রিদ্দাশায়খ হাবিবুল্লাহ নাদিম

মুরতাদ ও জিন্দিক

মুরতাদ ও জিন্দিক

শায়খ হাবিবুল্লাহ নাদিম হাফিজাহুল্লাহ

আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করার পর তাদেরকে মুমিন ও কাফের এ দু’ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ

তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের এবং কেউ মুমিন।[1]

‘কাফের’ শব্দটি ব্যাপক। শরিয়তের পরিভাষায় ‘কাফের’ এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনীত দীনের স্বীকৃত ও অকাট্য কোনো বিষয়কে অস্বীকার করে।[2]

সংজ্ঞার এই ব্যাপকতার মধ্যে মুরতাদ ও জিন্দিকও অন্তর্ভুক্ত। কারণ, ‘মুরতাদ’ ও ‘জিন্দিক’ ইসলামের স্বীকৃত কোনো না কোনো বিষয়কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অস্বীকার করে। কিন্তু সাধারণ কাফেরের সঙ্গে এদের কিছুটা তফাৎ রয়েছে। তাই এদের সংজ্ঞা ও বিধান দুটোই আলাদা। সাধারণভাবে ‘কাফের’ শব্দটি বলা হলে এর দ্বারা ‘কাফেরে আসলি’ তথা ‘জন্মসূত্রে কাফের’ উদ্দেশ্য হয়। পক্ষান্তরে ‘মুরতাদ’ ও ‘জিন্দিক’ বোঝাতে হলে তাদেরকে আলাদা নামে নামকরণ করা হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে ‘মুরতাদ’ ও ‘জিন্দিক’ কারা?

মুরতাদ ও জিন্দিকের পরিচয়  

যদি কোনো মুসলমান কোনো ধরনের কুফরে –তা কথা হোক কিংবা কাজ – লিপ্ত হয় এবং এ কারণে তার ঈমান ভেঙে যায়, তাহলে ওই ব্যক্তিকে বলা হয় ‘মুরতাদ’।[3] আর যদি কোনো ব্যক্তি নিজেকে বাহ্যত মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু অন্তরে কুফরি আকিদা-বিশ্বাস লালন করে। এমন ব্যক্তিকে বলা হয় ‘জিন্দিক’।[4] এমন ব্যক্তিরা কুরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা করে তাদের কুফরের পক্ষে দলিল দেয়ার অপচেষ্টাও করে থাকে।

মুরতাদের বিধান

মুরতাদের বিধান হলো, তাকে তিন দিনের অবকাশ দেওয়া হবে। এ তিন দিনের মধ্যে তার সংশয় দূর করার চেষ্টা করা হবে। যদি এ সময়ের মধ্যে সে তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়, অতীত কৃতকর্মের জন্য তাওবা করে এবং ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ মুসলমানরূপে জীবন যাপন করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে, তাহলে তার তাওবা গ্রহণ করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর যদি তাওবা করতে অস্বীকৃতি জানায় বা তাওবা করা থেকে বিরত থাকে, তাহলে তার ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। জুমহুর ইমামগণের মতানুসারে মুরতাদ পুরুষ হোক বা নারী—উভয়ের ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য হবে। তবে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতানুসারে মুরতাদ নারী হলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হবে; হত্যা করা হবে না।[5]

জিন্দিকের বিধান 

জিন্দিকও মুরতাদের মতো ‘ওয়াজিবুল কতল’ (হত্যাযোগ্য অপরাধী)। তবে জিন্দিকের বিষয়টি মুরতাদের তুলনায় আরও গুরুতর। জিন্দিক তাওবা করলে তার তাওবা কবুল করা হবে কি না—এ নিয়ে ফকিহগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম শাফেয়ি রহ.-এর মতে, জিন্দিক তাওবা করলে তাকে আর হত্যা করা হবে না। ইমাম মালিক রহ.-এর মতে, জিন্দিকের তাওবার কোনও মূল্য নেই। সর্বাবস্থায় সে ‘ওয়াজিবুল কতল’- তাকে অবশ্যই হত্যা করা হবে। ইমাম আহমদ রহ. থেকে দু-ধরনের মতই বর্ণিত রয়েছে। হানাফি ওলামায়ে কেরামের স্বীকৃত অভিমত হলো, জিন্দিক গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে নিজ থেকে তাওবা করে ফেললে তার তাওবা গৃহীত হবে এবং দণ্ড ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যদি তাকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে আর তার তাওবা গৃহীত হবে না এবং তার দণ্ডও ক্ষমা করা হবে না।[6]

 

 

 

 

[1] সুরা তাগাবুন : ৬৪/২

[2] وَالْكُفْرُ شَرْعًا: هُوَ إِنْكَارُ مَا عُلِمَ ضَرُورَةً أَنَّهُ مِنْ دِينِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَإِنْكَارِ وُجُودِ الصَّانِعِ، وَنُبُوَّتِهِ عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسِّلاَمُ، وَحُرْمَةِ الزِّنَا وَنَحْوِ ذَلِكَ. – المنثور في القواعد 3 / 84.

[3] الرِّدَّةُ فِي الاِصْطِلاَحِ: هِيَ كُفْرُ الْمُسْلِمِ بِقَوْلٍ صَرِيحٍ أَوْ لَفْظٍ يَقْتَضِيهِ أَوْ فِعْلٍ يَتَضَمَّنُهُ. – لسان العرب، والصحاح والخرشي 8 / 62، والقليوبي 4 / 174.

[4] الزَّنْدَقَةُ عِنْدَ جُمْهُورِ الْفُقَهَاءِ إِظْهَارُ الإِْسْلاَمِ وَإِبْطَانُ الْكُفْرِ، فَالزِّنْدِيقُ هُوَ مَنْ يُظْهِرُ الإِْسْلاَمَ وَيُبْطِنُ الْكُفْرَ. قَال الدُّسُوقِيُّ: وَهُوَ الْمُسَمَّى فِي الصَّدْرِ الأَوَّل مُنَافِقًا، وَيُسَمِّيهِ الْفُقَهَاءُ زِنْدِيقًا. – الموسوعة الفقهية الكويتية: لفظ زَنْدَقَةٌ.

[5] আপ কে মাসায়েল আওর উনকা হল : ১/৪৬

[6] প্রাগুক্ত

Back to top button