بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين
قال الله تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়ামকে ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল; যাতে তোমরা মুত্তাকী হও।” [সূরা বাকারা ০২: ১৮৩]
سبحانك لا علم لنا إلا ما علمتنا إنك أنت العليم الحكيم.
শাবান মাস চলছে। পবিত্র মাহে রমযান আমাদের মাথার উপর ছায়া ফেলছে আলহামদুলিল্লাহ। রমযান আগমনের মূল উদ্দেশ্য কী, তা স্বয়ং রাব্বুল আলামীন আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য হলো, তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মাহে রমযান পর্যন্ত পৌঁছে দিন এবং রমযানের ভরপুর রহমত ও মাগফিরাত প্রাপ্তির মাধ্যমে মুত্তাকীনদের কাতারে শামিল হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
শাবান মাসে রমযানের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে আমরা কী কী করতে পারি, তা নিয়ে আমরা এ মজলিসে কিছু আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। মোট আটটি শিরোনামের উপর আলোচনা হবে। প্রথম দিকের কথাগুলো মূল আলোচনার ভূমিকা।
শিরোনামগুলো হলো,
১। তাওবার মাধ্যমে রমযানের পূর্বেই আল্লাহর দিকে ফিরে আসুন।
২। এখন থেকেই নামাযকে সুন্দর ও উন্নত করুন।
৩। রমযানের পূর্বেই কুরআন তিলাওয়াতের পরিমাণ বৃদ্ধি করুন।
৪। শাবানে বেশি বেশি সিয়াম পালন করুন।
৫। বেশি বেশি দোয়া করুন এবং তাওফীক কামনা করুন।
৬। ইহতিসাব; আল্লাহর কাছে আজর প্রাপ্তির আশা মনে জাগ্রত করুন।
৭। নিজের সকল মন্দ আচরণ থেকে অপর মুসলিমকে হেফাযতে রাখার সংকল্প করুন।
৮। গোস্বা সংবরণ, অপরকে ক্ষমা করা এবং জাহেলদেরকে এড়িয়ে চলার অনুশীলন শুরু করুন।
মূল আলোচনা শুরু করার আগে ভূমিকা হিসেবে কিছু কথা আরজ করছি।
ভূমিকা
তাকওয়া পরিচয়
তাকওয়া শব্দের মূল অর্থ হলো- করা। হেফাযত করা। বাঁচানো। অর্থাৎ আল্লাহর বিধি-নিষেধগুলো মেনে চলার মাধ্যমে নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করা।
বেশি তাত্ত্বিক আলোচনা যেহেতু আমাদের এ মজলিসগুলোর উদ্দেশ্য নয়, তাই মূল আলোচনায় প্রবেশ করছি।
তাকওয়ার পরিচয় জানার আগে আমরা নিম্নোক্ত হাদীসটি প্রথমে দেখে নিই-
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يَقُولُ جَاءَ ثَلَاثَة رَهْط إِلَى بيُوت أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا أخبروا كَأَنَّهُمْ تقالوها فَقَالُوا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أحدهم أما أَنا فَإِنِّي أُصَلِّي اللَّيْل أبدا وَقَالَ آخر أَنا أَصوم الدَّهْر وَلَا أفطر وَقَالَ آخر أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلَا أَتَزَوَّجُ أَبَدًا فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ: «أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مني». –صحيح البخاري (5063) صحيح مسلم (1401)
অর্থ: একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য তিন ব্যক্তির একটি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের ঘরের নিকট আসলো। যখন তাঁদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদত সম্পর্কে জানানো হলো, যেন তাঁদের কাছে তা কম মনে হলো, আর বললো, “আমরা কোথায় আর নবীজী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কোথায়? তাঁর পূর্বাপর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।” তখন একজন বললো, “আমি সব সময় রাতভর নামায পড়তে থাকবো।” অপর একজন বললো, “আমি যুগ যুগ ধরে রোযা রাখতে থাকবো, রোযা ভাঙ্গবো না।” অপর একজন বললো, “আমি নারীদের থেকে দূরে থাকবো, কখনো বিয়ে করবো না।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের কাছে আসলেন এবং বললেন, “তোমরাই এসব এসব কথা বলেছ? সাবধান! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভয় করি এবং আমি তোমাদের চেয়ে অধিক তাকওয়ার অধিকারী। অথচ আমি রোযা রাখি এবং ভাঙ্গি। (রাতে) নামায পড়ি এবং ঘুমাই এবং বিয়ে করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ থাকবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।” [সহীহ বুখারী: ৫০৬৩; সহীহ মুসলিম: ১৪০১]
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আমি তোমাদের চেয়ে বেশি তাকওয়ার অধিকারী।
সুতরাং হাদীস থেকে বুঝা গেল, অধিক ইবাদতের নাম তাকওয়া নয়, নিজের আবেগ মতো ইবাদত করার নাম তাকওয়া নয়। বরং আল্লাহর মানশা ও সন্তুষ্টি মোতাবেক আমল করার নাম তাকওয়া। আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির সামনে নিজেকে ন্যস্ত করার নাম তাকওয়া। আল্লাহর মানশা ও মর্জির সামনে আত্মসমর্পণ করার নাম তাকওয়া।
বান্দা আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে কতটুকু ন্যস্ত করে, আল্লাহ মূলত এটাই দেখতে চান।
বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য প্রথম থেকেই বাইতুল্লাহ কিবলা ছিল। মাঝে ১৬/১৭ মাসের জন্য বাইতুল মোকাদ্দাসকে কিবলা বানানো হয়। এরপর চিরকালের জন্য বাইতুল্লাহকে কিবলা বানিয়ে দেওয়া হয়। মাঝে ১৬/১৭ মাসের জন্য বাইতুল মোকাদ্দাসকে কিবলা বানানোর পিছনে গূঢ় রহস্য কী? তা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন-
وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنْتَ عَلَيْهَا إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يَنْقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ وَإِنْ كَانَتْ لَكَبِيرَةً إِلَّا عَلَى الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ. –البقرة: 143
অর্থ: “(১৬/১৭ মাসের জন্য) তুমি যে কিবলার উপর ছিলে, তাকে আমি কিবলা বানিয়েছি শুধু এ উদ্দেশ্যে যে, আমি দেখতে চাই, কে রাসূলকে অনুসরণ করে? আর কে তার পিছন দিকে ফিরে যায়। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত কঠিন, তবে তাদের জন্য (কঠিন) নয়, যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন…।” [সূরা বাকারা ০২: ১৪৩]
এই অল্প সময়ের জন্য বাইতুল মোকাদ্দাসকে কিবলা বানানোর পিছনে আল্লাহর ইলমে অনেক অনেক হিকমত থেকে থাকবে। তবে সবচেয়ে মুখ্য হিকমত-রহস্য হলো, আল্লাহ দেখতে চান, কে আবেগের পিছনে ছুটে, আর কে আল্লাহর হুকুমের পিছনে ছুটে? যেহেতু বনি ইসমাঈলের আবাসভূমি ছিল পবিত্র মক্কা, তাই বাইতুল্লাহ তাদের আবেগের জায়গায় বহুকাল থেকেই অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে আছে। তাই ১৬/১৭ মাসের জন্য বাইতুল মোকাদ্দাসকে কিবলা বানিয়ে আল্লাহ দেখতে চাইলেন, তারা আবেগ থেকে সরে এসে আল্লাহর হুকুমকে প্রাধান্য দিতে পারছে কিনা?
অনেক সময়ই আমরা আল্লাহর বিধানের সামনে নিজেদের আবেগ ও যুক্তিকে জায়গা দিয়ে ফেলি। মূলত এসব আবেগ আর যুক্তিকে দূর করাই এই কিবলা পরিবর্তনের বড় ও মূল মাকসাদ।
‘আত্মসমর্পণ’ তাকওয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلا تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُّسْلِمُونَ} -آل عمران: 102
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় কর। এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” -সূরা আলে-ইমরান ০৩: ১০২
আয়াত থেকে বুঝা যায়, যথাযথ তাকওয়া হলো, আল্লাহর বিধানের সামনে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। অর্থাৎ এ কথা দিলে চলে আসা যে, আল্লাহর যেকোনো বিধান আমার সামনে আসবে, আমি তা আদায়ের জন্য শতভাগ প্রস্তুত।
অন্তরের এ হালাত নিয়ে মৃতুবরণ করতে পারলেই বুঝা যাবে বান্দা যথাযথ তাকওয়ার উপর মৃত্যুবরণ করতে পেরেছে। আর এমন বান্দাই কোনটি সঠিক, কোনটি ভুল; তা সহজে নিরূপণ করতে পারে। তাদের সামনেই হেদায়াতের পথ উন্মেচিত হয়।
আত্মসমর্পণের দ্বারাই হেদায়াত লাভ হয়
আবু তালিব খুব ভালোভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইসলাম সত্য ধর্ম। ইসলামের সহযোগিতায় তিন বছর শিআবে আবি তালিবে অবরূদ্ধ জীবন যাপনও করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কার মুশরিকদের বিপরীতে কতভাবে নুসরত করেছেন। এতকিছুর পরও শুধু যে কারণে তিনি হেদায়াত থেকে মাহরূম হলেন তা হলো, আত্মসমর্পণ (ইসলাম)। আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজে আত্মসমর্পণ করেননি। অথচ হেদায়াতের সম্পর্ক আত্মসমর্পণের সাথে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا “যদি তারা আত্মসমর্পণ করে, তবে তারা হেদায়াত পেয়ে গেল…..” [সূরা আলে-ইমরান, ০৩:২০ ]
আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ এমন এক গুণ, মূলত এর দ্বারাই বান্দার দিল-দেমাগ, চোখ-কান খুলে যায়; বান্দা হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়।
যে যতটুকু আত্মসমর্পণ করে, সে ততটুকু হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়। সাহাবায়ে কেরামের দ্বীনের বুঝ এতো গভীর থাকার পিছনে রহস্য মূলত এটাই। এর দ্বারাই মানুষ দ্বীনের পথে দৃঢ়তা অর্জন করে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে এত এত কঠিন পরীক্ষাও কেন টলাতে পারেনি? কারণ তাঁর মাঝে ছিল সর্বোচ্চ মাত্রায় আল্লাহর হুকুমের সামনে আত্মসমর্পণ। শুধু নিজেই আত্মসমর্পণ করেছেন তা নয়, বরং এই উম্মতকে ‘উম্মতে মুসলিমা’ বলেও নামকরণ করে গিয়েছেন। পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে বাইতুল্লাহ নির্মাণ করার পর দোয়া করেছিলেন-
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ
অর্থ: হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে আপনার (বিধানের) প্রতি আত্মসমর্পণকারী বানান। এবং আমাদের বংশধরদের থেকেও আপনার (বিধানের) প্রতি আত্মসমর্পণকারী একটি উম্মত বানান। [সূরা বাকারা:১, ১২৮]
মোটকথা, ইসলাম তথা আত্মসমর্পণের দ্বারাই হেদায়েতের পথ উন্মোচিত হয়। একই ধরণের বিষয় সূরা বাকারার শুরুতেও আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, هُدًى لِلْمُتَّقِيْنَ (কুরআন মুত্তাকীনদের জন্য হেদায়াত।) অর্থাৎ যার ভেতরে তাকওয়া থাকবে, কুরআন তার সামনে পথ খুলে দিবে। তাকওয়া যার মাঝে যে পর্যায়ের থাকবে, তার জন্য কুরআন সে পর্যায়ের হেদায়াত হবে। সুতরাং বুঝা যায়, তাকওয়া ও ইসলাম একই সূত্রে গাঁথা। তাকওয়ার জন্য ইসলাম একটি অপরিহার্য বিষয়।
তাকওয়ার বিষয়টি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে শায়খ আবু ইমরান হাফিযাহুল্লাহর একটি আলোচনা খুবই সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ। শায়খ তাকওয়ার তিনটি স্তর বলেছেন। তাকওয়ার উপর আরব মাশায়েখদের অনেক আর্টিকেল পড়েছি, কিন্তু এত সুন্দর করে গোছানো আলোচনা আর কোথাও পাইনি। আল্লাহ শায়খকে উত্তম জাযা ও দীর্ঘ নেক হায়াত দান করেন।
তাকওয়ার বিভিন্ন স্তর
তাকওয়া শব্দের মূল অর্থ হলো- বাঁচানো, করা, হেফাযত করা। এ অর্থটি মাথায় থাকলে স্তরগুলোতে তাকওয়ার অর্থ কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে তা স্পষ্ট হবে।
প্রথম স্তর: ঈমান আনার মাধ্যমে তাকওয়া। কেউ যখন ঈমান আনে, এর বদৌলতে সে তাকওয়ার ন্যূনতম পর্যায়টি অর্জন করে। এর মাধ্যমে বান্দা নিজেকে চির জাহান্নামি হওয়া থেকে বাঁচায়। এর নিচে তাকওয়ার কোনো স্তর নেই।
দ্বিতীয় স্তর: এর চেয়ে উপরের স্তর হলো, বান্দা তার উপর অর্পিত যত ফরয আছে সব আদায় করে এবং সকল হারাম থেকে বিরত থাকে। কারো মাঝে যদি এ পর্যায়ের তাকওয়া অর্জন হয়ে যায়, তাহলে আশা করা যায় যে, সে জাহান্নামের আযাব থেকে বেঁচে যাবে। তাকে এক মুহূর্তের জন্যও জাহান্নামে যেতে হবে না ইনশাআল্লাহ।
তৃতীয় স্তর: এর চেয়েও উপরের স্তর হলো, (ঈমান আনা, ফরয ইবাদত পালন ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি) এমন মুবাহ কাজ থেকেও বিরত থাকা, যেগুলো আখিরাতের যাত্রাপথে তার জন্য নিষ্প্রয়োজন।
এ স্তরটি অনেক বিস্তৃত। এ স্তরে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমল অনুযায়ী জান্নাতে নিজের পর্যায় উন্নীত করে। وَلِكُلٍّ دَرَجَاتٌ مِمَّا عَمِلُوْا (প্রত্যেকের জন্য রয়েছে যার যার আমল অনুযায়ী বহু বহু স্তর।) এ স্তরে ব্যক্তি তার তাকওয়া ও আনুগত্যের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে শুধু নিজেকে বাঁচায়ই না, বরং জান্নাতে তার মর্যাদা অনেক অনেক উঁচু করতে সমর্থ হয়।
এ স্তরটি এমন একটি স্তর, যেখানে বান্দা নিজেকে অত্যন্ত কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এবং আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে দৃঢ়তার সাথে ধরে রাখতে পারে। এমন ব্যক্তিরা আল্লাহর আনুগত্যের বড় বড় নিদর্শন স্থাপন করতে পারে।
এমন ব্যক্তি আখিরাতের যাত্রা পথে নিষ্প্রয়োজন মুবাহ বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে। ফারায়েয ও ওয়াজিবাত আদায়ের পাশাপাশি আখিরাতের যাত্রা পথে সহায়ক নফল ইবাদতে প্রচুর পরিমাণে নিজেকে আটকে রাখতে সমর্থ হয়।
এমন ব্যক্তিকে আপনি দেখবেন, কুরআনের সাথে তার সম্পর্ক গভীর। গভীর রাতে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর তাওফীক পাচ্ছে। খুঁজে খুঁজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহগুলো পালন করছে। গুনাহ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করছে।
এমন ব্যক্তিকে দেখবেন, নামাযে দাঁড়িয়েছে তো কোনো নড়াচড়া নেই। একেবারে স্থির হয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মশা-মাছি তাড়ানো, ধুলাবালি সরানো, কাপড়ের ভাঁজ সোজা করা এগুলোর দিকে তার বিন্দুমাত্র নজর নেই। সে আল্লাহর সামনে ছোটখাট বিষয়গুলোকে খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারে।
আল্লাহর সামনে তার আনুগত্য অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন হবে।
রমযান ও তাকওয়া
মূলত এই তৃতীয় স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমযানের দৌলত নসীব করেছেন।
একটু লক্ষ করুন:
রমযানে রোযার মধ্যে আমাদের প্রশিক্ষণটা কী ধরনের হয়?
এ মাসে মুবাহ-বৈধ বিষয়গুলো পরিত্যাগ করার মাধ্যমে আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। রোযার মধ্যে তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। আহার করা, পান করা, স্ত্রী সহবাস করা। এগুলোর যেকোনো একটি করলে রোযা ভেঙ্গে যায়। অথচ দেখুন, এগুলো স্বাভাবিক সময়ে মুবাহ-বৈধ ছিল। কিন্তু রমযানে ৩০টি রোযার মাধ্যমে আমাদেরকে আল্লাহর হুকুমের সামনে এমনভাবে আনুগত্য দেখাতে হয় যে, এই বৈধ জিনিসগুলো থেকে বিরত থাকতে হয়। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বান্দা নিজের উপর সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে। ফলে তার জন্য আল্লাহর চূড়ান্ত আনুগত্য প্রদর্শন করা সহজ হয়ে যায়।
এ মাসে স্বাভাবিক মুবাহ কাজগুলো থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে যোগ্যতার এমন স্তরে নিয়ে যেতে চান, যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো স্থানে আমরা নির্দ্বিধায় আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করতে পারি।
বিষয়টি এমন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ পেলে একটি স্বাভাবিক বৈধ জিনিসও ছেড়ে দিতে পারে, তার জন্য আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সামনে অন্যায়-অপরাধ ছেড়ে দেওয়া বা কোনো বিধানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া তো মামুলি বিষয়। রমযানের মাধ্যমে আল্লাহ মূলত তাঁর বান্দাকে এমন বানাতে চান।
লক্ষ করুন, এখন কেউ যদি রমযানে তাকওয়ার তৃতীয় স্তরের প্রশিক্ষণ নিতে এসে তাকওয়ার দ্বিতীয় স্তরকেই ভাঙ্গতে থাকে, যেমন- মিথ্যা বলতে থাকে, গীবত করতে থাকে, ঝগড়া করতে থাকে, নামায ছাড়তে থাকে, হারামে লিপ্ত হতে থাকে এবং ফরয-ওয়াজিব ছাড়তে থাকে; তাহলে এমন ব্যক্তি তাকওয়ার তৃতীয় স্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে কী করবে?
এ কারণেই হাদীস শরীফে এসেছে-
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ». -صحيح البخاري: 1903
“যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং এর উপর আমল ছাড়তে পারলো না, এমন ব্যক্তির পানাহার পরিত্যাগ করার প্রতি আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই।” -সহীহ বুখারী: ১৯০৩
অপর এক হাদীসে এসেছে-
«رُبَّ قَائِمٍ حَظّهُ مِنْ قِيَامِهِ السَّهَرُ، وَرُبَّ صَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ صِيَامِهِ الجُوعُ وَالعَطَشُ» -رواه ابن ماجه: 1690 وابن خزيمة: 1997 وقال البوصيري في مصباح الزجاجة (2/ 69) : هذا إسناد صحيح رجاله ثقات.
অনেক তাহাজ্জুদ গুজার এমন রয়েছে, যার ভাগে রাত্রি জাগরণ ছাড়া কিছুই নেই। আবার অনেক রোযাদার এমন রয়েছে, যার ভাগে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া কিছুই নেই।” -সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৬৯০; সহীহ ইবনে খুযাইমা: ১৯৯৭
আশা করি সকলের কাছেই উপরের আলোচনাটুকু বোধগম্য হয়েছে।
জিহাদঃ আত্মসমর্পণের সর্বোচ্চ চূড়ার নাম
এবার আমরা এমন একটি হাদীস নিয়ে আলোচনা করবো, যা প্রতিটি মুজাহিদের জন্য উত্তমভাবে উপলব্ধি করা জরুরি-
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ” ذرْوَةُ سَنَامِ الْإِسْلَامِ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ “- مسند أحمد: 22051 وروى الترمذي نحوه: 2616 وقال: هذا حديث حسن صحيح
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া হলো, জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ।” -[মুসনাদে আহমদ: ২২০৫১; জামে তিরমিযী: ২৬১৬]
এ হাদীসের মর্ম জিহাদপ্রেমী প্রতিটি ভাই বুঝা উচিত। হাদীসটি বুঝলে আমরা উপলব্ধি করতে পারবো, আমরা কোন পথে পা দিয়ে কী কী স্বপ্ন দেখছি; অথচ আমাদের হালাতের সাথে আমাদের স্বপ্নের পার্থক্য কত বেশি!
‘ইসলাম’ শব্দের মূল অর্থ আমরা আগেই বুঝেছি- “আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করা।”
সুতরাং মূল অর্থের দিকে তাকিয়ে হাদীসের অর্থ করলে অর্থ হয়- ” ذرْوَةُ سَنَامِ الْإِسْلَامِ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ ”
“আত্মসমর্পণের সর্বোচ্চ চূড়া হলো, জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক-
মানুষের কাছে তার জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। তাই এই মূল্যবান জিনিসটি কেউ আল্লাহর আনুগত্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় উন্নীত না হলে উৎসর্গ করতে পারে না। সত্যি বলতে শাহাদাত মামুলি কোনো বিষয় নয়।
সুতরাং জিহাদকে আত্মসমর্পণের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখার অর্থ হলো, কেউ যখন আল্লাহর সকল বিধানকে পালন করতে করতে উপরের দিকে চড়তে থাকে, তখনই সে প্রকৃত অর্থে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর মতো আমল করতে পারে।
সুতরাং আমরা যারা আত্মপ্রবঞ্চনায় পড়ে আছি যে, অন্যান্য বিধান যেমনই পালন করি, আমি জিহাদের মাধ্যমে সব ঘাটতি পূরণ করে ফেলবো, তাদের এ ধারণা ভুল।
বাস্তবেও দেখা যাবে, যারা জিহাদের আমল করেছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ আমলে অবিচল থেকেছেন, তাদেরকে আল্লাহর অন্যান্য বিধানের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পন করে এই পর্যায়ে পৌঁছতে হয়েছে। অন্যথায় নিজের অন্যান্য আমল দুরস্ত করা না হলে, খুব সম্ভাবনা আছে পিছলে যাওয়ার।
যখন কেউ কোনো পাহাড়ে চড়ে, সে যখন একদম চূড়ায় পৌঁছতে চেষ্টা করে, তাকে ধীরে ধীরে পাহাড়ের নিচ থেকে একটু একটু করে উপরের দিকে উঠতে হয়। কেউ যদি চিন্তা করে, আমি লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ে চড়ে যাবো, তাহলে দেখা যাবে সে উপরে পৌঁছার আগেই পিছলে যাবে।
তাই আমাদেরকে ইসলামের চূড়া তথা জিহাদের আমলে পৌঁছতে হলে, ইসলামের প্রতিটি স্তর বা আনুগত্যের প্রতিটি স্তর ধীরে ধীরে অতিক্রম করতে হবে। কিছু বাদ দিয়ে দিয়ে আমরা চূড়ায় পৌঁছতে পারবো না, বরং পা ফসকে একদম নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আল্লাহ হেফাযত করুন।
কুরআনের এ আয়াতটি দেখুন-
إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنْكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا … –آل عمران: 155
অর্থ: “নিশ্চয় যারা উভয় বাহিনীর পারস্পরিক সংঘর্ষের দিন পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল, প্রকৃতপক্ষে শয়তান তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের কারণে পদস্খলন ঘটিয়েছিল….।” [সূরা আলে-ইমরান ০৩: ১৫৫]
ওহুদের যুদ্ধে যেসব সাহাবীর প্রথম পর্যায়ে পা পিছলে গিয়েছিল, তাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, এই পদস্খলনের কারণ মূলত ইতিপূর্বে তাদের অসমীচীন কৃতকর্ম ছিল।
সুতরাং বুঝা গেল, জিহাদ সহজ কোনো আমল নয়। বরং এমন একটি আমল যেখানে আল্লাহর বিধানের সামনে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আত্মসমর্পণ প্রদর্শন করতে হয়। নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে হয়। তাই এই স্তরে উঠা সহজ কাজ নয়। বরং যারা পুরো পাহাড় ধীরে ধীরে অতিক্রম করেছে, তাদের জন্যই পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করা সহজ।
আল্লাহর প্রতিটি বিধানের সামনে সঠিকভাবে আত্মসমর্পণ না করে চূড়ায় আরোহণ করতে চাওয়া মানে মাঝে ফাঁকা রেখে রেখে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণের চেষ্টা করা। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পদস্খলন হবেই। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
একটু লক্ষ করুন, ইসলামের দুটি বিজয় ছিল সবচেয়ে বড় বিজয়; হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী বিজয়। বদর ও ফাতহে মক্কা।
মূলত সাহাবায়ে কেরামের জামাতকে নিয়ে এ দুটি যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন আল্লাহর সামনে নিজেদের সবচেয়ে বড় আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। রমযান মূলত আল্লাহ এ উদ্দেশ্যেই দিয়েছিলেন। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ইসলামের শ্রেষ্ঠ দুটি যুদ্ধে আল্লাহর সামনে শ্রেষ্ঠ আনুগত্য পেশ করলেন। রমযান যেমনিভাবে কুরআনের মাস, একইভাবে জিহাদেরও মাস।
এই আনুগত্য কী পর্যায়ের কাম্য তা অনুধাবন করতে এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ عَامَ الْفَتْحِ إِلَى مَكَّةَ فِي رَمَضَانَ فَصَامَ حَتَّى بَلَغَ كُرَاعَ الْغَمِيمِ – وهو موضع بين مكة والمدينة- فَقِيلَ لَهُ : إِنَّ النَّاسَ قَدْ شَقَّ عَلَيْهِمْ الصِّيَامُ ، وَإِنَّمَا يَنْظُرُونَ فِيمَا فَعَلْتَ . فَدَعَا بِقَدَحٍ مِنْ مَاءٍ بَعْدَ الْعَصْرِ ، فَرَفَعَهُ حَتَّى نَظَرَ النَّاسُ إِلَيْهِ ، ثُمَّ شَرِبَ . فَقِيلَ لَهُ بَعْدَ ذَلِكَ : إِنَّ بَعْضَ النَّاسِ قَدْ صَامَ . فَقَالَ : أُولَئِكَ الْعُصَاةُ ، أُولَئِكَ الْعُصَاةُ- رواه مسلم (1114)
অর্থ: হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়কালে রমযান মাসে রোযা রাখা অবস্থায় মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। যখন মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি ‘কুরাউল গামীম’ নামক স্থানে আসলেন, রাসূলকে বলা হলো, লোকদের জন্য রোযা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সবাই আপনি কী করেন সে অপেক্ষায় আছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের পর একটি পানি ভর্তি পাত্র আনতে বললেন। অতঃপর পাত্রটি উঁচু করে ধরে পানি পান করলেন, যাতে সবাই দেখে। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হলো, কেউ কেউ (কষ্ট করেই) রোযা রেখেছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তারাই হলো অবাধ্য। তারাই হলো অবাধ্য।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১১৪]
সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহ। আনুগত্য কীসের নাম!
আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ কীসের নাম, তা এ হাদীসে অত্যন্ত গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের বিপরীত হওয়ায় স্বয়ং রমযান মাসে রোযা রেখেও অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে।
এখানে মূল বিষয় এটাই, আবেগের নাম ইসলাম নয়। বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পূর্ণ আনুগত্যের নামই হলো ইসলাম। তাঁদের হুকুমের সামনে আত্মসমর্পণের নামই হলো ইসলাম।
হাদীস থেকে বুঝা যায়, জিহাদ আবেগ দিয়ে হয় না, বরং আনুগত্য দিয়ে হয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে বুঝার তাওফীক দান করুন।
আত্মসমর্পণের এক অনুপম দৃষ্টান্ত
মক্কা বিজয়ের পর পর হুনাইনের যুদ্ধ এবং তায়েফের যুদ্ধ হয়। তায়েফের যুদ্ধে শত্রুপক্ষ নিজেদের দুর্গে আশ্রয় নেয় এবং মূল ফটক বন্ধ করে আত্মর ব্যবস্থা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিলেন, দুর্গের ভেতর থেকে যে কোনো গোলাম বের হয়ে ইসলাম কবুল করবে, তাকে আযাদ করে দেয়া হবে। তখন ২৩ জন গোলাম বের হয়ে আসে এবং ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে একজনের ঘটনা হাদীসের কিতাবগুলোতে এসেছে-
عَنِ الْبَرَاءِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُقَاتِلُ الْعَدُوَّ فَجَاءَ رَجُلٌ مُقَنَّعٌ فِي الْحَدِيدِ، فَعَرَضَ عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْإِسْلَامَ فَأَسْلَمَ فَقَالَ: أَيُّ عَمَلٍ أَفْضَلُ كَيْ أَعْمَلَهُ؟ فَقَالَ: «تُقَاتِلُ قَوْمًا جِئْتَ مِنْ عِنْدِهِمْ» فَقَاتَلَهُمْ حَتَّى قُتِلَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «عَمِلَ قَلِيلًا وَجُزِيَ كَثِيرًا» (مسند أبي داود الطيالسي)
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুদের সাথে লড়াই করছিলেন। তখন লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিহিত এক ব্যক্তি আসলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে ইসলাম পেশ করলেন। সে ইসলাম গ্রহণ করলো এবং বললো, (এখন) সর্বোত্তম আমল কোনটি; যাতে আমি করতে পারি…? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যাদের থেকে এসেছ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর। তখন সে জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে অল্প আমল করলো; কিন্তু বিরাট প্রতিদান পেল।” [মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালিসী, হাদীস নং ৭৬০] হাদীসটি সহীহ বুখারীতেও এসেছে।
এখানে লক্ষণীয় যে, ওই ব্যক্তি যিনি জিহাদে শরীক হয়ে শাহাদাত বরণ করলেন, বাহ্যত তার আমলনামায় কোনো নামায নেই, রোযা নেই। কিন্তু যেটি আছে তা হলো, আল্লাহর যখন যে হুকুম, সে হুকুমের সামনে আত্মসমর্পণ করা। এর নামই ইসলাম।
শেষ কথা
আমরা যারা আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সাথে ধরে রাখতে চাই, যারা আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থেকে আল্লাহর সামনে নিজের জীবনের নজরানা পেশ করতে চাই, তাদের জন্য রমযানে তাকওয়ার অনুশীলন অনেক বড় নেয়ামত। মূলত রমযানই নিজেকে গঠন করার এবং নিয়ন্ত্রিত করার সবচেয়ে উত্তম সুযোগ।
এ সুযোগটি আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি এবং এর জন্য অগ্রিম কী কী প্রস্তুতি নিতে পারি, তা নিয়েই এ মজলিসগুলোতে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
***
আরো পড়ুন: