল ইসলামে অবস্থানকারী মুমিন দলের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য পিছু হটলে ভিন্ন কথা। শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার পর যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা যে দু’টি অবস্থায় পিছু হটা বৈধ করেছেন, তা ব্যতীত পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করবে, সে আল্লাহ তায়ালার ধমকের উপযুক্ত সাব্যস্ত হবে। তবে আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করলে ভিন্ন কথা।” –জামিউল বায়ান ফি তা’বিলিল কুরআন ১৩/৪৪০

ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১ হি.) বলেন-

حرم الله ذلك على المؤمنين حين فرض عليهم الجهاد وقتال الكفار… والفرار كبيرة موبقة بظاهر القرآن وإجماع الأكثر من الأئمة. اهـ -تفسير القرطبي: 7/371

“যখন আল্লাহ তায়ালা মু’মিনদের উপর কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও ক্বিতাল ফরজ করেছেন, তখন তা (যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পলায়ন করা) তাদের উপর হারাম করেছেন।… যুদ্ধ হতে পলায়ন ধ্বংসাত্মক কবীরা গুনাহ, যা কুরআনের বাহ্যিক বর্ণনা ও অধিকাংশ আয়িম্মায়ে কেরামের ঐক্যমতে প্রমাণিত।” –তাফসীরে কুরতুবী ৭/৩৭১

আল্লামা শাওকানী রহ. (১২৫০ হি.) বলেন-

فظاهر هذه الآية العموم لكل المؤمنين في كل زمن، وعلى كل حال إلا حالة التحرف والتحيز… وذهب جمهور العلماء إلى أن هذه الآية محكمة عامة غير خاصة، وأن الفرار من الزحف محرم، ويؤيد هذا: أن هذه الآية نزلت بعد انقضاء الحرب في يوم بدر… فيكون الفرار من الزحف محرما بشرط ما بينه الله في آية الضعف  …

ويؤيد هذا ورود الأحاديث الصحيحة المصرحة بأن الفرار من الزحف من جملة الكبائر، كما في حديث «اجتنبوا السبع الموبقات، وفيه: والتولي يوم الزحف» ونحوه من الأحاديث. اهـ -فتح القدير: 2/334

‍“আয়াতের বাহ্যিক বক্তব্য সকল যমানার সকল মু’মিনের জন্য এবং সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। তবে কৌশল হিসেবে কিংবা মুসলিম দলের সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে পিছু হটলে ভিন্ন কথা।… অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের বক্তব্য হল, এই আয়াতের বিধান এখনও অপরিবর্তিত। আয়াত আম তথা ব্যাপক, খাস নয়; এবং যুদ্ধ হতে পলায়ন হারাম। এ মতটিকে এ বিষয়টিও সমর্থন করে যে, আয়াতটি বদরের দিন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অবতীর্ণ হয়েছে।… অতএব, যুদ্ধ হতে পলায়ন করা হারাম। তবে আল্লাহ তায়ালা দুর্বলতার বিবরণ সম্বলিত আয়াতে যে শর্ত উল্লেখ করেছেন, সে শর্তসাপেক্ষে জায়েয।… এ ব্যাপারে যেসব সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টভাবে যুদ্ধ হতে পলায়ন করা কবীরা গুনাহ বলা হয়েছে, সেগুলোও এর সমর্থন করে। যেমন এক হাদীসে এসেছে– ‘তোমরা ধ্বংসাত্মক সাতটি গুনাহ থেকে বিরত থাক।’ সাতটির একটি হল, ‘যুদ্ধ হতে পলায়ন করা’। এ ছাড়াও এ জাতীয় আরো হাদীস রয়েছে।” –ফাতহুল কাদীর ২/৩৩৪

আরেকটি আয়াত

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

{يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ} -الانفال: 45

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোনো বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হও, অটল থাক এবং আল্লাহ তাআলাকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” –আনফাল (০৮) : ৪৫

আয়াতের ব্যাখ্যায় কাযী সানাউল্লাহ পানিপতি রহ. (১২২৫ হি.) বলেন-

يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذا لَقِيتُمْ للمحاربة فِئَةً يعنى جماعة كافرة ولم يصفها اشعارا بان المؤمنين لا يقاتلون الا الكفار فَاثْبُتُوا لقتالهم فان الفرار من الزحف كبيرة كما ورد في الصحاح من الأحاديث. اهـ -التفسير المظهري: 4/97

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন লড়াইয়ের জন্য কোনো বাহিনীর মুখোমুখি হও, (এখানে উদ্দেশ্য কাফের বাহিনী, কিন্তু তাদেরকে কাফের বিশেষণে বিষেশায়িত না করে একথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মুমিনরা একমাত্র কাফেরের বিরুদ্ধেই কিতাল করে), তখন তাদের সাথে লড়াইয়ে সুদৃঢ় থাক। কেননা লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পলায়ন করা কবিরা গুনাহ- যেমনটা বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এসেছে।” -তাফসীরে মাযহারী ৪/৯৭

আল্লামা শানকিতি রহ. (১৩৯৩ হি.) বলেন-

أَمَرَ اللَّهُ تَعَالَى الْمُؤْمِنِينَ فِي هَذِهِ الْآيَةِ الْكَرِيمَةِ بِالثَّبَاتِ عِنْدَ لِقَاءِ الْعَدُوِّ، وَذِكْرِ اللَّهِ كَثِيرًا مُشِيرًا إِلَى أَنَّ ذَلِكَ سَبَبٌ لِلْفَلَاحِ، وَالْأَمْرُ بِالشَّيْءِ نَهْيٌ عَنْ ضِدِّهِ، أَوْ مُسْتَلْزِمٌ لِلنَّهْيِ عَنْ ضِدِّهِ، كَمَا عُلِمَ فِي الْأُصُولِ، فَتَدُلُّ الْآيَةُ الْكَرِيمَةُ عَلَى النَّهْيِ عَنْ عَدَمِ الثَّبَاتِ أَمَامَ الْكَفَّارِ، وَقَدْ صَرَّحَ تَعَالَى بِهَذَا الْمَدْلُولِ فِي قَوْلِهِ: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ.  اهـ -تفسير أضواء البيان: 2/101

“আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে কারিমায় মুমিনদেরকে শত্রুর মোকাবেলায় দৃঢ়পদ থাকার এবং আল্লাহ তায়ালাকে বেশি বেশি স্মরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন; একথার প্রতি ইঙ্গিত করার জন্য যে, এটা সফলতার মাধ্যম। আর কোনো বিষয়ের নির্দেশ দেয়ার অর্থ তার বিপরীতটা থেকে নিষেধ করা; অথবা বলা যায়, অবশ্যম্ভাবীভাবেই বিপরীতটা নিষেধ হয়ে পড়ে। যেমনটা উসূল শাস্ত্রে বিধিত। অতএব আয়াতে কারিমা কাফেরদের সামনে দৃঢ়পদ না থাকার নিষেধাজ্ঞার প্রতি নির্দেশ করছে। আল্লাহ তায়ালা এই বিষয়টা স্পষ্টভাবেও ব্যক্ত করেছেন তাঁর এই বাণীতে- ‘হে ঈমানদারগণ, যখন তোমরা কাফেরদের মুখোমুখি হও, তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করো না’।” -আদওয়াউল বায়ান ২/১০১

খ. হাদীস শরীফ

ইমাম মুসলিম রহ. (২৬১ হি.) সহীহ মুসলিমে বর্ণনা করেন-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنّ رَسُولَ اللّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: “اجْتَنِبُوا السّبْعَ الْمُوبِقَاتِ” قِيلَ: يَا رَسُولَ اللّهِ وَمَا هُنّ؟ قَالَ: “الشّرْكُ بِالله. وَالسّحْرُ، وَقَتْلُ النّفْسِ الّتِي حَرّمَ الله إِلاّ بِالْحَقّ، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ، وَأَكْلُ الرّبَا، وَالتّوَلّي يَوْمَ الزّحْفِ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْغَافِلاَتِ الْمُؤْمِنَاتِ” -صحيح مسلم: 145

“হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় হতে বিরত থাকবে। আরজ করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলো কী? ইরশাদ করলেন, ‘আল্লাহর সাথে শরীক করা, যাদু করা, আল্লাহ তায়ালা যে প্রাণ (হত্যা করা) হারাম করেছেন তা অন্যায়ভাবে হত্যা করা, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা, সুদ খাওয়া, যুদ্ধের দিন পলায়ন করা এবং সতী-সাধ্বী মু’মিন নারীকে যিনার অপবাদ দেওয়া।” -সহিহ মুসলিম: ১৪৫

হাদীসে উল্লিখিত التولي يوم الزحف তথা ‘যুদ্ধের দিন পলায়ন করা’ এর ব্যাখ্যায়-

ইমাম নববী রহ (৬৭৬ হি.) বলেন-

 وأما عده صلى الله عليه و سلم التولى يوم الزحف من الكبائر فدليل صريح لمذهب العلماء كافة فى كونه كبيرة الا ما حكي عن الحسن البصري رحمه الله أنه قال ليس هو من الكبائر قال والآية الكريمة فى ذلك انما وردت فى أهل بدر خاصة والصواب ما قاله الجماهير أنه باق والله أعلم. اهـ -شرح مسلم، للنووي: 2/88

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের দিন পলায়ন করাকে কবীরা গুনাহ গণ্য করেছেন, যা কবিরা গুনাহ হওয়ার ব্যাপারে সকল উলামায়ে কেরামের মতের সপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ। অবশ্য হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ হতে ভিন্নমত বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, এটা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাঁর মতে এ আয়াতটি বিশেষভাবে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে। তবে সঠিক মত হল যেটি জুমহুর উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে, আয়াতের হুকুম এখনও বহাল রয়েছে।” -ইমাম নববী কৃত শরহে মুসলিম ২/৮৮

গ. ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য

আল্লামা কাসানী রহ. (৫৮৭ হি.) বলেন-

فرض عين عند عموم النفير وفرض كفاية في غير تلك الحال وإذا شهد الوقعة فتعين عليه. اهـ -بدائع الصنائع: 4/191

“নাফিরে আমের সময় জিহাদ ফরজে আইন। অন্য সময় ফরজে কেফায়া। তবে ময়দানে উপস্থিত হয়ে গেলে ফরজে আইন হয়ে যায়।” -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯১

ইমাম নববী রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন-

مَنْ شَرَعَ فِي قِتَالٍ وَلَا عُذْرَ لَهُ، لَزِمَهُ الْمُصَابَرَةُ، وَعَبَّرَ الْأَصْحَابُ عَنْ هَذَا بِأَنَّ الْجِهَادَ يَصِيرُ مُتَعَيَّنًا عَلَى مَنْ هُوَ مِنْ أَهْلِ فَرْضِ الْكِفَايَةِ بِالشُّرُوعِ. اهـ -روضة الطالبين: 10/213

“যে ব্যক্তি যুদ্ধ শুরু করে দেবে এবং তার কোনো ওজর থাকবে না, তার জন্য অটল থাকা আবশ্যক। আমাদের উলামায়ে কেরাম বিষয়টিকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে- যাদের উপর জিহাদ ফরজে কেফায়া, তাদের উপরও জিহাদ শুরু করার দ্বারা ফরজে আইন হয়ে যায়।” –রওযাতুত্তালিবীন ১০/২১৩

দুই. কাফেররা মুসলিমদের উপর আক্রমণ করলে বা আক্রমণে উদ্ধত হলে

জিহাদ ফরজে আইন হওয়ার দ্বিতীয় ক্ষেত্র হল, কাফেররা যখন মুসলমানদের কোনো এলাকায় আক্রমণ করে অথবা কোনো এলাকা দখল করে নেয় কিংবা আক্রমণে উদ্ধত হয়। তখন উক্ত এলাকার অধিবাসীদের সকলের উপর তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা এবং তাদের প্রতিরোধ করা ফরজে আইন হয়ে যায়।

ক. আলকুরআনুল কারীম

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ (38) إِلَّا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (39) إِلَّا تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ (40) انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (41). -التوبة

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হল, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বের হও, তখন তোমরা যমীনের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখেরাতের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। যদি তোমরা জিহাদে বের না হও, তিনি তোমাদের বেদনাদায়ক আযাব দেবেন এবং তোমাদের পরিবর্তে অন্য সম্প্রদায় নিয়ে আসবেন। তোমরা তাঁর কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। বস্তুত আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। যদি তোমরা তাঁকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করেছেন, যখন কাফেররা তাঁকে বের করে দিয়েছিল; যখন তিনি ছিলেন দু’জনের দ্বিতীয় জন। যখন তাঁরা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিলেন। যখন তিনি তাঁর সঙ্গীকে বললেন, ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন’। অতঃপর আল্লাহ তাঁর উপর তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাঁকে এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা সাহায্য করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বাণী অতি নিচু করে দিলেন। আল্লাহর বাণীই সুউচ্চ। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান। তোমরা হালকা ও ভারী যে অবস্থায়ই থাক, জিহাদে বের হও এবং তোমাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জান।” –সূরা তাওবা (০৯) : ৩৮-৪১

মালিকুল উলামা আলাউদ্দীন কাসানী রহ: (৫৮৭ হি.) বলেন-

فأما إذا عم النفير بأن هجم العدو على بلد، فهو فرض عين يفترض على كل واحد من آحاد المسلمين ممن هو قادر عليه؛ لقوله سبحانه وتعالى {انفروا خفافا وثقالا} قيل: نزلت في النفير. اهـ -بدائع الصنائع: 7/98

“যদি নাফিরে আম হয়ে যায়; অর্থাৎ কোনো এলাকায় শত্রুরা আক্রমন চালায়, তাহলে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এই ফরজ প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের উপর বর্তায়। এর প্রমাণ আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘তোমরা হালকা ও ভারী যে অবস্থায়ই থাক, জিহাদে বের হও’ বলা হয়, আয়াতটি নাফিরে আম সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।” -বাদায়িউস সানায়ি’: ৭/৯৮

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১ হি.) বলেন- 

وقد تكون حالة يجب فيها نفير الكل، وهي: الرابعة- وذلك إذا تعين الجهاد بغلبة العدو على قطر من الأقطار، أو بحلوله بالعقر، فإذا كان ذلك وجب على جميع أهل تلك الدار أن ينفروا ويخرجوا إليه خفافا وثقالا، شبابا وشيوخا، كل على قدر طاقته، من كان له أب بغير إذنه ومن لا أب له، ولا يتخلف أحد يقدر على الخروج، من مقاتل أو مكثر. فإن عجز أهل تلك البلدة عن القيام بعدوهم كان على من قاربهم وجاور هم أن يخرجوا على حسب ما لزم أهل تلك البلدة، حتى يعلموا أن فيهم طاقة على القيام بهم ومدافعتهم. وكذلك كل من علم بضعفهم عن عدو هم وعلم أنه يدركهم ويمكنه غياثهم لزمه أيضا الخروج إليهم، فالمسلمون كلهم يد على من سواهم، حتى إذا قام بدفع العدو أهل الناحية التي نزل العدو عليها واحتل بها سقط الفرض عن الآخرين. ولو قارب العدو دار الإسلام ولم يدخلوها لزمهم أيضا الخروج إليه، حتى يظهر دين الله وتحمى البيضة وتحفظ الحوزة ويخزى العدو. ولا خلاف في هذا. اهـ -تفسير القرطبي: 8/151-152

“কোনো কোনো অবস্থায় সকলের উপরই জিহাদে বের হওয়া ফরজ হয়ে যায়। চতুর্থ মাসআলায় এটাই বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। উক্ত অবস্থা হল, যখন কোনো (মুসলিম) ভূখণ্ডে শত্রু দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলার কারণে বা কোনো ভূখণ্ডে শত্রু ঢুকে পড়ার কারণে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় উক্ত ভূখণ্ডের হালকা-ভারী (সরঞ্জামধারী), যুবক-বৃদ্ধ সকল অধিবাসীর উপর ফরজ, শত্রুর মোকবেলায় জিহাদে বেরিয়ে পড়া। প্রত্যেকে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী শত্রু প্রতিহত করবে। যার পিতা নেই সে তো যাবেই, যার পিতা আছে সেও পিতার অনুমতি ছাড়াই বেরিয়ে পড়বে। যুদ্ধ করতে সক্ষম কিংবা (অন্তত মুজাহিদদের) সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম, এমন কেউ বসে থাকবে না। ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম হয়, তাহলে উক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মতো তাদের নিকটবর্তী এবং প্রতিবেশীদের উপরও আবশ্যক, জিহাদে বের হয়ে পড়া; যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারবে যে, এখন তাদের শত্রু প্রতিহত করার এবং তাদেরকে বিতাড়িত করার সামর্থ্য অর্জিত হয়েছে। তেমনি যে ব্যক্তিই জানতে পারবে যে, তারা শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম এবং সে বুঝতে পারবে- আমি তাদের কাছে পৌঁছতে এবং তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম; তার উপরই আবশ্যক সাহায্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। কারণ, সকল মুসলমান তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে এক হস্তের ন্যায়। তবে যে এলাকায় শত্রু আগ্রাসন চালিয়েছে, তারা নিজেরাই যদি শত্রু প্রতিহত করতে পারে, তাহলে অন্যদের উপর থেকে ফরজ রহিত হয়ে যাবে। আর যদি এমন হয় যে, শত্রুরা দারুল ইসলামের নিকটবর্তী হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও দারুল ইসলামে আগ্রাসন চালায়নি, তাহলেও তাদের উপর ফরজ, শত্রু প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। যাতে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী থাকে, ইসলামী ভূখণ্ড সংরক্ষিত থাকে এবং শত্রু অপদস্থ ও পরাস্ত হয়। এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই।” -তাফসীরে কুরতুবী: ৮/১৫১-১৫২

ইমাম কুরতুবী রহ.-এর বক্তব্য থেকে বুঝা গেল, নিম্নোক্ত তিন সূরতের প্রতিটিতেই জিহাদ ফরজে আইন।

১. যখন শত্রু কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালিয়ে তা দখল করে নেয়। (بغلبة العدو على قطر من الأقطار)

২. যদি শত্রু কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে, তবে এখনও তা দখলে নিতে সক্ষম হয়নি। (بحلوله بالعقر)

৩. যদি শত্রু আগ্রাসন চালানোর উদ্দেশ্যে দারুল ইসলামের দিকে আসতে থাকে এবং দারুল ইসলামের কাছাকাছি এসে পড়ে। (لو قارب العدو دار الإسلام ولم يدخلوها)

এই সকল সূরতে জিহাদ ফরজে আইন। তা বহাল থাকবে যতক্ষণ না শত্রুকে পূর্ণ পরাস্ত করা যায় এবং দারুল ইসলাম থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করা যায়।

খ. হাদীস শরীফ

হাদীসে এসেছে-

عن عبد الله بن عباس رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (لا هجرة بعد الفتح، ولكن جهاد ونية، وإذا استنفرتم فانفروا) -صحيح البخاري: 2783، صحيح مسلم: 1353

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, (মক্কা) বিজয়ের পর (মদীনায়) হিজরতের (ফরজ) বিধান রহিত হয়ে গেছে, কিন্তু জিহাদ ও নিয়ত রয়ে গেছে। যখন তোমাদেরকে জিহাদে বের হতে আহবান করা হবে, তোমরা বের হয়ে পড়।” –সহীহ বুখারী: ২৭৮৩, সহীহ মুসলিম: ১৩৫৩

الاسْتِنْفار অর্থ: জিহাদ ও নুসরতে বের হওয়ার আহবান জানানো।

ইমাম সুয়ূতী রহ. (মৃত্যু: ৯১১ হি.) উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন

أى إذا طلب منكم الخروج إلى الغزو فاخرجوا إليه. اهـ -جامع الاحاديث: 1338

“অর্থাৎ যখন তোমাদের কাছে তলব করা হয়, তোমরা জিহাদে বের হও, তখন বের হয়ে পড়।” -জামিউল আহাদীস: ১৩৩৮

তিনি আরো বলেন-

الاسْتِنْفار: الاسْتِنْجاد والاستِنْصار والمراد: إذا طلب منكم النُّصْرة فأجِيبوا وانْفِروا خارِجين إلى الإعانَة. اهـ -جامع الأحاديث: 1338

“الاسْتِنْفار অর্থ: সাহায্য ও নুসরত কামনা করা। উদ্দেশ্য, যখন তোমাদের কাছে নুসরত চাওয়া হয়, তখন সাড়া দাও এবং নুসরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়।” -জামিউল আহাদীস: ১৩৩৮

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (মৃত্যু: ৮৫২ হি.) বলেন

المعنى أن وجوب الهجرة من مكة انقطع بفتحها إذ صارت دار إسلام ولكن بقي وجوب الجهاد على حاله عند الاحتياج إليه وفسره بقوله (فإذا استنفرتم فانفروا) أي إذا دعيتم إلى الغزو فأجيبوا. اهـ -فتح الباري: 15/78

“উক্ত হাদীসের অর্থ হল, মক্কা বিজিত হয়ে দারুল ইসলামে পরিণত হওয়ার দ্বারা মক্কা থেকে হিজরত করার ফরজিয়ত শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় জিহাদে বের হওয়া তেমনি ফরজ রয়ে গেছে, যেমন আগে ফরজ ছিল। (فإذا استنفرتم فانفروا) দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাই ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ যখনই তোমাদের জিহাদের জন্য আহবান করা হবে, তোমরা সাড়া দেবে।” -ফাতহুল বারী: ১৫/৭৮

কাজি ইয়ায রহ. (মৃত্যু: ৫৪৪ হি.) বলেন

وقوله: (وإذا استنفرتم فانفروا) هو على وجهين؛ فأما الاستنفار لعدو صدم اْرض قوم، فنفيرهم له واجب فرض متعين عليهم، وكذلك لكل عدو غالب ظاهر حتى يقع، وأما لغير هذين الوجهين فيتكد النفير لطاعة الإمام لذلك، ولا يجب وجوب الأول. اهـ -إكمال المعلم: 6/275

“(وإذا استنفرتم فانفروا) তথা ‘যখন তোমাদেরকে জিহাদে বের হতে আহবান করা হবে, তোমরা বের হয়ে পড়’ -এর দু’টি সূরত রয়েছে। যদি এমন কোনো শত্রু প্রতিহত করতে আহবান করা হয়, যারা মুসলমানদের কোনো ভূখণ্ডে আক্রমণ করেছে, তাহলে তাদেরকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে জিহাদে বের হওয়া তাদের উপর ফরজে আইন। একইভাবে যে শত্রু দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলেছে, তাদের প্রতিহত করার জন্যে জিহাদে বের হওয়াও ফরজে আইন। এ ফরজ বলবৎ থাকবে, যতক্ষণ না শত্রু পরাজিত হয়। এই দুই সূরত ছাড়াও ইমাম যদি জিহাদে বের হওয়ার আদেশ দেন, তবুও ইমামের আনুগত্যের জন্য জিহাদে বের হওয়া আবশ্যক। তবে এটি পূর্বোক্ত দু’টির মতো জোরদার ফরজ নয়।” -ইকমালুল মু’লিম: ৬/২৭৫

গ. ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য

এই পরিস্থিতিকে ফিকহের পরিভাষায় নাফিরে আম বলা হয়। নাফির অর্থ যুদ্ধে বের হওয়া, আর আম অর্থ ব্যাপক। ‘নাফিরে আম’ দ্বারা উদ্দেশ্য এমন অবস্থা, যখন শত্রুকে প্রতিহত করতে ব্যাপকভাবে মুসলমানদের সকলের জিহাদে বের হওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কাফেররা মুসলিম ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালালে যেহেতু তাদের প্রতিহত করতে মুসলমানদেরকে ব্যাপকভাবে জিহাদে বের হতে হয়, তাই এ অবস্থাকে নাফিরে আম বলা হয়। নাফীরে আমের অবস্থায়ও সকলের উপর জিহাদ ফরজে আইন।

আল্লামা হাসকাফি রহ. (১০৮৮ হি.) বলেন-

وَفَرْضُ عَيْنٍ إنْ هَجَمَ الْعَدُوُّ فَيَخْرُجُ الْكُلُّ. اهـ -الدر مع الرد: 4/127

“শত্রু আকস্মিক হামলা করে বসলে জিহাদ ফরজে আইন। তখন সকলেই জিহাদে বের হয়ে পড়বে।”

আল্লামা ইবনে আবিদিন শামী রহ. (১২৫২ হি.) উক্ত বক্তব্যের ব্যখ্যায় বলেন-

وَهَذِهِ الْحَالَةُ تُسَمَّى “النَّفِير الْعَامّ”. قَالَ فِي الِاخْتِيَارِ: وَالنَّفِيرُ الْعَامُّ – أَنْ يُحْتَاجَ إلَى جَمِيعِ الْمُسْلِمِينَ. اهـ -رد المحتار: 4/127

“এ অবস্থাকে ‘নাফিরে আম’ বলা হয়। ‘আল-ইখতিয়ার’ গ্রন্থকার বলেন, ‘নাফিরে আম’ হচ্ছে এমন অবস্থা, যখন সকল মুসলমানের জিহাদে বের হওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে।” –রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৭

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. (৮৫৫ হি.) বলেন,

يجب الجهاد على الكفاية إلا إذا كان النفير عاماً بأن لا يندفع شر الكفار إذا هجموا ببعض المسلمين …  فيفترض على كل واحد. اهـ -البناية: 7/96

“জিহাদ ফরজে কেফায়া। তবে নাফিরে আম হয়ে গেলে সকলের উপর ফরজ হয়ে যায়। নাফিরে আম হল, যখন কাফেররা আক্রমণ করে বসে এবং কিছু সংখ্যক মুসলমানের দ্বারা তাদের অনিষ্ট প্রতিহত করা যায় না।… তখন সকলের উপর জিহাদ ফরজ হয়ে যায়।” –আলবিনায়া:৭/৯৬

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কাফেররা আক্রমণ করে বসলে বা কোনো ভূখণ্ড দখল করে নিলে এক পর্যায়ে দুনিয়ার সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। যাদের উপর আক্রমণ হয়েছে, সর্বপ্রথম তাদের উপর ফরজে আইন। তারা না পারলে বা না করলে, এই দায়িত্ব তাদের পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের উপর বর্তায়। তারা না পারলে বা না করলে তাদের পরবর্তীদের উপর বর্তায়। এভাবে ক্রমান্বয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের উপর জিহাদে শরীক হওয়া ফরজে আইন হয়ে যায়। এ অবস্থায় প্রত্যেকে তার নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী জান-মাল ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে শরীক হবে। অন্যথায় সবাই ফরজ ত্যাগের দায়ে গুনাহগার হবে।

আল্লামা ইবনে আবিদিন শামী রহ. (১২৫২ হি.) বলেন-

الجهاد إذا جاء النفير إنما يصير فرض عين على من يقرب من العدو، فأما من وراءهم ببعد من العدو فهو فرض كفاية عليهم، حتى يسعهم تركه إذا لم يحتج إليهم. فإن احتيج إليهم بأن عجز من كان يقرب من العدو عن المقاومة مع العدو أو لم يعجزوا عنها، لكنهم تكاسلوا ولم يجاهدوا: فإنه يفترض على من يليهم فرض عين كالصلاة والصوم، لا يسعهم تركه ثم وثم إلى أن يفترض على جميع أهل الإسلام شرقا وغربا على هذا التدريج. اهـ -رد المحتار: 4/124

“যদি শত্রুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়, তাহলে (প্রথমত) জিহাদ ফরজে আইন হয় ওইসব মুসলমানের উপর, যারা শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী। আক্রান্ত এলাকা থেকে যারা দূরে, (শত্রু প্রতিহত করতে) যদি তাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হয়, তাহলে তাদের উপর জিহাদ (ফরজে আইন নয়; বরং) ফরজে কেফায়া। এ অবস্থায় তাদের জিহাদে শরীক না হওয়ার অবকাশ থাকে। তবে শত্রুর নিকটে যারা রয়েছে, তারা যদি শত্রু প্রতিরোধে অপারগ হয় বা অলসতাবশত জিহাদ না করে, তাহলে তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে; যেমন সালাত ও সিয়াম ফরজে আইন। তখন তাদের জন্য জিহাদ না করার কোনো অবকাশ থাকবে না। এভাবে তাদের পরবর্তী এবং তাদের পরবর্তী মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে পূর্ব থেকে পশ্চিম; সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪

উল্লেখ্য, কোনো মুসলমান কাফেরদের হাতে বন্দী হলে তাকে মুক্ত করার জন্যও এক পর্যায়ে ফুকাহায়ে কেরাম জিহাদকে ফরজে আইন বলেছেন। স্বভাবত এখানেও সেই বিন্যাস প্রযোজ্য, যা উপরে রদ্দুল মুহতারের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করা হল।

ইমাম গাযালী রহ. (৫০৫ হি.) বলেন-

ولو أسروا مسلما أو مسلمين فهل يتعين القتال كما لو استولوا على الديار فيه خلاف والظاهر أنه يتعين إذا أمكن إلا حيث يعسر التوغل في ديارهم ويحتاج إلى زيادة أهبة فقد رخص فيه في نوع من التأخير ولكن لا يجوز إهماله. اهـ -الواسط: 7/5

“কাফিররা যদি দুয়েকজন মুসলিমকে বন্দী করে, তাহলে কি কিতাল ফরজে আইন হয়ে যাবে? যেমন তারা মুসলিম ভূখণ্ডে দখলদারিত্ব কায়েম করলে ফরজে আইন হয়ে যায়? এ মাসআলায় মতভেদ রয়েছে। তবে স্পষ্ট এটাই যে, (তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা) সম্ভব হলে ফরজে আইন হয়ে যাবে। তবে তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে আক্রমণ করা কঠিন হলে এবং অতিরিক্ত প্রস্তুতির প্রয়োজন হলে, বিলম্ব করার কিছুটা সুযোগ আছে। কিন্তু একদম উপেক্ষা করা জায়েয নয়।” –আলওয়াসিত:৭/৫

নাফিরে আম: একটি সংশয়

কেউ কেউ মনে করেন, ‘নাফিরে আমের জন্য ইমামের পক্ষ থেকে জিহাদের আহ্বান জরুরি। ইমামের আহ্বান না হলে কাফেররা আক্রমণ চালালেও নাফিরে আম হবে না এবং ব্যাপকভাবে জিহাদও ফরজ হবে না!’

এই ধারণা ঠিক নয়। নাফির আমের ব্যাখ্যা আমরা ইতিমধ্যে আল্লামা কাসানী রহ., আল্লামা আইনী রহ. ও আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রহ. এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছি। ইমাম কুরতুবী রহ. এর বক্তব্যও প্রায় কাছাকাছি। তাদের বক্তব্য থেকে নাফির আমের যে অর্থ দাঁড়ায় তা হল, ‘নাফির আম একটি অবস্থার নাম, যা সৃষ্টি হয় কাফেররা কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমণ করলে বা আক্রমণ করতে আসলে কিংবা আক্রমণ করে তা দখল করে নিলে, যখন তাদের প্রতিহত করার জন্য ব্যাপকভাবে সকল মুসলমানের জিহাদে বের হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়’। এ অবস্থাকে নাফির আম বলা হয় এবং তখন ব্যাপকভাবে জিহাদ সকলের উপর ফরজ হয়ে যায়। ইমামের পক্ষ হতে আহ্বান আসতে হবে, এমন কোনো শর্ত নেই। ইবনে আবিদিন রহ. এর বক্তব্য একেবারেই সুস্পষ্ট- وَهَذِهِ الْحَالَةُ تُسَمَّى “النَّفِير الْعَامّ”  ‘এ অবস্থাকে ‘নাফিরে আম’ বলা হয়’। পাঠকের প্রতি তাঁদের বক্তব্যগুলোতে আরেকবার নজর বুলিয়ে নেয়ার অনুরোধ রইল। এছাড়াও এবিষয়ে আমরা আরো কয়েকজন ইমামের বক্তব্য উল্লেখ করছি:

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (১৮৯ হি.) বলেন-

فأما إذا جاء النفير عاما فقيل لأهل مدينة: قد جاء العدو يريدون أنفسكم أو ذراريكم أو أموالكم لا بأس بأن يخرج بغير إذن والديه. اهـ -شرح السير الكبير: 1/128

“যখন নাফির আম হবে; কোনো এলাকার অধিবাসীদের বলা হবে, তোমাদের জান, মাল কিংবা তোমাদের স্ত্রী-সন্তানদের উদ্দেশ্যে শত্রুরা এসে পড়েছে, তখন পিতামাতার অনুমতি ব্যতীত জিহাদে বের হতে কোনো সমস্যা নেই।” -শরহুসসিয়ারিল-কাবীর ১/১২৮

ইমাম ইবনুল হুমাম রহ. (৮৬১ হি.) বলেন-

ثم هذا (إذا لم يكن النفير عاما، فإن كان) بأن هجموا على بلدة من بلاد المسلمين (فيصير من فروض الأعيان) سواء كان المستنفر عدلا أو فاسقا فيجب على جميع أهل تلك البلدة النفر. اهـ -فتح القدير: 5/439

“জিহাদ ফরজে আইন না হওয়ার এ বিধান হল, যখন নাফিরে আম না হবে। পক্ষান্তরে যদি নাফিরে আম হয়ে যায়; যেমন কাফেররা অকস্মাৎ মুসলিমদের কোনো ভূখণ্ডে আক্রমণ করে বসল, তাহলে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে। (প্রতিরোধ জিহাদের) আহ্বানকারী (যে কোনো আহ্বানকারী বা আক্রমণের সংবাদদাতা উদ্দেশ্য, ইমাম হওয়া জরুরি নয়। যেমন আল্লামা হাসকাফি রহ.র পরবর্তী বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।) বিশ্বস্ত হোক বা ফাসেক হোক। সে এলাকার সকলের উপর তখন জিহাদে বের হওয়া ফরজ।” -ফাতহুল কাদীর ৫/৪৩৯

আল্লামা হাসকাফি রহ. (১০৮৮ হি.) বলেন,

وفرض عين إن هجم العدو فيخرج الكل ولو بلا إذن) ويأثم الزوج ونحوه بالمنع ذخيرة…. (ويقبل خبر المستنفر ومنادي السلطان ولو) كان كل منهما (فاسقا) ؛ لأنه خبر يشتهر في الحال ذخيرة -الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار): 4/ 126-127

“এবং জিহাদ ফরজে আইন; শত্রু যদি আক্রমণ করে। তখন সকলেই বের হয়ে পড়বে, অনুমতি ছাড়া হলেও। স্বামী ও তার মতো (কর্তৃত্বের অধিকারী) অন্যান্যরা নিষেধ করলে গুনাহগার হবে।….. এখানে আহ্বানকারী বা সংবাদদাতা এবং বাদশার ঘোষকের সংবাদ গ্রহণযোগ্য, যদিও তারা ফসেক হয়। কারণ এটি এমন সংবাদ, যা তৎক্ষণাত ছড়িয়ে পড়বে।” -আদ্দুররুল মুখতার: ৪/১২৬-১২৭

ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-র বক্তব্য

উপরে ইমাম মুহাম্মাদ রহ., ইবনুল হুমাম রহ. এবং হাসকাফি রহ. নাফিরে আমের যে ব্যাখ্যা করেছেন, তা থেকেও স্পষ্ট যে, কাফেররা আক্রমণ করলেই নাফিরে আম হয়ে যাবে। ইমামের আহ্বানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেছেন, এ অবস্থায় ইমাম নিষেধ করলে, তাঁর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হলেও তাদের প্রতিরোধে কিতাল করতে হবে।

وإن نهى الإمام الناس عن الغزو والخروج للقتال فليس ينبغي لهم أن يعصوه إلا أن يكون النفير عاما. اهـ -شرح السير الكبير: 2/378

“ইমাম যদি লোকজনকে যুদ্ধ করতে এবং কিতালে বের হতে নিষেধ করেন, তাহলে তাদের জন্য তাঁর আদেশ অমান্য করা জায়েয নয়। তবে যদি নাফিরে আম হয়ে যায়, তাহলে ভিন্ন কথা।” -শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ২/৩৭৮

অর্থাৎ নাফিরে আম হয়ে গেলে তখন ইমাম নিষেধ করলেও জিহাদে যেতে হবে। এখান থেকে একেবারেই সুস্পষ্ট যে, কাফেররা আক্রমণ করলেই নাফিরে আম হয়ে যায় এবং জিহাদে বের হওয়া ফরজ হয়ে যায়। ইমামের আদেশের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ইমাম যদি এ সময় জিহাদে যেতে নিষেধ করেন, তাহলেও নাফিরে আম বহাল থাকবে। ইমামের কথা অমান্য করেই জিহাদে বের হতে হবে। কারণ, কাফেরদের আক্রমণের ফলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ইমামের নিষেধাজ্ঞা আল্লাহর নাফরমানির শামিল। আল্লাহর নাফরমানি করে কারো আনুগত্যের সুযোগ নেই। হাদিসে এসেছে,

لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق -المصنف لابن أبي شيبة: 34406

“খালেকের নাফরমানী করে মাখলূকের আনুগত্য বৈধ নয়।” -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৩৪৪০৬

ইমাম সারাখসী রহ.-র ব্যাখ্যা

ইমাম সারাখসী রহ. (৪৯০ হি.); ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

لأن طاعة الأمير فيما ليس فيه ارتكاب المعصية واجب كطاعة السيد على عبده فكما أن هناك بعد نهي المولى لا يخرج إلا إذا كان النفير عاما فكذلك ها هنا. اهـ -شرح السير الكبير: 2/378

“কেননা, যেখানে আমিরের আদেশ পালন করলে নাফরমানিতে লিপ্ত হতে হয় না, সেখানে আমিরের আনুগত্য ফরজ, যেমন গোলামের জন্য তার মনিবের আনুগত্য ফরজ। সুতরাং মনিব নিষেধ করলে যেমন গোলাম জিহাদে যাবে না, কিন্তু নাফিরে আম হয়ে গেলে মনিবের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই জিহাদে যাবে, তেমনি এখানে (আমিরের ক্ষেত্রে)ও বিষয়টি একই রকম।” -শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ২/৩৭৮

সুতরাং এ কথা বলা যে, ‘কাফেররা আক্রমণ চালালেও নাফিরে আম হবে না, জিহাদ ফরজ হবে না; ইমাম থাকতে হবে, ইমাম আহ্বান করতে হবে, এগুলো সম্পূর্ণই শরীয়ত বিরোধী ও ঈমান পরিপন্থী কথা। যেমনটা আল্লামা হাসকাফি রহ. (১০৮৮ হি.) বলেছেন,

(فإن هجم العدو) أي غلب (ففرض عين) يكفر جاحده، كما فى الإختيار وغيره. اهـ -الدر المنتقى: 2/408

 “অকস্মাৎ শত্রু আগ্রাসন চালালে জিহাদ ফরজে আইন। এর অস্বীকারকারী কাফের হয়ে যাবে। যেমনটি ইখতিয়ার ও অন্যান্য কিতাবে আছে।” –আদদুররুল মুনতাক্বা: ২/৪০৮

জিহাদে ইমামুল মুসলিমিনের নির্দেশ

অবশ্য এটা আলাদা বিষয় যে, খলিফাতুল মুসলিমিন যদি জিহাদের কাজ আঞ্জাম দেন এবং জিহাদের কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়ার জন্য কাউকে তা থেকে বিরত রাখেন বা কাউকে অন্য কাজের হুকুম করেন, তাহলে অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করা সকলের দায়িত্ব। অন্যথায় তাতে মুসলিম রাষ্ট্রে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, যাতে মুসলিমদের উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। এমন কাজ শুধু শরীয়ত নয়; সাধারণ বিবেক বুদ্ধিও সমর্থন করে না। তাছাড়া জিহাদের দায়িত্ব যদিও ব্যাপকভাবে সকল মুসলিমের এবং কাঙ্খিত স্তরে তা আদায় না হলে সামর্থ্যবান সকলেই গুনাহগার হবে, কিন্তু এজাতীয় ইজতেমায়ী সকল কাজের ইন্তেজাম ও ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্ব ইমামুল মুসলিমিনের। তিনি যদি কাজটি আঞ্জাম দেন, অন্যদের দায়িত্ব তার নির্দেশনায় কাজ করা।

পক্ষান্তরে পরিস্থিতি যদি এমন আকস্মিক হয়, যাতে ইমামের অনুমতি নেয়ার সুযোগ থাকে না; অনুমতি নিতে গেলে ততক্ষণে মুসলিমদের ক্ষতি হয়ে যাবে বা শত্রু হাতছাড়া হয়ে যাবে অথবা ইমাম যদি জিহাদের কাজ আঞ্জাম না দেন কিংবা মুসলিমদের কোনো ইমামই না থাকেন, তাহলে এসব ক্ষেত্রে তার অনুমতি ছাড়া; এমনকি তিনি নিষেধ করলে, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই দিফায়ি (প্রতিরক্ষামূলক) জিহাদ করা জরুরি। একথাও ফুকাহায়ে কেরাম সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।

জিহাদের জন্য ইমামের অনুমতির বিষয়টি স্বতন্ত্র একটি মাসআলা এবং এবিষয়েও বর্তমান বিশ্বে জিহাদ ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এই মাসআলাটি প্রস্তুত করার কাজ চলছে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তাআলা পূর্ণতায় পৌঁছে দিলে তা প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ। সকলের কাছে দোয়া চাই, আল্লাহ এরকম সবগুলো কাজ সহজ করে দিন এবং ইখলাস ও ইতকানের সঙ্গে অতি দ্রুততম সময়ে পূর্ণতায় পৌঁছে দিন। এখানে আমরা সংক্ষিপ্ত দু’একটি উদ্ধৃতি পেশ করছি।

ইবনে কুদামা মাকদিসি হাম্বলী রহ. (৬২০ হি.) বলেন,

فان عدم الامام لم يؤخر الجهاد لان مصلحته تفوت بتأخيره، وان حصلت غنيمة قسموها على موجب الشرع، قال القاضي وتؤخر قسمة الاماء حتى يقوم إمام احتياطا للفروج.اهـ

“যদি ইমাম না থাকে তাহলে এ কারণে জিহাদ পিছিয়ে দেয়া যাবে না। কেননা, পিছিয়ে দেয়ার দ্বারা জিহাদে নিহিত মাসলাহাত ও কল্যাণসমূহ হাতছাড়া হয়ে যাবে। গনীমত লাভ হলে হকদারদের মাঝে শরীয়তে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী বণ্টন করে নেবে। তবে কাজী রহ. বলেন, ইমাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত লজ্জাস্থান হালাল সাব্যস্ত করার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সতর্কতাবশত দাসীদের বণ্টন স্থগিত রাখবে।” -আলমুগনী ১০/৩৭৪

ইমামের অধীনে কেন জিহাদ করা হবে, তার কারণ ব্যাখ্যা করে-

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,

لأنه يمنع العدو من أذى المسلمين، ويكف أذى بعضهم عن بعض، والمراد بالإمام كل قائم بأمور الناس. -فتح الباري (6/ 136) .

“কারণ ইমাম মুসলিমদের কষ্ট দেয়া থেকে শত্রুকে প্রতিহত করে এবং মুসলিমদের পরস্পরকে পরস্পরের কষ্ট থেকে নিরাপত্তা দেয়। তবে ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য এমন ব্যক্তি, যিনি মুসলিমদের দায় দায়িত্ব আদায় করেন।” –ফাতহুল বারি: ৬/১৩৬

ইমাম মুহাম্মদ রহ. (১৮৯ হি.) ‘আসসিয়ারুল কাবীর’-এ বলেন,

وإن نهى الإمام الناس عن الغزو والخروج للقتال فليس ينبغي لهم أن يعصوه إلا أن يكون النفير عاما. اهـ -شرح السير الكبير: 2/378

“ইমাম যদি লোকজনকে যুদ্ধ করতে এবং কিতালে বের হতে নিষেধ করে, তাহলে তাদের জন্য তার আদেশ অমান্য করা জায়েয নয়। তবে যদি নাফীরে আম হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা।” -শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ২/৩৭৮

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর বক্তব্যের ব্যাখ্যায়-

ইমাম সারাখসী রহ. (৪৯০ হি.) বলেন,

لأن طاعة الأمير فيما ليس فيه ارتكاب المعصية واجب كطاعة السيد على عبده فكما أن هناك بعد نهي المولى لا يخرج إلا إذا كان النفير عاما فكذلك ها هنا. اهـ -شرح السير الكبير: 2/378

“কেননা যেখানে আমিরের আনুগত্য করতে গেলে নাফরমানীতে লিপ্ত হতে হয় না, সেখানে আমিরের আনুগত্য ফরয, যেমন গোলামের জন্য তার মনিবের আনুগত্য ফরয। সেখানে যেমন মনিব নিষেধ করলে গোলাম জিহাদে যাবে না, তবে নাফিরে আম হলে (নিষেধ করলেও) যাবে, এখানে (ইমামের ক্ষেত্রে)ও বিষয়টি তেমনই।” -শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ২/৩৭৮

খতীব শারবিনী রহ. (৯৭৭ হি.) বলেন,

[ فصل ] فيما يكره من الغزو، ومن يحرم أو يكره قتله من الكفار، وما يجوز قتالهم به ( يكره غزو بغير إذن الإمام أو نائبه ) تأدبا معه، ولأنه أعرف من غيره بمصالح الجهاد، وإنما لم يحرم؛ لأنه ليس فيه أكثر من التغرير بالنفوس وهو جائز في الجهاد  …

تنبيه: استثنى البلقيني من الكراهة صورا .

إحداها: أن يفوته المقصود بذهابه للاستئذان .

ثانيها: إذا عطل الإمام الغزو وأقبل هو وجنوده على أمور الدنيا كما يشاهد .

ثالثها: إذا غلب على ظنه أنه لو استأذنه لم يأذن له. -مغني المحتاج، دار الكتب العلمية 1415 هـ. ج: 6، ص: 24

“… ইমাম বা তার নায়েবের অনুমতি ছাড়া জিহাদ মাকরূহ। … তবে বুলকিনি রহ. কয়েক সূরতকে এর ব্যতিক্রম বলেছেন।

১. অনুমতি নিতে গেলে যদি উদ্দেশ্যই হাতছাড়া হয়ে যায়।

২. যখন ইমাম ও তার সৈন্য-সামন্ত জিহাদ বন্ধ করে দেয় এবং দুনিয়ামুখি হয়ে পড়ে; যেমনটি বর্তমানে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।

৩. যদি প্রবল ধারণা হয়, অনুমতি চাইলে ইমাম অনুমতি দেবেন না।”  -মুগনিল মুহতাজ: ৬/২৪

তিন. ইমাম কাউকে জিহাদের নির্দেশ দিলে

জিহাদ ফরজে আইন হওয়ার তৃতীয় ক্ষেত্র হল, ইমামুল মুসলিমীনের আদেশ। তিনি যাদেরকে জিহাদে যেতে নির্দেশ দিবেন, তাদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। স্বাভাবিক নিয়ম হল, মুসলমানদের জন্য কাফেরদের সঙ্গে বছরে অন্তত এক দুইবার জিহাদ করা ফরজে কেফায়া (অবশ্য এতে কারো কারো দ্বিমতও আছে)। যাতে তারা সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত থাকে এবং কখনো মুসলমানদের উপর আক্রমণের সাহস না করে। এ জিহাদ যেহেতু ফরজে কেফায়া, এজন্য সকলেরই এ জিহাদে বের হওয়া না হওয়ার এখতিয়ার থাকে। কিন্তু ইমামুল মুসলিমীন যদি এ জিহাদের জন্য কিছু মুসলমানকে নির্ধারিত করে দেন, তাহলে তাদের জন্য তখন জিহাদে বের হওয়া ফরজে আইন হয়ে যায়।

ক. আলকুলআনুল কারীম

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ. -التوبة: 38-41

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হল, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বের হও, তখন তোমরা যমীনের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখেরাতের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।” –সূরা তাওবা (০৯) : ৩৮-৪১

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (৩৭০ হি.) বলেন-

لو استنفرهم الإمام مع كفاية من في وجه العدو من أهل الثغور وجيوش المسلمين لأنه يريد أن يغزو أهل الحرب ويطأ ديارهم فعلى من استنفر من المسلمين أن ينفروا. اهـ -أحكام القرآن: 4/311

“শত্রুদের মুখোমুখি অবস্থানরত সীমান্ত প্রহরী এবং মুসলিম সৈন্যবাহিনী যথেষ্ট পরিমাণ থাকা সত্ত্বেও যদি হারবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এবং তাদের ভূমিতে আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে ইমামুল মুসলিমীন মুসলমানদেরকে যুদ্ধে বের হওয়ার আদেশ দেন, তাহলে তাদের উপর ফরজ, যুদ্ধে বের হওয়া।” -আহকামুল কুরআন : ৪/৩১১

ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১ হি.) বলেন-

إلا أن الإمام إذا عين قوما وندبهم إلى الجهاد لم يكن لهم أن يتثاقلوا عند التعيين ويصير بتعيينه فرضا على من عينه لا لمكان الجهاد ولكن لطاعة الإمام. اهـ -تفسير القرطبي: 8/142

“তবে ইমাম কোনো দলকে নির্ধারণ করে দিলে এবং জিহাদে যেতে আহ্বান করলে, তাদের জন্য পেছনে থেকে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইমামের নির্ধারণের দ্বারা, যাকে তিনি নির্ধারণ করেছেন, তার উপর জিহাদ ফরজ হয়ে যায়। এটা জিহাদ ফরজ হওয়ার কারণে নয়, ইমামের আনুগত্যের কারণে।” –তাফসীরে কুরতুবী : ৮/১৪২

খ. হাদীস শরীফ

হাদীসে এসেছে-

لا هجرة بعد الفتح، ولكن جهاد ونية، وإذا استنفرتم فانفروا. -صحيح البخاري: 2783، صحيح مسلم: 1353

“(মক্কা) বিজয়ের পর (মদীনায়) হিজরতের (ফরজ) বিধান রহিত হয়ে গেছে, কিন্তু জিহাদ ও নিয়ত রয়ে গেছে। যখন তোমাদেরকে জিহাদে বের হতে আহ্বান করা হবে, তোমরা বের হয়ে পড়।” –সহীহ বুখারী: ২৭৮৩, সহীহ মুসলিম: ১৩৫৩

এ হাদীসে যখনই জিহাদের আহ্বান আসবে, তখনই বেরিয়ে পড়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। কাফেররা আক্রমণ করে বসলে যেমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ আহ্বান এসে যায়, স্বাভাবিক অবস্থায় যখন জিহাদ ফরজে কেফায়া থাকে, তখন ইমামুল মুসলিমীনের পক্ষ থেকেও এ আহ্বান আসতে পারে। উভয় সূরতেই জিহাদে বেরিয়ে পড়তে হবে।

হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (৮৫২ হি.) বলেন

وفيه وجوب تعيين الخروج في الغزو على من عينه الإمام. اهـ -فتح الباري: 6/39

“উক্ত হাদীস একথার দলিল যে, ইমামুল মুসলিমীন যাকে যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত করবেন, তার জন্য যুদ্ধে বের হওয়া ফরজ।” -ফাতহুল বারী : ৬/৩৯

ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৫৬ হি.) বলেন-

وقوله: (وإذا استنفرتم فانفروا)؛ أي: طَلَب منكم الإمام النَّفير. وهو: الخروج إلى الغزو، فحينئذ يتعيَّن الغزو على من استُنفر بلا خلاف. اهـ -المفهم: 11/18

“আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘যখন তোমাদের বের হতে বলা হয় তখন তোমরা বের হও’। অর্থাৎ ইমাম যখন তোমাদেরকে জিহাদে বের হতে আদেশ করেন (তখন জিহাদে বের হয়ে যাও)। এমতাবস্থায় যাদের বের হতে বলা হবে, তাদের জন্য বের হওয়া ফরজে আইন। এতে কারো দ্বিমত নেই।” –আলমুফহিম : ১১/১৮

গ. ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (১৮৯ হি.) বলেন-

وإذا ندب الناس إلى ذلك فعليهم أن لا يعصوه بالامتناع من الخروج. اهـ -شرح السير الكبير: 1/189

“ইমাম যদি লোকদের জিহাদে বের হওয়ার আহবান করেন, তাহলে তাদের উপর আবশ্যক, জিহাদে বের হওয়া এবং ইমামের অবাধ্য না হওয়া।” –শরহুসসিয়ারিল-কাবির : ১/১৮৯

আল্লামা আবুল কাসিম গারনাতি মালেকী রহ. (৭৪১ হি.) বলেন-

وَيتَعَيَّن لثَلَاثَة أَسبَاب (أَحدهَا) أَمر الإِمَام فَمن عينه الإِمَام وَجب عَلَيْهِ الْخُرُوج. اهـ -القوانين الفقهية: 1/97

“জিহাদ তিন কারণে ফরজে আইন হয়। তন্মধ্যে একটি হল, ইমাম কর্তৃক জিহাদে বের হওয়ার নির্দেশ প্রদান। ইমাম জিহাদে বের হওয়ার জন্য যাকে নির্দিষ্ট করবেন, তার জন্য জিহাদে বের হওয়া ফরজ।” –আলকাওয়ানিনুল ফিকহিয়্যাহ: ১/৯৭

আল্লামা শামসুদ্দীন ইবনে কুদামা মাকদিসি রহ. (৬৮২ হি.) বলেন-

إذا استنفر الإمام قوما لزمهم النفير معه. اهـ -الشرح الكبير: 10/368

“ইমাম কোনো কওমকে জিহাদে বের হতে বললে, ইমামের সঙ্গে তাদের বের হওয়া ফরজ।”

–আশশরহুল কাবীর: ১০/৩৬৮

বর্তমান বাংলাদেশের মুসলিমদের উপর জিহাদের বিধান

বাংলাদেশসহ বর্তমান বিশ্বের সকল সক্ষম মুসলিমের উপর জিহাদ ফরজে আইন। কারণ বর্তমান সমগ্র বিশ্বেই আজ মুসলিমরা কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত। মুসিলিমরা যখন আক্রান্ত হয়, তখন তা প্রতিহত করার জন্য প্রথমে আক্রান্তদের উপর এবং তারা প্রতিহত করতে সক্ষম না হলে কিংবা প্রতিহত না করলে, তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর, তারপর তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর; এভাবে ক্রমান্বয়ে সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলিমের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। যেমনটি উপরের আলোচনায় আমরা ফুকাহায়ে কেরামের বক্তবগুলো লক্ষ করেছি। সালাফ ও খালাফের অনেক ফকিহই এবিষয়ে ইজমা বর্ণনা করেছে।

ইমাম জাসসাস রহ. (মৃত্যু: ৩৭০ হি.) বলেন,

ومعلوم في اعتقاد جميع المسلمين أنه إذا خاف أهل الثغور من العدو، ولم تكن فيهم مقاومة لهم فخافوا على بلادهم وأنفسهم وذراريهم أن الفرض على كافة الأمة أن ينفر إليهم من يكف عاديتهم عن المسلمين، وهذا لاخلاف فيه بين الأمة إذ ليس من قول أحد من المسلمين إباحة القعود عنهم حتى يستبيحوا دماء المسلمين و سبي ذراريهم. اهـ  -احكام القرآن: 4/312

“সকল মুসলমানের প্রসিদ্ধ আকীদা, যখন সীমান্তবর্তী মুসলমানেরা শত্রুর আশঙ্কা করে; আর তাদের মাঝে শত্রু প্রতিরোধের ক্ষমতা বিদ্যমান না থাকে; ফলে তারা নিজ পরিবার-পরিজন, দেশ ও জানের ব্যাপারে শঙ্কাগ্রস্ত হয়, তখন পুরো উম্মাহর উপর ফরজ হয়ে যায়, শত্রুর ক্ষতি থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে পারে পরিমাণ লোক তাদের সাহায্যে জিহাদে বের হওয়া। এবিষয়ে উম্মাহর মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। এমন কথা কোনো মুসলমানই বলেনি যে, শত্রুরা মুসলমানদের রক্ত প্রবাহিত করবে, তাদের পরিবার-পরিজনকে বন্দী করবে, আর মুসলমানদের জন্য তাদেরকে সাহায্য না করে বসে থাকা বৈধ হবে।” -আহকামুল কুরআন: ৪/৩১২

শামসুল আইম্মা সারাখসী রহ. (মৃত্যু: ৪৯০ হি.) বলেন,

فأما إذا جاء النفير عاما فقيل لأهل مدينة: قد جاء العدو يريدون أنفسكم أو ذراريكم أو أموالكم، فلا بأس بأن يخرج بغير إذن والديه؛ لأن الخروج في مثل هذه الحالة فرض عين على كل واحد، قال الله تعالى {انفروا خفافا وثقالا} [التوبة: 41، وما يفوته بترك هذه الفريضة لا يمكنه استدراكه، وما يفوته بالخروج بغير إذن الوالدين يمكنه استدراكه بعد هذا؛ فيشتغل بما هو الأهم، ولأن الضرر في تركه الخروج أعم، فإن ذلك يتعدى إليه وإلى والديه وإلى غيرهم من المسلمين، ولأنه لا يحل لوالديه أن ينهياه عن هذا الخروج، فيكون له أن يخرج ليسقط به الإثم عنهما، ولا طاعة لهما عليه فيما كانا عاصيين فيه. اهـ -شرح السير الكبير: 1/199

“আর যখন নফিরে আমের অবস্থা সৃষ্টি হয়, যেমন কোনো শহরবাসীকে বলা হল, ‘শত্রু এসে পড়েছে; তোমাদের জান, মাল ও পরিবার পরিজনের উপর আগ্রাসন চালাতে চাচ্ছে, তখন সন্তান তার পিতা মাতার অনুমতি ছাড়া জিহাদে বের হতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা এঅবস্থায় জিহাদে বের হওয়া প্রত্যেকের উপর ফরজে আইন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা হালকা-ভারী উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বের হও।’ (সূরা তাওবা: ৪১)। তাছাড়া এই ফরজ ছেড়ে দেয়ার দ্বারা যে ক্ষতি হবে, তা আর পূরণ করা সম্ভব হবে না; কিন্তু পিতা মাতার অনুমতি ছাড়া বের হওয়ার দ্বারা যা ছুটবে, তা পরে পূরণ করে নেয়া যাবে। তাই যেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেটাই করবে। তাছাড়া জিহাদ ছেড়ে দেয়ার ক্ষতি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ ক্ষতি তার ব্যক্তি থেকে পিতা মাতা এবং অন্যান্য সকল মুসলমান পর্যন্ত গড়াবে। এ সময় জিহাদে বের হতে নিষেধ করাও তার পিতা মাতার জন্য জায়েয নয়। তাই তার বের হওয়ার দ্বারা যেন পিতা মাতা (ফরজ আদায়ে বাধা দানের) গুনাহ থেকে রক্ষা পায়, এজন্যও বের হতে হবে। আর যেখানে তারা (আল্লাহ তাআলার) নাফরমানি করবে, সেখানে তাদের আনুগত্য করা সন্তানের দায়িত্ব নয়।” -শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ১/১৯৯

ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.) বলেন- 

وقد تكون حالة يجب فيها نفير الكل، وهي: الرابعة- وذلك إذا تعين الجهاد بغلبة العدو على قطر من الأقطار، أو بحلوله بالعقر، فإذا كان ذلك وجب على جميع أهل تلك الدار أن ينفروا ويخرجوا إليه خفافا وثقالا، شبابا وشيوخا، كل على قدر طاقته، من كان له أب بغير إذنه ومن لا أب له، ولا يتخلف أحد يقدر على الخروج، من مقاتل أو مكثر. فإن عجز أهل تلك البلدة عن القيام بعدو هم كان على من قاربهم وجاور هم أن يخرجوا على حسب ما لزم أهل تلك البلدة، حتى يعلموا أن فيهم طاقة على القيام بهم ومدافعتهم. وكذلك كل من علم بضعفهم عن عدو هم وعلم أنه يدركهم ويمكنه غياثهم لزمه أيضا الخروج إليهم، فالمسلمون كلهم يد على من سواهم، حتى إذا قام بدفع العدو أهل الناحية التي نزل العدو عليها واحتل بها سقط الفرض عن الآخرين. ولو قارب العدو دار الإسلام ولم يدخلوها لزمهم أيضا الخروج إليه، حتى يظهر دين الله وتحمى البيضة وتحفظ الحوزة ويخزى العدو. ولا خلاف في هذا. اهـ -تفسير القرطبي: 8/151-152

“কোনো কোনো অবস্থায় সকলের উপরই জিহাদে বের হওয়া ফরজ হয়ে যায়। … উক্ত অবস্থা হল- যখন কোনো (মুসলিম) ভূখণ্ডে শত্রু দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলার কারণে বা কোনো ভূখণ্ডে শত্রু ঢুকে পড়ার কারণে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় উক্ত ভূখণ্ডের হালকা-ভারি, যুবক-বৃদ্ধ সকল অধিবাসীর উপর ফরজ- শত্রুর মোকাবেলায় জিহাদে বেরিয়ে পড়া। প্রত্যেকে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী শত্রু প্রতিহত করবে। যার পিতা নেই সে তো যাবেই, যার পিতা আছে সেও পিতার অনুমতি ছাড়াই বেরিয়ে পড়বে। যুদ্ধ করতে সক্ষম কিংবা (অন্তত মুজাহিদদের) দল ভারি করতে সক্ষম, এমন কেউ বসে থাকবে না। ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম হয়, তাহলে উক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মতো তাদের নিকটবর্তী এবং প্রতিবেশীদের উপরও আবশ্যক- জিহাদে বের হয়ে পড়া; যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারবে যে, এখন তাদের শত্রু প্রতিহত করার এবং তাদেরকে বিতাড়িত করার সামর্থ্য অর্জিত হয়েছে। তেমনি যে ব্যক্তিই জানতে পারবে যে, তারা শত্রু প্রতিহত করতে অক্ষম এবং সে বুঝতে পারবে- আমি তাদের কাছে পৌঁছতে এবং তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম; তার উপরই আবশ্যক সাহায্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। কারণ, সকল মুসলমান তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে এক হস্তের ন্যায়। তবে যে এলাকায় শত্রু আগ্রাসন চালিয়েছে, তারা নিজেরাই যদি শত্রু প্রতিহত করতে পারে, তাহলে অন্যদের উপর থেকে ফরজ রহিত হয়ে যাবে। যদি এমন হয় যে, শত্রুরা দারুল ইসলামের নিকটবর্তী হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও দারুল ইসলামে আগ্রাসন চালায়নি, তাহলেও তাদের উপর ফরজ শত্রু প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। যাতে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী থাকে, ইসলামী ভূখণ্ড সংরক্ষিত থাকে এবং শত্রু অপদস্থ ও পরাস্ত হয়। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।” -তাফসীরে কুরতুবী: ৮/১৫১-১৫২

তিনি আরো বলেন,

قال ابن عطية: والذي استمر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين. اهـ -تفسير القرطبي: 3/38

“ইবনে আতিয়্যাহ্ রহ. বলেন, একথার উপর ইজমা চলে আসছে যে, উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরজে কেফায়া। যদি মুসলমানদের একাংশ তা আদায় করে, অন্যদের থেকে এর দায়িত্ব-ভার সরে যাবে। তবে শত্রু যদি কোনো ইসলামী ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালায়, তখন তা ফরজে আইন হয়ে যায়।” -তাফসীরে কুরতুবী: ৩/৩৮

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃত্যু: ৭২৮ হি.) বলেন,

وأما قتال الدفع فهو أشد أنواع دفع الصائل عن الحرمة والدين واجب إجماعا، فالعدو الصائل الذي يفسد الدين والدنيا لا شيء أوجب بعد الإيمان من دفعه، فلا يشترط له شرط  بل يدفع بحسب الإمكان، وقد نص على ذلك العلماء أصحابنا وغيرهم.اهـ -الفتاوى الكبرى: 4/608

“প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ মুসলমানদের দ্বীন ও সম্মানের উপর আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করার সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ স্তর, যা সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। যে আগ্রাসী শক্তি মুসলমানদের দ্বীন-দুনিয়া ধ্বংস করে, ঈমানের পর তাকে প্রতিরোধের চেয়ে গুরুতর ফরজ দ্বিতীয় আরেকটি নেই। এই ক্ষেত্রে কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়, বরং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের ও অন্যান্য (মাযহাবের) ফুকাহায়ে কেরাম সকলেই তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।” -আলফাতাওয়াল কুবরা: ৪/৬০৮

সংক্ষিপ্তকরণের জন্য আমরা এখানে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করলাম। অন্যথায় এই মাসআলায় সালাফ থেকে খালাফ, কোনো একজন নির্ভরযোগ্য ফকিহেরও দ্বিমত নেই। এটি মুসলিম উম্মারহ সর্বসম্মত মাসআলা। সকল মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহের কিতাবেই মাসআলাটি আছে।

সতর্কতা:

তবে জিহাদ মানেই না জেনে না বুঝে যখন তখন যেখানে সেখানে এলোপাতাড়ি কিছু আক্রমণ করে দেয়া নয়। এজন্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট মাসআলা মাসায়েল আছে, শরীয়াহ’র সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। জিহাদের জন্য প্রথমে জিহাদের প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করতে হবে। তারপর শরীয়াহ ও সমর বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে শরীয়াহ’র নীতিমালা অনুসারে জিহাদের কাজ আঞ্জাম দিতে হবে।

জিহাদের সামর্থ্য না থাকলে করণীয়

উল্লেখ্য, জিহাদ ফরজে আইন বললে কেউ কেউ মনে করেন, তাহলে আমরা যে অবস্থায়ই থাকি না কেন, এই মুহূর্তেই আমাদেরকে জিহাদে বেরিয়ে পড়তে হবে; এমনকি আমাদের যদি শত্রুর মোকাবেলা করার সমর্থ্য না থাকে, তবুও বের হতেই হবে এবং বর্তমান সামর্থ্যে যতটুকু সম্ভব, তাতেই কিছু একটা করে ফেলতে হবে। কারণ তা ফরজে আইন। এই ধারণা যেমন চলমান জিহাদের সমর্থক শিবিরে আছে, তেমনি বিরোধী শিবিরেও আছে। এই ধারণার ফলে বাস্তবে বেশ কিছু সমস্যাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমর্থক শিবিরে যারা এমন ধারণা লালন করেন, তারা এমন কিছু কাজ করে বসেন, যা প্রকৃত অর্থে জিহাদের জন্য ক্ষতিকর। তাদের বাস্তবতা বিবর্জিত ও অপরিণামদর্শী এসব কর্মকাণ্ডের ফলে জিহাদের বদনাম যেমন হয়, তেমনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে জিহাদি কার্যক্রম প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। একইভাবে তারা যখন জিহাদের নামে এমন কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের দাওয়াত দেন, স্বভাবতই তা তারই মতো আরেক অপরিণামদর্শী না হলে বোধগম্য মনে করতে পারেন না। ফলে এই ‘মাদউ’রা তার ভুল দাওয়াতের ভিত্তিতে জিহাদ ও মুজাহিদদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেন এবং যারা সঠিক পদ্ধতির জিহাদের কথা বলতে চান, তাদের কথাও তারা শুনতে রাজি হন না।

আর চলমান জিহাদ বিরোধী শিবিরে যারা এমন ধারণা লালন করেন যে, জিহাদ ফরজ হওয়া মানেই নগদে শত্রুর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়া এবং কিছু একটা করে ফেলা, তারা যেহেতু দেখেন, এই মুহূর্তে কার্যত জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই, সুতরাং তারা মনে করেন, বর্তমানে জিহাদ ফরজ এই কথাও বলা যাবে না। আমাদেরকে এখন জিহাদি সকল কার্যক্রম থেকে হাত পা গুটিয়ে দ্বীনের অন্য কাজগুলোই করে যেতে হবে। জিহাদের বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। এই ধারণার ফলে তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করা শরীয়তের হুকুম তা থেকেও বিরত থাকেন। তারা মনে করেন, আমাদের যেহেতু শত্রুর মোকাবেলা করার সামর্থ্য নেই, সুতরাং আমাদের কিছুই করার নেই। এজন্য তারা সময়ের দাবি, হেকমত ও শরীয়তের মানশা মনে করেই অজ্ঞতাবশত চলমান সহীহ পদ্ধতির জিহাদেরও বিরোধিতা করেন।

অবশ্য তাদের কেউ কেউ প্রস্তুতির কথা বলেন এবং দাবিও করেন, আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। কিন্তু প্রস্তুতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ এমনভাবে করেন, যার সঙ্গে জিহাদ ও কিতালের কোনো সম্পর্ক নেই; যদিও জিহাদ ও কিতালের উদ্দেশ্য সামনে রেখে করলে হয়তো তাদের অনেক কাজকেই প্রস্তুতি হিসেবে গণ্য করা যেত! কিন্তু বস্তুত তাদের ভবিষ্যত হাজার বছরের কর্মতালিকা ও কর্মপরিকল্পনাতেও জিহাদ ও কিতালের নাম গন্ধ নেই। যা আছে তা হল জিহাদ ও কিতালের বিরোধিতা, তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা। তাদের দৃষ্টিতে জিহাদ ও কিতালের নাম নিলেও যেহেতু শত্রুরা নারাজ হয়, সুতরাং আমাদের এই দুর্বলতার মুহূর্তে তাদেরকে নারাজ করা যাবে না। তাগূত ও কাফের মুরতাদদের দৃষ্টিতে ভাল থেকে তাদের আস্থা অর্জন করার জন্য যা যা করা দরকার, এখন আমাদেরকে তাই করতে হবে। বর্তমানে দ্বীনের কাজ করতে হলে, তাগূতের কাছে নিজেকে এতটাই ‘পরিচ্ছন্ন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে যে, জিহাদের নামটিও মুখে উচ্চারণ করা যাবে না; বরং দুশমনরা যেন কোনো ছুতো নাতায় আমার প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিও দিতে না পারে, এজন্য আগে বেড়ে ‘জঙ্গীবাদ’ বিরোধী কিছু কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় থাকতে হবে। এজন্য তারা জিহাদ ও কিতালের আলোচনা করা, জিহাদ ও মুজাহিদদের পক্ষে কথা বলা, কিতালের ফতোয়া দেয়া, মাজলুমের পক্ষে কথা বলা, এমনকি জিহাদ ও কিতালের ইলম চর্চাকেও হেকমত ও প্রজ্ঞাপরিপন্থী বলতে দ্বিধা করেন না। যেসব ‘উলামায়ে সূ’ জিহাদ ও কিতালের বিরুদ্ধে কথা বলে, ঈমান বিক্রি করে জিহাদ ও কিতালের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়, মুসলিমদেরকে দুমুঠো ভাতের নিশ্চয়তার জন্য তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকার হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ফতোয়া দেয়, রাঈসুল কুফফার ট্রাম্পকে মুসলিমদের কল্যাণকামী বলে দাবি করে, ইজরাইলের বিরুদ্ধে কিতালকে হারাম বলে ফতোয়া দেয় এবং যারা ইজরাইলের বিরুদ্ধে কিতাল করে তাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়, তাদের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলাকেও তারা ইলমের আমানত রক্ষা ও সময়ের ফরিজা আদায়ের জন্য জরুরি মনে করেন না।

দুটি ধারণাই ভুল

বস্তুত দু’পক্ষের ধারণাই ভুল। এখানে শরীয়তের নির্দেশনা হল, জিহাদ ফরজ হওয়ার পর যদি শত্রুর মোকবেলা করার সক্ষমতা থাকে, তাহলে অবশ্যই তাৎক্ষণিক বেরিয়ে পড়া এবং শত্রুর মোকাবেলা করা ফরজ। যেমন উপরোক্ত আলোচনায় ফুকাহায়ে কেরামের অনেকগুলো উদ্ধৃতিতে আমরা দেখেছি, যেখানে তাঁরা বলেছেন, শত্রু যদি কোনো অঞ্চলে মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে, তাহলে ওই অঞ্চলের মুসলিমদের উপর তাৎক্ষণিক তাদের মোকাবেলা করা ফরজে আইন হয়ে যায়। গোলাম তার মনিবের অনুমতি ব্যতীত, স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ব্যতীত এবং সন্তান পিতা মাতার অনুমতি ব্যতীত বেরিয়ে পড়বে। এটি মূলত ওই সময়ের কথা, যখন তাদের মোকাবেলা করার সামর্থ্য থাকবে।

পক্ষান্তরে মুসলিমদের যদি জিহাদের সামর্থ্য না থাকে, তাহলে সামর্থ্য অর্জন করা পর্যন্ত জিহাদ বিলম্বিত করার সুযোগ আছে। ফুকাহায়ে কেরামের অনেকেই তা পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া সামর্থ্যের বাইরে শরীয়ত কোনো বিধানই বান্দার উপর আরোপ করে না। এটি শরীয়তের মানসূস ও সর্বস্বীকৃত একটি নীতি। আমরা সংক্ষেপে ফকীহদের দু’একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি।

كَمَا يَجِبُ عَلَى الْمُعْسِرِ السَّعْيُ فِي وَفَاءِ دَيْنِهِ وَإِنْ كَانَ فِي الْحَالِ لَا يُطْلَبُ مِنْهُ إلَّا مَا يَقْدِرُ عَلَيْهِ وَكَمَا يَجِبُ الِاسْتِعْدَادُ لِلْجِهَادِ بِإِعْدَادِ الْقُوَّةِ وَرِبَاطِ الْخَيْلِ فِي وَقْتِ سُقُوطِهِ لِلْعَجْزِ فَإِنَّ مَا لَا يَتِمُّ الْوَاجِبُ إلَّا بِهِ فَهُوَ وَاجِبٌ بِخِلَافِ الِاسْتِطَاعَةِ فِي الْحَجِّ وَنَحْوِهَا فَإِنَّهُ لَا يَجِبُ تَحْصِيلُهَا لِأَنَّ الْوُجُوبَ هُنَا لَا يَتِمُّ إلَّا بِهَا. – مجموع الفتاوى:28/ 259

“যেমনিভাবে অভাবী ঋণগ্রস্তের উপর ওয়াজিব, ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করা, যদিও নগদে তার সামর্থ্যের চেয়ে অতিরিক্ত পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হবে না এবং সামর্থ্য না থাকার কারণে জিহাদ বিলম্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেমনিভাবে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ, শক্তি ও ঘোড়া প্রস্তুত করা ওয়াজিব। কারণ ওয়াজিব যা ব্যতীত আদায় করা যায় না, তাও ওয়াজিব। পক্ষান্তরে হজ্জ ইত্যাদির সামর্থ্য। এখানে সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করা ওয়াজিব নয়। কারণ, এখানে সামর্থ্য ব্যতীত বিধানটি ওয়াজিবই হয় না।” –মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/২৫৯

ইমাম আবুল হাসান তুসূলি রহ. (১২৫৮ হি.) বলেন,

وبهذا نعلم: أن محل كون الجهاد فرض كفاية: إذا لم يكن العدوّ أخذ شيئاً من بلاد المسلمين، وإلاّ كان فرض عين- على ما مرّ تفصيله قريباً- إذ هو: نازل بهم دائماً ما دام آخذاً لثغورهم وبلادهم، فيجب على أئمة وقته، وعلى من يليهم إن عجزوا، على من بعدهم إن ماتوا أو عصوا وتركوا أن يخرجوهم ممّا استولوا عليه، ولا يحلّ لهم تركهم، إلاّ بقدر ما [48/أ] يتجهّزون، ويعاودون ذلك المرة بعد المرّة، حتى يفتحها الله عليهم. اهـ -أجوبة التسولي: 285

“উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, জিহাদ ফরযে কেফায়া হওয়ার বিধান ওই সময় প্রযোজ্য, যখন মুসলমানদের ভূমির কোনো একটি অংশও কাফেরদের দখলে না থাকবে। নতুবা জিহাদ ফরযে আইন; যেমনটি ইতিমধ্যে আমরা বিশ্লেষণ করেছি। কেননা যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম ভূমি ও তাদের সীমান্তগুলো কাফেরদের দখলে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তো কাফেররা মুসলিম ভূমিতেই অবতরণ করে রয়েছে, (আর কাফেররা মুসলিম ভূমি কিংবা তার সীমান্তে অবতরণ করলে আলেমদের ঐক্যমতে জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায়)। তাই সমকালীন শাসকদের উপর, আর তারা অক্ষম হলে কিংবা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে না করলে, পরবর্তী শাসকবর্গের উপর ফরয, কাফেরদেরকে দখলকৃত ভূমি হতে বিতাড়িত করা। তাদের জন্য কাফেরদের ছেড়ে রাখা বৈধ হবে না। কেবল ততটুকু পরিমাণ ছেড়ে রাখা যাবে, যতটুকু প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন। এরপর তারা একের পর এক আক্রমণ করতে থাকবে, যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা তাদের বিজয় দান করেন।” -আজবিবাতুত তুসূলী: ২৮৫

শায়খ সালিহ আলফাওযান রহ. বলেন,

أما إذا كان المسلمون لا يستطيعون قتال الكفار فهم يؤجلون الجهاد إلى أن يقدروا. -الجهاد وضوابطه الشرعية، ص:47.

“মুসলিমরা যদি কাফেরদের সঙ্গে কিতালের সামর্থ্য না রাখে, সামর্থ্য হওয়া পর্যন্ত কিতাল বিলম্বিত করবে।”

তবে এই সুযোগ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য!

তবে জিহাদ ফরজ হওয়ার পর তা বিলম্বিত করার এই সুযোগটা শুধুই প্রস্তুতি গ্রহণ ও সামর্থ্য অর্জন করার জন্য, বসে থাকার জন্য নয়। যে সামর্থ্যের অভাবে শত্রুর মোকাবেলা করা যাচ্ছে না, এসময় তা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ফরজ।

ইমাম আবুল হাসান তুসূলি রহ. (১২৫৮ হি.) বলেন,

قال- سيدي- “العربي الفاسي”: (لا يبرأ المسلمون من عهدة المدافعة، ونصرة من عجز، إلاّ إذا استفرغوا الوسع في إزاحة الكفّار من المدائن التي أخذوها للمسلمين، (فلو نازلوها فلم تفتح، وجب عليهم معاودتها كلما أمكنهم ذلك، حتى يفتحها الله عليهم، ولا فرق في ذلك بين المدائن المأخوذة للمسلمين) 6 حديثاً أو قديماً).

لأن الوجوب والتعيين متعلّق بالمسلمين، لا بقيد زمان، ولا مكان، إلاّ أنه: يتعيّن على الحاضر زماناً ومكاناً،- على ما مرّ ترتيبه- فانا (فإذا) لم يفعل لعذر، أو لغير عذر، وجب على غيره ممّن يليه.

كما قاله “ابن عرفة”، عن “المازري”: (وترك من تقدم من أئمة المسلمين مدائن الإسلام في أيدي الكفّار، هم بذلك في محل العصيان، لا في محل الاقتداء والاستنان، وقديماً قيل: “أسلك سبيل الهدى، ولا يضرّك قلّة السالكين، واترك طريق الردى، ولا يضرّك كثرة الهالكين”) 1 اهـ كلامه. – أجوبة التسولي عن مسائل الأمير عبد القادر في الجهاد، ص: 279-280

“সাইয়িদি ফাসি রহ. বলেছেন, মুসলিমরা অক্ষমদের সাহায্য ও শত্রু প্রতিহত করার দায় থেকে কেবল তখনই মুক্ত হতে পারবে, যখন তারা মুসলিমদের ওই সকল শহর থেকে কাফেরদের বিতাড়িত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, যেগুলো কাফেররা দখল করে নিয়েছে। … চাই তারা মুসলিমদের এই শহরগুলো নতুন করে দখল করুক বা আগে দখল করে থাকুক।

কারণ ফরজে আইনটা মুসলিমদের সঙ্গে সম্পৃক্ত; স্থান ও কালের শর্তমুক্ত। হ্যাঁ, ইতিপুর্বে আলোচিত বিন্যাস অনুসারে তা আদায় করবে তারাই, যারা স্থান কালের বিচারে উপস্থিত। তারা যদি ওজরে কিংবা বিনা ওজরে না করে, যারা তাদের নিকটবর্তী, তাদের উপর ফরজ।

যেমন ইবনে আরাফা রহ. মাযুরি রহ. এর উদ্ধৃতিতে বলেছেন, পূর্ববর্তী শাসকদের জন্য ইসলামী শহরগুলো কাফেরদের হাতে ছেড়ে রাখার ক্ষেত্রে তারা গুনাহগার। এখানে তাদেরকে আদর্শ বানানো বা তাদের অনুসরণ করার সুযোগ নেই। বহুকাল আগেই বলা হয়েছে, তুমি সঠিক পথে চল। এপথের পথিক কম হওয়া তোমার ক্ষতি করবে না। বিভ্রান্ত পথ ছাড়। সে পথে ধ্বংসপ্রাপ্তদের আধিক্যও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।” –আজবিবাতুত তুসূলি: ২৭৯-২৮০

সারকথা তিনটি:

এক. জিহাদ তিন অবস্থায় ফরজে আইন

. জিহাদের কাতারে উপস্থিত হলে জিহাদ ফরজে আইন। শরয়ী ওজর ছাড়া পলায়ন করা হারাম ও কবীরা গুনাহ।

. নাফিরে আম তথা শত্রু কর্তৃক মুসলিম ভূখণ্ড দখল বা আক্রান্ত কিংবা আক্রান্তের উপক্রম হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায় এবং তারা যথেষ্ট না হলে বা না করলে পর্যায়ক্রমে সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। একইভাবে কোন মুসলিম কাফেরদের হাতে বন্দী হলে তাকে মুক্ত করার জন্যও এক পর্যায়ে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়।

. ইমামুল মুসলিমীন যাকে বা যাদেরকে জিহাদে বের হওয়ার নির্দেশ দেন, তাদের জন্য জিহাদে বের হওয়া ফরজে আইন।

দুই. বর্তমান বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলিমের উপর জিহাদ ফরজে আইন

বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই মুসলিমরা আক্রান্ত। মুসলিমদের অসংখ্য ভূমি কাফেরদের দখলকৃত। লক্ষ লক্ষ মুসলিম কাফেরদের কারাগারে অবরুদ্ধ ও অমানবিকভাবে নির্যাতিত। সুতরাং জিহাদ ফরজে আইন হওয়ার দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি উপস্থিত হওয়ায়, বর্তমান সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলিমের উপর জিহাদ ফরজে আইন। সশরীরে, মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে, অর্থ দিয়ে, দল ভারি করে; মোটকথা  যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, তার উপর ততটুকু দিয়েই অংশ গ্রহন করা ফরজ।

তিন. সামর্থ্য নেই বিধায় বসে থাকলে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না

সুতরাং এঅবস্থায় যারা সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টায় রত থাকবে, তারা ফরজের দায় থেকে মুক্তি পাবে। পক্ষান্তরে জিহাদের সামর্থ্য নেই বলে যারা সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টাও করবে না, তারা ফরজের দায় থেকে মুক্তি পাবে না।

فقط، والله سبحانه وتعالى أعلم، وعلمه أتم وأحكم، وصلى الله تعالى على نبيه وسلم.

 

আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

০২-০২-১৪৪২ হি.

২০-০৯-২০২০ ঈ.

আরো পড়ূন
জিহাদের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা কি সর্বাবস্থায়ই ফরয?

বর্তমানে কী কী কারণে জিহাদ ফরযে আইন?

বর্তমানে কি জিহাদ ফরজে আইন?

Related Articles

Back to top button